1975.06.13 | আইয়ুব খানের কুমির শিকার | ক্যাপ্টেন সাত্তার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা
আইয়ুব খানকে নিয়ে আমার গল্প লিখার কারণ অইয়ুব খানকে বিশেষ এক রকম আমি পছন্দই করতাম । একথা সবজন ইবাদত, এই দনিয়ার সমস্ত মানুষ যদি ধার্মিক, সাধু, মহাপুরুষ হত তবে দুনিয়াটি একটি উওজনাবিহীন, নিস্প্রাণ, নিরানন্দময় স্থানে পরিণত হতো। চুল বিচিএ এবং নাটকে সর্বগুণসম্পন্ন নায়কের বিপরীতে ভিলেনের চরিত্র সংযোজনে আমাদের স্থিল বতন আনন্দ বৃদ্ধি পায়। এই কারণে সকল সুখের স্থান ৪/ চুক্তিকেও ‘ পথিবীর মত কি পার করে চিত্রিত করবার ম. মথিষগণ দেবতাদের কে ভিলেন চরিত্রের সষ্টি ৪০. ?? এমনকি স্বয়ং দেবরাজ কু, পরিপক্কী অহল্যর ? আমরাল ভিলেন চরিত্রের উত্তম কি ব্য; নিষধ এলাকা(অস্পষ্ট) এবং ভিলেনগণ পৃথিবীকে যে একটু বেশী আকর্ষণীয় করে তুলেছে সেটা আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার বক্তব্য আইয়ুব খান একজন প্রথম শ্রেণীর ভিলেন ছিলেন। পাকিসন্তানের প্রধান সেনাপতি থাকাকালীন রাজনৈতিক ব্যাপারে তার হস্তক্ষেপ সেকথা ‘ফেডস নট মাষ্টারস’ বইতে পরোক্ষভাবে তিনি স্বীকার করেছেন, ষড়যন্ত্র – করে ক্ষমতা দখল; বিখ্যাত বৃটিশ প্রমোদবালা কৃষ্টান কীলারের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ইত্যাদি প্রমাণ করে আইয়ুব খান সাহেব যথার্থই একজন ভিলেন ছিলেন আর এই একটি কারণেই আইয়ুব সাহেবকে আমি পছন্দ করতাম। ১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মকাল । পিন্ডির মসনদে আইয়ুব খান যদিও তখন পর্যন্ত দৌল্ডপ্রতাপে সমাসীন কিন্তু পাকিস্তানের উভনয়াংশেই রাজনৈতিক গণবিদ্রহের পূর্বাভাস দিচ্ছে । পিন্ডির মসনদে বসে আইয়ুব খান সাহেব করতে বিশ্বাস করতে পারছেন না। নিজে পুরানো মডেলের ক্যাডিলাকে চড়েন অথচ ইয়াহিয়াকে লেটেস্ট মডেলের ক্যাডিলাক দিয়েছেন। নিজে যে বাড়তে থাকেন জেনারেল ইয়াহিয়াকে দিয়েছেন তার চাইতেও সুন্দরতর বাড়ী। এত করেও ইয়াহিয়াকে যেন বিশ্বাস করা যায় না । অখ্যাত অজ্ঞাত ভুট্টো যাকে তিনি নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত করলেন সে আজ তার ঘোর শত্রু। এয়ার মার্শাল অজগর খান, সিন্ধু প্রদেশের জাতীয়তা অনেকে তাঁর শত্রু। আইয়ুব খানের ভয় পাঠানদের পাকতন স্থানের দাবী, বেলুচদের স্বাধীকারের দাবী। আইয়ুব খান মনে করেন সকল আঞ্চলিক অসন্তােষ, দাবী-দাওয়া ও ব্যক্তিগত শত্রুদের পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের এই তিনি তাঁর কূটবুদ্ধির দ্বারা রাখতে পারবেন হয়তোবা কিন্তুু তার আসল ভয়-ভীতির কারণ বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিব। মোনায়েম খান, সবূর খান, ফজল্বল কাদের চৌধুরী প্রমুখ অনেক বাঙ্গালী নেতাকেই তিনি দেখেছেন কিন্তুু শেখ মুজিব এদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতুতে গড়া। এই শেখ মুজিবের ভয়ে তিনি বহু বিনিদ্রা রজনী কাটিয়েছেন। চোখে নিদ্রা নেমে আসলেই তিনি দেখতে পান চারিদিকে দাউ দাউ করে আগুন জলছে, শত কোটি ক্ষিপ্ত জনতার কঠিন উদ্বাহ, হস্ত তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মরিবার জন্য এগিয়ে আসছে আর শেখ মুজিব সেই জনতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আইয়ুব খান, সাহেব অনেক বুদ্ধি খরচ করে পিন্দির মসনদের উপর তাঁর আসন আজীবন স্থায়ী করবার বুনিয়াদি গণতন্ত্র আবিষ্কার করলেন কিন্তু মুজিব সব পরিকল্পনাই তছনছ করে দিয়েছেন। এই সকল কারণে মুজিবের উপর তার অক্রোশ সবচেয়ে বেশী। আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে মিথ্যা ষড়যন্ত্রের নাম দিয়ে যদিও তিনি মুজিবকে অন্তরীণ করেছেন তবু তিনি সম্পূর্ণ ভয়শূন্য হতে পারছেন না। বিচারের প্রহসন করে শেখ মুজিবকে চরম দন্ড দিয়ে মুজিব-ভীতি হতে মুক্তি লাভের কথাও চিন্তা করেছেন। কিন্তু সেখানেও ভয় যেহেতু সমস্ত বাঙ্গালী মুজিব নামে পাগল । মুজিবকে মিথ্যা শাস্তি দিতে গেলে সমস্ত বাংলাদেশে এমন বিদ্রোহের আগুন জলে উঠতে পারে যা হয়ত পাকিস্তানের অতিতকে বিপন্ন করে তুলবে । এইরকম সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দৈহিক, মানসিক অবসাদগত আইয়ুব খান সাহেব স্থির করলেন দেহ – মনক চাঙ্গা করবার নিমিত্ত বাংলাদেশের সুন্দরবনে যাবেন শিকার করতে। ১৯৬৮ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ নিযুক্ত তদানীন্তন গবর্নর মোনায়েম খানের নিকট বার্তা এসে পৌছল জুন মাসের শেষ নাগাদ তার পেয়ারা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসবেন । মোনায়েম খান সাহেবকে একথাও জানানো হলো ফিল্ড মার্শাল সাহেব এবার বাংলাদেশ সফরকালে সুন্দরবনে শিকারে গমনের ইচ্ছাও রাখেন। মোনায়েম খান ও তার অনুচরবর্গ তাদের পেয়ারা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেবকে জবরদস্ত, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের বিষয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সাহেবের আগমনের তখনও দশ – বারো দিন দেরী, এই সময় মোনায়েম খানের কাছে সংবাদ এল সুন্দরবনে পশর নদীতে জেলেদের হাতে বড় আকারের একটা কুমীর ধরা পড়েছে। মোনায়েম খানের মস্তিষ্ক ছিল ভীষণ উর্বর তাই কর্মীর ধরা গডার খবর শুনে সাথে সাথে স্থির করে ফেললেন এটাকে কাজে লাগাতে হবে। আর এই কুমীর টাকে সত্যিকারের কাজে লাগানো হবে যদি ট্রাস্কুয়ালাইজার (ঘুম পড়ানো ওষধ) ইনজেকশন দিয়ে কুমীরটাকে নদীর চরে ফেলে রেখে আইয়ুব খান সাহেব যখন নদীপথে সুন্দরবন যাবেন তখন যদি এই মস্তবড় কমীৱটাকে শিকারের জন্য দেখিয়ে দেয়া যায়। বাঘ শিকার কুমীর শিকার অসাধারণ ঘটনা। বাঘ শিকারের চাইতে কুমীর শিকারের দৃষ্টান্ত অপেক্ষাকত কম তাই কুমীর শিকার করা বাঘ শিকার করার চাইতেও বেশী বীরত্বময় ও গৌরবময়। কিন্তু যখন তখন ইচ্ছা করলেই কিমীর শিকার করা যায় না। সুতরাং এতবড় বিশ হাত বা একটা জ্যান্ত কুমীর মার্শাল আইয়ুব খান সাহেব নিশ্চয়ই যারপরনাই খুশী হবেন। আইয়ুব খানকে ‘খুশী করবার এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাবার পাত্র নন মোনায়েম খান সাহেব । সমস্ত প্রোগাম ঠিক হয়ে গেল পশুর নদীর মোহনায় কাটকা নামক স্থানে সাগর সৈকতে যে