জীবনচিত্র নামঃ ডা. হাসিময় হাজরা
Dr. Hashimoy Hazra
ডাকনামঃ হাসি
পিতার নামঃ ডা. অনন্ত মাধব হাজরা
পিতার পেশাঃ চিকিৎসক
ভাইবোনের সংখ্যাঃ পাঁচ ভাই ও এক বোন;
নিজক্ৰম-তৃতীয়
ধর্মঃ হিন্দু
স্থায়ী ঠিকানাঃ নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা।
শহীদ ডা. হাসিময় হাজরা
নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ বাড়ি নং-১৬/২, সড়ক-রামকৃষ্ণ মিশন রোড, ঢাকা
জন্মঃ ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪৬, ঢাকা
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ ১৯৬২, ঢাকেশ্বরী মিল স্কুল, নারায়ণগঞ্জ
আইএসসিঃ ১৯৬৪, তুলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ
এমবিবিএসঃ ১৯৭০, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
শখঃ খেলাধুলা
চাকরির বর্ণনাঃ
ইন্টার্নি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১৯৭০ সালে পাস করার পর থেকে নিখোঁজ হওয়ার দিন ২ মে ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাক আর্মি
নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ০২ মে, ১৯৭১
মরদেহঃ পাওয়া যায়নি
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
বৈবাহিক অবস্থাঃ অবিবাহিত
তব্য প্রদানকারী
ডা. কাজী তামান্না
শহীদ চিকিৎসকের লিলি (সম্পর্কে)
বাড়ি-১১, সড়ক-১, সেকশন-১২বি,
পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৮৯
আমার ভাই
শহীদ ডা. হাসিময় হাজরা
ডা. কাজী তামান্না
মে মাসের দু’তারিখ। এদিনে দু’জন মানুষের কথা খুব মনে পড়ে। তাঁদের একজনের আজ জন্মদিবস, আরেকজনের অন্তর্ধানদিবস। দু’জনের কারও সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু দু’জনই খুব আপন। তবে তাঁদের একজন জগৎ বিখ্যাত ব্যক্তি, বাঙালি জাতিকে যিনি পৃথিবীর কাছে পরিচিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পর তিনিই বাঙালি জাতিকে বিশ্ব সংসারে গৌরবান্বিত করেছেন; খাঁটি বাঙালি হিসেবে সবার মন জয় করতে পেরেছেন। তিনি বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার-আমার খুব প্রিয় মানুষ সত্যজিৎ রায়। তাঁর শুভ জন্মদিন এই দিনে। সেই সাথে আরেকজনের কথা ভেবে মন তোলপাড় করছে, আবেগে কলম থেমে যাচ্ছে; সে একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষ, যাকে বাংলাদেশে। মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া কেউ চেনে না। তাঁর রক্তের সম্পর্কের কেউ আর এখন বাংলাদেশে থাকে না। সে মানুষটির আকাশের মতো বিরাট, সমুদ্রের মতো গভীর একটা হৃদয় ছিল। বাংলাদেশের মানুষকে-মাটিকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। প্ৰাণ দিয়ে সে তা প্রমাণ করে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমার সতীর্থ, আমার আত্মার আত্মীয়, আমার ভাই ডা. হাসিময় হাজরা। ১৯৭১-এর এই দিনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় সদাহাস্যময় হাসিময় আপনজনের কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। আমাদের বাড়ি থেকে দুপুর ২টার দিকে একটা সাদা ভেসপা চড়ে মলিন শার্ট প্যান্ট ও পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে সেই যে গোপীবাগের ভাইটি আমার বেলা ২টার দিকে হঠাৎ ‘দিদি, ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে হেমের সাথে দেখা করে আসি’ বলে চলে গেল। যেতে নিষেধ করেছিলাম; আকাশে মেঘ ছিল, যে কোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমার কথা শুনলো না। জানি না কেন মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; তুমুল ঝড়বাদলের মাঝে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে চিৎকার করে উঠলাম, ‘আম্মা, হাসি আসেনি, ও কোথায়?’ আম্মা বললেন, ‘এসে যাবে, এত অস্থিরতার কী আছে।’ না আম্মার কথা সত্যি হয়নি। আমার
৩৯০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিত্সক জীবনকোষ
