You dont have javascript enabled! Please enable it!

জীবনচিত্র      নামঃ ডা. রাখাল চন্দ্ৰ দাস

Dr. Rakhal Chandra Das

ডাকনামঃ  রাখাল

পিতার নামঃ গুরুদয়াল দাস

পিতার পেশাঃ  কৃষিজীবী

মাতার নামঃ অনন্তময়ী দাস

ভাইবোনের সংখ্যাঃ এক ভাই ও দুই বোন; নিজক্ৰম-

তৃতীয়

ধর্মঃ হিন্দু (সনাতন)

স্থায়ী ঠিকানাঃ ধানীখোলা মধ্যভাটিপাড়া,

ইউনিয়ন/ডাকঘর-ধানীখোলা বাজার, উপজেলা-ত্রিশাল,

জেলা-ময়মনসিংহ

 

শহীদ ডা. রাখাল চন্দ্ৰ দাস

 

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ মির্জাপুর ইস্পাহানী চা বাগান, ইউনিয়ন/ডাকঘর-মির্জাপুর, উপজেলা-শ্রীমঙ্গল, জেলা-মৌলভীবাজার

জন্মঃ ১লা আগস্ট, ১৯৩২

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ দ্বিতীয় বিভাগ, ১৯৪৯, দরিরামপুর ইংলিশ হাই স্কুল, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

আইএসসিঃ দ্বিতীয় বিভাগ, ১৯৫২, আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ

এলএমএফঃ ১৯৫৫, লিটন মেডিকেল স্কুল, ময়মনসিংহ

এমবিবিএসঃ ১৯৬৮, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কারঃ প্রথম পুরস্কার; স্কুলজীবনের ক্লাসের সব পরীক্ষায়

শখঃ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, নাটক-আয়োজন-অভিনয়ঃ স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার দিবসে নাটকে অনেক পুরস্কার বিজেতা। খেলাধুলা-ফুটবল ও ক্রিকেটঃ স্কুলের সেরা ফুটবলার। ধানীখোলা মিলন সমাজ ও মিলন সমিতি প্রতিষ্ঠা। সাধারণ সম্পাদক, মিলন সমিতি

লেখালেখিঃ বিভিন্ন মেডিকেল জার্নাল যেমন-ইপিএমের জার্নালে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত। অসমাপ্ত আত্মজীবনী রচনা

সমাজসেবাঃ রেডক্রস, স্কাউটিং এবং সর্বশেষে মেডিকেল অফিসার হিসেবে লায়ন্স ক্লাবের সদস্য। ধানীখোলা বাজারে ‘গুরুদয়াল ফার্মেসি’ থেকে গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান

চাকরির বর্ণনাঃ

সহকারী সার্জনঃ মহারাজ সূর্যকান্ত হাসপাতাল, ময়মনসিংহ, ১৯৫৫-৫৬

মেডিকেল অফিসারঃ দিলদারপুর চা বাগান হাসপাতাল, কুলাউড়া, সিলেট, ১৯৫৭-৫৯

মেডিকেল অফিসারঃ ধানীখোলা দাতব্য হাসপাতাল, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ, ১৯৫৯-১৯৬৬

প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারঃ ধানীখোলা বাজারে নিজস্ব গুরুদয়াল ফার্মেসি, ১৯৬৮-৬৯

মেডিকেল অফিসারঃ মির্জাপুর চা বাগান হাসপাতাল, শ্রীমঙ্গল, ১৯৬৯-১৯৭১ আমৃত্যু

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ রাজাকার গাজী চেয়ারম্যানের দেয়া লিস্ট অনুযায়ী পাকবাহিনী। নামঃ ক্যাপ্টেন তারেক

নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ১২ মে, ১৯৭১

মরদেহঃ পাওয়া যায়নি

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে ‘আর. সি. দাস’ নামাঙ্কিত আছে।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২০০০ টাকার চেক

