আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত বিদেশী চরদের হুঁশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে, তাদের সমস্ত অপচেষ্টা বাংলাদেশের বীর জনগণ নস্যাৎ করে দেবে
গত রোববার ২৩ শে নবেম্বর ‘৭৫ গভীর রাতে সেনাবাহিনীর প্রধান ও উপ – প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বেতার ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী দালালদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী চক্রান্ত ও বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। একই সঙ্গে তিনি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে দেশের আপামর জনগণের সঙ্গে সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের সম্পূর্ণ একাত্মতার কথা ঘোষণা করেন।
নিম্নে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ দেয়া হল –
প্রিয় দেশবাসী!
আসসালামো আলায়কুম।
গত ৭ ই ও ১১ ই নবেম্বর বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিলাম। তখন থেকে আমি গর্বের সাথে লক্ষ্য করছি, জনসাধারণ কিভাবে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। তারা স্বতস্ফুর্ত ভাবে সামরিক আইন প্রশাসনের সাথে সহযোগীতা করছে।
একই ঘটনা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিছু লোক বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় নিয়োজিত হয়েছে। এই সমস্ত ব্যক্তি তাদের হীন স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে এখনো সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের নাম ব্যবহার করে চলেছে।
আমার প্রিয় দেশবাসী। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে আমাদের নীতি পুনরায় ঘোষণা করছি। আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক। সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনে আমাদের প্রশাসনকে দৃঢ ও কার্যকরী রাখতে আমরা প্রতিজ্ঞা বদ্ধ। আমাদের এই উদ্দেশ্য হাসিলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন যে কোন হস্তক্ষেপ – তা যে মহল থেকেই আসুক না কেন, আমরা তা বরদাস্ত করবো না। আমাদের এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরী করতে আমরা বদ্ধ পরিকর। এই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মৌলিক প্রয়োজন দেশ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। বেআইনী অস্ত্রধারীরাই এই শান্তি ও শৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় শত্রু। প্রতিটি শান্তিকামী নাগরিকের কাছে আমাদের আবেদন, তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানে আপনারা সহযোগিতা করুন।
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে আমাদের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন, আমরা আমাদের সকল বন্ধুদের আশ্বাস দিচ্ছি, তাদের সঙ্গে আমাদের বর্তমান সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাব।
আমি পুনরায় ঘোষণা করছি, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয় – এই নীতি আমরা অনুসরণ করে চলবো।
গত কয়েক মাস আমাদের জনগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সামরিক বাহিনী ও সামরিক আইন প্রশাসনের প্রতি আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
আমাদের দেশপ্রেমিক জনগণ ভাল করেই জানেন, কারা দেশের বন্ধু এবং কারা দেশের শত্রু৷ কারা দেশের স্বার্থে এবং কারা দেশের স্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত। এ সম্পর্কেও আমাদের জনগণ সজাগ রয়েছেন। জনসাধারণের কাছে আমার আবেদন, যারা হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত এবং যে সমস্ত বহিঃশক্তি আমাদের ধ্বংস করার অপচেষ্টায় নিয়োজিত তাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।
