স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতি
অর্থনৈতিক ভাষ্যকার
পাকিস্তানের সময়কার অবহেলা ও বৈষম্য স্বাধীনতা যুদ্ধ কালীন বিপর্যয় ও ধবংস এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে করেছিল পর্যদস্ত, তার উপর স্বাধীনতা উত্তরকালীন অর্থনৈতিক পন্থাদির অব্যবস্থা এবং ব্যর্থতা এদেশের ভাগ্যে নিয়ে এসেছিল এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ । পরিসংখ্যানের অভাব থাকায় জানা যায় না খাদ্যাভাবে কত মানুষের মত্যু ঘটেছে গত কয়েক বছরে।
ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় ১৯৬৯-৭০ সালে এক ধরলে ১৯৭২ সালের জুনে, তা হয়েছে ১৫২,৭৩-এর জুনে হয়েছে। ২১৭, চুয়াত্তরের জুনে ৩০৪ এবং পচাত্তরের জুনে দাঁড়িয়েছে ৪১০এ। জীবন যাত্রার এই ভয়ংকর ব্যয় বৃদ্ধি প্রমাণ করে এদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্যে কি পরিমাণ অত্মত্যাগ করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করে নিঃসন্দেহে। রুশ বিপ্লবের পর এধরনের অচলাবস্থা সোভিয়েট রাশিয়াতে দেখা দেয় । ১৯৭৯ সালের অক্টোবর ১ বলের ক্রয়ক্ষমতা যা ছিল, ১৯২০ দারুণ মুদ্রাস্ফীতির কাল। আমাদের দেশের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে ৭৫% সে তুলনায় অনেকটা কম। ১৯২৩ সালের মধ্যে রাশিয়ায় পরিস্থিতি আয়ত্তাধীনে আসে। অথচ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে সংযত বা সংহত করতে পারেনি। বিপ্লব বা যুদ্ধের পর দেশীয় পুনর্গঠনের জন্যে যে সময় প্রয়োজন হয় বাংলাদেশ সম্ভবত সে সময় উৎরে এসেছে।
১৯৬৯-৭০ এর তুলনায় ১৯৭২-৭৩ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) কমেছে চৌদ্দ শতাংশ। ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় পর গত ৫ বছর জিডিপি বৃদ্ধি পায় বারো শতাংশ। ১৯৭৪-৭৫ সালে জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ শতাংশ—সেখানে প্রকৃত পক্ষে বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ।
সাধারণ মোটা চালের দাম ঢাকায় মণ প্রতি ১৯৭২ এর জুন মাসে ছিল ১’১২ টাকা, ১৯৭৩ এর জুনে হয় ২১২ টাকা, ১৯৭৪ এর জুনে হয় ৩’৬১ টাকা এবং ১৯৭৫ সালের জুনে হয় ৫৭৫ টাকা চালের দামের এই অসাধারণ মুল্য।
দোকআন্দার এবং ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে আয় বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। শ্রমিক শ্রেণীর কিছু অংশ, যেমন রিকসাওয়ালা ইত্যাদি কিছুটা হলেও তাদের মজুরীকে বাড়িয়ে নিতে পারে । কিন্তু বেতনভোগী মানুষ কেবল অসহায়ের মত জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে। শহরে রেশনিং চাল, থাকে। যদিও বেশীর ভাগ রেন দ্রব্য পায় তারাই যাদের রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল এবং যাদের নীতিবোধ ছিল না। বেশীরভাগ বেতনভোগী কর্মচারীই রেশনিং অফিসারদের খুশী করতে না পারায় রেশন কার্ড লাভে ব্যর্থ হয়।
স্বাধীনতাপুর্বকালীন তুলনায় – ১৯৭২-৭৩ সালেখাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যায় ১৬ শতাংশ। অর্থকরীশস্য যেমন পাট, চিনি এবং চা উৎপাদন কমে যথাক্রমে ৬ %, ২৮% এবং ২১%। শিল্প-কারখানার উৎপাদনে হয় দ্রুততর ক্ষয়সাধন। পরবর্তী বৎসর অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৪ সালে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গত বছরের তুলনায় শতকরা আঠারো ভাগ। পর্ববর্তী বছরের তুলনায় পাট উৎপাদন কমে যায়। চা উৎপাদন সামান্য বৃদ্ধি এ অর্থ বছরে অর্থাৎ ১১৭৪- সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন গত বছরের তুলনায় কমেছে পাট উৎপাদন কমেছে, কেবল মাত্র চা উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। শিল্প কারখানা কোন কোন শিল্প যেমন সুতির কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট, ম্যাচ, সিমেন্ট ও চিনি উৎপাদন গত বছরের তুলনায় বেশী হলেও পাট পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন তুলার সুতা সিগারেট, স্টিল ইন ইউরিয়া ইত্যাদির উৎপাদন উল্লেখ যোগ্যভাবে কমে গেছে।
গত কয়েক বছরের লাগামহীন ম বধি ১৯৭৪-৭৫ সালে এসে কিছু কম হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ৫ দিকে গৃহীত ঋণ নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়তার ফলে এবং ১৯৭৫ সার শ’ টাকার নোট অচলীকরণের য ঋণ ও মুদ্রা সংকুচিত সরবরাহের এ লাগামহীন বৃদ্ধি দ্রঝমল্যের রোহনের অন্যতম কারণ বলে ধারনা করা হয়। ১৯৭৪-৭৫ সালর পর মুদ্রা সরবরাহ সংকোচনের প্রচেষ্টাই ছিল না। মুদ্রা ঘটাবার প্রধান কারণই ছিল পণ্য গণখাতের শিল্প কারখানা।
অন্যদিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে উপর্যপরি অর্থ ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ভয়াল করে। . মুদ্রা সরবরাহ বধি, উৎপাদন হস যোগাযোগের অব্যবস্থা ছাড়াও
(লক্ষ টনে)
বিষয় ১৯৭২-৭৪ ১৯৭৩-৭৪ ১৯৭৪-৭৫
ক) ধান ১৯.৩০ ১১৭.২১ ১১৩ ১৯
আউস ২২.৭৩ ২৮.২০ ২৮ ৫১
আমন ৫৫.৮৫ ৬৬ ৯৯ ৬০ ০০
বোরো ২০.৭০ ২২ ২০ ২৪ ৬০
খ) গম ০.৯০ ১ ০৯ ২ ৬০
মোট খাদ্য শস্য ১০০.২০ ১১৪ ৩০ ১১৪ ৮৪
মূল্য বৃদ্ধির আরেকটি বড় কাপ ছিল চোরাকারবারী। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এক ঐতিহাসিক চোরাচালান ঘটে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। চোরাচালানীয় এই মূল্য স্ফীতির প্রধান কারণ ছিল দুটি , টাকার মূল্যের অসমতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাকে এ উদ্দেশ্যে অবাধ ব্যবহারের অব্যাহত সুযোগ ।
১৯৭৫-এর মধ্যবর্তী সময়ের স্বপ্ন থেকে অর্থনীতিকে কিছটা নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব হয়েছে। যে ক’টি পদ ক্ষেপ এ বছর গ্রহণ করা হয়েছে সবকটি কমবেশী সার্থক হয়েছে। যা থেকে বোঝা যায় অনুন্নত দেশ হলেও বাংলাদেশে নতুন পদক্ষেপের যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া আছে। সুতরাং এদেশী জনগণ অধিকতর উপযোগী পদক্ষেপের আশায় এবং সম্ভাবনায় নতুন করে আশার বুক বাঁধছে। হয়তো আগামীতে জীবন-যাত্রায় কিছুটা স্বস্তির আশ্বাস পাওয়া যেতে পারে। খাদ্য পঋস্থিতিতে
১৯৭২-৭৩ সালে কৃষিখাতের উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনীয় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। উৎপাদন পতনের মূল কারণ হল,
অসময়ে বৃষ্টি, কৃষি কাঁচামালের . দষ্প্রাপ্যতা এবং কৃষকদের জন্যে প্রয়োজনীয় ঋণের অভাব। ১৯৭৩-৭৪ সালে ধান চালের উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় কিছুটা বদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালে ধানের উৎপাদন ছিল ৯৯:৩০ লক্ষ টন। পরবর্তী বৎ সর এর পরিমাণ হয়েছে ১১৭২২ লক্ষ টন। ১৯৭৪-৭৫ সালে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ধান উৎপাদন কমে যায়। দাঁড়ায় ১৯৩’১১ লক্ষ টন-এ। ১৯৬৯-৭০ সালের সঙ্গে বর্তমান বছরগুলোর তুলনা করলে দেখা যাবে উক্ত বছরে বর্তমান সবকটি বছরের থেকে উৎপাদন অনেক বেশী ফল= ১১৮১৬ লক্ষটন। স্বাধীনতার এ ক’বছর পরে উৎপাদনের এ স্তরে ধান উৎপাদন পৌছতে পারেনি। খাদ্য উৎপাদনের একটি তালিকা দেওয়া যায়ঃ
উৎপাদনের এই হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যশস্যের খাদ্যশস্যের মুল্য বৃদ্ধির ফলেই অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্যের মুল্য বৃদ্ধি পায়।
