You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.15 | ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিবৃতি এবং আলোচনা | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৫। ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিবৃতি এবং আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

[মাননীয় ডেপুটি স্পীকার সভা পরিচালনা করছেন]

জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কিত সংবাদ

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): আমি অত্যন্ত জরুরী এবং জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এবং তাঁকে এই ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেয়ার অনুরোধ করতে চাই।

” ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ, পাকিস্তানের বোমাবর্ষণের ফলে ভারতীয় জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি এবং পাকিস্তানী যুদ্ধবিমান কর্তৃক বারবার ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ”

মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ( শ্রী জগজীবন রাম): মাননীয় স্পীকার, মহোদয়, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারন হচ্ছে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরোধ।

২৫/২৬ মার্চের কালরাত্রে বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্মম হামলা সম্পর্কে সকল সাংসদ অবহিত আছেন। এই ঘটনার আগে পাকিস্তানে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবার সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা সমর্থন করে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা নির্বাচনের এই ফলাফল মেনে না নিয়ে ২৫/২৬ মার্চের কালরাত্রে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানী সেনাবাহীনীর অভূতপূর্ব নৃশংসতার শিকার হয়েছে; লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে; গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে; নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং শিশুরা বিকলাঙ্গ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমনের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে এবং পাক সেনারা মূলত বুদ্ধিজীবি, তরুণ এবং সংখ্যালঘু নিধনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি এমনকি কামান এবং যুদ্ধবিমানের মত আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যাবহার করা হচ্ছে। এই সংসদ ইতিমধ্যে এই অব্যাহত সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে।

বাংলাদেশের মানুষও বসে নেই, তারা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং পুলিশ বাহিনীর অনেক সশস্ত্র সদস্য তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। সামরিক জান্তা বাহ্যিকভাবে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনা করতে থাকলেও পিছন দিয়ে প্রায় দুই ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসে। বাংলাদেশে প্রতিরোধের মুখে পড়ার পর তারা সমুদ্র এবং আকাশ পথে আরো বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে তারা ইস্ট পাকিস্তান সিভিল ফোর্স এবং রাজাকার নামের বিশাল আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে এবং এরা গ্রামাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

নারী-পুরুষ-শিশু, মুসলমান-হিন্দু-খৃষ্ঠান-বৌদ্ধ; ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নির্মমতার শিকার অসংখ্য মানুষ আশ্রয়ের উদ্দ্যেশ্যে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে। পাক বাহিনীর অত্যাচার অব্যাহত আছে; অব্যাহত আছে শরণার্থীস্রোত। এই শরণার্থীর সংখ্যা বিস্ময়করভাবে প্রায় এক কোটিতে পৌছেছে।

পাকবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা এবং বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার নিষ্ঠুর প্রয়াসের কারণে সমগ্র বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। আমাদের জানামতে ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন এবং অসহায় অবস্থায় ঠেলে দেবার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তাদের আশ্রয় এবং ত্রাণ দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিলনা। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ফলে আমাদের উপর ব্যাপক চাপের সৃষ্টি হয়েছে; আমাদের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে, অনেক সামাজিক মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিক অধিকার ব্যাহত হচ্ছে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের ঐকন্তিক ইচ্ছা যে সন্ত্রাসের শিকার এই উদ্বাস্তুরা যেন সম্মান এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে নিজের দেশে ফেরত যেতে পারে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা এখন পর্যন্ত সন্ত্রাস বন্ধ অথবা এই উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরার মত নিরাপদ অবস্থা তৈরি করতে কোন উদ্যোগ নেয়নি। বিশ্ববিবেক, সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া সকল পদক্ষেপই বিফলে গিয়েছে।

পাক বাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থান অসম্ভব করে তোলার জন্য বাংলাদেশের মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে সামনে রেখে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। দেশপ্রেমিক বিপুল সংখ্যক তরুণ এই প্রতিরোধে যোগ দিয়েছে। তাদের এই প্রতিরোধ পাক বাহিনীর জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিরোধের সাফল্য বাংলাদেশে দ্রুত শত্রুমুক্তির ব্যাপারে আশা জাগিয়েছে।

