You dont have javascript enabled! Please enable it! ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ | মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক - সংগ্রামের নোটবুক

জীবনচিত্র      নামঃ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

Dr. Sujauddin Ahmed

ডাকনামঃ সুজা

পিতার নামঃ মো. মসিতুল্লাহ সরকার

পিতার পেশাঃ কৃষিজীবী

মাতার নামঃ নজিবন নেসা

ভাইবোনের সংখ্যাঃ পাঁচ ভাই ও এক বোন; নিজক্ৰম-তৃতীয়

ধর্মঃ ইসলাম

স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-বিরহলী, ইউনিয়ন/ওয়ার্ড নং-৬নং

পীরগঞ্জ, ডাকঘর/উপজেলা-পীরগঞ্জ, জেলা-দিনাজপুর

 

 

 

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

 

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ গ্রাম-জগথা, ইউনিয়ন/ওয়ার্ড নং-৬নং পীরগঞ্জ, ডাকঘর/উপজেলা-পীরগঞ্জ, জেলা-দিনাজপুর

জন্মঃ ১৯২২ (আনুমানিক)

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ প্রথম বিভাগ, ১৯৪৫, জিলা স্কুল, দিনাজপুর

এলএমএফঃ ১৯৪৮, ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল, বগুড়া

শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারঃ মেধাবী ছাত্র পুরস্কার, জেলা শিক্ষা অফিস, ১৯৪৫

শখঃ নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা ইত্যাদি রচনা। নাটক ও যাত্রা গানে অভিনয়

সমাজসেবাঃ পীরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, পীরগঞ্জ কলেজ, পাবলিক লাইব্রেরি, পীরগঞ্জ ডাকঘরসহ অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাঃ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগঃ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শহীদ হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত, সভাপতি, পীরগঞ্জ থানা শাখা, দিনাজপুর

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী

নিহত হওয়ার তারিখঃ ১৭-০৪-১৯৭১

মরদেহঃ

প্রাপ্তি স্থানঃ শিবগঞ্জ ভাতারমারী ফার্ম

প্রাপ্তি তারিখঃ ১৮-০৪-১৯৭১

সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ নিজেরাই

কবরস্থানঃ পৈতৃক গোরস্তান, বিরহলী, দিনাজপুর

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ পীরগঞ্জ পৌরসভা এলাকার একটি রাস্তার নামকরণ এবং পীরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির সম্মুখ চত্বরে শহীদদের নামফলক

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ২০০০/-

স্ত্রীর নামঃ তাহেরা বেগম

বিয়েঃ ১৯৫০

সন্তান-সন্ততিঃ সাতজন; পুত্ৰ-তিনজন, কন্যা-চারজন

মো. কামরুল হুদাঃ এমএসএস, এনজিওতে কর্মরত, ঢাকা

শামীম আরা বেগমঃ এসএসসি, গৃহিণী, ঢাকা

নাসিম আরা বেগমঃ এমএ, F.W.A.তে কর্মরত, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও

পারভীন আকতার বানুঃ এমএ, গৃহিণী, ঢাকা

মো. নরুল হুদাঃ বিএ, ব্যবসায়ী, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও

মো. বদরুল হুদাঃ এমএ, প্রভাষক, পীরগঞ্জ সরকারি কলেজ, ঠাকুরগাঁও

সাকিলা নাজনীনঃ এমএ, গৃহিণী, বীরগঞ্জ, দিনাজপুর

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ

আপন ভাই

 

তথ্য প্রদানকারী

তাহেরা বেগম

শহীদ চিকিৎসকের স্ত্রী

গ্রাম-জগথা (পূৰ্ব চৌরাস্তা)

ডাকঘর/উপজেলা-পীরগঞ্জ

জেলা-দিনাজপুর

 

৩৬০       মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

আমার স্বামী

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

তাহেরা সুজাউদ্দীন

 

