শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২১৩। বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি এবং বিবৃতির ওপর সদস্যদের আলোচনা | ভারতের লোকসভার বিবরণী | ২২ মার্চ, ১৯৭১ |
বিবৃতি – পূর্ববাংলার সাম্প্রতিক অগ্রগতি
জনাব স্পিকার: শ্রী শরণ সিং
শ্রী এস এম ব্যানার্জী (কানপুর): আমি পয়েন্ট অব অর্ডার তুলতে চাই
জনাব. স্পিকার: কিসের উপর?
শ্রী এস এম ব্যানার্জী: আপনি জানেন যে নিয়ম অনুযায়ী একজন মন্ত্রী তাঁর কাছে মনে হওয়া কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে শুয়ো মোটো দেবার অধিকার রয়েছে। আমার পয়েন্ট হচ্ছে দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশ আমরা পেশ করেছিলাম………
শ্রী সমর গুহ (কাঁথি): সকালে বিরোধী দলের নেতার সাথে একটি মিটিং ছিল এবং আমরা সব একমত যে একটি বিবৃতি তৈরি করা উচিত।
শ্রী এস এম ব্যানার্জী: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপার, আমি এটা জানি। এর উপর আলোচনা হওয়া উচিত; অন্যথায় এটা একটি একমুখী অবস্থা সৃষ্টি করবে। সরকার একতা বিবৃতি দেবে এবং আমরা কেবল তা হৃদয়ঙ্গম করব। তাই, আমি অনুরোধ করব আপনি দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশ দিন। এর উপর কিছু বলার অনুমতি দিন।
শ্রী সমর গুহ: আমি এই প্রস্তাব দিতে চাই। প্রধানমন্ত্রী, আমায় বলতেই হবে, বিরোধী দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা সকালে এক ঘণ্টা আলোচনা করেছি। আমরা সকলেই একমত যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি তৈরি করা উচিত। সেখানে তার দলের নেতারাও ছিল। এই একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে আমাদের দৃঢ় সংকল্প, সমর্থন ব্যাক্ত করা হয়। ভুক্তভোগীদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়। সে আলোকে আমাদের এই বিবৃতি গ্রহণ করা উচিত।
মিস্টার স্পিকার: পদ্ধতি আপনারা সবাই জানেন। যখন একজন মন্ত্রী এক বিবৃতি দেন তখন তাকে প্রশ্ন করা যাবেনা।
শ্রী পিলু মোদী (গোধরা) ……… কিন্তু আলোচনার জন্য —
জনাব. স্পিকার: আপনি রাষ্ট্রপতির ঠিকানার উপর একটি সাধারণ আলোচনা করতে যাচ্ছেন। কাজেই যথেষ্ট সুযোগ পাবেন।
জনাব. স্পিকার: আমি জানিনা তা কতদূর যুক্তিযুক্ত হবে।
প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রী ও তথ্য মন্ত্রী (শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধি )-
আমি কি বলতে পারি যে, যেহেতু এই ব্যাপারটি নিয়ে পুরো হাউস জোরালোভাবে মত দিতে আগ্রহী কাজেই এর ক্ষেত্রে আমরা একটু ব্যতিক্রম হতে পারি কিনা যাতে সদস্যরা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে।
জনাব. স্পিকার: আমি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ কে সাধুবাদ জানাই। আমি একটি ব্যতিক্রম করতে প্রস্তুত আছি। আমি আশা করি আপনি এটা আর পুনরাবৃত্তি করবেন না। এটি একটি ব্যতিক্রমী ব্যতিক্রম।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী (শ্রী শরণ সিং): ভারত সরকার আমাদের সীমানায় ঘটে যাওয়া ঘটনা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করছে। তাই আমাদের গভীর আবেগ এই হাউসএ প্রকাশিত হচ্ছে এবং যা সমগ্র দেশে জেগে উঠেছে।
মাননীয় সদস্যরা, আমি নিশ্চিত ২৮ নভেম্বর, ১৯৬৯ সাল থেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে আপনারা সম্যক অবগত যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একটি নব্য গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
সরকার ও ভারতের জনগণ সবসময় পাকিস্তানের জনগণের জন্য সহানুভূতি ও বন্ধুত্তপূর্ন আচরণ করেছে। অতএব, আমরা আশা প্রকাশ করেছিলাম যে পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক বিবর্তন অনুসরণ করবে। স্বাভাবিকভাবেই এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি সংবিধান অনুযায়ী জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মত অনুধ্যায়ী অভিব্যক্ত হবে – যা গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেখেছি।
তবে ঘটনা একটি ভিন্ন এবং বিয়োগান্তক দিকে মোড় নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ বিবর্তনের পরিবর্তে সেখানে এখন চলছে রক্তারক্তি।
প্রতিবেদন মতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও প্রাদেশিক পুলিশ জনগণের বিরুদ্ধে ২৫ এবং ২৬ মার্চ মধ্যরাতে নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করে। প্রচুর হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। মার্চ ২৬ সকালে ঢাকায় রেডিও স্টেশন সেনাবাহিনী দ্বারা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। অতঃপর রেডিও স্টেশন এর মাধ্যমে ১৫ টি নতুন মার্শাল ল এর ঘোষণা দেয়া হয়। রেগুলেশন নিষিদ্ধ, অন্য কিছু, সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, মিছিল, সভা, বক্তৃতা ও স্লোগান নিষিদ্ধ করা হয়। বেতার ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম ও সব খবরের উপর সম্পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরো দুই নিয়মিত বিভাগ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমন করার জন্য নিয়োগ করা হয়। আমাদের হৃদয় সেই সব মানুষদের জন্য যারা অভাবনীয় দুঃখকষ্ট ভোগ করছেন তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছে।
আমরা স্বাভাবিকভাবেই কামনা করছি এবং আশা করি যে, দেরী করে হলেও এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হবে যেখানে মানুষ গরিষ্ঠাতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারবে। এটা সত্য যে যেখানে এত বড় একটা সেগমেন্ট এর দ্বন্দ্ব চলছে এবং মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সম্প্রতি যখন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল, সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ভারতের জনগণ সেখানে দুর্ভোগ মেটাতে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল।
আমরা আবারো তাদের জন্য করতে চাই। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এর সাথে মিলে আমরা নিষ্পাপ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাড়াতে চাই।
শ্রী এ.কে. গোপালান (পালঘাট): বাংলাদেশে, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে, প্রকৃত অর্থে গৃহযুদ্ধ নয়। এটা একদিকে সামরিক একনায়কতন্ত্র এবং অন্য দিকে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্খার ব্যর্থটায় সৃষ্ট একটি যুদ্ধ। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শুধু কেন্দ্রের দুই টি বিষয় – পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র নয় বরং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। নির্বাচন ও জনগনের ইচ্ছাকে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে জনাব ইয়াহিয়া খান স্লোগান পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দেন এবং মানুষকে গুলি করে হত্যা করা শুরু করেন।
তারা বলে যে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তান এর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহবান জানান।
আরেকটি সমস্যা আছে যা আমাদের সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। মানুষ বাংলাদেশ-পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসতে পারে – হিন্দু বা মুসলমান, তখন তাদের আশ্রয় দিতে সমস্যা হতে পারে। এবং আমি আশা করি একটি সংগঠন তৈরি করে দেয়া হবে তাদের দেখাশোনা করার জন্য।
আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণ ও সামরিক গণহত্যার নিন্দা করি ও বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে মন থেকে সমর্থন করি। এবং ভারত সরকার এবং ভারতের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের জন্য সব রকমের সমর্থন ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে।
শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সংগ্রাম বা স্বাধীনতার জন্য এশিয়-আফ্রিকান দেশগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছেন এবং যদি এটা অব্যাহত থাকে তাহলে আমাদেরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন করতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে যে কোন সাহায্য দেয়ার।
শ্রী এইচ এন মুখার্জি (কলকাতা উত্তর পূর্ব): জনাব স্পিকার, স্যার, আপনি যেমনটি বলেছেন, এই ব্যতিক্রমী আলোচনায় আপনি নিশ্চই আমাদের জনগণের পক্ষ থেকে আপনার আবেগ প্রকাশ করবেন বাংলাদেশে ঘটতে থাকা অমানবিক ঘটনার জন্যে।
বাংলাদেশ, যেখানকার আদি বাসিন্দা এই হাউজেও আছেন। আমরা জানি হাজার হাজার রক্তপাত সেখানে হচ্ছে যার উদাহরণ ইতিহাসে নজির ছাড়া এবং তারা এমন এক বিপ্লবে নেমেছে যার কোন তুলনা হয়না। এমন একটি দল তাদের উপর অত্যাচার করছে যারা জঙ্গলের আইন ছাড়া কিছুই জানেনা।
স্যার, পূর্ববাংলায় সরকার যা হয়েছে বলে প্রচার করছে, বাস্তব অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। এই দেশে যেই সরকার ই কাজ করে থাকুক, তাদের সতর্ক মূল্যায়ন এই দেশ নিয়ে খুবই নিষ্প্রাণ ধরণের, বিশেষত এই অঞ্চলে যখন এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা আগে কখনোই ঘটেনি।
এটা ছিল সম্মতিক্রমে শুরু করা একটি বিপ্লব। ব্যালটের মাধ্যমে জনগণ নিজেদের প্রাদেশিক স্বশাসিত অধিকারের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে ছিল। ইতিহাসে এমনটা আগে দেখা যায়নি। এটার দর্শক এমন একটি দেশের মানুষ যারা গান্ধির নামে পরিশ্রম করে – তাদের এই মুহুর্তে এগিয়ে আসা উচিৎ।
আপনারা কি জানেন যখন ঢাকায় হরতাল ডাকা হয় তখন গভর্নর থেকে সরকারী কুক পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজ বন্ধ রাখেন। যাকে সামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয় বা তেমন একটা পদে তার শপথ নেওয়া হয় নাই কারণ প্রধান বিচারপতি তা প্রত্যাখ্যান করেন। আমরা ইতিহাসে এতটা একতাবদ্ধ জাতী আর দেখিনি। তারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের দাস্ত থেকে মুক্তি পেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমি বিষয়টি যথার্থতায় প্রবেশ করছি না, কিন্তু আমাদের সবার পূর্ববঙ্গের জনগণের অন্তর্বেদনা ক্রন্দন মনে করা উচিৎ। এটা দুর্বল এবং অপমানজনক নয়। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বাঙালির জানে কিভাবে মানুষের মত মরতে হয়। আর, সে কারণেই তারা যুদ্ধ করছে। ৭০০০০ সৈন্য এখন পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতিরোধের জন্য নিযুক্ত আছে। যখন পূর্ব বাংলায় সাংবিধানিক ভাবে একজন প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হতে যাচ্ছেন -আপনি এবং ডেপুটি স্পিকার নতুন সংসদ সম্পর্কে কথা বলছিলেন। আমার মনে হয় আপনি এবং আমি ইস্ট বেঙ্গল থেকে কিছু শিক্ষা পেয়েছি। কাদের অঙ্গুলিনির্দেশে কি হচ্ছে তা আমরা খুব ভালোভাবে জানি। আমাদের দেশের স্বার্থ অস্থির করে অনেকে ঘোলা জ্বলে মাছ স্বীকার করতে চাচ্ছেন। পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসন চায়। পশ্চিম পাকিস্তান একটি নির্দিষ্ট স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তাদের উপর নির্যাতন করেছে। ৭০ লাখ মানুষের স্বপ্ন চূর্ন করা হচ্ছে। আমরা এখানে শুধুমাত্র প্রতিবেশী দেশে বলে এসব অনুধাবন করছি। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আমরা একটি শব্দ উচ্চারণ করছিনা। আমি নিজে ভাষা পূর্ববাংলার ভাষায় কথা বলি, শুধু আমি একা না, এখানে আমাদের অনেকে এই ভাষায় কথা বলেন। তাই আমার লজ্জা লাগে যখন দেখি আমরা এখনো কিছু করতে পারিনি যাতে দুই দেশের মাঝে বন্ধুত্ব প্রমাণিত হয়। আমি চাই সরকার এমনভাবে এগিয়ে যাবে যেমনটা আমাদের দেশের উত্তর-পূর্ব অংশে করা হচ্ছে। অন্য রকম ইতিহাস তৈরি হলেও হতে পারে।
অতএব, আমি আশা করি সরকার পরিস্থিতির আরো মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে। আমি চাই সরকার বলুক ৭ কোটি মানুষের উপর এই গণহত্যার অনুমতি দেওয়া হবে না। আমি চাই সরকার এই জন্য জাতিসংঘ বা যেকন সংগঠনের কাছে যাবে এই ব্যাপারে যতোটা সংবিধান সমর্থন করে। তারা বলুক যে তারা পূর্ব বাংলার জনগণের বিষয়টি নিয়ে সকল ফোরামের কাছে যাবেন। আমরা তা করব কারণ তারা আর আমরা আসলে এক। এক সম্প্রদায়। মুজিবুর রহমান ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপনের ব্যাপারে অনেক বলেছেন। তিনি পাকিস্তানের শৃঙ্খলাভঙ্গ চাননি। তিনি শুধুমাত্র আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনরায় শুরু করা উচিত বলেছেন। অথচ পেছনে কিছু বিশ্বাসহীন মানুষ কোন আচার আলোচনা না করে করাচির নিরাপত্তা থেকে সামরিক আইন ঘোষণা করেন – এবং তারা যা করতে যাচ্ছেন তার সবই মানবতার বিরুদ্ধে যায়।
আমি প্রস্তুত ছিলাম না যে নির্বাচনে তারা অনেক উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা পেয়েছেন তার পরে এত শীঘ্র তারা এই দেশের মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখাননি বা নূন্যতম যুক্তিযুক্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পূর্ববাংলার জনগণকে শুভেচ্ছা জ্ঞ্যাপন করেন নাই। আমি বিবৃতি দিয়ে খুব হতাশ। আমি বলছিলাম আমি বিবৃতি দিয়ে খুব হতাশ। শ্রী স্বরন সিং শেষ কথাটি বলেছেন এই সরকার একটি ভয়ানক ভুল করছে। আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী আমাদের সবার আলোচনা শেষে সর্দার শরণ সিং এর কথার চেয়ে আরো কংক্রিট কিছু বলে শেষ করবেন – যদিও আমি তা জানিনা ভারত কি করতে যাচ্ছে এই গণহত্যা এবং রক্তাক্ত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে। যা কিছু ঘটছে তেমন ইতিহাস উপমহাদেশে বিরল।
শ্রী চিন্তামণি পানিগ্রাহি (ভুবনেশ্বর): স্যার, এটি ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাসে এবং দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে গুরুতর মুহূর্ত। সংবাদপত্রে ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে বর্ণিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের অপরিমেয় কষ্ট। এবং আমরা আমাদের হৃদয়ে গভীর যন্ত্রণা অনুভব করেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের সরকার ও এখানে উপস্থিত সব দল ও এই দেশের সমগ্র জনগণের হৃদয়ে তা স্পর্শ করেছে। আমার মনে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির পরে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের একটু অভিব্যক্তি দেবেন, যাতে বাংলাদেশের যে সাহসী যোদ্ধারা ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, যারা এশিয়ার মানবাধিকার ও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধ, তাদের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী আবেগঘন কিছু কথা বলবেন।
আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইব মুজিবুর রহমান অথবা মুক্তিযোদ্ধারা কেউ এশিয়ার দেশগুলোর থেকে কোন সাহায্যের জন্য আপিল করেছে কিনা। দ্বিতীয়ত, এটা সত্য যে, মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রভাব রাখেন এবং তাকে যদি কোন ভাবে সাহায্য করা না হয় তাহলে চরমপন্থীরা সুযোগ নিয়ে নেবে যা ভারতের স্বার্থের জন্য ভালো হবেনা। আমি আশা করি মন্ত্রী এটা স্পষ্ট করবেন। তৃতীয়ত, সরকারকে দেখতে হবে অতিরিক্ত অস্ত্র ভারত মহাসাগর এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর চোখ এড়িয়ে যেন না যেতে পারে। আকাশপথেও তা খেয়াল করা দরকার। সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবেন বলে আশা করি। ভারতের জনগণের জানতে চায় বাংলাদেশের এই সংকটাপন্ন মুহূর্তে বাংলাদেশের সাহসী যোদ্ধাদের কোনো প্রকার সহায়তা আমাদের সরকার দিচ্ছে কিনা। কমপক্ষে একটু সহানুভূতি যাতে তারা করে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মনবল পায়।
