You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.18 | বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান প্রসঙ্গে বিরোধী সদস্যদের প্রস্তাব বিতর্ক | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৯। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান প্রসঙ্গে বিরোধী সদস্যদের প্রস্তাব বিতর্ক ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ১৮ জুন ১৯৭১

 

১৬:৪৯ ঘটিকা

সিদ্ধান্ত: বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান

শ্রী সমর গুহ (কোন্টাই): আমি মাননীয় স্পিকারের অনুমতি নিয়ে আমার প্রস্তাব পেশ করছি।

১৬:৪৯
এই মহান সংসদ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে আমাদের পবিত্র সংবিধানের মূলনীতি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র সমুন্নত রাখতে, বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহনী পরিচালিত গণহত্যার সমাপ্তি টানতে; লক্ষ লক্ষ গৃহহারা উদ্বাস্তুকে নিজের দেশে ফিরিয়ে দিতে এবং উপমহাদেশে শান্তি, উন্নতি এবং প্রগতির একটি নবযুগের সূচনা করতে ভারতীয় সরকারের উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাদের জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষে প্রাথমিক সবধরণের সহায়তা করা।

১৭:০০ ঘটিকা
এই মহান সংসদে এমন একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপন করতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। কাকতলীয়ভাবে ঠিক এই সময়েই লেবার পার্টির নেতা বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করার প্রস্তাব তুলে ধরেছেন এবং ১২২ জন সাংসদ ইতিমধ্যে ঐ প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। প্রয়াত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন.এফ.কেনেডির ছোট ভাই সিনেটর টেড কেনেডিও যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে একই দাবী জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে বাংলাদেশের বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ইতিহাসের কোন দূর্ঘটনা নয়, বরং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের একটি যৌক্তিক পরিসমাপ্তি। ১৯৩৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ ছাত্র রহমতুল্লাহ রক্ষণশীল আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তান গঠনের ধারণা প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব যখন তৎকালীন বৃটিশ অফিসার জনাব জাফরুল্লাহর কাছে তুলে ধরা হয়, তিনি একে অবাস্তব একটি রাজনৈতিক কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন। এই রাজনৈতিক কল্পনা ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট মধ্যরাতে বাস্তবায়িত হয় এবং তখন থেকেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের সূচনা।

তখন আমি ঢাকায় ছিলাম। ১৯৪৭ সালে আমি ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে আসি।

আমি আশা করি আপনি আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেবেন। যুগবাণী নামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে আমি ২০ এর অধিক প্রবন্ধ লিখেছি। প্রবন্ধগুলোতে আমার মূল বক্তব্য ছিল যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অবধারিত এবং এই স্বাধীনতা শুধু সংখ্যালঘুদের সমস্যার সমাধান করবেনা বরং পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে যত সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধানেরও চাবিকাঠি হয়ে উঠবে। সেসময় আমার অনেক সম্মানিত সহকর্মী আমার লেখা নিয়ে হাসি মষ্করা করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও আমি পূর্ব বাংলা নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছি এবং একটার পর একটা বই লিখে গিয়েছি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা গণহত্যার পর অনেকে এটিকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেই সময় আমি শাস্ত্রিজীর সাথে দেখা করি। তখন আমি সাংসদ ছিলামনা। তিনি আমাকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমার বক্তব্য লিখিত আকারে তাঁকে দিতে বলেন। আমার বক্তব্য নিয়ে আমি একটি বই লিখে ফেলি এবং সেই বইটি শাস্ত্রিজীকে উপহার দেই। সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হিসাবে আমার প্রস্তাবের প্রথম দফা ছিল, “পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে সব রকমের সহযোগিতা করতে হবে। “

তারপরে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর “ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইস্ট বেঙ্গল” নামে আমি আরেকটি বই লেখি। বইটি পূর্ব বাংলার ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং পাকিস্তান সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ৬৫ এর যুদ্ধের পর পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবী পেশ করার পর আমি আরেকটি বই লিখি, বইটি প্রকাশের সময় আমার বন্ধুরা নিজ নামের পরিবর্তে ছদ্মনাম ব্যাবহার করার পরামর্শ দেন এবং আমি তাদের কথা মেনে নেই। আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট যে কোন রাজনৈতিক দূর্ঘটনা নয় সেটি তুলে ধরা। এটি অবধারিত ছিল। এই বিস্ফোরণ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অনিবার্য পরিণতি। এই কারণে আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে বাংলাদেশী শরণার্থী সমস্যা যদিও এই বিপ্লবের সাথে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু এটি মূল আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা জটিল একটি সমস্যার সমাধান। বাংলাদেশে যা ঘটছে সেটি ঐতিহাসিক একটি বিপ্লব এবং এর ভেতর লুকিয়ে থাকা অমিত সম্ভাবনা সমগ্র উপমহাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে।

মাননীয় স্পীকার, স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হলে সেটি উপমহাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আপনি যদি বাংলাদেশের সমস্যার মূলে যান, তাহলে আপনি তার স্বাধীনতার বৈপ্লবিক গুরুত্ব এবং এই লাখো শহীদের আত্নদান ভারত এবং সমগ্র মানবতাকে কি দিয়েছে সেটা অনুধাবন করতে পারবেন। সেই কারণে আমি জানতে চাই যে, এই বিপ্লবের অফুরন্ত সম্ভাবনার ব্যাপারে আমাদের সরকার অবহিত আছেন কিনা।