আমি কোনো লেখক বা সাহিত্যিক নই। সব কথা গুছিয়ে বলা সম্ভব নয়। আমার স্বামী একজন এল.এম.এফ ডাক্তার ছিলেন। তিনি অনেক দুঃখকষ্ট করে বড় হয়েছিলেন। আমার শ্বশুর ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর মতো তাঁর কোনো ক্ষমতা ছিল না। বাল্যকালে তাঁর মেধাশক্তির পরিচয় পেয়ে এলাকার একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি, পণ্ডিত সাহেব, তাঁকে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেন। এভাবেই পণ্ডিত সাহেবের বাসায় লজিং থেকে তিনি লেখাপড়া শুরু করেছিলেন। তাঁর একটাই উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষিত হয়ে এলাকার জন্য কিছু করা। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের আগে এ এলাকায় একজন ডাক্তার ছিলেনতিনি দেশ বিভাগের সময় এ দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যান। সেই থেকে এলাকায় চিকিৎসক বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। বিশেষ করে গরিব অসহায় দুস্থ মানুষের সেবাদান ছিল তার ডাক্তার হওয়ার মূল চালিকাশক্তি। পরিবারের আর্থিক সহযোগিতা ছিল না বলে তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করে মানুষের বাসায় লজিং থেকে তাঁর লক্ষ্যে পৌছান। তবে এলএমএফ পাস করে এমবিবিএস পড়ার ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক দৈন্য ও লজিং জীবনের নির্যাতিত অধ্যায়ের যবনিকা টানার কারণেই এমবিবিএস পাস করার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে মোটামুটিভাবে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচার তাঁকে প্রায়ই ব্যথিত করত। তিনি লক্ষ্য করতেন, পাকিস্তানিরা সবসময়ই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে আর বাঙালিরা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তিনি ডাক্তারি পাস করার পর সক্রিয়ভাবে রাজনীতি শুরু করেন। তাঁর মধ্যে দেশপ্রেম ছিল অগাধদেশমাতৃকার প্রতি ছিল তাঁর দুর্বার আকর্ষণ। পেশাগত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর দেশপ্রেম অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর

 

 

৩৬১       মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

 

রহমানের সাথে তিনি প্রতিমাসে ঢাকায় একবার দেখা করতেন এবং বঙ্গবন্ধুও তাঁকে বন্ধুর মতো ভালোবাসতেন। দলের কর্মসূচি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু যেসব নির্দেশনা দিতেন তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তুৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পীরগঞ্জ থানা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে কেন্দ্রীয় নির্দেশনানুযায়ী তিনি পীরগঞ্জে স্বাধীনতা যুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাই পাক হানাদার বাহিনীর দালালেরা মুক্তিযুদ্ধের নেতা, সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী নিধনের যে তালিকা তৈরি করেছিলেন ডা. সুজাউদ্দীন আহমদের নাম ছিল সেই তালিকার শীর্ষে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথমেই পাক হানাদার বাহিনী পীরগঞ্জে প্রথম পা রেখেই সেই তালিকানুযায়ী আমার স্বামীসহ সাতজন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এ ঠাকুরগাঁও জেলাধীন শিবগঞ্জের ভাতারমারীড়াঙ্গীতে তাঁকেসহ অপর ছয়জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর একটাই অপরাধ ছিল, দেশকে ভালোবাসা। তিনি আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও দেশপ্রেমিক ছিলেন বলেই পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁকে অকালে জীবন দিতে হয়। তাঁর শহীদ হওয়ার দিনটি কোনোদিনই ভোলার নয়।

