You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.02 | বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য উত্থাপিত প্রস্তাবের ওপর আলোচনা | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরনি - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২২। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য উত্থাপিত প্রস্তাবের ওপর আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরনি ২ জুলাই ১৯৭১

 

পুনঃরেজোলিউশন – বাংলাদেশকে স্বীকৃতি

জনাব ডেপুটি স্পিকার: এখন আমরা শ্রী সমর গুহর রেজল্যুশন নিয়ে আগাব। এর জন্য দুই ঘন্টা বরাদ্দ। এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। সুতরাং, শুধুমাত্র ৩০ মিনিট বাকি।

শ্রী এস এম বানেরি (কানপুর): আমার একটি আনুষ্ঠানিক সংশোধনী আছে। আমি ৩০ জুন তারিখ দিয়েছিলাম এই ভেবে যে সেদিন আলোচনা শেষ হবে। কিন্তু হয়নি। তাই আমার সংশোধনী ৩০ জুন ১৯৭১ কে ১৫ জুলাই ১৯৭১ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হোক। এটা প্রচার করা হোক।

জনাব. ডেপুটি স্পিকার: আমি মনে করি যে এটা কারণিক বিষয়। আপনার কি কোন ফ্রেশ সংশোধনী আছে?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আমি আমার সংশোধনী বিকাল ৩ টায় জমা দিয়েছি।

জনাব. ডেপুটি স্পিকার: আপনার আরেকটি সংশোধনী আছে, নং ৫। আপনি কি এটা মুভ করবেন?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: হ্যাঁ।

আমি আবেদন জানাচ্ছি।

শ্রী এস এম ব্যানার্জীর স্থানান্তরিত সংশোধনী, প্রিন্ট করা আছে ২, তালিকা নং ১-

“৩০-৬-১৯৭১” এর জন্য
বিকল্প “১৫-০৭-১৯৭১”

শ্রী এইচ এম প্যাটেল (ধান্দুকা): প্রথমে আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করতে চাই যখন সরকারি মুখপাত্র বলে যে যেসব উদ্বাস্তু ভারতে ঢুকেছিল তাদের ফেরত পাঠানো হবে, তারা নিশ্চই ফিরে যাবে – ইত্যাদি কথা দিয়ে সরকার কী বোঝাতে চান? এটা অর্জন করার জন্য তাদের প্রস্তাবনা কি? তাদের কি কোন রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পরিকল্পনা আছে? এর মানে হতে পারে মুজিবুর রহমান ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের মধ্যে বোঝাপড়া। যতক্ষণ না এই দুইএর মধ্যে সরকার ও প্রশাসনের কিছু ফর্ম প্রতিষ্ঠা করা যায় ততক্ষণ উদ্বাস্তুদের সেখানে ফিরে যাবার সম্ভবনা নেই। কিন্তু একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কি আছে? কেউ এই নিষ্পত্তির কথা বলছে? বিশ্বশক্তিগুলো এটা নিয়ে কথা বলছে? তাদের বিবৃতিতে উল্লেখিত হয়েছে যে, তারা একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি চান। আমরা কেন এই ধরনের একটি প্রস্তাবে আমাদের সমর্থন দেব? আমরা কি সন্তুষ্ট যে, এই ধরনের সমাধানের সম্ভবনা আছে?

আমাদের দুটি বিকল্প আছে। তাদের রেফার করা পদ্ধতিতে আমরা সমাধানের দিকে আগালাম – এতে করে উদ্বাস্তুরা কিছুটা আশা হয়ত পাবে। অথবা আমরা আমাদের নিজেদের মত করে আগালাম। এখন কোন পথটি দীর্ঘ মেয়াদে ভালো। আমরা জানিনা। কেন এটা পরিষ্কার নয়? এটা কি মিলিটারি একশনের জন্য? যদি তা না হয় তবে সরকারের মনে কী আছে?

আমি আশঙ্কায় আছি যে আমাদের সামনে একটা পথ আছে – সেটা হল আমরা যা বলছি সেটাকে একটা কাঠামোতে দাঁড় করানো। বলতে গেলে আমরা একাই এটা করব। সমস্ত বিশ্বকে বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ যে আমরা কাজের কাজই করছি। এবং বিশ্বাস করতে শুরু করি যে পয়েন্ট আসবে, খুব দ্রুতই আসবে, যখন আমরা সামরিক কায়দায় আগাব, এমন না যে আমরা তেমনটা চাই। কারণ কেউ যুদ্ধ নিয়ে চিন্তিত না – আর আমাদের অন্য কোন পথ নেই। এটা উভয় ফ্রন্টের জন্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আমাদের কি আর কোন বিকল্প আছে?

যদি এখানে বাংলাদেশর স্বীকৃতি প্রস্তাব করা হয় এটা শুধুমাত্র একটি প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। এটা শুধুমাত্র একটি পদক্ষেপ যে আমরা বলতে পারি যে, আমরা একটি সরকারকে স্বীকার করে নিচ্ছি। যদিও এটা কোন অঞ্চলের দায়িত্বে নেই কিন্তু এটা ঐ অঞ্চলের মানুষের দ্বারা স্বীকৃত। তাদেরকে তাদের অঞ্চল থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। স্বীকৃতি আমাদেরকে কাজ করার জন্য একটা সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করবে। কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি প্রস্তাবনা। প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে সামরিক একশন। আমাদের মনে রাখতে হবে এই একশন ছাড়া স্বীকৃতি দিয়ে কোন লাভ হবেনা।

যখন প্রধানমন্ত্রী হাউসের মধ্যে একটি রেজল্যুশন দিয়েছিলেন সেটা সর্বসম্মতিক্রমে পাস করেছি। কেন আমরা সবাই সেটা মেনে নিয়েছি? কারণটা হল আমরা জানি কিছু উদার মানুষকে নির্দয়ভাবে শোষণ করা হচ্ছে। কারণ তারা একটি অবাধ নির্বাচনে তাদের মতামত দিয়েছিল এবং আমরা মনে করি যেকোন গণতান্ত্রিক বিচারে তারা সরকার গঠন করার অধিকার রাখে। কিন্তু তাদের জোর পূর্বক দমন করা হচ্ছে এবং আমাদের মনে হয়েছে যে, আমাদের তাদের পাশে থাকা উচিৎ। আমরা কীভাবে সেটা করতে পারি? এই অবস্থায় হয়ত আমরা ভেবেছি একটু সহানুভূতিই যথেষ্ট হবে। কিন্তু যখন উদ্বাস্তুরা আমাদের বর্ডারে আসতে লাগল তখন সবাই বুঝতে পারল এটা শুধুমাত্র পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এমনকি কেউ যদি খুব বেশী আইনের কথাও বলেন। এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং ভারত এতে আক্রান্ত এবং ভারতকেই কাজ করতে হবে।

অনেকে সুপারিশ করেন যে আমাদের উচিৎ আমাদের বর্ডার বন্ধ করে দেয়া। কীভাবে আমরা তা করব? আমরা কীভাবে পাকিস্তানের মত নির্দয় হতে পারি? তাই ঐ প্রস্তাব না মেনে আমরা তাদের প্রবেশ করতে দিলাম। কিন্তু প্রবেশ করতে দেবার পরেই আমাদের দায়িত্ব আসল আমরা শুধু তাদের দেখাশোনা করলেই হচ্ছেনা – কারণ তাদেরকে তো আর চিরদিন এভাবে রাখা যাবেনা – তাদের নিরাপদে দেশে ফিরে যাবার ব্যাবস্থাও করতে হবে। আর তা করার একমাত্র পথ হল শেখ মুজিবুর ও তার সমর্থকদের নেতৃত্বের সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করা অথবা মিলিটারি একশন। এর মধ্যে কোনটা বাস্তবসম্মত? সেই পথে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রথম স্টেপ হতে পারে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে মিলিটারি একশন অনিবার্য – অতএব আমাদের খুব দ্রুত স্বীকৃতি দিতে হবে।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: এখনও প্রায় ১২ জন এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে চান। এবং মাননীয় মন্ত্রী ও যিনি প্রস্তাবকারী তাদেরকে জবাবও দিতে হবে। এত কিছু ২০ মিনিটে সম্ভব না। তাই আমি বিষয়টি সম্পর্কে হাউজের মত চাই।

আমরা ৫ টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখি কি হয়।
সংসদ বিষয়ক এবং শিপিং ও পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রী(শ্রী রাজ বাহাদুর): আমরা প্রস্তাবক এবং মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই জবাব দিতে তাদের কত সময় প্রয়োজন হবে। অবশিষ্ট সময় আলোচনা করতে দেওয়া যাবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): আমার ১৫ মিনিট সময় লাগতে পারে।

শ্রী এস এম বানেরি: আমরা ৫ টা ২৫ মিনিটের ব্যাপারে সম্মত। তিনি মাত্র ১৫ মিনিট সময় নিতে চান। তিনি এটা সম্পর্কে কিছুই বলতে চাচ্ছেন না। তাকে অন্তত ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতি সম্পর্কে কিছু বলতে দেয়া যাক। তিনি সে বিষয়ে নীরব থাকতে চান।

শ্রী সমর গুহ: আমার ২৫ মিনিট প্রয়োজন হবে।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: মন্ত্রী এবং প্রস্তাবক মোট ৪০ মিনিট সময় লাগবে বলেছেন। এর আলোকে বাকি বিতর্ক আমাদের এডজাস্ট করতে হবে।

শ্রী দীনেশচন্দ্র গোস্বামী (গৌহাটি): বাংলাদেশ বিষয়টি দেশের প্রতিটি নাগরিকের মনে আছে। এমনকি এই হাউজে আমরা আশা, রাগ, হতাশা, হতাশা, ক্ষোভ এবং নানা রকম অভিব্যক্তি পেয়েছি। এছাড়া এই হাউজে একটি অনুভূতি কাজ করছে – আমি এটা সঠিকভাবে টের পাচ্ছি – তা হল বিশ্বশক্তিগুলো প্রত্যাশিত পদ্ধতিতে এগিয়ে আসিনি – তাই আমাদের নিজেদেরই কিছু সিদ্ধান্তে যেতে হবে। আমি অনুভব করতে পারছি এতে করে যার জন্য আমরা যুদ্ধ করছি সেটা একটু পরাভূত হবে।

১৯৫৩ সাল থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শক্তি ও সর্বগ্রাসী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এই বাহিনী সমানভাবে সুষম। পশ্চিমা শক্তির সাহায্যে সর্বগ্রাসী বাহিনী সবসময় গণতান্ত্রিক শক্তিকে চূর্ণ করেছে। এই জন্য ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একটি প্রস্তাব পাস করে। যতদূর জানা যায় তা জোটনিরপেক্ষ নীতি ছিল। পশ্চিমা শক্তিগুলো উপলব্ধি করেছে যে, যদি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মুক্তির উপায় পেয়ে যায় তাহলে এই অংশে পশ্চিমাদের আধিপত্য শেষ হয়ে যাবে। অতএব, তাদের নিজস্ব স্বার্থে তারা একটি নীতি অবলম্বন করছে যা আমাদের পছন্দ না। এই কারণে এমনকি ব্রিটিশ সরকারও বলছে যে, এটি বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

পশ্চিমা শক্তির এই প্রতিক্রিয়ার কারণে তাদের সাথে আলোচনায় গেলে সেটা আমাদের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত হবে।

বিভিন্ন মুড এবং অনুভূতির কারণে কিছু ভুল পন্থা ইতোমধ্যে জায়গা নিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ইস্যু’ তে আমাদের কেউ কেউ অনুভব করে যে অর্থনৈতিক বিষয়টি সমাধান করাই মূল সমস্যা – সেটি সমাধান হলে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি অনুভূতি হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যার বিষয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব যা করার তা করব তাতে করে সেটা মুজিবুর রহমান গ্রহণ করুন বা না করুন। যদি আমরা মনে করি যে, শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশের নিজেদের সমস্যা তাহলে তা হবে চরম ভুল। এই জন্য আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রত্যেক বার বলেছেন যে আমরা বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করব।

রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা কি বোঝানো হয়? এমন সমাধান যা মুজিব ও তার অনুসারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য। তৃতীয় প্রশ্ন হল, এই বিতর্কের কোন অংশ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন? প্রশ্ন হল আমরা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দান করব কিনা? আমি যতদূর জানি যে স্বীকৃতি একটি আইন দ্বারা পরিচালিত ব্যাপার নয়, এটা একটা পলিসি। তাছাড়া স্বীকৃতি শুধু সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়, আইনি কর্তব্য সম্পাদনের পর অর্জিত কোন ফল নয়। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ অনুসারে হতে হবে। যদিও এটা নীতির ব্যাপার, তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে আন্তর্জাতিক কিছু নির্দিষ্ট শর্ত এর উপর প্রযোজ্য। সেগুলো হল – প্রথমত; একটি স্বাধীন সরকার ব্যাবস্থা থাকা, দ্বিতীয়ত, সেই সরকারের কার্যকর কর্তৃত্ব জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ মেনে চলবে, তৃতীয়ত, নির্দিষ্ট অঞ্চল থাকা। সংক্ষেপে বাহ্যিক স্বাধীনতা এবং একটি যুক্তিসঙ্গতভাবে সংজ্ঞায়িত অঞ্চল ও সরকার ব্যাবস্থা অপরিহার্য।

যতক্ষণ এগুলো উপস্থিত থাকে – অথবা বলা যায় – যদি কোন জাতি স্থায়িত্ব ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার এই শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে এটা সাধারণত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত এমন কাউকে স্বীকৃতি দেয়া বন্ধুসুলভ কাজ নয়। বলতে গেলে এটা এক রকমের হস্তক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক কর্তব্যে অবহেলা স্বরূপ।

অতএব, যখন আমরা স্বীকৃতি দেব তখন দেখব প্রাথমিক বিষয়গুলি উপস্থিত আছে কিনা। অকাল স্বীকৃতি শুধুমাত্র পাকিস্তানকে সমস্যার গুরুত্ব অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে সাহায্য করবে এবং মুক্তিকামী যোদ্ধাদের অপ্রত্যাশিত দিকে ধাবিত করবে। এর মানে এই নয় যে আমি স্বীকৃতির বিরোধিতা করছি। আমি মনে করি, যদি আমরা স্বীকৃতি দান করতে যাই তবে আমাদের তিনটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে কিনা তা দেখতে হবে। প্রথমত, আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলকে বৈধতার টিকিট দেব যাতে অগণতান্ত্রিক শক্তি, আভ্যন্তরীণ ও বহিস্থিতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত আমরা সচেতন যে স্বীকৃতির প্রশ্নে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও, এটি সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে, ইয়াহিয়া খানের বাংলাদেশে ইচ্ছাকৃত অগণতান্ত্রিক নকশা প্রণয়নের প্ল্যান স্থবির করে দেবে।

