শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২২৪। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি প্রসঙ্গে আলোচনা | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী | ৪, ৯ ও ১২ আগষ্ট, ১৯৭১ |
১২.১০ ঘটিকা
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি
মাননীয় স্পীকার: জ্বনাব এফ.এ.আহমেদ।
শ্রী সমর গুহ (কোন্টাই): আমি অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
মাননীয় স্পীকার: আমি আপনাকে অনুমতি দিতে পারছিনা। আপনি আগে থেকেই বক্তব্য দেবার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি আপনাকে ফ্লোর দিচ্ছিনা।
শ্রী সমর গুহ: আপনি যতক্ষন পর্যন্ত না আমাকে সংসদ থেকে বের করে দিচ্ছেন, আমি বাংলাদেশের ব্যাপারে কথা বলতে থাকব। আমি সংসদ এবং সংসদের মাধ্যমে এই বিষয়ে দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করেই যাব, বিশেষত যেখানে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
মাননীয় স্পীকার: উনি বলছেন যে উনাকে সংসদ থেকে বের করে না দেয়া পর্যন্ত উনি থামবেন না।
(এই সময় স্পীকারের বক্তব্যে বাধা পড়ে। )
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি (গোয়ালিয়র): স্পীকার মহোদয়, আমার নিবেদন এই যে, শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সংসদের মনোভাব এরকমই এবং আমাদের বন্ধু শ্রী সমর গুহ বাংলাদেশের সমস্যা না তুলে থাকতেই পারেন না। আপনি তাঁকে বলতে পারেন যে, আপনি এই সমস্যা নিয়ে ভাবছেন এবং এভাবে এই সমস্যা এড়াতে পারেন।
স্পীকার মহোদয়: এরুপ দু’তিন দিন তো আমি চিন্তা-ভাবনার কথা বলে কাটিয়েছি। আর কত দিন এভাবে চলবে।
শ্রী এস.এ.শামীম (শ্রীনগর): এই অবস্হান শ্রী সমর গুহের একার নয়। আমি নিশ্চিত যে পুরো সংসদই তাঁর সাথে সহমত পোষন করে। সুতরাং প্রশ্নটি শুধু শ্রী সমর গুহের নয়, প্রশ্নটি সমগ্র সংসদের তরফ থেকে উথাপিত। আমি জানিনা যে সরকারী দল কেন এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করছেন।
শ্রী এইচ.এন.মুখ্যার্জি (কলকাতা উত্তর-পূর্ব): মাননীয় সাংসদ যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন তা পুরো সংসদের জন্যই উদ্বেগজনক। সনসদে কিছু মন্ত্রী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন, আমি জানিনা তারা নির্বোধ কিনা; কিন্তু তাঁরা কোন প্রশ্নের উত্তর দেন না। সাংসদদের দায়িত্ব যে কোন গুরুত্বপূর্ন ইস্যু সংসদের দৃষ্টিগোচর করা এবং সরকারের দায়িত্ব এর প্রত্যুত্তর দেয়া। আমি লক্ষ করছি যে মাননীয় স্পীকার সব সময় সরকারকে সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করছেন এবং এবং নিজেদের পর্যবেক্ষন সংসদকে অবহিত করতে অনুরোধ করছেন। আমি চাইনা যে মাননীয় স্পীকার কোন ব্যাপারে পক্ষ অবলম্বন করবেন বা নিজের রায় জানাবেন, কিন্তু সরকার কিছুই বলছেনা। সংসদ নেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ উপস্হিত নেই। আমি জানিনা অন্য মন্ত্রীরা কি করছেন, কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব দেয়া তাঁদের অবশ্য কর্তব্য।
স্পীকার মহোদয়: আলোচ্যসূচিতে যেহেতু কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলনা, মাননীয় মন্ত্রীরা কেন এখানে থাকবেন? এখন রাজ্যসভার অধিবেশনও চলছে, মন্ত্রীরা পালাক্রমে দুই সভার কার্যক্রমেই অংশগ্রহণ করছেন। কেউ কেউ রাজ্যসভার অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন, কেউ কেউ এই সভার অধিবেশনে আসছেন।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : স্পীকার মহোদয়, আমি যা বলেছি, তার অর্থ এই নয় যে শ্রী সমর গুহের প্রশ্ন হেসে উড়িয়ে দিতে হবে। আমি আপনার এবং তার মধ্যকার দ্বন্দ্ব এড়াতে চেয়েছি মাত্র। আপনি এটা গ্রহণ করতে পারেন।
স্পীকার মহোদয়: কিভাবে নিতে পারি?