ব্যক্তিমানুষ হিসেবে শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ ছিলেন মাটির মানুষ। তাঁর গুণের কথা লিখে শেষ করার নয়। কোনটা আগে বলব আর কোনটা পরে বলব তা কেন জানি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তিনি অত্যন্ত সৎ, চরিত্রবান, শান্ত, বিনয়ী, অত্যন্ত পরিশ্রমী, ভদ্র, ধর্মপরায়ণ ছিলেনদেশমাতৃকার প্রতি ছিল তাঁর দুর্বার আকর্ষণ। তাই তিনি ভালোবেসেছিলেন দেশকে, দেশের মানুষকেমানুষকে ভালোবেসে তিনি মানুষের ভালোবাসার, শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন। এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা তাঁকে অসীম স্নেহ করতেন। তিনি সব কাজই নিজ হাতে করতে ভালোবাসতেন এবং তা তিনি দক্ষ কারিগরের মতো করতেও পারতেনমাছ ধরা, জাল বোনা, কৃষিকর্ম, শিল্পকর্ম সবকিছুই যেন তাঁর হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পেত। তিনি কোনো কাজ করতে পারতেন না, তাই আমার অজানা। আমি সাত সন্তানের জননী। ছেলেমেয়েদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের কোনোদিন রেগে কথা বলেননি। তিনি বাড়িতে কি বাইরে সবাইকে হাসিখুশি দেখতে চাইতেন। রসিকতা করে কথা বলা ছিল তাঁর স্বভাবের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কোনো কারণে আমি রেগে গেলে বা সন্তানদের ওপর রেগে গিয়ে থাকলে তার সেই মজার মজার রসিকতা আমাকে এখনো ৪০-৫০ বছর আগে নিয়ে যায়। আমি সেসব কথা স্মরণ করে আনন্দ পেয়ে পরক্ষণেই বেদনায় স্তব্ধ হয়ে যাই। তিনি আমাকে আদর করে ‘তানি’ বলে ডাকতেন। তাঁর সেই ডাক আজও আমার কানে বেজে ওঠে। আমার সাথে রেগে কথা বলেছে এমনটি আমার মনে পড়ে না। তিনি আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।

তিনি কোনো সরকারি চাকরি করতেন না। ডাক্তারি পাস করার পর তিনি প্রথমে নিজ গ্রামের বাড়িতে এবং পরে পীরগঞ্জ চৌরাস্তার মোড়ে (জগথা মৌজায়) জমি ক্রয় করে ডিসপেনসারি স্থাপন করেন এবং চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেন। চিকিৎসক হিসেবে তার অবদান এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে আজও স্মৃতি হয়ে আছে। তাকে দেখেছি একজন চিকিৎসকের মহান ব্ৰত নিয়ে মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে। নিজের ছেলেবেলা হতদরিদ্র ছিল বলেই কোনো অসহায় মানুষ তাঁর কাছ থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে যেতেন না। এলাকার মানুষ চিকিৎসার জন্য দিনে-রাতে যখনই ডেকেছে তিনি তখনই তাদের সেই ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তাঁর কাছে কুলি, মজুর, ধোপা, নাপিত, শিক্ষক, কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী সবাই ছিল সমানতাঁর চিকিৎসার হাত ছিল অসাধারণস্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও তার সুচিকিৎসার কথা এখনো মানুষের মুখে শোনা যায়। গর্বে ভরে ওঠে আমার বুক। তাঁর চিকিৎসার হাত দেখে সরকারি চিকিৎসালয়ের চিকিৎসকরা পর্যন্ত ঈর্ষা করতেন। তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। যত দূরেই রোগীর কল হোক না কেন তিনি যেতেন। গরিব-দুঃখী-অক্ষম ব্যক্তিদের কাছ থেকে তিনি কোনো ভিজিট নিতেন না। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ বিনামূল্যে দিয়ে তিনি রোগী সারিয়ে তুলতেন। তাঁর এসব কর্মকাণ্ড এখন নীরব সাক্ষীতিনি যেন ছিলেন মহামানব। তাঁর হাতের ছোঁয়াতেই যেন রোগী ভালো হয়ে যেত। তাই ডাক্তার হিসেবে তাঁর নাম অতি দ্রুত দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। পীরগঞ্জ এলাকা ছাড়াও অনেক দূর থেকে রোগীরা এসে চিকিৎসাসেবা নিয়ে যেত।

 

 

৩৫২       মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

 

সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর পদচারণা ছিল উল্লেখ করার মতো। তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনায় পীরগঞ্জে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে নাটক ও যাত্ৰাগান প্রদর্শিত হতো। তিনি নিজে সেসব নাটক ও যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। স্থানীয় কলাকুশলীদের নিয়ে এসব অনুষ্ঠান করা হতো। খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ। তিনি খেলোয়াড়দের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এলাকার প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ডাকঘর, পাবলিক ক্লাব প্রভৃতি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। এলাকার মানুষ তাঁর কাছে শুধু চিকিৎসাসেবা নিতে আসতেন না, ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত পরামর্শ নিতেও আসতেন। তাঁর লেখার হাত ছিল। তিনি নিজে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রতিবেদন ইত্যাদি রচনা করতেন। সংবাদপত্র ও রেডিওর খবর ছিল তাঁর প্রাত্যহিক রুটিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ইত্তেফাক পত্রিকার এজেন্সি গ্রহণ করেন। ফলে এলাকার মানুষের সংবাদপত্র পাঠের পথ সুগম হয়েছিল।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ      ৩৬৩