কিছুদিন আগে মাননীয়া প্রধাণমন্ত্রী রাজ্যসভায় উল্লেখ করেছেন, ” বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের নরকতুল্য অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। যদি আমাদের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সাহস দেখায়, তবে ভারতীয় জনগণ খুশি মনেই নরকের ভেতর দিয়ে যাবে এবং সব ধরণের ভোগান্তি সহ্য করবে। আমি নিশ্চিত যে সরকার এই ইতিবাচক পদক্ষেপটি নিলে সমগ্র ভারতবাসী সরকারের পেছনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াবে এবং সব কষ্ট হাসি মুখে সহ্য করে নেবে।

যুদ্ধ শুরু হবার আড়াই মাস হয়ে গেল, সরকারের আচরণ কি? জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার নানা রকমের টাল-বাহানা করছে। আমাদের সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা একাধিকবার বলেছেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। তাদের বক্তব্য থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে সার্বভৌম বাংলাদেশের যৌক্তিকতা সরকারও অস্বীকার করতে পারছেনা। তবে কখন এই স্বীকৃতি দেয়ার যৌক্তিক ও উপযুক্ত সময়, এই ব্যাপারে তারা দ্বিধাগ্রস্হ।

কিছুদিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে স্বীকৃতি দেয়া হবে। এবং সঠিক সময়ে স্বীকৃতি দান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে পরিস্থিতি কতটুকু জটিল হলে স্বীকৃতি দান করার সঠিক সময় আসবে? এই ব্যাপারে সরকার কঠোর রকমের নীরবতা পালন করছে। এমনকি কি পরিস্থিতি, বা কি কি বিষয় সমূহের উপর ভিত্তি করে তারা স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময় নির্ধারণ করবে সে ব্যাপারে সংসদকেও কিছু জানাচ্ছেনা।

কিন্তু জনগণ কি চায়? বেশীরভাগ রাজ্য সরকার সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাব করেছে। কোন কোন মন্ত্রী এবং কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা প্রকাশ্যে বলেছেন যে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। মুসলিম লীগ বাদে সংসদের প্রতিটি বিরোধীদল একমত যে এখনই স্বীকৃতি দেবার উপযুক্ত সময়। মিঃ চাগলা, মিঃ সেটালভাডের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞেরা একবাক্যে বলেছেন যে সরকারের উচিত এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। অসংখ্য জনসভায় ভারতীয় জনগণ একই দাবী তুলেছে। কিছুদিন আগে যখন সেন্ট্রাল হলে লোক সভা এবং রাজ্যসভার সদস্যদের সামনে বাংলাদেশী সংসদীয় দল নিজেদের বক্তব তুলে ধরে স্বীকৃতি চান, তখন দুই সভার সদস্যরাই একযোগে বজ্র কন্ঠে তাদের সমর্থন জানান। এসব ঘটনা থেকে কি প্রতীয়মান হয়? এখান থেকে বোঝা যায় যে প্রায় পুরো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু হয় সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, অথবা সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। সরকার মনে করে সঠিক সময় নির্ধারন করার মত প্রাজ্ঞতা শুধু তাদেরই আছে, কিন্তু জনগণ মনে করে সময় ইতিমধ্যে পার হয়ে গিয়েছে এবং আর দেরী করা সরকারের উচিত হচ্ছেনা।

সরকার সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে চায়। স্বাভাবিক ভাবেই এর মানে দাড়ায় যে সরকার পাকিস্তানকেও সময় দিতে চায়। পাকিস্তান সরকারের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশী চতুর ও চক্রান্তকারী। তারা কতটুকু নীচে নামতে পারে সেটা চিন্তাও করা যায়না। সরকারের সময়ক্ষেপণের সুযোগে তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং বিপ্লব গুড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশে নিজেদের পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে হিন্দুদের দেশ ছাড়া করবে, যার ফলে ভারতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতী বিনষ্ট হবে এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা দেখা দেবে। সরকার সময় চায়। তারা কি মনে করে যে এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু এক ধরনের জড়বস্তু? তারাও মানুষ, তাদেরও রাগ, উদ্বেগ ও অন্যান্য অনুভূতি আছে। নয়াদিল্লী থেকে চাপিয়ে দেয়া নির্দেশের মাধ্যমে তাদের সবসময় নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। ইতিমধ্যেই অনেক ধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। অনেক জায়গায় এলাকাবাসী এবং শরণার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। এধরণের ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং আমাদের জন্য একটা বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করবে। সুতরাং এই সময়ক্ষেপণ পাকিস্তানের নয়, আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। এই সময়ক্ষেপণ পাকিস্তানকে আরো ষড়যন্ত্র করার এবং আমাদের জন্য আরো সমস্যা সৃষ্টি করার সুযোগ করে দেবে।

পদক্ষেপ নেবার কথা আর কি বলব, গণহত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত, পাকিস্তানের নেয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপের উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত আমাদের সরকার দেখায়নি। আমি বলতে চাই যে পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিনষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে এবং কিছু করা দূরে থাক, আপনারা এ ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত দেখাতে চান নি।

সরকার শুধু মাত্র একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করার লক্ষে শ্রী শরণ সিং এবং আরো কয়েকজন মন্ত্রীকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে। নিজেরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে তারপর বিভিন্ন দেশে দূত পাঠিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য জনমত গড়ে তোলাটাই কি সঠিক পদক্ষেপ হত না? সেটা বিশ্বের অনেক দেশকে নিজের নীতি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করত। আমাদের সরকার ভাল করেই জানে যে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাক, এটা বিশ্বের কোন পরাশক্তিই চায়না। তারা বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র কি চায়? আজকের সংবাদপত্রেও আছে যে তারা ভারতকেই সংযম প্রদর্শন করতে বলছে। পাকিস্তানের মত খুনি, কসাই একটি রাষ্ট্র, যারা বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে, মা-বোনদের অপহরণ করে নিয়ে নির্যাতন করছে- সেই পাকিস্তানের সাথে তারা ভারতকে এক পাল্লায় মাপতে চায়।