খাদ্য পরিস্থিতি স্বাধীনতার স্বর থেকে দ্রুত সংকটময় হয়ে ওঠে জানুয়ারী ১৯৭২ থেকে জুন ১৯৭৩ এর মধ্যে শতকর একশ’ভাগ মূল্য বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী জুনে বৃদ্ধি পায় ৭৪ শতাংশ। শেষ অর্থবৎসরে বাগধ পায় ৫ ৬ অংশ। ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বৎসরের শেষ দিক থেকেই খাদ্যশস্য মুল্য চাপ কিছুটা লাঘব হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা আরও কমে যেতে থাকে। এই হ্রাসের কারণ পরবর্তী পর্যায়ে আলোচিত হবে।
মণপ্রতি টাকায়
নিকট চালের দাম
জানুয়ারী ১৯৭২ ৪০ ” ৫৭
জুনে ১৯৭৩ ৮৫’৩০
ডিসেম্বর ১৯৭৩ ৮০’০২
জুন ১৯৭৪ ১৩৩ • ৪২
ডিসেম্বর ১৯৭৪ ১৯৮’ ৩১
জুন ১৯৭৫ ১৯৯’১১
খাদ্যশস্যের এই ভয়ংকর মুল্যে বৃদ্ধি অন্যতম কারণ। অন্যান্য কারনগুলি আমরা পরে বিশ্লেষণ করবো । রেশন প্রথাও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এ সব এখন বিশ্লেষণ করা যেতেপারে।
রেশন প্রথা
অর্থনীতির নির্মাণকারি নিয়ন্ত্রণ যেমন সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ, খাদ্যশস্যের মুল্য নির্ধারণ ইত্যাদি মূল্যমানকে কমাতে পারে না। বা কোনো সঠিক সমাধান দিতে পারয়ে না ।
রেশন প্রথা হচ্ছে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি একদিকে বাজারের চালের দামের কোন পরিবর্তন করতে পারেনি অন্যদিকে তা জন্ম দিয়েছে লক্ষাধিক অন্যায়। এ অন্যায়কে জেনে শুনে তদানীন্তন সরকার কিছু করতে পারেনি।
রেশন চাল, আছে মাত্র শহর অঞ্চলে তাও শহরের মাত্র এক খণ্ডাংশ রেশনের আওতায় পড়ে। বাকী শহরবাসীরা যে কোন কারণেই হোক রেশন কার্ড সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং সমগ্র দেশের মাত্র গুটিকয়েক লোক এই সুবিধা পেয়ে থাকে।
রেশনের নামে নিয়ন্ত্রণ খোলাবাজারি মল্যমানকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। তদুপরি সরকার কর্তৃক ক্রমান্বয়ে রেশন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করায় খোলাবাজারী মল্য ধারাবাহিকভাবে বেড়ে গেছে। রেশন পণ্যের একটি মূল্য তালিকা আমরা পেশ করতে পারি, যা থেকে প্রতীয়মান হবে যে সরকার প্রায় সব ক’টি পণ্যের মূল্য ৯০০% -এর উপরে স্বাধীনতা উত্তরকালীন সময়ে বাড়িয়ে দিয়েছে:
লেশন পণ্যের ইস্যু মুল্য
স্বাধীনতা
থেকে জুন ১৯৭৩ পর্যন্ত |
জুলাই ১৯৭৩ | মে
১৯৭৪ |
জুন
১৯৭৪ |
ডিসেম্বর
১৯৭৫ |
জুন
১৯৭৫ |
|
চাল | ৩০.০০ | ৪০.০০ | ৬০.০০ | ৬০.০০ | ৬০.০০ | ৬০.০০ |
গম | ২০.৮০ | ৩০.০০ | ৫০.০০ | ৫০.০০ | ৫০.০০ | ৫০.০০ |
আটা | ২৩.২০ | ৩৩.৬০ | ৫৩.৬০ | ৫৫.২০ | ৫৫.২০ | ৫৫.২০ |
ময়দা | ||||||
সুজি | ৩৩.৬০ | ৪৮.৮৩ | ৫৮.৮০ | ৭৫.০০ | ৭৫.০০ | ৭৫.০০ |
চিনি | ৮৪.৮০ | ১৬০.০০ | ১৬০.০০ | ২০০.০০ | ২৫৬.০০ | ২৫৬.০০ |
সোয়াবিন | ১৪০.০০ | ২২০.০০ | ৩২০.০০ | ৩২০.০০ | ৩২০.০০ | ৩২০.০০ |
রেপসিড | ১৬০.০০ | ২৪০.০০ | ৩২০.০০ | ৩২০.০০ | ৩২০.০০ | ৩২০.০০ |
কেরোসিন | ২.৭৫ | ৩.১২ | ৬.৬২ | ৬.৬২ | ৬.৬২ | ১.০০ |
রেশন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে সামগ্রিক মূল্য বৃদ্ধি একটি মস্ত বড় কারন।এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি উল্লেখ্য। রেশন দ্রব্য সঠিক সরবরাহ ও মুল্যহ্রাসের উদ্দেশ্যে সরকার নভেম্বর ১৫, ১৯৭৪ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চালু করে। জুলাই ১৯৭৫ শেষ অবধি আমন ধান-চাল সংগ্রহ হয় এক লক্ষ সাতাশ হাজার টন। যেখানে ১৫ই নভেম্বর ১৯৭৩ থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪ পর্যন্ত ধান-চাল সংগ্রহ হয়েছিল একাত্তর হাজার টন। বোরো-ইরি ধান-চালও এই সংগ্রহ অভিযানে কেনা হয়। ২১শে এপ্রিল থেকে ৩১শে জুলাই, ১৯৭৫ সালে সংগ্রহ হয় চৌদ্দ হাজার টন। ধান সংগ্রহ করা হয় মণ প্রতি ৭৪ টাকা এবং চাল ১১৪ থেকে ১২০ টাকা করে। গড়ে আনুমানিক মণ প্রতি এক শত টাকা ধরলে সংগ্রহের দাম পড়েছে প্রায় সোয়া কোটি টাকা। অথচ বিক্রি করা ভর্তুকি দিতে হয়েছে আনুমানিক পচাশি লক্ষ টাকা। এছাড়া বিদেশ থেকে বেশী দামে যে ধান-চাল-গম সংগ্রহ করা হয়েছে তার উপরেও ভতুর্কি দিয়ে রেশন থেকে ইস্যু করা হয় । সতরাং এক কোটি টাকারর উপর মোট ভুর্তুকি দেওয়া হয়েছে বলে
| আশসা ধব নিতে পারি। কি পলিলে দানত অনায়, লালাবাজার ইদায়ি স্বজন গরী। এই এক কোটি, ই কা জনগণকে ঘলর নিংঙ্কান ফল দেয়। অথচ এই এক ফোটি টকা মেরে
ভর্তুকি না দিয়ে যদি কৃষকদের ঋণ দেওয়া হত, অতিরিক্ত সার ও আধুনিক যন্ত্রাদির জন্য সাহায্য করা হত তবে সম্ভবতঃ খোলাবাজারেই চালের দাম মণপ্রতি ষাট টাকা না হলেও তার কাছাকাছি আসতে পারতো। এ পদ্ধতি জন্ম দিত না কোন দুর্নীতি। বরং শুধু শহর এলাকারই নয় সমগ্র লোক সংখ্যাকে দুর্ভিক্ষজনিত এই কষ্ট পেতে হত না। সুতরাং জনগণের মন থেকে এ ধারনা মুছে যাওয়া উচিৎ যে রেশন ছাড়া আমাদের উপায় নেই। খাদ্য আমদানি ।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি প্রতিষ্ঠানের হিসাব মতে ‘ংলাদেশের স্বাধীনতাউত্তরকালীন খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বছরে বিশ থেকে পচিশ লক্ষ টন। বাংলাদেশের প্রথম আর্থিক বছরে প্রকৃত আমদানী ছিল ২৯ লক্ষ টন। পরবর্তী বৎসর এর পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ১৭ লক্ষ টন। সর্বশেষ বৎসরে আমদানী লক্ষমাত্রা নির্ণিত হয়েছিল ২৩ লক্ষ টন।
(লক্ষ টণ)
আমদানি | ১৯৭২-৭৩ | ১৯৭৩-৭৪ | ১৯৭৪-৭৫ |
চাল | ৩.৯৭ | ০.৮৬ | ২.৬০ |
গম | ২৪.৬৮ | ১৫.৬৫ | ২০.৩৬ |
মোট | ২৮.৬৫ | ১৬.৫১ | ২২.৯৬ |
মোট খাদ্যশস্য প্রাপ্তির শতকরা কত ভাগ আমদানী | ২৮.৫৯ | ১৩.৯৬ | ১৯.৯৯ |
হিসাব অনুসারে দেখা যায়, আমদানীর ফলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় নগণ্য। অথচ তবু খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে যায়। এর প্রধান কারণই ছিল মজুদদারি ও অপ্রতিরোধ্য চোরাচালান। ১৯৭৪-৭৫ সালের শেষদিকে খাদ্যশস্যের মূল্য হ্রাস একটি বিবেচ্য ঘটনা। এ মূল্য হ্রাস সম্ভবতঃ অর্থ বছরের শেষদিকে না হয়ে প্রথম দিকেই হতে পারন যদি আমদানীকৃত শস্য সঠিক সময় এসে পৌছত। বছরের প্রথম তিনচতুর্থাংশে আমদানীকৃত খাদ্যশস্য পৌছেছে অত্যন্ত স্থূল গতিতে, মোট চৌদ্দ লক্ষ টন মাত্র। অথচ কেবল মাত্র শেষ চতুর্থাংশে আমদানী হয় নয় লক্ষ টন। অতএব জনগণ আশা করে বিগত সরকারের খাদ্য শস্য আমদানীর ব্যাপারে গড়িমসির অবসান হবে। এ বছর সঠিক খাদ্যশস্য পৌছেলে পণ্যাদির মূল্য সমান নিশ্চয়ই কমবে।
গত সরকার জনগণকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে আন্তর্জাতিক বাজারে চাল-গমের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এ দেশে এগুলির দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা আংশিক সত্য মাত্র, সম্পূর্ণ নয়। কেননা অামদানীকৃত খাদ্যশস্যের পরিমাণ মোট খাদ্যশস্যের মাত্র শতকরা বিশ ভাগ। সতরাং আমদানী মূল্য খুব সামান্যই প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
দ্রব্যমুল্য ও জীবনযাপন সূচি
খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজ, নীয় সকল পণ্যের মূল্য। মার্চ ১৯৭৫ ‘ পর্যন্ত এ বৃদ্ধি ছিল অপ্রতিহত। একদিকে দ্রব্যাদির সররবাহ ও উৎপাদন ছিল কম অন্য দিকে বর্ধিত চাহিদা ও মুদ্রা সংখ্যায় বৃদ্ধিই এই মূলের অগ্নিতে ঘৃতাহতির কাজ করে। স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলিতে অবশ্য মদ্রা সরবরাহ একটা সমস্যা হিসাবে ছিল না। তখনকার মুল্যবদ্ধির কারণ ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। বণ্টন নীতির দুর্বলতা, বিদেশীদান ও সাহাৰ্য্যকে লুটে নেওয়ার জন্যে তদানীন্তন ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের নেশা চোরাচালান মজুদদারী।
মূল্যবৃদ্ধির একটা তালিকা নিচে দেওয়া গেল।
ঢাকার বাজার দর
দ্রব্যাদি(সেরপ্রতি) | ১৭জানু.
১৯৭২ |
জুন,৭৩ | জুন,৭৪ | জুন,৭৫ |
চাল(সাধারণ) | ১.১৯ | ২.৪৪ | ৩.৬৯ | ৫.২৫ |
আটা | ০.৮৭ | ১.১২ | ২.২৫ | ৪.৫০ |
ডাল (মসুর) | ২.০০ | ৩.০০ | ৫.০০ | ৬.০০ |
আলু | ০.৬২ | ১.৫০ | ২.৫০ | ৩.৫০ |
মাছ(রুই) | ৪.৫০ | ৯.০০ | ১২.০০ | ১৬.০০ |
খাসির মাংসস | ৪.৫০ | ৬.০০ | ১২.০০ | ১৪.০০ |
সরিষার তেল | ৭.০০ | ১২.০০ | ২২.০০ | ৩২.০০ |
চিনি | ৪.৫০ | ৬.০০ | ৯.০০ | ১৮.০০ |
লবন | ০.৬২ | ০.৫০ | ১.০০ | ১.১২ |
কেরোসিন তেল(গ্যালন প্রতি) | ৬.০০ | ৩.০০ | ৭.০০ | ৯.২৫ |
সাবান | ৪.২৫ | ৪.৫০ | ১২.০০ | ১৮.০০ |
লংক্লথ (গজপ্রতি) | ৪.৫০ | ১২.০০ | ১৪.০০ | ৯.০০ |
ন্যায্যমুল্যের দোকান
মুল্যমাঙ্কে কমাবার জন্য গত সরকার এক স্বপ্নিল পদ্ধতি প্রচলন করে। এ ধরনের পদ্ধতির ধারণা গোড়াতেই ছিল অপক্কএবং সারা দেশের প্রতিটি শহর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এক ধরনের দোকান খোলা হয়, যেখান থেকে নিত্যপ্রয়ো জনীয় দ্রব্যাদি সরকারী মূল্যে সরবরাহ করা হবে বলে বলা হয়। একই বাজারে এক দোকানে ন্যায্যমূল্যে দ্রব্যাদি পেলে ক্রেতারা আর অন্য দোকানে যাবে না। অন্য দোকানদারগণ তখন বাধ্য হবেন তাদের মূল্যমান কমাতে। এই ভাবে সারা দেশে মূল্য হ্রাস পাবে। এই ছিল কর্তৃপক্ষের স্বপ্ন।
ন্যায্যমূল্যের দোকান খেলার পরে দেখা গেল বেশীর ভাগ দোকান পেয়েছে তারাই যাদের রাজনৈতিক খুটি আছে। এবং সে খুটি হবে সরকার দলীয়। এটি ছিল প্রথম ভুল।
যেহেতু রাজনৈতিক ব্যাকিং তাদের ছিল, এবং যেহেতু ব্যাকিং থাকলে পুলিশ এদেশে কিছু করতে পারে না, সেহেতু এ দোকানদাররা অনায়াসেই তাদের কোটা কালো বাজারে বিক্রি করে দিতে আরম্ভ করলো। সুতরাং দোকানে ক্রেতাদের জন্যে কিছু অবশিষ্ট থাকলো না। বাজারের দাম কমলো না এবং অবশেষে এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ বলে মেনে নেওয়া হল।
(অসপষ্ট)
কালো বাজার বলে অদ্ভুত এক বাজার স্বাধীনতার প্রথম বছর থেকেই সারা বাংলাদেশে গড়ে ওঠে এমন কোন পণ্য নেই যা এই বাজারের আওতায় পড়েনি। এর সঙ্গে এল মজুদ ব্যবসা। সরবরাহ কমিয়ে দিল বড় বড় মজুদদাররা দাম যেতে
থ কলো হ হ করে বেড়ে। গত সরকার এ অবস্থার কোন সমাধান দিতে পারেননি। সম্ভবতঃ এই কারণে যে নিজেদের দলীয় লোকরাই এসব ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল।
এ কথা অবশ্য বলা উচিত-মজুদ ও কালোবাজারি মুদ্রাস্ফীতির একটি লক্ষণ মাত্র। মুদ্রাস্ফীতির কারণ নয়। মজুদদার ও কালোবাজারিরা প্রকৃতপক্ষে সমগ্র অর্থনীতিসমদ্রের মাছ। সামদ্রিক মাছ তো আর সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা ঝড়ও জন্ম দিতে পারে না, সুতরাং মদ্রাস্ফীতির একমাত্র কারণ তা নয়; বরং যারা মুদ্রাকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বাড়তে দিয়েছে তারাই-অর্থাৎ সরকার। যদিও মুনাফাখোর, কালোবাজারি ও মজুদদাররা প্রধান কারণ নয়। তবুও তারা অর্থনীতিকে বেশ কয়েকবার দারুণভাবে কষাঘাত মারতে পেরেছে। এর মধ্যে প্রধান ব্যাপারটি হল লবণ কেলেংকারী। লবণের দাম সেরপ্রতি গড় মূল্য ছিল পঞ্চাশ পয়সা। অথচ হঠাৎ এর মূল্য সেরপ্রতি একশত টাকা অর্থাৎ শতকরা বিশ হাজার ভাগ বেড়ে যায়। সম্ভবতঃ ইতিহাসে কোথাও এ ভয়ংকর বৃদ্ধির নজির নেই।
এরাই সরকারকে অবলম্বন করে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে।
প্ৰচুর ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে। ব্যাংক ঋনের একটা বিরাট অংশই সমাজ বিরোধী এই সমস্ত কার্যকলাপের কাজে আসছিল। অক্টোবর ১৯৭৪ সালের আগে এর বিরুদ্ধে সরকার কোন পদক্ষেপ নেননি। ৩১শে অক্টোবর আদেশ জারি করা হয় যে ব্যাংক অাগাম গ্রহণে ষাট দিনের মধ্যে তা পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে মজুদ ব্যবসায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা আরও আগে নেওয়া যেত।
চোরাচালান
বাংলাদেশে চোরাচালান দু রকম হয়। প্রথমটি হচ্ছে সাধারণ চোরাচালান। দ্বিতীয়টি হচেছ পুজি পাচার। এর মূল কারণ হচেছ আমাদের মুদ্রার প্রকৃত মূল এবং সরকারী মূল্যের পার্থক্য। ভারতীয় মুদ্রার সঙ্গে আমাদের মুদ্রা বিনিময় হার খোলা বাজারে এক রকম। অথচ সরকারী হিসাবে তা সমান সমান। –
চোরাচালানের এই প্রথম কারণটি ভাল করে দেখা যাক। নীচের তালিকা থেকে দেখা যাবে ভারতীয় একশত টকা বাংলাদেশী কত টাকার সমান।
খোলাবাজারে টাকার বিনিময় হয়। সময় ভারতীয় একশত টাকার
সমান বাংলাদেশী টাকাঃ
জুলাই ১৯৭২ | ১০৯.৫২ |
ডিসেম্বর ১৯৭২ | ১৩০.০০ |
জানুয়ারী ১৯৭৩ | ১৬৫.০০ |
জুন ১৯৭৩ | ১৬৭.৬০ |
ডিসেম্বর ১৯৭৩ | ১২০.০০ |
জুন ১৯৭৪ | ১৭৬.৪৭ |
মুদ্রামানের এই পার্থক্যের জন্যে বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসের শেষে প্রাপ্ত হিসাব থেকে দেখা যায় ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য দাঁড়িয়েছে নয় কোটি টাকা, যেখানে রপতানী, হয়েছে মাত্র তিন কোটি টাকার মত। অর্থাৎ প্রায় দু’কোটি টাকায় ঘাটতি। এ ঘাটতির মূল কারণ ছিল পাট ও মাছ রপতানীর ব্যর্থতা। আর এ ব্যর্থতার কারন হল বর্ডারের ওপারে যেহেতু অসরকারীভাবে চোরাচালানকৃত পাট ও মাছ সস্তায় পাওয়া যায় সেহেতু সরকারীভাবে তা রপতানী করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জেসিআই সরকারী বিনিময় হারে আমদানী করতে অনিচছা প্রকাশ করে। দ্বিতীয়
করার কথা ছিল সাড়ে তিন কোটি টাকার মাছ। অথচ ইলিশ, চিংড়ী ইত্যাদির চোরাচালানির ফলে মাত্র দু কোটি টাকার মাছ রপতানী করা সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং চোরাচালানি আমাদের অর্থনীতিকে দু’ভাবে পঙ্গু করেছে। প্রথমতঃ অামাদের দ্রব্যাদি অনায়াসে বিদেশে চলে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আমরা রপতানী করতে পারছিনা, শুধু আমদানী করে আমাদের সম্পদকে বিদেশকে দিতে হচেছ। তাছাড়া মূল্যের অনুপাত অনুসারে যেহেতু বাণিজ্য হয় সেহেতু বাংলাদেশ থেকে সোনা রুপা এবং মূল্যবান ধাতব বিদেশে চোরাচালানি হচেছ। যেগুলি আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্যে যথেষ্ট। বাংলাদেশ রাইফেলস সুত্র থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের সময় ধরা পড়েছে এ রকম একটা – হিসাব পেশ করতে পারি। সেখান থেকে দেখা যাবে কি কি দ্রব্য অমাদের দেশ থেকে কি পরিমাণ চোরা- চালান হত।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চোরা চালালের সময় ধৃত দ্রব্যাদির মুল্য
(হাজার টাকায়)
দ্রব্য | ১৯৭২-৭৩ | ১৯৭৩-৭৪ |
সোনা/রূপা | ৫৪ | ৪৮১ |
মাছ | ২৮৭ | ৩৪৯ |
পাট | ৪০১ | ৮৪ |
ধান/চাল | ৩১ | ১১৪ |
চামড়া | ২৬১ | ৫৪ |
ওষুধ | ৫২ | ১৮২ |
সাইকেল | ১১৫ | ৩২ |
চটব্যাগ | ১২৯ | ১২৬ |
সার | ১৬ | ৪৭ |
মরিচ,ঘড়ি,তাস ব্রেড | ||
ময়দা,গুড়,চিনি,দুধ | ২৫৬ | ৪৪১ |
ডিম,লবণ,ইত্যাদি | ||
মুদ্রা | ১০৪৪ | ২০৬ |