তাই স্বীকৃতি দেবার আগে শর্তগুলো আছে কিনা দেখতে হবে। যদি আমরা দেখি যে সবগুলো বিষয় নেই তবে আমি মনে করি এখনো স্বীকৃতি দেবার সময় হয়নি। তবে আমাদের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে এগুলো পূরণ হয়।

এই কথাগুলো বলে আমি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছি।
শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত (আলিপুর): জনাব ডেপুটি স্পিকার, স্যার।

সর্ব প্রথম আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে চাই এতে আমাদের কোন উপকার হবে কিনা। অবশ্যই, এই ধরনের কথা তাঁর দলের এক সদস্য বলেছেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গৃহীত হবার মত বিষয়গুলো উপস্থিত আছে কিনা – একটি বিশেষ সরকার স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য কিনা সেগুলো দেখতে হবে- অন্যথায় আমরা এমন কিছু করতে চাইনা যা বিরক্তিকরভাবে প্রকাশিত হয়। আমি এটা বলার জন্য দুঃখিত। কিন্তু কেউ যদি এটিকে মানদণ্ড ধরে যুক্তিতর্ক করতে চায় এবং আন্তর্জাতিক আচরণের নীতি মানে সেক্ষেত্রে মাননীয় মন্ত্রী খুব ভালভাবেই জানেন যে প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সেভাবে তা মেনে নেবেনা। ইসরায়েল, যা পাকিস্তানের চেয়ে ছোট, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত একটি প্রস্তাবে তাকে বলা হয়েছিল ঐ অঞ্চলের সামরিক দখল ছেড়ে দিতে। কিন্তু ইসরাইল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সেই সিদ্ধান্তকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ করেনি। বিশ্ব কি এটা সম্পর্কে কিছু করতে সক্ষম হয়েছে?

জাতিসংঘ একাধিকবার সুপারিশ করেছে যে, কেউ দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্ত্র বিক্রয় করবেন না। অথচ যুক্তরাজ্য সরকার দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্ত্র বিক্রি করে যাচ্ছে। আপনি এটি সম্পর্কে কিছু করতে পারেন? সুতরাং, আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে এবং দেখুন আমরা কেমন বিশ্বে বাস করছি। শুধু কাল্পনিক এবং তাত্ত্বিক নীতির কথা বলে লাভ নাই। বরং স্বীকৃতি দেবার আগে সাধারণ শর্তগুলো পূরণ করা জরুরী। বিশ্ব তেমন কোন স্থান না। আপনাকে নিজের জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি উদারতা দেখানোর বিষয় নয়। আমি চাইনা আপনি বিষয়টা সেভাবে দেখুন। আমি চাই আপনি এটা আমাদের নিজের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন। শুধুমাত্র এটাই নির্ণায়ক এবং আমাদের সরকারের মুখপাত্রদের এটাই বলতে বলা হয়। যখন তারা বলে যে তারা চাপে পড়ে কাজ করছে – তারা আসলে ক্রুদ্ধ হয়ে বলে। “আমরা কখনোই চাপে ছিলাম না। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করব”। এখন এটা পরীক্ষা করার সময়। আমরা দেখতে চাই তারা এখন কি করে।

গত সোমবার থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। দুটি জিনিস তৈরি হয়েছে যার জন্য সরকার অনেক দিন অপেক্ষা করেছেন। একটি হল ইয়াহিয়া খানের ঘোষনা। এর বিস্তারিত আমি বলার দরকার মনে করছিনা। চিন্তার ধারা এখন পাল্টে যাবে। আমাদের এখন রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করতে হবে ও অন্যান্য সরকারকে চাপ দিতে হবে যাতে করে ইয়াহিয়া খান একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়। এখন তিনি তার সম্প্রচারে বলেছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক শাসন অব্যাহত থাকবে। মার্শাল ল অব্যাহত থাকবে। পূর্ব পাকিস্তান উপনিবেশ হবে। এতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক মীমাংসার সম্ভবনা দেখা যাচ্ছেনা। সাধারণ নির্বাচন কার্যত বাতিল করা হয়েছে। সকল আওয়ামী লীগ সদস্য যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এবং উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগেকে নিষিদ্ধ করা হবে। আমি ক্ষোভের সাথে জানাচ্ছি সরদার শরণ সিং গত শুক্রবারের বিবৃতিতে মুজিবুর রহমানের মুক্তির সম্পর্কে একটি শব্দও বলেননি। রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সকল স্লোগান এখন মৃত। দয়া করে এটি আবার বলবেন না। ইয়াহিয়া খান স্পষ্টভাবে তার কথায় বলে দিয়েছেন তিনি কোন পথে যাচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, অল্প কিছুদিন আগে আমাদের মন্ত্রী দেশের মাটিতে পা ফেললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রকাশ্যে গত কয়েকদিনে বলেছে যে তারা পাকিস্তানে অর্থনৈতিক, সামরিক বা অন্য কোন এইড বন্ধ করবে না। ইয়াহিয়া খান কেন এই অবস্থা নেবেনা? চীন তাকে সমর্থন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাঁকে সমর্থন করছে। স্যার, সময় আর নেই। আমি শুধু আর এক বা দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমাদের সীমান্তে প্রতিদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করছে এবং আমাদের সীমানা লঙ্ঘন করছে। এটাও এক ধরণের আগ্রাসন। কারণ পাকিস্তানি সেনারা বন্দুক আর বেয়নেটের মুখে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আমাদের দেশে পাঠাচ্ছে। এটা খুব শীঘ্রই থামবে না। তারা এব্যাপারে কি করবেন? আমরা কীভাবে আমাদের বর্ডার পাহারা দেব? এটা আমার প্রথম প্রশ্ন। মন্ত্রী বিশ্বকে জানিয়েছেন যে তারা যদি কেউ এগিয়ে না আসেন তাহলে আমরা নিজেদের মত কাজ করতে বাধ্য হব। এখন আমি তার কাছে জানতে চাই সেই সময় এসেছে কিনা। পুরো সময়ে আমরা নিজেদের পিঠ চাপড়িয়েছি – কারণ অনেক দেশ আমাদের পলিসিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

আমি বলতে চাই, স্যার, এখন ইয়াহিয়া খানের ব্রডকাস্টের পর বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেলনা। আপনিও স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশ বলে চালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু এর অর্থ হল, বিশ্ব জানবে যে আপনি পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামাবাদের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। আপনি কি তা করতে ইচ্ছুক? আমি সব সময় বলে এসেছি নিজেদের এলাকা না হলেও তাদের শাসন চলছে এবং চলতে থাকবে।

এখানে একটি সরকার আছে যেখানে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রতিনিধিত্ব করে। এটাই আমাদের নৈতিক শক্তি যে আমরা নিজেদের নীতির পক্ষেই আছি। তারা নির্বাচনে ৯৮% আসন পেয়ে জিতেছে। তথাপি তাদের এক বর্গফুট জায়গাও নেই যার উপরে তাদের স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ আছে। কিন্তু আপনি মিলিটারি শাসককে স্বীকার করে যান যাদের পেছনে কোন অনুমোদন নেই। এখন এটা পুরো বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত। ২ দিন আগে গার্ডিয়ান পত্রিকা সম্পাদকীয়তে সুচারুরূপে একটি প্রশ্ন করেছে যার উত্তর দিতে আমাদের সরকার রাজি হয়নি।

আমি উদ্ধৃতি করছি:
“ইয়াহিয়ার মহাপরিকল্পনার মাঝে আসল প্রশ্নটা কি কখনো করা হয়েছে? পাকিস্তান কি আর বিদ্যমান? ঐক্যের কি আর কোন মূল্য আছে? পাঞ্জাবি সৈন্যদল কি অর্জন করেছেন? মুজিব নিখোঁজ হবার পর পাকিস্তানকে জাদুর কাঠি দিয়ে এক করার জন্য অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক উদ্বাস্তু হয়েছে”।

পাকিস্তান এক করার গল্প এবং এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার – এসব অনেক দেশে বলে বেরানো হচ্ছে। তাই হয়ত আমাদের এই সামরিক শাসনকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং বাংলাদেশে তাদের কর্তৃত্ব চালিয়ে যেতে দিতে হবে যদিও তা এখন হজম করা যাবে না। আমি মনে করি ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারে অন্যান্য কিছু দেশের চিন্তায় কিছু বদল আসবে, যারা সম্ভবত রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পক্ষে ছিলেন – আমি জানি না যদিও।

আমি পত্রিকায় জেনেছি যে ডঃ শরণ সিং বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি জানিনা সঠিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে কিনা। রিপোর্টে বলা হয়েছে এটা কোন ভাবেই আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। যদি তাই হয় তবে আমি মনে করি এটা বাতাসে খড়ের মত ব্যাপার। তবে এটা ঠিক একজন ডুবন্ত মানুষ খড় ধরে হলেও বাঁচতে চায়। আমার মনে হয় আমাদের সরকার এখন এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে এসেছে যে আমাদের নিজস্ব সীমানা রক্ষা করতেও পারছেনা। উদ্বাস্তু প্রবাহ বন্ধ করতে পারছে না। আমেরিকান অস্ত্র পাকিস্তান যাওয়া বন্ধ করতে পারছে না এবং এমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না যার মাধ্যমে আমরা আমাদের অঞ্চল, সীমানা ও অর্থনিতি রক্ষা করতে সক্ষম। এখন আবার ভাবতে হবে। স্যার, অনেক মানুষ তাদের বলেছে যে সময় হয়েছে। অতএব আমি অনুরোধ করি দয়া করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিন যারা তাদের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে – যারা নৈতিকভাবে সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্বীকৃত। এবং আপনি জানিয়ে দিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে আমরা স্বীকৃতি দেই না। এর পর আমরা পরবর্তি পদক্ষেপে এগিয়ে যাব।

জনাব ডেপুটি স্পিকারঃ এটা এমন একটি বিষয় যেখানে সব সদস্য ইনভল্ভড থাকতে চান। যদি সবাই ৫ মিনিটে বলে শেষ করে সহযোগিতা কোনে তাহলে আজকে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাবে। তাই আমি সদস্যদের অনুরোধ করছি সংক্ষেপে বলতে।

শ্রী নিম্বাল্কার(কোলহাপুর): জনাব ডেপুটি স্পিকার, স্যার, আজকের বিতর্কে আমি টাইমস অব ইন্ডিয়ার গোল্ডস্মিথ থেকে কোট করছি –

‘সত্যিকারের উদারতা মানে মানবতার সকল নিয়ম মেনে চলা নয়। জীবনের অন্তিম ইচ্ছাকে ফলো করতে এবং বর্তমানের সুবিধাগুলোকে দমিয়ে রেখে ভবিষ্যতের ভালো ফল থেকে বঞ্চিত করাও উদারতা।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি খুব দ্রুত সমাধান করা সম্ভব না। শুধুমাত্র সরকার জানেন কখন সেই সঠিক সময় আসবে – কারণ তাদের কাছেই সঠিক তথ্য আছে।

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: সঠিক সময় কখন?

শ্রী নিম্বাল্কার: এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। আমি বলতে চাই আমাদের মন্ত্রী বিভিন্ন রাজধানীতে যে সফর করেছেন এর ফলে ঐ সময়ে পৌঁছাতে আমরা দ্রুত সক্ষম হব।

এখানে আমি দুই জন সংসদ সদস্যের কথা বলতে চাই যারা একসময় ট্রেজারি বেঞ্চে ছিলেন। একজন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী দীনেশ সিং – তিনি বলেছেন সরকার একটি সুযোগ হারাল; আমি মনে করি সরকারের ২৫ মার্চই ব্যাবস্থা নেয়া উচিৎ ছিল। আমি এর সাথে একমত না। প্রথমতঃ যদি আমরা শ্রী দীনেশ সিং এর পথে যেতাম তাহলে একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হত। সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মধ্যে না – বরং পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। এবং সেটাই আমরা এড়াতে চেয়েছি। আমরা যদি শুধুমাত্র সেটা করতাম এবং পাকিস্তান ভারতকে আগ্রাসক হিসাবে ব্র্যান্ডেড করে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে যেত। এটা পাকিস্তানের জন্য কঠিন কোন কাজ ছিলোনা। আমি বুঝিনা মন্ত্রী কতটা দায়িত্ব নিয়ে অফিস করেন। মন্ত্রণালয় যে মুহুর্তে তাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হল তখন থেকেই এমন আচরণ শুরু।

দ্বিতীয় প্রাক্তন মন্ত্রী যার কথা আমি বলতে চাই তিনি হলেন শ্রী ক্রিস্টিনা মেনন। যে কোন ব্যক্তি যিনি ভারতের স্বাধীনতার আগে অথবা ঠিক তার পরপর লন্ডনে ছিলেন; তিনি নিশ্চই শ্রী কৃষ্ণ মেননের প্রতি শ্রদ্ধা থামাতে পারেন না। তিনি মাঝে মাঝে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসতেন। খুব সক্ষম আইনজীবী হওয়ায় তার কথার পক্ষে যুক্তি তর্ক ও ন্যায্যতা খুঁজে বের করে ফেলতেন।

শ্রী সমর গুহ: আমরা একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি যা নিয়ে গোটা জাতি উদ্বিগ্ন। যদি ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরা বিরোধীদলীয় সদস্যদের ও তাদের মতামতকে আক্রমণ করা শুরু করে তবে আমি মনে করি তারা শুধু সরকারের না এমনকি দেশের অপকার করছেন।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: আমি মনে করি যুক্তি খুব বৈধ। এটা এমন একটি প্রশ্ন যা নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। এখানে পারস্পরিক সমালোচনা করা উচিত হবে না।

শ্রী নিম্বল্কর: আমাদের মন্ত্রীরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা ধীরে ধীরে আমাদের জন্য সাফল্য বয়ে আনছে।