সরকারী ডাকবাংলো আছে সেখানে আইয়ুব খান সাহেব থাকবেন দুদিন। এই কাটকা জায়গাটি বড়ই মনোরম। সুন্দরবনের উত্তরাংশে যেমন নদীর এক তীরে বন এবং অন্য তীরে মানববসতি, এখানটা তেমন নয়। এ জায়গাটা সম্পূর্ণ মানববসতি বিবর্জিত, তাই উত্তরাংশের চাইতে এখানে বন্য মুরগী, বন্য শুয়োর, বাঘ, হরিণ ইত্যাদির সংখ্যা অনেক বেশী। আর এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের তুলনা সম্ভবতঃ দুনিয়ায় বিরল । এর একদিকে ঘন বন বেষ্টিত নিবিড় ছায়াময় সুন্দরী, ক্যাওড়া, পশুর, বাইল, গোল – পাতার বন। এখানে আছে অসংখ্য বন্যপাখী, জলচর পাখী, মৌমাছির ঝাক। এই বনে রাত্রে বাঘের গর্জন ধনিত-প্রতিধনিত হয়ে ফিরে। এর অন্যদিকে – সীমানাবিহীন অনন্ত প্রসারিত নীল সাগরের সাথে অসীম আকাশের মিল হয়েছে দিগন্তে। অনন্ত কাল ধরে এখানে সাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বালুচরে। এই অসীম আশ্চর্য সুন্দর জল ও স্থলের মিলন ক্ষেত্রে এসে মানুষের মন সংসারের ক্ষুদ্র গন্ডিত থেকে মুক্তি লাভ করে। ক্ষণিকের জন্য মানব সংসারের দৈনন্দিন ব্যথা-বেদনা ভুলে যায় । আর ঠিক এই কারণে কার্টকার ডাকবাংলো আইয়ুব খান সাহেবের দেহমনর অবসাদ দূর করার একান্ত উপযুক্ত স্থান । আইয়ুব খান সাহেব ঢাকা হতে খুলনা যাবেন বিমানবাহিনীর একখানা হেলিকপ্টারে , তার পর খুলনা হতে নৌপথে ফেরি – এন্ডারসন জাহাজযোগে যাবেন কাটাকায় । আইয়ুব খানের ঢাকা আসতে তখনও এক সপ্তাহ বাকি। মোনায়েম খানের নিকট সংবাদ এল যে কুমীর মহারাজা ধরা পড়েছিল পশর নদীর জেলেদের হাতে সেই কুমীর মহারাজা ধরা পড়বার পর হতে একটানা অনশন ধর্মঘট পালন করে চলেছে এবং তার একটানা অনশনের ফলে প্রাণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কুমীর মহারাজার প্রাণ বাঁচাবার সর্বপ্রকারের চেষ্টা করবার জন্য মোনায়েম খান সাহেব নির্দেশ পাঠালেন। কুমীর মহারাজা কি মোনায়েম খানের নির্দেশি পুরোপুরি উপেক্ষা করলো। মানুষের হাতে ধরা পড়ার লজ্জা হতে মুক্তি লাভের নিমিত্ত অনশন করে প্রাণ ত্যাগ করার যে স্থির সংকল্প সে করেছে সে বিষয়ে কুমীর মহারাজা অটল রইল । জ্যান্ত হাস, মুরগী, ছাগল ইত্যাদি অনেক নৈবদ্যই মহারাজার সমীপে উৎসর্গ করা হলো কিন্তু মহারাজা সকল লোভ ললসা সম্বরণ করে নির্বিকার রইল । এই সব সংবাদই মোনায়েম খানের গোষ্টীতভূত হলো। আইয়ুব খানের ঢাকা পৌছবার চার – পাঁচদিন মাএ বাকি আছে । কুমির মহারাজাকে যেমন করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ঢাকা হতে বড় বড় পশু চিকিৎসক পাঠানো হলো কুমীরের প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু ফল হলো না । আইয়ুবখান সাহেব ঢাকা পৌছবার দুদিন আগেই সবাইকে নিরাশ করে পশু চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ করে দিয়ে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে কুমীর মহারাজা মহা প্রস্থান করল। এদিকে মোনায়েম খানের রোখ চেপে গেছে। তাহার পেয়ারা প্রেসিডেন্টের কুমী শিকারের ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। কিন্তু কুমীর পাওয়া যায় কোথায় ? একবার