 

আমার বাবা

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ।

কামরুল হুদা

 

আমার বাবা সুজাউদ্দীন আহমদ সুজা ডাক্তার নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। বগুড়া ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল থেকে ডাক্তারি পাস করেছিলেন। মা’র কাছে শুনেছি, ডাক্তারি পাস করার পর নিজের এলাকায় এসে তিনি এক বছর বিনা ফিতে জনগণের চিকিৎসা করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় জনগণ, বিশেষ করে গরিব জনগণের জন্য তার কী পরিমাণ দরদ ছিল! চিকিৎসা পেশাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন সত্যিকার অর্থে মানুষের সেবা করার জন্য।

বাবার জন্মতারিখ বা জন্ম সাল আমার জানা নেই। আমার অনুমান ১৯২৪ কিংবা ১৯২৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বীরহলী গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। পিতা মশিতুল্লাহ সরকার ছিলেন একজন গরিব কৃষক। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে বাবা ছিলেন তৃতীয়। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বড় দু’ভাই অল্প বয়সেই কৃষিকাজের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। পড়াশোনার সুযোগ তাঁরা পাননিকিন্তু আমার বাবার পড়ালেখার প্রতি ঝোঁক ছিল প্রচণ্ড। তাই সমস্ত প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে তিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পড়ালেখা সমাপ্ত করেন। এরপর ভর্তি হন পীরগঞ্জ হাই স্কুলে। তারপর দিনাজপুর সরকারি জিলা স্কুলে। তিনি কোন ক্লাসে দিনাজপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হন তা আমার অজানা। তিনি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। তাই ছাত্রছাত্রী পড়ানোর চুক্তিতে দিনাজপুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. ওয়াসিমের বাড়িতে লজিং থাকতে শুরু করেন। আমার বাবার আচারআচরণে মুগ্ধ হয়ে ডাক্তার-গিন্নি তাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেন। আমার বাবাও এই স্নেহময়ী মহিলাকে মা বলে সম্বোধন করতেন। ডাক্তার সাহেবের ছেলেমেয়েরাও আমার বাবাকে নিজেদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করে। এই পরিবারটির সাথে আমাদের এখনও সুসম্পর্ক আছে।

বাবা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করতে পারেননি। তাঁর কাছ থেকে শুনেছি—প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে তিনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষা ভালো হয়নি। পরীক্ষার পর তিনি দিনরাত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা

 

৩৬৪       মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

 

করতেন যেন ফেল করেন। তাঁর এ প্রার্থনা পূরণ হয়নি। পরীক্ষার ফল বের হলে জানতে পারলেন তিনি তৃতীয় বিভাগ পেয়েছেন। খুব দুঃখ পান তিনি। শিক্ষকরাও দুঃখ পান। কারণ তাঁরা জানতেন আমার বাবা খুব ভালো ছাত্র ছিলেন।

পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশার কারণে তিনি কলেজে পড়ার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। ছোট থেকেই তাঁর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এ স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হবে? পড়ার খরচ চালানোর মতো টাকা তিনি কোথায় পাবেন? কিন্তু তিনি হতাশায় ভেঙে পড়লেন না। চলে এলেন বগুড়ায়। অদম্য মনোবল নিয়ে ভর্তি হলেন ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলে। চার বছরমেয়াদি কোর্স। তাঁর ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন ছিল। বগুড়ার নামকরা চিকিৎসক ডা. মোজাফফরের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি তাঁকে তাঁর নিজের বাসায় লজিং রাখলেন। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী ব্যাপারটা সহজভাবে নিলেন না। প্রতিনিয়ত তিনি বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। আমার দাদির কাছ থেকে শুনেছি, ডাক্তারের স্ত্রী আমার বাবাকে ঠিকমতো খেতে দিতেন না। কতোদিন যে না খেয়ে তিনি রাত কাটিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তবুও হতাশায় তিনি ভেঙে পড়েননি। অদম্য মনোবল নিয়ে চারটা বছর তিনি পার করেন। আমার মনে হয় যেদিন তিনি ডাক্তারি পাস করেন সেদিনটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন।

