শেখ মুজিবুরের উত্থান ও পতন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২ অক্টোবর ১৯৭৫
এনায়েতুল্লাহ খানের নিজস্ব প্রতিবেদন
শেখ মুজিবুর রহমানের অকাল পতন আমাকে অবাক করেছে একথা বললে অত্যুক্তি হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তোবা আপাত বিস্ময়ে চমকিত হয়েছি। বৈরিতা সত্ত্বেও বেদনার অঙ্কুশে বিদ্ধ হয়েছি দরুদুরু ভবিষ্যৎ চিন্তায় অকারণে উদ্বেলিত হয়েছি। কিন্তু এ সবই নিছক রাজনৈতিক ভাবনা, মধ্যবিত্ত মানুষের স্বভাবগত প্রক্রিয়া। তাই মুহূর্তের বিমূঢ়তা পরক্ষণে স্বস্তির আশ্বাসে উচচকিত হয়েছে ; কালান্তরের ঘন্টাধ্বনি শৃঙ্খলিত চেতনাকে উজ্জীবিত করেছে। কথাগুলো অপ্রিয়—প্রকারান্তরে নিষ্ঠুর—কিন্তু নিদারুণ সত্য বটে। যেমন সত্য নিয়তির অমোঘ বিধান কিংবা ইতিহাসের নির্মম বিচার। এ দুয়ের তফাৎ মৌল। প্রথমটি সংস্কার, দ্বিতীয়টি বিজ্ঞান। কেউ বলেন ভবিতব্য, কেউ বলেন ডায়ালেকটিকস। কিন্তু উভয়েরই পরণাম অবশ্যম্ভাবিতায় শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তার অধিষ্ঠান এবং পরশেষে স্বর্গ হতে বিদায় এই অবশ্যভাবতারই বিয়োগান্ত আলেখ্য।
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একদিকে নাটকীয়তায় চমকপ্রদ, অন্যদিকে বৈধতায় খন্ডিত। তাঁর ক্ষমতারোহনের অভিযাত্রা বিগত এক দশকে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছিল।
অগনিত আত্মদান এবং একঝুড়ি রপেকথা মিলিয়ে তৈরী হয়েছিল তাঁর স্বর্গের সিড়ি। ব্যক্তিত্বের অপরিমিত শৌর্য ও অনুকূল ইতিহাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠে ছিল তাঁর রাজকাহিনী। তিনি ছিলেন রূপকের রাজা। সত্যিকারের মুকুটের ভার তাই তিনি বইতে পারেননি। উপরন্তু সেই ভারে ন্যুজ হয়েছেন। রক্তকরবীর আত্মবিমোহিত রাজার মত দুশাসনের অচলায়তন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। যারা প্রাণ দিল, ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে পদাঘাত করে নিরদ্বিধায় অস্ত্র তুলে নিল, যারা দেশপ্রেমের সুমহান অঙ্গীকারে রক্ত দিয়ে মাতৃভূমির ঋণ শোধ করলো তাদেরই রক্ত-মাংস, হাড়ের বিনিময়ে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন এক অলৌকিক ক্ষমতার দেউল। সেখানে দেবতা একক, কিন্তু পুজারী নেই। মানুষকে বাদ দিয়ে শুরু হলো বিগ্রহের রাজনীতি, পুতুলের খেলা। পরদেশী পটুয়ার হাতে সৃষ্টি হলে পুতুলের রাজা শেখ মুজিবুর রহমান।
আমার এ কথা নিষ্করন জানি, কিন্তু ইতিহাস আরও বেশী নির্মম । এবং তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পনেরই আগষ্ট। হঠাৎ দ্রিমি দ্রিমি শব্দে বিদীর্ণ হলো নিস্তব্ধ প্রভাত। এক ঝাঁক আগ্নেয় সীসে লক্ষ কোটি মানুষের নিবীর্য রোষের আকস্মিক বিস্ফোরণের মত, নিপাত করল পুতুলের রাজত্ব। সেনাবাহিনীর একদল বীর তরুণ নিষ্কল্প হাতে সমাধা করল পরিবর্তনের ঐতিহাসক দায়িত্ব। এরই নাম ভবিতব্য অথবা ইতিহাস।এই পুতুল নাচের ইতিকথা রাজনীতি বা ইতিহাসবিযুক্ত নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গোত্রীয় ক্ষমতার অভিলাষ এবং সাম্রাজাবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার ইতিবৃত্ত ! সে এক বিচিত্র কাহিনী। সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৃঙ্খন একাত্তরে চরমতম জাতিগত নিপীড়ন -ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল তখনও পর্দার আড়ালে চলছিল আপোসের জয়ীখেলা। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও একাত্তরের গণপ্রতিরোধকে নিবৃত্ত করবার জন্য শুরু হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।
ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও একাত্তরের গণপোরাধকে নিবৃত্ত করবার জন্য শুরু হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।কিন্তু ইতিহাস স্থবির নয়
যে জাতকের ইচেছর উপর তার গতিধারা নিয়ন্ত্রিত হবে। তাই জাতীয় মুক্তির বিভ্রম সৃষ্টির হীন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও স্ফীত হয়েছিল গণবিদ্রোহ। একাত্তরের পচিশে মার্চ ব্যাপী সেই গণবিদ্রোহকে বিধ্বংস করবার রক্তক্ষয়ী প্রচেষ্টা মাত্র। সেই আত্মদান বাংলার মানুষের ব্যক্তির নয়। দলমত নির্বিশেষে সকলশ্রেণীর দেশ প্রেমিকদের গোষ্ঠীর নয়। পক্ষান্তরে সেই ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী ক্ষমতার রাজনীতির প্রছচ্ছায় গণ বিপ্লব প্রতিরোধকে ঠেকাতে হয়েছে। সেবারও চট্টগ্রামের অবরোধ ও জয়দেবপুরের সেনাবিদ্রোহ পাবনার বৈকৈল্পিক সমাবেশ কুমিল্লার ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ঐতিহাসিক প্ৰতিরোধ তদানীগঞ্জ প্রেসিডেন্ট ভবনের গোপন আলাপনকে নস্যাৎ করে গণবিদ্রোহের প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আপোষকামী নেতই জনগণের চিত রক্তদানকে অস্বীকার করে গোল টেবিলে দেশবিভাজনের স্বপ্ন দেখে ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান পচিশে মার্চ সন্ধ্যায়ও তাই মন স্থির করতে পারেননি। তাঁর শেষ আহবান ছিল সাতাশে মার্চের হরতাল, স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়। সেই সঙ্কটকালেও এগিয়ে এসেছিল সামরিক বাহিনী এবং বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ ও যুবাদের দল। তবুও সেই যুদ্ধ গণযুদ্ধে রুপায়িত হতে পারেনি। কেননা বৈদেশিক চক্র এই সংগ্রামকে নিজ খাতে প্রবাহিত করবার জন্যে বদ্ধপরিকর ছিল। মুক্তিবাহিনীর প্রতি চরম অবিশ্বাস হেতু সৃষ্টি হলো তথা কথিত মুজিববাহিনী। জনযুদ্ধের অভিযাত্রাকে রুখবার জন্য করা হলে সামরিক হস্তক্ষেপ।
এই চক্রান্তের ইতিহাস সুদীর্ঘ যখন মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীরা গেরিলাবাহিনীর তরুণেরা এবং দেশের অভ্যন্তরের বিপ্লবী যোদ্ধারা জনযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে জাতীয় মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোবার জন্যে যুদ্ধ করছিল, তখনই মুজিব নগরের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এই চক্রান্ত দানা বেধে ওঠে। এই চক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ন্ত্রিত করবার চক্রান্ত, পরবর্তীতে নেতত্বকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করবার চক্রান্ত । যারাই তখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তাদেরই কপালে জটে
জুটেছে অপপ্রচারণা ও রাজনৈতিক নিগ্রহ। মওলানা ভাসানীর অন্তরীণ, খন্দকার মোশতাক আহমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণা বামপন্থী দেশপ্রেমিক শক্তিকে নির্মূল করবার পরিকল্পনা এবং মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বকে হেয় করবার অপচেষ্টা এই চক্রান্তেরই অঙ্গ। পরলোকগত দুর্গাপ্রসাদ ধারয়ের (ডিপির) অঙ্গলি হেলনে পরিচালিত মুজিবনগর সরকারের বশংবদ নেতৃত্ব ও প্রশাসন এবং সম্প্রসারদের সৎ মুজিব বাহিনীর প্রতিবিপ্লবী কার্যক্রম একাত্তরের সংগ্রামের সবচাইতে মসলিন্ত অধ্যায়। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেবে, সাক্ষ্য দেবে জাতীয় মুক্তির প্রত্যাশী এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী লক্ষকোটি দেশপ্রেমিক জনগণ।
