You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৬। পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশ সফর শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

বিবৃতিঃ প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর

প্রধানমন্ত্রী, পারমাণবিক শক্তি মন্ত্রী, বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) : আমি সবেমাত্র বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা যুক্ররাষ্ট্র, ফ্রান্স, এবং গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মান সফর থেকে এসেছি।

বারবার পাঠানো আমন্ত্রণের সাড়ায় এই দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেওয়া হয়েছিলো এবং তা নেওয়া হয়েছিলো পারস্পারিকতার চর্চার সাথে সংগতি রেখে। সভার সকলের মনে থাকবে যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, প্রধানমন্ত্রী হীথ ১৯৭০ সালে আমাদের দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। চ্যান্সেলর কেসিঞ্জার ১৯৬৯ সালে এবং প্রেসিডেন্ট পম্পিডো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন আমাদের দেশ সফর করেছিলেন। কিন্তু আমাদের সাধারণ নির্বাচনের কারণে আমার সফর স্থগিত ছিলো।

বাংলাদেশে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে আমাদের সীমান্তে মারাত্মক পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমি এই সফরে উদ্যোগী হয়েছিলাম, যাতে আমাদের উপর আরোপকৃত বোঝার সহজীকরণের করা যায় এবং যারা আমাদের নিরাপত্তাকে হুমকি দিচ্ছে তাদের অনুৎসাহিত করার ব্যাপারে সর্বাত্তক প্রচেষ্টা হিসেবে। এমন জাতীয় বিপর্যয়ের সময় আমাদের জনগণের আশ্বাস এবং আমাদের সকল দলের একতা সফরটিকে গুরুত্ববহ করেছে।

আমার সফর সরকার প্রধানদের সাথে ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আমার চিন্তা-ভাবনা বিনিময় করতে সক্ষম করেছিলো – এমন একটি সময়ে যখন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছিলো এবং বিশ্বস্বার্থ, দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক, এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও এটি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে ও এই প্রদেশের শান্তিতে যে হুমকি সৃষ্টি করেছিল – এই সফর এইসব ব্যাপারে তাদের কাছে আমাদের দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতে সক্ষম করেছিলো।

আমাদের আলোচনা কিছু আশঙ্কা দূর করতে ও সমস্যাটির মূল কারণে মনযোগ দিতে করতে সাহায্য করে, সেটি হলো পাকিস্তান সামরিক সরকার তাদের নিজেদের জনগণের রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে, বাংলাদেশে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে এবং ভারতে শরণার্থীদের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি মনে করি যে এই দেশ ও অন্যান্য দেশগুলো উপলব্ধি করতে পারবে যে ইতোমধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত নেতার সাথে এবং তাদের আইনসঙ্গত ইচ্ছানুযায়ী সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির একটি রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধান ছাড়া সীমান্তবর্তী সমস্যাসমূহের দূরীকরণ ফলপ্রসূ হবেনা। অধিকাংশ দেশ আরো মনে করে যে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অপরিহার্য এবং পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে এটি বুঝাতে তারা মনস্থ করে।

দীর্ঘদিন এটিকে পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মর্মান্তিক উদাসীনতা দেখানো হয়েছে – যা এখন একটি সমাধান খোঁজার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

মূল ঘটনাটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ও মেঘাচ্ছন্ন করার জন্য জাতিসংঘকে জড়িত করতে সচেষ্ট হওয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে পাকিস্তান বিরোধিতা এবং দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করতে পাকিস্তানের প্রচেষ্টা প্রকাশ হয়ে গেছে। এটি এখন খুব ভালো বুঝা হয়েছে যে ভারত পাকিস্তানের পদক্ষেপে পথভ্রষ্ট হবেনা এবং যে জনগণের সাথে এমন অবিচার ও হিংস্রতার সাথে আচরণ করেছে তাদের সাথে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অবশ্যই বোঝাপড়ায় আসতে হবে। এটিও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে যে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর একটি সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার কোন অধিকার কোন দেশেরই নেই এবং স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদের যে স্পৃহার দ্বারা তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে তা কোন শক্তিই দমিয়ে রাখতে পারবেনা।

আমার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় আমি জানতে পেরেছিলাম যে পাকিস্তানে আরও অস্ত্রবাহী জাহাজ পাঠানো বন্ধের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানি থেকে আর কোন অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছেনা।

এটি আমার ব্যগ্র আশা যে যেসব রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেছি তাদের সম্মিলিত বা পৃথক উদ্যোগ পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে বুঝতে সাহায্য করবে যে ভারতে সামরিক শক্তি প্রদর্শন কিংবা একটি সামরিক সংঘাত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কোন লাভ হবেনা। আমি মনে করি যে উপদেষ্টারা এটা বুঝানোর জন্য খুব দেরি করে ফেলেননি যে কেউ কঠিন সত্য অবজ্ঞা করে চলতে পারেনা। বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য ও আইনসঙ্গত আকাঙ্ক্ষাকে অবজ্ঞা বা পদদলিত করা যাবেনা।

আমরা যেভাবে নব্বই লক্ষেরও বেশি শরণার্থীদের দেখাশোনা করার গুরুভার বহন করছি, তার জন্য সহানুভূতি ছিলো। শরণার্থীদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য তহবিলে সংযোজনের ব্যাপারে ইঙ্গিত এসেছে। এসকল দেশ সম্মত হয়েছে যে শরণার্থীদের আরো আগমন থামাতে এবং যারা ভারতে অবস্থান করছে নিরাপত্তা ও মানবীয় মর্যাদার সাথে তাদের স্বদেশে ফেরা সহজতর করতে পূর্ব বাঙলায় অবশ্যই যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

