শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২২৮। পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী | ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বিবৃতি
প্রসঙ্গঃ পাকিস্তানে জরুরী অবস্থার ঘোষণা এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি
প্রধানমন্ত্রী, পারমাণবিক শক্তি মন্ত্রী, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) : পাকিস্তান জুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করে গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা সম্পর্কে লোকসভা অবহিত আছে। এই ঘোষণা বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের মনযোগ সরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং যে পরিস্থিতি সে নিজেই তৈরি করেছে তার দোষ আমাদের উপর চাপানোর জন্য তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। একটি সামরিক সরকার, যে সরকার বাংলাদেশের জনগণের উপর গত আট মাস ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং গত তিন চার মাস যাবৎ সামগ্রিক যুদ্ধের জন্য আমাদেরকে হুমকি প্রদর্শন করে আসছে, সম্পূর্ণরূপে তার নিজের জনগণ এবং বিশ্বকে প্রতারিত করা ছাড়া সেই সরকারের এমন ঘোষণার কোন অর্থ নেই।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের স্বতন্ত্র বক্তব্য এই প্রভাব তৈরি করেছিলো যে সে অন্ততপক্ষে সামরিক অভ্যাগমন পরিত্যাগ করতে ও একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে কিছু বিশ্বনেতাদের উপদেশ চিন্তাভাবনা করছেন। আমরা মনে করি যে জরুরী অবস্থার ঘোষণা একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজবার চাপ থেকে বের হওয়ার একটি উপায়।
বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর সফলতা স্পষ্টতই সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনাকে বিপর্যস্ত করেছে। তাদের সকল জনগণের পূর্ণ সমর্থনের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী বাহিনী পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি করেছে এবং তাদের স্বদেশের বৃহৎ অংশ মুক্ত করেছে।
আমাদের নিজস্ব বিশাল ব্যয়ে আমরা প্রায় এক কোটির মত ভীত-সন্ত্রস্ত নারী, পুরুষ, শিশুর অসহনীয় বোঝা দেখাশোনা করা কাঁধে নিয়ে আসছি, যারা কিনা পাকিস্তানি নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে। নিরাপত্তা এবং মানবিক মর্যাদার প্রত্যয়যোগ্য নিশ্চয়তা নিয়ে শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরতে চায়। আমরা এটা নিশ্চিত করতে দৃঢ় যে তারা যত শীঘ্রই সম্ভব দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হবে।
পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী আমাদের সীমান্ত এলাকাগুলোতে জান-মালের উপর হানা দিয়ে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। তাদের বিমান বাহিনী শুধুমাত্র কয়েকবার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি, একবার শ্রীনগর পর্যন্ত চলে এসেছিলো। গুপ্তচর ও অন্তর্ঘাতকরা রেল ও সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ৮৯০ টি ছোটখাটো ঘটনা রোধসহ সীমান্ত আইন অমান্য করার কারণে আমরা ৬৬ টি প্রতিরক্ষা পয়েন্ট স্থাপন করেছি। আকাশ আইন লঙ্ঘনের জন্য ৫০ টি ঘটনা রোধসহ আমরা ১৭ টি প্রতিরোধ গড়েছি। কিন্তু এইসব প্রতিরোধ কোন কাজেই আসেনি এবং তাদের এই অবিরাম উৎক্রমণ ঢাকতে পাকিস্তানি অপপ্রচার মাধ্যম এই গল্প প্রচার করে যাচ্ছে যে আমরা একটি অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত এবং ট্যাংক ও সৈন্যবাহিনীসহ বিশাল এক আক্রমণ নিয়ে সওয়ার হয়েছি। এটি পুরোপুরি মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে, এটা হল পাকিস্তান, যে সামগ্রিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিলো এবং তার সকল সশস্ত্র শক্তি আমাদের সীমান্তে যুদ্ধ অবস্থানে পাঠিয়েছিলো এবং “ভারত জয় করো” শ্লোগানসহ একটি বড় ভারত-বিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়েছিলো। এইজন্য আমাদের দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ও আমাদের দেশের নাগরিকদের জান-মাল রক্ষা করতে আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হয়েছিলো এবং আমাদের বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে পাঠাতে হয়েছিলো। পরিস্থিতি ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করার বা একটা সংঘাত শুরু করার অভিপ্রায় আমাদের কখনোই ছিলো না। এরপরে, আমরা আমাদের বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছি যেন আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম না করে। আমরা ১৯৪৭-৪৮ সালের, ১৯৬৫র জানুয়ারির এবং আগস্ট- সেপ্টেম্বরের অভিজ্ঞতার কথা অবজ্ঞা করতে পারিনা।
নভেম্বর ২১ তারিখে, মুক্তিবাহিনীর উপর, যারা কিনা বয়রার আশেপাশে স্বাধীন এলাকা দখল করেছিলো, তাদের উপর পাকিস্তানী পদাতিক সৈন্যবাহিনী যুদ্ধজাহাজ ও গোলাবারুদসহ আক্রমণাত্মকভাবে চড়াও হয়েছিলো। আমাদের পূর্ব সীমান্ত থেকে পাঁচ মাইল দূরে, পাকিস্তানী সাঁজোয়া ভারী গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানকে হুমকি দিয়ে আমাদের সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়েছিলো। আমাদের রাজ্যে তাদের গোলাবর্ষণ হয় যা আমাদের কিছু সংখ্যক মানুষকে আহত করে। স্থানীয় ভারতীয় সামরিক কমান্ডার পাকিস্তানী আক্রমণকে দমন করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছিলো। এই যুদ্ধে ১৩ টি পাকিস্তানী চ্যাফি যুদ্ধজাহাজ নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিলো।
নভেম্বরের ২২ তারিখে পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের অবস্থানের উপর চারটি স্যাবর জেট নিয়ে আকাশপথে হামলা করেছিল। ভারতীয় রাজ্যের ভেতরে এগুলো আমাদের ন্যাটস দ্বারা প্রতিহত করা হয়েছিলো যারা তিনটি স্যাবর জেটকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। পাকিস্তানী বিমানচালক যারা তাড়া করেছিলো, তাদের মধ্যে দুই জন আমাদের রাজ্যে ধৃত হয়েছিলো। আমরা এটিকে পুরোপুরি একটি স্থানীয় প্রক্রিয়া মনে করি।
যদিও পাকিস্তান একটি জরুরী অবস্থার ঘোষণা দিয়েছে, আমরাও একই ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকবো যদি না পাকিস্তানের আর কোন আক্রমণাত্মক কাজ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই ধরণের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। একইসাথে আমাদের দেশের উচিৎ হবে অবিচল থাকা। আমাদের সাহসী সশস্ত্র সামরিক বাহিনী এবং আমাদের জনগণ নিশ্চিত করবে যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কোন রাজনৈতিক হঠকারিতা উপযুক্ত জবাব পাচ্ছে। পাকিস্তানের শাসকদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতাই শান্তির পথ – যুদ্ধ, স্বাধীনতা হরণ এবং গণতন্ত্রের দমন শান্তির পথ নয়।