স্তির করলেন ঢাকা চিড়িয়াখানায় যে দুটি কুমীর আছে সেখান থেকে একটাকে দরে প্লেনে করে নিয়ে যাবেন সন্দরবনে । কিন্তু দুটি কারণে এই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে হয়। প্রথমত ও চিড়িয়াখানার কুমীর দুইটি ভীষণ ছোট। আইয়ুব খান সাহেব এত ছোঁট কুমীর শিকার করে মোটেই খুশী হবেন না । দিতীয়ত : ঢাকা থেকে কুমীর ধরে নিয়ে গেলে গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন হবে। চিড়িয়াখানা হতে কুমীর ধরে নিয়া যাওয়া হয়েছে। শিকারের জন্যে কথ্য জানাজানি হয়ে গেলে সেটা একটা হাস্যকর ব্যাপার হবে একথা মোনায়েম খানের মত পান্ডালোক লোক ও বুঝতে পেরেছিল । আগেই বলেছি মোনায়েম খানের মস্তিষ্ক ছিল ভীষণ উর্বর তাই কোথায় কুমীর পাওয়া যায় সে সমস্যারও একটা সমাধান উদ্ভাবন করে ফেললেন তিনি। তিনি স্থির করলেন ঐ মৃত কুমীর মহারাজাকেই জ্যান্ত কুমীর বলে চালিয়ে দেবেন। মোনায়েম খান সাহেব নির্দেশ দিলে তার পেয়ারা প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শালটির সাহেব নদী- পথে পথে সুন্দরবনে মালে সে পৃথিআন এক খান পূর্ব নিদিষ্ট স্থানে মৃত কুমীর, মহারাজার দেহটাকে পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হবে । দেখে যেন মনে হয় সত্যিকারের জল জাত একটা বিরাট কুমীর সদ্যমাথা তলে পানির উপরে ভেসে উঠেছে। অবশ্য মরা কুমীরকে জ্যান্ত কুমীর বলে চালিয়ে দিতে অন্য একটা সমস্যা দেখা গেল। মরা কুমীর পানির মধ্যে উপর হয়ে থাকে না। অন্যান্য মরদেহের মত সেটাও পানিতে চিৎ হয়ে ভাসে। এই সমস্যা দূর করবার জন্য পানির মধ্যে বাশ পুতে তার সাথে কমীর মহারাজার মৃতদেহটা উপর করে উত্তমরুপে বাধা হলো। অবশেষে ১৯৬৮ সনের ১৭ই জুন বেলা দশটায় মেরিয়ান এন্ডারসন জাহাজযোগে খুলনা হতে বেশ কিছু সংখ্যক মোসাহেব _ ও বিদূষককে সাথে নিয়ে ফিল্ত মর্শাল আইয়ুব খান সুন্দরবনের পথে যাত্রা করলেন। ডেকের উপর চেয়ার নিয়ে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খান সাহেব পাশাপাশি বসেছেন। স্টীমার ছুটে চলেছে নদীর একতীর ঘেষে। প্রচন্ড নদীর স্রোত প্রচণ্ডতা জলের মাঝে জাগায় জায়গায় ঘূর্ণিআতের সৃষ্টি করে চলেছে। ভাটির দেশের নদী বলে নদী গুলিও বেশ প্রশস্ত। এপার হতে ওপারের গাছপালক ছোট ছোট দেখায়। বর্ষাকাল বলে মেঘাচ্ছন্ন ঐ পাশ। নদীর তীরে সবুজ, ধান ক্ষেত আম, কাঠাল, নারকেল, সুপারি, খেজুর গাছের বাগান। সবকিছু মিলে একান্ত স্নিগ্ধ চিরন্তন বাংলা রূপ। আইয়ুব খান মোনায়েম খানের এই সবের দিকে কোন খেয়াল নেই। তাহারা দুজনে আলাপ করলেন দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে। আইয়ুব খান মোনোয়েম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, মোনায়েম সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের রাজনৈতিক তৎপরতা কিভাবে বন্ধ করা যায়? মোনায়েম খান সাহেব আইয়ুব খানকে এই প্রশ্নের উত্তরে জানালেন যে আইয়ুব খান সাহেব এব্যাপারে তার উপর ভার দিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। মেনোয়েম খান জানেন কিভাবে ছাত্র