সামরিক শাসকেরা বিগত কয়েক মাস ধরে নিজেদের দুষ্কর্ম থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্য দিকে সরানোর জন্য ভারতের উপর দোষারোপ করার চেষ্টা করে আসছে। আমরা শুধু আক্রান্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন এবং তাদের সাহায্য করার অপরাধে অপরাধী। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাদের উপর প্রতিশোধ নেবার হুমকি দিয়েছেন। বাংলাদেশে পাক বাহিনী বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। ৩০শে জুলাই, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের তরফ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ ঘোষনার হুমকি আসে। ১২ই অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি আবার এই হুমকির কথা পুনব্যাক্ত করেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানিদের যুদ্ধ উন্মাদনার পালে বাতাস দেয়া হচ্ছে। “ভারতকে চূর্ণ কর”, “ভারত দখল কর” ইত্যাদি লেখা সম্বলিত পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। পাকিস্তানীদের জিহাদের জন্য আহবান করা হচ্ছে।

ভারতের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধের হুমকি দেয়ার পর ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ভারত-পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। রাজস্থান, গুজরাট এবং পূর্ব পাঞ্জাব সীমান্তের খুব কাছে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। করাচী চুক্তির বরখেলাপ করে যুদ্ধবিরতি রেখা লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠান হয়েছে, আধা সামরিক ফ্রন্টিয়ার কর্পস গ্রুপকে তলব করা হয়েছে, বিপুল সংখ্যক মুজাহিদদের সক্রিয় করা হয়েছে এবং কারাকোরাম স্কাউটদের নিয়ে একটি অতিরিক্ত বাহিনী সংগঠিত করা হয়েছে। পশ্চিম সীমান্ত এবং যুদ্ধবিরতী রেখা বরাবর বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মজুত করা হয়েছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের প্রায় পুরো সামরিক বাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এনে সম্পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতিসহ আমাদের সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে। এরপর থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় একের পর এক উষ্কানীমূলক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। স্থল এবং আকাশপথে সীমান্তরেখা লঙ্ঘনের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। আমাদের পূর্বসীমান্তে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, যার ফলে সম্পদের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশী আশ্রয়ার্থী মৃত্যুবরণ করেছে। যুদ্ধবিরতি রেখার কাছে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে এবং পূর্ব সীমান্তে আমাদের যোগাযোগ ব্যাবস্থা নষ্ট করার জন্য অনেকগুলো নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।

আমি অত্যুক্তি করতে চাইনা, কিন্তু আমাদের সীমান্তের অববস্থা খুবই সংকটজনক। অন্তরেখার কাছে পাকবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তারা পুরোদমে আক্রমনের জন্য সম্পূর্ণরুপে প্রস্তুত। আমাদের কাছে আসা খবর অনুযায়ী তারা আমাদের বিমানঘাঁটিগুলোতে স্বতপ্রণোদিত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে।

এই অববস্থায় পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। আজকে আমাদের সেনাবাহিনীকে সবরকমের পরিস্থিতি মোকাবেলার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে। আমাদের জওয়ানেরা মানসিকভাবে অত্যন্ত চাঙা অবস্থায় আছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জনগনের মনোবলও অটুট আছে, তারা যুদ্ধপ্রস্তুতিতে সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে নাশকতা প্রতিরোধ এবং বিমান আক্রমন মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যেকোন আগ্রাসন প্রতিরোধে আমরা বদ্ধ পরিকর এবং প্রয়োজন হলে আক্রমণকারীর মাটিতে যেয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে।

আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের প্রস্তুতি দেখে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা তৃতীয় বারের মত আমাদের উপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া থেকে নিরস্ত হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটা সন্তোষজনক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এবং শরণার্থীরা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের সতর্কতা শিথিল বা সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করব না। আমি আশা করি ইসলামাবাদের নেতারা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবেন এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উপর সামরিক আগ্রাসন চালানোর নিরর্থকতা উপলব্ধি করতে পারবেন। আমি আশা করতে চাই যা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই আত্নঘাতি পথ পরিহার করবেন, আমাদের দোষারোপ করা বন্ধ করে এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন যেটা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়। শুধুমাত্র এই পদক্ষেপই উপমহাদেশের সব মানুষের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে এবং তাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের লক্ষে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাবার সুযোগ করে দেবে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারন হচ্ছে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরোধ, মন্ত্রী মহোদয়ের এই বক্তব্যের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি জানি যে দুঃসাহসিক, অদম্য মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিজেদের মানসিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরুপে হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা আমাদের প্ররোচিত করে একটি যুদ্ধে জড়াতে চায়, যাতে করে তারা সমস্যার একটা আন্তর্জাতিক রুপ দিয়ে জাতিসংঘের কাছে নিয়ে যেতে পারে, এবং জাতীসংঘ থেকে একটি পর্তবেক্ষক দল পাঠিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম বন্ধ করে দিতে পারে। আমার বক্তব্যে আমি মুক্তিবাহিনীর ভাই-বোনদের অভিনন্দন জানাতে চাই, যারা নিরলসভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন এবং বেশ কিছু অঞ্চল ইতিমধ্যে ইয়াহিয়ার দখলমুক্ত করে এনেছেন। আমি আশা করেছিলাম যে অধিবেশনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে এখনো কোন বক্তব্য দেননি।

আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে পাকিস্তান নিয়মিত আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে। প্যাট্রিয়ট নামক খবরের কাগজে আমি জানতে পরেছি যে ১৪ই নভেম্বর চাম্ব অঞ্চলে পাক যুদ্ধবিমান তিনবার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, এবং দুপুর ১:২৫ মিনিটে একটি মিরাজ যুদ্ধবিমান আমাদের সীমায় অনুপ্রবেশ করেছে।

আমি সুস্পষ্টভাবে ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমাদের জওয়ানদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করতে চাই এবং আমি জানি ভবিষ্যতেও তারা যেকোন ধরনের আগ্রাসনের জবাব দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করার পরও আমরা তাদের বিমান গুলি করে ভূপাতিত করিনি। যশোর থেকে একটি জেট যুদ্ধবিমান মাত্র তিন মিনিটে দম দম বিমানবন্দরে এসে বোমা ফেলে যেতে পারে। আমি জানতে চাই যে কোন বিমান আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে তাকে গুলি করার জন্য আমাদের জওয়ানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে কিনা এবং দেয়া হলে তারা কেন সেটা পালন করেনি। আমরা কেন যুদ্ধবিমানগুলোকে নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে দিচ্ছি? তাদের আমাদের সীমানায় অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যতো মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অজানা নয়। আমি এই প্রশ্নের উত্তর চাই। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই যে আমি বা আমার দল যুদ্ধের পক্ষে না। আমরা যুদ্ধবাজ নই এবং আমরা যুদ্ধে জড়াতে চাইনা। আমাদের জওয়ানদের সীমান্ত অতিক্রম না করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি সেটা সমর্থন করি। কিন্তু আমাদের সীমান্ত রক্ষায় এবং তাদের সেনারা যেন আমাদের সীমান্ত অতিক্রম না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে কি ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে আমি সেটা জানতে চাই। আমি চাইনা মাননীয় মন্ত্রী কোন গোপন তথ্য ফাঁস করে দিন এবং আমি জানি আমাদের জওয়ানেরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কাশ্মীর এবং অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করছে এবং সেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয়ে দিনপাত করছে। কুমিল্লা থেকে আগত অভিবাসিরা আগরতলাতে অবস্থান করছে এবং মুক্তিবাহিনীর জয় নিশ্চিত করতে তারা যোকোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন যে পরিস্থিতিঅত্যন্ত গুরুতর এবং এবং এই উত্তেজনাকয় পরিস্থিতি মোকাবেলায় যেকোন পদক্ষেপ নিতে আমরা প্রস্তুত আছি। আমি জানতে চাই যে সীমান্তের মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা এবং পাকবাহিনী যেন সীমান্ত অতিক্রম করে আমাদের এলাকায় এসে গুলি করে মানুষ হত্যা করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য কোন ব্যাবস্থা নেয়া হবে কিনা। আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে এই দুইটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর চাই।

আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সম্পূর্ণ বক্তব্য পড়েছি এবং আমি তাঁকে ধন্যবাদ দেই। মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, আমাদের দিক থেকে আমাদের সীমান্তের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষে আমি মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কাছে একটা জিনিষ জানতে চাই। তিনি যদি এই প্রশ্নের উত্তর না জানেন, তবে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্তর চাই। যখন আমরা মুক্তিবাহিনীর সাফল্য চাই, ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাফল্য চাই, বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে বিশ্ববিবেকের সমর্থন চাই, তখন আমরা কি করব? আমরা কি নীরব দর্শক হয়ে থাকব, নাকি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব?