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : স্পীকার মহোদয়, দৃষ্টি আকর্ষণ (CALL ATTENTION)- এর মধ্যে আপনি এটি নিতে পারেন।
স্পীকার মহোদয়: আমি আপনাকে শুধু এটুকু বলতে পারি যে আমাকে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে কাজ হবেনা। সংসদে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। একজন সাংসদ স্পীকারের চেয়ারকে অপমান করছেন আর আপনি বলছেন আমার তা মেনে নেয়া উচিত। আমি এটা মেনে নিতে পারিনা।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : স্পীকার মহোদয়, আমি এর উপর দৃষ্টি আকর্ষণ (CALL ATTENTION) দিয়েছি।
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): আমার মনে আছে যে প্রশ্নটি যখন তোলা হয়েছিল, আপনি শ্রী শরণ সিংকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে অনুরোধ করেছিলেন। এটি সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছে, আমাকে এ ব্যাপারে বক্তব্য দিতে দিন।
মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ( শ্রী জগজীবন রাম): বাংলাদেশের জনগনের মুকুটহীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার দেয়া বক্তব্যে সংসদের অন্য সবার মত সরকারও উদ্বিগ্ন। সংসদ কে ইতিমধ্যে অবহিত করা হয়েছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের কোন ক্ষতি না করতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য আমরা অনেকগুলো দেশের নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ জানিয়েছি।
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: চলুন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবী করে আমরা সংসদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব পাশ করি।
শ্রী জগজীবন রাম: আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইতিমধ্যে সংসদকে জানিয়েছেন যে সরকার কূটনৈতিক পর্যায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। সরকারের চাওয়া এ বিষয়ে একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর।
জরুরী জন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার বিষয়ে ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য
শ্রী সমর গুহ: আমি নিম্নলিখিত জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং উনার বক্তব্য আশা করছি:
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হতে পারে।
মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ( শ্রী শরণ সিং): সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হতে পারে এবং পাকিস্তানে তথাকথিত সংসদ বসার সময় শেখ মুজিব জীবিত নাও থাকতে পারেন এই মর্মে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যে আমাদের সরকার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। অথচ ইয়াহিয়া খান তার আগের একটি বক্তব্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে “পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী” হিসাবে ” উল্লেখ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি তে জয়লাভ করেছেন এবং এর মাধ্যমে সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, সমগ্র পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা। ২৫শে মার্চের পর কি ঘটেছে সেটা সারা পৃথিবী জানে। জনরায় উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সাধারনগনের উপর সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যে মানবাধিকারের লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। ভোটের ফলাফলকে সম্মান জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে পাকিস্তানি সরকার নিরীহ মানুষের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে এবং গণহত্যা করছে, তার উদাহরন সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে পাওয়া যায়না। শেখ মুজিবুর রহমানের এই হাস্যকর বিচার মানবাধিকার পরিপন্হি এবং সমগ্র বিশ্বের উচিত এর নিন্দা জানানো। কারাগারে এবং গৃহবন্দী শেক মুজিব এবং তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। আমাদের উদ্বেগের কথা আমরা বিদেশী সরকারগুলোকে জানিয়েছি এবং পাকিস্তানের উপর এ ব্যাপারে প্রভাব খাটাতে অনুরোধ করেছি। শেখ মুজিব, তাঁর সহযোগী এবং পরিবারের কারো যদি কোন ক্ষতি হয়, তাহলে বাংলাদেশের পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে এবং এই পরিনামের জন্য পাকিস্তানী সামরিক জান্তা একক ভাবে দায়ী থাকবে। আমরা বিশ্ববিবেকের কাছে অনুরোধ জানাই যে তারা যেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। আমরা পাকিস্তান সরকারের এই প্রস্তাবের নিন্দা জানাই এবং তাদের সতর্ক করে দিতে চাই যে এপথে অগ্রসর হলে এর পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
শ্রী সমর গুহ: লোক সভা এবং রাজ্যসভার সদস্যরা তাঁদের গভীর উদ্বেগ এবং আশঙ্কার কথা জানিয়ে আপনার কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ এবং অবিলম্বে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির লক্ষে বিশ্ব নেতাদের প্রভাবিত করার জন্য আপনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। এখন সরকারের পালা। শেখ মুজিবের আশু মুক্তি এবং তাঁর ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আমাদের জানা দরকার। বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য শুধু বিশ্ব দরবারে ধর্না দেওয়াই যথেষ্ঠ হবেনা। আমার মতে সবচেয়ে কার্যকর পন্হা হচ্ছে বাংলাদেশেকে অবিলম্বে রাষ্ট্র হিসাবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সামরিক আদালতে দাঁড় করানোর আগে রাওয়াল পিন্ডির সামরিক জান্তাকে অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাবস্হা করা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়াটা আমাদের প্রথম এবং প্রধান ইস্যু হওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা নন, তিনি শুধু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নন, তিনি তার থেকে অনেক বড় কিছু। তিনি আজ সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রতীক। আমি আবার “বঙ্গবন্ধু” শব্দটি ব্যাবহার করি, তিনি আসলেই গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের বন্ধু- প্রজাতন্ত্রের আদর্শ। আমি সংসদকে স্মরন করিয়ে দিতে চাই, একটি সমগ্র জাতী একজন নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে, শেখ মুজিব ছাড়া এরকম উদাহরণ ইতিহাসে আর নেই। পৃথিবীর কোথাও আর কোন বহুদলীয় নির্বাচনে তাঁর মত ৯৮.৯% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার নজীর নেই।
কোন সামরিক, ফ্যাসিবাদি অথবা অন্যধরনের স্বৈরাচারী সরকার জনগনের সার্বভৌম ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। এটাও মনে রাখতে হবে যে নির্বাচনটি সামরিক জান্তার অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই অবস্হায় তাঁর এরকম বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়া বিশাল একটা ঘটনা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক এই দেশের সংসদকে স্বীকার করতে হবে যে বিশ্বের অন্য কোন দেশের কোন গনতান্ত্রিক নেতা শেখ মুজিবের মত গনতন্ত্রের পতাকা তুলে ধরতে পারেননি।
আমরা নিজেদের গান্ধীর উত্তরাধিকার হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। মহাত্না গান্ধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পিতা। আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই যে জাতীয় মুক্তির জন্য এই কৌশল খাটাতে শেখ মুজিব গান্ধীজি থেকে অনেক বেশী সফল। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে সম্পূর্ণরুপে বিশ্বাস করে এবং ২৫ শে মার্চের পূর্বে বাংলাদেশের জনজীবন বা প্রশাসনের উপর ইয়াহিয়ার বিন্দুমাত্র কতৃত্ব ছিলনা। এখানে উল্লেখ্য যে প্রধান বিচারপতি গভর্নর টিক্কা খানের শপথগ্রহণ পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, বিশ্বের কোথাও এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
ইয়াহিয়া খান দাবী করেন যে তিনি নাদির শাহের বংশধর। তিনি নাদির শাহের মতই শাসক হতে চান, গনতান্ত্রিক আন্দোলনের সবচেয়ে বড় আইকন শেখ মুজিবকে প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি করতে চান। আদালতে বিচার হওয়ার আগেই তিনি বিচার করে ফেলছেন, বলে দিচ্ছেন যে অক্টোবরে পুতুল সংসদ বসার পূর্বেই মুজিবকে হত্যা করা হবে।
আমি পাকিস্তানকে সাবধান করতে চাই যে তারা যদি চেষ্টা করে…..