আমাদের অঙ্গীকার পালনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা অনেক রাজবন্দীদের মুক্তি দিয়েছি এবং আরো অনেকে পর্যায় ক্রমে মুক্তি পাবে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় কোন কোন মহল আমাদের এই সদিচ্ছাকে দূর্বলতা বলে ধরে নিয়েছেন এবং আমাদের সদিচ্ছাকে নস্যাৎ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টাকে বানচালের জন্য তারা তাদের উদ্দেশ্য প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোন কোন মহল তাদের অতীত হীন কার্যকলাপের কথা ভুলে গিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব – বিরোধী চক্রের সঙ্গে হাত মেলানোর চেষ্টায় লিপ্ত। বহিঃশক্তির সহায়তায় এই মহল পুনরায় তৎপর হওয়ার সুস্পষ্ট আভাস দিয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী! এরা কারা আমাদের তা বলে দিতে হবে না। আপনারা তা জানেন। আপনারা জানেন, তারা কি করতে চায় এবং তাদের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে আসে। জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধনের জন্যই তারা তৎপর। আমরা দেশে আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে দেব না। আর রক্তপাত সহ্য করবো না। এরা হচ্ছে রাষ্ট্র বিরোধী চক্র। এদের পেছনে জনসমর্থন কতটুকু তা সবার জানা আছে। আপনারা জানেন, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা সামরিক বাহিনীর নাম পর্যন্ত ব্যবহার করছে। আমরা তাদের পরিষ্কার ভাষায় বলে দিতে চাই, আমাদের সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ ভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং জনগণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের সামরিক বাহিনী রাজনীতির উর্ধ্বে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা রক্ষাই এদের একমাত্র লক্ষ্য। যারা দেশের স্বার্থ বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত তাতের সম্মন্ধেও সামরিক বাহিনী সজাগ। দেশের প্রশাসন ব্যবস্থায় যারা জড়িত, তাদের প্রতি আমাদের উপদেশ, আপনারা নির্ভয়ে এবং দৃঢতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। কোন মহলের হস্তক্ষেপ আপনারা বরদাস্ত করবেন না। জনগণ আপনাদের সঙ্গে। দেশের স্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে আপনারা জনগণের সাথে সহায়তা করুন। এই সব ব্যক্তিদের কঠোর হস্তে দমন করুন। দেশ প্রেমিক নাগরিকদের সহায়তায় বেআইনী অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আপনাদের জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে৷ উদ্ধেশ্যমূলক ভাবে গুজব রটিয়ে এবং প্রচার পত্র ছড়িয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের প্রচেষ্টাকে বানচাল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের জনগণ এদের পরিচয় সন্মন্ধে যথেষ্ট সচেতন। আপনারা একতা বদ্ধ থাকুন। ইনশাআল্লাহ স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। পরিশেষে, আমি আপনাদের জোর দিয়ে বলতে চাই যে, সামরিক বাহিনী ও জনগণ এবং প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে সম্পূর্ণ একাত্মতা বজায় আছে। আমরা যদি একতাবদ্ধ থাকি তাহলে কোন বিদেশী শক্তি বা প্রভাব আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটা জাতি এবং আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে প্রতিটি নাগরিকই আমাদের সৈনিক। আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত বিদেশী চরদের হুঁশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে – তাদের সমস্ত অপচেষ্টা বাংলাদেশের বীর জনগণ নস্যাৎ করে দেবে। আমাদের মাটিতে মীর জাফরের কোন স্থান নেই। সামরিক বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ আনসার এবং মুক্তিযোদ্ধা সহ সকল দেশ প্রেমিক নাগরিকদের প্রতি আমাদের আহ্বান, মীর জাফর এবং বিদেশী দালালদের খুঁজে বের করুন। এবং উপযুক্ত শাস্তি প্রদানে সক্রিয় সহযোগিতা করুন। আল্লাহ আমাদের সহায়৷ খোদা হাফেজ।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
***
জাতীয় ঐক্য
– বিচিত্রা ভাষ্যকার
বাংলাদেশের সাহসী মানুষ এখন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের চূড়ান্ত সংগ্রামে লিপ্ত। কারও আধিপত্য যে মানবে না, কারও দাপট সহ্য করবে না, মাথা নোয়াবে না কারও শাসানিতে৷ স্বাধীন ভাবে বাঁচার এবং নিজের ভাগ্য গড়ে তোলার আকাঙ্খা এখন দশ দিকে স্বার্থহীন লক্ষ কোটি কন্ঠে উচ্চারিত।