শ্রী জগজীবন রাম: এই দুটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তর আমার বক্তব্যেই দেয়া হয়েছে। আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই এবং এটা আমি আমার বক্তব্যে উল্লেখ করেছি। আমার সম্মানিত বন্ধুরা যদি খবরের কাগজ পড়ে থাকেন, তবে দেখবেন যে আমাদের যুদ্ধবিমান শত্রুপক্ষের বিমানকে তাড়া করেছে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: কিন্তু সংবাদপত্রে এটাও ছিল যে তারা ব্যার্থ হয়েছে।

শ্রী জগজীবন রাম: আপনার অনুমান আপনি করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে জওয়ানদের কি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমাদের সেনাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে সীমানায় অনুপ্রবেশকারীকে তাড়া করতে …… ( তাঁর বক্তব্যে এ সময় বাঁধা দেওয়া হয়)

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ( গোয়ালিওর): নাকি গুলি করে নামানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে?

শ্রী জগজীবন রাম: আমাদের পূর্বসীমান্তে গোলাবর্ষনের ব্যাপারে আমি আমার বক্তব্যে বলেছি যে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কাশ্মীর এবং অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করছে, কিন্তু আমি নিশ্চিত করছি কোন পাক সেনার সীমানা অতিক্রম করে ভারতে ঢোকার সাহস হয়নি। তারা যদি সীমান্ত অতিক্রম করে, তাদের পাকিস্তানে ছুঁড়ে ফেরত পাঠানো হবে …… ( তাঁর বক্তব্যে এ সময় বাঁধা দেওয়া হয়)। আমাদের জওয়ানদের এই নির্দেশই দেয়া হয়েছে। গোলাগুলি করতে আমাদের জওয়ানদের বারণ করা হয়েছে, আমি নিশ্চিত তারা এটা করছে এবং করবে। এখনো পর্যন্ত, আমি আবারও বলছি এখনো পর্যন্ত নির্দেশ হচ্ছে আমাদের সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করবেনা। আমার বক্তব্যে আমিই মাত্রই বলেছি যে যদি শত্রুপক্ষের তরফ থেকে আগ্রাসন হয়, তাহলে পাকিস্তানের মাটিতেই যুদ্ধ হবে।

স্বীকৃতির ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে উপযুক্ত সময়ে সেটা দেয়া হবে।

শ্রী দশরথ দেব (উত্তর ত্রিপুরা): মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন শত্রুপক্ষ সীমানা অতিক্রম করলে আমাদের সেনারা তাদের পিছু হটিয়ে দিয়ে তাদের এলাকায় যেয়ে যুদ্ধ করবে। কিন্তু আমি কিছু বিষয়ে মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

ত্রিপুরা সীমান্তজুড়ে মর্টার এবং অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনী গোলাবর্ষন করে চলেছে। এমন কোন রাত নেই যে গোলাবর্ষন হচ্ছেনা, বিশেষ করে বেলোনিয়া, সোনমপুর, আগরতলা এবং কামালপুর শহরে। এর মধ্যে তিনটি শহর থেকে সব মানুষ পালিয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র সরকারী কর্মকর্তারা, যাদের এলাকা না ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা সেখানে আছেন। প্রতিদিন গোলাবর্ষণের কারনে সাধারন মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অতি সম্প্রতি আগরতলা শহরে একটি মর্টার বিস্ফোরনে ৬ জন নিহত এবং ২০ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা এখনো হাসপাতালে আছেন।

শুধুমাত্র এই চারটি প্রধান শহর নয়, পুরো ত্রিপুরা সীমান্ত জুড়েই প্রতিদিন মানুষ গুলিতে আহত এবং নিহত হচ্ছে। এই মাসে শুধু কামালপুর শহরে ৫০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকা কমলনগর, সিমনা-সিধাই এ ৫০ জন নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। পাকিস্তানী গোলাবর্ষনের কারনে সীমান্ত অঞ্চলে ফসল, বাড়ি-ঘর এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