( এসময় তাঁর বক্তব্যে বাধা পড়ে)
তাদের জন্য সতর্কবানী রইল, এর পরিনাম খারাপ, ভয়াবহ রকমের খারাপ হবে। ইয়াহিয়া খানের জানা উচিত যে তিনি যদি শেখ মুজিবের কোন ক্ষতি করেন, তাহলে বাংলাদেশে বসবাসরত ৪০ লক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ৫১/২ ডিভিশন সৈন্যের জীবন সংশয়ের মুখে পড়বে। শেখ মুজিবকে যদি হত্যা করা হয়, একজন পাকিস্তানী সৈন্য অথবা পশ্চিম পাকিস্তানী কোন কিছু বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে ফিরতে পারবেনা। সুতরাং বাংলাদেশে জিম্মি তার নিজেদের মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ইয়াহিয়া খান কোন ধরনের হটকারী পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকবেন বলে আশা করা যায়। এরকম কোন কিছু হওয়া অবশ্যই উচিত নয়, কিন্তু আমি সত্য বর্ণনা করছি মাত্র। তারা যদি শেখ মুজিবের কোন ক্ষতি করে, তাহলে ভয়াবহ রকমের পরিনতি নেমে আসবে। ইয়াহিয়ার এটা মনে রাখা উচিত যে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর হতে পারে, এবং এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী নিরপরাধ মানুষের জীবন সংশয় হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী আজ এখানে নেই। আমি তাঁকে কঙ্গোর নেতা লুমুব্বার জীবন রক্ষার্থে পন্ডিত জহর লাল নেহেরুর নেয়া পদক্ষেপগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আমি পন্ডিত নেহেরুর কন্যা, মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে শেখ মুজিবের নিরাপত্তা এবং মুক্তির জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানাই।
আমি সরকারের কাছে জানতে চাই অবিলম্বে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা। আমি আগেই বলেছি যে আমার মতে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং নিরাপত্তার জন্য এটিই হবে সর্বোত্তম পদক্ষেপ।
দ্বিতীয়ত আমি জানতে চাই শেখ মুজিবের মুক্তি ও নিরাপত্তা চেয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করে এই মহান সংসদ সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাশ করবে কিনা। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবের ক্ষতি করার সাহস পাবেনা।
তৃতীয়ত, আমি স্পীকারের কাছে অনুরোধ জানাই যে ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টারী ইউনিয়নের সভাপতি হিসাবে আপনি শুধুমাত্র বিরোধীদলীয় সাংসদদের নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করবেন। এই প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দেশে গিয়ে শেখ মুজিবের পক্ষে আন্তর্জাতিক মত তৈরির চেষ্টা করবেন।
চতুর্থত, আমি সরকারের কাছে জানতে চাই তারা রাশিয়ার সাথে সামরিক জোট গঠনের ব্যাপারে সংসদে কোন বক্তব্য দেবেন কিনা। আমি সরকারের কাছে জানতে চাই আমাদের বন্ধু গ্রোমিকো…..
(এসময় তাঁর বক্তব্যে বাধা পড়ে)
হ্যাঁ আমি তাঁকে বন্ধুই বলি কারন বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। আমি জানতে চাই শেখ মুজিবের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা এবং মুক্তির ব্যাপারে তাঁরা গ্রোমিকোর সাথে আলোচনা করেছেন কিনা। সর্বশেষে, আমি জানতে চাই প্রয়োজনে এই ব্যাপারটা সরকার জাতিসংঘ তুলে ধরবে কিনা।
শ্রী শরণ সিং: মাননীয় সাংসদ, শেখ মুজিবের প্রতি আপনার মত আমিও অত্যন্ত শ্রধ্ধাশীল। তিনি শুধু নির্বাচনে বিপুল বিজয় বা সমগ্র দেশের মানুষের নিরঙ্কুশ ভালবাসা পাননি, তিনি সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে সম্মান অর্জন করেছেন। একারনেই তাঁর ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন এবং ইয়াহিয়া খানের নেয়া বিচারের উদ্দোগের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। কিন্তু মাননীয় সাংসদ এমন কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছেন, যেগুলো আসলে এই প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। যেমন স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারটা।
শ্রী সমর গুহ: স্বীকৃতি দিলে আমরা বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্হাপন করতে পারব এবং তিনি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন। আইনগতভাবে এটি তাঁকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবে।
শ্রী শরণ সিং: এটি একটি আলাদা বিষয়। এখন এটি নিয়ে আলোচনা করে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে আমাদের অবস্হান দূর্বল করতে চাইনা। পরিস্হিতি যাই হোকনা কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত অবৈধ বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া।
তারপর উনি এই সংসদ থেকে একটি বিবৃতি চেয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি উনার সাথে সহমত পোষন করি। আমার মতে সর্বসম্মতিক্রমে পুরো সংসদের পক্ষ থেকে এরকম একটি বিবৃতি দেয়া হলে সেটি শেখ মুজিবের প্রতি আমাদের সম্পূর্ন সমর্থন বোঝাবে এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তার উপর শেখ মুজিবের মুক্তি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।
মাননীয় স্পিকারের কাছে উনি যে আবেদন করেছেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মাননীয় স্পীকারই নেবেন।
স্পীকার মহোদয়: আপনি আমাকে কি করতে উপদেশ দেন? আমার কি করা উচিত?