ডঃ ভি কে আর ভারাদারাজা রাও (বেল্লারী): স্যার, ক্ষমতাসীন দলের একজন সদস্য হিসেবে, আমি বাংলাদেশে গণতন্ত্র অবদমনের যে কঠিন ঝড় চলছে তার জন্য আমার বিষাদময় অনুভূতি প্রকাশ করছি।
ভারতীয় ইতিহাসে বা এই উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য একটি অহিংস আন্দোলন সব প্রত্যাশা অতিক্রম করে সফল হয়েছে। আমি এটা বলতে চাই আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশ ভারত তার সাধ্যের চেয়েও সফলভাবে তা পেরিয়ে এসেছে। সেসব অহিংস আন্দোলনের নেতারা শান্তিপূর্ণ ভাবে সমঝোতা করেছিলেন। স্বাধীনতার দাবিতে ছিল না; স্বায়ত্তশাসন এবং দীর্ঘকালস্থায়ী দাবিদাওয়াগুলি তারা দাবি করেছিলেন। আমার জানা মোঃতে ইতিহাস কোনোদিন দেখেনি যে একজন সামরিক আইন প্রশাসক কে শপথ পাঠ করানো থেকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। আমি দেখিনি একটি রেডিও স্টেশন তার নিজের ইচ্ছায় পূর্ববাংলায় আবেগপূর্নভাবে জনগণের নেতার কাছে সমর্পিত হয়েছে। এই ধরনের জিনিস গান্ধীর সময়েও আমাদের নিজের দেশে ঘটেনি। পূর্ববাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এমন একটি অহিংস আন্দোলন সফলতা লাভ করার পর্যায়ে আসার মাত্র সাত দিনের মধ্যে ট্যাংক এবং সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা দমন পীড়ন শুরু করা হল যা অনুমানের বাইরে।
১২ টা –
তারা আমাদের প্রতিবেশী কিনা সেটা কোন বিষয় না। ইস্ট বেঙ্গল বিশ্বের একটি অংশ এবং আমরা ঘোষণা করেছি, আমাদের প্রেসিডেন্ট বলতে আনন্দিত হবেন যে, ভারতের কণ্ঠ যেখানেই অন্যায় সেখানেই জাগ্রত হবে। আমি মনে করি, পূর্ব বাংলায় অবিচার ও নিপীড়নের যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তা অদ্বিতীয়।
আমি আমার দলের নেতা কে মনে করিয়ে দিতে চাই যে ১৯৪৭ সালে, যখন আমরা একটি সরকার গঠন করে উঠিনি এবং তার বিশিষ্ট পিতা ভারতের তথাকথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতা ছিলেন, তিনি তখন একটি এশিয়ান পিপলস কনফারেন্স ডাকেন। আমি তখন ছিলাম। সেখানে ভারতীয় ৪৮ জন সদস্যে সমস্ত বিশ্বে ঘটে চলা নিপীড়ন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন জ্ঞ্যাপন করেন। নিপীড়ন এবং অত্যাচারের সেসব ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে আমাদের সীমানা জুড়ে চলছে। আমি জানি আমার দলের নেতা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী বেশী না হলেও অন্তত তার বাবার মতো সাহস পেয়েছেন।
আমি অবশ্যই বলব, এই সুযোগে, যে আমি আমার সাবেক সহকর্মি মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতিতে হতাশ। কারণ তার ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের জন্য যারা আসলে ট্যাঙ্কের নিচে নিষ্পেষিত হচ্ছেন তাদের ত্রাণ দেয়ার ব্যাপারে তার প্রয়াস সন্তোষজনক নয়। তিনি কাদেরকে রিলিফ দিতে যাচ্ছেন? পূর্ব পাকিস্তানে মৃত মানুষের জন্য? আমি জানি না, আমি আমার দলের মাননীয় নেতাকে অনুরোধ করতে চাই উপনিবেশবাদের শেষ চিনহ এশিয়া মহাদেশের থেকে মুছে ফেলতে হবে এবং মানুষকে অবাধ ও আত্ম সন্মানের সাথে জীবনযাপন করতে এবং তাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক পথে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে।
শ্রী কৃষ্ণ মেনন (ত্রিভানদ্রাম): জনাব স্পিকার, স্যার, আমি এই হাউসে অনেক দর্শকদের দেখতে পাচ্ছি যা আমি সবসময় দেখিনা। এব্যাপারে সন্দেহ নাই যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা একটি জাতীয় বিপ্লব এবং তা হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসন এর বিরুদ্ধে যা বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে।
আমি বিস্তারিত বলতে চাইনা। আমি বলতে চাই পূর্ববাংলার নিপীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য আমাদের সর্বাত্তক চেষ্টা করা উচিৎ। তাদেরকে আপনি শরনার্থি বা অন্য যাই বলুন না কেন। আমাদের শুধুমাত্র আমাদের আকাশ সীমায় তাদের উড্ডয়ন এবং আক্রান্ত হলে বদলা নিয়েই সন্তষ্ট থাকলেই চলবে না। আমি আশা করি, সরকার জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে। যা কিছু ঘটছে তার বিরুদ্ধে কনভেনশন অনুযায়ী দায়িত্বশীল হতে হবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
যতদিন আমাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা ইসলামাবাদে থাকবে, আমরা সঠিক তথ্য পাব, যার উপর ভিত্তি করে আমরা জাতিসংঘের সাথে বোঝাপড়া করতে পারব।
এই সময়ে নৈরাশ্যবাদী হলে এবং যদি বলি আমরা জাতিসংঘ ও সংসদে কিছুই করতে পারবোনা সেটা হবে চরম ভুল। আমরা বিশ্বের প্রতিটি ফোরাম ব্যবহার করব। যখন এই দেশের জনমতের একটি বড় অংশ মোজাম্বিক এবং এ্যাঙ্গোলা অথবা আফ্রিকাতে দমন ও নিপীড়নের বিপক্ষে প্রতিবাদ প্রকাশ করেছে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের সংগ্রাম সমর্থন করছে,, আরবের লোকদের আরেকটি সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমর্থন করেছে, তখন তাদের ব্যাপারে আমরা কিভাবে চুপ করে থাকি যারা একদম ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে? আমি কোন ভাবেই বলছিনা যে আমরা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে তা করতে চাই। আপনার পাকিস্তান কাশ্মীরে যা করছে তা করতে চাচ্ছিনা। এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যা শুরু হয়েছে শাসক সরকারের নিজেদের দেয়া নির্বাচনের ফলাফলের পরে। এটি একটি ন্যায্য আন্দোলন। যা জনগণের ভোট দ্বারা পবিত্রীকৃত হয়েছে এবং সেখানে একটি এই সম্পর্কে কোন দ্বিমত নাই। এবং আমি আশা করি যে, প্রধানমন্ত্রী তার পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন ইন্ডিয়ান রেড ক্রসের মত সংগঠনগুলোকে নিযুক্ত করে। তারপর অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
আফ্রো-এশীয় মতামত যা ঔপনিবেশিক শাসনের সময় প্রয়োগ করা হয় যেখানে শাসন করার সুযোগ নাই, অব্যাহত আন্দোলনে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে নয়, এটা নির্বাহী বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মত সংস্কারের জন্য নয়। এটা শুধুমাত্র বিপ্লবী মানুষদের স্বাধীনতার দাবি। আমি আশা যতক্ষণ সরকার নতুন সরকার জনগণের দ্বারা বাস্তবায়িত না হয় ততদিন আন্দোলন চলবে। এবং যেন উত্তর ভিয়েতনাম ও পূর্ব জার্মানির মত না করে। (বাধা) কারণ এই বিষয়ে বিলম্ব যত হবে এটা তত কঠিন হবে। যখন একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং মানুষ তার কমান্ড মানে এবং তখন তা আমেরিকার আইনেও বাধ্যবাধকতা সঞ্চালন করতে সক্ষম হয় এবং তা অবিলম্বে স্বীকৃত হওয়া উচিত। সুতরাং, যদি একটি আবেদন নতুন সরকার কর্তৃক প্রণীত হয় তাহলে এটাকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ, নাম যাই হোক – যেহেতু আরেকটা বংগ এখানে আছে।
অবশেষে, আমি বলতে চাই, জনাব স্পিকার, যে এই ঘোলা পানিতে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে। ব্রিটিশ সরকার যারা এই অংশ থেকে প্রস্থান করেছিল, তারা প্রথম ভারত ও পরে সিংহল কে বেইজ হিসেবে নেবে। জানিনা খবর সঠিক কিনা। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশও এমনটাই করছে। সাম্রাজ্যবাদ ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে পছন্দ করে। এবং আমাদের সময়মত হস্তক্ষেপ করতে হবে – কারণ বিপদ একদম আমাদের সীমানা পাসে চলে এসেছে।
আমি আপনাকে ধন্যবাদ, জনাব মাননীয় স্পিকার, আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য।