সুতরাং, যখন মাননীয় মন্ত্রী বলেন যে আমাদের জওয়ানের সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে প্রস্তুত, তখন আমি তাঁর কাছে জানতে চাই সীমান্ত এলাকার ভারতীয় নাগরিকদের নিজ ভূমে শরণার্থী হওয়া প্রতিরোধ করতে সরকার কি পদক্ষেপ নিচ্ছে? ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া এসব মানুষের ত্রান এবং অন্যান্য সাহায্য পৌছে দিতে সরকার কি করছে? এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এসব মানুষের পক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, মাননীয় মন্ত্রী বলছেন যে উপযুক্ত সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। আমি জানিনা সেই উপযুক্ত সময় কখন আসবে। পাকিস্তান আমাদের সীমান্তে সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করেছে এবং তাদের আক্রমণে প্রতিদিন ভারতীয় নাগরিকদের প্রাণহানি ঘটছে। যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং মুক্তিবাহিনীকে জিনিষ-পত্র দিয়ে সাহায্য করা হয়, তবে তারা শুধু ভারতীয় সীমান্ত থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দেবেনা, বাংলাদেশের ভেতরেই তাদের ধ্বংস করে দেবে।

আমি সরকারের কাছে জানতে চাই যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে তারা আর কতদিন সিদ্ধান্তহীনতার বেড়াজালে বন্দী থাকবে। আমাদের সরকার কখন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে?

শ্রী জগজীবন রাম: ত্রিপুরা সীমান্তে গোলাবর্ষনের ব্যাপারে মাননীয় সংসদ বিশেষভাবে কামালপুর এবং বেলোনিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন। আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি কারণ তিনি ঐ এলাকা থেকে এসেছেন, সুতরাং ঐ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সাহসী যোদ্ধাদের সাফল্যের কথা তিনি নিশ্চই ভুলে যাননি। কামালপুর-বেলোনিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে ঐ এলাকা দখল করেছে। আমি জানি যে সীমান্তবর্তী শহর ও গ্রামগুলিতে ঝুঁকি আছে। এলাকাবাসীর দূর্দশা লাঘব করতে সরকারী প্রশাসন সব ধরনের ব্যাবস্থা নেবে।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে কোন ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা নেই, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়েছে এবং সেই সিদ্ধান্ত হচ্ছে উপযুক্ত সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। কখন সেই উপযুক্ত সময় আসবে সেটা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল।

মুক্তিবাহিনীর ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, মাননীয় সাংসদেরা জানেন যে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে, সমুদ্রে এবং কিছু ক্ষেত্রে আকাশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের থেকে সবধরনের সাহায্য পাচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকেরা মুক্তিবাহিনীর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং সমরাস্ত্র সংগ্রহে তাদের সহায়তা করছেন।

শ্রীমতি মুকুল ব্যানার্জি ( নয়াদিল্লী): সর্বাগ্রে আমি ভারতের নিরাপত্তার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহন এবং সীমান্ত অঞ্চলে কার্যকর ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকেও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমাদের নেতৃবৃন্দের কূটনৈতিক দক্ষতার কারনে এমন কিছু দেশ এবার আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যারা অতীতে পাকিস্তান ইস্যুতে কখনোই আমাদের পক্ষাবলম্বন করেনি। এই প্রথমবারের মত আমাদের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বজুড়ে সফল হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এর পরেও আমাদের সীমান্তে ক্রমাগত ভাবে অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং ব্যাপক গোলাবর্ষন চলছে। পাকিস্তানের ক্রমাগত প্ররোচনা সত্বেও আমাদের সরকার এবং জনগণ সংযত আচরণ করছে, কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে আর কতদিন মানুষ ধৈর্য ধরে রাখতে পারবে?

আমি মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে আরো জানতে চাই যে উনি রাধিকাপুরের ব্যাপারে অবহিত আছেন কিনা। রাধিকাপুর পশ্চিম দিনাজপুরের সর্বশেষ স্টেশন, খুব ছোট একটি জায়গা। পাকবাহিনীর ক্রমাগত গোলাবর্ষণে সেখানকার জনজীবন বিপর্যস্থ। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আরো জানতে চাই যে চাঁচার সহ আসামের আন্যান্য কিছু জেলায় বেশ কিছু অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা ঘটেছে এবং কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা নাশকতাকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। সীমান্ত এলাকায় এধরনের নাশকতা প্রতিহত করতে কি ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে?