শ্রী শরণ সিং: এ ব্যাপারে আমি বলতে চাই যে, ভারতীয় সরকার ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে রাশিয়া সহ বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর সাথে আলোচনা করেছে। আমরা তাঁদের অনুরোধ করছি যে তাঁরা যেন পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকান্ড বন্ধ এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কার্যকর আলোচনা শুরুর পরিবেশ সৃষ্টি করার ব্যাবস্হা করেন।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি (গোয়ালিয়র): তাদের প্রতিক্রিয়া কি?
শ্রী শরণ সিং: বেশিরভাগ সরকারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে এব্যাপারে কথা বলবেন।
মাননীয় সাংসদের শেষ প্রশ্নের ব্যাপারে বলতে চাই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে ইতিমধ্যে একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে এই স্মারকলিপি জাতিসংঘের ভেতর এবং বাইরে যথেষ্ঠ প্রভাব ফেলবে। জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হবে কিনা সেই ব্যাপারে আরো চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে।
স্পীকার মহোদয়: এই প্রথম বারের মত স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি প্রশ্ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গটি আমি বিবেচনা করছি। ডঃ করণ সিং যদি আমাকে দুইটি জাম্বো জেট বিমান ধার দেন, তাহলে আমি পুরো সংসদকেই বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারি।
মাননীয় বিমান এবং পর্যটন মন্ত্রী (ডঃ করণ সিং): আপনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা মাননীয় স্পীকার।
স্পীকার মহোদয়: ঠিক আছে। আমার ইচ্ছাই উনার ইচ্ছা। আমি চেষ্টা করে দেখব আপনাদের জন্য একটি বিদেশ সফরের আয়োজন করা যায় কিনা। কিন্তু বিদেশ যেয়ে আপনাদের এক জিনিষ নিয়ে বসে থাকলে চলবেনা। আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে আগামী কনফারেন্স অফ ইন্টার পার্লামেন্টারী ইউনিটের সবগুলো সভা এবং কমিটিতে আমাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ইতিমধ্যে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
শ্রী পি. ভেঙ্কটাসুব্বাইয়া ( নান্দিয়াল): মাননীয় স্পীকার। এই ব্যাপারে আমার ছোট্ট একটি কথা বলার আছে। এই গুরুত্বপূর্ন ব্যাপারে হাস্যরস করা ঠিক নয়।
স্পীকার মহোদয়: সমস্ত বিস্তারিত সহ আই.পি.আই এর কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যৎে স্পীকারের উদ্দেশ্যে আর কোন প্রশ্ন করা হবেনা।
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): স্পীকার মহোদয়, আমি মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের শেষ বাক্যটি পড়তে চাই। তিনি বলেছেন:
” আমরা পাকিস্তান সরকারের এই প্রস্তাবের নিন্দা জানাই এবং তাদের সতর্ক করে দিতে চাই যে এপথে অগ্রসর হলে এর পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে। “
এই প্রথম বারের মত আমরা শুধু পাকিস্তানী সরকারের কর্মকান্ডে বিষ্ময় বা নিন্দা জ্ঞাপনই করিনি, ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণীও উচ্চারন করেছি। আমরা সামরিক স্বৈরাচার এবং তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভু আমেরিকার চরিত্র সম্পর্কে জানি এবং এটাও জানি যে ইয়াহিয়া সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার হাতের পুতুল ছাড়া কিছু নন। অতীতের করুন অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে পৃথিবীর অনেকগুলো সংগঠন রোসেনবার্গের মৃত্যুদন্ড বন্ধ করার দাবী জানিয়েছিল। কিন্তু তাতে কি হল? তার মৃত্যুদন্ড বন্ধ করা যায়নি। আমি জানি প্যাট্রিক লুমুম্বার কি হয়েছিল। তাঁকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা এও জানি মার্টিন লুথার কিংকে হত্যা করার পর কি করা হয়েছিল। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যেয়ে কেউ যখন শহীদ হয়, আমি তখন অবাক হইনা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের আমরা সম্মান দেই। কিন্তু আমার একমাত্র চিন্তা হচ্ছে শেখ মুজিবের প্রহসনের বিচারের পর তাঁকে যদি হত্যা করা হয়, তা হবে একই সাথে মানবতা, সংসদীয় গনতন্ত্র এবং বাংলাদেশে অসাম্প্রয়দায়িকতাকে ক্রুশবিদ্ধ করা।
আমি জানি যে যতক্ষন পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি শিশুও বেঁচে আছে, ততক্ষন পর্যন্ত সামরিক সরকার শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারবেনা। যেসব মানুষ যুদ্ধ করছেন, তাঁদের শক্তির উপর আমার আস্হা আছে। সামরিক বাহিনীর গুলিতে এখন পর্তন্ত ৬ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু তারা এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। মুক্তিফৌজ নতুন নতুন এলাকা দখল করছে এবং তাদের শক্তি দিনে দিনে বাড়ছে।
এই ঘটনার নিন্দা জ্ঞাপন, পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারী উচ্চারন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যোগাযোগ করা ছাড়াও আমাদের সরকারে উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয় নিষ্পত্তি করা।
ভারতের মানুষ এ ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? গতকাল একটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠান অংশগ্রহনের সময় আমার একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে এম.এন.কুমার মুখ্যার্জি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলেন।
আমরা সবাই, এমনকি আমাদের মন্ত্রীরাও জানেন যে অন্তরের অন্তঃস্হল থেকে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই। আজ ৯ ই অগাস্ট একটি ঐতিহাসিক দিন, এই দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লক্ষে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা সংগঠিত হয়েছিল। আজকের এই মহান দিনে আমি মাননীয় মন্ত্রীকে অনুরোধ করব গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতা রক্ষার্থে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে।