[শ্রী কে এন তাওয়ারি আসন গ্রহণ করলেন]

প্রফেসর ড. মাদি-টু ডান্ডেভাতে(রাজাপুর): জনাব ডেপুটি স্পিকার স্যার, একটা জাতির জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে যখন সার্বভৌম সংসদে দল ও দলীয় রাজনীতি উপরে উঠতে হয়। চীনা আগ্রাসনের সময় আমরা এরকম করেছিলাম। এবং পাকিস্তান আগ্রাসনের সময়ও একই পুনরাবৃত্তি করেছিলাম। আজও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে হবে। বাংলাদেশের ইস্যু শুধুমাত্র দলীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে হবেনা – বরং জাতীয় স্বার্থের দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে। ট্রেজারি বা বিরোধী দলের বেঞ্চ থেকে মিসলিডিং করলে হবেনা। এটা স্পষ্টভাবে পরিষ্কার করা যাক, যে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়টি আরো শাণিত হয়ে গেছে এবং বিশেষ করে সাম্প্রতিক পাকিস্তানে অ্যামেরিকার অস্ত্র সাহায্যে এটি খুব বড় পরিমাণে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। এমন একটি সময়ে যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি ভয়ানক সংগ্রামে জড়িত। এটিও আবার কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এবং আমি হাউজে বলতে চাই এটা বিশ্বশক্তিগুলোর রাজনীতির পরিণতি। এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। এটাই তাদের ‘এশিয়ান কৌশল’। এ কারণে আমেরিকা চায় যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ নয় বরং একটা টানা উত্তেজনা বজায় থাকুক।

এ কারণে আমেরিকা চায়না যে বাংলাদেশের মত গতিশীল ও উদীয়মান জাতি সামনে আসুক। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ এবং ভারতের মিত্র এবং যদি বাংলাদেশ ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত জোট বজায় থাকে তাহলে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য তারা পুনরুদ্ধার করতে চায়।

আর এটা নিছক আমেরিকার কৌশল নয়। একটা সময় ছিল যখন সোভিয়েত রাশিয়া কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারতকে শক্তিশালী সমর্থন দিয়েছিল। অনন্তর যখন তারা উপলব্ধি করেন যে পাকিস্তান আমেরিকার একচেটিয়া সহানুভূতি পাচ্ছে তখন তারা ধীরে ধীরে কাশ্মীর ইস্যুতে জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এভাবেই রাশিয়ার পলিসি নতুন আকার ধারণ করে।

বিশ্বশক্তিগুলোর রাজনীতির সাধারণ প্যাটার্ন দেখে মনে হচ্ছে যে, তারা বাংলাদেশের স্বীকৃতির ইস্যুতে সমবেদনার মনোভাব গ্রহণ করবে। এশীয় রাজনীতির কৌশল থেকে মনে হয় বাংলাদেশের ব্যাপারটি বিশ্ব শক্তিগুলোর কাছে প্রজেক্টেড আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের নীতি ও সম্পর্ক শুরু থেকেই স্পষ্ট আছে।

দুর্ভাগ্যবশত, এটা সত্য যে, আমাদের দেশ বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দূতাবাস ব্যর্থ হয়েছে। একজন ব্যক্তি যাকে বিশাল কাজে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিনি হলেন জয় প্রকাশ নারায়ণ। তিনি শুধু ভারত সরকারের রাষ্ট্রদূত না বরং আমাদের জনগণের রাষ্ট্রদূত – কারণ একমাত্র তিনি বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে আছেন। অসাধারণ প্রচেষ্টা নিচ্ছেন তিনি। আমরা তার কাজের প্রশংসা করছি।

যতদূর বিশ্বশক্তিগুলো উদ্বিগ্ন আছে, তাতে আমাদের এমন কাজ করা ঠিক হবেনা যে অন্য দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে তারপরে আমরা দেব। আমি আমাদের সরকারের অবস্থান বুঝতে পারি। সম্ভবত সরকার ভীত যে যদি কোন বিশ্বশক্তি বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে এগিয়ে না আসে এবং শুধুমাত্র ভারত তা একতরফাভাবে করে এবং আরও যদি চীন পাকিস্তানের দিকে ঝোঁকে তাহলে পাকিস্তানের সাথে সরকারের সরাসরি একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে যায় – সাথে অন্যান্য দেশের সাথেও। আমেরিকা সহ পাকিস্তান ও চীনের সমন্বয় হলে সেটা হবে একটি বিশাল দুর্যোগ। সম্ভবত সেই ভয় সরকারের মনের মধ্যে লুকোনোর আছে।

আমি এই বলে শেষ করছি যে যখন ইয়াহিয়া খান হুমকি দিয়েছেন যে তিনি তার পুতুল শাসন চাপিয়ে দিবেন সেই বিশেষ সন্ধিক্ষণে আমরা অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব। আমাদের ঝুঁকি নিতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই যে, ঝুঁকি আছে কিন্তু আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর ধারালো ইমেজ আছে। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ একজন ‘সফল রাজনৈতিক’ হিসেবে। আমি চাই তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও সেই ইমেজ ধরে রাখবেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে জুয়া; কিছু ঝুঁকিপূর্ন সূক্ষ্ম হিসাব নিকাশ; বাংলাদেশকে স্বীকৃতি; বাংলাদেশ বিষয়ে নতুন বাহিনী তৈরী করা এবং ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করা – এভাবেই আগাতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের এই সমন্বয় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ধ্বংস করে দেবে এবং সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আন্তর্জাতিক সংঘাত ও ক্ষমতার রাজনীতির জন্য একটি গুটি হিসেবে এশিয়ার জমি ব্যবহার করতে পারবে না। এই পদ্ধতিতেই আগাতে হবে এবং এই ঝুঁকি নিতে হবে। আমি আশা করি এই মনোভাব গ্রহণ করা হবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।

শ্রী বি কে দাশ চৌধুরী (কোচবিহার): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার ভারতের অতীত ঐতিহ্য বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য স্বতঃস্ফূর্ত, ব্যাপক এবং দেশব্যাপী যে চাহিদা তৈরি হয়েছে তার নিজস্ব যুক্তি আছে।

ব্যাপারটি হাউসের সামনে স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্গুমেন্ট চলছে যে স্বীকৃতি দিতে হলে নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক মানদণ্ড লাগে। শুধু লজিস্টিক ভিউ এবং তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিলেই হয় না। হাউসের একজন মাননীয় সদস্য পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে একটি দেশকে স্বীকৃতি দেবার নির্দিষ্ট কিছু পূর্বশর্ত আছে।

আমি প্রথমে ওইসব পয়েন্টের জবাব দিতে চাই। তিনি বলেছেন, সেখানে একটি অঞ্চল থাকতে হবে এবং কার্যকর সরকার থাকতে হবে এবং স্থায়িত্ব থাকতে হবে। আমি মাননীয় সদস্যকে অনুরোধ করব এগুলো সত্য ও সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হবে। একটি সার্বভৌম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে এটি সত্য এবং এটি স্পষ্টভাবে এবং নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুণগত পরিবর্তন এনেছে। আর এতে বোঝা যায় যে এটি পাকিস্তানকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে তাদের দ্বিজাতি তত্ত্বে। দেখা যায় যে পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্বের মৃত্যু ঘটেছে পূর্ব পাকিস্তানে যার নাম এখন বাংলাদেশ।

এই তিনটি শর্তের সবগুলোই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আছে। সেখানে একটি সরকার আছে, আর এই সরকার বাংলাদেশের ৯০% মানুষের সমর্থনপুষ্ট। এরপর কেউ কীভাবে বলে যে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাবার যোগ্য না? এরপর আসে এলাকার প্রশ্ন। এটা বিশ্বের সবার জানা যে অন্তত কিছু এলাকা মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণাধীন।

অন্যান্য বিষয়গুলোর কি অবস্থা? অন্য বিষয় হল এটা টেকসই কিনা। এটা সত্য যে যদি বাংলাদেশ স্বীকৃতি পায় তাহলে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে এমন একটি অবস্থান তৈরি করবে যা একদিন বিশ্বের ক্ষমতার রাজনীতিকে সামঞ্জস্যপূর্ন করবে।

এই সব কথা বিবেচনা করে, আমি বুঝতে পারি না কেন এই ধরণের বিতর্ক করা হচ্ছে।
আরেকটি মাননীয় সদস্য বললেন এখনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি তাকে সব কিছু বিবেচনা করতে বলব। আমরা একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাঠামোতে কাজ করি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই এটা সরকারের জন্য একচেটিয়া হয়ে যাবে কিনা? সরকারের কি সংসদের সদস্যদের ঐক্যমত্য নিয়ে গনতান্ত্রিকভাবে কাজ করা উচিৎ নয়? সরকারকে সদস্যদের মতামত বিবেচনা করতে হবে, ভারতীয় জনগণের মতামত বিবেচনা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনাটা আরও বিস্তর। আমি সন্মানিত সদস্যকে সেগুলোও মাথায় রাখতে বলব।

আন্তর্জাতিক আইনের কি কোন বেসিক কাঠামো আছে? এমন কোন বেসিক নিয়ম আছে যা সবসময় স্থির?

আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি জরুরী পরিস্থিতিতে, নির্দিষ্ট মতামত এবং নির্দিষ্ট উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র সেগুলো গ্রহণ করে। বিপরীতভাবে, কিছু আইন এবং নিয়মাবলী আছে যা পালন করার বাধ্যবাধকতা আছে। তাই, সে ক্ষেত্রে, আমি সরকারের নিকট আপীল করব, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে, লজিস্টিক ভিউ বা তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কোন বাঁধা নেই।

শুধু তাই নয়, অতিতে ১৯০৩ সালে অ্যামেরিকা পানামাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তার আগে পানামার এক ইঞ্চি জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। অ্যামেরিকা তাদের স্বীকৃতি দেয়। এমনকি প্রথম যুদ্ধের পরে এরকম অনেক রাষ্ট্রকে অ্যামেরিকা স্বীকৃতি দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও কিছু রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। ইন্দোনেশিয়াতে নরডমের নেতৃত্বের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল? এটা খুব পরিষ্কার।

সুতরাং, এই সব দিক বিবেচনা করে, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক সরকার বাংলাদেশকে কয়েক বছরের জন্য একটি উপনিবেশ করে রাখতে চায়। তাই এটা সরকারের জন্য দায়িত্ব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। এবং মনে রাখবেন যখন আপনি বাংলাদেশকে সকল সহায়তা দেবেন তখন স্বীকৃতি দেয়া থাকলে আপনি ভারমুক্ত অনুভব করবেন। তবে তা হবে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করতে চাই এখনি স্বীকৃতি দেবার আসল সময়। এখনো যদি আমরা এই পথ না নেই তাহলে সামনে আর কি করতে পারব? তাই এই পদক্ষেপ পরের স্টেপে যেতে সহায়তা করবে।

জনাব. চেয়ারম্যান: জনাব কৃষ্ণ মেনন,
শ্রী বি কে দাশ চৌধুরিঃ যদি সরকার সময় মত তা করতে ব্যার্থ হয় তবে এটা ভণ্ডামি হবে যা পরবর্তিতে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হবে …

শ্রী কৃষ্ণ মেনন (ত্রিভানদ্রাম): আমি স্বল্প সময়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে চাই। তাই আমার প্রশ্ন সংক্ষিপ্ত করে শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে থাকতে চাই। এবং অনেকেই বলেছে যে এটা কোন দলীয় প্রশ্ন নয়।

আমিও তাই বলি। এমনকি যদি সেটাও হয় আমি বলব কিছু দিন আগে ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে বলা হয়েছিল যে স্বীকৃতি এখন উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে – সেটা মিথ্যা ছিলোনা। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ৮০ বা ৯০ দিন হল। এখনো যদি সরকার মনে করে যে সময় আছে তবে তা ভুল হবে।

আজ বিকেলে এবং আগে আলোচনায় বৈদেশিক নীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি সেগুলোর উপর আলোচনা করতে চাইনা। পরেও সুযোগ থাকতে পারে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এখন বলছি, যে আমি এখন পররাষ্ট্র বিতর্কে যেতে চাই যদি স্পিকার আমাকে অনুমতি দেন। এটা হয়ত ফরেন পলিসি নিয়ে বলার সময়। অন্যান্য বিষয় এখন আমার অবস্থানে আসে না।

এটা আবশ্যক যে বাংলাদেশকে স্বীকার করা উচিত। বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বক্তব্যে যখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যাকে পছন্দ করব তাদের একসঙ্গে ডাকব – গণপরিষদ বা অন্যত্র’। কমান্ড পারফরম্যান্স। যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির আই এস ও মেম্বাররা স্বীকৃতির আবেদন করতে পারে, তখন এটা বেমানান নয় যে সমাজতান্ত্রিক দল বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবী করবে। আর এখন স্বীকৃতি মানে রাষ্ট্রদূত পাঠানো নয়। সেই আলোচনা এখানে আসেনা। এটা দূত পাঠানোর বিষয় নয়। এটা একটি জাতির অস্তিত্ব স্বীকারের প্রশ্ন। পূর্ব বাংলার দশ ভাগের এক ভাগ লোক এখন আমাদের দেশে অবস্থান করছে। আমরা তাদের সক্রিয় করার জন্য কী করছি? আমরা তঁদের কি সহায়তা দিচ্ছি? যাতে তারা ফিরে গিয়ে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে? আমি বলছি না যে আমরা বাংলাদেশে অস্ত্র পাচার করব। কিন্তু আমাদের সাহায্য করতে হবে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সক্রিয় করার ব্যাপারে যাতে তারা পাকিস্তানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। আমি বলছিনা যে আমি আমাদের পাকিস্তান বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উস্কানি দিতে হবে।

আমি ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অনেক শুনেছি। আমি শুনেছি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরকম অনেক বার বলেছেন। এখন যদি বলি পাকিস্তানের একশন ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’ নয় তাহলে স্বীকৃতি দেয়া কেন আভ্যন্তরীণ হবে? কোন বহিরাগত কর্তৃপক্ষ বলে কি কিছু আছে যারা আমাদের বলে দেবে? আমাদের কি অন্য কোন দেশের বলার অপেক্ষায় থাকতে হবে? আমি বলছি জনাব চেয়ারম্যান, এটা আমাদের সিদ্ধান্ত, শধুই আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। অন্য কোন দেশের হুমকি দেবার কিছু নেই। সময় চলে যায়নি। কারণ পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। সেখানে আলাদা ‘সরকার’ গঠন করতে হবে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বলতে চাই, মানুষ আমার বক্তব্য সম্পর্কে যাই ভাবুন না কেন, আমাদের সরকারের উচিৎ পূর্র বাংলায় ভিয়েতনামের মত আরেকটি ভিত্তি গড়ে দেয়া। যখন আমি বাংলাদেশের কথা প্রথমে বলেছিলাম, যখন প্রথম এটা চেম্বারে উঠেছিল, অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন। আমি স্পষ্টভাবে বলি, অ্যামেরিকা শুধু যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে সফর করছিলেন তখনি পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠায়নি বরং যখন তিনি ফিরে এসেছেন তখনো পাঠিয়েছে। এবং এটা ধারাবাহিকভাবে চলমান আছে।

একটি মাননীয় সদস্য: আপনি কি চিনের সম্পর্কেও তা মনে করেন না?