উপরে বর্ণিত ধৃত দ্রব্যাদির উপর নির্ভর করে এবং চোরাচালানের ব্যর্থতার সম্ভাব্যতা ০.০০০৭ ধরে হিসাব করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে মোট কত টাকার পণ্য চোরাচালান হয়েছে। এ ধরনের একটি তালিকা পাওয়া যায় ডঃ এ এম এ রহিমের আগষ্ট ১৯৭৪ এ বাংলাদেশ ব্যাংক বুলেটিনের একটি প্রবন্ধ থেকে।
(হাজার টাকায়)
সময় | সার্থক চোরাচালানের পরিমাণ |
জানুয়ারি ১৯৭৩ | ৩,০৪,০৭৩ |
ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ | ৭,৪৮,০৪৭ |
মার্চ ১৯৭৩ | ৪,০৮,২৮৫ |
এপ্রিল ১৯৭৩ | ১০,৩২,১৩৪ |
মে ১৯৭৩ | ৪,৩৫,৪১০ |
জুন ১৯৭৩ | ১০,৪৯,২৬৫ |
১৭২-৭৩ সম্পূর্ণ অর্থ বছর | ৬৭,৮৯,৫২৯ |
গত সরকার চোরাচালান বন্ধ করতে শক্তির সাহায্য নেন। কিন্তু এ কথা আমরা আগেই বলেছি যে চোরাচালান হচ্ছে একটি অর্থনৈতিক ব্যধি। যার ওষুধ কেবল মাত্র অর্থনৈতিক পদ্ধতিই হতে পারে, সামাজিক পদ্ধতি নয়। তবুও শক্তি প্রয়োগে চোরাচালানকে রোধ করা না গেলেও সংযত করা সম্ভব ছিল। অথচ সেটুকুও তারা করতে সার্থক হননি। এরকারণ ছিল এই যে ক্ষমতা লব্ধ রাজনৈতিক দলের হোমরাচোমরারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজনৈতিক শক্তি সঙ্গে থাকায় অন্যান্য শক্তি যেমন বিডিআর সাম
সত্বেও কিছু করতে পারেনি। শক্তি প্রয়োগে চোরাচালান বন্ধ
করতে হলে সব প্রথম প্রয়োজন ছিল উক্ত সরকারের অপসারন।
বর্তমান ক্যালেন্ডার বছরে অবশ্য শেষাবধি দুটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল, যখন দেশ প্রায় নিঃস্ব। এগুলি হচেছ শতটাকার নোট অচলীকরণ এবং বিনিময় হার পূননির্ধারণ। এ সম্পর্কে আলাদা ভাবে আলোচিত হবে।
যুদ্ধোত্তর অর্থনীতিকে পনগঠিত করার জন্যে, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি ও শিল্পকে পুন্রুঞ্জীবিত করার জন্য প্রচুর পরিমান অর্থের প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজন প্রকৃতপক্ষে ছিল যতটা তার থেকে বেশী মদ্রা তৈরী করা হয়।
মুদ্রা সরবরাহে’র বৃদ্ধিই দ্রব্য. মূল্যের এই শৃঙ্গগারোহনের অন্যতম প্রধান কারণ। ১৯৭৩ সালের জুনে যে অর্থবৎসর শেষ হয় সেখানে মুদ্রাসরবরাহ দুইশত দশ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দু’শ ছিয়ানব্বই টাকা হয়। পরবর্তী অর্থ বছর বৃদ্ধি পায় একশত এক শ কোটি টাকা। সুতরাং জুন ১৯৭৪ এর পরিমান হয় আটশত স.তরো কোটি টাকা। ডিসেম্বর ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই একই ভয়াবহ গতিতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে চলে। ১৯৭৫ সাল থেকে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। অর্থাৎ মুদ্রা বৃদ্ধির গতিধারা কিছুটা শ্লথ হয়। বরং বলা উচিৎ মুদ্রা সরবরাহ ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছরে কমে যায়। এ বছর সোয় দু কোটি টাকা কমে জুনে ১৯৭৫’এ এর পরিমাণ হয় প্রায় আটশত পনের কোটি টাকা। মুদ্রা সরবরাহের এই অপ্রতিরোধ গতির মূল কারণ বিশ্লেষণ করলে
দেখা যাবে সরকারী রাজস্ব কার্যক্রম ও গণখাত–এই দুটি এর জন্যে দায়ী। রাজস্ব কার্যক্রম ও গণখাত এ উভয়ই যেহেতু সরকারী অতএব বলা উচিত মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি ঘটায় তদানীন্তন সরকার। বাংলাদেশ ব্যাকের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে এ কথা প্রমাণ করা যায়।
মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির কারণ
১/ ব্যক্তিগত খাত | -১৩.৪৪ | +৫২.৬৮ | +৩৯.২৪ |
২/সরকারি খাত | +২০০.০০ | +১০৫.২৫ | +৩০৫.২৫ |
৩/ সময় আমানত | -১৩৪.৫৬ | -১০৬.৬৭ | -২৪১.২৩ |
৪/ সরকারি রাজস্ব কার্যক্রম | +১৮৩.০৮ | +১৭২.৩৪ | +৩৫৫.৪২ |
৫/ বিদেশি খাত | +৬৪.১৪ | -৮৩.১৭ | -১৯.০৩ |
৬/ অবশিষ্ট কারণ | +৯.৩১ | -১৯.৬৮ | -১০.৩৭ |
মোট | +৩০৮.৩১ | +১২০.৭৫ | +৪২৯.২৮ |
উপরের তালিকা থেকে সপষ্ট ভাবেই দেখা যায় সরকারীখাত এবং সরকারী রাজস্ব কার্যক্রম– এ দুটি কারণই মুদ্রা সরবরাহের এই বৃদ্ধির জন্য দায়ী। নয়া সরকারের এক শ্বেতপত্রে দেখা যায় স্বাধীনতা থেকে এ পর্যন্ত সরকারী ঘাটতি অর্থ সংস্থানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিনশ’ ছিয়াশি কোটি টাকার মত। এছাড়াও জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নেয় ১৯৭৪-৭৫ সালেই একশ একান্ন কোটি টাকা। যে কোন কারণই থাকুক না কেন দেশের এ. অবস্থায় সরকার কর্তৃক এই বিরাট মুদ্রা সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটানো অত্যত অদক্ষতার পরিচয় দেয় এবং জনগণ সহজেই এই দুর্ভোগের জন্যে সরকারকে দায়ী করতে পারে ।
মুদ্রা সরবরাহ হ্রাসের প্রচেষ্টা
‘১৯৭৪ সালের জুলাইয়ের পর্বে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাসের উদ্দেশ্য প্রকৃতপক্ষে কোন প্রচেষ্টাই নেওয়া হয়নি। সর্বপ্রথম ২১শে জন ১৯৭৪ সালে ব্যাংকের হারকে পাঁচ শতাংশ থেকে আট শতাংশে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে সুদের হার বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৪ সালের শেষ চতুর্থাংশে কয়েকটি দৃঢ় ঋণ নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করা হয়। যেগুলি ঋণ ও মুদ্রা সরবরাহ হ্রাসে সার্থক হয়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের
টাকার নোট অচলিকরণও এই প্রচেষ্টারই একটি উলেখ্য পদক্ষেপ |কুমহাসমান মামল্য এবং দুবত্র নাতিক চির (পলিতে। সুদের হারকে বাড়িয়ে দেওয়া হয় জুলাই ১৯৭৫ থেকে এই নতুন হার পুরাতন হারের চেয়ে উল্লেখ যোগ্য হারে বেশী। সাধারণ সঞ্চয় আমানতের উপর সুদের হার শতকরা পাঁচ ভাগ থেকে ছয় ভাগ এবং সময় আমানতের উপর ছয় ভাগ থেকে সোয়া নয় ভাগ পর্যন্ত করা হয়। ধার হারকেও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। নয় দশ শতাংশ থেকে এর পরিমাণ এখন হয় বারো/তেরো শতাংশ। সুদের হার বেড়ে গেলে সঞ্চয় বাড়বে আশা করা যায় এবং এ সঞ্চয় যেন সময় আমানতে চাহিদা আমানতের তুলনায় বেশী হয় এ উদ্দেশ্যে সময় আমানতে সুদের হারকে চাহিদা আমানতে সুদের হার থেকে আনুপাতিকভাবে অনেক বেশী করা হয়। সুদের হারের বৃদ্ধির সঙ্গে একদিকে সঞ্চয় যেমন বৃদ্ধির আশা করা যায় তেমনি ঋণ সংকোচনকেও আশা করা যেতে পারে। কেননা ঋণের জন্যে খরচা এখন পর্বাপেক্ষা বেশী। এ দুটি উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছে কিনা আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি।
(কোটি টাকায়)
বিষয় | সুদের হার পরিবর্তনের আগে জুনে ১৯৭২ থেকে জুন ১৯৭৪ পর্যন্ত গড় বৃদ্ধি | সুদের হার পরিবর্তনের পর জুন ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বৃদ্ধি |
চাহিদা আমানত | ৮৭.৭৭ | ৩৫.৭৭ |
সময় আমানত | ৯৩.১২ | ৭৩.৪২ |
সময়/চাহিদা আমানতের অনুপাত | ০.৭৩ | ০.৯০ |
ব্যাংক ঋণ | ১৯৫.১৬ | ৫৩.৪৮ |