স্ত্রীর নামঃ লাবণ্য প্রভা দাস

বিয়েঃ ৬ ফাল্গুন, ১৩৫৯ বাং (১৯৫৩ সাল)

সন্তান-সন্ততিঃ পাঁচজনঃ পুত্ৰ-তিনজন; কন্যা-দু’জন

দিপালী রানী দাসঃ এসএসসি, ভারতে স্বামীর সংসারে গৃহিণী

প্রদীপ কুমার দাসঃ এসএসসি, সরকারি চাকরি (সিজিএ অফিসে)

প্রমোদ দাসঃ এসএসসি, সরকারি চাকরি (রেলওয়ে)

বাদল চন্দ্ৰ দাসঃ নবম শ্রেণী, ল্যান্স নায়েক (অব.)(সেনাবাহিনী)

মিতালী রানী দাস লিপিঃ এইচএসসি, হোমিও ডাক্তার, ঠাকুরকোনা নেত্রকোনা

 

 

তথ্য প্রদানকারী

প্রদীপ কুমার দাস

শহীদ চিকিৎসকের প্রথম পুত্র

৩নং নীলাচল আবাসিক এলাকা, মেডিকেল

কলেজ রোড, চরপাড়া, ময়মনসিংহ

অফিসঃ উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস,

মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ      ৩১১

 

আমার বাবা

শহীদ ডা. রাখাল চন্দ্ৰ দাস

প্রদীপ কুমার দাস

 

আমার বাবা ডা. রাখাল চন্দ্র দাস ছিলেন একজন সহজ-সরল অতি সাধারণ মানুষ, যার মধ্যে ছিল নিরহঙ্কার মন এবং ছিল দেশপ্রেম। তাঁর দেশপ্রেমের সাক্ষাৎ মেলে গ্রামে থেকে যাওয়ার ইচ্ছায় এবং কোনো অবস্থাতেই দেশ ত্যাগ না করায়তাই ১৯৭১-এ পাক হানাদার বাহিনী যখন স্বাধিকার আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার জন্য এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা যজ্ঞোৎসবে মেতেছিল, তখনও আমার বাবা এই মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি।

তিনি ছিলেন গ্রামের ছেলে। আমাদের গ্রামের নাম ধানীখোলা। এই ধানীখোলাতেই ১৯৩২ সালের ১ আগস্ট বাবার জন্ম। আমার বাবাকে পিতামহ শৈশবে লেখাপড়া করাতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলেও তাঁর মতো একজন কৃষক হবেবাবার বয়স যখন পাঁচ, তখন থেকেই তাকে বাড়ির ও পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথে গরুর পাল নিয়ে মাঠে যেতে হতোএভাবে কিছুদিন যাওয়ার পরই বাবা বুঝলেন, এই কাজ তাঁর নয়। তাঁর মন ছুটে যেতে পাঠশালায়এ সময় পাশের বাড়ির আলীমউদ্দীন মাস্টারের কথায় ঠাকুরদা রাজি হয়ে বাবাকে ভর্তি করে দিলেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিশু শ্রেণীতে।

প্রাইমারি স্কুলের লেখাপড়া শেষ করার পর ইংলিশ হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় আবার বাদ সাধলেন তাঁর বাবা। অবশেষে বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ভর্তি হলেন দরিরামপুর এইচ ই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে। এই স্কুলেই কবি নজরুল ইসলাম লেখাপড়া করেছিলেন কিছুদিন। আমাদের বাড়ি থেকে তিন মাইল দক্ষিণে ত্রিশাল থানা সংলগ্ন এই স্কুলে যেতেন প্রতিদিন প্রায় ছয় মাইল পায়ে হেটে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য গ্রামের অনেক দুষ্ট ছেলে বাবাকে ভূতের ভয় দেখিয়েও নিরস্ত করতে পারেনি। বাবা কুসংস্কারে বিশ্বাস করেননি কোনোদিন, আমাদেরও না করার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। বাবা মোটামুটি ভালো ছাত্র ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসারে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন।

 

 