১৫ ই আগস্ট থেকে শুরু করে ৭ ই নবেম্বর – এই নিতান্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ অতিক্রম করে এসেছে ইতিহাসের দীর্ঘ দীর্ঘ পথ। বাংলাদেশে ইতিহাস দ্রুত বদলায়, জনগণের ইচ্ছাগুলি অজ্ঞাত ভাবে জয়ী হয়ে ওঠে, শত্রু – মিত্র নির্ভুলভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। সময়ের এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক সচেতনতার যে পরিচয় দিয়েছে, তা তুলনাহীন। এ দেশের মানুষ কখনও ভুল করে না – আগস্টের এবং নবেম্বরের প্রবহমান ঘটনাস্রোত তা নতুনভাবে প্রমাণিত করেছে।
সাতই নবেম্বর রাজধানীর পথে পথে আমরা দেখেছি, স্বাধীনতা – রক্ষাকামী মানুষের অটল ইচ্ছার বিদ্যুৎ চমক, পথে পথে শুনেছি শপথের দীপ্ত উচ্চারণ, সর্বস্তরের সকল মানুষের দূর্বার ঐক্যের ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে স্বধীনতা সংরক্ষণের অনমনীয় আকাঙ্খা।
৭ ই নবেম্বর দেশের বীর সশস্ত্র বাহিনী, বিডিআর পুলিশ, আনসার ও জনসাধারণ চূর্ণ করে দিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্ত। ইতিহাসের কাঁটা যারা উল্টো দিকে ঘোরাতে চেয়েছিল, তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।
শ্যামল, সমতল এই স্নিগ্ধ জনপদের মানুষ শত শত বছর ধরে স্বাধীনতা অর্জন ও সংরক্ষণের জন্য সংগ্রাম চালিয়েছেন। রক্তাক্ততার সেই সংগ্রামের পথ। চরম মূল্যে সে কিনেছে অভিজ্ঞতা। কখনও এসেছে সাময়িক পরাজয় কিন্তু এ দেশের মানুষ কখনও বিজিত হয় নি। কখনও পিছু হঠে নি লড়াইয়ের অঙ্গন থেকে। পতন অভ্যুদয়ে বন্ধুর পথ ধরে মানুষের মিছিল এগিয়ে চলেছে কেবলই সামনের দিকে, স্বাধীনতার পরম তীর্থের দিকে। আজ সে তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের অনমনীয় সংগ্রামে নিয়োজিত।
এই দুঃখী, বঞ্চিত জনপদের পরিশ্রমী ও সাহসী মানুষগুলির লড়াই সরলরেখা ধরে এগোয়নি, নানা দিকে মোড় নিয়েও সে অভ্রান্ত ভাবে এগিয়ে গেছে তার লক্ষ্যের দিকে – ইতিহাসের এক এক অধ্যায়ে এক এক রূপ নিয়েছে তার লড়াই। কিন্তু অপরিবর্তিত থেকেছে বাঙালী জাতির আকাঙ্ক্ষা – নিজেরাই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা হবো। কারো আধিপত্য সহ্য করব না। মানুষের জাতিসত্তা গঠন, নিয়ন্ত্রণ করে তার ভূগোল, তার ভাষা, তার অর্থনীতি এবং তার মানসিক প্রকৃতি। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কালীন রাজনৈতিক ভাবনা বিকাশের পটভূমিতে বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় সত্ত্বা অর্জনের সংগ্রাম পেয়েছে বিভিন্ন রূপ। কখনও তার মানসিক প্রকৃতি বা ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য এসেছে সামনে, কখনও বা ভাষাগত বৈশিষ্ট্য তার লড়াইয়ের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু সংগ্রামের সকল অধ্যায়ে অপরিবর্তিত থেকেছে তার লক্ষ্য – এই ভূগোল, এই অর্থনীতি, এই ভাষা এবং তার মানসিক প্রকৃতি নিয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্খা লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য হিসাবে কাজ করে গেছে তার রাজনৈতিক সচেতনতার পেছনে।
বাংলাদেশ নামক জনপদ শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত হয়েছে কাঁচামাল বা প্রাথমিক পণ্য লুন্ঠনের উন্মুক্ত ক্ষেত্র হিসাবে। তারা জুগিয়েছে সোনালী আঁশ, যার আভায় উজ্জ্বল হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, কলকাতা, করাচী। নিজে অভুক্ত থেকে এ দেশের মানুষ যোগান দিয়েছে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সব্জি, ডিম – কল্পনা করা যায় এমন সব কৃষিপণ্য। কিন্তু উন্নয়নের সামান্য তম স্পর্শ লাগেনি এই জনপদে। ১৯৪৭ সালের আগে এই অঞ্চলে শিল্পের সংখ্যা এক আঙুলে গোণা সম্ভব ছিল। ১৯৪৭ সালের পরে শিল্পের কিছুটা বিকাশ ঘটলেও এ দেশের মানুষের সৃষ্ট সম্পদ বিনিয়োজিত হয় নি পরিপূর্ণ মাত্রায়। সম্পদ কুক্ষিগত করেছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, সম্পদ অর্থে রূপান্তরিত হয়ে চলে গেছে দেশের বাইরে।