শ্রী জগজীবন রাম: আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে মাঝে মাঝে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটছে এবং শত প্ররোচনার মুখেও আমাদের সেনারা সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা সংযত আচরনই করে যেতে থাকব, আমরা অযথা যুদ্ধে জড়াতে চাইনা। আর যদি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে, তখন আমাদের সেনাবাহিনী বীরের মতই পরিস্থিতির মোকাবেলা করবে।

নাশকতাকারী এবং গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে আমরা ইতিমধ্যে ব্যাবস্থা নিয়েছি। এধরনের পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষ বিপুল সংখ্যক নাশকতাকারী এবং গুপ্তচর পাঠিয়ে থাকে। এধরনের অন্তর্ঘাত প্রতিহত করা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এব্যাপারে সচেতন আছে এবং অনেক নাশকতাকারী এবং গুপ্তচরকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী: মাননীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর ভাষনে যা বলেছেন, তার পরেও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। তাঁর বক্তব্য পড়ার পর কখনো কখনো মনে হয় সরকার পরষ্পরবিরোধী কথা বলছে। তিনি একথা স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তান প্রায় এক কোটি লোককে আমাদের দেশে ঠেলে দিয়ে এক নতুন ধরনের আক্রমন পন্থা অবলম্বন করেছে। তিনি একথাও মেনে নিয়েছেন, আমি তাঁরই বক্টব্য উদ্ধৃত করছি,

“আমাদের কাছে আসা খবর অনুযায়ী তারা আমাদের বিমানঘাঁটিগুলোতে স্বতপ্রণোদিত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে। “

পাকিস্তান হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে আমাদের এয়ার ফোর্সকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতে পারে। একই সাথে তিনি স্বীকার করেছেন যে, পাকিস্তান অব্যাহতভাবে সীমান্তে গুলিবর্ষণ করছে, আমাদের জওয়ানেরা নিহত হচ্ছে। বেসামরিক লোকেরা মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এরপরও তিনি বলেন, পাকিস্তান হামলা করলে আমাদের জওয়ানেরা দাঁতভাঙা জবাব দেবে এবং যুদ্ধকে আমরা শত্রুর মাটিতে নিয়ে যাব। এর অর্থ কি এই যে, আমরা নতুন কোন আক্রমণের জন্য প্রতীক্ষারত? এক কোটি লোককে ভারতে ঠেলে দেয়া- যার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে-এটা কি আক্রমণ নয়? একদিকে বলা হচ্ছে আমরা যুদ্ধকে শত্রু ভূ-খন্ডে নিয়ে যাব, অন্য দিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মহোদয় একথাও সমর্থন করেন যে, আমি জওয়ানদের বলে দিয়েছি, তারা যেন নিজ সীমান্ত অতিক্রম না করে। আমি জানতে চাই, আপনি কোনটা হামলা মনে করেন? শরনার্থী ঠেলে দেয়া হামলা নয়? প্রতিদিন আকাশসীমা লঙ্ঘন করা হামলা নয়? প্রতিদিন গুলিবর্ষণ করা হামলা নয়? যে ভূ-খন্ড হতে বোমা বা গুলিবর্ষণ করে তারা আমাদের নাগরিক হতাহত করছে, আমাদের সম্পদ বিনষ্ট করছে, যে শরনার্থী মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের আশ্রয়ে এসেছে তাদেরও মৃত্যুর দুয়ারে পৌছে দিচ্ছে- তাদের দেশে ঢুকে পড়ে তাদের আড্ডা ভেঙে দেয়ার অধিকার আমাদের সৈন্যরা পাবে না কেন? সেরুপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কবে? প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মহোদয় কোন সময়ের প্রতীক্ষায় আছেন? এ যাবত যা হয়েছে, তা যদি হামলা হয় তবে কোন নতুন হামলার প্রতীক্ষা করার প্রয়োজন নেই।