যেহেতু আপনারা স্বীকৃতি দেননি, শ্রী শরণ সিং দেশে দেশে যেয়ে স্বীকৃতি চাইতে পারছেন না। তিনি শুধু উদ্বাস্তু সমস্যা তুলে ধরতে পারছেন, কিন্তু মূল সমস্যাটা বিশ্ব জনমতের কাছে উপযুক্তভাবে উপস্হাপন করা যাচ্ছেনা। আপনারা বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যাপারেও বিশ্বের কাছে কোন দাবী জানাতে পারছেন না। আপনারা শুধু বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর ইতিমধ্যে আমাদের দেশ উদ্বাস্তুদের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে।

আপনারা ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেন। বিশ্বের কাছে দৃঢ়তার মূল্য আছে। সময়ক্ষেপণ না করে আত্নবিশ্বাসের সাথে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দিলে অন্তত যুগোস্লাভিয়ার মত কিছু দেশ আমাদের অনুসরণ করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নিত।

আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শ্রী শরণ সিং শুধু বাংলদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিরোধিতাই করেন নি, বরং এই ব্যাপারে কোন ইতিবাচক ভূমিকা নিতেই অসম্মত ছিলেন। এই ভদ্রলোক যখন সরকারী মুখপাত্র হিসাবে অন্য একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানের সাথে আলোচনা করবেন, তার নিজের চিন্তাধারা কি সেখানে প্রভাব ফেলবে না? আর তিনি কি নিয়ে কথা বলবেন? মুক্তিফৌজ আর আওয়ামী লীগ যেখানে বলছে যে দুনিয়ার কোন শক্তিই পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে আবার একত্রিকরণ করতে পারবেনা, সেখানে কি তার পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আর কোন রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার সুযোগ আছে? আমি কোন কঠিন ভাষা ব্যাবহার করতে চাইছিনা, কিন্তু সরকারী মুখপাত্ররা আযৌক্তিকভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো বহাল রেখে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন।

আমাদের মাননীয়া প্রধাণমন্ত্রী সেদিন সংসদে বলেছেন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৃত্যু আমাদের সরকার মেনে নেবে না। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তাঁর সরকার আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচালের শিকার হয়ে বিভিন্ন রকম চাপের মুখে এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। প্রধাণমন্ত্রী বাংলাদেশের মৃত্যু চান না, কিন্তু অন্তর্জাতিক রাজনীতির বলি হয়ে শ্রী শরণ সিং বাংলাদেশের মৃত্যু পরোয়ানায় সাক্ষর করতে বাধ্য হচ্ছেন।

মুক্তিফৌজ ও আওয়ামী লীগ বার বার বলছে যে সমস্যার একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার করা এবং নির্বাচিত সরকারকে নিজের দেশে একটি সার্বভৌম সংসদ গঠন এবং সংবিধান প্রণয়ন করতে দেয়া। এটিই একমাত্র সমাধান, এর কোন বিকল্প নেই। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো বহাল রেখে কোন সমাধান হতে পারেনা। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই। আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলেছি। আপনাকে মনে রাখতে হবে, এই মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগ বা আন্য কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। তারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার এবং পুলিশ থেকে নিযুক্ত। আপনাকে আরো মনে রাখতে হবে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫০% সদস্যকে ২৫ মার্চের রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আপনারা কেউই সীমান্ত এলাকায় জাননি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনে পাকিবাহিনীর প্রতি জমে থাকা ঘৃণা অনুভব করতে পারেন নি। বাংলাদেশী কিছু অফিসার, যারা যুদ্ধে বাবা-মা-নিকটজন হারিয়েছেন, বলছেন যে সরকার যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকে কোন সমঝোতা করে, তবে সেই সরকারকে উৎখাত করা হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠমোর মধ্যে থেকে কোন সমাধান মুক্তিফৌজ ও জনগণ মেনে নেবে না। পাকিস্তান এখন মৃত, বাংলাদেশই তাদের দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা।

আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে শুরুতে বাংলাদেশের ব্যাপারে উৎসাহী থাকলেও এখন কোন বিচিত্র একটা কারণে আমাদের সরকার দ্বিধাগ্রস্ত এবং বিভ্রান্ত। আমাদের সরকারের অবস্হা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- দ্বিধাগ্রস্ত থেকে বিভ্রান্ত, বিভ্রান্ত থেকে কৌশলী, কৌশলী থেকে হতবুদ্ধি এবং পরিশেষে কোন রকমে পলায়নের চেষ্টা। আমার মনে হয় শুধুমাত্র দেশবাসী এবং বাংলাদেশের জনগণকে শান্ত রাখার জন্য তারা মুখে কিছু সাহসী এবং ইতিবাচক কথা বলছেন।

এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিনা। হয়তো তারা কোন বিশেষ জায়গা থেকে সবুজ সঙ্কেত পাচ্ছেন না, যদিও তারা দাবী করেন যে তাদের সব নীতি সম্পূর্নরুপে স্বাধীন।

এর মধ্যে আরো বিপজ্জনক ঘটনা ঘটছে, আমি জানিনা সংসদে এই ব্যাপারটা তুলে ধরব কিনা। মানুষের মধ্যে নানা রকমের আলোচনা হচ্ছে, বিভিন্ন রকম গুজব ছড়াচ্ছে।

আমি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ১৯৫০ সালে আমিই প্রথম ব্যাক্তি যে ঢাকা থেকে পালিয়ে সোজা এখানে এসে পন্ডিতজীর সাথে দেখা করি…..