১৯৭১ এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এ দেশের দুঃখী মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আশা করেছে, তার সৃষ্ট সম্পদ এবার পরিপূর্ণ ভাবে তার কল্যাণে নিয়োজিত হবে। কিন্তু পাচার আর লুন্ঠনের পথ আবার উন্মুক্ত হয়েছে নতুন করে। চোরাচালান, মূদ্রার ফটকাবাজি, পাট নিয়ে কারসাজি, মাছ মাংস মুরগী তুলে নিয়ে যাওয়ার বাঁকা বানিজ্য নীতি এদেশকে আবার নিঃস্ব, নিরক্ত করে দিয়েছে৷ দুর্ভিক্ষ এই জনপদকে আবার কিছু প্রাণশূন্য করেছে, বস্ত্র সংকট আবার ধুলো পথে লুটিয়ে দিয়েছে নারীর লজ্জা। দুধের অভাবে ককিয়ে মরেছে এ দেশের শিশু, সোনার মানুষ বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থেকেছে পথে পথে। দুর্নীতিপরায়ণ ফড়িয়াগ্রস্থ আর তাদের বিদেশী দোসররা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভ্যুদয়কে মিথ্যা করে দিতে চেয়েছে – চেপে রাখতে প্রয়াস পেয়েছে স্বাধীন জাতি রূপে আমাদের স্বতন্ত্র বিকাশের আকাঙ্ক্ষা।
এই পটভূমিতেই জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলাদেশের ইতিহাস তার আপন পথ করে নিয়েছে ১৫ ই আগস্ট থেকে ৭ ই নবেম্বরের ঘটনা প্রবাহ অনুসরণ করে। বাঙালী জাতির স্বাধীন চেতনার বিদ্যুৎ চমক উদ্ভাসিত করে তুলেছে ইতিহাসের পৃষ্ঠা। ১৫ ই আগস্টে পট পরিবর্তনের ভেতরে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বলতে চেয়েছে, কারও আধিপত্য সে মানতে রাজী নয়, আপন সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জগৎ সভায় সে সক্রিয় জোট – নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণে সংকল্পবদ্ধ। আমাদের দেশ ছোট কিন্তু জাতি বড়, অভিভাবকের প্রয়োজন আমাদের নেই।
গত ৩ রা নবেম্বর দেশী বিদেশী চক্রান্তের মাধ্যমে ইতিহাসের কাটা ঘুরিয়ে দেয়ার হীন অপপ্রয়াস, ৭ ই নবেম্বর আবার বাঙালী জাতির উথ্বান তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের ইস্পাত কঠিন সংকল্পকে ঝকঝকে তলোয়ারের মত সবার সামনে তুলে ধরেছে। ৭ ই নবেম্বরে অর্জিত জনগণের সুবিশাল দূর্ভেদ্য ঐক্য, বিদেশী চক্রান্তের বিরুদ্ধে তার উচ্চারিত ধিক্কার, দেশীয় প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে তার শপথ এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে বাংলাদেশ কি চায়। এ প্রশ্নে দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়ার মনে যেন কোন সংশয় না থাকে। জনমনের এই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এই অবিচল ঐক্য যে কোন জাতির জন্য এক বিরাট রাজনৈতিক সম্পদ।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বপক্ষে জনতার কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে দ্ব্যর্থহীন শপথ৷ রায় উচ্চারিত হয়েছে সম্প্রসারণবাদ, আধিপত্যবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।
১৫ ই আগস্ট থেকে ৭ ই নবেম্বর এই সময়ের মধ্যে বাঙালী জনগণের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম উপনীত হয়েছে গুণগত ভাবে এক নতুন স্তরে৷ চক্রান্তকারীদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত, আমাদের স্বাধীনতার প্রতি বিপদের উৎসগুলিও জনগণের জানা। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নিরাপদ করে তোলার বর্তমান পর্যায়ের লড়াইয়ে তাই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে – অর্জিত ঐক্যকে সংহত ও সংগঠিত করে তুলতে হবে।
এই মুহূর্তে জনগণের মধ্যে চাই সজাগ, সচেতন, সক্রিয় ঐক্যবোধ। সর্বস্তরের মানুষকে মূলগত প্রশ্নে এককাটা থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে বিরোধ বিসম্বাদের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। স্বাধীনতার সপক্ষে আমরা যত ঐক্য বদ্ধ হব, অনমনীয় হব, চক্রান্তকারী দের তৎপরতাও তত কুট পথ ধরে অগ্রসর হবে। জনগণের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টিই হবে তাদের লক্ষ্য। সচেতন থেকে তাদের কুট কৌশল সব ব্যর্থ করে দিতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের দ্বন্দ যখন প্রধান হয়ে ওঠে আভ্যন্তরীণ পর্যায়ের সমস্যাকে তখন গৌণ বলেই গণ্য করতে হয়। গৌণ গণ্য করার অর্থ এই নয় যে সমস্যাকে ফেলে রাখা – বরং সম্প্রীতির পরিবেশে তার সুষ্ঠ সমাধানই জাতীয় দায়িত্ব হয়ে দাড়ায়।
