You dont have javascript enabled! Please enable it!

 জীবনচিত্র   নামঃ ডা. রেবতী কান্ত সান্যাল

Dr. Rebati Kanta Sanyal

ডাকনামঃ গেদু সান্যাল

পিতার নামঃ রমণী কান্ত সান্যাল

পিতার পেশাঃ জমিদারি

মাতার নামঃ শরৎসুন্দরী দেবী

ভাইবোনের সংখ্যাঃ এক ভাই ও দুই বোন; নিজক্ৰম-দ্বিতীয়

ধর্মঃ সনাতন ধর্ম

স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-বিশিয়া, ইউনিয়ন-৫নং, ডাকঘর-ডাঙ্গাজাঙ্গাল, উপজেলা-আত্রাই, জেলা-নওগাঁ

শহীদ ডা. রেবতী কান্ত সন্যাল

 

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ লালবাজার, ওয়ার্ড নং-২, নাটোর পৌরসভা, উপজেলা-নাটোর সদর, জেলা-নাটোর-৬৪০০

জন্মঃ ১৩০৬ বাং ১৮৯৯

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ প্রথম বিভাগ, ১৯১৫, খাজুরা উচ্চ বিদ্যালয়

আইএসসিঃ প্রথম বিভাগ, ১৯১৭, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা

বিএসসিঃ দ্বিতীয় বিভাগ, ১৯১৯/২০, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা

এমবিঃ প্রথম বারেই উত্তীর্ণ, ১৯২৪/২৫, কলকাতা মেডিকেল কলেজ

শখঃ প্রাতঃভ্রমণ, ব্যায়াম (যোগ ব্যায়াম)

সমাজসেবাঃ স্কাউটের সদস্য

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাঃ সাধারণ সদস্যঃ ভারতীয় কংগ্রেস, ১৯২২-১৯৪৭

চাকরির বর্ণনাঃ

সহকারী সার্জনঃ বালুরঘাট হাসপাতাল, অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর, ১৯৫২ সালে মাত্র ২৯ দিন চাকরিরত ছিলেন

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ মুসলিম লীগের দু’জন সক্রিয় সদস্য ও দু’জন অবাঙালি (বিহারি)

নিহত হওয়ার তারিখঃ ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১

মরদেহঃ

প্রাপ্তি স্থানঃ লালবাজার, নাটোরের নিজ বাড়িতে

প্রাপ্তি তারিখঃ ১৫ এপ্রিল ১৯৭১ সাল

সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ পচাদাস (প্রতিবেশী)

শ্মশানঘাটঃ কাশিমপুর

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি

স্ত্রীর নামঃ অন্নপূর্ণা দেবী

বিয়েঃ ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫, (১৯২৮ সাল)

সন্তান-সন্ততিঃ এক পুত্র ও তিন কন্যা

দীপালী সান্যালঃ ম্যাট্রিকুলেশন, প্রয়াত

শেফালী সান্যালঃ নবম শ্রেণী, প্ৰয়াত

শিবানী সান্যাল (ফুনু) দশম শ্রেণী, প্রয়াত

রঞ্জন কান্ত সান্যাল (খোকন) ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ (মরণোত্তর), প্রয়াত

 

 

তথ্য প্রদানকারী

ডা. লক্ষ্মীকান্ত সান্যাল

শহীদ চিকিৎসকের নাতি (ভাতিজার পুত্ৰ)

লালবাজার নাটোর, পোস্ট-নটোর

জেলা-নাটোর

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকাষ       ৩২৩

 

আমার ঠাকুরদা

শহীদ ডা. রেবতী কান্ত সান্যাল

ডা. লক্ষীকান্ত সান্যাল

 

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে। পাকিস্তান মিলিটারি ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলে ঢুকতে শুরু করেছে। পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই গাড়ির বহর রাজশাহী শহরেও ঢুকতে লাগলোবৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের বাঙালি রাজাকার এবং অবাঙালিরা (বিহারিরা) বাঙালি হত্যা-নির্যাতনে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা বোধ করল।

নাটোর শহরের লালবাজারের দালানবাড়িতে বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. রেবতী কান্ত তথা আমার ঠাকুরদা সান্যাল পরিবারের বসবাস। শহরের অধিকাংশ বাঙালিই ইতোমধ্যে ভারতে শরণার্থী হয়েছে। কিন্তু সর্বজনপ্রিয় দাদা তাঁর একান্তবর্তী পরিবার নিয়ে ঐ বাসাতেই আছেন (চিকিৎসককে কেউ টার্গেট করবে না, এটা দাদার দৃঢ়বিশ্বাস)আমিও সেখানেই থাকি। দাদাকে চিকিৎসা বিষয়ক নানা কাজে সহায়তা করি।