জনাব চেয়ারম্যান: দয়া করে কোন হস্তক্ষেপ করবেন না।

শ্রী কৃষ্ণ মেনন: যদি তাদের সামরিক শক্তির কাছে কোন অস্ত্র না থাকে তবে। যখন তাদেরকে কোন জাতিকে দমিয়ে রাখার জন্য অস্ত্র দেয়া হয় তখন সেটা ইন্দো-চায়না পরিস্থিতির মত হয়। আমরা ধীরে ধীরে সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই দেশে এখন এবং গত কয়েক বছর ধরে বলার মত কোন পররাষ্ট্র নীতি নাই। আমরা ধীরে ধীরে অস্ত্রহীন ও দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এই পরিস্থিতে আমাদের অবস্থান আসলে কোথায়। আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি না কিংবা স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে ব্রিটেনের মত হস্তক্ষেপ, অথবা সীমালঙ্ঘনকারীর জন্য রিং ধরেও বসে নাই। কিন্তু আমাদের বর্তমান পলিসি এগ্রেসরকে (সীমালঙ্ঘঙ্কারী) পুষে রাখছে। কারণ তারা বারবার বলেছে তারা পুনর্গঠন করবেনা। তারা বলছেনা যে তারা স্বীকৃতি দেবে; শুধু বলছে ‘সময় আসেনি বা এখনো যথাযথ হবেনা’। সরকারের কাছে সময় ঘড়ি ধরে আসেনা, কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও আসেনা, তাহলে কীভাবে আসে? এটা শুধুই ঘটনার গতি দেখে নির্নয় করতে হয় যাকে আমরা বলি পলিসি।

১৬.00 ঘন্টা

যেমনটি শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত বলেছেন যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-দশমাংশ পাকিস্তান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। এটা একধরনের পরোক্ষ আগ্রাসন। যখন একটি দেশ জনগণকে তার নিজের বাড়িতে ভূখণ্ডে বাস করার অনুমতি দেয় না এবং অন্য দেশে পুশ করে – যেমনটা পাকিস্তান করছে – এটা কি? যদি পূর্ববাংলার জনগণ সেখানে কোন অসুবিধা ছাড়াই এখানে আসত তাহলে আমরা তাদের ফিরিয়ে দিতাম অথবা জেলে রাখতাম অথবা সেই অবস্থায় যা করার তা করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি বা করতে পারিনা কারণ তাদের দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা এমন যে সেখানকার মানুষ সন্ত্রাসের ভয়ে পালিয়ে এখানে আসছে।

জনাব চেয়ারম্যান, আমি বসে পড়ার আগে একটি কথা বলতে চাই। এখানে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ এসেছে তাদেরকে আমরা কোন নার্সিং হোম বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সদস্য হিসেবে দেখছিনা। তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে, শারীরিকভাবে এবং অন্যান্যভাবে সমর্থ করতে হবে যাতে তারা দেশে ফিরে গিয়ে বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করতে পারে। উদ্বাস্তু শিবির (এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে)র ভিতরে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সেখানে যেসব সমর্থ শরীরের মানুষ আছে, যাদের কর্মক্ষমতা আছে, বুদ্ধি আছে এবং যারা সাবেক সৈনিক তাদেরকে এসব ফোর্সের দায়িত্ব দিতে হবে। ফলে যখন তারা ফিরে যাবে তারা একটি মুক্তিবাহিনীর মত কাজ করতে পারে।

আমরা ক্রমাগত কিছু শব্দ এবং এক্সপ্রেশন শুনি যে ‘তাদের ফিরে যাওয়ার মত অবস্থা তৈরি করতে হবে। ‘ কে সেই পরিবেশ করে দেবে? তারা কি পাকিস্তান বা বিশ্বের বা জাতিসংঘের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সরকার, যারা কঙ্গোতে একটি জগাখিচুড়ি পাকিয়াছিল? আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, আন্তর্জাতিক কোন সহযোগিতার আমরা ব্যবহার করতে চাইনা। পূর্ব বাংলা থেকে যারা এসেছে তাদেরকে এভাবে তৈরি করতে হবে যাতে করে তারা রাজনৈতিকভাবে, মানসিক ও শারীরিক শক্তি দিয়ে সেখানে ফিরে যায় এবং প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলে। আমি মনে করি এই সময়ে এটাই আমাদের করতে হবে। আমি এটাকে আর দীর্ঘায়ীত করতে চাইনা।

আর, যদি এই কাজ করা হয়, তাহলে স্বাধীনতাকামী বাহিনীর বিজয়ে কিছু অবদান হয়ত রাখা হবে।

আমি আরও বলতে চাই যে, আমরা বেসরকারী সদস্যদের গতিতে আলোচনা চালাচ্ছি। কেউ ভাবেনি আমরা আজ বিস্ময়কর বা নতুন কিছু বলতে যাচ্ছি। কারণ হল ৩/৪ দিন আগে যখন আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম তখন নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমাদের কিছু ভিজিটরও সেদিন এখানে ছিল যারা সম্প্রতি পূর্ব বাংলা থেকে ঘুরে এসেছেন। আমি বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী নিজেই সরাসরি, বা পরোক্ষভাবে, বলেছেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান ফিরে আসতে পারবেনা। পাকিস্তান সরকার সেখানে থাকবেনা, তাহলে আপত্তি বা স্বীকৃতি দেবার কে আছে সেখানে? পাকিস্তান থেকে আমাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে ফেলায় একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে যারা আছে তাদের সঠিক অস্তিত্ব নেই। স্বীকৃতিই পারে তাদের অস্তিত্বকে বাস্তব রূপ দিতে।

এটা দুঃখজনক ব্রিটিশ, আমেরিকান বা ফরাসি কাগজপত্রে আমাদের চেয়ে বেশী তথ্য আছে। সরকার এসব সংবাদপত্রের উপর নির্ভর করে। এবং যখন তারা রিপোর্টের প্রভাব অনুধাবন করতে না চান তখন তারা পুরো বিষয়টি একটি রহস্যে ঘিরে রাখে – তখন তারা বলে এখানে সরকার কি করছে তা বলা নাই … প্রভৃতি।

অবশেষে, আমি আবারো বলছি এই বিতর্ক বেসরকারী সদস্যের গতিতে হচ্ছে। আমি আশা করি সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী যিনি ক্ষমতাসীন দলের চিফ হুইপ তিনি মুখ খুলবেন। বর্তমান ইস্যু নিয়ে সদস্যরা তাদের চিন্তা চেতনা অনুযায়ী ভোট দেবেন। এটা দলীয় সিদ্ধন্তের চেয়ে অনেক বড় কিছু। আমরা কিছুই হারাইনি, কারণ আমরা যদি এই গতিতেও আগাই সরকারের পতন হবেনা। একটি ফ্রি ভোট দেয়া যেতে পারে যাতে বিশ্ব জানতে পারে ভারতের জনগণের মনের ইচ্ছা কি।

আমাদের বিরোধী দলের বন্ধুদের সম্পর্কে সপ্তদশ শতাব্দীর এক দার্শনিকের একটি কথা উল্লেখ করছি,
“অজ্ঞতা মানুষকে দল গঠন করায়।
লজ্জা তাকে দল পরিত্যাগে বাঁধা দেয়। ’

তেমন পরিস্থিতি যেন না আসে।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: শুধুমাত্র অজ্ঞতা নয়।
শ্রী কৃষ্ণ মেনন: অতএব, আমি আশা করি, এই সংসদে, ঐতিহ্যের সঙ্গে, এই অবস্থায় এই ধরনের একটি ভোটের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে – যাতে করে এই ব্যাপারে আমাদের অবস্থান জানা যেতে পারে – হুইপের কার্যক্রমকে ব্যাহত না করে। আমি মনে করি ফ্রি ভোটের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। এতে আমাদের গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দেখানো হবে।

শ্রী প্রিয় রঞ্জন দাস মুন্সী (দক্ষিণ কলকাতা): বাংলাদেশ সম্পর্কিত রেজল্যুশন উপর আলোচনায় ইতিমধ্যে হাউসের অনেক সদস্য মতামত দিয়েছেন এবং এটি একটি পরিপক্ক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমাদের দলের এবং অন্য দলের অনেকের থেকে অনেক অদ্ভুত ধারণা পাওয়া গেছে। কিন্তু আমি সেসবের বিস্তারিত আলাপে যেতে চাইনা।

আমি দুটি প্রধান দিকে আমার মতামত প্রকাশ করতে চাই। ভারত সরকার ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বের সামরিক সরকারকে নিন্দা করেছেন। যার ফলে আমরা যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছি এবং সারা বিশ্ব জেনেছে যে আমরা কোন পারমাণবিক শক্তি বা সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করতে রাজি না। আমরা শুধুমাত্র মানবতার শক্তির উপর নির্ভর করতে চাই। যেহেতু আমরা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষের উপর ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার নিন্দা করার সাহস দেখিয়েছি যেহেতু নিক্সন সরকারের পাকিস্তানে অস্ত্র চালান পাঠানোর ব্যাপারেও আমাদের নিন্দা করার ক্ষমতা আছে। মানবতার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেবার সাহস আমাদের রয়েছে।

অনেক সদস্য সমস্যাটিকে কিছুটা জট পাকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। আমি এটা দীর্ঘ সময়ের জন্য দেখেছি। অনেক সদস্য আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড যাচাই করার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে করে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময় কিনা। আমি জানি না কেন আমাদের সেই মানদণ্ড ধরে যেতে হবে। যতদূর আমি জানি তাতে গণতন্ত্র শুধুমাত্র জনগণের রায়ের উপর অথবা জনগণের দ্বারা জনগণের প্রতিনিধিদের পছন্দের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের ৯৮ শতাংশ নির্বাচিত হয়েছে – এটি ইয়াহিয়া খান অথবা আন্তর্জাতিক কোনো উৎসের সুবিধা নিয়ে হয়নি। এটা হয়েছে জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে। তাই অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ক্ষতি কি? আমাদের উচিৎ অবিলম্বে তাদের স্বীকৃতি দেয়া।

যদি ভারতের জনগণের শক্তির উপর দাঁড়ানোর সাহস থাকে তাহলে বিশ্বের কে কি প্রশ্ন করল সেই চিন্তা না করে আমাদের উচিৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। এবং এই সিদ্ধান্তের জন্য ভারতের সমস্ত জনগণ দায়ী থাকবে। যদি সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয় তবে তাদের ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়ে আসতে হবে এবং বিশ্বকে জানাতে হবে যে, না তারা এমন কিছু করতে যাচ্ছেনা। কিন্তু এত সময় ধরে বিষয়টাকে দীর্ঘায়ীত করার মানে কি? তাহলে যারা কষ্ট করছে তাদেরকে সহানুভূতি দেখান, শরনার্থিদের প্রতি সহানুভূতি দেখান অথবা বিশ্ব শক্তিগুলোর সাথে এত আলোচনার মানে কি? বিশ্বের কাছে আমাদের জন্য যা দরকার তা তো আগে থেকেই ছিল। অ্যামেরিকা থেকে আমাদের মন্ত্রীর ফিরে আসার পর অ্যামেরিকার আচরণ কি ছিল? পরিস্থিতির গুরুত্ব ও বাস্তবতা অনুধাবন না করেই অ্যামেরিকা পাকিস্তানে জাহাজভর্তি অস্ত্রের চালান পাঠাল। এদিকে, কমিউনাল শক্তিধর যুক্তরাজ্য কি ব্যাবস্থা নিল? তারা কি এই সমস্যা নিয়ে একটি মন্তব্যও করেছে? পার্লামেন্টের একজন সদস্যকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো ছাড়া তারা কি আর কিছু করেছে? তারা কি এটি নিয়ে কোন রাজনৈতিক অবস্থা প্রকাশ করেছে? আবার ধরুন রাশিয়ার কথা। নিশ্চই তারা কিছু সাহায্য ও আরও কিছু জিনিস পাঠাচ্ছে। কিন্তু তারা কি কোন সিরিয়াস রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে? দুঃখের সাথেই বলছি সোভিয়েত ইউনিয়নের মত একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র এখনো কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয় নাই। সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৪ তম কংগ্রেসের বক্তব্যে আমি বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে একটি কথাও কোথাও খুঁজে পাইনি। সবাই শুধু দেখতে চায় ভারত কীভাবে আগায়। যদি ভারত কাশ্মীরের দিকে আগায় তারা বলবে সেখানে অ্যামেরিকার ভয় আছে। ভারত যদি NEFA এর দিকে যায় তারা বলবে সেখানে চিন এর ভয় আছে। কিন্তু আমি দেখেছি যে এটা ভারতের নিজস্ব সমস্যা হওয়া উচিত এবং এটা আমাদের সমাধান করতে হবে। যদি ইতিহাসে আমাদের জন্য বিপদ আসে – তবে ভারত সরকার এবং হাউজের সদস্যদের সেভাবে সমর্পন করতে হবে। চিন বাংলাদেশ সমস্যায় অলরেডি একটি ফাঁদ তৈরি করেছে। আমাদের হয় জনগণের শক্তিতে নির্ভর করে অবস্থান নিতে হবে এবং তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে অথবা বলে দিতে হবে আমরা এসবের মধ্যে নেই কারণ আমরা অ্যামেরিকা বা রাশিয়ার সাথে জোটনিরপেক্ষ অবস্থানে আছি।