এরই ফলশ্রুতি ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭৯ ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ও আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় মুক্তির পরিবর্তে দেশবাসী পেল এক পুতুল সরকার এবং সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে পুতুলনাচের ইতিকথা।
শেখ মুজিবুর রহমান এই ইতিকথার নেপথ্য নায়ক। আগরতলার কুখ্যাত ষড়যন্ত্র মামলা এবং একাত্তর সালে মুজিববাহিনীর অভ্যুদয় কোন বিচিছন্ন ঘটনা নয় বরঞ্চ বিচিছন্নতাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের পর্যায়ক্রমিক ঘটনাপঞ্জী। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং সম্প্রসারণবাদবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে এর মৌলিক তফাৎ রয়েছে। প্রথমটি বাঙ্গালী বজোয়ার সবচাইতে ঘৃণ্য ও মেরুদন্ডবিহীন অংশের ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত এবং দ্বিতীয়টি বাঙ্গালী জাতীয় বর্জোচার দেশপ্রেমিক আংশসহ সকল শ্রেণীর মানুষের জাতীয় ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম। আমার বেদনাবোধ হয় এই জন্যে যে শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন সত্ত্বেও তাঁর সংকীণ শ্রেণীচেতনা, বিদেশী প্রভার দায়বদ্ধ রাজনীতির শৃঙখল মোচন করতে পারেননি। বরঞ্চ পুতুলের মত—হয়তবা অনিচছুক পুতুলের মত—প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে তার দ্বৈত ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি ছিলেন দক্ষ নট অভিনয়ের চাতুর্যে ঐতিটি নাটকীয়, মুহূর্তে দর্শকবৃন্দের তুমুল করতালি কুড়িয়েছেন, বাগ্মিতার সম্মোহণে বিভ্রমের মায়াজাল রচনা করেছেন। জাতীয় স্বাধীনতার মহানায়কের শিরোপা পরিধান করেছেন। কিন্তু বারবার ষড়যন্ত্রের ঋণ
শুধতে গিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সেখানেই তার ট্রাজেডী। শেখ মুজিবুর রহমানের অন্য পরিস্থিতিতেও এ কাহিনীতে ছেদ পরেনি। সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট অতিবিপ্লবী মুজিববাহিনী একাত্তর সালে তার পক্ষ হয়ে প্রতিনায়কের ভূমিকা পালন করেছে। এই বিকল্প বাহিনী সেই ষড়যন্ত্রী রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার। মুজিববাদের তথাকথিত ভাবদর্শন, মুজিবের শাসনের ফ্যাসিবাদী তত্তৰ, ভাষা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃত এই একই পরিকল্পনার অংশবিশেষ।
মুজিববাদ ও মুজিববাহিনীর কাহিনী আজো ইতিহাসে অনুল্লিখিত। এই অতিবিপ্লবী তত্তৰ ও সংগঠন শুধুমাত্র ব্যক্তি শাসন কায়েম করবার জন্যই সৃষ্টি করা হয়নি, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট সম্প্রসারণবাদী আধিপত্যকে নিরকুশ করবার জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের রক্ষীবাহিনী মুজিব বাদ ও মুজিববাহিনীরই সাংগঠনিক রুপ। মুজিববাদ ও মুজিববাহিনী • সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ছিল ত্রিবিধ ।
