জীবনচিত্র নামঃ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ
Dr. Shamsuddin Ahmed
পিতার নামঃ ইমানউদ্দিন আহমেদ
পিতার পেশাঃ রেলওয়ে কর্মকর্তা
মাতার নামঃ রাশেদা বেগম
ভাইবোনের সংখ্যাঃ তিন বোন, এক ভাই; নিজক্ৰম-
তৃতীয়
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ বাড়ি নং-৬৯ হাউজিং এস্টেট,
আম্বরখানা, জেলা-সিলেট
শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ বাড়ি নং-৬৯ হাউজিং এস্টেট, আম্বরখানা, জেলা-সিলেট
জন্মঃ ১ আগস্ট, ১৯২০
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ প্রথম ডিভিশন, বৃত্তি ও লেটার, ১৯৩৯, সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
আইএসসিঃ প্রথম ডিভিশন, ১৯৪১, সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ
এমবিবিএসঃ ১৯৪৬, কলকাতা মেডিকেল কলেজ
এফআরসিএসঃ ১৯৬২, রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স, ইংল্যান্ড
শখঃ সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুরাগী, রাইফেলস ক্লাবের সদস্য
সমাজসেবাঃ
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স কোর (প্রথম রিলিফ সংস্থা)
প্রতিষ্ঠাতা, জালালাবাদ অন্ধকল্যাণ সমিতি
প্রতিষ্ঠাতা, সিলেট আম্বরখানা বালিকা বিদ্যালয়
সভাপতি, বিভিন্ন মসজিদ কমিটি, সিলেট
প্রতিষ্ঠাতা, টিবি হাসপাতাল
ছোটবেলায় Scout leader হিসেবে বিভিন্ন দাঙ্গাপীড়িতদের সেবাদান
রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাঃ
সভাপতি, সহ-সভাপতি, সক্রিয় সদস্যঃ আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন, ১৯৪১-৪৩
চাকরির বর্ণনা
অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, সার্জারি বিভাগঃ সিলেট মেডিকেল কলেজ, ১৯৬৯-১৯৭১
সহ-অধ্যাপক, সার্জারি বিভাগঃ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, ১৯৬৭-১৯৬৯
সিভিল সার্জনঃ সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগ, ১৯৬৪-১৯৬৭
সহ-অধ্যাপক, সার্জারি বিভাগঃ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, ১৯৬২-১৯৬৪
শিক্ষক, সার্জারি বিভাগঃ চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুল, ১৯৫৫-১৯৫৭
রেসিডেন্ট সার্জনঃ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ১৯৫৪-৫৫
শিক্ষকঃ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা, ১৯৫৩
প্রধানঃ নারায়ণনগর স্কুল হাসপাতাল, ১৯৫২
প্রধানঃ কুমিল্লা হাসপাতাল, ১৯৪৮
হাউস সার্জনঃ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ১৯৪৭
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ
মেজর রিয়াজা/লে. কর্নেল সরফরাজ মালিক
সংগঠনের নামঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিহত হওয়ার তারিখঃ ৯ এপ্রিল, ১৯৭১
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ
প্রাপ্তি তারিখঃ ৯ এপ্রিল, ১৯৭১
সন্ধানদানকারী পরিচয়ঃ মাঈনউদ্দীন হোসেইন (চাচা)
কবরস্থানঃ পুরনো সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ (বর্তমান শহীদ শামসুদ্দীন হাসপাতাল প্রাঙ্গণ)
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ সিলেটের শহীদ মিনারের পাশে তাঁর স্মৃতিফলক ও কবরস্থান আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিপ্রাঙ্গণ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩২৭
শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ মুক্তিযুদ্ধের ১০ বছর পর বিএমএ ও সিলেটের যুব সংস্থা একটি করে প্ল্যাক প্রদান করে
স্ত্রীঃ বেগম হোসেনে আরা আহমেদ (অধ্যক্ষ)
বিয়েঃ ৪ এপ্রিল ১৯৪৭
সন্তান-সন্ততিঃ দুই পুত্র ও তিন কন্যা
ফরহাত জামানঃ BA/Computer Science, New York, USA
সালাহউদ্দীন আহমেদঃ ইঞ্জিনিয়ার, New Jersey, USA
ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদঃ ডাক্তার, Philadelphia, USA
রাহাত হোসেইনঃ Nutritionist, New York, USA
ডা. মালেকা আহমেদঃ ডাক্তার, lowa, USA
তথ্য প্রদানকারী
ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শহীদ চিকিৎসকের পুত্র
6 Celar Hollow Drive, Rose
Valley, PA 19086, USA
৩২৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার বাবা
শহীদ ডা. অধ্যাপক শামসুদ্দীন আহমেদ
ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সিলেট মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান আমার বাৰা ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ ১৯৭১-এর মার্চের প্রথম দিকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তখনই সিলেট মেডিকেল কলেজে একটি Blood blank ও Emergency squad গঠন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু হওয়ার পর হাসপাতালে অনবরত আগত আহতদের চিকিৎসায় তিনি অন্য চিকিৎসকদের নিয়ে সর্বক্ষণ নিয়োজিত থাকেন। তিনি পরিষ্কারভাবে ছাত্রদের বলেন, ‘এই রকম হিংসাত্মক কার্যক্রম ও গণহত্যার একমাত্র সমাধান-বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং তার জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।’ ঐ সময়ে একদিন পাঞ্জাবি সৈন্যরা তাঁদের সঙ্গে চাকরিরত বাঙালি ডা. লে. মঈন ও ক্যাপ্টেন মাহবুবকে গুলি করে হাসপাতালে দিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মাহবুব মৃত্যুবরণ করেন কিন্তু ডা. লে. মঈনকে বাবা অপারেশন করে সুহাবস্থায় হাসপাতাল থেকে সরিয়ে দেন। সিলেট শহরে আটকে পড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপিসহ অন্যকে অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে দূরে সরিয়ে দেন।
এপ্রিলের ৩ তারিখ আমি (মেডিকেল প্রথম বর্ষের ছাত্র), সালাম (কর্নেল অব.), আনিস (মেজর অব.) ও আবুল হাসান বুলু (মেডিকেল পঞ্চম বর্ষের ছাত্র) মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার উদ্দেশ্যে কাউকে না জানিয়ে বিয়ানীবাজার পুলিশ ফাড়ি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করি। পরের দিন কর্নেল রবের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তাঁর নির্দেশে তেলিয়াগড়ায় গিয়ে মেজর শফিউলার দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করি। আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে বাবা শঙ্কিত না হয়ে আমার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে দেশের জন্য দায়িত্ব পালনে তরুণসমাজকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। হানাদারদের গণহত্যায় আতঙ্কিত সিলেটে মেডিকেল কলেজের ছাত্র-শিক্ষক-ডাক্তাররা শহরতলিতে আশ্রয় নিতে শুরু করলে এক পর্যায়ে হাসপাতাল প্রায় ডাক্তারশূন্য হয়ে পড়ে। সমস্ত হাসপাতালে আহতদের সেবার জন্য ডা. শামসুদ্দীনের সাথে থেকে যান ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী ও নার্স মাহমুদুর রহমানসহ আরো
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩২৯
শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ
কয়েকজন। ডা. শামসুদ্দীন মহিলা নার্সদের হাসপাতাল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তাঁর নিজের মা ও সদ্য বিবাহিতা বড় মেয়ে ও তার জামাই, বড় ছেলে ও ছোট দুই মেয়েকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ আমার মা সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমেদ স্বামীকে সাহায্য করার প্রয়াসে শহরে থেকে যান। মা হাসপাতালে রোগীদের খাবার সরবরাহ ও প্রয়োজনে নার্সের কাজ করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ডা. শামসুদ্দীন অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত সবাইকে এই ভয়ঙ্কর ক্ষেত্র থেকে সরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তাঁকে তাঁর চাচা প্রধান শিক্ষক মৌলভি মঈনউদ্দিন হোসেন হাসপাতালে না যাওয়ার জন্য হাত ধরে অনুরোধ করলে তিনি শান্ত হাসি হেসে বলেন, ‘এখনই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তাছাড়া জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী হাসপাতালে যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হওয়ার কথা নয়।’
এপ্রিলের একেবারে প্রথম দিকে বাঙালি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অতর্কিত আক্রমণে পাক হানাদাররা সিলেট শহর ত্যাগ করে শালুটিকর বিমানবন্দরে চলে যায়। সেই সময় হাসপাতালে কিছু পাকিস্তানি সৈন্যও ভর্তি ছিল। সেসব আহত শত্রুসেনাকে আক্রমণ করা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরত রাখেন ডা. শামসুদ্দীন।