ডাক্তারি পাস করার পর তিনি নিজ গ্রামে এসে চিকিৎসা পেশায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর নাম-যশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পীরগঞ্জ থানা সদরে জমি কিনে ডিসপেনসারি এবং বাড়ি নির্মাণ করেন।

ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থানার কমলাবাড়ির জমিদার পরিবারের এক কন্যার সাথে আমার বাবার বিয়ে হয়। দৃশ্যত এ বিয়ে ছিল অসম। কারণ আমার বাবার বংশগত পরিচয় খুব বড় ছিল না। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ের কাছে বংশগত পরিচয় ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সেই জমিদার পরিবারের লোকজন তাদের কন্যাকে আমার বাবার হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেননি।

আমার মা ছিলেন খুবই সুন্দরী। যখন তাঁর বিয়ে হয় তখন বয়স ছিল তেরো কিংবা চৌদ্দআমার বাবা দেখতে কেমন ছিলেন তার একটা বর্ণনা দেয়া যায়। আমার বাবা দেখতে ছিলেন মোটাসোটা। গালভর্তি দাড়িশুনেছি তিনি কোনোদিনই নাকি দাড়ি কাটেননি। দাড়িওয়ালা মোটাসোটা একটা লোককে কম বয়সী এক সুন্দরী মেয়ে সহজভাবে কি গ্রহণ করতে পেরেছিল? না পারাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মা পেরেছিলেন। আমার বাবাকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। কিন্তু ভালোবাসাই নয়, তিনি আমার বাবার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন এবং এখনও আছেন। এখনও সুযোগ পেলে তিনি আমার বাবার গুণের ফিরিস্তি অতি উৎসাহে বর্ণনা করেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার বাবা আওয়ামী লীগের পীরগঞ্জ থানা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা কমিটির সহ-সভাপতি এবং দিনাজপুর জেলার কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেনআওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হন। আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করেছেন। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনের সময় তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক প্রচারণায় অংশ নেন।

১৯৫৭ সালে যখন মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে ‘ন্যাপ’ গঠন করেন তখন পীরগঞ্জের অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা ন্যাপে যোগদান করেন। কিন্তু আমার বাবা আওয়ামী লীগেই থেকে যান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম আস্থা ও বিশ্বাস। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব যান যখন সামরিক আইন জারি করেন তখন পাকসেনারা তাঁকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। সারাদিন থানায় আটকে রেখে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেয়।

ছয় দফা আন্দোলনে আমার বাবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তখন শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি। আওয়ামী লীগের তখন চরম দুৰ্দিন। স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের ভয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে-ময়দানে অনুপস্থিত। এ সময় কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে এবং ছয় দফার পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ      ৩৬৫

 

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

 

শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বাবার ছিল খুব ভালো সম্পর্ক। শেখ সাহেব তাঁকে ‘মুরুব্বি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমার বাবা শেখ সাহেবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি সবসময় বিশ্বাস করতেন শেখ সাহেব দেশকে একদিন স্বাধীন করবেন।

বাবা যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই মানুষ ও সমাজের সেবা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। তিনি কতো মানুষের যে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন তার ইয়ত্তা নেইহিন্দু-মুসলমান অনেক নারী-পুরুষ আমার বাবাকে ‘ধর্মা বাবা’ বলে ডাকতোঅনেক গরিব পরিবারকে তিনি অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন।

নিজের ভাইবোনের প্রতি বাবার দায়িত্ববোধ ছিল অত্যন্ত গভীর। তিনি সবসময় তাঁদের টেনে তোলার চেষ্টা করেছেন। নিজের সংসারের প্রতি তিনি কিছুটা উদাসীন ছিলেন। কিন্তু নিজের ভাইবোনদের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে তিনি ছিলেন সবসময় সজাগপীরগঞ্জ সদরে জমি কিনে তিনি যে বাড়ি করেছেন সেখানে বড় ভাইকে নিয়ে এসেছেন। তাঁকে হোটেল করে দিয়েছেন। এখনও আমাদের ভিটেবাড়ির অর্ধেক অংশে আমার চাচার ছেলেমেয়েরা রয়েছে। আমার সবচেয়ে ছোট চাচাকে তিনি পড়াশোনা করিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভে প্রভূত সাহায্য করেছেন।

পীরগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমি দেখেছি কলেজের চাঁদা তোলার জন্য সাইকেলে চড়ে তিনি গ্রামগঞ্জে ছুটে বেড়িয়েছেন। সেই কলেজ আজ সরকারি কলেজ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

আমার বাবা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জীবনে তিনি খুব কমই নামাজ কাজ করেছেন। প্রায় প্রতিদিনই সকালে তিনি কোরান শরিফ পাঠ করতেন। কিন্তু তিনি গোড়া মুসলমান ছিলেন না। তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন এক সংস্কৃতিবান মানুষপীরগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন। আমার যখন ছয়-সাত বছর তখন মঞ্চে তাঁর অভিনীত নাটক আমি দেখেছি।

আমার এখনও মনে পড়ে ‘টিপু সুলতান’ নাটকে তিনি ‘হায়দার আলী’র চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মনোনীত হন। আর আমি টিপু সুলতানের ছোট ছেলেআমরা দু’জনই নাটকের রিহার্সেলে অংশ নিয়েছি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আমার বাবা হায়দার আলীর চরিত্রে অভিনয় করেননি। তবে পাশাপাশি অন্য একটি নাটকে তিনি অভিনয় করেন।

বাবা আমাদের ভাইবোনদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য সবসময় উৎসাহ দিতেন। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা একটা নাটক করেছিলাম। আমার ছোট বোন এবং আমি সেই নাটকে অভিনয় করি। আমার বাবা নাটকের একজন দর্শক ছিলেন। আমার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তিনি আমাকে বলেন, ‘রাজশাহী বেতার কেন্দ্রের নাটকে অংশগ্রহণ করার জন্য তোমার চেষ্টা করা উচিত।’ আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র।

সেদিনের কথা আমার এখনও মনে পড়েআমি তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলামবাবা আমার ঘুম ভাঙান। বললেন, ‘রূপবান হচ্ছে, দেখবি?’ কথাটা কানে যেতেই আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। কারণ তখন ‘রূপবান’ পালার কথা মানুষের মুখে-মুখে। তখনও আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বাবার সাথে রূপবান যাত্রা দেখতে গেলাম। সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা এখনও আমি অনুভব করি।

আমার বাবা খুব রসিক ছিলেন। খুব মজার মজার কথা বলে সবাইকে হাসাতেন। তাঁকে দেখলে বোঝা যেতো না তিনি এত মজা করতে পারেন। কারণ তাঁর চেহারাটা ছিল গম্ভীর প্রকৃতির। তবে যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরা জানেন কী পরিমাণ রসবোধ তাঁর ছিল!

একদিন হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘বল তো, এ দুনিয়ায় সবচেয়ে ভদ্ৰ কে?’ আমি তো প্রশ্ন শুনে অবাক! আমার মুখ দেখে বললেন, ‘পারবি না এই তো? আমি বলে দিচ্ছি। এ দুনিয়ার সেরা ভদ্ৰলোক হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তখন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে নানা অনুষ্ঠানে অংশ

নিতেন।

আমার বাবা কাজ ছাড়া কখনও থাকতেন না। সবসময় কোনো না কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।

 

 

৩৬৬       মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

 

ফজরের আজানের পরপরই তিনি ঘুম থেকে ওঠে পড়তেন। নামাজ ও কোরান পাঠশেষে তিনি কোনো না কোনো সাংসারিক কাজে লেগে পড়তেন। ঘর মেরামত থেকে শুরু করে গরুর জন্য খড় কাটা—সব কাজই তিনি করতেন। অন্য কোনো কাজ না থাকলে জাল বুনতেন। জাল দিয়ে মাছ শিকার করা তাঁর অন্যতম প্রধান শখ ছিল।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সমগ্র বাংলাদেশ টালমাটাল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সমগ্র জাতি মহাসংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পীরগঞ্জেও সেই সংগ্রামের ঢেউ এসে লেগেছে। আমার বাবা স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এখানে দিনাজপুরের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা একটু বলা প্রয়োজনপ্রথম অবস্থায় দিনাজপুর জেলা পুরো মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এ মুক্ত অবস্থা বেশিদিন থাকেনি। পাকসেনারা দিনাজপুর শহর পুনরায় দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যায় এবং ভারতে আশ্রয় নেয়। এপ্রিল মাসের ১৪-১৫ তারিখের দিকে আমরা জানতে পারি ঠাকুরগাঁও শহরও পাকসেনারা দখল করে নিয়েছে। এ অবস্থায় লোকজন বাড়িতে থাকা নিরাপদ মনে করলো না। অনেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলোআমরাও আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। কিন্তু বাবা পীরগঞ্জের বাড়িতে থেকে গেলেন।