৩১২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. রাখাল চন্দ্ৰ দাস

 

আমার বাবাআমার পিতামহের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না বলে তিনি বাবাকে আর লেখাপড়া করাবেন না বলেই স্থির করলেন। কিন্তু শত কষ্টের মধ্যেও বাবা একদিন আনন্দমোহন কলেজে আই.এস.সিতে ভর্তি হলেন। বাবার মধ্যে সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে দুর্দমনীয় বাসনা ছিল, তার প্রমাণ মেলে তাঁর প্রতিটি কাজে। তিনি যে ইচ্ছা একবার পোষণ করেছেন তার বাস্তবায়নে পিছপা হননি কখনো।

সামান্য বৃত্তির টাকার ওপর ভরসা করেই কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল হোস্টেলে থাকার খরচ যোগাতেবড় উচ্চাকাঙ্ক্ষার সামনে কোনো সমস্যাই সমস্যা রইল না। লজিং, মেস ও হোস্টেলে থেকেই পার করলেন কলেজ জীবন। আমার পিতামহ বাধ্য হলেন জমি বিক্রি করতে।

১৯৫২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাস করে ময়মনসিংহ লিটন মেডিকেল স্কুলে থেকে এলএমএফ ডাক্তারি কোর্স পাস করলেন ১৯৫৫ সালে। এরই মধ্যে ঘটে গেছে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা অংশ নিলে হোস্টেল ছাড়তে বাধ্য হন। এল.এম.এফ পড়াকালে ১৯৫৩ সালে লাবণ্যপ্রভা দাসকে বিয়ে করেন। আমার মা-ও একজন সহজ-সরল সাধারণ মেয়েমা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। তাতেই তিনি বাবাকে বুঝে নিতেন; পরস্পরের সাথে সদাই ভালো। সমঝোতা ছিলবাবা নিজে গরিব ঘরের ছেলে হলেও কার্পণ্য করতেন না কোনোদিন কোনো কিছুতেঅকাতরে দান করতেন গরিব-দুঃখীকে, পাড়া-পড়শিকে এবং গরিব আত্মীয়-স্বজনকে। মা কোনো সময়ও বাবার কাছে কোনো অপ্রয়োজনীয় গয়না বা অন্য কিছুর জন্য আবদার করতেন না বা বায়না ধরতেন না। কারণ মা জানতেন যে, বাবাকে দিয়ে গয়না বানানো যাবে না। বাবা নিজে চলতেন খুব সাদাসিধেভাবে, তেমনি মাকেও সেভাবে চলতে বলতেন বা চালাতেন। মা বলতেন, মেয়ে বড় হবে, বিয়ে দিতে হবে, তার জন্য আগে থেকে গয়নাগাঁটি বা অন্য জিনিস বানিয়ে রাখলে ভালো হয়; কিন্তু বাবা তাঁর জবাবে বলতেন, যখন বড় হবে, তখন দেখা যাবে।