আগে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি বিমান ফেলে দেয়া হবে। এখন বলা হচ্ছে পাকিস্তানি বিমান তাড়িয়ে দেয়া হবে। আমরা এ যাবত তাদের একটি বিমানও ফেলতে পারিনি। তারা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান ধাওয়া করেছে। গুজরাটের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বলবন্ত রায় মেহতা কি পরিস্থিতিতে নিহত হয়েছিলেন তা এই সংসদ এবং এই দেশ ভুলতে পারেনা। আমরা কতদিন পর্যন্ত আমাদের আকাশসীমার অবিরাম লঙ্ঘন বরদাশত করব? পাকিস্তানের একটি বিমান ফেলে দেবার ক্ষমতাও আমাদের নেই, আমি এটা মানতে রাজি নই। সম্ভবত বিমান বাহিনীকে বিমান নামানোর আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি আমাদের স্থল বাহিনীর সৈন্যদের শত্রু ভূ-খন্ডে প্রবেশের যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, তাও ফিরিয়ে নেয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। শত্রু নিজ ভূ-খন্ড থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকলে আমাদের সেনা বাহিনীর হাতে তাদের সীমায় ঢুকে আক্রমণ চালিয়ে তাদের স্তব্ধ করে দেয়ার অধিকার থাকতে হবে। আমি যখন আক্রমণের কথা বলি, আত্নরক্ষার জন্য বলি। আত্নরক্ষার জন্য আমাদের আক্রমণ চালাতে হতে পারে।

আরেকটা প্রশ্ন আছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মহোদয় বলেন যে, আমাদের সেনাবাহিনী সীমান্ত থেকে তখনই চলে যাবে যখন কোন সমাধান বের হবে। বাংলাদেশ সমস্যার এরুপ সমাধান হতে হবে যেটা পূর্বের নির্বাচিত লোকেরা মেনে নেবেন। যাঁরা প্রথমে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কারারুদ্ধ আছেন, কেউ আত্নগোপন করে আছেন। তাঁদের জায়গায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান নতুন লোক নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের সাথে যারা নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন, তারা এখন পূর্ব বাংলার জনপ্রতিনিধি হিসাবে আছেন। সেখানে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় যারা আগে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা নির্ভিকভাবে, নিঃসঙ্কোচে নিজেদের কথা বলতে পারবেন কি? বিশ্ব মতের চেষ্টায়, বিশ্বের সহানুভূতির আশায় আমরা কি নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ বলি দিতে যাচ্ছি? আমি জানিনা শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন কি না। আগামীতে ইয়াহিয়া খান তাঁকে ছেড়ে দেবার নাটক রচনা করতে পারেন। দীর্ঘ আলোচনা চলতে পারে। যে এক কোটি লোক এখানে এসেছে, এখন তাদের কি দশা হবে?

ভারত সরকারের কোন মুখপাত্র কি একথা বলতে রাজি আছেন- আমি প্রতিরক্ষা প্রশ্ন করছি-যখন পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশে একটি অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলার সরকার প্রতিষ্ঠা না হবে,, তখন পর্যন্ত শরনার্থীদের ফিরে যাবার কোন আশা কি করা যায় না?

রাজনৈতিক সমাধানের ডাক উঠেছে। বিশ্বরাষ্ট্রসমূহ চাইবেনা পাকিস্তান ভেঙে যাক। কিন্তু পাকিস্তানের সৈন্য যদি বাংলাদেশে থাকে তাহলে শরণার্থীরা কিভাবে ফিরে যাবে? বিগত ২৪ বছরে যারা এসেছে, তাদের মধ্যে কি কেউ ফিরে গিয়েছে? শরণার্থীদের মাঝে আমারও যাবার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের অংশ থাকে, শরণার্থীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালান পাক সেনারা যদি সেখানে থাকে, তবে শরণার্থীরা ফিরে যাবেনা। তখন আমরা এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান কিভাবে করব যার ফলে শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারে?

মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন সরকার সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছে না। আমি জানতে চাই, ভারত সরকার কি পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে এই আল্টিমেটাম দিতে রাজি আছে যে, সাত দিনের মধ্যে আক্রমণাত্নক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, অন্যথায় ভারতের জন্য এখন রাস্তা খোলা আছে। এটি পাকিস্তানের উপর আক্রমণ চালানোর প্রশ্ন নয়, বরং যে হামলা ইতিমধ্যে হয়েছে তার জবাব দেবার প্রশ্ন। এবং এই সরকার জবাব দিতে প্রস্তুত আছে কিনা আমি এটাই জানতে চাই।

শ্রী জগজীবন রাম: শ্রী বাজপেয়ী বিমান দ্বারা আমাদের আকাশসীমা অতিক্রমের প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি সংবাদপত্রে নিশ্চই দেখে থাকবেন যে, পাকিস্তানী বিমান প্রবেশের পর আমাদের পক্ষ থেকে এন্টি এয়ারক্রাফট গান চালানো হয়েছে। আমি সংসদের অন্য কক্ষে বলেছিলাম আর এখানেও তা পুনরায় বলতে চাই যে, কোন পাকিস্তানী বিমান প্রবেশ করলেই তাকে ভূপাতিত করা হবে এই মর্মে আমাদের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।