সুতরাং, আমি রেজল্যুশনকে সমর্থন করি কারণ এখন স্বীকৃতি দেবার সময় এসেছে। আমরা যদি তা করতে বাধ্য হই বাংলাদেশের যুব সমাজ যারা ক্যাম্পে বসে তাদের সময় ব্যয় করছে তারা তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার জন্য আমাদের অভিশাপ দেবে। তারা এটা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত না, তারা ভারতের মহিমান্বিত ইতিহাসের সাথে, ভারতের মানুষ তাদের সে আশ্বাস দিয়েছে তার সাথে এটাকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।

শ্রী জাম্বুবেন্ত ঘোটে (নাগাপুর)ঃ স্পিকার মহোদয়, বাংলাদেশের সমস্যা আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের নয়, আমাদের দেশের একটি গুরুত্তপূর্ন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিকতার কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। মানবিকতার কারণে পাকিস্তানী আক্রমণ প্রতিহত করা উচিৎ, এটাই আমাদের দেশের ভূমিকা ছিল। এই ভূমিকায় বাংলাদেশের প্রশ্নে দেশ ঐক্যবদ্ধ আছে। এমতাবস্থায় আমাদের এটাই পর্যবেক্ষন করা জরুরী যে, আমাদের বিদেশ নীতি কি এবং আজ আমাদের বিদেশ নীতি কোন দিকে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের বিদেশ নীতি দেউলিয়াত্তে পৌঁছে গেছে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদেরকে বলতে হচ্ছে, বিশ্বে আজ আমাদের কোন বন্ধু নেই। দূরের কথা থাক, নেপালও আজ আমাদের বন্ধু নয়। বার্মাও আমাদের কাছে মিত্র নয়। শুধু এই নয়, বরং আমাদের দেশেও এমন কতগুলো শক্তি আছে যারা আমাদের পক্ষে নেই। এ অবস্থায় আমাদের বিদেশ নীতি কোনদিকে যাচ্ছে, কোন গর্তে আমরা নিপতিত হচ্ছি, এটাও আমাদের দেখা উচিৎ। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আজ অবধি কথা বলে আসছি, চিনের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে শতাব্দী কাল ধরে চিন ও ভারত দুটি বন্ধু ও ভ্রাতৃত্বপ্রতিম দেশ ছিল, কিন্তু আজ এমন অবস্থা এসেছে যে আবার আমাদেরকে বাংলাদেশ প্রশ্নে চিনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বিশ্বের বহু দেশেই তো আমাদের প্রতিনিধি গেছেন, আজ চিনের সঙ্গে আলোচনার জন্যও আমাদেরকে অবশ্যই তৈরি থাকতে হবে, যাতে বাংলাদেশ প্রশ্নে চিন আমাদের সঙ্গে একমত হতে পারে। আজ বাংলাদেশে যে বর্বরতাপূর্ন হামলা হচ্ছে যেখানে মানবতাকে পদদলিত করা হয়েছে, শিশুদের পিষে মেরে ফেলা হচ্ছে, এমতাবস্থায় আমরা বাংলাদেশের পিছনে দাঁড়িয়েছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পিছনে সারা দেশ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তিনি মশাল হাতে সামনে এগুচ্ছেন – এরূপ দৃশ্যকল্প আমরা সামনে রেখেছি, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এখন কোন দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়, সামান্য সময় অপচয় করাও সমীচীন নয়, কেননা এখন আমাদের ওপর সময় এসে পড়েছে যে, পরে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না, বাকি থাকবে শুধু পরিতাপ।

শ্রী শশীভূষণ( দক্ষিণ দিল্লী)ঃ স্পিকার মহোদয়, যে পরিস্থিতি আমাদের দেশ অতিবাহিত করছে তাতে আমাদের সদস্যগণের খুব সংযত ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপিত করা উচিৎ। কিছু লোক আছেন, দিনের আলোতেও তারা অন্ধকার দেখেন, চারিদিকে শুধু নিরাশাই চোখে পড়ে, বিশ্বে তাদের কেউ নেই, তারা একেবারে তলিয়ে যান, কিন্তু আমি মনে করি যে, যখন আমরা কোন ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তৎপর হই তখন এরকম হতাশার কথা বলা দেশকে পেছনে ঠেলে দেবার নামান্তর। বিশ্বে আমাদের সহযোগী নেই একথা আমার কাছে দুর্বোধ্য। পৃথিবীর যেখানেই প্রগতিশীল শক্তি আছে যারা সমাজবাদের জন্য যুদ্ধ করছে, তারা আমাদের সঙ্গে আছে, বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের সঙ্গে কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশে আমার যাবার সুযোগ হয়েছে। সেখানকার জনগণ সহযোগীতা করেছে এবং সেখানকার সরকারও সমর্থন দিয়েছে। দু’তিন মাসের মধ্যে কোন পরিবর্তনকে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়ে দেবে এটা কখনো হয় না। আমরাও স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলাম কিন্তু বিশ্ব কতদিন পরে স্বীকৃতি দিয়েছে? ভিয়েতনামের স্বীকৃতি মিলেছে তিন বছরে। সুতরাং বিশ্ব আমাদের সাথে নেই একথা মানিনা। আমি আরেকটি কথা বলতে চাই, যদি আমরা বাংলাদেশের সরকারকে সহায়তা না করতাম তারা দশটি দিনও টিকতে পারত না। কারও ওপর যদি বিশ্বাস থাকে তবে সেটিও হচ্ছে এই মহান দেশ কেননা এদেশের ৫০ কোটি জনসাধারণ আন্তরিকভাবে তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের কোন দেশ এত বড় আন্তরিক স্বীকৃতি কখনো পায়নি। এখন সরকারের স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। আমি একথার পক্ষপাতী যে, বাংলাদেশের জনগণ যারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, তাদেরও নিজ শক্তিতে সামনে চলা উচিৎ এবং আমাদের উচিৎ তাদেরকে সাহায্য করা। আমি সরকারের কাছে আবেদন করছি ৯ আগস্ট সামনে আসছে, তখন পর্যন্ত যদি আমরা কোন সিদ্ধন্তে পৌছতে না পারি তবে সংসদকে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে, আমাকে আমরণ অনশন করতে হবে, সেদিন সমগ্র দেশের যুবকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্রত গ্রহণ করবে। ব্যাস, আমি এটুকুই বলতে চাই।

শ্রী ফুলচন্দ্র বর্মা(উজ্জয়ন)ঃ বাংলাদেশে আজ যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সেটি শতাব্দীর সর্ববৃহৎ গণহত্যা। সত্তুর-আশি লাখের মত লোক আমাদের এখানে এসে পড়েছে। তাদের আগমনের ফলে আমাদের অর্থনিতি ধ্বংস হচ্ছে, আমাদের সমাজে ভাঙ্গন ধরছে, একই সঙ্গে তারা আমাদের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে কেননা বাংলাদেশ হতে আগত লোকদের সঙ্গে অনেক চরও ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন মাননীয় সদস্য বলেছে যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ২১৬ জন সন্মানিত সদস্য বাংলাদেশেক স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাব উথাপন করেছেন। আমার দুঃখ হয়, আমাদের সরকার কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অগ্রসর হচ্ছেনা। আমি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে এই আবেদন করছি যে, সময় এসে গেছে, মোটেই বিলম্ব না করে আমাদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য অগ্রসর হওয়া উচিৎ।

শ্রী মুরাসলি মাড়ান(মাদ্রাজ দক্ষিণ): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, আমি ধরে নিচ্ছি আমরা যে যুদ্ধ করিনি তাতে আমরা হেরে গেছি। এটা এমন যুদ্ধ যেখানে যুদ্ধ না করেই আমরা পাকিস্তানের কাছে হেরে গেছি। তা না হলে কীভাবে আমরা ৮ মিলিয়ন লোকের বোঝা মেনে নিচ্ছি? জনাব কৃষ্ণা মেনন বলেছেন বাংলাদেশের এক দশমাংশ লোক আমাদের ভেতর ঢুকে পড়েছে। এখন আমরা একটি বাচ্চাকে ধরে বসে আছি – অথচ সে কোথা থেকে আসল তা যেন আমরা জানিনা। আমরা এটা কখনো আশা করিনি যেখানে সংসদে রেজোল্যুশন পাশ হয়েছে। আমরা তখন উৎফুল্ল মেজাজে ছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশ আজ অথবা কাল দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জানতে ব্যার্থ হয়েছি যে বাংলাদেশে আসলে কি ঘটছে। আমরা সময় মত আমাদের বন্ধুদের পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি আমরা ইন্ডিয়ান সংবাদপত্রকে গাইড দিতে ব্যার্থ হয়েছি, ও ভারতীয় জনমত গঠন কৌশলে ব্যর্থ হয়েছি – কারণ তারা সব সময় উচ্চাশামিশ্রিত সংবাদ পরিবেশন করছিল।

গণহত্যা শুরুর ছয় দিন পর, আমাদের সংসদ বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সমর্থনে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মত ভাবে পাস করে। কিন্তু এখনও আমরা তাদের স্বীকৃতি দেই নাই। যখন তা হবে তখন উপমহাদেশের ইতিহাস পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আমরা লক্ষ লক্ষ জীবন ও বাড়িঘর রক্ষা করতে পারতাম। যা করার কথা ছিল তা আমরা করিনি। “সুনিপুণ নিষ্ক্রিয়তা” শব্দটি আমাদের অবস্থানকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে বলে আমার ধারনা।

পরিশেষে, আমরা টের পেলাম যখন উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করল। যখন আমরা বুঝলাম আমাদের অর্থিনিতে টান পড়ছে, আমরা একের পর এক নানান দেশের রাজধানীতে যেতে থাকলাম। একটা সময় ছিল যখন পুরো বিশ্ব ভারতের নেতৃত্বের অপেক্ষা করত। পরে আমরা হলাম জোটনিরপেক্ষ গ্রুপের নেতা। এখন আমরা সেই উদ্যোগ, উদ্দীপনা ও নেতৃত্বও হারিয়েছি। জনাব মেনন যেমন বলেছেন, এখন যা দরকার তা হল ফরেন পলিসি। আমাদের কর্মঠ পররাষ্ট্রনীতি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মত মৃত। একটি স্পর্শ পাথর পররাষ্ট্রনীতি খুঁজে বের করতে হইবে যা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সাহায্য করবে।

আমরা কীভাবে শরণার্থী সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছি? ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের কী ঘটেছিল? এখনও সেই সমস্যা সমাধান হয়নাই। রাস্তায় সাধারণ মানুষের প্রশ্ন আপনি কিভাবে শরণার্থী সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছেন? সাধারণ মানুষ আমাদেরকে বলে, “যদি বাংলাদেশ না থাকে, যদি তাদের ভৌগোলিক অঞ্চল না থাকে, তবে এটা ভারতের দায়িত্ব সেটা তৈরি করা। ’ ইজরায়েল সেনা মরুভূমি পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। চীন এখনও আমাদের অঞ্চলের হাজার বর্গ মাইল দখল করে রেখেছে। ক্ষমতাশালীরা আমাদের কথা বুঝবে শুধুমাত্র যদি আমরা তাদের ভাষায় বোঝাতে পারি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং জনাব রজার্স ‘হত্যা’ শব্দটিকে যথাযথ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার জন্য প্রস্তুত নন। তাজউদ্দীন আহমদ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তখন তিনি বলেছিলেনঃ
“প্রতিদিন এই স্বীকৃতি ও সহায়তা বিলম্বিত হচ্ছে এবং সহস্র মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। “

শুধু বাংলাদেশ স্বার্থ নয় বরং ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের তা করতে বাধ্য করতে পারে। এটাই শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ অ্যামেরিকাতে বলেছেন। সময় ও স্থান নির্বাচন আমাদের শত্রুর হাতে থাকবে। আজকের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবর বলছে যে মুজিবুর রহমান রাওয়ালপিন্ডিতে একটি হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন। কাল হয়ত সংবাদ আসবে যে পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর বলছে যে মুজিবুর রহমানের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তার পরের দিন হয়ত খবর আসবে তিনি হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কঙ্গোর লুমুম্বাতে এরকম ঘটেছিল। একই জিনিস বার বার হতে পারে এবং মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হতে পারে। সরকারের উচিৎ তার জীবন রক্ষা করতে সম্ভাব্য সব কিছু করা। জনাব রজার্স আসছেন। এর আগে সরকারের কিছু করা উচিত। শুধুমাত্র স্বীকৃতি এই সমস্যার সমাধান করবে না। আমি আশা করব সরকার আজ তার প্রোগ্রাম তৈরি করবেন।

শ্রী রাম নারায়ণ শর্মা(ধন্যবাদ)ঃ স্পকার মহাশয়, বাংলাদেশের সমস্যা আজ আমাদের সামনে একটা জীবন মরণ প্রশ্ন। জীবন মরণ প্রশ্ন এজন্য বলছি যে এই সমস্যার প্রথম পর্যায়ে আমরা ঐ দেশের শতকরা দশ ভাগ লোককে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, জানিনা আরও কত পারসেন্ট লোক আসবে। এমতাবস্থায় আমরা যা ব্যয় করছি অন্য দেশের প্রতিও এই আশা রাখছি যে তারাও আমাদের সাহায্য করবে। তবে যেভাবে সাহায্য আসছে তা একেবারে না আসার মত। কিন্তু আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমি দেখছি যে আমাদের দেশে আগত এই ৭০ লক্ষ লোকের জন্য মাথাপিছু চার/পাচ টাকা করে ব্যয় করলেও দৈনিক ৩ কোটি টাকা খরচ হয়। যদি বছরের হিসাব ধরা হয় তাহলে তা সহস্র কোটি টাকায় পৌঁছে। এভাবে আরও আসতে থাকলে আমাদের ব্যয় আরও বাড়বে। আমাদের দেশের সমস্ত প্রচেষ্টা সে দিকেই নিবদ্ধ। সকল নেতার মনোযোগ সেদিকেই বাঁধা, সারা দেশের দৃষ্টি সেদিকেই আকৃষ্ট। এই সমস্যা আরও কত প্রকট হতে পারে তার কোন পরিমাপ নেই।