(ক) মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে। মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি ও আধিপত্যকে খর্ব করা, (খ) গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট দেশপ্রেমিক বিপ্লবী সামজিক শক্তির – মোকাবেলা করা এবং (গ) প্রয়োজনবোধে শেখ মুজিবুর রহমানের অবরতমানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। প্রায় দুটো কারণের জন্য মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে মুজিববাহিনীর তীব্র দ্বন্দর সৃষ্টি হয়েছিল এবং তৃতীয় কারণের জন্যে সম্প্রসারণবাদের বংশবদ মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব ও প্রশাসনের সঙ্গেও সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল।
একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই এলিট ফোর্স সৃষ্টির ইতিহাস আরও বিচিত্র। মুজিববাহিনীর নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা • অনুযায়ী শেখ মজিবুর রহমানের
হস্থলিখিত পত্রের উপর ভিত্তি করে এবং তারই – নির্বাচিত উত্তরাধিকারীদের (?),
নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক বাহিনী গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, দেরাদনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই বিশেষ প্রতিবিপ্লবী সংগঠন জেনারেল ওসমান নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী, এমনকি তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকারেও নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিলনা। জৈনিক ভারঞ্জয় সেনাপতির প্রত্যক্ষ পরিচালনায় সংগঠিত তথাকথিত মুজিববাহিনীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সাংগঠনিক কাঠামো এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত এ কথাই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে এই বাহিনী মৌলিক বিরোধ ছিল। বিরোধের সম্ভাব্য কারণ আমি আগেই উল্লেখ করেছি।
যদি শেখ মুজিবুর রহমানের পত্রের কথা সত্যি হয়ে থাকে তবে একথাও প্রতীয়মান হয় যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ উদ্দেশ্যের সঙ্গে মুজিববাহিনীর গভীর যোগসূত্র রয়েছে। দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে শেখ মুজিবুর রহমানের পদতরাণের এ ভূমিকা পূব নির্ধারিত ছিল। – মঞ্চসফল নায়কের মত তিনি নেপথ্যের কুশলী পরিচালকের ইঙ্গিত প্রতি পদে পালন করে গেছেন। তিনি ছিলেন ভাগ্যের বরপুত্র। কিন্তু এচিলিসের গোড়ালীর মত তাঁর অজেয় ভাগ্য ১৫ই আগষ্ট মহতের যন্ত্রণায় নিঃশেষিত হয়ে যায়।। এখানে উল্লেখ্য যে মুজিবনগর সরকার ও প্রশাসন, মুজিববাহিনী এবং তথাকথিত কাদেরীয়া বাহিনীর মধ্যেকার দ্বন্দের সঙ্গে বাঙ্গালীর কোন সম্পর্ক ছিলনা। এই দ্বন্দ আন্তু স্বার্থের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ, ক্ষমতার প্রসাদপ্রাতির লড়াই। একাত্তরের যুদ্ধের অনিশ্চয়তা,দীর্ঘসুত্রিতার আশঙ্কার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎউপরোক্ত দ্বন্দকে তীব্রতর করে তোলে। কিন্তু তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। কেননা সব পতুলের মাঝে তিনি পুতুলের রাজা। রূপকের মাধ্যমে সৃষ্ট তার ভাবমূর্তি, প্রচারণার স্পশমণিতে উদ্দীপ্ততার আত্মদানের রপকাহিনী, এবং সর্বোপরি তার ব্যক্তিত্বের অপরিমিত শৌর্য ও ঐতিহাসিক নিবন্ধ জাতীয় স্বাধীনতার বিভ্রম সৃষ্টিতে অনেক বেশী কার্যকর। জনগণের বিমত ভালাবাসার বর্ণচ্ছটায় আলোকিত ভাবমূর্তি তার শ্রেণীচরিত্রের রঙ্গীন প্রচছদ মাত্র। বাঙ্গালী বুর্জোয়া নিকৃষ্টতম ও মেরদন্ডবিহীন মৎসী শ্রেণীর তিনি। ছিলেন যোগ্যতম, শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি।