বাবা এল.এম.এফ পাস করে কিছুদিন ময়মনসিংহ সূর্যকান্ত হাসপাতালে ডাক্তারি করেছেনসময়টা ১৯৫৫-৫৬ সাল। তারপর তিনি চলে গেলেন সিলেট জেলার কুলাউড়া থানার অদূরে এক নির্জন পাহাড়ি এলাকা দিলদারপুর চা বাগানের ডাক্তার হয়ে। সেখানে অনধিক দুই বছর চাকরি করেছেন। কিন্তু সেখানে আত্মীয়-স্বজন না থাকলেও খুব একটা নিঃসঙ্গ বোধ করতেন না। বাগানের ম্যানেজার ও বড়বাবুর পরিবার সর্বদাই সঙ্গ দিতেন। তা সত্ত্বেও বাবার মন পড়ে থাকতো নিজ গ্রামের দিকে। তাই ১৯৫৯ সালের দিকে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের ডাক্তার নিযুক্ত হয়ে চলে এলেন নিজ গ্রাম ধানীখোলা দাতব্য চিকিৎসালয়ে। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ছোট হাসপাতালের ঘরটিকে বড় করে সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও অনুদানসাপেক্ষে পরিবার পরিকল্পনা ইউনিটও খুলেছিলেন। নিজ গ্রামে থেকে চিকিৎসা করতে লাগলেন এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত জনসাধারণের। আগেই একটা ওষুধের দোকান করেছিলেন ধানীখোলা বাজারে। এবার বাবা নিজেও দোকানে বসতেন। কিন্তু দোকানে বসে বাবা ব্যবসায় লোকসান দিতে থাকেন। তার কারণ নিজ গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রাম, এমনকি পার্শ্ববর্তী থানার গরিব লোকজনও আসতো চিকিৎসার আশায়। বাবা রোগীদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করতেনধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব রোগী। তবে বাবার রোগীরা প্রায় সবই ছিল গরিব। ধনী রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট নিতেন, মধ্যবিত্ত রোগীদের থেকে নিতেন খুব অল্প, আর গরিব রোগীদের কাছ থেকে কোনো ভিজিট নিতেন না। বরং ওষুধ কেনার পয়সা না থাকলে নিজ দোকান গুরুদয়াল ফার্মেসি থেকেই ওষুধ দিয়ে দিতেনপরে রােগীরা কখনো সেই পয়সা দিতে এলে বলতেন, ‘আর পয়সা দিতে হবে না, তোমরা গরিব মানুষ, পয়সা দিবে কী, এই পয়সা দিয়ে পথ্য কিনে খেও।’ এই কথাটা এখনো স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে গ্রামের গরিব জনসাধারণের মুখে শোনা যায়।

বাবার বড় দুই বোন ছিলেন। বাবাই সবার ছোট। প্রথম বড় বোনের দুই ছেলে ও চার মেয়ে ছিল। তাদের অবস্থাও খুব ভালো ছিল না। তাই বড় ভগ্নিপতি ছোট মেয়েকে কোলে রেখে মারা গেলে, বাবা বড় ভাগ্নে ব্রজেন্দ্র ও আরেক ভগ্নিকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। দ্বিতীয় বোনের চার ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। তাদের মধ্যে বড় ছিল চিত্তরঞ্জন। বাবা তার এই ভাগ্নেকে খুবই আদর করতেন। নিজে তার লেখাপড়ায় প্রেরণা দিতেন

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ      ৩১৩

 

শহীদ ডা. রাখাল চন্দ্ৰ দাস

 

এবং আই এস সি পাস করার পরে ডাক্তারি পড়ার জন্য বললেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে তার ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। ভাগ্নে চিত্তরঞ্জনের অনুরোধে নিজেকেও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হতে হয় ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৮ সালে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসে আবার গ্রামে চিকিৎসা শুরু করেন। গুরুদয়াল ফার্মেসিকে একটা ছোট হাসপাতালে রূপান্তরিত করার চিন্তাভাবনা ছিল বাবার। অবশেষে ১৯৬৯ সালের জুন মাসে সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার মির্জাপুর ইস্পাহানীর চা বাগানে ডাক্তার হলেন আবারও। এখানেই তিনি ছিলেন জীবনের শেষ পর্যন্ত।

আমার বাবা ডা. রাখাল চন্দ্র ছিলেন একজন সংস্কৃতিসেবী। ক্রীড়াবিদ হিসেবেও বেশ নামডাক আছে। বাবা যখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন তখন থেকেই ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলতেন। প্রাইমারি স্কুলে তাঁকে ছাড়া ফুটবল টিম অচল ছিল। হাইস্কুলে ওঠে নিয়মিত ফুটবল চর্চা করতেন এবং একজন প্রথম শ্রেণীর খেলোয়াড় ছিলেন।

কলেজে উঠেও ফুটবল এবং ক্রিকেট সমানভাবেই চালিয়ে গেছেন। এজন্য তাঁকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি দরিরামপুর হাইস্কুলের শিক্ষকবৃন্দও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন।