মনে রাখতে হবে, প্রতিক্রিয়ার চক্রান্ত সরল রেখা ধরে অগ্রসর হয় না। যে সব পেশাদার লোক জনসভা ভন্ডুল করে তারা জনসভার পতাকা ধরেই সভায় যায়। জনগণের আন্দোলনকে যারা বানচাল করতে চায় তারা মুখে একই স্লোগান নিয়েই অনেক সময় নামে জনগণের কাফেলায়। স্বাধীনতার পতাকা হাতে নিয়ে স্বাধীনতার বিরোধিতা করার দৃষ্টান্ত সম – সাময়িক ইতিহাসে বিরল নয়। চক্রান্তকারীরা স্রোতের সঙ্গে ভেসে তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। সুযোগ বুঝে খুলে ফেলে গণদরদের মুখোস। তাদের সম্পর্কে জনগণকে সচেতন থাকতে হবে।
জনগণের মধ্যে অটল ঐক্যই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করার একমাত্র পথ। সমস্যা আমাদের অনেক। জনগণ যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত। গত প্রায় চার বছরের কুশাসন এদেশের মানুষকে বঞ্চনার, যন্ত্রনার শেষ সীমানার চরম পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। সব সমস্যারই সমাধান খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু আমরা যখন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের সংগ্রামে লিপ্ত তখন আভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রহণ করতে হবে শান্তিপূর্ণ শৃঙ্খলাপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথ ও পদ্ধতি। সেনা বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সাম্প্রতিক কালে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন তার কিছু অংশ ঐক্যের প্রশ্নে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি জাতীয় প্রয়োজনের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, “আজ জাতির সামনে সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জনগণের মধ্যে ঐক্যবোধ, সামরিক বাহিনীর মধ্যে একতা এবং প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি। “
স্বাধীনতার স্বার্থেই এই ঐক্য ও সম্প্রীতি আমাদের গড়ে তুলতে হবে৷ সামরিক বাহিনীর কর্মীদের উদ্দেশ্যে তার সুস্পষ্ট বক্তব্যঃ
একটি আধুনিক ও দক্ষ বাহিনী হিসাবে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলাই সরকারের লক্ষ্য। গত ১৪ ই আগস্ট পর্যন্ত আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দূরাবস্থার মধ্যে পড়েছিল। স্বাধীনতার পর ঐ দিন পর্যন্ত যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তাদের অবহেলার ফলে দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য দের মনে হতাশার ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। গত চার বছরের পুঞ্জীভূত অবহেলার ফল এত দ্রুত দূর করা সম্ভব নয়। তবে আশা এই যে, আমরা কামিয়াব হবোই।
দীর্ঘ দিনের অবহেলা, শোষণ, বঞ্চনা আর অপশাসনের ফলে সমাজ জীবনের জাতি স্তরে যে সমস্যা জমে উঠেছে, তা একদিনে কিংবা এক বছরে সম্পূর্ণ ভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। এসব সমস্যার সমাধান বের করতে হবে একসঙ্গে বসে, পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে, সম্প্রীতির পরিবেশে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে৷ আভ্যন্তরীণ প্রশ্নে নিজেদের সমস্যাকে প্রধান করে তুললে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীরাই লাভবান হবে। দেশের ভেতরে জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি, উসকানী দান, হতাশা সৃষ্টির প্রয়াস অগোপন নয়। এই কারণেই জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্তে লিপ্ত ষড়যন্ত্র কারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন নৌ বাহিনী প্রধান কমোডর মোশারফ হোসেন। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকারের সাথে সহযোগিতা করার জন্য সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা ভাসানী।