এটা বলার পরে আমি অবশ্যই এটা পরিষ্কার করতে চাই যে আমরা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করতে পারিনা, এমনকি সেসব দেশের উপরও নয় যেসব দেশ আমি সফর করেছি। আমরা তাদের সমবেদনা, তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনকে মূল্যায়ন করি, কিন্তু এই বোঝা আমাদের এবং বাংলাদেশের জনগণ যাদের সাথে আমাদের পূর্ণ সমবেদনা ও সমর্থন আছে, তাদেরকেই বহন করতে হবে।

যেহেতু আমাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন, তাই আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং আমাদের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষা করতে শেষ নারী-পুরুষটিও প্রস্তুত আছে। বলাবাহুল্য, যদি বাংলাদেশে সন্তোষজনকভাবে পরিস্থিতির সমাধান না হয়, আমরা সীমান্ত থেকে আমাদের বাহিনী সরিয়ে নেওয়ার মতো ঝুঁকি নিতে পারিনা। কারণ এটি আমাদের নিরাপত্তার উপর মারত্মক হুমকি আরোপ করে।

বিজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের প্রাজ্ঞ তাড়নার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে সমাধানের অতীত সমস্যারও সমাধান পাওয়া গিয়েছে বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেমন: ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নার মধ্যকার সমস্যার ক্ষেত্রে। কিন্তু এসব অগ্রগতিতে আমাদের প্রসন্ন হলে চলবে না।

ইউরোপে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসানের একটি উদ্দীপনা আছে। যেটি, আমরা আশা করি যে, শীঘ্রই ঐ মহাদেশে স্থিতিশীল নিরাপত্তার দিকে পরিচালনা করবে। এটি এশিয়াতে ও পৃথিবীর অন্যান্য অংশে একটি স্থিরকারী প্রভাব রাখবে। সেখানে একটা উপলব্ধি ছিলো যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতার অবসানের ব্যাপারটির সাথে বাহ্যিক দৃষ্টিগত অর্থনৈতিক নীতির সাথে সংযুক্ত করা উচিৎ, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বের চাহিদার ব্যাপারে।

দেশগুলোর সাথে দ্বি-পাক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেখানে ভালো সাড়া মিলেছে। বেলজিয়াম, ফ্রান্স এবং গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানি উপলব্ধি করেছে যে ভারত এবং ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি সুবিশাল প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে।

সংক্ষেপে, এগুলোই হচ্ছে আমার মনের কথা যা আমি সম্মানিত সদস্যদের জানাতে চেয়েছিলাম। আমি নির্দিষ্ট করে কোন নির্দিষ্ট দেশের নেতাদের নাম উল্লেখ করছি না কারণ তারা সকলেই ভারতের প্রতি সমবেদী ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো।

আমি মনে করি আমার এই সফর ব্রিটেনের সাথে আমাদের সম্পর্ক পুনরধিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে যা ১৯৬৫ সালে একটি খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিলো।

যেসব দেশ আমি সফর করেছি তাদের সরকার ও জনগণ যে উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ অভ্যর্থনার সাথে আমাকে সর্বত্র গ্রহণ করেছে তার জন্য আমি ভারত সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি সবশেষে আরো তারিফ করতে চাই বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমকে যারা বাংলাদেশে ঘটনাসমূহের নিরপেক্ষ প্রচার, জনগণের উপর অবাধ অবর্ণনীয় নির্যাতন, তাদের বীরোচিত সংগ্রামের কথা জানানোর জন্য – যা সেখানকার মানুষ তাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি আমার জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দল যারা কোন বহিরাগত হুমকির বিরুদ্ধে প্রজ্ঞা ও সংযম দেখিয়েছে এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।

মাননীয় ডেপুটি স্পীকার, আমি আমার এই বিবৃতি একটি অনুস্মারকের সাথে শেষ করছি যে জাতিগত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ শান্তি, স্বাধীনতা ও সুবিচারের প্রেরণা প্রতীকায়িত করে। এমন একটা সময় ছিলো যখন স্নায়ুবিক যুদ্ধের খপ্পরে থাকা বিশ্বে আমাদের আওয়াজ ছিলো একাকী। এমনকি পাকিস্তানি সামরিক সরকারের আমাদের জন্য তৈরি করা মারাত্মক সমস্যার মাঝেও আমাদের জনগণ, আমাদের দেশ, এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই মহান দেশ শান্তি এবং আত্মসংযমের স্পৃহা বজায় রেখেছে। আমরা আমাদের সীমান্তের ওপার থেকে আসা হুমকি ও প্ররোচনার দ্বারা সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনা প্রত্যাখ্যান করেছি। তাহলে চলুন আমরা আমাদের মধ্যে পুরো আস্থা নিয়ে নিজেদের পরিচালিত করি যেন বিশ্ব দেখতে ও জানতে পারে যে ভারতের একসাথে থাকার শক্তিমত্তা আছে। ভারত শান্ত এবং আমরা আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম।

শ্রী সমর মুখার্জী (হাওড়া) : মহোদয়, এই ব্যাপারে আমরা একটি আলোচনা চাই।

ডেপুটি স্পীকার মহোদয় : তিনি এইজন্য একটি মোশন নোটিশ দিতে পারেন।

শ্রী এস. এম. ব্যানার্জী : এটাকে সার্কুলেট করতে হবে।

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: সকালে দলের নেতাদের সাথে আমার একটি সাক্ষাৎকার ছিলো। তারা এতে সম্মত হয়েছিলো যে আমরা আলোচনা করবো। এর তারিখ আপনি এবং ব্যবসায়ী উপদেষ্টা কমিটি নির্ধারন করবেন।

ডেপুটি স্পীকার মহোদয়: এটি শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!