শহীদ ডা. হাসিময় হাজরা
অবচেতন মনে কিসের যেন একটা কালো ছায়া, একটা ভয় প্রবেশ করলো। কেবলই মনে হতে লাগলো হাসির কিছু একটা হয়েছে। হাসি ফিরলো না-সারারাত কেটে গেল অনিদ্রায়। সন্ধ্যার পর কারফিউ; কিছু করার নেই।
সকালে দারুণ উকণ্ঠা নিয়ে বন্ধু নাজমুন ও ফওজিয়াকে ফোন করলাম। ওরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে এলো। আমিও গেলাম। হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্টের সাথে দেখা করলাম। প্রফেসর লস্করের অধীনে ও কাজ করতো। অন্য প্রফেসরদের বললাম, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কোনো খবর নিতে পারি কিনা। কিন্তু কেউ সহযোগিতা করতে পারলেন না। উপরন্তু আমাকে চুপচাপ বাড়ি ফিরে যেতে উপদেশ দিলেন। এতদিন পর উপলব্ধি করলাম, হাসিময় আমার ভাই হলে হবে কি, ও আমার ধর্মের নয়, ও হিন্দু, তাই এই মুহূর্তে ওর খোঁজ নেয়া মানে শুধু আমার নয় আমাদের পুরো পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নেয়া। যে হাসিময় এ দেশকে আপন সত্তার সাথে একাত্ম করে নিয়েছিল। ঢাকায় তাঁর জন্মস্থান বলে অহঙ্কার বোধ করতো, দেশত্যাগ করার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। ২৫ মার্চের পরেও ওপারে যেতে চায়নি। অথচ ওরা মা, ভাইবোন সবাই ভারতের বাসাতেই থাকতেন।
হাসিময় হাজরা; ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাণোচ্ছল এক যুবক। সবার বিপদ-আপদে এগিয়ে যেতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেনি। এমন বন্ধুবৎসল আমি আর দেখিনি। সেই হাসি বেঁচে আছে, যা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে তার খোঁজ নেয়ার সাহসটুকু পর্যন্ত আমাদের কারও হলো না। কী অমানবিক অবস্থার মধ্যে আমাদের থাকতে হচ্ছিল আমার এই লেখা পড়ে বর্তমান প্রজন্ম নিশ্চয়ই কিছুটা আঁচ করতে পারবে। তবু এই সাঁইত্রিশ বছর আমি এই গ্লানি নিয়ে বেঁচে আছি, যে হাসিময় এই দেশকে নিজের মা ভেবে আঁকড়ে থেকেছে, আমাকে ‘দিদি’ বলে ডাকতে পেরে উফুল হয়েছে, সেই হাসি কোথায় গেল তার কোনো খোঁজ বোন হয়েও নিতে পারিনি। মনে পড়ে, আমি, আমার বন্ধু নাজমুন ও ফওজিয়া অসহায়ভাবে হাসপাতালের করিডোরে বিষগ্ৰচিত্তে দাঁড়িয়ে আছি; হঠাৎ আমাদের প্রিয় শিক্ষক ডা. ফজলে রাব্বীর (১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ যিনি নিজেও রাজাকারদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন) সাথে দেখা। তাঁকে দেখে হুহু করে কেঁদে উঠলাম। স্যারকে সব বললাম। স্যারও অসহায়ভাবে একই কথা বললেন। আমার আব্বার জন্য উদ্বিগ্ন হলেন—কারণ হাসি আমাদের বাড়িতে ছিল। এভাবে এক হিন্দু ভদ্ৰলোককে আশ্রয় দেয়ার জন্য সাইদুল হাসানকে পাকসেনারা হত্যা করেছিল। স্যার পরম স্নেহে মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন। স্যারের সাথে সেই আমার শেষ দেখা। তারপর ১৭ ডিসেম্বর একাত্তরে কলকাতার পত্রিকায় রাব্বী স্যার এবং আরও অনেক আপনজন ও চেনা-অচেনা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রাজাকারদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার খবর পড়ি। সে আর এক অধ্যায়।
আজকের বাংলাদেশের দিকে চোখ রেখে এ প্রজন্মের কেউ আন্দাজ করতে পারবে না ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের গোড়ার দিকে ঘূণ্য পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে কীভাবে এ দেশের যুব সম্প্রদায় মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখেছিল। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে একটা নতুন দেশ তখন কষ্ট-যাতনা ভোগ করছে। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হচ্ছে একটা নতুন মানচিত্রের। সেই সময় জীবনের স্বৰ্ণোজ্জ্বল একটা যুগে অনেকের সাথে দেখেছি হাসিময় হাজরার দেশপ্রেম, অন্যায়ের প্রতিবাদে আপোসহীন এক অসাধারণ মানুষকে। ১৯৬৯-এর প্রবল গণ-আন্দোলনে আদমজী শ্ৰমিক এলাকায় বর্বর পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। হাসিময় তখন শেষ বর্ষের ছাত্র। মেডিকেল কলেজে পাকবাহিনী কর্তৃক আদমজী শ্ৰমিক এলাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর আসার সাথে সাথে অকুতোভয় হাসিময় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আদমজী এলাকায় আহত শ্রমিকদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। তিন-চার দিন পর ফিরে আসে। মানুষের প্রতি অন্তরের গভীরতর স্তর থেকে নৈতিকবোধ আর ভালোবাসা না থাকলে কারফিউ উপেক্ষা করে এইভাবে জীবনবাজি রেখে বেরিয়ে পড়া সম্ভব নয়। একইভাবে তাকে ছুটে যেতে দেখেছিলাম ‘৬৯-এর ডেমরার সাইক্লোনের সময়। ১৯৭০-এর ভয়াবহ গর্কির সময় উপকূল এলাকায় ১০-১২ দিন একনাগাড়ে মানুষের সেবায় ও নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে কেউ বিপদে পড়লেও হাসিমুখে তাঁর পাশে দাঁড়াতে আনন্দ পেত। ওর ছিল বিরল রক্তের গ্রুপ ‘ও’ নেগেটিভ। চেনাঅচেনা কতজনকে যে ও হাসিমুখে রক্ত দান করেছে। মনে রাখতে হবে, এখনকার মতো তখন এত সহজে কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। কেউ কোনো বিপদে পড়লে প্রথমেই আমাদের হাসির কথা মনে পড়ত। কোনো বিপদের মুখে যেতে ও ভয় বা দ্বিধা করতো না। ১৯৬৯-৭০-এর টালমাটাল দিনগুলোতে হাসিময়কে প্রতিটি
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৯১
শহীদ ডা, হাসিময় হাজরা
মিছিলের অগ্রভাগে দেখা গেছে। অথচ রাজনৈতিকভাবে কোনো দলের প্রতি তার খুব একটা আনুগত্য ছিল না। আগেই বলেছি, বুকভরা মানবপ্রেম, সাথে সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদে আপোসহীন হাসিময় মিছিলে শ্লোগানে খুঁজে পেত প্রতিবাদের ভাষা। সেই সময় হাসি বারবার বলতে দেশ স্বাধীন হতে আর বেশি দিন নেই। এই সময় ওর মাকে লেখা একটা চিঠিতে আশ্চর্য দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।
হাসিময়ের জন্ম ১৯৪৬-এর ২৩ জানুয়ারি। বাবা অনন্ত মাধব হাজরা ঢাকেশ্বরী মিলের ডাক্তার ছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে হাসি ছিল তৃতীয়। ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় হাসির মা এবং তাদের পুরো পরিবারের সবাই ড্রেনের মোটা পাইপের ভেতর প্রাণের ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পাইপের মধ্যে কাটানোর পর কোনোক্রমে বেঁচে পরে ভারতে চলে যান। কিন্তু হাসি এবং তার বাবা এ দেশের মাটি ছাড়তে পারেননি। ঢাকেশ্বরী কটন মিলের প্রৌঢ় ‘ডাক্তারবাবু’ ঐতিহ্য সূত্রে যার শরীরে বইছে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক উজ্জ্বল পুরুষ অমৃতলাল হাজরার পবিত্র রক্ত (এর নামে কলকাতায় একটি রাস্তার নাম আছে)। যিনি অনন্তমাধব হাজরার কাকা তিনি কেমন করে নিজ ভূমি ত্যাগ করবেন? ভবিষ্যতের আর এক শহীদ হাসিময় হাজরাও শত বিপদেও ঘূণাক্ষরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতের মাটিতে পা দেয়ার কথা চিন্তাও করেনি। অথচ ‘৬৪ সালেই ওপারে চলে গেলে মায়ের আদরে, ভাইবোনের স্নেহেভালোবাসায় অনায়াসে এক সুন্দর জীবন বেছে নিতে পারতো। মানবিকতা, দেশপ্রেম, জন্মভূমির প্রতি অগাধ আস্থার কারণেই হাসিময়ের দেশত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ এটা হাসি বিশ্বাস করতো। কিন্তু মানুষই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে ও প্রায়ই যেত সেখানকারই জর্ডনের এক ছাত্র আরো দু’জনের সাথে ওকেও পাকিস্তানি খুনি জান্তার হাতে তুলে দিয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সাথে হাসি জড়িয়ে পড়েছিল। এবং আমাকে বলেছিল মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ওপারে চলে যাবে। তার আগেই জীবনের ওপারে চলে গেল।
