You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.26 | বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে আলোচনা | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সুত্র তারিখ
২১২। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী ২৬ মার্চ, ১৯৭১

লোকসভার কার্যক্রম দুপুরের খাবার বিরতির পর আবার দুইটা বেজে চার মিনিটে শুরু হল।

সভাপতিত্ব করছেন শ্রী আর ডি ভান্ডারী
বিষয়: পুর্ব বাংলার অবস্থা/ঘটনাবলী

শ্রী সমর গুহ(কাঁথি): জনাব, আমি অতি জরুরী একটি বিষয়ের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন ও বটে। এই মাত্র আমরা রেডিও এর খবর মারফত জানতে পারলাম যে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০০০ সৈন্য এনে সেখানে সেনাবাহিনী সব বড় বড় শহর ও গুরুত্বপুর্ন এলাকাইয় অবস্থান নিয়েছে।

ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেছেন। তার সরকার ঢাকা সহ অন্যান্য বড় শহরে সান্ধ্য আইন জারি করেছে। তারা ঢাকা বেতার কেন্দ্রের দখল নিয়ে নিয়েছে। তারা সেখানে বাংগালীদেরকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে। শুধু নাই নয়, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে ব্যাপক যুদ্ধ করছে।

আমার কাছে খবর আছে যে শত শত লোককে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। পথেঘাটে কাউকে দেখা মাত্রই তাকে গুলি করার একটা নির্দেশ জারি করা হয়েছে। আরেক সংবাদে জানা গিয়েছে যে করাচী বিবানবন্দরে হাজার হাজার বাঙালি পুর্ব পাকিস্তানে চলে আসার চেষ্টাইয় জড়ো হয়েছেন। সেখানেও কয়েকশত লোক নিহত হয়েছেন।

আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে জানাতে চাই যে ধারনা করা হচ্ছে যে শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য নেতাদের হয় মেরে ফেলা হবে নয়ত তাদেরকে বন্দি করে কলম্বো বিমানবন্দরের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে। সুতরাং আমি আপনার কাছে, এবং আপনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি যাতে ভারত সরকার শ্রীলঙ্কা সরকারের কাছে পাকিস্তানি সামরিক বা বেসামরিক কোন বিমানই যেন সামরিকবাহিনির সদস্যদেরকে শ্রীলঙ্কা হয়ে যাওয়া আসা না করতে পারে সে ব্যাপারে লিখিতভাবে অনুরোধ করে।

এছাড়াও আরেকটি ব্যাপার আছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের লোকদের এখন খবরের জন্য কেবলমাত্র অল ইন্ডিয়া রেডিওর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর উচিত খবর প্রচার … (বাঁধা)। আমাকে শেষ করতে দিন। বাংলাদেশের সংগ্রাম পরিষদ এই প্রথম ভারত ও শ্রীলঙ্কার কাছে আন্তর্জাতিক জনমতকে স্বাধীনতার পক্ষে আনার জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। আমি সরকারকে অনুরোধ করছে এ বিষয়টি অন্যান্য এশিয় দেশের সাথে সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘে আলোচনায় জন্য তুলতে।

আমি করাচী বিমানবন্দর জড়ো হওয়া বাঙ্গালীদেরকে সরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা করার অনুরোধ করছি।
সবশেষে বলছি, আমি এই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই একটি দৃষ্টিআকর্ষনী প্রস্তাব এনেছি এবং এ ব্যাপারে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রস্তাবও দিয়েছি। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন ও জরুরী। আমি এই (লোক)সভায় অনেকবার বলেছি যে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সমাধানের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন। এটা অত্যন্ত জরুরী এবং অত্যাবশ্যক বিষয়। আমরা এ নিয়ে চুপ হয়ে বসে থাকতে পারি না। আমাদের সরকারের উচিত ব্যাপারটি আমলে নেয়া এবং এ নিয়ে কিছু একটা করা।

শ্রী এস ব্যানার্জি (কানপুর): জনাব, শুধুমাত্র যে সামরিক আইন জারি হয়েছে তাই না, বরং দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদেরকে সেনাবাহিনীর কর্নেল ও জেনারেলরা নির্দেশ দিয়েছে খবর সংগ্রহের জন্য হোটেলের বাইরে না যেতে এবং বলা হয়েছে যে বাইরে গেলে তাদেরকেও গুলি করা হবে। এই সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে সেখানে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এজেন্টরা যারা পুর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের সফলতা চায়নি সেখানে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগন যে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে জয় লাভ করেছে এটা তাদের ভালো লাগেনি।

