1975.06.13 | বাকশাল গঠন নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রার রিপোর্ট | ১৩ জুন ১৯৭৫
নতুন অভিযাত্রা
পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণ – মুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় চার আদর্শের অনুকরণে রাষ্ট্র ও জনগণের সার্বিক কল্যাণ ও সর্বাত্মক উন্নয়নের জন্য বিপ্লবী অভিযাত্রার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক কাঠামো ঘোষণা করেছেন।সেই সঙ্গে ঘোষণা করেছেন দলের ও কার্যনির্বাহী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের নামের তালিকা। সংগ্রাম ও প্রত্যয়ের স্মারক মহান ৭ই জুনের ঐতিহাসিক দিনে বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা করেন। সে হিসেবে এই ঘোষণা তাৎপর্য মন্ডিত। প্রত্যেকটি জাতির জীবনে এমন কয়েকটি তারিখ থাকে যে দিনগুলো সে জাতির স্বকীয়তা এবং গৌরবময় পথযাত্রার প্রতীক। ৭ই জুন বাঙালী জাতির ইতিহাসে তেমনি একটি দিন। আর এই দিনে জাতীয় দলের গঠনতন্ত্র এবং সাংগঠনিক কাঠামো ঘোষণা করে এ দিনটিকে আরো গৌরবময় করে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু। দেশের শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে, দেশের জনগণের জন্য একটি সুখী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের পূর্বশর্ত হিসেবে দ্বিতীয় বিপ্লবের অহ্ববান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু এ বছরে ২৫শে জানুয়ারী। যাতে দেশের প্রতিটি স্তরের লোক ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে সে সুযোগও দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আর এ উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবশান ঘটিয়ে একটি মাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা। যে রক্তক্ষয়ী সংগামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সে সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ গণজাগরণ ছিল চালিকা শক্তি। সেদিনের সেই দিনগুলোতে দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য। জাতীয় প্রয়োজনে, সংকট উত্তরণে যে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন, সে জাতীয় ঐক্য স্থাপনে ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের মানুষ। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পেছনে চালিকা শক্তি হিসেবে যা কাজ করেছে তা হচ্ছে বাঙালাদেশের মুক্তি কামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ পথযাত্রা। আর সেই সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে ব্যক্তিগত মতবাদ কিংবা দলগত আদর্শের ওপর স্থান দিয়েছিলেন সবাই। এমনিভাবেই তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি প্রাপ্ত সবক’টি দেশ জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই একাত্তর সালে নতুনভাবে পথযাত্রা শুরু করেছে বাঙালী জাতি। সেদিনের সেই পথযাত্রার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। স্বাধীনতার পর দলমতনির্বিশেষে সবাই রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করেছেন, ভিন্ন প্লাটফর্মে দাড়িয়ে দেশবাসীর সামনে তাদের কর্মসূচী উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু বিগত তিন বছরে জাতীয় জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেছে যা জাতীয় পরিস্থিতির পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। গণবিরোধী একশেণীর লোক জাতীয় জীবনের সুখ-শান্তি বিনষ্ট করে দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে মেতে উঠেছিল। তাদের বহুবার ভালো হবার সুযোগ দিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্ত সে আহ্বানে কেউ কর্ণপাত করেনি। বঙ্গবন্ধু অবশেষে বাধ্য হয়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরো তিনটি কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন সেগুলো হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। পরমুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকলে, দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ না করলে, রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়েছে তা অর্থহীন হয়ে যাবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অচলাবস্থা,উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি এতদিনের আকাঙ্ক্ষিত প্রগতির পথে বাধা হয়ে ছিল। সরকারের কাঠামোর এই মৌলিক পরিবর্তন সেই বাধাকে অপসারিত করবে,প্রশাসনিক সংকট দূরীভূত হবে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে। তাই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব সার্থক ও সফল করে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের। দেশ গঠনে এখন আত্মনিয়োগ করা উচিত প্রতিটি মানুষের। সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত উদ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় যাতে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত নীতি ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করা যায় তার জন্যই একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত নীতিমালার ফলশ্রুতি হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়াগী লীগ। শাসনব্যবস্থাকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করার জন্য একটি মাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলের ব্যবস্থা রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন নয়। বিশেষ করে, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য বাংলাদেশের যে অঙ্গীকার সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের ইচ্ছার বাস্তব প্রতিফলন। তাই জনগণের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব অনেক বেশী। আর সে কর্তব্য ও দায়িত্বকে সঠিভাবে সম্পাদন করার জন্য প্রয়োজন রাষ্টীয় শাসন ব্যবস্থায় একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের কতৃর্ত্ব, যে রাজনৈতিক দলে দেশের প্রতিটি নাগরিক অংশহণ করবেন। এর পেছনে রয়েছে বাস্তব ভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত দর্শন। রাষ্টের প্রতি ব্যাপক জনগণের যে প্রত্যাশা, সে প্রত্যাশার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি মাত্র রাজনৈতিক দল। এর ফলে বিচ্ছিনভাবে নয়, একই কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও অভিজ্ঞতার বিনিময়ে জনগণের জন্য এমন এক ব্যবস্থা প্রবর্তনে সক্ষম হন যা জনকল্যাণে নিবেদিত। রাষ্ট্র রাজনৈতিক কর্মকান্ড এসবের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে সমগ্র জনসাধারণের কল্যাণ। এই কল্যাণ ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় যতখানি সম্ভব, অন্যকোন ব্যবস্থায় তা সম্ভব নয়। অপর দিকে রাষ্টীয় বিধিব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য যদি কোন শক্তিশালী মাধ্যম না থাকে, তাহলে সে রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রীয় ব্যবধা হতে পারে না। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ সব একই সূত্রে গ্রথিত । পরষ্পরের প্রতি পরস্পরের যে অঙ্গীকার তার সামগ্রিক ফলশ্রুতি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্তব্য ও দায়িত্ব সহজেই অনুমেয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হলে তাই প্রয়োজন একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের। জনগণ হচ্ছেন সার্বিক ক্ষমতার উৎস । আর সে ক্ষমতাই রাষ্ট্রের শক্তির জোগষোপান। কাজেই সমগ্র জনগণকে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে, জনগণের ক্ষমতার যে ব্যবহার সম্ভব, অন্যভাবে তা সম্ভব নয় । বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দেশ। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশেই আজ একদলীয় শাসনব্যবস্থা। তৃতীয় বিশ্বের সামনে আজ যেসব সমস্যা, সেসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্যই একদলীয় শাসনব্যবস্থা। আর এই এক জাতীয় দলের মধ্যে সমবেত হয়েছেন সবাই। তৃতীয় বিশ্বের যে দেশগলো আমাদের নির্ভরযোগ্য মিত্র, সেসব দেশগুলো এ ব্যাপারে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই দেশগুলোতে সবাই জাতীয় প্রয়োজনকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে একই দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। একই রাজনৈতিক দলের কাঠামোর মধ্যেই আলাপ, আলোচনা, সমালোচনা ও আত্ম-সমালোচনার মাধ্যমে স্থিরীকৃত হয় জাতীয় অগ্রগতি সাধনের কর্মসূচী। দেশ গঠনে মতের বিভিন্নতা অস্বাভাবিক নয়। কিন্ত সহনশীলতা থাকলে এই বিভিন্নতাকে একটি লক্ষ্যে পরিচালিত করা যায়। আলজিরিয়া, মিসর, তানজানিয়া প্রভৃতি দেশগুলো সে বাস্তবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের যে কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন, সে কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কাজ । ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারলে যে সফলতা অর্জন সম্ভব অন্যভাবে তা সম্ভব নয়। এতদিন যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্লাটফর্মে দাড়িয়ে রাজনীতি করেছেন তাদের দেশপ্রেম সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ নেই। কিন্ত এ দেশপ্রেমকে যদি জাতীয় কল্যাণে ও অগ্রগতি সাধনে নিয়োজিত করা।যায় তাহলে তা বিপথগামী হবে। আর এই দেশপ্রেমকে সুষ্ঠভাবে জনগণের স্বার্থে নিয়োজিত করতে হলে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলের কাঠামোয় ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর যে দেশগুলো পাঁচ এর দশকের পর স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে দেশগুলো এ পথেই জাতীয় অগ্রগতি সাধন করেছে । কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-যুবক, নারীসমাজ এবং বুদ্ধিজীবীসহ দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের সমন্বয়ে একক একটি জাতীয় দল গঠনের মধ্য দিয়ে সুশৃঙ্খল শোষণহীন একটি সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কে অঙ্গীকার তিনি রেখেছেন।জাতীয় দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে সকল স্তর এবং বৃত্তির মানষের । দলের কার্যনিবাহী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোতে সমন্বয় ঘটেছে বহুমখী প্রতিভার আর সার্বিক প্রতিনিধিত্বের। সংগ্রামী নেতা, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, পালামেন্টারিয়ান, অর্থনীতিবেত্তা, কৃষক-শ্রমিক, যুবক ও ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি, মহিলা প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পদস্থ সরকারী কর্মচারী এবং প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানগণসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকেই অভন্ত করা হয়েছে জাতীয় সংগঠনে। সর্বশেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় দল গঠিত (অস্পষ্ট)
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1975.06.13-bichitra.pdf” title=”1975.06.13 bichitra”]