স্বাধীনতা সংরক্ষণের চূড়ান্ত সংগ্রামের এই পর্যায়ে তাই ধর্ম নির্বিশেষে, অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে, কে বড় চাকুরে – কে ছোট চাকুরে তা বিচার না করে, শিক্ষিত – শিক্ষা বঞ্চিতের দূরত্বের প্রশ্ন না তুলে, এক মনে ও এক সমতলে আমাদের জাতীয় ঐক্য দুর্ভেদ্য করে তুলতে হবে। ঘরোয়া সমস্যা আমরা ঘরোয়া ভাবেই সমাধান করবো, কোন উসকানীর ফাঁদে পা দেব না। যারা জাতীয় ক্ষেত্রে বিভেদ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী তারা দেশের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিতে চায়।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের লক্ষ্য। এই নির্বাচনের জন্য চাই সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, এবং জনগণের ইচ্ছাকে জয়ী করে তোলার জন্য চোখের মণির মত রক্ষা করতে হবে মাতৃ ভূমির স্বাধীনতা। জনগণের সর্বাত্মক ঐক্যই আজ এ স্বাধীনতার গ্যারান্টি।
এই শ্যামল, সমতল, শান্ত জনপদের মানুষ তাদের অধিকার ও ভাগ্য সম্পর্কে সচেতন। নিজের ভাগ্য নিজের হাতে গড়তে তারা কৃত সংকল্প। তারা চায়, স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে গড়ে উঠুক দফা আধুনিক, গতিশীল সশস্ত্র বাহিনী। তারা চায় দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। তারা চায় পৃথিবীর সকল দেশের সঙ্গে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক – এ ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষের কথা বলার কোন অবকাশ নেই।
নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্বাধীনতাকে, সার্বভৌমত্বকে সর্বস্ব দিয়ে রক্ষা করতে হবে। স্বাধীনতা না থাকলে আমাদের অস্তিত্বও অর্থহীন। তাই এক সমতলে দেশ প্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাড়াতে হবে, ব্যর্থ করে দিতে হবে বিভেদকামীদের চক্রান্ত।
***
আমাদের দেশ ছোট কিন্তু জাতি বড়
– মোশতাক
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ ৭ ই নবেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে জাতীয় ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেন – আমাদের দেশ ছোট কিন্তু জাতি বড়। এর প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে হায়েনার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে – স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তি ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায়। আবার এর প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। কল – কারখানায় বেশী পেশী – নিংড়ানো শ্রমে সর্বাপেক্ষা বেশী উৎপাদনও করতে হবে। অতঃপর পরস্পরকে সুখী ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টায় সকলকে এক জাতীয় মহা প্রয়াসে নিয়োজিত হতে হবে নিবেদিত চিত্তে।
***
সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহযোগিতা করুন
– ভাসানী
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকারের সাথে সর্বান্তঃকরণে সহযোগিতা করার জন্য সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী দলমত নির্বিশেষে জনসাধারণের প্রতি সরকারকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাহায্য করার আবেদনও জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এটা বাস্তবিকই দুঃখজনক যে, আভ্যন্তরীণ ও বাইরের শক্তি সমূহ এখন পর্যন্ত গুটিকয়েক মীর জাফরকে কাজে লাগিয়ে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত রয়েছে।
মওলানা সাহেব বলেন, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব ও সার্বভৌম সমতা নীতির ভিত্তিতে গৃহীত দেশের পররাষ্ট্র নীতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত বিদেশী চক্রান্ত সমূহের বিরুদ্ধে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা এ সব নীতির ভিত্তিতে সকল দেশ বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব কামনা করি। কিন্তু কোন কোন বিদেশী শক্তি এই পবিত্র নীতির পথে অন্তরায় সৃষ্টির জন্য সক্রিয় ভাবে এক অশুভ প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
তিনি সশস্ত্র বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও জনসাধারণের প্রতি চক্রান্তকারীদের হীন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য সদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকার আহ্বানও জানান। তিনি বলেন, চক্রান্ত কারী শক্তি সমূহ যাতে কোনভাবে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা সীমান্তে বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে৷ এ জন্য তিনি সকলকে রাজনীতির উর্ধ্বে থাকার আহ্বান জানান।