শ্রী সমর গুহঃ স্যার, আজ আমি এই উপমহাদেশের সবচেয়ে সুখী মানুষ। কারণ আমার পূর্ববাংলায় মুজিবুর রহমানের সাথে পাঁচ বছরের জন্য কাজ করতে হয়েছিল। এবং আমাকে পাগল বলে খেতাব দেয়া হয়েছিল যখন ১৯৫২ সালে আমার নিজের লেখা একটি বইতে আমি উল্লেখ করেছিলাম যে স্বাধীন পূর্ববাংলা পাকিস্তানের দুই অংশের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সৃষ্টি হবে। এরপর আমি বিভিন্ন নিবন্ধ ও গ্রন্থে অনেক বার এটা লিখেছি এবং সব সময় আমাকে মানুষ পাগল হিসেবে অভিহিত করেছে। কিন্তু, স্যার, আজ একটি পাগলের কথা সত্য হচ্ছে এবং একারণে আমি খুব খুশি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির পর সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। সম্ভবত এটা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। আমি মনে করি এটা দেশ ভাগের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ দেবে। এটা পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এক ঐতিহাসিক বিপ্লব।
মুজিবুর রহমানের এক বিস্ময়কর বিপ্লবী নেতৃত্বের উদাহরণ দিয়েছেন সমস্ত বিশ্ব তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। সকলে জানি ন্যাশনাল আওয়ামী লীগের নেতা জনাব ভাসানী চীনা সাহায্যে সব রকমের অসুবিধা তৈরি করছেন। কিন্তু এখন সব দল; ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জামাত – উল উলেমা, সব দল সম্পূর্ণভাবে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।
এটা মহান পরিতৃপ্তির একটা ব্যাপার যে এখন পূর্ব বাংলার সব বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগ ও তাদের সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শুধু সেনানিবাস এলাকায় এবং কিছু অন্যান্য শহরাঞ্চলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ৮০০০০ মানুষ নিয়ন্ত্রণে আছে। ট্যাংকের সাহায্যে এবং মেশিনগানের সাহায্যে তারা কসাইখানা করে রেখেছে; তারা পূর্ববাংলায় বিপ্লবীদের হাজারে হাজারে গণহত্যার করছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নত হবে এবং তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। কারণ, সেনাবাহিনীর এই ৮০০০০ মানুষকে চাপে রাখবে সাড়ে সাত কোটি মানুষ।
যারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা জানেন তারা এটা বুঝতে পারবেন। সেখানে অনেক নদী আছে। লজিস্টিক কারণেই সেখানে সকল জনসংখ্যার উপর দমন চালানো সহজ নয়।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে চাই একটি জাতির জীবনে এমন আন্দোলন এমন সুযোগ সব সময় আসে না। এটা নিষ্পত্তি করার সময়। এটা ভারত সরকারের নেতাদের দ্বারা নিষ্পত্তিমূলক কিছু করার সময়। আমি অনেক বার বলেছি যে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার বাস্তব সমাধান কাশ্মীরে নয়, বরং তা পূর্ব বাংলায়। যদি পূর্ববাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সফল হয়, যা আসলে হবেই, তখন সেখানে সমগ্র উপমহাদেশে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে ও ভারত ও পাকিস্তান মধ্যকার পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো হবে।
আমি বলতে চাই, অবিলম্বে সরকারের উচিৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাদেরকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। আমাদের দেখতে হবে কি অবস্থায় একটি জাতি তাদের সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। দেখা যায় আওয়ামী লীগ ১৬২ টি সদস্য পদ সুরক্ষিত করে যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়েও বেশী।
অতএব, যদি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক নীতির কোন অর্থ থাকে তাহলে বাংলাদেশর জনগণের অধিকার আছে তাদেরকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেবার।
তারা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের ভুঅঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের বেসামরিক প্রশাসনও চলছে এবং সেখানকার জনগণ তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। তাদের নিজস্ব সরকার ও নিজস্ব পতাকা আছে। সার্বভৌমত্ব পূরণের সকল শর্ত সেখানে উপস্থিত। অতএব, তারা নিজেদের একটি স্বাধীন দেশ ঘোষণা করতে পারে এবং বাস্তব গণতান্ত্রিক অর্থে তাদের সে অধিকার আছে এবং ভারতেরও অধিকার রয়েছে আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার।
এটি একটি প্রমাণিত সত্য। আমি বলছি না ভারত তার সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ববাংলায় ঝাঁপিয়ে পরুক। সামরিক হস্তক্ষেপ, আন্তর্জাতিক কোড মানা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রেখেই ভারত পূর্ববাংলার জনগণ ও বিপ্লবীদের সম্ভাব্য সকল সহায়তা দিতে পারে।
আমি কিছু জিনিস সুপারিশ করবে। ভারতের উচিৎ অবিলম্বে বিশ্ব জনমত গঠন করা। আমি এই সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে চাই। এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নেতারা তাঁদের সাহায্যের জন্য হাত প্রসারিত করতে ভারত, সিংহল এবং অন্যান্য এশীয় ও বিশ্বের দেশগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে। তারা এটা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে। অতএব এই বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু নয়। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে তাদের স্বীকৃত হবার অধিকার আছে।
আমিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি বেসামরিক মানুষ যারা গণহত্যার স্বীকার হচ্ছে তাদের জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে ব্যাবস্থা নিতে।
আমিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরও দাবি জানাচ্ছি তিনি যেন ব্রিটেন সরকার, কলম্বো বন্দর এবং মালদ্বীপকে পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ব লাকিস্তানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা নেয়ার জন্য বন্দর হসেবে ব্যাবহার করার অনুমতি না দেয় এই ব্যাপারে অনুরোধ করতে। নৌবাহিনীকে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারত মহাসাগরে পাহারা দিতে হবে যাতে এইসব নরঘাতক, খুনী রা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে না পারে।
আমি আরও একটি নিবেদন করি। আমি জানি যে, বাংলাদেশের হাজার হাজার লোক করাচি বিমানবন্দরে আশ্রয় নিয়েছে। তারা জানে না তাদের কি ঘটবে। তাদের জবাই করা হচ্ছে। অতএব, আমি তাদের ভারতের ভিতর দিয়ে একটি নিরাপদ ট্রেন বা অন্য কোন মাধ্যমে তাদের নিজের দেশে ফিরে যাবার পথ সহজ করে দিতে অনুমতি প্রদানে সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
উপসংহারে আমি বলব এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমাদের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত নষ্ট করা যাবেনা। আশা করব ভারতীয় একজন সাহসী কন্যা হিসেবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ রক্ষার বিপ্লবের হাত বাড়িয়ে দেবেন এবং ভবিষ্যতে ভারতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
বাংলাদেশকে আমার স্যালুট! জয় বাংলা জয় হিন্দ! মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ, নেতাজি জিন্দাবাদ! নেতাজি মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা। আমি ব্যক্তিগতভাবে তা জানি।
শ্রী এ.কে. সেন (কলকাতা উত্তর পূর্ব): এই কোন খারাপ মুহুর্ত নয় বরং গর্ব করার মুহূর্ত। এবং আমরা খুশি যে একটি জাতি বিপ্লবের মাধ্যমে জেগে উঠছে। তাদের বিরুদ্ধে যারা তাদের বছরের পর বছর শোষণ নির্যাতন করে যাচ্ছে। এখানকার অনেক রক্তাক্ত স্থান ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কাছে পরিচিত। সেখানে আমাদের হাজার হাজার শহীদদেরও রক্ত ঝরেছে যারা ব্রিটিশদের বুলেটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। সেই দৃশ্য আবার যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের বুলেটে ফিরে এসেছে কিছু নিরীহ লোকদের বিরুদ্ধে যারা শুধুমাত্র সাধারন নাগরিকদের মত বাঁচতে চেয়েছে এবং তাদের নাগরিক অধিকারটুকু চেয়েছে। তারা কি করেছে?