স্পীকার মহোদয় : শ্রী সমর গুহ, আপনি অনেক সত্য কথা তুলে ধরছেন। । কিন্তু আপনার একটু সতর্ক হওয়া উচিত।

শ্রী সমর গুহ: সেজন্যই আমি সব খুলাখুলি বলছিনা। আমি বলছি যে বাজারে নানা রকমের গুজব ছড়াচ্ছে, সরকারের উচিত পরিষ্কার করে কথা বলা।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী (কানপুর): মাননীয় স্পিকার, আমি কি একটা কথা বলতে পারি? আমি শ্রী সমর গুহের বক্তব্যের মর্ম উপলব্ধি করতে পারছি। তিনি আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক কথা বলেছেন। আমার মতে তাঁর সব কথা সংবাদপত্রে যাওয়া উচিত না, বিশেষ করে সেনাপ্রধাণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত( আলীপুর): আমি আরেকটু বড়িয়ে বলতে চাই যে এই বক্তব্যের কোন রেকর্ডই থাকা উচিত না। এগুলোর কিছুই আমার জানা ছিলনা।

শ্রী সমর গুহ: এগুলো কারোই জানা ছিলনা।

শ্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত: এগুলো আসলেই ঐতিহাসিক সত্য কিনা সেটাই আমার জানা নেই।

শ্রী সমর গুহ: কোন প্রটোকলের অপেক্ষা না করে লিয়াকত আলীকে করাচী থেকে দিল্লীতে উড়িয়ে আনা হয়েছিল। আমার এটা জানা আছে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী (কানপুর): ১৯৫০ সালে পন্ডিতজী পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। সারা পৃথিবীরই এটা জানা আছে। এই বক্তব্য রেকর্ডে থাকা উচিত না।

স্পীকার মহোদয় : শ্রী সমর গুহ, আমরা এই ব্যাপারে একমত যে আমরা বাংলাদেশকে সমর্থন করি এবং এর কোন ক্ষতি চাইনা। কিন্তু আমি যদি এই বক্তব্য রেকর্ডে রাখি, আমি জানিনা এটি কিভাবে ব্যাবহৃত হবে। আমার মনে হয় আমি এটি রেকর্ড থেকে মুছে ফেললে আপনি আপত্তি করবেন না।

শ্রী সমর গুহ: আমি চাইনা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অন্য সবার মতের উর্ধে থাকুক। সংসদ যদি মনে করে এটি রেকর্ডে থাকা উচিত না, তবে তাতে আমার আপত্তি নেই। আমি শুধু বলব, আমাদের নেতৃবৃন্দের ব্যাখ্যা দেয়া উচিত যে কেন তারা কোন ব্যাবস্হা নিচ্ছেন না। কি পরিস্থিতি, বা কি কি বিষয় সমূহের উপর ভিত্তি করে তারা স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময় নির্ধারণ করবেন, সেটা পরিষ্কার করে সংসদকে জানানো উচিত।

আমার মনে হয় সরকার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত কারণ তারা মনে করছে যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে সেটা পাকিস্তানের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের কারণ হবে। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক দেশই এরকম পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু তার কারণে তাদের যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়নি। যদি তাও হয়, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, এর মুখোমুখি হওয়া ছাড়া অন্য কোন সম্মানজনক রাস্তা আছে কিনা সেটি আমার জানা নেই। পাকিস্তান ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২১/২ ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। ফলে এই অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। আপনারা জানেন যে পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে, বিশ্বশক্তিরাও তাদের উপর কূটনীতিক চাপ বৃদ্ধি করছে। এসময় তাদের সাথে একটি সামগ্রিক যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা খুবই কম। আর যুদ্ধ লাগলেও সেটা ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের জন্য অনেক বেশী ক্ষতির কারণ হবে।

আরেকটি আশঙ্কার কথা বলতে হচ্ছে। দেশে এমন একটি প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে যে অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তান ভেতর থেকে নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী : যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা হবে না।

শ্রী সমর গুহ: শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, যুক্তরাজ্য সহ আরো দেশ আছে, যারা মনে করে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায়ই থাকা উচিত। তারা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ভেঙে পড়তে দেবেনা।

সরকারের আরেকটি আশঙ্কা আছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার কারণে কোন যু্দ্ধ লাগলে চীনও তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আমি বলতে চাই যে সরকার খুব বড় ভুল করছে। সরকার পৃথিবীর ছোট-বড় প্রায় সব দেশে দূত পাঠিয়েছে, আমি জানিনা তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে কেন চীনের সাথে আলোচনা করছেনা। চীনের সাথে একটি নীতিগত অস্ত্র আমাদের সাথে আছে, কারণ গত ২৫ বছর ধরে চীন একটি প্রপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করছে যে তারা বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের প্রতিই তাদের সমর্থন আছে। তাদের এই বক্তব্যের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচিত বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনার চেষ্টা করা। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করা যায় যে চীন সরাসরি বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে একটি কথাও বলেনি। পাকিস্তানের সমর্থনে তারা কিছু কথা বলেছে, কিন্তু বাংলাদেশ বিষয়ে তারা মুখ বন্ধ রেখেছে।

শ্রী এম.রাম গোপাল রেড্ডি (নিজামাবাদ) : তারা বলেছে যে তারা পাকিস্তানের আখন্ডতা রক্ষা করতে চায়।

শ্রী সমর গুহ: এ ব্যাপারে তাদের কোন সরকারী বক্তব্য অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সাথে সাক্ষাত করতে চীনে গিয়েছিলেন, তখন চীনের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে চীন কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা একটি কথাও বলেনি।

