জীবনচিত্র নামঃ ডা.স.ম. মনছুর রহমান সরকার
Dr. S. M. Monsur Rahman Sarkar
ডাকনামঃ মন্ট
পিতার নামঃ ফজলুল আহাম্মেদ সরকার
পিতার পেশাঃ স্ট্যাম্প ভেন্ডার
মাতার নামঃ বিবিজান
ভাইবোনের সংখ্যাঃ পাঁচ ভাই ও এক বোন; নিজক্ৰম
কনিষ্ঠ
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ নান্দেড়াই, ইউনিয়ন-৫নং আব্দুলপুর, ওয়ার্ড নং-০৭,
ডাকঘর-নান্দেড়াই, উপজেলা-চিরিরবন্দর, জেলা-দিনাজপুর
শহীদ ডা. স. ম. মনছুর রহমান সরকার
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ঐ
জন্মঃ ২০ জানুয়ারি, ১৯৪৫ খ্রি.
জন্মস্থানঃ চিরিরবন্দর, দিনাজপুর
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ প্রথম বিভাগ, ১৯৬১, চিরিরবন্দর উচ্চ বিদ্যালয়, দিনাজপুর
আইএসসিঃ প্রথম বিভাগ, ১৯৬৩, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, দিনাজপুর
এমবিবিএসঃ ১৯৬৯, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
চাকরির বর্ণনাঃ
সহকারী সার্জনঃ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, অমৃত্যু
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য (রাজাকার সহযোগে)
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ১৩ এপ্রিল ১৯৭১
মরদেহঃ
প্ৰাপ্তি স্থানঃ চারঘাট স্বাস্থ্যকেন্দ্র
সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ ডা. মনজিলা খাতুন (শহীদ নজিবর রহমানের মেয়ে)
কবরস্থানঃ চারঘাট স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বি.এম.এ কেন্দ্ৰীয় কাৰ্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ত্রাণ তহবিল হতে দুই হাজার টাকার চেক
বৈবাহিক অবস্থাঃ অবিবাহিত
তথ্য প্রদানকারী
এম এ মোত্তালেব সরকার
শহীদ চিকিৎসকের
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৪৯
আমার চাচা
শহীদ ডা. স. ম. মনছুর রহমান সরকার
এম এ মোত্তালেব সরকার
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামের নাম নান্দেড়াই; দিনাজপুর জেলার ৫নং আবদুলপুর ইউনিয়নের আওতায় গ্রামটির অবস্থান। সেই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন
শহীদ ডাক্তার মনছুর রহমান সরকার। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, ডাকনাম ছিল মন্টু। বাল্যকাল থেকেই ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ; এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। বাল্যকাল থেকেই তিনি আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এভাবে তাঁর স্কুলজীবন শুরু হয় এবং ১৯৬১ সালে চিরিরবন্দর হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে বছর চিরিরবন্দর হাই স্কুলে একমাত্র তিনিই এ গৌরব অর্জন করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি শুধু প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হননি, সেই সাথে মেধা তালিকাতেও শীর্ষস্থান অধিকার করে নেন। তারপর ১৯৬৩-৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস পরীক্ষায় সম্মানজনকভাবে উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই সহকারী সার্জন হিসেবে যোগদান করেন।
কিন্তু এর পরপরই ঘটে যায় চরম হৃদয়বিদারক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, নির্যাতন বিশেষত নারী নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের ঘটনা ঘটতে থাকে। পাকবাহিনী যুবসমাজের ওপর তাদের শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অনেক বাঙালি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভারতে চলে যেতে থাকে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদানের সাত-আট দিন পর ডা. মনছুর রহমান সরকার, নজিবর রহমান, বাদশাসহ আরো কয়েকজন রাজশাহী থেকে ভারতের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা হন। ১৩ এপ্রিল পথিমধ্যে ক্লান্ত হয়ে তারা রাজশাহী চারঘাট সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের কাছে এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তখন একদল রাজাকার
৩৫০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. স. ম. মনছুর রহমান সরকার
তাদের বাঙালি হিসেবে চিনে ফেলে এবং পাকবাহিনীকে খবর দেয়। খবর পেয়ে পাকবাহিনীর কয়েকজন দ্রুত সেখানে এসে উপস্থিত হয়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকবাহিনী ডা. মনছুর রহমান সরকারসহ তার সফরসঙ্গী সবাইকে বুলেটের আঘাতে হত্যা করে।
আমরা ডা. মনচুর রহমান সরকারের মৃত্যুসংবাদ পাই শহীদ নজিবর রহমানের মেয়ে ডা. মনজিলার কাছ থেকে। সদ্য পিতৃহারা, শোকবিহবল ডা. মনজিলা নিজে বাড়িতে এসে ডা. মনছুর রহমান সরকারের মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে যান।
ডা. মনছুর রহমান সরকারের মৃত্যুসংবাদ সেদিনই তাঁর মাতার কাছে পৌঁছে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামী ফজলুর রহমানকে। উপর্যুপরি শোকের প্রবল ভার সহ্য করতে পারেননি তিনি; সন্তান হারানোর কয়েক দিনের মধ্যে তিনিও চিরবিদায় গ্রহণ করেন।
ডা. মনছুর রহমান সরকার ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়ার পর নিজের কঠিন পড়াশোনার সময় নষ্ট করেও অনেক অসহায় রোগীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতেন। তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল দুস্থ রোগীদের জন্য। তাঁর একটি স্বপ্ন ছিল যে তিনি গ্রামে একটি ফ্রি চিকিৎসা ক্লিনিক করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! তাঁর ইচ্ছা পাক হানাদারবাহিনী চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিল। তাঁর ইচ্ছা পূরণ হলো না; গ্রামের গরিব অসহায় রোগীদের চোখে কান্নাই রয়ে গেল। শহীদ ডা. মনছুর রহমান সরকার নিজের জীবন দিয়ে তাঁর মাতৃভূমির স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। জাতি তাঁকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করুক এই কামনা করি।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯, ৪৩।
গ. মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর; লেখকঃ এম এ কাফি সরকার; প্রকাশনা; অংকুর প্রকাশনী, দিনাজপুর; প্রকাশকালঃ মার্চ ১৯৯৬; পৃ. ৫৯-৭১।
ঘ. একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর; সম্পাদনাঃ সুকুমার বিশ্বাস; প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারী ২০০০; পৃ. ২৬৯।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৫১
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