তারা শুধু তাদের নেতাকে ভট দিয়েছে। তারা স্বেচ্ছায় তাদের নেতাকে সব কিছু করার অনুমতি দিয়েছে। তিনি আইয়ুব খানের বা ইয়াহিয়া খানের মতো সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে জোরপূর্বকভাবে কিছু করেন নাই। মানুষ স্বেচ্ছায় তাকে সব ক্ষমতা দিয়েছে। যখন সামরিক নেতা পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন তারা তাদের নিজস্ব চোখে দেখেন বাংলাদেশের পতাকা ঘরে ঘরে উড়ছে এবং গভর্নমেন্ট হাউজ ও সামরিক সদর দপ্তরেও একই অবস্থা। এবং শাস্তি হিসেবে সামরিক জান্তা ৭০ মিলিয়ন নির্দোষ মানুষের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করেন। লাখ লাখ নারী রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে এবং আমরা তাদের জন্য গর্বিত। তারা আমাদের মত রক্ত মাংসের মানুষ। তারা এখনও আমাদের ভাষার বলে। তারা রেডিওতে যে গান গায় যুগ যুগ ধরে তা আমাদের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর সেখানে সমুদ্রপথ বিদেশী অস্ত্র সহ কিছু মিথ্যুক ঢুকে পড়ছে আর নির্বিচারে হত্যা করছে সেই সব নিরীহ নির্দোষ নারী, পুরুষ ও শিশুদের।
আমার মনে আছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মহান পিতা ডাচদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন যখন তারা সমুদ্র পথে তাদের সৈন্য ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা দমন করার জন্য যাচ্ছিল। তিনি তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বলেছিলেন। সেই মুহূর্ত আবার এসেছে। আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আবেদন করছি একই ভাবে নেতৃত্ব দিতে।
এটা শুধু বাংলাদেশের একার কণ্ঠস্বর নয়। বা শুধু পশ্চিমবঙ্গের কণ্ঠ নয়। এটা সমস্ত এশিয়ার কণ্ঠ, যা মানবতার কথা বলছে এবং তাদের দুর্দশা এবং দাসত্বের নির্মম কাহিনী জানান দিচ্ছে।
অতএব, প্রধানমন্ত্রী যে নেতৃত্ব দেবেন, যা দেশবাসী তাকে দিয়েছে। সাহসের হাত নিয়ে তিনি সমগ্র এশিয়াতে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং শোষণের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাবেন এটাই আশা।
এটা শুরু ভারত-এর জন্য একটি মুহূর্ত নয় – একা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি মুহূর্ত। এবং যদি আমরা কাজ শুরু করি তাহলে সবাই দেখতে পাবে – বিশেষ করে যারা সাধারণত নিরীহদের সাহায্যের জন্য কথা বলেনা। অতএব শুধু দুখ প্রদর্শন না এখন কিছু করার সময় এসেছে। তারা আমাদের সাথে ঘনিস্টভাবে সম্পর্কিত, তারা আমাদের বন্ধু, তাদের আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন এবং যদি আমরা সাহায্য কততে অস্বীকার করি তাহলে ভবিষ্যতে এই মুক্ত মানুষগুলো তা ভুলে যাবেনা।
আসুন নিজেদেরকে সংগঠিত করি এবং সব সাহায্য দেই। চলুন আগে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি শুরু করুন। পাকিস্তানে সব অস্ত্র সরবরাহ ব্যাহত করুন। দরকার হলে সেইসব বন্দর এবং দোকান দখলে নিন যারা নিরপরাধ মানুষদের জবাই করার উদ্দেশ্যে প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল। আমরা জাতিসংঘকে দাবি জানাই- সেখানে আমাদের পুর্ব অবস্থান ও জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে আমাদের এই গণহত্যা বন্ধে এগিয়ে আসতেই হবে – বিশেষ করে যারা আমাদের একদমই কাছের মানুষ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও খুব উৎসাহব্যঞ্জক ও সহানুভূতি পূর্ণ কথা বলেছেন যদিও তা অকপটে আমাদের অনেককে হতাশ করেছে। আমি প্রফেসর মুখার্জির অনুভূতির সাথে যোগ করে বলি, আমাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন, আরও অনেক শক্ত হওয়া দরকার যা পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা থাকবে।
আমার মনে আছে যখন ফরাসি বিপ্লব শুরু হয় এবং প্যারিস থেকে বিক্ষুব্ধরা ভার্সাই আসে রাজা বলেছিলেন – ‘মানুষ কি বিদ্রোহে করছে? তাঁর মন্ত্রী বলেন, “না, স্যার, এটা একটি বিপ্লব! ‘ প্রফেসর মুখার্জীকে তা মনে রাখতে হবে।
অতএব, এই শুধু নির্যাতিত কিছু মানুষের বছরের পর বছর ধরে শোষিত হবার যন্ত্রণা নয়। এটা নিছক সাহায্য ও সহানুভূতির কথা নয়। এটি কিছু করার জন্য চিৎকার করা বিপ্লবী কণ্ঠ যাতে বিশ্বের বিবেক জেগে উঠে এবং সেই মানুষগুলো যারা বিদেশী অস্ত্র নিয়ে নিরপরাধ মানুষের উপর সশস্ত্র যুদ্ধের অবতীর্ণ হয়েছে তাদের ধ্বংস করে দেয়।
শ্রী কে মনোহরণ (মাদ্রাজ উত্তর): পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি না শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য তো নয়ই বরং আমি দুঃখিত বলার জন্য যে তা ভয়ঙ্কর হতাশাজনক। আমার মত উদ্বেগ এই হাউসএর অনেকের কথায় ফুটে উঠেছে। শ্রী এ.কে. সেন যিনি আমার আগে বক্তব্য রাখলেন তিনি বলেছেন, শক্তিশালী ভাষা ব্যবহার করা প্রয়োজন। যতদূর আমি বুঝি যে শক্তিশালী ভাষা বলতে তিনি আরও জোড়াল পদক্ষেপ বুঝিয়েছেন; যা এখনো দৃশ্যমান নয়।
ব্যালট – যা পূর্ববাংলার জনগণের মর্যাদা, স্বীকৃতি, অবস্থান এবং স্বাধীনতা দিয়েছে তা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ইসলামাবাদ থেকে আনা অসংখ্য বুলেট দিয়ে তাদের উপর চালানো হচ্ছে। পূর্ব বাঙলায় যা হচ্ছে তা শুধু কিছু লোকের যুদ্ধ নয় – বরং তা ইয়াহিয়ার সাজানো মিলিটারি গুন্ডাদের বিরুদ্ধ যুদ্ধ।
এই প্রেক্ষাপটে, ভারত সরকারের কি করতে হবে? এটাই এখন এই হাউজদের সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের মূল জানার বিষয়। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই ইতোমধ্যে ভারত সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্ররোচনা দেবার অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাই একটি খোলা ঘোষণা দেয়া উচিৎ যে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে আছি। কিন্তু গোপনে বা অন্যথায় কোন ভাবে সরকার তা করবে তা আটদের ব্যাপার। আমরা সরকারকে সে ব্যাপারে বিব্রত করতে চাইনা।
জানামতে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার বিপক্ষে যথেষ্ট জনমত গঠন হয়েছে। তাই একটি সর্বদলীয় কনভেনশন বা সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে এবং তার মাধ্যমে আমরা জনমত সংগঠিত করতে পারি। আমরা সমগ্র উপমহাদেশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষন করতে পারি। এবং আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আমাদের নৈতিক সহানুভূতি দেখাতে পারি। যদি তার চেয়ে বেশী কিছু দেয়া হয় তাহলে সেটা কিছু গোপন সংস্থা বা আন্তর্জাতিক সংস্থা কে জানানো যথার্থ।
