You dont have javascript enabled! Please enable it!

 জীবনচিত্র    নামঃ ম. রফিকুল ইসলাম বাসেত

Md. Rafiqul Islam Baset

ডাকনামঃ বাসেত

পিতার নামঃ আলহাজ মৌলভী মো. তোরাব আলী

পিতার পেশাঃ সরকারি কর্মকর্তা

মাতার নামঃ জাহেদা খাতুন

ভাইবোনের সংখ্যাঃ ছয় ভাই ও এক বোন; নিজক্ৰম-ষষ্ঠ

ধর্মঃ ইসলাম

স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-কাজিরকান্দি, ডাকঘর-আলোকবালী

উপজেলা, জেলা-নরসিংদী

 

শহীদ মেডিকেল ছাত্র ম. রফিকুল ইসলাম বাসেত

 

নিহত/নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট, রংপুর

জন্মঃ ১৯৫২ সাল

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

এসএসসিঃ ১৯৬৮, লেটারসহ, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা

এইচএসসিঃ ১৯৭০, লেটারসহ, নটরডেম কলেজ, ঢাকা

এমবিবিএসঃ ১৯৭১ (প্রথম ব্যাচ), রংপুর মেডিকেল কলেজ

শখঃ সাহিত্য, খেলাধুলা, ভ্ৰমণ

সমাজসেবাঃ স্কাউটিং

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ অবাঙালি (বিহারি) সহযোগে পাক আর্মি

নিহত হওয়ার তারিখঃ ১ এপ্রিল, ১৯৭১

মরদেহঃ পাম্পের মাঠে মাটি চাপা দেয়া হয়। সৈয়দপুর বিমানবন্দরের কর্মচারী ফয়েজউদ্দিন ৫ জানুয়ারি ২০০৮ মাটি চাপা দেয়ার জায়গাটি শনাক্ত করেন।

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ নেই

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি

বৈবাহিক অবস্থাঃ অবিবাহিত

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ

ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার মো. ফজলুর রহমান (বড় ভাই)

 

 

তথ্য প্রদানকারী

স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) মো. সামছুর রহমান

শহীদ মেডিকেল ছাত্রের ভাই

৩০৩/এ, গুলবাগ, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ      ৪০৫

 

আমার দেবর

শহীদ মেডিকেল ছাত্র

ম. রফিকুল ইসলাম

সুরাইয়া বেগম

 

একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি যখনি স্মরণ করি, মনে হয়, আমার স্বামী-দেবর-ভাগ্নের মৃত্যুর ৩৮ বছর আগের কোনো অতীত ঘটনা নয়; মনে হয় যেন গতকাল বিকেলের ঘটনা। নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় যে কীভাবে ওদের ছেড়ে আমি এখনো বেঁচে আছি।

একজন মানুষের জীবনে তার মাতৃভূমির স্বাধীনতার চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? যখন ভাবি আমার স্বামী-দেবর-ভাগ্নের এ রক্তদান তাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতারই জন্য, তখন নিজেকে আর দুঃখী মনে হয় না। যখন মনে হয় আমার স্বামী-দেবর-ভাগ্নে তাদের তাজা রক্ত মাতৃভূমির মাটির সাথে মিলিয়ে দিয়ে আরো উর্বর করে দিয়ে গেছে, ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য শান্তি এবং আশার বীজ বপন করে রেখে গেছে, তখন গর্ববোধ করি, মনে অনুপ্রেরণা আসে, বেঁচে থাকার সাহস ও শক্তি খুঁজে পাই।

আমার শ্বশুর মরহুম আলহাজ তোরাব আলী সাহেব ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তাঁর সাত সন্তানের তৃতীয় ছিলেন আমার স্বামী মো. ফজলুর রহমান; ষষ্ঠ ছিল রফিকুল ইসলাম। আমার স্বামী ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে গৃহসংস্থান পরিদপ্তরে ১৯৫৮ সালে যোগদান করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও রাজশাহীর সাড়া উপশহরের অবাঙালি কলোনিগুলো নির্মিত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি রংপুরের সৈয়দপুরের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সৈয়দপুরের ক্যান্টনমেন্ট তাঁর তত্ত্বাবধানেই সম্প্রসারণ ও মেরামত হয়েছিল।

আমার দেবর রফিকুল ইসলাম তখন রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। রংপুর মেডিকেল কলেজে ওটাই ছিল প্রথম ব্যাচ। তখন অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে ক্লাস বন্ধ হওয়ায় সে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে আমাদের বাসায় অবস্থান করছিল। তখন কে জানতে মৃত্যুই তাকে ডেকে এনেছিল আমাদের কাছে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে

 

 

৪০৬       মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ মেডিকেল ছাত্র ম. রফিকুল ইসলাম বাসেত

 

সৈয়দপুর অন্যতম। সেখানে বাঙালি নিধন শুরু হয়েছিল ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর কালরাতেরও আগেএকাত্তরের ২৩ মার্চ পাকবাহিনীর কয়েকজন সৈনিক আমার স্বামীকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আধ মাইল দূরে একটি মাটির কূপের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে। তিনি একবার মাত্র তাকিয়ে দেখেছিলেন-কুপ ভর্তি খণ্ডিত লাশ। নিয়তি সেদিন তাকে অব্যাহতি দিলেও হানাদার বাহিনীর কালো হাত থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর নিতি মেলেনি। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও ওর সমগ্ৰ চিন্তা-চেতনায় ও উপলব্ধিতে ছিল দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তি কামনা। ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রায় সারাক্ষণ মৌনভাবে বসে চিন্তা করতেন আর মাঝে মধ্যে বলতেন, দেশটার কী হবে?

১৯৭১-এর ৩১ মার্চ গভীর রাতে রেইড শুরু হয়। ভোর রাতে রফিকুল ইসলামসহ আমাদের গোটা পরিবার আত্মরক্ষার জন্য বাড়ির প্রাঙ্গণে তৈরি ট্রেঞ্চে আশ্রয় গ্রহণ করি। সেখানে সারাক্ষণ নিদারুণ ভয়, আতঙ্ক ও উদ্বেগে রাত কাটাইট্রেঞ্চেই আমার স্বামী পরদিন দুপুর পর্যন্ত কাপড়ের কভার ও বেল্ট লাগানো ছোট কোরান শরীফ ঝুলিয়ে কোরান তেলওয়াত করেছেন আর দোয়াদরুদ পড়েছেন। সবাইকে শান্ত থাকার উপদেশ দিয়েছেন। পরদিন দুপুরে ১ এপ্রিল, পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আমরা ঘরে চলে আসি। বিকেলের দিকে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে গুলি ছুড়তে ছুড়তে একদল পাকসেনা আমাদের বাসভবনে আসেঘরে ঢুকে সবাইকে বাইরে বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দেয় এবং সবাইকে লাইন করে দাঁড়াতে বলে। এই সময় আমার এক বছরের মেয়ে শাহানা পারভীন রুমা সৈন্যদের ভায়ে ওর বাবাকে চেপে ধরে। আমার স্বামীর গলায় তখনও ছোট কোরান ঝুলানো ছিল। বর্বর বাহিনী কোরান শরীফটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে ‘কেয়া তুম জয় বাংলা বোলতা? পাকিস্তান দু’টুকরা করতা হ্যায়?’ ইত্যাদি বলে আমার স্বামী, তাঁর ভাগ্নে এসএসসি পরীক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন, দেবর রফিকুল ইসলাম ও বাসার মালি রুহুল আমীনকে ওদের সাথে যেতে বলে। মেয়েটি তখনও তার বাবার সাথে মিশে ছিল। কিছুতেই নামতে চায় না। আমি তাকে জোর করে নামিয়ে জোড় হাত করে বর্বরদের কাছে কাকুতি-মিনতি করলাম ওদের ছেড়ে দিতে। ওরা অস্ত্র তুলে আমাকে গুলি করার হুমকি দিয়ে ওদের নিয়ে যায়। বাসা থেকে ধরে নিয়ে বেরোনোর কয়েক মিনিট পরেই অনেকগুলো গুলির শব্দ শুনতে পাই। হয়তো এই গুলিতেই ওদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।

আমরা সবাই চারজনের আগমনের প্রতীক্ষা করছিলাম। আমার ছেলে নাজমুল হাসান অপু ও মেয়ে শাহানাজ পারভীন রুমা তাদের পিতা, চাচা ও ভাইয়ের প্রত্যাবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে প্রহর শুনছিলআমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল। তারা কেউ ফিরছেন না। আসছেন না। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলোআসলেন মেজর গুল, মেজর জাভেদ, ক্যাপ্টেন বখতিয়ার ও কর্নেল শফি। তারা আমাদের ছাদের ওপর কামান বসালেন। দারুণ উত্তেজনা, অশান্তি ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে আমরা রাত কাটালাম২ এপ্রিল। আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় দিন। আমাদের গাড়ির অবাঙালি (বিহারি) ড্রাইভার আবিদ জানতে আমার স্বামী, দেবর, ভাগ্নে প্রমুখের ভাগ্যে কী ঘটেছিলসে জানতে তারা তখন কোথায়? হানাদারদের সাথে তার খুব দহরম-মহরম। সে ঐদিন কয়েকজন অবাঙালিকে নিয়ে এসে আমাদের বাসা লুট করে নিয়ে গেল। হানাদার সেনাবাহিনী ঐ দিনই আমাদের সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুলে নিয়ে গেল। সেখানে দেখি শুধু মহিলা আর মহিলাকমপক্ষে ৬০০-৭০০ জন সবাই এক একটা করুণ কাহিনীর প্রতিমূর্তি-জীবন্ত সাক্ষী। সেখানে আমরা হানাদার সৈন্যদের পৈশাচিকতা দেখেছি, শুনেছি তাদের বিদ্রূপপূর্ণ টিটকারী।

সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আমি পূর্বপরিচিত জনাব শাহ আলমের সহায়তায় দুটি সন্তানসহ কোনোক্রমে প্রাণে রক্ষা পেলাম। জনাব আলম পুরো দু’দিন আমাদের বিশেষভাবে তৈরি মাটির গর্তে লুকিয়ে রেখেছিলেন। ঘাস, বিচালি দ্বারা আচ্ছাদিত সে গর্তের ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে অবাঙালিরা মারাত্মক অস্ত্ৰ হাতে নিয়ে আমাদের খুঁজেছে। দুদিন পর শাহ আলম আমাদের সৈয়দপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসায় নিয়ে আসেন। তখন দারুল উলুম মাদ্রাসায় বাঙালিদের জন্য ক্যাম্প করা হয়েছিল। সেখানে আমরা দু’মাস ছিলাম। পরে আমার স্বামীর বড় ভাই জনাব আবদুল আউয়াল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২ জুন ঢাকায় নিয়ে আসেন।

আমার এ লেখার শেষ করার মতো নয়। ১ এপ্রিল থেকে ২ জুন পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ে এক একটি ইতিহাস রচনা করা যায়। শেষ করার পূর্বে একটা কথা না বললে অসমাপ্ত থেকে যাবে। ২৫ মার্চ ৭১ রাতে

 

 

৪০৭        মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ মেডিকেল ছাত্র ম. রফিকুল ইসলাম বাসেত

 

ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হলে সৈয়দপুরের কয়েকজন সাহসী বাঙালি তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য কারফিউর ফাঁকে ফাঁকে আমার স্বামীর কাছে এসে আমাদের বাসার স্টোর রুমে বসে সৈয়দপুরে আক্রমণ শুরু হলে ওরা। কীভাবে কোথায় কেমন করে প্রতিরোধ করবে সে বিষয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ করতো। এভাবে কয়েকশ’ তরুণ যুবক কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে আমাদের মতো আরো অনেক বাঙালির বাসায় যেয়ে আলাপ-আলোচনা করতো। আমাদের বাসায় ওরা আলোচনা শেষে খাওয়া-দাওয়া করে কারফিউ শুরুর পূর্বে শুকনো খাবার পোটলায় বেঁধে নিয়ে চলে যেত। এভাবে ৩১ মার্চ সৈয়দপুরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত চলছিল। এই খরবটি আমরা স্বামীর গাড়ির অবাঙালি (বিহারি) ড্রাইভার আবিদ সম্ভবত পাক আর্মিকে জানিয়ে দেয়এতে করে কারফিউর সময়। বাড়ির জানালা দিয়ে খেয়াল করতাম টহলরত পাকসেনা আমাদের ঘরের দিকে সর্বদা নজর রাখছে।

যাহোক, যখনই স্বামী-দেবর-ভাগ্নে হারানোর মর্মান্তিক মুহূর্তটি মনে পড়ে তখনই নিজেকে অস্বাভাবিকভাবে হারিয়ে ফেলি, শুরু হয় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। এইভাবে বিগত ৩৮ বছর ধরে আমার দিন কাটছে। দিন আরও কেটে যাবে; কিন্তু স্বাধীনতার প্রতি মর্যাদা, ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা যেন চির অম্লান থাকে, দেশবাসীর কাছে এই আমার শেষ কামনা।

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মেডিকেল ছাত্র স্মৃতিফলক; রংপুর মেডিকেল কলেজ ভবনে শোভিত।

খ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনা; তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১, জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৫৩৯।

গ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৪র্থ খণ্ড; প্রথম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪০২, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬; পূ. ১২৩ ।

ঘ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রকৌশলী স্মৃতিকথাঃ সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঝণ; প্রকাশকালঃ ডিসেম্বর ১৯৯১; পৃ. ১১১

ঙ. দৈনিক পূর্বদেশঃ ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।

 

 

৪০৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!