উপরের তালিকা থেকে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। সুদের হারের বৃদ্ধির ফলে চাহিদা ও সময় আমানতে সঞ্চয় বৃদ্ধি পাওয়ার আশা করা গিয়ে আলকিত সেখানে। চাহিদা ও সময় উভয় আমানতে সঞ্চয়ের পতন হয়। এর কারণ দুটি। সুদের হার বৃদ্ধি প্রকৃত অর্থে
দেশ | পণ্যের মূল্যে পরিবর্তন | ব্যাংক রেট শতকরা বছরে |
বাংলাদেশ | ৩০০ | ৮ |
ব্রাজিল | ৩২.৩ | ১৮ |
চিলি | ৩৫১.১ | ৭৫ |
চীন প্রজাতন্ত্র | ৩৪.৪ | ১৬.৫ |
ভারত | ৩১.৪ | ৯ |
পাকিস্তান | ২৫.৮ | ৯ |
বৃদ্ধি ছিল না। আগের পাঁচ টাকা সুদের চেয়ে মুদ্রাস্ফীতির ফলে এখনকার আট টাকা সুদ প্রকৃত অর্থে কম। অর্থাৎ সুদের হারের প্রকৃত অর্থে পতন হয়েছে। দ্রবতীয় কারণ হল ব্যাংক ঋণ কমার ফলে আমানত হ্রাস পায়। কেননা ব্যাংক ঋণের একটা অংশ বর্ধিত আমনত। সুতরাং ব্যাঙ্ক ঋণের পতন ও আমানত বৃদ্ধি একই সঙ্গে হওয়া সম্ভব নয় সুদের হার বৃদ্ধির সার্থকতা হল সময় চাহিদা আমানতের অনুপাতে। অর্থাং আগের থেকে সময় আমানত চাহিদা আমানতের তুলনায় বেশী হয়েছে। সুদের হার বৃদ্ধি ব্যাঙ্ক ঋণকে কমাতে সক্ষম হয়েছে কিনা এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কেননা ব্যাঙ্ক ঋণের পতন শুধুমাত্র সুদের হারের জন্যেই ঘটেনি বরং ঋণ নিয়ন্ত্রণ নীতিই বেশী প্রভাবিত এ অবস্থায় প্রস্তাব করা যায় সুদের হারের পুনর্নির্ধারণ। পাঁচ থেকে আট শতাংশ বৃদ্ধি প্ৰকৃত অর্থে বৃদ্ধি নয়, বৃদ্ধিরর পরিমাণ আরও বেশী হতে পারে। পুনর্বৃদ্ধি কোন অযৌক্তিক ব্যাপার হবে না আমাদের মুদ্রাক্ষী তর সঙ্গে তুলনা করলে। অন্যান্য কয়েকটি দেশেও সুদের হারের কি বিরাট পরিমাণ পরিবর্তন করা হয়েছে তাদের মদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষিতে তা আমরা তালিকা থেকে দেখতে পাবো ! সুদের হারের পরিবর্তন না করেও একই ফল আমরা পেতে পারি আংশিক ইনডেক্সিং পদ্ধতিতে। ১৯৭৪ সালে আমি ব্যাংকে একশ’কা জমা রাখলে ১৯৭৫ সালে মদ্রাস্ফীতির কারণে আম র ঐ টাকার মূল্য যদি ৩০% কমে তবে ওই তিরিশ শতাংশ সাবসিডি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে জনগণ ক্রমহ্রাসমান মুদ্রা মূলের প্রেক্ষিতে বাৎসরিক ত্রিশচল্লিশ শতাংশ লোকসান করতে নিশ্চয় জমা রাখবে না। এই সাবসিডি সম্পন্ন না হলেও আংশিক হতে পারে। এবং তারপর দিতে হবে। সুদ তা যে হারই হোক না কেন।
ঋণ নিয়ন্ত্রণ
মুদ্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণই হল ঋণ বৃদ্ধি। ঋণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে গত কয়েক বছরই অনেকগুলি নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যেমন সোনা-রূপা বন্ধকী ছাড়া ঋণ প্রদান বন্ধ করা হয়। অবশ্য বাড়ীঘর মেরামত ও তৈরী এবং ব্যবসার জন্য স্থাবর সম্পত্তি বন্ধকীর বিপরীতে ঋণ দান অব্যহত থাকে। প্রথম অর্থ বছরেই ষ্টক এক্সচেঞ্জ সিকিউরিটি ডিবেনচার, শেয়ার ইত্যাদির বিপরীতে ঋণ দান বন্ধ করা হয়। কতকগুলি নির্বাচিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বিপরীতে সরকারকে বা সরকারী প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কাউকে ঋণ দান এ বছরই বন্ধ করা হয়। রপতানীকে সাহায্য করা ছাড়া জমিন অথবা পরিচছন্ন আগাম বন্ধ করা হয়। আমদানীর জন্যে নিষিদ্ধ পণ্যের বিপরীতে গত বছর নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় অর্থ বছর অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৪ সালে গত বছরের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিই চালু থাকে। কেবলমাত্র উৎপাদন সহায়ক কাজগুলির বেলায় ১২ মাসের উপরে নয় এমন সময়ের জন্যে কোন পার্টিকে সর্বোচচ পচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত গ্যারান্টিয়যুক্ত আগাম অথবা অন্য আগাম দেওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। এই সুবিধা চালু হয় ১৯৭৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে। উপরোক্ত ঋণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু থাকা সত্ত্বেও ঝণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠে। ১৯৭২-৭৩ সালের ১৮৫৯৪ কোটি টাকা বৃদ্ধির তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ২০৪৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৮১৬ ৯৩ কোটি টাকায় পৌছে। অতএব, বোঝা যায় উক্ত ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ তেমন কর্মক্ষম ছিল না। অর্থাৎ প্রকৃত পক্ষে তেমন কোন কার্যকর ঋণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এদেশে ছিল না। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে প্রকত পক্ষেই কিছু দৃঢ় ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অনুৎপাদনমুলক এবং ফটকা ব্যবসাকে সংহত করার জন্যেই এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু হয়। এর ফল হয় শুভ। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত সময় ঋণ প্রায় চুয়ান্ন কোটি টাকা হ্রাস পায়। পরবর্তী তিন মাসে আটত্রিশ কোটি টাকা ঋণ কমে আটশত সত্তর কোটি টাকা হয়। ঋণ ফেরতের দু’মাস নির্ধারিত সময় ছাড়াও পঞ্চাশ শতাংশ মার্জিন নিরুপণ এই পদক্ষেপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে চাপ প্রয়োগে ঋণ না নিতে পারে তারও ব্যবস্থা করা হয়।।
নোট অচলীকরণ
দারুণ মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে অর্থনীতিকে সচল করার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক এপ্রিল ১৯৭৫-এ এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়। একশত টাকার নোট অচল ঘোষণা করা হয়। এ পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত কিন্তু খুব একটা সহজ ছিল না। কেননা অচলীকরণের বিপক্ষে যুক্তি অনেক। তবু রাশিয়া বিলবোত্তর সময় মুদ্রাস্ফীতিকে প্রশমিত করার জন্যে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। আরও অনেক দেশ এপদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এর সার্থকতা খুব কম স্থানেই দেখা গেছে। দ্বিতীয়তঃ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে এ পর্যন্ত বার বার নোটকে অচল ঘোষণা গণমনে মধ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে অনাস্থার জন্ম দিতে পারতো। তবু এ পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং জনগণ এ পদক্ষেপে স্বাগত জানায়। মুদ্রা সরবরাহ কমান ছাড়াও চোরা কারবার বন্ধ করার প্রচেষ্টাও এর মধ্যে অন্তনিহিত ছিল। দেশীয় কালোটাকাকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে। অনাদেয় সরকারী করকেও কিছুটা জোর করে তুলে নেওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া সীমান্ত এলাকায় এক ধরনের নতুন উৎপাত চালু ছিল। কিছু বিদেশী ব্যবসায়ী বাংলাদেশী নোট কিনে নিয়ে জমা করছিল। এপ্রিল মে ধান পাকার সময় তখন তারা বাংলাদেশী