১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। পীরগঞ্জের বাড়িতে আমি এবং বাবা। তখন বিকেলবেলাআমি বিছানায় শুয়েছিলাম। বাবা ছিলেন ডিসপেনসারিতে। হঠাৎ তিনি ঘরে এলেন। বললেন, ‘পাকসেনারা আসছে।’ কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সাহস করে দু’জনই বাইরে এলাম। দেখলাম, পাকসেনাদের গাড়ির বহর আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেপ্রথমে তারা আমাদের কিছুই করলো না। আমরা ভাবলাম কিছুই হবে না। এই ভাবাটাই ছিল আমাদের কালপ্রায় ১৫ মিনিট পর। বাবা আর আমি তখন দু’জনই বাড়ির ভেতরেহঠাৎ একদল পাকসেনা আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করলোতারা বাবাকে মারধর করছে। কিছুক্ষণের জন্য আমার চেতন যেন লোপ পেলোমুহুর্তের মধ্যে আমার চেতনা আবার ফিরে এলোকে যেন আমার ভেতর থেকে বলে উঠলো, পালাও, পালাও। এবার তোমারা পালা। আমি বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে গেলাম পাশের এক গ্রামে। সেখানে সূর্য ডোবা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। পীরগঞ্জ বাজার থেকে যারা ফিরে আসছিল তাদের কাছে শুনলাম পাকসেনারা চলে গেছে। রুদ্ধশ্বাসে বাড়িতে ফিরে এলাম। দেখলাম বাড়িতে আগুন জ্বলছে। বুঝলাম বর্বর পাকসেনাদের কাজ। লোকজনের কাছে শুনলাম তারা আমার বাবা, চাচা, মোস্তফা প্রফেসর, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জব্বার, শাহজাহানসহ মোট আটজনকে ধরে নিয়ে গেছে। ধারণা করলাম, তাঁদের ঠাকুরগাঁওয়ে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখবে। কিন্তু সে ধারণা ছিল ভুল।

বাড়ির আগুন নিভিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথিমধ্যে দেখলাম উন্মাদিনীর মতো মা ছুটে আসছেনআমাকে দেখে বললেন, ‘তোর বাবা কোথায়?’ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘বাবার কিছু হবে না।’ অনেক কষ্টে মাকে গ্রামের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম।

আমার দাদি তখনও বেঁচে। বয়স একশ’ বছরের কাছাকাছি। তাই দু’ছেলেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে গেছে শুনে তিনি যে বিলাপ শুরু করলেন তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

আমরা কোনোমতে রাতটা পার করলাম। বেলা দশটা-এগারোটার দিকে এলো সেই চরম দুঃসংবাদআমাদের বাড়ি থেকে ৭-৮ মাইল দূরে ভাতারমারীড়াঙ্গীতে আমার বাবা এবং অন্যদের হত্যা করে পাকসেনারা তাদের লাশ রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে। এ কথা শোনার পর আমাদের কী অবস্থা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

লাশ কে আনতে যাবে এটা এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিলো। কারণ লাশ আনতে গিয়ে যদি পাকসেনাদের মুখোমুখি হতে হয়, তখন কী হবে? আমাদের এক বড় ভাই শহীদ, তিনি এগিয়ে এলেন। তিনি গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করে লাশ আনতে পাঠালেন। তিনি নিজে লাশ আনতে গিয়েছিলেন কি না মনে নেই। বেলা ৩টার দিকে লাশ এলোদেখলাম গরুর গাড়িতে তিনটা লাশ। দুটি লাশ নামানো হলোআমার বাবার ও চাচার লাশ। সারা গায়ে রক্ত আর নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্ন। আমি চিৎকার করে উঠলাম। বাড়িতে নতুন করে কান্নার রোল উঠলোবিশেষ করে আমার মা এবং দাদিকে সামলানো মুশকিল হয়ে উঠলোএ দৃশ্য আমি আর বর্ণনা করতে চাই না।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ      ৩৬৭