মাননীয় মন্ত্রী সাথে সাথেই বলবেন যে এই প্রস্তাব প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। কিন্তু শুধু এদিক-ওদিক আবেদন করে কিভাবে আপনি একটি দেশকে রক্ষা করতে পারবেন? স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কলের পুতুল, তারা ইয়াহিয়ার কিছুই হতে দেবেনা। ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে শেষ করে দিতে চাইবে কারন স্বৈরাচার সবসময়ই মনে করে ব্যাক্তিকে দমন করেই মতবাদকে ধ্বংস করে দেয়া যায়। আমি জানি যে তারা সফল হবেনা, কিন্তু চেষ্টা তারা অবশ্যই করবে।
মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন, বর্তমান অবস্হার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি তিনি পুনর্বিবেচনা করা করবেন কিনা।
যদিও আমি চুক্তির পুরোটা এখনো জানিনা, কিন্তু পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র-চীন জোটের বিপক্ষে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ গ্রোমিকোর সাথে আমাদের সরকারের যে জোট গঠিত হয়েছে সেটা জেনে আমি অত্যন্ত খুশি। এই ঐতিহাসিক দিনে চুক্তির সাথে জড়িত সকলকে অভিনন্দন। কিন্তু আমি জানতে চাই যে এই জোট গঠনের পরে পাকিস্তান এবং চীনের আক্রমণের ভয় না পেয়ে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে কিনা। আমি নিশ্চিত যে আমাদের আক্রমণ করার সাহস কারো হবেনা। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হলে আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতা সবই রক্ষা করতে পারব।
মাননীয় স্পীকার, আপনার মাধ্যমে আমি মাননীয় মন্ত্রীকে এই বিষয়ে আরেকটু বিশদ আলোচনা করার আহ্বান জানাই। আমি খুশি যে তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান মুজিবকে হত্যা করলে ঠিক কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সেটা পরিষ্কার করা বলতে হবে। এটা পাকিস্তান এবং দুনিয়ার মতের উপর ছেড়ে দেয়া যাবেনা। আমাদেরও অনেক বন্ধুরাষ্ট্র আছে। সমাজতান্ত্রিক শক্তি রাশিয়া আমাদের সাথে আছে। এটা প্রমাণিত যে আমাদের সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুরা আমাদের গম পাঠায়, পাকিস্তানকে পাঠায় অস্ত্র। কিন্তু রাশিয়া আমাদের প্রকৃত বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব আজ আরো শক্তিশালী হল। আমাদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে সাহসী হওয়া উচিত। শেখ মুজিবুর রহমানের দ্রুত মুক্তির ব্যাবস্হা করার জন্য আমি সরকার এবং বিশ্বনেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানাই।
শ্রী শরণ সিং: বাংলাদেশকে স্বীকৃতী দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অবস্হান অনেকবার ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এই মুহূর্তে এ নিয়ে আবার আলোচনা করা অপ্রয়োজনীয়। আমি এ ব্যাপারে কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে চাইনা। দ্বিতীয় প্রশ্নে উনি পাকিস্তান শেখ মুজিবকে হত্যা করলে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সেটা পরিষ্কার করে বলতে বলছেন। আমি মনে করি এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা।
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : আমার প্রশ্নের পুরো উত্তর দেয়া হয়নি। চুক্তির ব্যাপারে কি হল?
( তাঁর বক্তব্যে বাধা পড়ে)। আমরা রাশিয়ার সাথে একটা চুক্তিতে এসেছি
(বক্তব্যে আবার বাধা পড়ে)
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : চুক্তির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানিনা।
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: আমি জানতে চাই কোন চুক্তি হয়েছে কিনা এবং চুক্তি হয়ে থাকলে সেই ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য চাই।
স্পীকার মহোদয়: মাননীয় মন্ত্রী চুক্তির ব্যাপারে এখনো কোন বক্তব্য দেননি।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানিনা।
স্পীকার মহোদয়: তিনি এ ব্যাপারে পরে বক্তব্য রাখবেন।
( তাঁর বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : বাংলাদেশকে নিয়ে বাইরে অসংখ্য সভা-সমাবেশ হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা তাদের কিছুই বলতে পারছিনা।
( বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)
স্পীকার মহোদয়: অর্ডার, অর্ডার। শ্রী এইচ.এম.প্যাটেল।
শ্রী এইচ.এম.প্যাটেল( ধানদুকা): মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য এবং শ্রী সমর গুহের প্রশ্নের উত্তরে তাঁর দেয়া ব্যাখ্যার পর আমি আর বিস্তারিত কিছু বলার প্রয়োজন দেখিনা। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই মুহুর্তে সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয়, যদিও আমাদের অনেকেই মনে করছেন যে এখনই স্বীকৃতি দেয়াটা জরুরী। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন, এ ব্যাপারে সমগ্র সংসদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে তিনি কি একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবেন কিনা। এরকম একটি বিবৃতি দেয়া হলে সেটা কিছুটা হলেও গুরুত্ব বহন করবে। যদিও এই গুরুত্বের পরিমাণ কতটুকু হবে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পাকিস্তান এবং ইয়াহিয়া খান সবসময়ই যুক্তিবোধের বাইরে আচরণ করে আসছে। তারপরেও এই ব্যাপারে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি মন্দের ভাল হিসাবে কাজ করবে।
শ্রী শরণ সিং: এই মহান সংসদে আমার বক্তব্যের পর বিভিন্ন দলীয় সাংসদদের প্রতিক্রিয়া শোনার পর আমার মনে হয়েছে যে সার্বিক ভাবে সবাই আমার বক্তব্য সমর্থন করছেন। আমি ইতিমধ্যে বলেছি এই অবস্হান সমর্থন করে সংসদ যদি একটি প্রস্তাব পাশ করে, তাতে আমার আপত্তি নেই।
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি: তাহলে সেটাই করুন। আপনি প্রস্তাবটা উত্থাপন করতে পারেন না?