টাকা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ধান কিনে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। এ থেকে দু ধরনের লাভ। প্রথমতঃ বাংলাদেশী টাকা ক্রয়ের ফলে বিনিময় হারের বিভিন্নতা হেতু লাভ। দ্বিতীয়তঃ ধান চাল সস্তায় কিনে চোরাকারবারী করার লাভ। অচল ঘোষণার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় শুভ। গুজব ছড়িয়ে পড়ে টাকা জমা দিলে তার হিসাব চাওয়া হবে। ফলে অনেক কালোটাকাওয়ালা প্রাণের ভয়ে লোকসানকে মেনে নিয়ে টাকা জমা দেওয়া থেকে বিরত হয়। ফলে মোটা অংকের মুদ্রা সরবরাহ কমে যায়। ধীরে টাকা বদলি নীতির ফলে কয়েক মাস মুদ্রা সরবরাহ দারুণ কম থাকে। এর প্রতিক্রিয়া সামান্য হলেও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর পড়ে। এ নীতি এক ধরনের জোর করা মেয়াদী আমানতের মত সব শেষে ঘোষণা করা হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ অংকের উর্ধে যাদের টাকা জমা পড়েছে তাদেরকে সঞ্চয়পত্র দেওয়া হবে। এর সময়কাল হবে সাত বছর। এ নীতির ফলে মুদ্রা সরবরাহ আরও হ্রাস পায়। সঞ্চয় জনগণের বিরাট অংশকেই কষ্ট দেয়। অনেকেরই সঞ্চিত সর্বস্ব সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। অনেকের স্বপ্নই ধুলায় মিশে যায়। তবু এ কথা সত্য যে অচলিকণ এক বৃহত্তর কল্যাণ আনতে সাহায্য করেছে। মার্চে যেখানে মদ্রা সরবরাহ ছিল ৮৮৯৬৩ কোটি টাকা সেখানে মাত্র এক মাসেই মুদ্রা সরবরাহ কমে হয় ৭৪২৩৫ কোটি টাকা। প্রধানতঃ এ নীতির জন্যেই জীবন-যাপনের সচী হ্রাস পায়। ফেব্রুয়ারী মাতো
এ সূচী ছিল যেখানে ৪৭৫’২৫ সেখানে মে মাসে হয় ৪৩০৭৬। এ কল্যাণকেও রাজনীতি কলষিত করে। রাজনৈতিক অনেক হোময়াচোমরারা নাকি বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনেক টাকা গোপনে ভাগিয়ে নেন। অনেকে আবার ধরাও পড়েন। এ সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। এর ফলে এ কল্যাণ সম্পূর্ণ সার্থক হতে পারেনি। সাত বছর মেয়াদী বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের একটি ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করতে হয়। হিসাব না নিয়ে গড়পড়তা সবাইকেই সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে সমস্ত কালো টাকাকে কর্তৃপক্ষ মেনে নেয় এবং তা সাত বছর পর সুদে সমেত ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেসাদা করে দেওয়া হয়। এই সাদাকরণের পেছনে রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করেছিল কিনা তা আমাদের জানা নেই।
জাতীয়করন
বাংলাদেশ চারটি মৌলিক আদর্শের উপর দণ্ডায়মান। সমাজতন্ত্র এদের মধ্যে মুখ্য। সমাজতান্ত্রিক নীতি আদর্শকে সার্থক করতে শিল্প কারখানা এবং ব্যাঙ্ক ইত্যাদি জাতীয় করণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ উদ্দেশ্যে এবং বিভিন্ন কলকারখানা পরিদর্শন এবং সমম্বয় সাধনের জন্যে কয়েকটি কর্পোরেশন তৈরী করা হয় ২৬শে মার্চ, ১৯৭২ সালে ঘোষিত এক নির্দেশের মাধ্যমে। পাট কারখানা কর্পোরেশনের অধীনে আছে ৭৭টি কারখানা। টেক্সটাইল কারখানা কর্পোরেশনের অধীনে আছে ৭২টি। চিনি মিল কপোরেশনের অধীনে আছে ১৫টি কারখানা। এছাড়া স্টীলমিল, কাগজ ও হাড়বোড়, সার রসায়ন ও ঔষধ, কারিগরি ও জাহাজ নির্মাণ, খনিজ তেল ও গ্যাস, খাদ্য তৎজাতীয় এবং বনজাত ইত্যাদি আরও কয়েকটি কর্পোরেশন সৃষ্টি করা হয়। ব্যাঙ্ক সমূহকে জাতীয়করণ করা হয়। এবং মাত্র দুটি ব্যাংক তৈরী করে প্রতিযোগিতামূলক কারবার চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। কাঁচা পাট রপতানী ব্যবসাকে ৩০শে মে ১৯৭২ সাল থেকে জাতীয়করণ করা হয়। এগুলিকে দেখাশোনার জন্যে তৈরী হয় পাট রপতানী কর্পোরেশন। ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য কোন ব্যবসায় জাতীয়করণ তেমন কোন সার্থকতা এনে দিতে পারেনি। বরং জাতীয় কত প্রতিষ্ঠানগুলি এক দিকে ব্যাংক সমুহ থেকে ঋণ নিয়ে মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়েছে অন্য দিকে উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ এর স্তর পর্যন্ত না আনতে অবস্থাকে আরও ভয়াবহ করেছে। মোট উৎপাদনের শতকরা ৮৫ ভাগই এসে থাকে জাতীয়ত প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে। অথচ এ প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কার্য ক্ষমতায় যায় সাম্যান্য শতাংশ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে কেবল বা ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানসহ ৫৫০ কোটি টাকা লোকসান দেয় পাট খাতে মাত্র সাত শতাংশ, চিনি ও লোহার কারখানায় যথাক্রমে ষাট ও ত্রিশ শতাংশ কার্যক্ষমতার ব্যবহার হয়েছে। এ সমস্ত তথ্য থেকে দেখা যায় জাতীয়করণ অর্থনীতিকে কোন সুবিধা তো দেয়নি বরং ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
শিল্প উৎপাদন :
কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৬৯-৭০ এর উৎপাদন স্তরে এখনও বাংলাদেশ পৌছতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ছিল অদক্ষ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা যন্ত্রাংশ ও কাচামালের অভাব, বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘন্তা, মিলের গোলমাল এবং শ্রম অশান্তি। আমরা একটি তালিকার মাধ্যমে
স্বাধীনতাউত্তর শিল্প উৎপাদন পরিস্থিতি দেখতে পারি।
দ্রব্য | ১৯৬৯-৭০ | ১৯৭২-৭৩ | ১৯৭৩-৭৪ | ১৯৭৪-৭৫ |
পাট জাত(হাজার টন) | ৫৮০ | ৪৪৬ | ৫০০ | ৪৪৫ |
তুলার সুতো(লক্ষ পাউন্ড) | ১০৫০ | ৮০৯ | ৯১৩ | ৯১৩ |
কাগজ(হাজার টন) | ৪৪ | ২৩ | ২৪ | ২৮ |
নিউজপ্রিন্ট(হাজার টন | ৩৬ | ২৭ | ২৭ | ২৯ |
সিগারেট (কোটীটি) | অপ্রাপ্য | ৬৩৪ | ১১৯০ | ১০৪৫ |
ম্যাচ(লক্ষ গ্রোস বক্স) | ১৩০ | ৫৯ | ৬২ | ৬২ |
সিমেন্ট (হাজার তন) | ৫৩ | ৩১ | ৫১ | ৮২ |
স্টিল(হাজার টন ) | ২২০ | ৬৭ | ৭২ | ৭৫ |
ইউরিয়া(হাজার টন ) | অপ্রাপ্য | ২০৭ | ২৭৪ | ৬৮ |
চিনি(হাজার টন ) | অপ্রাপ্য | ১৯ | ৮৮ | ৯৭ |
চা(লক্ষ পাউন্ড ) | অপ্রাপ্য | ৫৭১ | ৬০৭ | ৬৫২ |
তুলার কাপড় (লক্ষ গজ ) | ৫১২ | ৫৮৮ | ৭৯৪ | ৮৪৭ |
শুষ্ক ও বিক্রয় করের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অধিক আন্তর্জাতিক সহায়তা লাভের ফলে সরকারের রাজস্ব অবস্থার উন্নতি হবে। এ সমন্বয়ের ফলে অর্থপ্রেরণ প্রিমিয়াম প্রথা ও বিনিময় কর প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে। এতে বিনিময় হারের একীভূত প্রথা সৃষ্টিতে সাহায্য হবে। মোট কথা এ পদক্ষেপ অর্থনীতিকে সচল করতে সাহায্য করবে।