৭ এপ্রিল হানাদাররা আবার সিলেটে ভারি অস্ত্রসহ হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী হাসপাতালে প্রবেশ করে এবং চিকিৎসা সেবাদানরত ডা. শামসুদ্দীন, তাঁর একনিষ্ঠ সহযোগী ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী, নার্স মাহমুদুর রহমান, পিয়ন মো. মহিবুর রহমান, মকলিসুর রহমান সহ মোট সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে। কয়েকদিনের কারফিউ শেষ হওয়ার পর ১৩ এপ্রিল তাঁর সেই চাচা মৌলবি মঈনউদ্দিন হোসেন লাশ খুঁজে বের করেন। তারপর তিনি ডা. মোবারক আলী, ভায়রা সৈয়দ আবদুন নবী ও অন্যদের উপস্থিতিতে (পুরাতন) সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অঙ্গনে ডা. শামসুদ্দীনসহ অন্য শহীদদের কবরস্থ করেন। সেই জায়গায় আজ গড়ে উঠেছে স্মৃতিসৌধ। পরবর্তীকালে তার পাশেই গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন অগণিত মানুষ।
৩৩০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
ডাক্তার শামসুদ্দীন
বাংলাদেশের আর একজন অমর শহীদ ডাক্তার শামসুদ্দীন আহমেদ। ‘মানুষের চেয়ে নহে কিছু বড়, নহে কিছু মহীয়ান’-এই নীতি যাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল, মানবতার। সেবাই যাঁর জীবনের ব্রত ছিল, শত্ৰু-মিত্র নির্বিশেষে মানুষকে যিনি সবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন, সেই মানুষকেই যে বিনা অপরাধে কেউ হত্যা করবে একথা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বিচিত্র এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে, তেমনি করেই ঘটেছিল মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ ডা. শামসুদ্দীনের নির্মম মৃত্যু। সিলেটের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার মধ্যেও তিনি কলকাতা এবং বিহারে আহতদের সেবা করেছেন অক্লান্তভাবে। তারপর ঢাকাতে রেসিডেন্ট সার্জন থাকাকালে তিনিই পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স কোর গঠন করেন এবং বন্যাকবলিত দুর্গতদের সাহায্যার্থে কয়েকটি রিলিফ স্কোয়াড গঠন করে বিভিন্ন স্থানে পেরণ করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে গুটিবসন্তে যখন ৬০ হাজার লোক প্রাণ হারায় তখন ডা. শামসুদ্দীনের আন্তরিক চেষ্টায় ডাক্তার ও মেডিকেল ছাত্ররা এই মহামারীর প্রতিরোধকল্পে অভিযান চালান। প্রফেসর শামসুদ্দীন একজন ডাক্তাররূপে কেবল নিজের সীমিত কর্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি তাঁর অর্জিত বিদ্যা ও শক্তিকে মানবের সেবায় নিঃস্বার্থভাবে উৎসর্গ করেছিলেন।
বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সেই ভয়াল দিনগুলোতে সীমান্ত এলাকা সিলেট শহরের ওপর প্রচণ্ড হামলা হয়। শহর ছেড়ে চলে যেতে থাকেন অনেকে। কিন্তু ডা. শামসুদ্দীন শুভাকাক্ষীদের অনুরোধ সত্ত্বেও হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হননি। বরং তিনি বয়োকনিষ্ঠ ডাক্তার, নার্স ও প্যারামেডিকেল স্টাফদের অনুরোধ করেন যারা আহত আছে এবং যারা আহত হয়ে আসবে সেসব অসহায়দের সেবা করার জন্য। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যদি চলে যাই তবে মুক্তিবাহিনীর লোকদের সাহায্য করবে কারা?’ আহতদের উপযুক্তভাবে সেবা করার জন্য মাত্র দেড় মাইল দূরে অবস্থিত কোয়ার্টারে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের রেখে তিনি হাসপাতালে রাতযাপন করতেন এবং দিবারাত অক্লান্তভাবে আহতদের সেবা করতেন।
হাসপাতালে তিনি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে থাকেন এবং যেসব তরুণ ডাক্তার মুক্তিবাহিনীর সাথে কাজ করছিলেন তাঁদেরও ওষুধপত্র দিয়ে সাহায্য করেন। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল সীমান্তের
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৩১
শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ
তামাবিল বর্ডার অতিক্রম করে একটি ইতালিয়ান টিম সিলেটে আসেন। প্রফেসর শামসুদ্দীন তাঁদের সমস্ত হাসপাতাল ঘুরিয়ে নিরীহ নাগরিকদের ওপর পাকিস্তানি জঙ্গি বাহিনীর নগ্ন হামলার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তুলে ধরেন। তিনি এই ঘৃণ্য আক্রমণের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য পেশ করেন ইতালিয়ান দল তা রেকর্ড করে দেশে নিয়ে গিয়ে প্রচার করেন।