তার মানে আবার এই নয় যে, সরকার চুপ থাকবে। সরকার কূটনৈতিক ভাবে এটা নিয়ে আগাবে। সরকার মানবাধিকার কমিশন, জাতিসংঘ বা অন্য কোন ফোরামে পূর্ব পাকিস্তানের উপর যা হচ্ছে সেটার ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষন উত্থাপন করতে পারেন।
আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সকালে বৈঠক করি। প্রধানমন্ত্রী এটা সম্পর্কে অনেকটা চিন্তিত, এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা সম্পর্কে সমানভাবে উদ্বিগ্ন, কিন্তু তা সত্বেও, তার বিবৃতি আমাদের ভয়ঙ্কর হতাশ করেছে। তাই আমি অনুরোধ করব ভারত সরকারকে আরো একটু বিবেচনা করতে এবং তা সমস্ত জনগণ, দায়িত্বশীল সংস্থা, দেশ – বিশেষ করে এশিয়ান-আফ্রিকান দেশগুলোর কাছে পৌঁছাতে হবে এবং বিশ্বের মতামত নিতে হবে।
আমি যখন এই কথা বলছি এর মানে এই নয় যে আমি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছি। এটা এখন শুধু পাকিস্তানের বিষয় নয়। মেশিনগানের গুলিতে লাখ লাখ শিশুদের ও নারীদের হত্যা, ধর্ষন করা হচ্ছে – এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারেনা। আমরা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব। আমি মনে করি সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। আমরা মঙ্গলকামনা করি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারি।
শ্রী সমর গুহ: কোন পূর্ব পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ।
শ্রী কে মনোহরণ: জনাব সমর গুহ রহমানের যোগাযোগ রাখেন। আমার একে বাংলাদেশ বলতে কোন আপত্তি নাই।
কিছু সদস্য উঠে দাঁড়ালেন —
জনাব. স্পিকার: মাত্র অল্প কয়েক সদস্য প্রশ্ন বা ব্যাখ্যা করতে চাওয়ার অনুমতি চান, কিন্তু এটা কি নিয়মিত বিতর্কে পরিণত হল? এটা কঠিন যে কোনটা ব্যাতিক্রম আর কোনটা বিতর্ক।
শ্রী পি কে দেও (কালাহান্ডি): এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এবং প্রত্যেক দলকে অংশহ্রহন করতে দেওয়া উচিত।
ডঃ. হরি প্রসাদ শর্মা (আলওয়ার): এই হাউসের প্রতিক্রিয়া একটু তীব্র হয়েছে, আমরা একটু বেশি আবেগ প্রকাশ করছি। আমার মনে হয় না এত ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আমাদের প্রতিক্রিয়া আমাদের মৌলিক মূল্যবোধের উপর আক্রমণ তীব্র হয়েছে। মৌলিক কিছুতে আমাদের আক্রমন করা হচ্ছে। এটা না শুধুমাত্র দেশের অন্যান্য অংশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার দ্বারা আক্রমন নয় বরং মূল্যবোধের উপরে আক্রমণ। আমরা বরাবর বিশ্বজুড়ে মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেশের অন্যান্য অংশ নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি অহিংস সুশৃঙ্খল সংগ্রাম করছে এবং আমি মনে করি এর ইতিবাচক দিক আছে।
সেখানে অন্যান্য সমস্যা খুব শীঘ্রই শুরু হবে। যদি আমরা সঠিক আন্দোলন এর সিদ্ধান্ত না নিতে পারি। সরকারকে মনে করিয়ে দিতে একটি প্রবাদ – দেরিতে বিচার আসলে বিচার না করার নামান্তর। কাজেই কোন প্রকার বিলম্ব পূর্ব বাংলার জন্য হতাশাজনক হতে পারে।
আরেকটি সমস্যা যা খুব শীঘ্রই আসবে – তা হল পূর্ব বাংলার স্বীকৃতি। আমি মনে করি সরকারএর প্রস্তুত থাকা উচিত। আমরা স্বীকৃতির উপর তাত্ত্বিক আলোচনায় যেতে চাইনা। একটা পুরো জাতির স্বীকৃতির দরকার আছে। চারটি মৌলিক নিয়ম স্বীকৃতির জন্য পূর্ণ করা হয়েছে সেখানে। পূর্ব পাকিস্তানের একটি নির্দিস্ট অঞ্চল আছে; সেখানে নির্দিষ্ট জনসংখ্যা আছে; তাদের একটি নির্দিষ্ট জাতিগত পরিচয় আছে এবং কার্যত নিয়ন্ত্রণ আছে সরকার কর্তৃক – যার চালক মুজিবুর রহমান। কাজেই যদি আমরা সঠিক সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তাহলে আমাদের প্রতিবেশীর উপর অবিচার করা হবে যা আমাদের নিজস্ব মৌলিক নীতি বিরোধী। এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত নয়। ইন্দোনেশিয়াতেও এমন হয়েছিল। আমরা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা সেখানে কোনো সশস্ত্র বাহিনী পাঠাই নাই। সেখানে সবসময় আরেকটি কর্মপন্থা ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে নয়া দিল্লিতেএকটি সম্মেলনে আহূত হয়েছিল। আমি মনে করি অন্তত আমরা সেরকম কিছু করতে পারি কিনা। আমি শুধুমাত্র সুপারিশ করতে পারি – তবে সরকার যা করবেন তা যেন সমস্ত জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়। এবং যাতে ভবিষ্যতে আমাদের কোনোদিন লজ্জা না পেতে হয়।
শ্রী শ্যাম নন্দন মিশ্র (বেগুসারাই): জনাব স্পিকার, স্যার, আমার বলতে দ্বিধা নেই যে সরকার যে বিবৃতি দিয়েছে তা ফ্যাকাশে এবং ম্রিয়মাণ। আমি বলব যে এটা নির্জীব। এবং এটি বিশেষভাবে আশ্চর্যজনক অন্তত যে দেশের পেছনে এত শক্তি রয়েছে।
আমিও কয়েকটি শব্দ এখানে বলতে চাই। এখানে হয়ত আমাকে একটু সাবধান হয়ে বলা উচিৎ। আমরা কখনো পাকিস্তানের নামে কুৎসা রটাইনি। তাই এখন যদি কিছু বলি সেটা শুধুমাত্র এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বলা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে আমরা সম্ভ্রান্ত ফরাসির মত বলতে চাইনা যাকে তিনি আক্রান্ত হলে তা অবহিত করা হলে তাকে বলা হল যে একটি বিপ্লব শুরু হয়েছে। তখন তিনি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনটা আমরা চাইনা। আমরা আমাদের চোখ রাখতে পারিনা। অন্যান্য মাননীয় সদস্যরা বলেছেন যে আমাদের বর্ডারে কীভাবে গণহত্যা হচ্ছে, নিষ্পেষিত হচ্ছে মানবতা, মানব স্বাধীনতা ও গণতান্ত্র যেখানে মুখ থুবড়ে পরে আছে যারা আমাদের পরিবারের কাছের সদস্য ছিলেন।
আমরা আমাদের চোখ বন্ধ রাখতে পারিনা। সেখানে সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়েছে – এমন কি বর্ডারে যা হচ্ছে তাও নজরে রাখতে হবে। আমি আশা করি যে সরকার আমাদের পূর্ব সীমান্তে এমনকি আমাদের পশ্চিম সীমান্তেওচোখ রাখবেন। কারণ উভয়দিকেই বিভিন্ন আয়োজন চলছে। তারা সেটাকে আরও বাড়াতে পারে ও শাখাপ্রশাখা ছড়াতে পারে।