উপরোক্ত তালিকা থেকে দেখা যায় ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনীয় বলতে গেলে কোন উৎপাদনই আজ পর্যন্ত বাড়েনি। উপরন্তু ১৯৭২-৭৩ সালের স্তর থেকেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। শ্রম অশান্তি শিল্প এলাকায় লেগে থাকে। যদিও শ্রমিকরা শান্তির পক্ষপাতী ছিল এবং উৎপাদন বাড়াতে ছিল উৎসাহী। কিন্তু তদানীন্তন রাজনৈতিক (অস্পষ্ট) নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে এবং রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনের জন্যে উস্কানিমুলক তৎপরতা চালিয়ে যায়। যার ফলে উৎপাদনে হয় ক্ষতি এবং নতুন বিনিয়োগকে করে অনুৎসাহিত। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ সম্পর্কে অপরিচ্ছন্ন ধারণার জন্যে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন তেমন বাড়তে পারেনি। তাছাড়া ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী চালু ছিল। ঘোড়াশাল সার কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে । সার উৎপাদন ১৯৭৩-১৯৭৪ সালের প্রথম ১১ মাসে যেখানে ২.৬১ লক্ষ টন ছিল সেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালের ঐ একই সময় বিস্ফোরণের ফলে উৎপাদন কমে হয় মাত্র ০.৬০ লক্ষটন । পাট কারখানা গুলিতে একের পর আগুন লাগতে থাকে , এর ফলে প্রায় ষোল হাজার টন পাটজাত দ্রব্য পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এ সমস্ত ধ্বংসাত্মক কার্যাবলীর সামনে তা বিদেশি চক্রান্তেই হোক আর দেশী চক্রান্তেই হোক , গত সরকার অসহায় ছিলেন।
বিদেশি ত্রান ও সাহায্য
স্বাধীনতার পর থেকে ৩০ শে জুন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩২০.৩৭ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি করে। এ ধরনের ধার ও ঋণ চুক্তি সম্পাদিত হয় সোভিয়েত রাশিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুক্তরাজ্য , যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সুইডেন, ডেনমার্ক রুমানিয়া পশ্চিম জার্মানি, নেদারল্যান্ড এবং বুলগেরিয়ার সাথে। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্যে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্যের হিসাব দেখানো হয়েছিল ৩৫২ কোটি টাকা , কিন্তু সংশোধিত হিসাবে দেখা যায় যে ২৯৮ কোটি টাকার বেশী বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে না। ১৯৭২-৭৩ সালে পণ্য লেনদেন বাবদ ঘাটটির পরিমাণ ছিল ২০২.৮ কোটি টাকা । পরবর্তী বৎসর ১৯৭৩-৭৪ সালে ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪১৫.২ কোটি টাকায় দারাই। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ সালে আমদানি ব্যয় ১৭৯.১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬৬৭.৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায় এবং রফতানি আয় ৩৩৩.৩ কোটি টাকা থেকে কমে ২৫২.৩০ কোটি টাকা হয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই থেকে ১৯৭৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময়ে জুন মাস পর্যন্ত সময়ে রফতানি আয় ( বারটার ব্যবসা সহ) গত বছরের ২৮৫.৬ কোটি টাকার তুলনায় ২৫২.৩ কোটি টাকায় নেমে আসে রফতানি আয় কম হয় প্রধানতঃ জাহাজ পরিবহন সম্পর্কিত অসুবিধা, অভ্যন্তরীণ পরিবহন সম্পর্কিত বাধা বিপত্তি এবং ভারতের সঙ্গে যে “সুষম” বাণিজ্য ও পরিশোধ চুক্তি সম্পন্ন হয় তার অধীনে নির্ধারিত পরিমাণের তুলনায় কম পরিমাণ কাঁচা পাট রফতানি ইত্যাদি কারনে। ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সালে বিভিন্ন পণ্য থেকে যে রফতানি আয় হয় তার পরিমাণ নিম্নরুপঃ
১৯৭২-১৯৭৩( কোটি টাকায় ) | ১৯৭৩-১৯৭৪( কোটি টাকায় ) | |
পাটজাত দ্রব্য | ১৫৪.৮ | ১২৬.৯ |
কাঁচা পাট | ১০১.২ | ৮৪.৬ |
শুকনো মাছ | ১০.৫ | ৭.৩ |
মাছ | ৫.২ | ৯.২ |
পশুচর্ম ও চামড়া | ৩.৫ | ৭.২ |
অন্যান্য | ৫.৭ | ১৭.৯ |
বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতিকুল ভারসাম্য ১৯৭৪-৭৫ সালেও অব্যাহত থাকে। জুলাই ১৯৭৪মার্চ ১৯৭৫ সময়কালে পণ্য খাতে (দৃশ্যমান রফতানি বাদ আমদানি) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮২.৪০ কোটি টাকায়। পূর্ববর্তী বছরে ঐ একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৬৬.৬০ কোটি টাকা। অনুরুপ ভাবে “সার্ভিসেস” (অদৃশ্যমান রফতানি ব্যয় বাদ আমদানি) খাতে জুলাই ১৯৭৪- মার্চ ১৯৭৫ সময় কালে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৫.০০ কোটি টাকায়। তুলনামুলকভাবে পূর্ববর্তী বছরে একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫০.০০ কোটি টাকা। কয়েকদিন আগের বাংলাদেশ ব্যাংক করতিক সরবরাহকৃত তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে অবশ্য বছরের প্রথম নয় মাসে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে যেখানে ঘাটতি ছিল ৬.৯০ কোটি টাকা সেখানে পরবর্তী বছরে সাকুল্য বাড়তির পরিমাণ ছিল ৫৯.৭০ কোটি টাকা। অপরিশোধ্য বৈদেশিক অর্থ সমাগম বিশেষ বৃদ্ধি এবং নীট মূলধন প্রাপ্তিই লেনদেনের ভারসাম্যের অনুকুলতার প্রধান কারন।
বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ
বাংলাদেশ স্বাধীন হয় শূন্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে। এবং বাংলাদেশ বাঙ্কে রক্ষিত সোনার পরিমাণ ও দাঁড়ায় শূন্য। সমগ্র বিশ্বের সহানুভূতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থা সত্তর উন্নত হয়। জুন ১৯৭২ এ এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১১০.৫০ কোটি টাকা । ডিসেম্বর ১৯৭২ এ মজুদের পরিমাণ শৃঙ্গে পৌঁছে দুইশ সতের কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি সমগ্র ১৯৭৩ সালে মোটামুটি ভালই থাকে। কিন্তু পরবর্তী বছরে দেখা দেয় সঙ্কোচন । আগস্ট ১৯৭৪ এ এর পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র পঁয়ত্রিশ কোটি টাকা। কুয়েতি ব্যাঙ্কের আমানত আসে নভেম্বর ১৯৭৪ এ। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক সুত্র থেকে এর পরিসংখ্যান পরবর্তী সময়ের জন্যে না পাওয়া গেলেও ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে এর পরিমাণ একশ সাতাশি কোটি টাকা হয় বলে ১৯৭৪ এর ব্যাঙ্ক –বার্ষিক রিপোর্টের মূল বক্তব্য থেকে জানা গেছে। এ বৃদ্ধি প্রধানতঃ বন্ধু ভাবাপন্ন দেশসমূহ হতে প্রাপ্ত অনুদান ও ঋণ এবং আন্তজাতিক অর্থ তহবিল থেকে গৃহীত তেল বাবদ সাহায্যকেই প্রতিফলিত করে।
বিনিময় মূল্য পুননির্ধারণ
মুদ্রাস্ফীতি এবং দারুণ দারিদ্র্যের প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে শ, টাকার নোট অচল ঘোষণা করা হয়। এবং তার এক মাসের মধ্যেই ঘোষণা করা হয় দ্বিতীয় রণনীতি-বিনিময় মূল্য পুননির্ধারিত ।