এই হচ্ছে আমার প্রস্তাব। ফ্যাসিবাদিরা পুর্ব পাকিস্তানে গনতন্ত্রকে হত্যা করছে। চলুন আমরা সমর্থন দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করি এবং জানাই যে আমরা অন্যান্য দেশের জনগনের অধিকার রক্ষায় ও কাজ করব। আমি আপনাকে, এবং আপনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি গনতন্ত্রের ঝান্ডা সমুন্নত রাখতে ও শেখ মুজিবকে আরো সহায়তা দিতে। যদি শেখ মুজিব মারা যায়, তাহলে ইয়াহিয়ার ফ্যাশিস্ট সরকার আবার পুর্নশক্তিতে বহাল হবে। আমরা এর বিরোধিতা করছি। পাকিস্তানের জনগনকে জানিয়ে দেওয়া হোক যে ভারত মুজিবুর রহমানের সাথেই আছে এবং আমরা ইয়াহিয়ার সকল কর্মকান্ডের নিন্দা জানাচ্ছি।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু (ডায়মন্ড হারবার): এই ব্যাপারটাতে ভুক্তভোগী যারা তারা আমাদেরই রক্ত মাংস। সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের কারনেই আমাদের দেশ ভাগ হয়েছিল। সেদিক থেকে দেখলে আমরা উট পাখির মত বালিতে মাথা গুঁজে রাখতে পারি না। আজকে কি হচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানে? যদিও আমরা বারবার চেষ্টা করেছি এই ব্যাপারে সরকারের নীতি ও মনভাব জানতে, আমরা ব্যর্থ হয়েছে উত্তর পেতে। লোকসভার সভাপতিও এ প্রসঙ্গে কোন তথ্য দেননি। এখন পর্যন্ত আমরা রেডিও এবং অন্যান্য বক্তাদের মাধ্যমে যা তথ্য পেয়েছি তার ভিত্তিতে কি আপনি দয়া করে আমাদের সরকারকে অনুরোধ করবেন যাতে সরকার তার নিজস্ব সুত্রে পাওয়া তথ্যের আলোকে আমাদেরকে জানিয়ে অবিলম্বে একটি বিবৃতি দেয় এবং আমাদেরকে জানায় যে বাংলাদেশের জনগনের উপর নির্বিচার হত্যার ব্যাপারে আমরা কি করতে যাচ্ছি?

মিনিস্টার অফ পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স, শিপিং অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট (শ্রী রাজ বাহাদুর): সরকারও স্বাভাবিকভাবেই বিরোধিদলের সদস্যদের মতই আশঙ্কিত বাংলাদেশে কি হচ্ছে তা নিয়ে। আমরা আমাদের নিজস্ব সুত্রে সব ধরনের তথ্য জোগাড় করব …

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আপনারা এখনও (তথ্য) জোগাড় করেননি?

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমরা জোগাড় করেছি ও আরও করছি।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আমাদেরকে জানান।

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমরা এ বিষয়ে নজর রাখছি এবং যথাসময়ে এ ব্যপারে বিবৃতি দেয়া হবে।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: এক্ষনি … (বাঁধা)

শ্রী রাজ বাহাদুর: যত তারাতারি সম্ভব।

শ্রী সমর গুহ: আমরা যদি এখনই বিবৃতি না দেই তাহলে ওদের মুক্তি সংগ্রামের ব্যপারে আমাদের সংহতি … (বাঁধা)

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমি চাপের মুখে নতি স্বীকার করবো না। আমি কথা শেষ করার আগেই আপনারা আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন। আমরা অবশ্যই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি পরিপুর্ন বিবৃতি দেব।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আজকেই কেন নয়?

শ্রী রাজ বাহাদুর: যদি আজকে হয় তাহলে আজকেই, যদি এই মুহুর্তে হয় তাহলে এই মুহুর্তেই … (বাঁধা)। আমাদের উত্তেজিত হয়ে বা তাড়াহুড়া করে কিছু করা উচিত হবে না। আমাদের অবস্থাটা খুব সাবধানে খুঁটিয়ে দেখে বিচার করে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিবৃতি দিতে হবে।

শ্রী ইসহাক সম্ভলী (আমরোহা): চেয়ারম্যান সাহেব, মন্ত্রি মহোদয় বলেছিলেন যে যথাসময়ে সরকার বিবৃতি প্রদান করবেন। আমি জানতে চাই সেই সময় কখন হবে।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: আমরা এ ব্যাপারে আপনার রুলিং চাই।