শ্রী পি.কে.দেও (কালাহাঁড়ি ): তারা পাকিস্তানকে গান বোট দিয়েছে।

শ্রী সমর গুহ: সেটা তারা করবে। আমেরিকা থেকে শুরু করে রাশিয়া, সবাই এটা করছে। রাশিয়া পর্যন্ত চট্টগ্রামে একটি কারখানা স্হাপনের জন্য তাদের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়েছে। আর পাকিস্তান বাংলাদেশে যেসব গানবোট ব্যাবহার করছে, সেগুলো আমেরিকা, ফ্রান্স ও অন্যান্য আরো দেশ থেকেও এসেছে, শুধু চীন থেকে নয়। চীনের ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির ব্যাপারে আমি সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ১৯৫০ সালের পর আমেরিকা চীনের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শত্রু ছিল। কিন্তু এখন চীন আমেরিকার মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য হতে চাইছে।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী : পিং পং কূটনীতি।

শ্রী সমর গুহ: স্পীকার মহোদয়, কূটনীতির দিক দিয়ে চীন অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং রক্ষণশীল। তারা খুব সহজে তাদের নীতি পরিবর্তন করেনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের এই নীতির পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুবই গুরত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের নৈকট্য লাভ করতে চাইছে। কিন্তু তারা আবার ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়াতেও সরাসরিভাবে যুক্ত। এসব দেশকে তারা সাহায্যও করছে। সুতরাং তারা পাকিস্তানকেও সাহায্য করবে, কিন্তু নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে নয়। নিজেদের জাতীয় স্বার্থ বাদ দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন পাওয়া বন্ধুত্ব ভুলে গিয়ে শুধু পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য তারা পূর্ব বাংলার যুদ্ধে নিজেদের জড়াবে, এটি খুবই ভুল ধারণা। কূটনৈতিক কারণে হলেও আমাদের উচিত চীনের সাথে আলোচনার চেষ্টা করা।

বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। শুধুমাত্র এই একটা উপায়েই তাদের সাহায্য করা যায়। তাদের অস্ত্রের দরকার নেই, কিন্তু তারা এই সাহায্যটা চায়, স্বীকৃতি চায়। আপনারা যদি সীমান্ত এলাকায় যান, তাহলে দেখবেন দেশের স্বাধীনতার জন্য হাজার-হাজার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সাথে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছে। খুব অল্প পরিমাণ রসদ সম্বল করে তারা একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্বীকৃতি তাদের মনে নতুন আশা জাগাবে, মনোবল অনেক গুণে চাঙা করে তুলবে। মুক্তিবাহিনী পাক সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়েছে। সংবাদপত্রে এসেছে যে তারা ঢাকাতে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। তারা ঢাকা বিমানবন্দরে হামলা চালিয়েছে, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দিয়েছে।

আমাদের প্রধাণমন্ত্রী জনগণের সামনে নিজের একটি ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়েছেন, অত্যন্ত শক্তিশালী, অকুতোভয় একটি ভাবমূর্তি। সর্বশক্তিমান ভাবমূর্তি।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি ( গোয়ালিয়র): এখন সেই ভাবমূর্তির কি অবস্হা?

শ্রী সমর গুহ: আমি তাঁকে ক্ষুব্ধ করতে চাইনা। বিরোধী দলে থেকে আমরা জনমত গড়ে তুলতে পারি, সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা শুধু মাত্র মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীরই আছে। আমি শুধু সরকারী দলের সাংসদদের বলতে চাই, আপনারা জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। দিনে দিনে প্রধাণমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ভীরু এবং কাপুরষতায় বদলে যাচ্ছে।
জনৈক সাংসদ : শ্রী বাজপেয়ি উনাকে প্ররোচিত করেছেন।

মাননীয় স্পীকার : এই প্রস্তাবে কিছু সংশোধনী আছে। যারা সংশোধনী উত্থাপন করতে চান, তারা সেটা করতে পারেন।

শ্রী এস.এম.ব্যানার্জী : আমি একটি সংশোধনী উত্থাপন করতে চাই।

” প্রস্তাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সব ধরণের সহায়তা করা হোক’

এর পরিবর্তে ‘ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে ৩০-০৬-১৯৭১ এর পূর্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সব ধরণের সহায়তা করা হোক’ ব্যাবহার করা উচিত।

শ্রী সমর গুহের প্রস্তাবে আবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক, এই কথাটি বলা হয়েছে। অবিলম্বে বলতে আজকের দিনও বোঝা যেতে পারে, আবার তিন মাস পরের একটি দিনও বোঝা যেতে পারে। আমি একটি নির্দিষ্ট তারিখ ব্যাবহার করতে চাই, যাতে করে ১ জুলাই থেকে তারা সব ধরণের সাহায পেতে শুরু করে। আমি আশা করি আমার মাননীয় সহকর্মী সংশোধনীটি গ্রহণ করবেন, কারণ তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতি চান।

শ্রী বিভূতি মিশ্র ( মোতিহারী): সিদ্ধান্তের শেষে এটি জুড়ে দেবার জন্য আমি প্রস্তাব করছি:
” এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করছে এবং এই কামনা করছে যে তারা যেন শীঘ্রই নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাফল্য লাভ করে। তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে এবং আশা করছে যে বিশ্বরাষ্ট্রসমূহ তাদের পূর্ণ মর্যাদা দেবে। তারা সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছে যে বর্তামান পরিস্হিতি পর্যবেক্ষণ করে সে যেন প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। “