পুতুলনাচের ইতিকথার পরের কথা তাই বিচিত্রতর। এই উৎপাদন বিমুখ, লুণ্ঠনপ্রিয়, পরাভূতশ্রেণী স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের ওপর নির্ভরশীল হবে। ঐতিহাসিক কারণে এবং উপমহাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে উপরোক্ত তিন শক্তিত্রয়ের সমন্বয় ও দ্বন্দ পৌনঃপনিকভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মুৎসুদ্দী বুর্জোয়ার আন্তর্জাতিক নির্ভরতার নিক্তিকে প্রভাবিত করেছে। বিগত সাড়ে তিনবছর এই পরামখতার মুল স্তম্ভ ছিল সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনস পৃষ্ট সম্প্রসারণবাদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তাদেরই নির্দেশে নির্ণীত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক গতচেতনাকে পায়ে মাড়িয়ে সার্বভৌমত্বের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে, জাতীয় অর্থনীতি ও উন্নয়নের স্বার্থকে ধ্বংস করে এবং সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে এই শক্তি-জোটের স্বার্থে অবনমিত করে শুরু হয়েছিল পরিকল্পনার দ্বিতীয় অধ্যায়। এরই ফলশ্রুতি একদল, এক-নেতা, একদেশেরই পরিণাম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য। এরই অবশেষ লুণ্ঠিত, লাঞ্ছিত, মত্যুকীণ বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমান এই নাট-কের নিরুপায় ক্রীড়নায়ক। তাঁর অসচ্ছতা আমি স্বচক্ষে দেখেছি, দেখেছি দায়বদ্ধ মানুষের নিষ্ফল ইচ্ছের বিলাপ। এখানেই ছিল তার দ্বৈধতা, তিনি ছিলেন কিংবদন্তী নায়ক। তার রাজনীতির প্রকিয়া দ্বিচারণে অতুল্য। কিন্তু ঋণগ্রস্থতার দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বার বার ‘চক্রবৃদ্ধিহারে তিন মুল্যের কড়ি গুণছিলেন। তার প্রাপ্য ছিল শুধুমাত্র ক্ষমতার ময়ূরসিংহাসন।
আমি এ প্রসঙ্গের দীর্ঘ অবতারণা করেছি শুধুমাত্র এ কথা বলবার জন্যে যে ‘ বাংলাদেশের সমাজবিন্যাস, সামাজিক স্তর এবং ঐতিহাসিক পটভূমির প্রেক্ষিতে ব্যক্তি দৌর্বল্য কিংবা ব্যক্তি দুঃশাসন, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক স্থবিরতা শেখ মুজিবুর রহমানের অকাল পতনের প্রধান কারণ হতে পারে না। কেননা রাজনীতি ও ইতিহাস নিজস্ব গতিবেগে এগিয়ে চলে। সেখানে ব্যক্তি গৌন, মুখ্য শুধ, ঘটনাপ্রবাহের ডায়নামিক্স। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উখান এবং পতন এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই নিহিত ছিল। তার সম্রাটের বন উপজাতীয় গোষ্ঠীপ্রিয়তা, আকাশচুম্বী, অহম এবং আত্মবিমোহন। তারই দায়বদ্ধ আত্ম ও শ্রেণীসঞ্জাত অপূতি আগ্রাসী (Aggressive)অভিব্যক্তি। যতোই তিনি হাজারো সুতার বাঁধনে জড়িয়ে গেছেন ততই বুদ্ধি পেয়েছে তার আত্ম বিভ্রম ইংরেজীতে যাকে বলা হয় Paranoia আমার কারামুক্তির পর ২৯শে লাই তার সাথে দেখা হয়েছিল । বিক্ষিপ্ত পদচারণায় অস্থির শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ?
“Perhaps the whole thing was a sabotage. I am sorry for what happened to you.