আমাদের সীমান্তে বিক্ষিপ্ত গোলাবর্ষণ হচ্ছে একথা স্বয়ং আমি বলেছি। আমি এও বলেছি যে এক কোটি শরণার্থী এ দেশে পাঠিয়ে দেয়া এক জঘন্য আক্রমণ। আমি আরও বলেছি যে আমাদের উষ্কানি দেয়ার জন্য যত গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে আমরা তা নীরবে সহ্য করছি, কেননা পরিস্থিতি যুদ্ধে রুপ নিক সেটা আমরা চাই না। আমি আগে বলেছি এবং দৃঢ়তার সাথে আবার বলতে চাই যে, পাকিস্তানের একটি সৈন্যও যদি আমাদের সীমান্তের কাছে আসে, তবে আমাদের সৈন্যরা তাকে তাড়িয়ে সীমান্তের ওপারে পৌছে দেবে। কিন্তু পাকিস্তানের এ আচরণ আমি এভাবে নিতে চাইনা আমাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার, লক্ষও সুস্পষ্ট এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও পরিচ্ছন্ন। এমনিতে পাকিস্তানের একটি বিমানও যদি চলে আসে, তবে তাকে আমরা হস্তক্ষেপ বা অনুপ্রবেশ বলে উল্লেখ করে আক্রমণ বলতে পারি। আমাদের সীমান্ত লক্ষ করে একটি গুলি ছোড়া হলেও আমরা তাকে আক্রমণ বলতে পারি, আমরা তা বলেছিও। কিন্তু আমরা যে অর্থে আক্রমণের কথা বলেছি সেটা হল এই যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈন্য যদি আমাদের সীমান্তের নিকটবর্তী হয় তাহলে আমাদের জওয়ানরা তাদের সীমান্তের ওপারে ছুঁড়ে দেবে।

আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই যে এ ব্যাপারে কোন অনিশ্চয়তা নেই। আমরা সিদ্ধান্থীনভাবে কাজ করছি না বরং একটি সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করছি।

আমাদের আরও দৃঢ় বিশ্বাস, শরণার্থীদের সম্মান ও নিরাপ্তার সাথে দেশে ফিরে যাবার মত পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে। সেই অবস্থা কখন তৈরি হবে সেটাও আমি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান শুধু তাই হতে পারে যা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহনযোগ্য। তাঁদের কাছে কোনটা গ্রহনযোগ্য তা তাঁরা দ্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছেন এবং আমি আশা করি শ্রী বাজপেয়ী সেটা পড়েছেন। তাঁরা বলেছেন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থেকে কম কোন রাজনৈতিক সমাধান তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেনা। তাঁরা একথারও পুনরুক্তি করেছেন যে, তাঁরা বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠা করেই লোকদের ফিরিয়ে নিতে চান। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের এই প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেছেন।

শ্রী বাজপেয়ী উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা সেখানে আবার নির্বাচন করিয়েছে। এটি বিশ্ব ইতিহাসের কোন নতুন ব্যাপার নয়। যখনই কোন সামরিক শাসনের শক্তি কমে আসে, যখন তাদের চেতনা হয় যে তাদের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, তখন তারা এই প্রকার শিখন্ডিদের আশ্রয় নিতে দ্বিধা করেন। এরুপ পরিস্থিতিতে বংশবদ মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়, বিশ্ব ইতিহাসে এরকম অনেক নজীর মেলে। ইতিহাসে এরকম বংশবদ মন্ত্রীসভার যেরকম পরিনতি হয়ে এসেছে, বাংলাদেশেও সেরকম পরনতিই হবে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।

এ ব্যাপারেও আমার কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের তরুণরা যারা নিজেদের মাতা-ভগ্নিদের অপমানিত হতে দেখেছেন, যারা নিকট আত্নীয়দের নির্মমভাবে নিহত হতে দেখেছেন, বাংলাদেশের পূর্ন স্বাধীনতার কোন বিকল্প যে নেই, একথা তারা কখনো বিস্মৃত হতে পারবেন না। সংসদকে আমার বলার এই-ই আছে। এর বেশী বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।