স্পীকার মহোদয়: এই সংশোধনীগুলো এখন সংসদের সামনে পেশ করা হল।
শ্রী কৃষ্ন হালদার ( অশুগ্রাম) : মাননীয় স্পীকার, আমি আমার মাতৃভাষা বাংলায় কিছু কথা বলতে চাই। এটি ভারতীয় সরকার এবং জনগণের জন্য অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার যে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রস্তাব না আসায় বিরোধী দলের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি প্রস্তাব উত্থাপন করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে বাংলাদেশে কি হচ্ছিল এটা সমগ্র বিশ্ববাসী জানে। বর্তমান বাংলাদেশে- যেটি আগে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরচিত ছিল, পাকিস্তানের জনসখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ বাস করত এবং তারাই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এটিও সবাই জানেন যে সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা হওয়া সত্বেও নিজেদের মাতৃভাষার সরকারী স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল। তারা চেয়েছিল তাদের ভাষার সরকারী স্বীকৃতি দেয়া হোক এবং অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যাবহার চালু করা হোক।
পূর্ব বাংলার পাট বিক্রি করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার মানুষ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কতৃক অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়ে আসছে। বাংলার মানুষ তাদের সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ প্রথমবারের মত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষনের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সেই আন্দোলন দমনের জন্য শক্তিপ্রয়োগের পথ বেছে নেয় এবং শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালীকে দাবী আদায় করে নিতে হয়।

আইয়ুব খানের পতনের পর সামরিক শাসকেরা আবার বাংলার মানুষকে তাদের সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা চালায়। এমনকি তাদের সামান্যতম নাগরিক অধিকার পাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়; সুতরাং নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় বাঙালীকে আবার সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হয়। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর বাংলাদেশের মানুষ যখন নিজেদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল, ঠিক সেই সময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের উপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। স্পীকার মহোদয়, এটাও সবাই জানেন যে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাল্পনিক অভিযোগে গ্রেফতার করে কোন বিচার ছাড়াই আটকে রাখা হয়েছে।
স্পীকার মহোদয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে বাঙালী অনেক রক্ত দিয়েছে। অনেক মানুষ ইতিমধ্যে শহীদ হয়েছেন। সমগ্র বিশ্ববাসী দেখছে যে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের দাবী আদায় করে নিচ্ছে। তারা বিশ্ববাসিকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে সামরিক আগ্রাসন সবসময় জয়ী হতে পারেনা। যে জাতী রক্তের বিনিময়ে হলেও নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ, পৃথিবীর কোন শক্তিই তাদের হারাতে পারেনা। আইয়ুব খানের দমননীতির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে বাঙালীকে কত রক্ত দিতে হয়েছে সেটা সবাই জানে।

ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছে। নজিরবিহীন এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শুধু পূর্ব বাংলায়ই নয়, সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী প্রচার চালায়। তারা পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়নি, তারা স্বায়ত্তশাসন চাইছিল। তারা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক বঞ্চনার অবসান চাইছিল। বাংলার মেহনতি মানুষের কষ্টের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে যাচ্ছিল। নিজেদের কষ্টে অর্জিত সম্পদে পূর্ব বাংলার মানুষ নায্য হিস্যা পাচ্ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা পূর্ব বাংলাকে মূলত নিজেদের উপনিবেশ হিসাবে বিবেচনা করছিল। একারণেই বাংলার মানুষ এই অর্থনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। তাদের দাবী ছিল শুধুমাত্র পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলাকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কিন্তু তাদের এই নায্য দাবী না মেনে তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি সামরিক বাহিনী নামিয়ে গনহত্যা চালানো হচ্ছে, তার নজির ইতিহাসে বিরল। ইতিমধ্যে ৫ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। মানব সভ্যতার সাথে এরকম বিশ্বাসঘাতকতার নজির সম্ভবত ভিয়েতনাম ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবেনা।

স্পীকার মহোদয়, আমার দল সি.পি.এম বিশ্বাস করে সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর হুমকি কখনো জনসাধারণ থেকে আসেনা, আসে সরকারী দলের তরফ থেকে। সরকারী দল যখন দেখে সংসদীয় গণতন্ত্রে তাদের স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করা যাচ্ছেনা, তারা সেটা ধ্বসংস করে দেয়ার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটেছে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছে যে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তারা আর পূর্ব বাংলায় শোষণ চালিয়ে যেতে পারবেনা, একারণে তারা পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রকে জন্মের আগেই গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছে।

আমাদের পার্লামেন্টে যে প্রস্তাবটা পাশ হয়েছে, সেটি মূলত সরকারের উপর বিরোধী দলের চাপের কারণ। সবগুলো বিরোধীদলের ঐক্যবদ্ধ দাবীর সামনে সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। সংসদে যখন প্রস্তাবটা উঠে, তখন সব বিরোধী দল একযোগে বাংলাদেশকে সব ধরণের সাহায্য-সহযোগীতা করার দাবী জানায়। কিন্তু সেসময় সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আংশিক সাহায্য দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা আশা করছিলাম যে খুব তাড়াতাড়ি সরকার সর্বাত্তক সহায়তা করার ঘোষণা দেবে, কিন্তু ২৫ মার্চের পর আড়াই মাস হয়ে গেলেও এ ব্যাপারে সরকার কোন পদক্ষেপই নেয়নি। আমাদের সবধরণের সমর্থন থাকা সত্বেও নিজে স্বীকৃতি না দিয়ে সরকার বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের আশায় আমরা প্রতিটি দেশের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। সরকার যদি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান আসলেই চায়, তাহলে তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই স্বীকৃতি দেয়া হলে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে আস্হাশীল হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন দিকে মোড় নেবে এবং আরো বেশী মানুষ সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া এই উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের আর কোন রাস্তা নেই। সরকার অন্য উপায়ে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু ইতিমধ্যে ৫৫ থেকে ৬৫ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে ঢুকে পড়েছে এবং আমার মতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়াই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়। বাংলাদেশের মানুষের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। আমি শুধু একজন বাঙালী বলে একথা বলছিনা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের দুই দেশের লোক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। দুঃখের ব্যাপার এই যে জাতীয়তাবাদী শক্তির দূর্বলতার সুযোগে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হয়ে গিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদি শক্তিরা সবসময়ই চেয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে থাকুক। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতেই ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে গিয়েছে। ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে, তাদের সেই মুক্তি সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। তারা এখনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।