আন্দোলন দমন করতে হবে । শুধু ফিল্ড মার্শাল সাহেবের অবগতির জন্য জানালেন মেনায়েম খান সাহেব ছাএ আন্দোলন দমনের জন্য কি কি কার্যকম গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। প্রথমত : মোনায়েম সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকারী চকরীজীবী ছাত্র অভিভাবকদের তর্ক করে দিবেন যে যদি তাদের ছেলেমেয়েরা রাজনৈতিক আন্দোলনে শরীক হয় তবে অভাবকদের চাকরী বর্খাস্ত করবেন। দিতীয়ত: ব্যবসায়ী অভিবাবকদের ছেলেমেয়েরা যদি আন্দোলনে শরীক হয় কোন অভিভাবকদের ব্যবসা সংক্রান্ত লাইসেন্স ইত্যাদি বাতিল করবেন। তৃতীয়তঃ যে সকল ছাএ-ছাএী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে। তারা যতই মেধাবী হোক না কেন সরকারী সাহায্য, বৃত্তি ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা হোতে বঞ্চিত হবে। চতুর্থতঃ যে সকল ছাত্রছাত্রী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে তারা সকলপ্রকার সরকারী চাকরীর ও ছাত্রাবাসগুলিতে বসবাসের জন্য অনুপাত ঘোষণা করা হবে। মোনায়েম খান যদিও অতি উৎসাহের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলন দমনের তার পরিকল্পনা হুজরের কাছে বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন তবু আইয়ুব খানকে দেখে মনে হলো তিনি যেন ছাত্রআন্দোলন দমনের মহৎ পরিকল্পনা শুনবার জন্য তেমন উৎসাহী নন, তাই মোনায়েম খান হঠাৎ একটু দমে গেলেন। আইয়ুব খান আরমিকেদারার পিছনের দিকে হেলে চক্ষু মুদেনুয়ে পড়লেন। মোনায়েম খান কিভাবে ছাত্র-আন্দোলন প্রতিরোধ করবেন তা শুনবার আইয়ুব খানের নিরৎসাহের কারণ আইয়ুব খানের বিশ্বাস পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলন কিংবা শ্রমিক আন্দোলন আসলে সব, আন্দোলনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে প্রেরণা যোগাচ্ছেন শেখ মুজিব। সুতরাং শেখ মুজিবকে দমন করতে পারলে সকল আন্দোলনই দমন করা সম্ভব হবে। ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপকতা ও দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া কত প্রচণ্ড হতে পারে সেটা আইয়ুব খান ভালই বঝেন। কিন্তু এটাও বুঝেন শেখ মুজিবকে দমন না করতে পারলে কিছুতেই ছাত্র-আন্দোলন দমন করা সম্ভব হবে না। তাই চক্ষুগুদে আইয়ুবখান চিন্তা করছিলেন ‘শেখ মুজিবকে কেমনে শায়েস্তা করবেন। শেখ মুজিব তার আসল। জানের দুশমন, তার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, তার রক্তের চাপ বৃদ্ধির কারণ ঘটিয়েছে, অকালে বার্ধক্য লাভ ঘটিয়েছে। স্টীমার ঘটে চলেছে একটানা অদুরেই সুন্দরবন শুরু হয়েছে। নদীর একপারে লোকালয় আর অন্যপারে গভীর জল। বাংলার এই অসীম আশ্চর্য সৌন্দর্যের প্রতি আইয়ুব খানের কোন খেয়াল নেই। তিনি শুধু একটানা নিরবিছন্নভাবে চিন্তা করে চলে্ছেন শেখ মুজিবকে কেমনে শায়েস্তা করবেন। পাশে বসে মোনায়েম খান উসখুস করছেন। এইভাবে আইয়ুব খান যখন নিবিড় চিন্তায় মঘ্ন তখন মোনায়েম খান হঠাৎ তাহার চোস্ত পায়জামা জড়ানো বক্র পদযুগলের উপর ভর করে চিৎকার করে। উঠলেন~~~ ‘হুজুর কুমীর’। আইয়ুব