 

শহীদ ডা. সুজাউদ্দীন আহমদ

 

সবাই বেশ আতঙ্কে থাকলেও জানাজায় অনেক লোকের সমাগম হলো। বাবাকে কবরে নামিয়ে দেয়ার পরও মনে হচ্ছিলো না যে বাবাকে আমি আর কোনোদিন দেখতে পাবো না।

৩৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, এখনও বাবাকে ভুলতে পারিনি। আমার বাবার মতো বাবাকে কি ভোলা যায়? বাবার সাত সন্তানের মধ্যে আমি ছিলাম সবার বড়। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি তাকে বেশি সময় কাছে পেয়েছি। কেন জানি তিনি আজকাল প্রায়ই আমার স্বপ্নে আসেন।

আমার মা যিনি মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছেন তিনি এখনও বাবার ছবি বুকে নিয়ে নীরবে-নিভৃতে চোখের পানি ফেলেন। একটা মানুষ এভাবে চলে যাবে এখনও মনে হয় তিনি তা মেনে নিতে পারেননি।

বাবার অকালমৃত্যুতে আমাদের পরিবারটি দিশেহারা হয়ে পড়ে। কারণ তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমার বাবা যা আয় করেছেন তাই খরচ করেছেন। আমাদের জন্য কোনো সঞ্চয় বা বড় কোনো সম্পত্তি রেখে যাননি। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর্থিক কারণে আমি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে পারিনি। আমার মা ছিলেন দারুণ সাহসী মহিলাশক্ত হাতে তিনি সংসারের হাল ধরেন। সংসার চালাতে তাকে যে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না। তবুও তিনি দমে যাননি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শহীদ পরিবার হিসেবে দু’হাজার টাকার একটা চেক পেয়েছিলাম। এরপর আর কোনো সাহায্য আমরা পাইনি। আর সাহায্যের জন্য কোনো তদবিরও আমরা করিনি।

বাবার শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয় তিনি হারিয়ে যাননি। তিনি আছেন এ দেশের পতাকায়, আছেন অসংখ্য সংগ্রামী মানুষের মাঝেবাবার জন্য আমার মনটা সবসময় গর্বে ভরে থাকে। আমার বাবা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন, এটা চিন্তা করেও সুখ।

এ লেখা লিখতে গিয়ে আমার চোখ বারবার পানিতে ভরে উঠেছে। মাঝে মধ্যে লেখা থামিয়ে চোখের পানি ফেলেছি অনেকক্ষণতারপর আবার কলম চালিয়েছি। আমি জানি না এ ছোটো লেখার মধ্য দিয়ে আমার বাবাকে তুলে ধরতে পেরেছি কিনা। আমার মনে হয়, পারিনি। আর পারা সম্ভবও নয়। আমার একটাই মাত্র আকাঙ্ক্ষা, যে স্বাধীনতার জন্য আমার বাবার মতো অসংখ্য মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন সে স্বাধীনতা আরও সংহত হোক, স্বাধীনতার ফসল সবার ঘরে ঘরে পৌছে যাক, সুন্দর সমৃদ্ধ একটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হোক।

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।

খ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনা বাংলা একাডেমী; ১০ম খণ্ড; প্রকাশকালঃ ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪০৪, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭; পৃ. ১৭ এবং ১২শ খণ্ড; প্রকাশকালঃ ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯; পূ. ৫৭।

গ. মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর; লেখকঃ এম এ কাফি সরকার প্রকাশনাঃ অংকুর প্রকাশনী, দিনাজপুর; প্রকাশকালঃ মার্চ ১৯৯৬; পৃ. ৫৯-৭১ ।

ঘ. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস; সম্পাদনাঃ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; প্রকাশনা ও সাহিত্য প্রকাশ; প্রথম খণ্ড; পৃ. ১৬৬।

 

৩৬৮      মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