১৮:০০ ঘটিকা

স্পীকার মহোদয়। পশ্চিম বাংলায় ও একই ধরণের সংগ্রাম চলছে। পশ্চিম বঙ্গের মানুষও নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে। কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে অত্যন্ত বিপজ্জনক নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তারা সেখানে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। সমগ্র রাজ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং বিনা কারণে অনেক মানুষকে গ্রেফতার-হয়রানি করা হচ্ছে। এলাকায় সিআরপি এবং সেনা মোতায়েন করা হয়েছেএবং সিআরপি সদস্যরা বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছে। সরকার যদি আসলেই বাংলাদেশকে সমর্থন করতে চায়, তাহলে পশ্চিম বঙ্গের মানুষের অধিকারও ফিরিয়ে দিতে হবে এবং সিআরপি ও সেনাদের অত্যাচার থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। কিন্তু সরকার অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিল পাস করাতে চায়, যে বিল পাশ হলে সমগ্র পশ্চিম বঙ্গ পুলিশী রাজ্যে পরিণত হবে। এই প্রস্তাবের আগে সংসদে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমাদের দল চায় যে প্রত্যেকটা রাজ্য আরো বেশী করে স্বায়ত্বশাসনের ক্ষমতা লাভ করুক। শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকারগুলোকে আরো বেশী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবী না মেনে নিলে ভারতের ভবিষ্যতে কি আছে তা কেউ বলতে পারবেনা।

সবশেষে আমি বলব, বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া হোক। আমি সমাজতান্ত্রিক এবং এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোকে অনুরোধ করব তারাও যেন কাল বিলম্ব না করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। সেইসাথে আমি বিশ্বের প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে অনুরোধ করব, তারা যেন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরণের সমর্থন দেন এবং স্পেনে ফ্যাসিবাদি শক্তির সাথে লড়াই করার সময় যে অন্তর্জাতিক মৈত্রি গড়ে উঠেছিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন তাই হয়।

স্পীকার মহোদয়, শরণার্থী শিবিরে থাকা অসংখ্য মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্য দেশগুলো কি ভুমিকা রাখছে সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়, বাংলাদশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা একসাথে লড়াই করেছি।

স্পীকার মহোদয়, ভারত দাবী করে তারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। এই দাবী সমুন্নত রাখার জন্য হলেও আমাদের উচিত বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণের সৃষ্টি করা। আমি জানি, মার্কিন চাপের কারণে আমাদের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছে। অথচ ভারতের কোটি কোটি মানুষ এই একই দাবী করছে। আমার দাবী মেনে নেয়া মানে লক্ষ-কোটি জনতার দাবী মেনে নেয়া। মাননীয় স্পিকার, এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শ্রী বিভূতি মিশ্র : আমাদের সরকার, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করুন, এইটা আমি চাই। আমাদের আইন প্রণেতারা যে প্রস্তাব পাশ করেছেন তাতে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন, তাদের প্রশংসা করেছেন- কিন্তু আসল সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ব্যাপারে দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। কারো প্ররোচনায় বা কারো প্রভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়।
আমি সরকারের কাছে বিনীতভাবে আবেদন করছি, সরকার ভেবে-চিন্তে অগ্রসর হোন, কেননা এ ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে আমাদেরকেই। যাঁরা সামনে বসে আছেন, তাঁরা যদি আজ ক্ষমতায় চলে আসেন তবে তাঁদের কথাও বদলে যাবে। তাঁরা যদি ক্ষমতায় থাকতেন তবে অন্য কথা বলতেন। যেহেতু বিরোধী দলে আছেন তাই এরুপ ভাষা ব্যাবহার করছেন। কংগ্রেস সমর্থকেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়েছেন, এজন্য আমরা স্বাধীনতার মূল্য জানি এবং অন্যের স্বাধীনতার মূল্য বুঝি। সুতরাং, ভেবে-চিন্তে অগ্রসর হওয়া চাই, রাজা-মহারাজাদের খপ্পরে পড়া উচিত নয়।

শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী : আমি শ্রী সমর গুহকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রস্তাব এনে এই সংসদকে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্হিতি সম্পর্কে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই প্রস্তাব সরকারকেও নতুন পরিস্হিতির উপর তার নীতি ব্যাক্ত করার সুযোগ করে দিয়েছে।

স্পীকার মহাশয়, যখন থেকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এ্যান্হনি মাসকোরেনহাস-এর বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, একটি অদ্ভূত অস্হিরতায় সারা দেশ ছেয়ে গেছে। আমি এ্যান্হনি মাসকোরেনহাসকে ধন্যবাদ জানাই। মাসকোরেনহাস-এর মূল বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানে দুটি বিকল্প রয়েছে: এক, গণহত্যা দুই উপনিবেশিকীকরণ। আমি তার লেখা হতে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করতে চাই।

” পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে সরকারী নীতি ঢাকাস্হ ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে বসে আমাকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এর মূল জিনিষগুলো হচ্ছে:

(১) বাঙালীরা নিজেদের অবিশ্বস্ত প্রমাণ করেছে এবং তাদের অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসনের অধীনে রাখতে হবে;
(২) বাঙালীদের সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। গণ হারে ইসলামীকরণের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদ রোধ করতে হবে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শক্তিশালী ধর্মীয় বন্ধন গড়ে তুলতে হবে।
(৩) যুদ্ধ এবং হত্যার মাধ্যমে হিন্দুদের নিচিহ্ন করে দেবার পর তাদের সম্পদ সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম মধ্যবিত্তদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। এটা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে বিবেচিত হবে।

” বাঙালীরা সব কোথায়? ” ঢাকার জনশূণ্য রাস্তা দেখে আমি আমার সাথে থাকা পথপ্রদর্শককে

জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর আসল, ” তারা সব গ্রামে চলে গিয়েছে। ” গ্রামের আশে-পাশে যেয়েও কোন বাঙালী চোখে পড়লনা। ঢাকার মত কুমিল্লা শহরও ছিল নীরব। কুমিল্লা থেকে লাকসাম যাবার পথে ১০ মাইল রাস্তায় যে কয় জন মানুষ দেখা গেল, তাদের বাস্তবিকই হাতের আঙুলে গুনে ফেলা যায়।

কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্কের চেয়রম্যান মিঃ কুর্নির সাথে তার করাচীস্হ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষে বসে কথা হচ্ছিল। দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গ আসলে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ” এই দুর্ভিক্ষ বাঙালীদের অন্তর্ঘাতের ফল। তারা মরুক। এতে যদি তাদের হুঁশ ফেরে। “

আমরা পূর্ব বাংলায় সহায়তা করতে চাই। তার পক্ষে আমরা সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। রাজ্যসমূহের বিধানসভাগুলোও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানিয়েছে। প্রধাণমন্ত্রীর ভাষণ আজ দেশকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সেটা স্পষ্ট নয়। যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা আমরা আলোচনা করছি সেজন্য কি সময় পাওয়া যাবে? পাকিস্তানি শাসকেরা কি তা মেনে নেবে? আমার বন্ধু শ্রী সমর গুহ বলেছেন যে আওয়ামী লীগ সেটা মানবে না। এত অত্যাচারের পর আবার পাকিস্তানের অংশ হওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। আমি সে বিষয়ে বলছিনা। পাকিস্তানী শাসকদের কি পথে আনা গেছে? বিশ্বজনমত কি পাকিস্তানি শাসকদের প্রভাবিত করতে পেরেছে? আমি জানতে চাই নয়াদিল্লী হতে যে মন্ত্রী প্রতিনিধিদল বাইরে গিয়েছিলেন, তাঁরা কি নিয়ে ফিরেছেন? বিশ্ব রাজধানীসমূহের প্রতিক্রিয়া কি? বড়জোর তারা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ দিতে প্রস্তুত আছে কিম্বা মৌখিক সহানুভূতি জাহির করতে তৈরি আছে। যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা আমরা আলোচনা করছি- তার অর্থ এই যে, বাংলাদেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে, বাংলাদেশ উপনিবেশ থাকবেনা, বাংলাদেশ হতে যত শরণার্থী এসেছে সকলে ফিরে যেতে পারবে, তাদের জান-মাল ও সম্মান নিরাপদ থাকবে; এই সমাধানের জন্য কি বিশ্বরাষ্ট্রসমূহ আমাদের সাহায্য করবে? আমিতো কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনা। মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য কি আমি তাই শুনব।

হত্যাযজ্ঞ চলছে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। গণহত্যার বিষয়টি কি জাতিসংঘে উপস্হাপন করা যেতনা? ভারত সরকার তা উত্থাপন করে দেখতে পারে। বিশ্বের সমর্থন পেতেই হবে এমন কোন কথা নেই কিন্তু তা করা হলে আমাদের ভূমিকায় আত্নতৃপ্তি থাকত। দ্বিতীয়ত পৃথিবীর কোন দেশ কত গভীর পানিতে অবস্হান করছে তা পরিষ্কার হত। আমাদের নীতি নির্ধারণ করতে সুবিধা হত। নীতি একটিই হতে পারে এবং সেটি হচ্ছে একটি প্রতিজ্ঞা-আজকের বাস্তব অবস্হার সঙ্গে কোন আপোষ নেই। বাংলাদেশে সেই পরিস্হিতির সৃষ্টি করতে হবে যাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে পারে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেজন্য যুদ্ধ ছাড়া যদি কোন উপায় না থাকে তবে ভারতের যুদ্ধ করার জন্যও তৈরি থাকতে হবে।

প্রথমেই আমরা দেরী করে ফেলেছি। সরকারের যদি কোন পরিষ্কার ধারণা থাকত এবং ২৫শে মার্চ যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অত্যাচার শুরু করেছিল তখনই যদি আমরা নিজেদের নীতি নির্ধারণ করতাম তাহলে বাংলাদেশের পরিস্হিতি হয়ত অন্যরুপ হত।

আমরা ভুল করেছি। কিন্তু যেটুকু বিলম্ব হয়েছে আমরা তা এখনো শোধরাতে পারি। আমি বিশ্বজনমত জাগ্রত করার বিরোধী নই, সেকাজ চলতে থাকুক কিন্তু নয়াদিল্লীর ধারণা পরিষ্কার থাকা দরকার। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ভাগ্য বিধান ওয়াশিংটন, লন্ডন, বন বা মস্কোতে হবে না, নয়াদিল্লীতে হবে এবং নয়াদিল্লী সাহসের সঙ্গে চললে এক নতুন ইতিহাস লেখা যেতে পারে। আজ আমাদের দেখতে হবে সরকার নতুন ইতিহাস রচনার যোগ্যতা রাখে কিনা।