বিনিময় মূল্যে কেন পরিবর্তন করা হল তা দেখা যেতে পারে। দীর্ঘ দিন যাবত সরকারী বিনিময় হারের সাথে খোলাবাজারি বিনিময় হারের অসামঞ্জস্য ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছিল। খোলাবাজারের বিনিময় মূল্যই প্রকৃত চাহিদা ও সরবরাহের ফলাফল। সুতরাং তা নিসন্দেহে অপেক্ষাকৃত সঠিক। অথচ কর্তৃপক্ষ এ সঠিক মূল্য থেকে বহুদুরে নির্ধারণ করেছিলেন বিনিময় মূল্য। সরকারী ও খোলাবাজারি বিনিময় মূল্যের পার্থক্যের জন্য জন্ম নিয়েছিল চোরাচালান । খোলা বাজারি বিনিময় হার সরকারী হারের এ পার্থক্য জন্ম দিয়েছে উৎপাদন হ্রাস , আমদানি –রফতানির ভারসাম্যহীনতা এবং মুদ্রার প্রলয়ংকারি বৃদ্ধির গর্ভে। একদিকে উৎপাদন হ্রাস এবং অন্নদিকে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি উভয় বিনিময় হারের উপর ঘুনের কাজ করে। এই সমস্ত প্রেক্ষিতে বিনিময় হারের পরিবর্তন করা হয়। মুদ্রামূল্যের এই পরিবর্তন স্বভাবতঃ আমদানিকে করবে সংযত। রফতানি পাবে বৃদ্ধি। চা ও পাটের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের সাথে প্রতিযোগীতায় বাংলাদেশ পেরে উঠছিল না। নতুন মূল্যমানে হয়তো পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যে কল্যাণকর হবে। বিনিময় মূল্যের এই পুন নির্ধারিত মান সরকারী আয়কে বাড়াবে। আমদানি পণ্যের মূল্য এখন বেশী হবে। সুতরাং মুল্লের উপর নির্ধারিত ট্যাক্সের (এডভেলোরেম ট্যাক্স ) পরিমাণ এখন বেশী হবে। বিনিময় হারের এ পরিবর্তন না হলে সরকারের ব্যয়ভার লাঘব হতো না । ঘাটতি অর্থায়ন এবং পাটের জন্যে ভর্তুকি ব্যবস্থা মুদ্রা সরবরাহকে বাড়িয়ে ছিল। পাট ও পাটজাত দ্রব্যের উপর সরকার প্রায় ৫৮ কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছেন। বর্তমান ব্যবস্থায় মুদ্রাস্ফীতির এসব কারন মুছে দিল। টাকার বিনিময় হার সমন্বয়ের ফলে আশা করা যায় যে, দেশের রফতানি ও কাঁচামাল আমদানির হার বাড়বে। ফলে শিল্পোৎপাদন ক্ষমতার অপচয় রোধে সুবিধা হবে। অধিকন্তু রফতানি ভর্তুকি রহিতকরন, আমদানি শুল্ক ও কিক্রয় করের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অধিক আন্তজাতিক সহায়তা লাভের ফলে সরকারের রাজস্ব অবস্থার উন্নতি হবে। এ সমন্বয়ের ফলে অর্থপ্রেরণ প্রিমিয়াম প্রথা ও বিনিময় কর প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে। এতে বিনিময় হারের একীভূত প্রথা সৃষ্টিতে সাহায্য হবগে। মোট কথা এ পদক্ষেপ অর্থনিতিকে সচল করতে সাহায্য করবে।
গণ অর্থায়ন ও বাজেট
স্বাধীনতার সংগে সংগে প্রথম বাজেট তৈরী করা হয় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ৩০শে জুন, ১৯৭২-এর জন্যে যেখানে আয় ছিল ৪৮৫২ কোটি টাকা এবং ব্যয় ছিল ৯৯:১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫০*৬১ কোটি টাকার ঘাটতি।। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মোট বাজেটে ছিল ৭৮৬°৩৮ কোটি টাকা যার মধ্যে ২৮৫°৩৮ কোটি টাকা ছিল রাজস্ব বাজেট এবং ৫০১০০ কোটি উন্নয়ন বাজেট। রাজস্ব বাজেটের আয় ছিল ২৮৫’৩৮ কোটি এবং ব্যয় ছিল ২১৮৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ উদ্ববৃত ছিল ৬৬১৫ কোটি টাকা। ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশ বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয় ৪১১৩ কোটি টাকা এবং রাজস্ব ব্যয় ধরা। হয় ২৯৫*৩০ কোটি টাকা। এতে উত্ত দাঁড়ায় ১১৬*০১ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্যে ব্যয় নির্ধারিত হয় ৫২৫°৩৫ কোটি টাকা। এই পরিকল্পনায় পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী অর্থ বছর অর্থাৎ ১৯৭৪-৭৫ সালের বাজেটে রাজস্ব আয় দেখানো হয় ৫৯৫৫০ কোটি টাকা এবং খরচ দেখানো হয় ৫৩১১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ উধত্ত থাকে ৬৪৩৭ কোটি টাকা। ১৯৭৫-৭৬ সালেও উদ্বও বাজেট ঘোষণা করা হয়। রাজস্ব আয় থাকে এখানে ৭৫৫৩৮ কোটি এবং ব্যয় দেখানো হয় ৫৯৯’১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ উদ্যত্ত থাকে ১৫৬’ ১৯ কোটি টাকা। এই অর্থ বছরে উন্নয়নের জন্য ৯৫০ কোটি টাকার এক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। গত বছরের ৫২৫ কোটি টাকার পরিকল্পনার চেয়ে বর্তমান বছরের পরিকল্পনা প্রায় দ্বিগুণ। উত্ত বাজেট ঘোষণা অর্থনীতির জন্যে একটি আশাজনক ঘটনা। মুদ্রাস্ফীতিকে সংকোচন করতে গেলে এখন এ ব্যবস্থা সময়োপয়ে ! তদুপরী নতুন কোন কর প্রস্তাব না থাকাও একটি নবতর ঘটনা ছিল। সর্বশেষ পরিস্থিতি গত সরকারের অর্থনৈতিক ব্যর্থতার ফলাফল হিসাবে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে তা থেকে জনগণ প্রাথমিকভাবে আশা করে মূল্যমানের নিম্নগতি। নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই চালের দাম কমতে আরম্ভ করে। যদিও এই হ্রাস স্বাভাবিক ছিল না। ভীতি থেকে মজুদারের চাল বাজারে বেশী ছেড়ে দেওয়ার ফলে চালের দামে এ পতন দেখ যায়। এর পিছনে কোন অর্থনৈতিক কারণ ছিল না। সুতরাং এ অবস্থা টেকেনি। তবে এ কথা প্রমাণ করেছে ব্যবসায়ীরা ইচেছ করলেই চালের দাম কমাতে পারে। সুতরাং জনগণ আশা করে সামরিক সরকার চালের দামের পতন ও উত্থানকে বিশ্লেষণ করে বাজারে সঠিক সরবরাহের ব্যবস্থা করবেন। মুদ্রা সরবরাহের বর্তমান যে গতিধারা চলছে তা থেকে মনে হয় যে নিকৃষ্টতম চাল এখন পাওয়া যায়। সাড়ে তিনটাকা সের দরে তা আগামী ডিসেম্বরে পাওয়া যেতে পারে তিনটাকা দরে। কাপড়, আটা ও অন্যান্য দ্রব্যের দামের যে পতন দেখা যাচেছ তাকে রক্ষণ করা প্রয়োজন, আর যেগুলির দাম বাড়ছে তার সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।
সমাপ্তি
স্বাধীনতাউত্তর এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান ভূলই ছিল সংজ্ঞায়। বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক দেশ’ বলে ঘোষণা করা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে গত সরকার পুজিবাদের এক চমৎকার হাতিয়ার হিসাবেই সমাজ তন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন। কারণেই , সমাজতন্ত্রের কোন ব্যখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর যে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিই কুয়াশাচছন্ন সে রাষ্ট্রের অর্থনীতি কখনোই পরিচছন্ন উন্নতির ধার রাখতে পারে না। অতএব সর্বপ্রথম প্রয়োজন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংজ্ঞা নির্ধারণ। সেই সংজ্ঞার ওপর নির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে সম্পষ্ট পরিকল্পনা। এর জন্যেই চাই অধ্যবসায়। প্রশাসন ও পরিচালনে সরকারকে আরও সুষ্ঠ, নীতি গ্রহণ করতে হবে। গণ সমর্থনের জন্যে অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে এই মুহুর্তে অধিকতর দৃঢ়তার সংগে অর্থনীতিকে নতুন করে ঢালিয়ে সাজাতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতিই গণ সমর্থনের সব থেকে বড় পন্থা।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1975.10.02-bichitra-1.pdf” title=”1975.10.02 bichitra”]