খান সাহেব এমন চীৎকার শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সহস্য তার চিন্তায় বাধা পড়ায় তিনি চোখ খুলে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘হোয়াট হ্যাপেন’.। মোনায়েম খান তার বক্রপদযুগলের উপর দাঁড়িয়ে লাফাতে লাফাতে উত্তেজিতভাবে আবার চীৎকার করে বললেন ও হুজুর কুমীর। আইয়ুব খান সাহেব মোনায়েম খানের লাফালাফি দেখে অবাক হয়ে গেলেন । আবার প্রশ্ন কর “হেয়াট কুমীর? মোনায়েম খানের এবার বোধ-গাম্য হলো, তার পেয়ার প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল সাহেব কুমীর কি বস্তু তা জানেন না, ‘তাই এবার বললেনঃ হুজুর করকোডাইল, বিগ করকোডাইল। করকোডাইলের নাম শুনে আইয়ুব খান সাহেব আরামকেদারা ছেড়ে তড়াং করে লাফিয়ে উঠে আরাম কেদারার পার্শ্বেই রক্ষিত তার ইংলিশ মেড লায়ন এন্ড লায়ন কোম্পানীর যে রাইফেলটা ছিল সেই রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে ব্যস্ত সমস্তভাবে জলদগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন :’হোয়েআর?’ মোনায়েম খান সাহেব গলায় উত্তেজনায়, সুর এনে এক দামী পুরস্কার পাবার উপযুক্ত অভিনয়ের সাথে, আগের থেকে কিছুই জানেন না এমনভাব করে অঙ্গলি নির্দেশ করে কুমীরটাকে দেখালেন। আইয়ুব খান সাহেব রাইফেল হাতে তুলে নিয়ে রাইফেলের সাথে যুক্ত টেলিস্কোপের মাধ্যমে কিছুক্ষণের জন্য কুমীরটা নিরীক্ষণ করলেন তারপর গুড়ুম গুড়ুম করে দু-তিনবার গুলি ছড়লেন এবং গুলি ছোঁড়ো শেষে অবাক হয়ে দেখলেন কুমীরটা তার গুলি উপেক্ষা করে পূর্ববত জলের উপর যতটুক মাথা তুলে ছিল ঠিক তেমনি অবস্থায়ই আছে । আইয়ুব খান সাহেব আবার গুলি ছাড়লেন, রাইফেল পাল্টিয়ে অন্য একটি গুলিভর্তি রাইফেল তুলে নিয়ে গুলি ছুড়লেন। কিন্তু তাকিয়ে দেখলেন কুমীর বাবাজী আগের মতই মাথা তুলে ঠিক তেমনটিই আছে। সবকিছু দেখে আইয়ুব খানের সন্দেহের উদ্রেক হলো তিনি জাহাজটিকে কুমীরের কাছে ভিড়াবার আদেশ দিলেন। জাহাজ কুমীরের কাছে আসতেই খানিকটা দূর হোতে দেখতে পেলেন লায়ন এন্ড লায়ন মার্কা রাইফেলের সেভেন মিলিমিটারের বিরাট গুলির প্রচন্ড আঘাতে কুমীরের মক্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। যেখানে মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে সেখানেতো কুমীরের মরে ভেসে উঠবার কথা অথচ কুমীর বাবাজীর নড়নচড়ন নেই । আইয়ুব খান লোকজনকে আদেশ করলেন কুমীরটাকে টেনে তুলতে। জলবোট নিয়ে লোকজন কুমীর তুলতে গিয়ে দেখতে পেল কুমীরটার পায়ের সাথে, পিঠের সাথে, লেজের সাথে দড়ি দিয়ে কতকগুলি বাশ বাধা এবং বাশগুলি আবার পানির নীচে মাটিতে পোঁতা রয়েছে। আইয়ুব খানও সবকিছু দেখলেন এবং বঝলেন। চুরি ধরা পড়ে যাওয়ায় মোনায়েম খান অপ্রতিভ ও অপ্রস্তুত হতে আইয়ুব খানের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান মোনায়েম খান উদ্দেশ্য করে ক্ষোভের সাথে বললেন —মোনায়েম ছাহাব আপভি হামকো বেকুফ বানাতা’!
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1975.06.13-bichitra-3.pdf” title=”1975.06.13 bichitra”]