১৯৩৯ সালে বাবা যখন প্রথম শ্রেণীর ছাত্র তখনই তিনি জীবনের প্রথম নাটক ‘আজব বিচার’-এ অভিনয় করেন। প্রতিটি শ্রেণীতেই নাটকে অংশ নেয়া ছিল স্কুলের প্রতিবার বাৎসরিক পুরস্কার দিবসের অঙ্গ। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র থাকতেই বহু বই পুরস্কার পেয়েছিলেন। হাইস্কুলের ছাত্র হয়ে তাঁর সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির সংখ্যা বেড়ে যায়। এভাবে কলেজ জীবনে এমনকি কর্মজীবনেও তিনি নাটক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। তিনি গ্রামে একটা ক্লাব গড়েছিলেন নিজস্ব উদ্যোগে বন্ধুদের সাহায্যে। ‘ধানীখোলা মুকুল সমিতি’ ছিল বাবার একান্ত প্রচেষ্টার ফল। প্রথমে বাবা ধানীখোলা মিলন সমাজের সদস্য ছিলেন এবং এর ফুটবল টিমের একজন সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। পরে মুকুল সমিতি গঠন করে সমিতিকে একটা আদর্শ ক্লাবরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

 

 

৩১৪       মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. রাখাল চন্দ্ৰ দাস

 

বাবা ছিলেন নির্ভীক, অকুতোভয় ও সত্যবাদিতার মূর্ত প্রতীক। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আপোস করেননি কোনো মিথ্যাচারিতার সাথে। কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন চিরদিন। চা বাগানে অফিস স্টাফদের সাথে যেমন ভালো ব্যবহার করতেন, তেমনি বাগানের কুলি-মালিনীদের সাথেও আন্তরিক ব্যবহার করেছেন। বাগানের কুলিদের অসুখ-বিসুখে তিনি ব্যথিত হতেন, তাদের চিকিৎসায় ও সেবাযত্নে উঠেপড়ে লাগতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও গ্রামের গরিব আত্মীয়-স্বজনের কথা ভুলে যাননি।

অবশেষে এলো ‘৭১-র কালরাত। মার্চ মাসেই সিলেট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পাক হানাদার বাহিনী অবস্থান নেয়। এদিকে লোকজন হানাদারদের ভয়ে ভীতসস্ত্রস্ত হয়ে দলে দলে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। বাগানের স্টাফদের অনেকেই চলে গেলেন। তাঁরা যাওয়ার সময়ে বাবাকে চলে যেতে বললেন। কিন্তু বাবা বাগানের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন না। বাগানের বড় বাবু রবীন্দ্র দাশ পুরকায়স্থও বাবাকে অনুরোধ করলেন যে ‘আগে প্রাণ বাঁচান, পরে অন্যদের বাঁচাবেন বা তাদের কথা চিন্তা করবেন।’ কিন্তু বাবা তাঁর কথাও শোনেননি। এমনকি সহকারী ম্যানেজার এ. আহমেদ পর্যন্ত স্টাফদের নিরাপদ স্থানে গিয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য নিজের ব্যবহৃত গাড়িটিও দিলেন। অনেকেই গেলেন কিন্তু বাবা তাঁর সন্তানতুল্য কুলি-কামিনীদের ছেড়ে গেলেন না। তাঁর তত্ত্বাবধানে মির্জাপুর চা-বাগান হাসপাতাল ছাড়াও একই কোম্পানির পার্শ্ববর্তী বৌলাছড়া চা বাগানের হাসপাতালও ছিল। আমি তখন ছোট। আমাদের পরিবারের সবাই তখন বাগানের বাসায়। আমিও সবার সঙ্গে চলে যেতে আবদার করেছিলাম, কিন্তু বাবার মন নরম করতে পারিনি।