But my hands were tied.” তার রাজনীতির বিচারণ সত্ত্বেও করেছিলাম। কেননা আমি জানি পুতুলের রাজনীতি কতো নিষ্করণ। সেখানে রাজা সাজা যায় কিন্তু ইচেছমত রাজ্য শাসন করা যাইয় না ।নিপূণ ক্রীড়া তাকে গরিমা দিয়েছিল কিন্তু প্রাণ দেয়নি, পোশাকী বৈভবে বিভূষিত করেছিল কিন্তু স্বাধীনতা দেয়নি। এক-নেতা একদল এই প্যান্টো, মাইম (Pantomime) প্রদর্শনীর সর্বশেষ পর্ব।
বিগত সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের দঃখী জনগণ এই অবাক প্রদর্শনীর মৌন দর্শক ছিলেন। তাদের নিঃশব্দ আতিতে ধ্বনিত হচিছল কতিপয় টেরায় অট্টনোল। আর তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র যারা সমাজতন্ত্রের ছলে, মৈত্রীর ছদ্মবেশে এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে আরালে বাংলাদেশকে বৈদেশি স্বার্থের অবারিত লীলাক্ষেত্রে পারগত করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে বাঙ্গালী বুর্জেয়া নিকটতম মেরুদণ্ডবিহীন মৎসন্দীকলে দেশের অর্থনৈতিক ঐ সামাজিক ভিত্তিকে ধংসকল্পে পর দেশী বাণিজ্যিক পুজির সেবাদাসের ভুমিকায় নিয়োজিত ছিল। এরই সাংগঠনিক রুপ ছিল দেশপ্রেমিকদের ত্রিদলীয় ঐক্যজোট। এই ঐক্যজোটের নীল নকশা পরিশেষে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে রূপায়িত হয়।
ফলতঃ একদিকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাববলয়ে আপতিত হয় এবং অন্যদিকে পূর্বে ভারতের সোথ শিল্পকেন্দ্রের প্রায় ঔপনিবেশিক পশ্চাদভূমিতে পরিণত হয়। দেশের উৎপাদিকা শক্তিকে সপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করবার ইতিহাস বিংশ শতাব্দীতে বিরল। অষ্টাদশ শতকের ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলের লটেরা বাণিজ্যিক পুজির অবাধ লুণ্ঠনের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। এই দ্বৈত চক্র কখনো এককভাবে, কখনো যুগ্মভাবে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কায়েম করবার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিধারা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় স্বাধীনতাকে বৈদেশিক প্রভুদের স্বার্থে নস্যাৎ করবার জন্য এই চক্রজোট পৌত্তলিকতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে, মুজিববাদের ফ্যাসিবাদী দর্শনকে নিপীড়নমূলক পৌত্তলিক রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে দিয়েছে দেশপ্রেমিকদের ঐক্যজোটের অপর দুটো রাজনীতি ও বৈদেশিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক দল।
এক-নেতা একদল শেখ মুজিবুর রহমানের একক আত্মচিন্তা নয়। বিগত সাড়ে তিন বছরের দেশপ্রেম বিরহিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি। আর সে জন্যেই তার পতন শুধুমাত্র অবাধ দুর্নীতি, লুণ্ঠন, দুশাসন, গোষ্ঠীপ্রিয়তা ও পারিবারিক শাসন প্রতিষ্ঠার কারণজনিত নয়। এর মৌল কারণ পূর্বে উল্লিাখিত রাজনীতি ও ইতিহাসের মুখে নিহিত। আমি বারবার একই কথায় ফিরে আসছি কারণ আমার দৃষ্টিতে রাজনীতিই মুখ্য, ব্যক্তি নয় ; ইতিহাস প্রধান, ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। শেখ মুজিবুর রহমান জুভাগের সিংহ নন অথবা দেববংশোদ্ভৰ খল নায়ক নন। তিনি বাংলাদেশের সমাজ বিন্যাস ও পরিমণ্ডলে লালিত এফজন নশ্বর মানব।