আমি আশা করি যে সরকার এমন পদক্ষেপ নেবে যে Cento বা SEATO এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করেন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার মাটিতে কি হচ্ছে এই অজুহাতে এখানে ঢোকার চেষ্টা না করে। এটা সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।
বিষয়টা এমন না যে আমরা সবসময় পাকিস্তানকে একটি স্থায়ী শত্রু হিসেবে দেখি। আর যদি তাই হয় তবে তাদের সঠিক ভাবে বুঝতে আমাদের সমস্যা হবে।
সর্বশেষে, আমার দল সন্তুষ্ট থাকবে সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক। এবং আমরা সন্তস্ট হব যে সরকার বাংলাদেশ পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে। কারণ আমাদের বিশ্বাস সরকার যদি বুঝতে পারে তাহলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবেনা।
পরিশেষে, আমরা অতি দ্রুত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানুষের স্বাধীনতা ও যেভাবে নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে সেই সত্য তুলে ধরার জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে। আমার কোন সন্দেহ নেই, যে কূটনৈতিক ভাবে সরকার তার সব প্রচেষ্টা বলবত রাখবেন। আমি আমার পার্টির পক্ষ থেকে বলতে চাই আমার এই হাউজের উপর ভরসা আছে। শুধু তাই নয় হাউজের বাইরে সেই সব সাহসী মানুষ আত্ম বিশ্বাসী মানুষ যারা জনগণের সার্বভৌমত্বের মত প্রকাশের জন্য আন্দোলন করছেন। আন্দোলন এত শক্তিশালী এবং আত্মনির্ভরশীল যে পাকিস্তান সরকার বলছে যে এটা বাইরের শক্তিগুলোর দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে। বরং আমি ভীত পাকিস্তান সরকার তাদের দমন করার জন্য বাইরের দেশ থেকে অস্ত্র এনে কিছু একটা করে কিনা। আন্দোলনশতস্ফুর্ত যে শেষ পর্যন্ত আমার আশা যে আন্দোলন সফল হবে।
শহর এস এ শামীম (শ্রীনগর): জনাব স্পিকার, আমার হৃদয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আমার ভাইদের জন্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং আমি পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাবলির ব্যাপারে অন্তর্বেদনা অনুভব করছি এবং এই হাউসে উদ্বেগ ভাগ করে নিচ্ছি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলবো যে আমি আবেগ দ্বারা তাড়িত নই। পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষ এক বিশাল সংকটের মুখোমুখি। আমাদের মাথা গরম করলে চলবে না। আমরা আবেগ দ্বারা চলব না। এই হাউজে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। সেই জুলফিকার আলি ভুট্টর বিরুদ্ধে যে ইন্দো-পাক সম্পর্ক নিয়ে, ফক্কার- বন্ধুত্ব নিয়ে, প্রতারিত করেছে। মুজিবুর রহমান কে ভারতের দালাল বানিয়েছে। ১৯৬৯ এর অভ্যুত্থানের একমাত্র তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার চার্জ দেয়া হয়েছিল যাতে বলা হয়েছিল সে আমাদের গুপ্তচর। আমাদের হাত ভুট্টোর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য নয়। তবে আমরা যে স্বীকৃতি দেবার জন্য তাড়াহুড়া না করি। এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই —
(বাধা)—-
শ্রী সমর গুহ: এটি একটি বিচ্ছিন্ন কথা।
শ্রী S.A. শামীম: হতে পারে। নিবন্ধিত হোক্। আমি আমার গণতান্ত্রিক ভিন্নমত বলার অধিকার রাখি। একই ভাবে আপনি আপনার মতামত প্রকাশ করতে পারেন।
প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে যে ক্ষেত্রে এই বিষয়টা জাতিসংঘের সাপ্নে পেশ করা হবে। আমি একজন কাশ্মীরি হিসাবে, জানতে চাই তাদের আসলে কি করার আছে? তারা গোটা ব্যাপারটাই তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। তারা কাশ্মীরে কি করেছে? আপনি জাতিসংঘে গিয়েছিলেন এবং আপনি আট দিনের মধ্যে একটি সমাধান আশা করেন। এখন ২৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং এখনও আপনি কোন সমাধান পান নাই।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আগ্রাসনের মুখোমুখি। তারা সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করছে। গ্রহণ করব বা করবোনা – এভাবে আমরা আগাতে চাইনা। এই পর্যায়ে আমাদের অন্তর্বেদনা এবং রাগ সংযত করতে হবে। আমি সরকারের সঙ্গে পুরোপুরি একমত এবং আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মিলিয়ে বলতে চাই যে তার বিবৃতি সময়োচিত।
মুজিবুর রহমান, যিনি আন্দোলন শুরু করেছেন, আমাদের সকলের সহানুভূতি তার দরকার। সে ভারতীয় সংসদ, ভারত সরকার বা ভারতীয় জনগণের অস্ত্র দিয়ে তার এই আন্দোলন শুরু করেন নাই। তিনি একজন সাহসী ব্যক্তি। আমি তাঁকে যতটুকু জানি তিনি যথেষ্ট সাহসী পাকিস্তানী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ন্ত্রণের জন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। আমাদের সহানুভূতি তার সাথে আছে এবং এটা রেকর্ডেড। আমি নিশ্চিত তিনি এই যে ভারতের পার্লামেন্টে ভারতের প্রতিনিধিরা তাদের সহানুভূতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তার উপর তাদের অন্তর্বেদনা প্রকাশ করবে।
সংকটের এই অবস্থায় ভুলে যাবেন না যে এখন পূর্ব বাঙলায় যে পরিস্থিতি তা দেশের অন্যান্য অংশে ঘটতে পারে। আপনি নিশ্চই ডান পন্থিদের প্রভাব সম্পর্কে অবগত? আমি তা সমর্থন করিনা এবং আমি একমত না যে এটা …….. করা উচিত (বিঘ্ন).
শ্রী সমর গুহ: সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। আপনি যা বলেছেন তা বলার অধিকার আপনার নেই — …… (বাধা)
শ্রী এস এ শামীম – এই সরকার ইয়াহিয়া সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সরকার আজ পর্যন্ত ইয়াহিয়া সরকারের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করেননি। আমি সচেতনভাবে কথা বলছি এবং আমি দায়িত্ব নিয়ে একটি পূর্ণ ধারনা সঙ্গে কথা বলছি। এক জন্য আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে ডান সমর্থন করিনা। আমাদের আরও ভাবতে হবে, আইনি এবং রাজনৈতিক প্রভাব বুঝতে হবে। আমার হৃদয় বাংলার মানুষের জন্য থাকবে এবং আমি পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে তার জন্য অনুতপ্ত অবস্থায় আছি। কিন্তু আমাদের মত প্রকাশের প্রতি মর্যাদাশীল হওয়া উচিত। আমাদের অভিব্যক্তি একটি সংযত হতে হবে। আমি আমার মত বলতে চাই, পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে কাশ্মীরের জনগণকে মুজিবুর রহমানের সাথে থাকবে – সেই মহান বীর, মহান মুক্তিযোদ্ধা।
কিছু মাননীয় সদস্য. জেগে উঠলেন ……..