সভাপতি: আমি আমাদের ইচ্ছার কথা মন্ত্রি মহোদয়কে জানাবো।

শ্রী ইসহাক সম্ভলী: আমার আশঙ্কা- যে কোন সময় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে ফেলতে পারে।

সভাপতি: আপনি চেয়ারে বসুন জনাব সম্ভলী

শ্রী ইসহাক সম্ভলী: এ সময় বাঙ্গালী নিধনের প্রশ্ন। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এখন আর বিলম্ব করার অবকাশ নেই।

শ্রী রাজবাহাদুর: জনাব, আমি আগেও বলেছি আমাকে সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত …

শ্রী ইসহাক সম্ভলী: আমি এর আগেও বাঙ্গালী নিধন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছি। একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। অনতিবিলম্বে এই সমস্যা রাষ্ট্রসংঘে তোলা উচিত এবং বাংলাদেশের মানুষের সাথে একাত্মতা (প্রকাশ) করা প্রয়োজন।
সভাপতি: সন্মানিত সদস্য আপনি দয়া করে নিজের আসনে বসুন।

শ্রী সমর গূহ: আমি শুধু আরেকটি জরুরী ব্যাপারে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন একারনে যে শেখ মুজিবুর রহমানকে যেকোনো মুহুর্তে গুলি করে মেরে ফেলা হতে পারে। শুধু মাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভারত ও শ্রীলঙ্কার মত প্রতিবেশি দেশের প্রতিক্রিয়াই তার প্রান বাঁচাতে পারে। এই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী। তাকে যেকোনো মুহুর্তে মেরে ফেলা হতে পারে। আমি এই মুহুর্তে একটি প্রস্তাব আনতে চাই। সরকার কি এই ব্যাপারটিকে গুরুত্বপুর্ন ও জরুরী মনে করছে নাকি করছে না?
শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: স্যার আপনি অন্যায্য আচরন করছেন।

সভাপতি: আমি সব সময়েই আপনাদের প্রতি ন্যায্য আচরন করেছি। আপনার শব্দচয়নে সতর্ক হোন। আমি অন্যায্য আচরন করেছি, এরকম অভিযোগ তুলবেননা।

পার্লামেন্টারী অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রি এ ব্যাপারটা আমলে নিয়েছেন এবং তিনি ব্যাপারটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবেন এবং সভায় প্রয়োজনীয় বিবৃতি দেয়া হবে আজ-কালের মধ্যেই।

শ্রী সমর গূহ: শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী নন, ব্যাপারটা জানা প্রধানমন্ত্রীর জন্যও গুরুত্বপুর্ন।

সভাপতি: আপনি আপনার আসনে বসুন।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: স্যার, সরকারকে দিয়ে আজকের মধ্যে একটি বিবৃতি প্রকাশ করাটা সম্পুর্ন আপনার হাতে। তাদের কাছে যদি তথ্য না থাকে তাহলে তারা ট্রেজারী বেঞ্চে বসার অযোগ্য।

শ্রী রাজ বাহাদুর: যে কোন বিবৃতি প্রকাশিত হবার আগে মন্ত্রিপরিষদের সামনে তুলতে হবে, তারপর মন্ত্রিসভা বসবে, সব তথ্য যাচাই করে দেখতে হবে, তারপরেই কেবল বিবৃতি প্রকাশ করা সম্ভব।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: কিন্তু লোকসভা তো কালকে শেষ হবে।

শ্রী সমর গূহ: শুধু মনে রাখবেন যে শেখ মুজিবর রহমানের প্রান রক্ষা ক্ষমতা এখন ভারত ও শ্রীলঙ্কার জনগনের হাতে।

শ্রী রাজ বাহাদুর: আমরাও এ ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের সমানই উদ্বিগ্ন … (বাঁধা)

সভাপতি: কিছুই লিপিবদ্ধ করা হবে না, এখন থেকে এখানে যা বলা হবে তার কিছুই লিপিবদ্ধ করা হবে না … (বাঁধা)

মন্ত্রি মহোদয় ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা আমলে নিয়েছেন। তিনি বারবার করে সেকথা বলেছেন।

শ্রী রাজ বাহাদুর: এই বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর অঞ্চলে একটি স্পর্শকাতর বিষয় এবং স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের স্বার্থেই আমাদেরকে ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। সবকিছু খতিয়ে দেখার পর আমরা অবশ্যই একটা বিবৃতি দেব।