হাসিময়ের ‘দিদি ডাকের প্রতি খুব দুর্বলতা ছিল। হয়তো বড় বোন না থাকাতে এমনটি হয়েছিল। তাই সহপাঠী হয়েও আমাকে দিদি বলে ডাকতো। ওর মৃত্যুর পর আমি এ ডাকের মর্যাদা দিতে পারিনি। এটা যেমন সত্য, আবার এটাও সত্য যে আমি ওর বোন বলে স্বীকৃতি পেয়েছি। ১৯৮৯ সালে কথাসাহিত্যক রশীদ হায়দার ফোনে আমাকে জানান, বাংলা একাডেমী থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আপনজনদের স্মৃতি অনুরণনের স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য তারা ‘স্মৃতি ১৯৭১’ নামে সঙ্কলন প্রকাশ করছেন। আমাকে হাসিময়ের স্মৃতি তৰ্পণ করতে হবে। স্মৃতি ১৯৭১’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে ‘আমার ভাই’ নামে হাসিময়ের বোন হিসেবে আমি ওর অসংখ্য স্মৃতির কথা কিছু লিখেছি। অন্য অনেক লেখকের সাথে হাসিময় আমার ভাই বলে স্থায়ী আসন নিয়ে নিয়েছে। এই বই আমি কলকাতায় ওর পরিবারের কাছে পাঠিয়েছি। ওর বাবা আবেগতাড়িত হয়ে যে চিঠি আমাকে দিয়েছেন তা পড়ে পানিতে চোখ ভরে ওঠে। ওর অন্য কোনো আপনজন বাংলাদেশে নেই। ওকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে রাখার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাঁচিয়ে রাখার আকাতায় ওর যেসব জিনিসপত্র এবং ছবি আমার কাছে ছিল তা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়েছি। হাসির নামে ডাকটিকিট বের হয়েছে। আমার বাড়িতে বড় করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের ছবি রেখেছি। সবাইকে অহঙ্কারের সাথে বলি এই আমার ভাই, যার অস্থি-মজ্জা রক্ত এই পবিত্র বাংলার মাটির সাথে মিশে আছে। আমার ছেলেরা গর্ববোধ করে ওদের মামা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। হাসিময়ের বড় ভাই অসীম কুমার হাজরা দিল্লি থেকে এখানে এলে আমার কাছে এসে ভাইয়ের কথা বলে মন হালকা করতে চেষ্টা করেন। এটুকুর বেশি আমি ওর জন্য করতে পারানি।
তবে নিজেকে খুব ছোট মনে হয় যখন দেখি এখনও এ দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হয়নি। মৌলবাদীদের দাপটে মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের এত বড় ত্যাগের বিনিময়ে কী পেয়েছি আর কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে হয়তো আমাদের বাকি জীবন কেটে যাবে। জানি না মহান শহীদরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কোথায় স্থান পাবে। তবে আমি তাদের আমার স্মৃতির মণিকোঠায় চিরভাস্বর করে রাখবো। হাসিময় ওর একটা ছবির পেছনে (যে ছবিটা সব জায়গায় ছাপা হয়) লিখেছিল, ‘দিদি আমাকে যেন ভুলে না যাস।’ না ভুলিনি আমি আমার ভাইকে ভুলিনি। এখনও বিশ্বাস করতে লোভ হয়, হাসি বাংলাদেশের কোথাও আছে, ৩৮ বছর পরও হয়তো সহসাই ‘দিদি’ বলে ডেকে উঠবে।
৩৯২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. হাসিময় হাজরা
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭ ।
ঘ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ৬ষ্ঠ পর্যায়; ১৯৯৭ । (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
ঙ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় খণ্ড, ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ শ্রাবন ১৪০৯, ডিসেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ১৬৯ ।
চ. *মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ১৪ ।
ছ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্ৰী।
জ. চারিতাভিধান; সম্পাদনাঃ সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় সংস্করণ; প্রকাশকালঃ মাঘ ১৪০৩, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭; পৃ.২৮।
ঝ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ পৌষ ১৪০০, জানুয়ারী ১৯৯৪; পৃ. ৪৭।
ঞ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ আগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ১০৬ ।
ট. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ২৫, ৪৩।
ঝ. রবে নীরবে; রচনাঃ কাজী তামান্না।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৯৩
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