আমার তুচ্ছ অভিমতে এর সমাধান একটিই রয়েছে। এখন আপনার অন্য দেশের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। এখন আপনাকে একাই চলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার বক্তব্য হচ্ছে তাড়া যদি এগিয়ে আসে তবে ভালো কথা। যদি না আসে তবে আপনার সিদ্ধান্ত আপনাকে নিজেই নিতে হবে। ঐ সিদ্ধান্ত শুধু স্বীকৃতি দেয়াই নয় বরং বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা যেন বাংলাদেশবাসীর হাতে আসে, বাইরের আধিপত্য যেন শেষ হয়ে যায়। এজন্য আপনাকে সেখান থেকে আগত লোকদের শুধু ট্রেনিং দিয়েই নয়, যদি দরকার হয়, নিজ দেশের সৈন্য পাঠিয়েও বাংলাদেশের লোকদের মুক্ত করতে হবে। স্পকার মহাশয়, আমার পরামর্শ, সরকার বর্ডার সিল করে দিন। আজও যেভাবে হাজার হাজার লোক আসছে তাদেরকে আসতে না দিয়ে আমরা অস্ত্র দিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে দেব। শুধু অস্ত্রই নয়, যদি দরকার হয় তবে রসদপত্র দিয়েও তাদেরকে সাহায্য করব।
সুতরাং, মাননীয় স্পিকার, আমি বলব, আমার মতে এই সমস্যার সমাধান একটিই। যদি এরূপ ডিমে তেতলা নীতি নিয়ে আমরা চলি তাহলে আমাদের ব্যয় আরও বাড়বে, আমরা আমাদের ওপর বিপদ ডেকে আনব, এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে আমাদের যে অবস্থান, তা হারাব। এ জন্য আমি সরকারকে এ বিষয়ে খুব সত্বর সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ করছি।

প্রফেসর ড. এস এল সাক্সিনা(মহারাজগঞ্জ): স্যার, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। তিনি তার বীরত্ব ও দ্রুত সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার সংকল্পের অভাব এবং আলস্য আমাকে ব্যাপকভাবে ব্যথিত করেছে। তিনি ১ এপ্রিলের বাস মিস করেছেন। ২৫ মার্চ থেকে ১ লা এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্প্রদায়কে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তখন তাড়া হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে। যদি আমরা তখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতাম এবং আমাদের সৈন্য পাঠাতাম তাহলে হয়ত এত কিছু হতনা। তখন পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় অল্প ছিল এবং আমরা সহজেই তাদের পরাজিত করতে পারতাম। সেক্ষেত্রে আজ বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আবির্ভুত হত। এবং কোন সমস্যা থাকত না। কিন্তু আমরা তখন বাস মিস করেছি।

এখন আমরা বিশ্ব বিবেককে নাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু আমরা সফল হইনি। সবাই স্বার্থপর। ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারের পর, আমি আশা করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তা মেনে নেবেন না – তাতে করে চীন, পাকিস্তান বা অন্য যে কোন শক্তি হোক না কেন। আমরা আগে পাকিস্তানের সাথে সংঘাতে আমাদেরর শক্তি দেখিয়েছি। আমি আশা করি আমাদের সরকার অবিলম্বে বাংলাদেশের গণহত্যা থামাতে আমাদের সৈন্য পাঠাবে। আমাদের চীন এবং পাকিস্তান কে ভয় করলে চলবে না যাদের আমরা ১৯৬৫ সালে হারিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে আগতদের মধ্যে অনেক সাহসী যুবক আছে। আমরা এসব যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং তাদের অস্ত্র দিয়ে তাদের দেশে যুদ্ধ করতে পাঠাতে পারি। আমি নিশ্চিত বিজয় আমাদের হব এবং তারপর সবাই আমাদের সমর্থন দেবে। কারণ কেউ কাপুরুষ জাতিকে সমর্থন করেনা। কাজ করার সময় এসেছে এবং এখন আর কোন উপায় নেই। কংগ্রেসের সদস্যরাও এর পক্ষে মত দিয়েছেন। আমি আশা করি, পুরো জাতি এই মতামতের পক্ষে। অতএব, আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী সাহসের সাথে ঘোষণা করবে যে আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছি।

শ্রী এম সত্যনারায়ণ রাও (করিমনগর): আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে এই সরকার শোচনীয়ভাবে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ৩১ মার্চ এই হাউস একটি সর্বসম্মত রেজোলিউশন দ্রুত কার্যকর করার জন্য পাশ করেছিল। কিন্তু এটা ব্যর্থ হয়েছ। তাদের এই দেশ শাসন করার অধিকার নেই। এক সদস্য বললেন, যেহেতু তাদের কোন অঞ্চল বা জনসংখ্যা নেই তাই আমরা স্বীকৃতি দিতে পারিনা। তাই যদি হবে তাহলে কেন এই সরকার পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ উল্লেখ করছেন? এই সরকার বাংলাদেশ বলার কোন অধিকার রাখেনা। যদি বলে তাহলে তার আগে উচিৎ তাকে স্বীকৃতি দেয়া। স্যার, শুধুমাত্র সেটা করলেই আমরা শক্তিশালীভাবে কাজ করতে পারব। আমরা কি দ্রুত কাজ করছি? সামরিক সহায়তা অথবা সৈন্য পাঠালে সমস্ত বিশ্ব হয়ত স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসত। একটি উক্তি আছে: সফলতার মত কোন সাফল্য নেই। এটা সবচেয়ে দু: খজনক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন সর্দার হয়ত। তাকে যথেষ্ট সাহসী হতে হবে। সর্দারের মত সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারতেন। আমরা এখানে সিদ্ধান্ত নিতে পারি এবং এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারি। অন্যথায় সমস্ত বিরোধী দল একত্রে জনগণকে বলবে এই সরকারকে স্বীকৃতি না দিতে। আমি সর্দার শরণ সিংএর কাছে অনুরোধ করছি বাংলাদেশকে অবলম্বে স্বীকৃতি দিন অন্যথায় এটি আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। যখন আমাদের নিজেদের লোকদের খাওয়ানোর ক্ষমতা নেই সেই মুহুর্তে আমরা এই লোকদের পেছনে কোটি কোটি রুপি খরচ করছি। দয়া করে অন্তত এটাকে কন্সিডার করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। শুধু স্বীকৃতি নয় আমাদের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেখানকার ভিক্টিমদের পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করুন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, এই ইস্যুতে, বিরোধী দল থেকে এমন মন্তব্য আমি আশা করিনি। কি কারণে এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছিনা সেটা নিয়ে কোন বিতর্কে আমি যেতে চাইনা। আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি এবং সন্মানিত সদস্যের কাছে অনুরোধ তারাও যেন ব্যাপারটি সামলান।

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন সেটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এটা আভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এটা নিয়ে কোন বৃহত্তর জটিলতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। আপনি যদি সংযম করতে না চান তাহলে আমি বলব এটা শুধু আমাদের জাতীয় স্বার্থের কোন বিষয় নয়। এটাই আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: আপনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারের পর পরিবর্তিত কিছু বলেননি।

শ্রী শরণ সিং: আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতির উপর আমার মতামত দিব এবং অন্যান্য দিকগুলোও আলোচনা করব।
শ্রী এস এম ব্যানার্জী: তাকে কেন জ্ঞান দিচ্ছেন?

শ্রী শরণ সিং: আমি জ্ঞ্যান দিচ্ছি না। কিন্তু আমি কি নম্রতা ও আন্তরিকতা সাথে জিজ্ঞাসা করতে পারি যে কেন তিনি আমাকে এটা জিজ্ঞাসা করছেন? আমি জ্ঞান দিতে চাই না; এটা আমার পথ নয়। কিন্তু আমি সন্মানিত সদস্যকে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে বলি যে আমরা যে ধরণের জনমত তৈরি করার চেষ্টা করছি তাতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ যেন লঙ্ঘিত না হয় – আমরা সবাই যেন এক থাকতে পারি। আপনারা যদি এই ধরণের তর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন আর কি করব কি করব না সেটা বলতে থাকেন তবে আমি নিশ্চিত এতে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে এবং আমরা মূল সমস্যা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ব। আমাদের সবাইকে আমাদের মূল উদ্যেশ্য অনুধাবন করতে হবে এবং আমরা তা না করে আশেপাশের অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের পেছনে শক্তি ক্ষেপণ করছি।

আমাদের মুল উদ্যেশ্য রেজোলিউশন সম্পর্কিত যা আমরা সব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করিয়েছিলাম। এতে বলা আছে আমরা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সমর্থন দিচ্ছি এবং তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি প্রকাশ করছি। আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সেই সমর্থন বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার করেছি। এই রেজোলিউশন অনুসারে কাজ করার জন্য আমরা কীভাবে আগাব সেই ব্যাপারে আলোচনা চলছে। সেখানে মতভেদ হতে পারে। কিন্তু সেটা সমাধান করতে চেষ্টা করা উচিত এবং মুল উদ্দেশ্য বোঝা উচিৎ। শুধু একটি বিশেষ পদক্ষেপ এই সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়। এটাই সমগ্র বিষয়ের মূল কথা।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি সম্পর্কে বলা যায় সেখানে এমন কিছু তিনি বলেছেন যা আগে থেকেই আশা করেছিলাম। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতির কারণে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দায়িত্ব এখন শুধুমাত্র তার নিজের উপর বর্তায় – যেখানে তারা চাচ্ছে মুক্তি এবং সামরিক শাসন থেকে পরিত্রাণ।

প্রফেসর ড. এস এল সাক্সেনা: আপনার সাহায্য ছাড়া?
শ্রী শরণ সিং: আপনি যদি বিবৃতিটি দেখেন তাহলে দেখবেন সেখানে গণতান্ত্রিক পথে আসার কোন সম্ভবনা নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে জাতীয় পরিষদের সংবিধান প্রণয়ন না করে তিনি হয়ত এক্সপার্ট কাউকে দিয়ে সেটা তৈরি করাবেন। সেখানে আরও কিছু আপত্তিকর কথা আছে যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে তারা সামরিক শাসন চিরস্থায়ী করতে চাচ্ছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ও গণতন্ত্রের পথে যাত্রাকে সম্পূর্নভাবে অবদমিত করা হয়েছে।

গণপরিষদ নির্বাচনের পিছনে যে দর্শন ছিল যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তাদের শাসনতন্ত্র রচনা করার অধিকার থাকবে – এখন, তা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হল। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হল সামরিক শাসন সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত পদে কারা হেরেছে। অবাক ব্যাপার হল প্রশাসন এমন কিছু করতে যাচ্ছে যাতে করে একটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে এবং এতে করে তারা ওইসব নির্বাচিত আসন হারাবে। গণতন্ত্রের পথে এর চাইতে নিষ্ঠুর কৌতুক আর হয় না। তারা বলছে যদি কোন দল বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে যুক্ত থাকে তবে তাদের দোষী করা হবে তারপর তারা বিবেচনা করবে তাদের জাতীয় পরিষদের সদস্য হওয়ার অধিকার থাকে কিনা।

এটাকে বলা যায় গণতান্ত্রিক ধারণার প্রতি সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি প্রকাশ। সেখানে আরেকটি অত্যন্ত অসন্তোষজনক বিষয় রয়েছে। বলা হয়েছে যে আঞ্চলিক দলগুলো সংবিধান প্রণয়নে অংশ নিতে পারবেনা এবং কোন জাতীয় অনুষ্ঠানেও তাদের ডাকা হবেনা যতক্ষণ না তাদের সমস্ত দেশেই দলীয় শাখা থাকে। আমি মনে করি এটাই একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মুল কেটে দেবার জন্য যথেষ্ট। এতে করে শুধু বাংলাদেশ নয় পশ্চিম পাকিস্তানেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। উদাহরণস্বরূপ, বেলুচিস্তানের দল শুধু বেলুচদের কথা বলে, উত্তর পশ্চিম ফ্রন্টের প্রদেশের দলগুলো শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ – এতে করে তারা আঞ্চলিক দল হিসেবে বিবেচিত হবে – জাতীয় কোন দল হিসেবে নয় – এবং জাতীয় নির্বাচনে অংশ সুযোগ না পাবার কারণে তাদের ক্ষমতা খর্বিত হবে।

এই হচ্ছে কিছু বৈশিষ্ট্য যা গণতান্ত্রিক আদর্শের পথে সুস্পষ্টভাবে আপত্তিকর। এতে করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশাসনিক ক্ষমতা না দিয়ে গণতন্ত্রের সম্মান্য সম্ভবনাও মাটিয়ে মিশিয়ে দেয়া হল।

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আপনি এখন কি করতে যাচ্ছেন?

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: এখন কি তাহলে আপনার সব আশা শেষ হয়ে গেছে? আপনি কি এখনও একটি রাজনৈতিক সমাধানের আশা করছেন?

শ্রী শরণ সিং: আমি তেমন কোন আশা পোষণ করিনা যা তিনি আমাকে বলতে বলছেন।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: আপনি আমাদেরকে বলুন আপনার আশা কি।

শ্রী শরণ সিং: আমাদের এর প্রয়োগ বুঝতে হবে। এতে বোঝা যায় বাংলাদেশের জনগণকে দীর্ঘ আন্দলন চালাতে হবে।

স্বীকৃতির প্রশ্নে আমি বলতে চাই আমরা এটাকে নেগেটিভলি দেখছিনা, আমরা এর বিপক্ষে নই। এটা আমাদের ধারাবাহিক বিবেচনায় আছে।

ডঃ. রনেন সেন (বারাসত): কত দিন?

শ্রী শরণ সিং: এবং আমি বলতে চাই যে সঠিক সময়ে আমরা স্বীকৃতি দেব। এই অবস্থায় আমি সন্মানিত সদস্যদের জানাতে চাই যে কিছু নতুন বিষয় উঠে এসেছে এবং ইয়াহিয়া খানের সম্পূর্ন নেগেটিভ বিবৃতিতে আমাদের আচরণ পুনঃনির্নয় করতে হবে। (বাঁধা)
আমাদের তাড়াহুড়া করলে হবেনা। যখন আমরা বলি যে আমরা স্বীকৃতির বিপক্ষে না তখন অনেকেই ভাবতে পারেন না যে আমরা কীভাবে সামনে আগাব। এখানেই আমাদের স্বীকৃতির উপর তাড়া দেয়া হয়। এটাই একমাত্র বিষয় যেটা নিয়ে আমাদের তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। এর উপর আমাদের নেগেটিভ ধারনা পোষণ করলে হবেনা। আমরা এটাকে বারবার পরীক্ষা করে দেখতে পারি। যেহেতু চেষ্টা করব যারা সংগ্রাম করছে তাদের পাশে থাকার – রেজোল্যুশনে সেরকম অঙ্গীকারই আমরা করেছি যা এই হাউজে সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়েছে।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: অর্থাৎ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের শাসনের উপর আপনার স্বীকৃতি বহাল আছে। বাংলাদেশ বলা মানে আপনি সেটাকে স্বীকার করছেন। তারা সেখানে যা কিছু করছে তাকেই আপনি সমর্থন দিচ্ছেন

শ্রী শরণ সিং: এভাবে শ্রেণীগত বিবৃতি না দেয়াই ভালো – তাতে কোন লাভ নাও হতে পারে . . .