মওলানা সাহেব বীর সশস্ত্র বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার এ জনসাধারণকে অতি সম্প্রতি দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত চক্রান্তকে নস্যাৎ করার ব্যাপারে তাদের ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাইরের ও ভেতরের শত্রুরা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক জঘন্য ষড়যন্ত্র করার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
তিনি বলেন, দেশের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মহলসমূহ এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টাও চালিয়েছিল। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে। তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনী, বিডিআর পুলিশ ও আনসার সদস্যদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে যে কোন মূল্য ও ত্যাগ স্বীকাে করে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
সৈনিকরা যাতে দেশরক্ষায় আত্মনিয়োগ করতে পারে সে জন্য মওলানা ভাসানী উর্ধতন কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের আহ্বানও জানান।
তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রে সসজ্জিত করে দেশের আঞ্চলিক অখন্ডত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম দক্ষ ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি প্রদান করে বলেন, একটি প্রবল শক্তি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের স্বাধীনতার প্রতি বৈরীভাবাপন্ন শক্তিসমূহ যখন তৎপর তখন দেশবাসীকে নীরব দর্শক সেজে না থাকার আহ্বান জানান।
***
রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র নস্যাতের আহ্বান
– জেনারেল জিয়া
আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। কতিপয় মহলের বিভিন্ন প্রচারণার সঙ্গে আমার নাম জড়িত দেখে আমি বিষ্মিত হয়েছি। আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই যে, রাজনীতির সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।
স্বার্থান্বেষী মহল ভুয়া পরিচয় দিয়ে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর নামে জনগণকে হয়রানি করারও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা জনগণের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব ও হতাশা সৃষ্টির হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
সমাজের সর্বস্তরের জনগণের কাছে আমার আজ বিশেষ অনুরোধ, আপনারা এই ষড়যন্ত্রকারীদের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। আমি প্রতিটি নাগরিককে এই সময় সর্বান্তঃকরণে সরকারকে সহায়তা করার আহ্বান জানাই। দেশে সামরিক আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও স্বার্থান্বেষী মহল সামরিক আইনের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে না দেয়াই এদের উদ্দেশ্য। আমাদের প্রিয় দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশবাসী সজাগ থাকবেন বলে আমি আশা করি। আমার দৃঢ বিশ্বাস যে দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্র বিরোধীদের এই হীন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেবেন।
আমার সামরিক বাহিনীর সহকর্মীবৃন্দ, আজ আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আপনাদের কল্যাণ এবং স্বার্থ রক্ষা করে একটি আধুনিক এবং দক্ষ বাহিনী হিসাবে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলা। গত ১৪ ই আগস্ট পর্যন্ত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর দুরাবস্থা সম্পর্কে আপনারা অবগত আছেন। স্বাধীনতার পর ঐ দিন পর্যন্ত যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তাদের অবহেলার ফলে দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য দের মনে হতাশার ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। গত চার বছরের পুঞ্জীভূত অবহেলার ফল এত দ্রুত দূর করা সম্ভব নয়। তবে আশা এই যে, আমরা কামিয়াব হবোই।
জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দেশপ্রেমিক জনগণকে রাষ্ট্র বিরোধী যে কোন মহলের চাপের স্বীকার না হওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আমি আশা করি আপনারা আমাকে এবং আমার সহকর্মীবৃন্দকে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা এবং সহায়তা দান করবেন। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
***
ষড়যন্ত্রকারীরা বিভেদ সৃষ্টিতে মেতে উঠেছে
– কমোডর মোশাররফ
দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে বর্তমান সরকার জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এর গুরুত্ব ও প্রকৃতি আমাদের প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার মূল লক্ষ্য সামনে রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করা আমাদের প্রত্যেকের আজ অতি মহান দায়িত্ব।
বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি জনাব এ এম সায়েম জাতির উদ্দেশ্যে তার নীতিনির্ধারণী ভাষণে পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করেছেন যে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে দেশের শাসন ক্ষমতার সল্প সময়ের মধ্যে তুলে দেয়াই তার সরকারের লক্ষ্য। দেশের এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমাদের আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শৃঙ্খলা ও কর্তব্যনিষ্ঠা। এই সময়ে বিশেষভাবে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব তাদের স্বাভাবিক কর্তব্যের চাইতেও অধিক৷ সামরিক বাহিনীর উপর এখন শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার এবং জাতীয় পুনর্গঠনের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে। জাতির সেবার তা আমাদের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী, দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা ফিরিয়ে আনার পূর্বশর্ত – ‘সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ’। এই পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই আমরা সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশে আমরা দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা করছি। আপনাদের সহযোগিতায় এই লক্ষ্যে পৌছতে আমরা বদ্ধপরিকর। এই সময় কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্তে মেতে উঠেছে। বাইরের উসকানি এবং উদ্দেশ্যমূলক গুজব ও প্ররোচনার মাধ্যমে তারা দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়েছে। তাদের সর্বনাশা চক্রান্ত আমরা সমূলে ধ্বংস করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশবাসী এই বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন বলে আমার দৃঢ আস্থা রয়েছে। সার্বভৌমত্ব ও জাতির স্বার্থে সজাগ প্রহরী সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দকে এদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ঐতিহাসিক ৭ ই নবেম্বর জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা যেভাবে প্রকাশ পেয়েছিল এবং যে একতা ও সংহতির নজির স্থাপিত হয়েছিল তা বাস্তবে রূপ দেবার জন্য রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের সকল অপচেষ্টাকে সামরিক বাহিনী ও দেশবাসী ধ্বংস করে দেবে এটা আসার দৃঢ সংকল্প।
আমাদের যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে অল্প সময়ে তা সমাধান করা সম্ভব নয়। দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে অবিরাম প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের সাধ্য সীমিত হতে পারে, কিন্তু সামরিক বাহিনী সহ বেসামরিক প্রশাসন, কৃষক, শ্রমিক, পুলিশ, আনসার, ছাত্র সমাজসেবী বুদ্ধিজীবী তথা আপামর জনসাধারণের সমবেত প্রচেষ্টায় ইনশাআল্লাহ আমরা সফলকাম হব।
***
ইউনিকোডে টাইপ – Maruf Muktadir Khan[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1975.11.28-bichitra-copy.pdf” title=”1975.11.28 bichitra copy”]