৯ এপ্রিল ৯টার সময় সিলেট মেডিকেল কলেজের কাছে ভীষণ যুদ্ধ হয়। হাসপাতালের অদূরবর্তী টিলাস্থ সিভিল সার্জনের বাংলা থেকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাক সেনাবাহিনীর ‘কনভয়ের’ প্রথম জিপটি উল্টে যায়। এবং তিনজন খানসেনা নিহত হয়।
এর পরপরই হাসপাতাল এলাকা সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলে এবং উক্ত এলাকাটি মুক্ত করার নির্দেশ জারি করা হয়। মেজর রিয়াজসহ একদল সশস্ত্ৰ পাকসেনা হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান না পেলেও হাসপাতালে যারা আছে তাদেরই বাইরে এনে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়।
ডা. শামসুদ্দীনসহ হাসপাতালের আরো কয়েকজন কর্মচারীকে প্রাচীরের কাছে এনে দাঁড় করানো হয়। তিনি তখন উদ্যোগী হয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের ভুল ভাঙাতে চেয়েছিলেন। কারণ কর্তব্যরত ডাক্তার যে কারো শত্রু হতে পারেন তিনি তা ভাবতে পারেননি। কিন্তু প্রথমেই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। গুলি এসে তাঁর বাম উরুতে লাগে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। এরপর দ্বিতীয় গুলিটা যখন তাঁর বাম পেটে লাগে তখনও তিনি দাঁড়িয়ে। কিন্তু তৃতীয় গুলিটা হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হতেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
এরপর একনাগাড়ে কারফিউ চলতে থাকে। ১৩ এপ্রিল মাত্র এক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে তাঁর নিকট আত্নীয় কয়েকজন এসে তাঁর দেহকে শনাক্ত করেন এবং হাসপাতাল অঙ্গনের মধ্যে মাত্র এক ফুট গর্ত করে অতি দ্রুততার সাথে তাঁর লাশ দাফন করেন।
প্রফেসর শামসুদ্দীনের মতো মহৎ সেবাব্রত প্রাণ আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তাঁর মহান স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করার জন্য ইতোমধ্যে সিলেটের মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসটিকে ‘ডাক্তার শামসুদ্দীন হল’ নাম দেয়া হয়েছে। তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তরা মেডিকেল কলেজটিকে ‘শামসুদ্দীন মেডিকেল কলেজ’ নামকরণ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
(*ডক্টর মযহারুল ইসলাম সম্পাদিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে থেকে সঙ্কলিত)
৩৩২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৫৯২,৭০৭ ।
ঘ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ষষ্ঠ পর্যায়; ১৯৯৭ । (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
ঙ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৪র্থ খণ্ড; ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ডিসেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ৩০ ।
চ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৮৪ ।
ছ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্ৰী।
জ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯, ৩০।
ঝ. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস; সম্পাদনাঃ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ; প্রথম খন্ড।
ঞ. বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা; লেখকঃ রফিকুল ইসলামঃ প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল; ২৮ অগ্রহায়ণ, ১৩৮০, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৩; পৃ. ৮৫।
ট. সিলেটের যুদ্ধকথা; লেখকঃ তাজুল মোহাম্মদ; প্রকাশনা; সাহিত্য প্রকাশ; প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৩৯৯, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৩; পৃ. ৪৫
ঠ. এমজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ স্মৃতিস্তম্ভ, সিলেট।
ড. *শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণেঃ সম্পাদনাঃ ডক্টর মযহারুল ইসলাম; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ মার্চ ১৯৭৩; পৃ. ৪৫ ।
ঢ. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান; সম্পাদনা; এএসএম সামছুল আরেফিন; প্রকাশনা; ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; প্রকাশকালঃ ১৯৯৫; পৃ. ৫৪৫।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৩৩
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