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: কেন নয়?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: এই দেশের জনগণ জানুক আপনি কি।

জনাব. চেয়ারম্যান: কওয়া করে কোন ব্যক্তি আক্রমণ করবেন না. . . . . ..(বাধা)

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আমার তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে কিছুই নাই স্যার. . . . .
(বাধা).

শ্রী শরণ সিং: আমি শুধুমাত্র বলতে চাই এসব কথায় আমার কিছু হয় না – আমি টলি না। আমি এসব চিৎকারের সাথে একমত না।

শ্রী এস এম ব্যানার্জি: আমরা আপনার কেয়ার করিনা। আপনি ভুট্টোর বন্ধু। আপনি ইয়াহিয়া খানের বন্ধু. . .

জনাব চেয়ারম্যান: জনাব ব্যানার্জি আপনি যা বলছেন সব রেকর্ড হচ্ছে। আমি আবেদন করছি আপনি হস্তক্ষেপ করবেন না . . .
আপনি একজন প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান .. আপনার প্রায়শ এমন করা উচিত নয়।
শ্রী শরণ সিং: স্যার, আমি বিতর্ক বাড়াতে চাইনা। আমি বলতে চাই এই মুহুর্তে এটি সরকারের অবস্থান – আমার ব্যাক্তিগত অবস্থান নয়।

আমরা এটা পর্যালোচনা করছি এবং আমরা যথাযথ সময়ে সিদ্ধান্ত নেব। এটা আমাদের অবস্থান এবং আমি আশা করি এটা প্রশংসা করা হবে এবং জনাব সমর গুহের কাছে অনুরোধ করছি এই ইস্যুতে দেশ ও হাউজকে বিভক্ত না করতে। কারণ এখানে কোন দ্বিমত নেই। এবং আমি চাইনা স্লোগানে স্লোগানে মূল বিষয় হারিয়ে যাক। এটা ছোঁড়াছুড়ির ম্যাচ না। মাননীয় সদস্য এর সাথে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ঝুঁকি জড়িত। . . . .(বাধা). তাই আমাদের দায়িত্ব. . . .

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আমেরিকা সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনি কেন আপনার কর্তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না?

শ্রী শরণ সিং; একটির সাথে আরেকটি গুলিয়ে ফেলার দরকার নেই।

সেটি অস্ত্র সরবরাহের প্রশ্নের সাথে সমর্কিত। (বাধা)। আমি ইতিমধ্যে আমার শক্তিশালী প্রতিবাদ জানিয়েছি।
(বাধা).

জনাব চেয়ারম্যান: আমি কাউকে ইচ্ছামত দাঁড়াতে দেবনা। আমি মাননীয় জনাব ইন্দ্রজিৎ গুপ্তকে প্রশ্ন না করার অনুরোধ করছি। জনাব বড়ে. আমি আপনাকেও অনুমতি দিচ্ছিনা। এভাবে হাউজ চলেনা।

শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত: মাননীয় মন্ত্রী বসে পড়ার আগে আমি জানতে চাই তিনি সে উত্তর দিচ্ছেন সেটা কি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দূত হিসেবে কিনা। বিশেষ দূত। জনাব কিসিঞ্জারের পদ আপনার হওয়া উচিৎ। তার সফরে আমাদের প্রভাবিত হওয়া উচিৎ না। আমাদের উচিৎ আমাদের সমস্যা বলা, দেশের স্বার্থের কথা বলা।

শ্রী কৃষ্ণ মেনন: মন্ত্রী তার উত্তর শেষ করার আগে এটা বলবেন কি? তিনি বলেছেন, তাকে স্লোগান দ্বারা বিভক্ত করা উচিত নয়। স্বীকৃতির বিষয়টা কি স্লোগানের মত হাল্কা বিষয়? আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি স্লোগানের মত বিষয় নয়।

শ্রী মুরাসলি মরণ: আমরা জেনেছি যে শ্রী মুজিবুর রহমান গুরুতর অসুস্থ। . . .

জনাব. চেয়ারম্যান: আর কোন প্রশ্ন নয়।

শ্রী সেজিয়ান (কুম্বাকোনাম): শ্রী মুজিবুর রহমান গুরুতর অসুস্থ। এটা তাদের স্বাভাবিক চালাকি। যখনি তারা কারো জীবন নিয়ে কিছু করতে চায় তখন তারা এসব বলেন। আজ বলা হয়েছে, মুজিবুর রহমান অসুস্থ। আগামীকল্যই তারা বলতে পারেন, তিনি এখনো শঙ্কামুক্ত নন। আগামী পরশু এটা রিপোর্ট করা হতে পারে যে তার মৃত্যু হয়েছে। আমি জানতে চাই সরকার এ ব্যাপারে কি করছে?

শ্রী শরণ সিং: আমি বলতে চাই যে, এই নীতিই আমরা ফলো করার চেষ্টা করছি এবং আমরা বরাবর হাউস এবং হাউজের বাইরে বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তা অবহিত রেখেছি। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভারত সফরের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আমি মাননীয় সদস্যকে বলব কোন সম্পর্কই নেই এমন কিছুর সাথে কোন কিছু মিলিয়ে ফেলবেন না। আমি জানিনা জনাব কৃষ্ণ মেনন স্লোগানের সাথে বিষয়টি আলাদা কীভাবে করলেন।

শ্রী কৃষ্ণ মেনন: আমি বলেছি স্বীকৃতিকে আপনি স্লোগানের সাথে তুলনা করেছেন।

শ্রী শরণ সিং: সে ব্যাপারে আমি অবস্থান স্পষ্ট করেছি। এবং সেটা সরকারেরও অবস্থান। বিষয় হল কখন এটা করা উচিত। স্বীকৃতির সাথে স্লোগানের কোন সম্পর্ক নেই। আমি বলতে চেয়েছি যে স্লিঙ্গিং ম্যাচ আপনারা শুরু করেছিলেন সেই ব্যাপারে। পার্থক্য হচ্ছে সময়জ্ঞ্যানে – যে কখন স্বীকৃতি দিতে হবে। এটা একটা বাস্তব প্রশ্ন। তাই আমি বলেছি যেহেতু হাউজে মূল বিষয়ে তেমন কোন পার্থক্য নেই তাই অন্য কোন ক্ষুদ্র ইস্যু নিয়ে সেখানে বিভক্তি সৃষ্টি করা ঠিক হবেনা। আমি এটাই বলতে চেয়েছি।

শেষ প্রশ্ন সম্পর্কে, আমি সম্পূর্ণরূপে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। বস্তুত, এই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেই এবং আমাদের সবাইকে পাকিস্তানের সঙ্গে খুব জোরালোভাবে দেখতে বলেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান একটি অসামান্য নেতা যিনি এমন অসামান্য বিজয় অর্জন করেছেন এবং যারা আনুগত্য ও কমান্ডের উপর পাকিস্তানের সুবিশাল সংখ্যার জনগণ আস্থা রেখেছে। বস্তুত তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জয় লাভ করেছেন যদি আমরা সম্পূর্ণ পাকিস্তানকে হিসাবে ধরি। তিনি একজন অসামান্য নেতা। আমরা বলেছি সরকারিভাবে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা সব রকমের চেষ্টা করা হবে। আজ সকালে বলা হয় যে, তিনি গুরুতর অসুস্থ। কিছু দিন আগে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে তার স্বাস্থ্য একটু ভিন্নরকম আছে। এই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমরা সব সরকারকে বিশেষভাবে তাড়া দিয়েছি যাতে করে তারা পাকিস্তানের সামরিক শাসককে শেখ মুজিবুর রহমান এর মতন একজন অবিসংবাদিত নেতার সুস্থতা নিশ্চিত করতে বলে। কিছু সন্মানিত সদস্য বলেছেন আমরা বলিনি যে তাকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। আমি প্রকৃতপক্ষে আরও বেশী কিছু করেছি। আমরা বলেছি শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দিলে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান হবে – কারণ তিনি তাদের অবিসংবাদিত নেতা। তাকে ছেড়ে দিলে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হবে যে তাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবে। আমরা সব সময় তার মুক্তির পক্ষে এবং আমরা সকল সরকারকে অনুরোধ করেছি।

১৭-০০ টা

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: তিনি কি জানেন তাকে আসলে কোথায় রাখা হয়েছে?

শ্রী শরণ সিং: আমাদের তথ্য অনুযায়ী তিনি এখনো পশ্চিম পাকিস্তানে।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: কারাগারে?

শ্রী এস এম ব্যানার্জী: কোন জেলে? পশ্চিম পশ্চিম পাকিস্তান অনেক বড়। আমি জানি। তাকে কোন জেলে রাখা হয়েছে।

শ্রী সমর গুহ: এই পর্যায়ে এটা বলা সঠিক নয়।

শ্রী শরণ সিং: অতএব, শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা প্রশ্নে এবং সামরিক শাসক তাকে ভালো রাখার ব্যাপারে এবং তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দেবার ব্যাপারে এবং একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর শুরু হবার ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে। এবং আমি সন্মানিত সদস্যকে অনুরোধ জানাচ্ছি এটিকে ভোটের জন্য রেজল্যুশন দেবেন না। কারণ আমাদের এখন এই বিষয় নিয়ে বিভক্ত করা উচিত হবেনা।

ডঃ. রনেন সেন: একেবারে নিরাশ বিবৃতি।
শ্রী শরণ সিং: আমি জানি আমি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারি নাই।

শ্রী এস ব্যানার্জিঃ তিনি ভারতের কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেন না।

শ্রী সমর গুহ: এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী বলেছেন যে, সরকার বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতির ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা এখনও ইতিবাচক কি করেছেন তা বলেননি। সম্ভবত সরকার এত তাড়াতাড়ি দিতে হতে পারে তা ভাবেননি এবং তাই একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপর জোর চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের আশা ইয়াহিয়া খান কর্তৃক বিস্ফোরিত হল। আমি জানি না আমাদের সরকার এখনও কোন নরম বিছানায় শুয়ে চরম-আলস্যে শীতনিদ্রা দেবেন কিনা। আমি জানি না তারা কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ নেবেন কিনা। কিন্তু আমি সত্যিই অবাক হয়েছি যে আমাদের সরকার বাংলাদেশের প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বার্থের উপর আরো বুদ্ধিমান ও বিশেষজ্ঞ হয়েছেন – কারণ তারা বুঝতে পেরেছেন কোনটা ভালো কোনটা খারাপ – কখন স্বীকৃতি দিলে ভালো হবেনা ইত্যাদি। যখন বাংলাদেশের সব মানুষ, তাদের নেতা, তাদের সরকার, এবং তাদের মুক্তি বাহিনী এবং তাদের সব রাজনৈতিক নেতারা একবার নয় – বারবার শুধু ভারতকে নয় – এখন সারা পৃথিবীর মানুষকে বলছে তাদের সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে – তখন আমাদের সরকার কীভাবে বলেন যে এখন স্বীকৃতি দিলে তা ভালো হবে না খারাপ হবে। আমি জানিনা হয়ত আমাদের সরকার তাদের চাইতেও ভালো জানেন যে তাদের আগ্রহ কিসে।

আমি জানি না আমাদের এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রীর জন্য কোন বিশেষণ ব্যবহার করা উচিত। যদি তিনি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি বলতে চাই তিনি সত্যিই একজন বিভ্রান্তিকর পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কারণ তিনি অনেকবার আমাদের বিভ্রান্ত করেছেন এই বলে যে যদি ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে অন্য কোন দেশ আমাদের অনুসরণ করবে না। কিন্তু শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ তার ৪৮ দিনের সফরে কূটনৈতিক বাঁধা উপেক্ষা করে বিশ্বের ২০ টি দেশ এর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে আলাপ করেছেন এবং তাদের অনেকে একটি প্রকাশ্যে স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছেন যে যদি ভারত সাহস নিয়ে স্বীকৃতি দেয় তবে বিভিন্ন দেশ সেটা অনুসরণ করবে। অন্তত চার বা পাঁচটি দেশ অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবে।

কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি স্টেটমেন্ট ইস্যু করা হয়েছে যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ।

আমি জানি না কি সরকার বিশ্বের মতামতের সংহতি সম্পর্কে আরও কি আশা করেন। সম্ভবত এর আগে কোন সময়, কোন নির্দিষ্ট বিষয়, পুরো বিশ্বের মতামত, পত্রপত্রিকা ও জনমত ইহাহিয়া খানকে নিন্দার ব্যাপারে এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থনের ব্যাপারে এতোটা সর্বসম্মত ছিলোনা।

একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্বীকৃতি ইস্যুতে আমাদের বন্ধু সোভিয়েত রাশিয়ার আচরণ। যদি মস্কোর চাপ মাপার জন্য আমাদের ব্যারমিটার থাকত তাহলে দেখতাম সেটা আমাদের ভারতীয় সি পি আই এর ব্যারোমিটারের সমান। আমরা তাদেরকে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উচ্চকণ্ঠ পেতাম। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা সব সময় তাদের অতি উচ্চস্বরে চিৎকার করতে দেখি। রাশিয়া যদি বলত যে তারা স্বীকৃতি দেবে। আমি সরকারের কাছে জানতে চাই মস্কো বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের অবস্থান দিল্লীকে জানিয়েছে কিনা। যদি জানায় তাহলে তার রাজনৈতিক ইমপ্লিকেশন কি? সেটা হল সরকারের উচিৎ অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। রাশিয়া তাতে দ্বিমত করবেনা। তারা ১/২ মাসের মধ্যে ভারতকে সাপোর্ট দেবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।