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশ্লেষণই অরাজনৈতিক এবং ভ্রমাত্মক বলে আমি মনে করি। তিনি ছিলেন মাধ্যম এবং তারই নেতৃত্বে গড়ে উঠছিল আমলা-মৎসী শ্রেণীর অসার রাজত্ব। সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তি সর্বদাই এই ধরনের মেরুদণ্ডবিহীন শ্রেণীর উপর ভিত্তি করে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করে। আর সে জন্যই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অভিষিক্ত হয়েছিল বাঙ্গালী বুর্জোয়াদের হীনতম অংশ, প্রশাসনযন্ত্রে প্রধান ছিল নালী ব্যুরোক্রেসির সবচাইতে দুর্নীতিপরায়ন ও তাবেদার অংশ এবং অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান ছিল পরদেশী লটেরা পুজির দেশীয় সেবাদাস। একদলীয় শাসন সেই ঘৃণ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জোটকে কায়েম করবার জন্যে প্রবর্তন করা হয়েছিল।
এই চক্রজোটের একছত্র প্রতিভুত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তার ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের ঋণ শোধ করছিলেন। গণতন্ত্র হরণ, নির্মম নীপীড়ন কণ্ঠরোধ এবং হত্যা এই প্রক্রিয়ারই অন্যতম পর্যায়। আজও ৬২ হাজার রাজনৈতিক কর্মী, বিপ্লবী ও মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজিব কর্তৃক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় দিন গুণছেন। আর সেই প্রক্রিয়াকে পরমোল্লাসে উস্কানি দিয়েছে কম্যুনিষ্ট নামধেয় একদল স্থলিত পরজীবী। কেননা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়া তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারত না। শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের দুঃশাসন সহস্র জননীর বুক ভেঙ্গে দিয়েছে, শত শত বীর দেশপ্রেমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, দেশীয় সম্পদ পাচারের নয়া ইতিহাস রচনা করেছে, মনন ও সংস্কৃতিকে হত্যা করেছে এবং সর্বোপরি সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিয়েছে। অর্থনীতির আর কানাকড়িও অবশিষ্ট নেই। অতএব কালান্তরের এই সন্ধিক্ষণে যদি আমরা সেই রাজনীতিকে পরাস্ত না করতে পারি, শোষণ ভাঙ্গার সংগ্রামে অবতীর্ণ না হতে পারি—এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, জাতীয় বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি ও কৃষক ঐক্যজোট না গড়তে পারি তবে আবার পুতুল রাজ্য কায়েম হবে। পুতুলের রাজাকে যদি খুজে না পাওয়া যায় তবে আবার পরদেশী পটুয়া নতুন আদলে পুতুল গড়বে।
পরিশেষে তবুও বলব শেখ মুজিবুর রহমান আমায় চোখে গ্রীক
জ্যেষ্ঠয় এক করুণ শ্রেণীচেতনায় সঙ্কীর্ণ, ঈর্ষায় বিদ্বিষ্ট, ভালবাসা অগ্রিম কিন্তু দুর্বলতার আকীর্ণ একজন নূর মান। ক্ষমতার আগুনে তাঁর সদম্ভ পদচারণা কখনো ভীতি, কখনো ঝরণ র সৃষ্টি করেছে। সত্যভাষণে তিনি ভ্রূকুটি করেছেন, প্রতিবাদীকে রোষানলে ভস্ম করতে চেয়েছেন এবং মিথ্যা ভাষণে তুষ্ট হয়েছেন। দেশকে ভালবাসতে গিয়েও তিনি দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জীবন দিয়ে তাকে সেই মুল্য শোধ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ অমর হোক, স্বাধীনতা দীর্ঘ জীবি হোক
আমাৱ এ বক্তব্য নতুন নয়। হলিডে পত্রিকায় ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ রচনাবলীতে
আলোচিত রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত – বিস্তারিতভাবে . আলোচনা করেছি।
এ ছাড়াও হলিডে তে বদরুদ্দিন উমরের সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রবন্ধমালাতেও তত্ত্বগতভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষিত, স্বাধীনতার সামাজিক ভিত্তি ও শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ও শ্রেণী।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1975.10.02-bichitra.pdf” title=”1975.10.02 bichitra”]