(তাঁর বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি : আমরা সবাই মিলে ইতিমধ্যে একটা বিবৃতি দিয়েছি। সেটার কি হল? আরেকটা বিবৃতি দিয়ে কি হবে?
(বক্তব্যে বাঁধা পড়ে)
স্পীকার মহোদয়: মিঃ ব্যানার্জি, সব সময় ফ্লোর কেড়ে নেবেন না। এটা খুবই খারাপ। শ্রী পি.আর.দাস মুন্সি।
শ্রী পি.আর.দাস মুন্সি (কলকাতা দক্ষিণ): মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্যের উপর আমি বলতে চাই যে এটা অত্যন্ত খুশির ব্যাপার যে সরকার একদম সঠিক সময়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেছে।
এই ব্যাপারে এখন আমি আমাদের গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করতে চাই। ১৯২৪ সালে আমাদের এক মহান নেতা নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু যখন গ্রেফতার হন, তখন আরেক মহান নেতা সি.আর.দাস বলেছিলেন যে দেশের জন্য স্বাধীনতা চাওয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে তিনি অপরাধী।
ভারতীয় জনগন এবং সারা বিশ্বের অগণিতগনতন্ত্রকামী মানুষদের জন্য এখনই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থনে সি.আর.দাসের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করার। আমরা যে সত্যের পথে আছি এবং আমাদের হৃদয়কে অনুসরন করছি এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই।
আমরা জেনেছি যে সরকার এ ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগের কথা অন্যান্য দেশগুলোকে জানিয়েছে এবং পাকিস্তান সরকারের উপর নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেছে। এই আলোচ্য বিষয়ে আমি মাননীয় মন্ত্রিকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।
সম্প্রতি আমরা দুটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র মঞ্চস্হ হবার ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। তার একটির পেছনে আছেন পিকিং এ কিসিন্জার এবং চৌ এন লাই, অন্যটি রচনা করছেন ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া এবং কিসিন্জার। আমি জানতে চাই সরকার কি এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে অবহিত আছে কিনা। কিসিন্জার এবং চৌ এন লাই বৈঠকের পরে নিক্সন প্রশাসন এই অঞ্চলে তাদের অশুভ প্রভাব বিস্তার করছে এবং ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছেন। যদিও ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে হুমকি দিচ্ছেন, কিন্তু তিনি আদপে নিক্সনের পালকপুত্র ছাড়া আর কিছু নন। এই অঞ্চলের ব্যাপারে নিক্সন ইয়াহিয়ার পরামর্শ মেনে চলেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
এরপর আমি একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় উত্থাপন করতে চাই। আমরা ইতিমধ্যে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছি এবং সম্ভবত পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেছি। আমি বিশ্বাস করি শেখ মুজিবকে হত্যার হুমকি দেয়ার মাধ্যমে ইয়াহিয়া শুধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষনা করেননি, ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন। কারণ ভারতের জনগন এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের সাথে সম্পূর্ণরুপে একাত্নতা প্রকাশ করে।
ইয়াহিয়া খান যদি মুজিবুর রহমানের কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করেন, তাহলে কি আমাদের সরকার বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর নগ্ন আগ্রাসনের প্রতিবাদে সমগ্র ভারতের মানুষকে, বিশেষ করে তরুণসমাজকে মুক্তিফৌজে যোগ দেয়ার আহবান জানাবে?
আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে এই দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর চাই।
শ্রী শরণ সিং: পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং তাদের সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সার্বিক অবস্হানের বিরোধিতা করে আমরা জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেছি এবং আমাদের তীব্র প্রতিবাদ ব্যাক্ত করেছি। ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে আমি সংসদকেও অবহিত করেছি।
জনগনকে মুক্তিফৌজে অংশ নেয়ার আহবান জানানোর ব্যাপারে উনার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে চাই যে এটি মূলত রাজনৈতিক উদ্দোগের ব্যাপার, সরকারী নয়।
শ্রী পি. ভেঙ্কটাসুব্বাইয়া: মাননীয় সাংসদদের দ্বারা পেশকৃত স্মারকলিপিতে সমগ্র ভারতবাসীর পক্ষ থেকে আধুনিক যুগের নাদির শাহ ইয়াহিয়া খান কতৃক বাংলাদেশের জনগনের উপর চালানো অত্যাচার এবং বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। নিপীড়ন বন্ধ করতে ইয়াহিয়াকে চাপ দেয়ার জন্য আমাদের সরকার বিভিন্ন বিদেশী শক্তিকে অনুরোধ করেছেন। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করবেন না। মালয়শিয়ার টুংকু আব্দুর রহমান, যিনি কিছুদিন আগেও আমাদের অতিথি হয়েছিলেন, সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে তার দেয়া বক্তব্যে শুনে মনে হয়েছে গনহত্যা বন্ধে ইয়াহিয়াকে চাপ দিতে তিনি অনিচ্ছুক। এই সন্ধিক্ষণে ইয়াহিয়া খান পিকিং এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দালাল হিসাবে কাজ করছেন এবং এই সাহসেই তিনি শেখ মুজিবকে হত্যা করার হুমকি দিতে পেরেছেন। যুক্টরাষ্ট্র দাবী করে তারা সমতা এবং ভাতৃত্বে বিশ্বাসী, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা এডওয়ার্ড কেনেডির মত বিশিষ্ট সিনেটরের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে এই নির্মম নিপীড়ন চালাতে পাকিস্তানকে সাহায্য করে যাচ্ছে। এমতাবস্হায় আমি জানতে চাই যে মাননীয় মন্ত্রী পরাশক্তিগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানকে চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে এখনো আশাবাদি কিনা। ঘটনাবলী এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে পরাশক্তিগুলো শুধু মাত্র নিজেদের স্বার্থ নিয়ে চিন্তিত, মানবতার ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। আমাদের সাথে এখন রাশিয়া আছে, যারা সবরকম প্রয়োজনের সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি জানতে চাই রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় মাননীয় মন্ত্রী ইয়াহিয়া খানের কর্মকান্ড জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সামনে উপস্হাপন করবেন কিনা।
শ্রী শরণ সিং: কিছু দেশের আচরনের ব্যাপারে মাননীয় সাংসদ যে মন্তব্য করেছেন, তা সঠিক। আমি খোলাখুলিভাবে বলতে চাই যে, আমার ধারনা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিঃ পোডগোরনি এবং আর অল্প কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রতিনিধিরা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে এ ব্যাপারে আদৌ কোন পদক্ষেপ নেবেন না।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি: কোন কোন দেশ ব্যাতিক্রম?
শ্রী পিল্লু মোদি (গোধরা): আর তারা কতটুকি সম্মানিত?
শ্রী শরণ সিং: কিছু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে যেন এই রাষ্ট্রগুলো নিজেদের যতটুকু প্রভাব আছে সেটা খাটিয়ে ইয়াহিয়াকে আরো ধ্বংসযজ্ঞ চালানো থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে।
কার্যকরনের ব্যাপারে মাননীয় সাংসদ জানতে চেয়েছেন যে ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্হা এবং জাতিসংঘে তোলা হবে কিনা। অবশ্যই ব্যাপারটা সেখানে উত্থাপন করা যায়, উপযুক্ত সময়ে এটি উল্লেখিত সংস্হাগুলোতে তুলে ধরার ইচ্ছা আমাদের আছে।
১২ আগষ্ট, ১৯৭১
জবাব:পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানের কতিথ বিচার
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি (কানপুর): মাননীয় স্পীকার। আজ সকালে আপনার মাধ্যমে আমি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার ব্যাপারে বক্তব্য দিতে অনুরোধ করেছিলাম। আমি জানি অধিবেশন প্রায় শেষের দিকে এবং এখন ব্যাপারে একটি সমাধানে আসা সম্ভব নয়। তবে যেহেতু মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী এখানে উপস্হিত আছেন এবং শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সকল রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি ইতিমধ্যে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, সেহেতু তিনি যদি সংসদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য দিলে সারা পৃথিবী জানবে যে এই সংসদ শেখ মুজিবের ব্যাপারে আর সকলের মতই উদ্বিগ্ন এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় সহায়তায় শেখ মুজিবকে হত্যা প্রচেষ্টা রুখে দিতে চায়। শেখ মুজিবের মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতার মৃত্যু ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে একটি বক্তব্য দিতে আমি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।
প্রধানমন্ত্রী, আনবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: মাননীয় স্পীকার, আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা সংবাদের ব্যাপারে মাননীয় সাংসদদের গভীর উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা সম্পূর্নরুপে উপলব্ধি করতে পারছি।
আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি যে তাদের মত সরকারও উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্হ। মাননীয় সাংসদের শেষ বাক্যটির সাথে আমি একমত নই, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম বন্ধ হবার নয়। কারন আমরা জানি যে শহীদের মৃত্যু মানুষকে অমরত্ব দেয়। এধরনের ঘটনা আন্দোলনকে দূর্বল করার পরিবর্তে শক্তিশালী করে। বিশ্বের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, কতৃপক্ষ যত বেশী দমন-পীড়ন চালায়, আন্দোলন-সংগ্রাম তত দূর্বার হয়ে ওঠে।
আমরা সবসময়ই খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি। এই খবরটি ইউনাটেড প্রেস থেকে পাওয়া, মাননীয় সাংসদরা চাইলে এটি বিশ্বাস করতে পারেন, আবার নাও পারেন।
” গতকাল নির্ধারিত দিনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে পাকিস্তানী কর্মকর্তারা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। “
এ ব্যাপারে আমরা আর কোন খবর পাইনি, পাকিস্তানী রেডিওতেও কোন ঘোষণা নেই। এই মাত্র আমরা বন্যা-খরার মত প্রাকৃতিক দূর্যোগ নিয়ে আলোচনা করছিলাম, যা বছরের পর বছর মানুষের কষ্টের কারন হয়ে আসছে। কিন্তু এটি মনুষ্যসৃষ্ট দূর্যোগ, প্রাকৃতিক নয়। আমি আগেই বলেছি, আমি শুধু স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার হরণের ব্যাপারে চিন্তিত নই, এই ঘটনা ভারতের উপর যে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে সেটিও আমার চিন্তার কারণ।
আমি বুঝতে পারছি যে মাননীয় সাংসদরা সরকার থেকে আরো বেশী কিছু চাইছেন। অনেক সাংসদ বিভিন্ন বিদেশী সংসদ এবং সংস্হাকে চিঠি লিখে বিভিন্ন বিষয় অবহিত করেছেন। সরকারী পর্যায়েও আমরা জাতিসংঘ মহাসচিব মিঃ ইউ থ্যান্টের সাথে কথা বলেছি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের জীবন বাঁচানোর উদ্দোগ নেয়ার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। আমি জানি অনেক সাংসদ মনে করেন যে সমগ্র সংসদের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি আসা উচিত। এরকম একটি বিবৃতির ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের অনুভূতির পুনঃপ্রকাশ করা ছাড়া এই বিবৃতি আর কোন কাজে আসবেনা। আমরা জানি যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আমাদের বিবৃতি অথবা বিশ্বের অন্যান্য দেশ কি বলল তার তোয়াক্কা করেনা। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু দেশের সরকারের চাপে কাজ হতে পারে এবং আমাদের সেই লক্ষেই চেষ্টা করে যেতে হবে।
আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে আমরা কিছু করলে সেটা ক্ষতির কারণও হতে পারে। পাকিস্তানি জান্তা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে শেখ মুজিব ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ করছেন এবং ভারত তাকে মদদ দিচ্ছে। ভিত্তিহীন নানা রকমের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আসলে….