আমি সরকারকে সতর্ক করে দিতে চাই সময় হচ্ছে সবচেয়ে সিদ্ধান্তকারি বিষয়। এটাই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারন করবে – ৭ মিলিয়ন উদ্বাস্তু আর ভারতের ভাগ্য নির্ধারন করবে। আমি সরকারকে সতর্ক করে বলতে চাই আমাদের শত্রু এখন সময়। আর পাকিস্তান হল সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমরা ইতিমধ্যে খুব মূল্যবান প্রারম্ভিক সময় ব্যয় করেছি। ২৫ মার্চ পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তার এক ব্যাটেলিয়ান সেনাবাহিনী নিয়ে যেয়ে কুণ্ঠাবোধ করেনি। তারা বাংলাদেশের আন্দোলনকে পিষে ফেলতে চেয়েছিল – কারণ তারা ভীত ছিল – তারা ভেবেছিল যদি তারা পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য নিয়ে যায় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়বে। ২ সপ্তাহ পর যখন তারা বুঝতে পারল যে ভারত কিছু করতে যাচ্ছেনা তখন তারা আড়াই ডিভিশন সৈন্য পাঠাল যা দিয়ে তারা বাংলাদেশের অভ্যুত্থান দমিয়ে দিল এবং প্রায় ১০ লাখ দেশপ্রেমিকে হত্যা করল।

আমি আরও মনোযোগ আকর্ষন করে বলতে চাই যে চিন ১২ এপ্রিল পর্যন্ত একটি শব্দও করেনি। তারা ভারত কি করে তা দেখছিল। রাশিয়াও প্রথমে খুব কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিল কারণ রাষ্ট্রপতি পোদ্গোর্নি ইয়াহিয়া খানকে একটি শক্তিশালী চিঠি লিখেছিলেন। সেটা ফলো আপ করেন নি কেন? উত্তর মস্কোতে নয় – দিল্লীতে আছে। দিল্লী সঠিকভাবে পর্যাপ্তরূপে এবং কার্যকরভাবে রিএক্ট করেনি।

আমি আরও দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই যে ২৫ মার্চের পর থেকে প্রায় ২ সপ্তাহের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং অন্যান্য সব বিশ্বশক্তিগুলোর সম্পূর্ণরূপে নীরব ছিল। কারন কি? তারা সাবধানে ভারতের প্রতিক্রিয়া দেখছিল। ভারত কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। কূটনৈতিক অনুশীলন অনুযায়ী, তারা অকারণে পাকিস্তানকে জ্বালাতে পারেনি।
সময় পাকিস্তানের পক্ষে এবং আমাদের বিপক্ষে। আমরা অনেক অনুমান করেছি। আমাদের প্রথম ভাবনাটি ছিল যে পাকিস্তান পশ্চিম থেকে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে তাদের সেনা নামানোর সাহস করবে না। এটা ভাবনার কারণ হলো এই যে আমরা ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশের বিপ্লব তারা নিজেরাই অর্জন করতে সক্ষম হবে। যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের দ্বিতীয় ভুল ধারনা ছিল ছিল যে অনধিক দুই মিলিয়ন উদ্বাস্তু ভারতে পার হয়ে যাবে। একটি সভায় যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন যে প্রায় ১৫ লাখ উদ্বাস্তু এসেছেন। জনাব চৌহান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমার পাশে বসা ছিলেন এবং তখন আমি বললাম যে, ভারতের অস্থায়ী গতিশক্তিহীনতা লাভ করছে। এটা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যিনি তা থেকে ভারতকে তুলে আনছেন। আমি জানি না, এখানে কোন কৃষ্ণ আছেন কিনা যিনি মন্ত্রীকে কাজ করতে বলবেন। আপনাকে কাজ করতেই হবে।

সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, এবং শিপিং ও পরিবহন মন্ত্রী (শ্রী রাজ বাহাদুর): তিনি শেষ করার আগে আমি একটি কথা বলতে চাই। যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে এবং যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে বিষয়টি পরখ করা হচ্ছে। অতএব, কার্যপ্রণালী বিধি নিয়ম ৩৪০ এর অধীনে, আমি মনে করি প্রশ্ন বিতর্ক এখন স্থগিত করা হতে পারে।

শ্রী এস এম বানেরি; ৩(১) পড়ুন যদি আপনি নিয়ম অপব্যাবহার চান।

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমি নিয়ম অপব্যবহার করছি না। আমি দুইটি অনুরোধ করেছি। বহিঃবিষয়ক মন্ত্রী ইতিমধ্যে অবস্থান বিবৃত করেছেন। এটি একটি উন্নয়নশীল পরিস্থিতি। আমরা হঠাৎ করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। অর্থাৎ যে কোন একটি স্ন্যাপ ডিসিশন। যেহেতু অবস্থা উন্নয়নশীল তাই একে পর্যালোচনার অধীনে রাখা হয়েছে। আমাদের এর প্রয়োগ এবং প্রতিক্রিয়া বুঝতে হবে অথবা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর ঘোষণার প্রতক্রিয়া দেখতে হবে। তাই আমি অনুরোধ জানাচ্ছি যে বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হতে পারে।

জনাব চেয়ারম্যান: নিয়ম অপব্যবহার বলে কিছু নাই। (বিঘ্ন) বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হল। শ্রী এ কে গোপালন।

শ্রী সমর গুহঃ স্যার, যেহেতু বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হয়েছে রেজল্যুশন বেঁচে আছে। আমি হাউসকে ভাগ করতে চাই না। যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোন বাধা না থাকে তাহলে কোন সন্দেহ নেই যে এই রেজল্যুশন সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের দ্বারা গৃহীত হবে। কিন্তু আমি হাউসকে ভাগ করতে চাই না। আমি একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে চাই এবং হাউস ভাগ চাইনা। আমি তাই আমার রেজল্যুশন এর উপর এই বিতর্কের স্থগিতকরণে সম্মত আছি।

জনাব. চেয়ারম্যান: প্রশ্ন হল: “বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করা হল”।
প্রস্তাব গ্রহণ করা হল।

শ্রী এস এম বানেরি: পয়েন্ট অব অর্ডারে, স্যার, হাউসে ভোট চাওয়ার আগে, আপনি বিতর্ক অনির্দিষ্টকাল স্থগিত করে দিলেন।
জনাব চেয়ারম্যান: পরে আমি হাউসে ভোট গ্রহণ করেছি।

সর্বশেষে, পাকিস্তান সময় ক্ষেপণ করছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে টাকা পাবার জন্য।

তাই আমি বলেছি সময় এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমি দুঃখিত যে, সরকার জানেন না যে একটি বিপ্লবী জাতীয় আন্দোলনের গতিশীল পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করতে হয়। আমি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলব রাশিয়ান বিপ্লবের ইতিহাস পড়ে নিতে। ট্রটস্কি, যিনি সেই বিপ্লবের স্থপতি ছিলেন, একটি বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে তার মেজাজ ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা নির্ধারণের উপর। আপনি ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের মানুষ এক মাস আগে যুদ্ধ শুরু করেছে। এক মাস ধরে সেখানে অসহযোগ আন্দোলন চলেছে। এবং তারপর থেকে তিন মাস ধরে তারা যুদ্ধ করছে। এটা চতুর্থ মাস। এটা কি সম্ভব তাদের জাতীয় অভ্যুত্থান আকাঙ্ক্ষা, শক্তি ও মানুষের মেজাজ আগের মতোই আছে? তাই আমি বলতে চাই, এই আন্দোলনের স্বীকৃতি অত্যাবশ্যক। এটা তাদের বাহুতে একটি শট হিসেবে কাজ করবে; এটা তাদের পুরো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেবে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে তাদের বিশ্বাস পুনস্থাপন করবে এবং নতুন কর্মউদ্দীপনা যোগাবে; উজ্জ্বল কর্মউদ্দীপনা।

আপনি সত্যিই দেখতে চান তাহলে, আপনি দেখতে পাবেন যে, বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধারা সিংহের মত যুদ্ধ করছে। যেখানেই আমি চলে গেছি সেখানেই আমি তাদের অপারেশন বেস দেখেছি। প্রথম যে প্রশ্ন তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে তা হল “আপনারা কখন আমাদের স্বীকৃতি দেবেন? ” স্বীকৃতি মানে তারা তাদের নিজস্ব সংগ্রামের রাজনৈতিক স্বীকৃতি চায়। স্বীকৃতি মানে হল আমরা যে তাদের স্বাধীনভাবে সাহায্য করতে চাই তার স্বীকৃতি; এখানে কোন কূটনৈতিক বাঁধা থাকবেনা।

আমি সরকারকে সতর্ক করতে চাই, যারা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের কথা বলেন আমি তাদের পক্ষে নই। আমি মনে করি স্বীকৃতি হচ্ছে এই মুহুর্তে যুদ্ধের একমাত্র বিকল্প। অন্যথায় ইতিমধ্যে যুদ্ধকালীন পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে এবং এই হাউসের অনেক সদস্য বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেছেন। বাংলাদেশকে মুক্ত করার কথা বলছেন। এর মানে কী? এটার মানে যুদ্ধ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ করার জন্য কোন প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের নিজস্ব মুক্তিবাহিনী আছে। তাদের গেরিলা যোদ্ধা আছে; তারা তাদের পুরো উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। আপনি যদি তাদের অস্ত্র ও অন্যন্য সরঞ্জাম দেন তা তাদেরকে শক্তিশালী করবে এবং বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক স্বাধীনতা চালিয়ে যাবার সুযোগ দেবে। সেটা তাদেরকে শক্তিশালী করবে। এটাই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে একমাত্র বিকল্প। অর্থাৎ, তাদের অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে হবে। এরপর স্বাধীন জাতির ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে আপনি তাদের অস্ত্র দিতে পারেন; তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এবং তারা যা কিছু চায় তার সবকিছু দিতে পারেন – এমনকি তারা বিশ্ব ঘুরে আসার স্বাধীনতা পাবে। এটাই আমি বলতে চাই। এটাই বাংলাদেশকে সাহায্য করার একমাত্র উপায়।

আমি শেষ করার আগে শুধু একটা শব্দ বলতে চাই। কুরুক্ষেত্রের খারাপ সময়ে কি ঘটেছে? মহাভারতে কি লেখা আছে? অর্জুন ৮০ লাখ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন যে আমি শিশুসুলভ কথা বলছি। তিনি বলেন, অনধিক ২০ লাখ আসবে। এখন অবস্থা কি? আপনার দ্বিতীয় ধারনা বিলকুল ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

তৃতীয় ভাবনাটি এখনো চলছে। তারা ভাবছেন যে পাকিস্তান ভেতর থেকে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ভেঙ্গে যাবে। আজকাল কোন দেশ অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে পতন হয়না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আছে, তেল-সমৃদ্ধ দেশ আছে। এমনকি সঙ্গী দেশগুলো ভয় করে যে, তাদের ঋণ শোধ না করা হতে পারে; রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানকে সহায়তা দিতে অস্বীকার করতে পারে এবং যদি তারা আরও ঋণ দেয় তাও হয়ত পরিশোধ করতে পারবেনা। সুতরাং শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভিত্তিতে তারা পাকিস্তানকে আটকাতে পারবেনা। সম্ভবত পাকিস্তান আরো এইড পেতে বিদেশী শক্তির সঙ্গে একতরফা আলোচনার সময় পাবে।

আপনি যদি পাকিস্তানকে সময় দেন তাহলে এর মানে কী? আমি এর ফলাফল বলতে পারি। প্রথমত সে দুইটা নতুন ডিভিশন আর্মিকে অস্ত্রসাঁজে সজ্জিত করার সময় পাবে – সাথে থাকবে চাইনিজ মিলিটারি হার্ডওয়্যার। এটাকে দ্রুততম সময়ে করার জন্য পাকিস্তান ডিভিশনগুলোকে এক তৃতীয়াংশ ট্রেইন্ড সৈন্য আর এক তৃতীয়াংশ নতুন সৈন্য দিয়ে মিশিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে ফ্রান্স থেকে দুই স্কোয়াড্রন ফাইটার বোমারু বিমান পাচ্ছে। তৃতীয়ত, পাকিস্তান শিগগিরই তার চতুর্থ সাবমেরিন পাচ্ছে। চতুর্থত, পাকিস্তান আগামী দুই মাসের মধ্যে ন্যাটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইরান ও তুরস্ক থেকে অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশের শপিং সম্পন্ন করার সুযোগ পাচ্ছে। পঞ্চমত, পাকিস্তান তার বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর বাংলাদেশী অফিসার ও কর্মিদের প্রতিস্থাপন করার সময় পাচ্ছে। এদের সংখ্যা বাহিনীর প্রায় ২০ শতাংশ। এবং তাদের অধিকাংশই প্রযুক্তি কর্মি। নৌবাহিনীতে যারা আছেন তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। তারা এখন বাঙালিদের জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আপনি তাদেরকে আসব করার সময় দিচ্ছেন। এখন তাদের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীতে প্রশিক্ষিত কর্মী ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম আছে। এবং তাদের সময় দিয়ে আপনি তাদের এই শূন্যতা দূর করার সুযোগ দিচ্ছেন।

ষষ্ঠত, পাকিস্তান বাংলাদেশে অবাঙালিদের মধ্যে থেকে সশস্ত্র মিলিশিয়া, প্যারা মিলিশিয়া, পুলিশ বাহিনী এবং পাল্টা গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সময় কাজে লাগাচ্ছে। সপ্তমত, বর্তমানে নৌপথ বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সরবরাহ এবং যোগাযোগ লাইন; তারা রেল ও সড়ক যোগাযোগ পুনরূদ্ধারের জন্য ক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং যদি আপনি তাদেরকে সময় দেন তাহলে তারা এটা করে ফেলবে। অষ্টমত, পাকিস্তান চীন থেকে চীনা গানবোট এবং কয়লা পাচ্ছে। নবমত, পাকিস্তান এই সময়কে রাজনৈতিকভাবে ব্যাবহার করছে – তারা মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী ও অন্যান্য পুতুল দল এবং বিভীষণ তৈরি করছে যারা বাংলাদেশে তাদের সমর্থন দেবে। দশমতঃ তারা খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধি এবং দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরি করে আরও মানুষকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাঠাবার সুযোগ পাচ্ছেন।