৪ এপ্রিল ১৯৭১বেলা ১টা। দাদার বাসার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঠাকুরদার পরিচিত নাসিরউদ্দিন (নাসির চেয়ারম্যান) এবং কাঁচু মুক্তার (মুসলিম লীগ নেতা) বাসায় ঢুকল; এরা ছিল এলাকার চিহ্নিত রাজাকার। কঁচু মুক্তার ঠাকুরদাকে বলল, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না’এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আপনাকে কেউ কিছু বলবে না।’ এভাবে ঠাকুরদাকে আশ্বস্ত করে ওরা চলে গেল।

কাঁচু মুক্তারের ছেলেকে একবার ঠাকুরদা কঠিন অসুখ থেকে সারিয়ে তুলেছিলেন। ছেলেটার অনেকদিন ধরে খুব জ্বর। রাজশাহীর বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ. কে. খান ঠাকুরদার কাছে রেফার করলেন। ঠাকুরদা অনেক যত্ন করে চিকিৎসা করলেন। মেডিকেলের বিভিন্ন বই ঘাঁটাঘাঁটি করলেন; সে অনুযায়ী ওষুধ দিলেন। আমিও ঠাকুরদাকে সাহায্য করলাম। বেঁচে গেল কাঁচু মুক্তারের ছেলে।

সেই কাঁচু মুক্তার বেলা ১টায় ঠাকুরদাকে আশ্বস্ত করে চলে গিয়ে আবার। ফিরে এলো বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। সঙ্গে নাসির চেয়ারম্যানও আছে। আরও

 

৩২৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকাষ

 

শহীদ ডা. রেবতী কান্ত সান্যাল

আছে দুই অবাঙালি (বিহারি); হাফপ্যান্ট পরিহিত। তারা চারজন দরজা ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করলো। ঠাকুরদাকেই বাইরের ঘরে পেল। তাঁকে দেখেই ওদের একজন গুলি করলগুলি লাগল ঠাকুরদার ডান হাতেঠাকুরদার হাতে ছিল সংসারের চাবির গাছা; ঝনঝন্‌ করে মেঝেতে পড়ে গেলওরা চাবি নিয়ে সিন্দুকটা খুলল। সিন্দুকে ছিল বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা আর ১৪,০০০ পোস্টাল ইস্যুরেন্স। সেগুলো সব নিতে লাগল।

ঠাকুরমা তখন রান্নাঘরের উনুনে লুচি ভাজছিলেন; সঙ্গে বাড়ির বহু দিনের বিশ্বস্ত ভৃত্য পদ, সে লুচি বেলছিলগুলির শব্দে ঠাকুরমা, পদ দৌড়ে ঠাকুরদার ঘরের দিকে এলোঠাকুরদার গুলিবিদ্ধ হাত থেকে রক্ত ঝরছে। ঠাকুরমা পদকে উঠানে নিয়ে এলোউঠানের বালতিতে ক্ষতস্থান ধুতে লাগল।

এদিকে সিন্দুকের সম্পদ লুট করে কঁচুর দলও উঠানে চলে এলোতারা ঠাকুরদাকে হাত উঁচু করে দাঁড়াতে বলল। ঠাকুরদা কাঁচুকে বলল, ‘আমার কী দোষ? দেশ থেকে তো পালাইনি! আমার অন্যায়টা কী? কাঁচু, তুমি না দুপুরে বলে গেলে, আমার কোনো ক্ষতি হবে না। তাহলে?’ কথা শেষ হলো না। বিহারিদের একজন একের পর এক গুলি করলগুলি প্রথমে লাগল পেটে, তারপর বুকে, তারপর চোখের খুব কাছে কপালে। দাদা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। অস্ফুট সুরে একবার শুধু ডাকলেন, ‘পদ…।’ বিপদে-আপদে ডাকলেই যাকে কাছে পেতেন। তারপর নীরব-নিথর হয়ে গেলেন। পদ ছুটে আসছিলপদকেও গুলি করল। গুলি লাগল বুকে। পদও তখনই শেষ।

আমি বড় একটা চাড়ির (গরুর খাবারের বড় পাত্র) ভেতরে লুকিয়েছিলাম। ওরা চারজন চলে যেতেই তুলা-ব্যান্ডেজ নিয়ে এসে ঠাকুরদার রক্তস্থান পরিষ্কার করতে লাগলাম। কিন্তু সেসবের দরকার ছিল না। ঠাকুরদা আগেই চলে গেছেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমি ঘোড়ার টমটম গাড়িতে করে কালীগঞ্জ গ্রামের দিকে চলে গেলাম। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম। ৭নং সাব-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করলাম।

ঠাকুরদার নাটোরের লাল বাজারের সে বাড়ি এখন বেদখল। দালান ধ্বংসপ্রায়। ভবঘুরে লোকজন সেখানে থাকে। বাড়ির মালিকানা নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। স্বাধীন দেশেও এসব দেখতে আর ভালো লাগে না।

 

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।

খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

গ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ আগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ২২

ঘ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ২৭।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকাষ ৩২৫

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!