দেখতে দেখতে মার্চ মাস কেটে গেল। এপ্রিল মাসেই পাক হানাদার বাহিনী শ্রীমঙ্গলে ঘাঁটি করলা; শুরু হলো বাঙালি নিধন। হানাদারদের অত্যাচারে যার যা কিছু আছে তা নিয়েই বাধা দিতে লাগলোবাগানে বা পাশের গ্রামে সবাই তীর-ধনুক বানালো ঘরে ঘরে, জনে জনে বাবা ও ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার ফণি বাবুও তীর-ধনুক বানিয়ে ঘরে রাখলেন। আমরা ছোটরাও তীর চালানো শিখে ফেললাম ক’দিনেইপাহাড়ি জায়গায় টিলা কেটে রাস্তা করা হয়েছে সে এলাকায়। প্রথমে রাস্তায় বড় বড় পাথর ফেলে পাক হানাদারদের বাধা দেয়া হয়। পাহাড়ি ছোট নদীর উপর পুল ভেঙে দেয়া হয়। সাহসী লোকজন জঙ্গলের আড়াল থেকে তাঁর ছুড়ে তাদের আহত করতো ও প্রতিরোধ করতোসন্ধ্যা নামার সাথে সাথে এ দেশের হতভাগ্য আঘাতপ্রাপ্ত লোকজন গোপনে আমাদের বাসায় আসতোবাবা তাদের চিকিৎসা করতেন, ওষুধ দিতেন। বাগানে বাবা এমনিতেই কোনো রোগীর কাছ থেকে টাকাপয়সা নিতেন না। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পয়সা নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না! আহতদের সেবায় বাবা নিজেকে সারাক্ষণ ব্যাপৃত রাখতেন। হাসপাতাল ছেড়ে, রোগীদের ছেড়ে, আহতদের ছেড়ে, সর্বোপরি দেশকে তিনি ছাড়তে পারেননি। নিজের প্রাণ দিয়েও তিনি দেশকে-মাতৃভূমিকে ছাড়লেন না। সেদিন অর্থাৎ ১২ মে, ১৯৭১-এ সকালবেলায় বৌলাছড়া হাসপাতালে রোগী দেখে গেলেন। এর আগের দিন রাতে মাথায় গুলিবিদ্ধ একজনের গুলি বের করে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে এসেছিলেন। তাকে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় হানা দিয়ে কিছু লোককে মেরে ও কিছু লোককে ধরে নিয়ে গেছে। সেই কথাই বলাবলি হচ্ছিল। সবাই ভয়ে পালাচ্ছিল। রোগীরাও ভয় পাচ্ছিলবাবা তাদের সেদিন অভয় দিচ্ছিলেন। কিন্তু নিজে তিনি পালানোর কোনো চেষ্টাই করেননি। হঠাৎ সেদিন ধূমকেতুর মতো এসে পাক হানাদার বাহিনী হাসপাতালের চারদিক ঘিরে ফেলে এবং অতর্কিত আক্রমণ চালায়। বাবা তখন যন্ত্ৰণাকাতর এক রোগীর শিয়রে বসে তার সেবায় ব্যস্তহাসপাতালে ঢুকে হানাদার বাবাকেই প্রথম পেয়ে ধরে নিয়ে গেল। সেই যে নিয়ে গেল, বাবা আর ফিরে এলেন না। বাবার সব গুণের মধ্যে একটিমাত্র দোষই ছিল এবং তা হলো, তাঁর একগুঁয়েমিএই একগুঁয়েমির কারণেই দেশত্যাগ করলেন না। কিন্তু প্রাণত্যাগ করলেন।

 

(*রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১ থেকে সঙ্কলিত)

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ      ৩১৫

 

শহীদ ডা. রাখাল চন্দ্ৰ দাস

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।

খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে (তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭ ।

ঘ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১ম খণ্ড, ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ডিসেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ১১০।

ঙ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৯০ ।

চ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ অগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ৮৫

ছ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৪৩ ।

জ. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস; সম্পাদনাঃ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ; প্রথম খন্ড।

 

৩১৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!