জনাব. স্পিকার: এটা অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না।
শ্রী পি কে দেও – আমি হাউসের সামনে আমার দলের মতামত স্থাপন করতে চাই।
জনাব. স্পিকার: ভুলে যাচ্ছেন, আমি সব প্রধান দল এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের অনুমতি দিয়েছি।
শ্রী পি কে দেও: আমাদের একটি জাতীয় দল এবং আমরা আমাদের মতামত এখানে লিপিবদ্ধ করাতে চাই।
জনাব. স্পিকার: আমি ডঃ মেলকোট এবং শ্রী দেও কে দু’মিনিট সময় দিতে পারি। এরপর প্রধানমন্ত্রী কে দেয়া হবে।
ডঃ. মেলকোট (হায়দ্রাবাদ): আমাদের সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা আমরা অনুধাবন করেছি। যখন আমরা সেখানকার কথা বিবেচনা করি তখন আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়। যখন আমরা ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল্মা – ব্রিটিশরা আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং আমাদের ওপর তারা এমন বল করত যে তারা মনে করত তা করা ঠিক আছে। সে সময়ে আমরা সব বিশ্বজুড়ে সরকারের সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলাম এবং যখনই আমরা কাগজে যা পড়েছি ১৯৩০ এবং ১৯৪২ সালে কিছু বিদেশী সরকার আমাদের পক্ষে ছিল যার জন্য আমরা খুশি ছিলাম। কাজেই এই সন্ধিক্ষণে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব – আমরা আমাদের সহানুভূতি, অনুভূতি প্রকাশ করব এবং তাদের সমর্থন করব। গণতান্ত্রিকভাবে দেখানো হয়েছে যে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন এবং তারা একটি অহিংস পদ্ধতিতে একটি যুদ্ধ যুদ্ধ করেছেন। এখানে আমি আপনাদের দৃষ্টি আবদ্ধ করতে চাই। এটা ভারতের জনগণ ও ভারত সরকারের দায়িত্ব পূর্ববাংলার নিপীড়িত মানুষ যে যুদ্ধ করছে তাতে সাহায্য করা। সরকার পর্যাপ্তরূপে অনুভূতি ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মুহুর্তে প্রত্যেক সম্ভাব্য পদ্ধতিতে সমর্থন পূর্ববাংলার জনগণের জন্য খুব মর্যাদাপূর্ণ।
আমি সব সদস্য যারা এরকম বলেছেন তাদের সমর্থন করলাম। কিন্তু আমি অবশ্যই বলবো যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক প্রণীত বিবৃতি অপর্যাপ্ত এবং অপর্যাপ্ত।
জনাব. স্পিকার: আমি পি টি আই থেকে খবর পেয়েছি। আমার মনে হয়; এটা আমাদের নিজস্ব টেলিপ্রোম্পটার থেকে আসছে। এটি বলছে যে পূর্ব বাংলার নেতা মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রেডিও পাকিস্তান আজ (বাধা) ঘোষণা করেন।
কিছু মাননীয় সদস্য: লজ্জা লজ্জা!
জনাব স্পীকার: গ্রেপ্তারের গত রাতে মধ্য রাতের পর করা হয়েছিল. শ্রী পি কে দেও।
শ্রী পি কে দেও: জনাব স্পিকার, স্যার, স্বাতন্ত্র্য পার্টির পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত এবং জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করছি এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য তারা ডিসেম্বরের নির্বাচনে যে স্পষ্ট ম্যান্ডেট পেয়েছেন তার জন্য তাদের আকাঙ্খার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি।
আমি যখন বাংলাদেশের কথা বলি, তখন আমি পাকিস্তানে ভৌগোলিক অর্থহীনতা এবং ধর্মের ভিত্তিতে কংগ্রেসে দ্বারা গৃহীত হয়েছে বলে মনে করেছি। কিন্তু আমরা সবকিছু সমর্পন করে দিয়েছি। আমাদের পূর্বসুরিরা যা করে গেছেন আমরা সেই একই কাজ করতে চাইনা।
এই মুহূর্তে আমি ফলিস থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তারা যা করেছিলেন যখন চিনের তিব্বত আগ্রাসন করেছিল। অথবা চেকোস্লোভাকিয়ার আগ্রাসন। সেই ভুল গুলো আমাদে মনে রাখতে হবে। আমাদের সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্খার সমর্থন করা উচিত।
এই মুহূর্তে, আমি স্বতন্ত্র পার্টির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই জাতিসংঘে এবং আফ্রো-এশীয় সম্মেলন এবং অন্যান্য সব আন্তর্জাতিক ফোরামে মানবাধিকার কমিশনের প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ নিতে, এবং একই সময় সেখানে মানুষ ত্রাণ ও চিকিত্সার আবেদন পাঠাতে।
সর্বশেষে, আমি সেই সাহসী শহীদের যারা তাদের মাতৃভূমির জন্য নিজেদের জীবন দিয়েছেন তাদের শুভেচ্ছা জানাই। আমি তাদের সঙ্গে পূর্ণ সহানুভূতি প্রকাশ করছি।
প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রী ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী): জনাব স্পিকার, স্যার, কিছু খবর আমরা পেয়েছি. . . . .
জনাব. স্পিকার: আমি ভেবেছিলাম অফিস আমাকে পাঠিয়েছে তা ঘোষণা করতে। আমি জানি না।
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী: এই সংবাদ রেডিও পাকিস্তান থেকে এসেছে তবে আমি বলতে পারব না তা সত্য না মিথ্যা। আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটাকে সত্য বলে মেনে নেয়া ঠিক হবেনা কারণ এটা অপপ্রচারও হতে পারে।
স্যার, শক্তি কথার মসয়ে নিহিত থাকেনা। আমার সহকর্মী সরদার সাহিব আবেগের সঙ্গে উচ্চারিত করেন নাই। এর কারণ তার পক্ষ থেকে বা সরকারের পক্ষ থেকে সেই অনুভূতির অভাব। কিন্তু এটা সত্য যে আমরা এই আন্দোলন এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের ব্যাপারে গভীরভাবে সচেতন।
পূর্ববঙ্গে নতুন কিছু হয়েছে। সেখানে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে যাচ্ছিল যেখানে সকল মানুষ প্রায় এক কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলেন। আমরা এটাকে স্বাগত জানিয়েছি, এমন নয় যে আমরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছি। কিন্তু, ঘটনার মূল্যের জন্য তা করেছি। যেমনটা আমার এক বন্ধু বলেছেন – যার জন্য আমরা সবসময় একত্রে দাঁড়াই এবং যার জন্য আমরা সবসময় সোচ্চার হয়েছি। এবং আমরা আশা করেছিলাম যে একটি নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ আমাদের আরও কাছাকাছি আসবে। যা আমাদের নিজেদের মানুষদের ভাল পরিবেশ দেবে এবং এই উপমহাদেশে একটি সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করবে। কিন্তু তা হয়নি। পাকিস্তান এমন একটি সুদৃঢ় করার জন্যে চমৎকার সুযোগ নষ্ট হয়েছে এবং যা দুঃখজনক, পীড়াদায়ক। তাই এই সম্পর্কে আমরা শক্তিশালী কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না। এটিও আবার একটি নতুন পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন রূপে। এটা নিছক একটি দমন আন্দোলন নয়, । এখানে ট্যাংক দিয়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর চালানো হচ্ছে। আমরা সমস্ত ঘটনার খবর নিচ্ছি।
আমি নিশ্চিত মাননীয় সদস্যরা তা বুঝতে পারছেন। আমি মাননীয় সদস্যদেরনিশ্চিত করতে চাই যে আমরা অবশ্যই দ্রুত গুরুত্তপূর্ন সিদ্ধান্ত নেব। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শেষ হয়ে যায়নি। আমরা সম্পূর্ণরূপে সজাগ আছি। এবং আমরা কি ঘটছে এবং কি আমরা করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে ক্রমাগত দায়িত্ব পালন করব। আমি তার সাথেও একমত যে বলেছেন আমরা নিছক একটি তাত্ত্বিকভাবে যেন এগুলোকে না দেখি। একই সময়ে আমাদের সঠিক আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। গণহত্যা সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি সচেতন এবং যা আমরা বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এই মুহূর্তে আমি শুধু বলতে পারি যে, আমরা সম্পূর্ণরূপে হাউসের সবার অন্তর্বেদনা, আবেগ দেখেছি এবং এই বিষয়ের উপর তাদের গভীর উদ্বেগ ভাগ করে নেব। আমার সবসময় বিশ্বাস আছে যে স্বাধীনতা অবিভাজ্য নয়। আমরা সবসময় নির্যাতিতদের সাথে ছিলাম। কিন্তু এই রকম গুরুতর অবস্থায় আমরা, সরকার হিসেবে, মনে করি আমরা ভালো অবস্থায় আছি। আমি হাউসকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ আছি এবং আমরা বিরোধী দলীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখব যাতে তারা আমাদের তাদের পরামর্শ দিতে পারেন এবং আমরা তাদেরকে আমরা যতটুকু জানব তা জানাতে পারি।