শ্রী এস.এম.ব্যানার্জি : এগুলো সব মিথ্যা কথা।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: সবই মিথ্যা কথা। কিন্তু আমাদের এমন কিছু করা উচিত হবেনা যাতে করে এই প্রোপাগান্ডা বিশ্বাসযোগ্য হয় এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যায়।
আমি মাননীয় সাংসদদের আরেকটি কথা বলতে চাই। আমরা মাঝে মাঝে বক্তব্যে পশ্চিম পাকিস্তান শব্দটি ব্যাবহার করি। আমাদের সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানি জনগনকে আলাদা রাখা উচিত, তাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই
( তাঁর বক্তব্যে এসময় বাধা পড়ে)।
আমাদের বিবাদ পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সাথে যারা নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করছে, তাদের ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক অধিকার দিচ্ছেনা। একই কাজ তারা পাকিস্তানের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের সাথেও করছে। এখন আমরা অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। অধিবেশন শেষ করার আগে আমরা শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশের দূর্ভাগা মানুষদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে চাই। বাংলাদেশ সম্ভবত উপমহাদেশের যেকোন অঞ্চলের তুলনায় সবচেয়ে বেশী বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে। সেই মানুষেরাই আজ অত্যন্ত কষ্টে আছে।
আমি আগেই বলেছি শেখ মুজিব শুধু একজন ব্যাক্তি নন। আমাদের প্রত্যেকটা ব্যাক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত, কিন্তু আজ শেখ মুজিব
( তাঁর বক্তব্যে এসময় বাঁধা পড়ে) পুরো বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্খার, ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
এই বক্তব্যের সাথে সাথে আমি সংসদ অধিবেশন শেষ করতে চাই। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, কিন্ত এটি সময়ের চাহিদা।
শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র (বেগমসরাঁই): শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে আপনি যেসব বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করেছেন, তাদের প্রতিক্রিয়া কি?
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: কিছু রাষ্ট্র বলেছে তারা বিষয়টি বিবেচনা করবে এবং কিছু রাষ্ট্র ইতিমধ্যে বিষয়টি বিবেচনা করেছে।
শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র: ইউ থ্যান্ট এ বিষয়ে এখনো কোন উদ্দোগ নেননি?
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: মাননীয় সাংসদ অবশ্যই ইউ থান্টের বিবৃতিটি পড়েছেন। এটি আজ সকালের সংবাদপত্রে এসেছে। আমি জানিনা এটি সম্পূর্ন বিবৃতি কিনা, কিন্তু এটি মাননীয় সাংসদদের পরিস্হিতির জটিলতা সম্পর্কে ধারনা পেতে সাহায্য করবে। অন্যান্য বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের দূর্বল দিকগুলো সম্পর্কে আমাদের ধারনা হয়েছে।
শ্রী পি. ভেঙ্কটাসুব্বাইয়া ( নান্দিয়াল): অন্তর্গ্রথিত দূর্বলতা।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী: আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে এই মুহূর্তে ঠিক কি করলে তা শেখ মুজিবের সাহায্যে আসবে। এই দুর্যোগমুহূর্তে পুরো সংসদ যেভাবে একাত্নতা এবং সংহতি প্রকাশ করেছে, আমি তাতে গর্ববোধ করছি। আমরা শুধু শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারেই আগ্রহী নই, আমরা মনে করি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কর্মকান্ড শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের মানুষের জীবনেই নয় বরং সমগ্র পৃথিবীতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। যেসব সরকার পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সাহায্য করছে, পরবর্তীকালে এ ঘটনার প্রভাব তাদের উপরেও পড়বে। এই হত্যাযজ্ঞ তাদেরও কোন উপকারে আসবেনা।
স্পীকার মহোদয়: সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি ঘোষণা করা হল। সবাই শান্তিতে ছুটি কাটান, নভেম্বরের কোন সময় আবার সংসদ অধিবেশন বসবে।
১৯:২১ ঘটিকা
সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি হল।