শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
২১৪। বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ প্রসঙ্গে আলোচনা | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী | ২৯ মার্চ, ১৯৭১ |
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী (গোয়ালিকর)ঃ আমাকে আরেকটি কথা বলতে হচ্ছে। সারাদেশ এবং এই সংসদ বাংলাদেশের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে উপস্থিত আছেন। এই সভা কি বাংলাদেশের জনগণের সংগে নিজের সংহতির কথা ব্যক্ত করে একটি প্রস্তাব পাশ করতে পারে না? প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রী যা কিছু বললেন বিপক্ষ দলের অন্যান্যরাও সেই কথাই বলছেন। ভারতের পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলার জনগণের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করছে এটা আমাদের রেকর্ডে থাকা দরকার। আমি মনে করি, এটা কোন দলীয় ব্যাপার নয়। এখানে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় এবং আমরা ওই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি।
স্পীকারঃ প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির উপর এখানে পর্যাপ্ত বক্তৃতা হয়েছে। বক্তৃতার রূপ ছিল বিতর্কের মতই। এসব বক্তৃতায় যা কিছু বলা হয়েছে, আমি মনে করি, তাতে হাউসের সম্মতি ছিল এবং তাকে প্রস্তাবের সমরূপ মনে করা চলে।
শ্রী সমর গুহ(কন্টাই)ঃ এটা বিতর্কের ব্যাপার নয়। ট্যাঙ্ক ও মেশিনগানের গুলিতে ঢাকায়, চট্টগ্রামে ও অন্যান্য জায়গায় হাজার হাজার মানুষ মরেছে। এই গনহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী কী করেছেন?
উনারা কী করেছেন? যখন হাজারে হাজারে মানুষ মরছে তখন এটা বতর্কের বিষয় নয়। এটা কোন বিশেষ শুভ ইচ্ছা পোষণের ব্যাপার নয়। এই কশাইগিরি(নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড), বিশৃঙ্খলা এবং গনহত্যার প্রতিবাদ সরূপ আমাদের সরকার কী করেছে?
এখানে আরেকটি বিষয় আছে। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাসমূহে প্রকাশ হয়েছে যে গুয়াহাটি থেকে কলকাতা গামী ভারতীয় যাত্রীবাহী একটি ডাকোটা পাকিস্তান আর্মি গুলি করে ভূপাতিত করেছে এবং তা ধ্বংস হয়ে পাকিস্তানের ভিতর গিয়ে পরেছে।
স্পীকারঃ আপনি কি দয়া করে বসবেন? আমি আপনাকে অনুমতি দিচ্ছিনা।
শ্রী সমর গুহঃ এটা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমি এই ব্যাপারে মনোযোগ দিতে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলেছি। বেসামরিক বিমান মন্ত্রীর এই সভায় ডাকোটাটি এখনো নিখোঁজ কিনা এই ব্যাপারে একটি বিবৃতি দেয়া উচিত।
স্পীকারঃ আমি আপনাকে অনুমতি দেইনি।
শ্রী সমর গুহঃ আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এমনকি ভারতীয় নাগরিকদেরও পাকিস্তানি আর্মি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করছে। আমরা কি এমন চুপচাপ বসে থাকব যখন হাজারো মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে অকারণে নিষ্ঠুরভাবে এবং যখন অকারণ বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে? স্যার, এটা শুধুমাত্র সহানুভূতি জানানো নয়। সত্যিকার কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে …
স্পীকারঃ শ্রী সমর গুহ, আমাকে অতি রুঢ় হতে হবে যদি আপনি এরকম করে যেতে থাকেন?
শ্রী সমর গুহঃ গণহত্যা থামানোর জন্য? আমি তাই জানতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি যে, এই সভার উচিত পুর্ববঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সম্পুর্নভাবে সংহতি প্রকাশ করা। এটা একটা চরম প্যাঁচ, শুধু …
স্পীকারঃ শ্রী গোপলান।
শ্রী সমর গুহ, আপনি দয়া করে বসুন।
শ্রী সমর গুহঃ আমি বসছি না। সীমানার ঐপারে আমার ভাইয়েরা নিহত হচ্ছেন। আমি ঢাকা থেকে এসেছি, আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমি জানি ঢাকার রাস্তায় হাজারো মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আপনি কি চান যে আমি চুপচাপ বসে থাকি, যখন আমার ভাইয়েরা অকারণে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হচ্ছেন, তাদের হত্যা করা হচ্ছে?
স্পীকারঃ আপনি দয়া করে রাশ টানুন।
শ্রী সমর গুহঃ মা, মহিলা এবং বাচ্চাদের হত্যা করা হচ্ছে, এবং আমরা চুপচাপ বসে আছি।
স্পীকারঃ আপনি যদি এইরকম করতে থাকেন, তাহলে কিছুই রেকর্ড হবে না, আপনি দয়া করে বসুন। একই বিষয় আরো ভালোভাবে বলা যায়।
শ্রী সমর গুহঃ আপনি যদি শুধু ঢাকা হতে আসতেন! আপনার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম হত।
শ্রী এস এম ব্যানার্জি(কানপুর)ঃ আমরা প্রত্যেকেই ঢাকা হতে আসা। আপনি শুধু একা নন। (বাধা দিয়ে)
স্পীকারঃ এটা কি হচ্ছে? অন্যদের উপস্থিতিতে আপনাকে উল্লেখ করা আমার জন্য ভাল দেখায় না। শ্রী গোপলান।
শ্রী এ কে গোপলান(পালঘাট)ঃ স্যার, এটা সত্য যে, একটা বিবৃতি দুই দিন আগে দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি কিছুদিন আগের অবস্থা থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন। ওখানে একটা অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে এবং যেখানে যুদ্ধ পরিস্থিতি চলেছে, সে ব্যাপারে বলা যায় যে ওখানকার অবস্থা খুব ভয়াবহ। সুতরাং, এখানে সরকারেরও কিছু বলার থাকতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রীও দুইদিন পর ঐদিন বলেছেন, যখন প্রতিবার একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখন প্রধানমন্ত্রী কিছু বলতে পারতেন। সুতরাং এখন এটা সময় যে আমরা বালাদেশ-পুর্ব পাকিস্তান এর পরাক্রমশালী জনগণের প্রতি আমাদের সংহতি প্রকাশ করি। এটা সত্য যে আজকের অবস্থা দুইদিন আগের অবস্থা থেকে ভিন্ন। সুতরাং, আমরা অনুরোধ করি যে প্রধানমন্ত্রী পুর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধরত মানুষের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে একটা বিবৃতি দিবেন।
শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত(আলিপুর)ঃ মাননীয় স্পিকার, আমি কি একটা মতামত দিতে পারি?
যেমনটা শ্রী গোপলান এরমধ্যে বলেছেন যে, ঘটনাপ্রবাহ এখন খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যেহেতু আপনি এই সভায় ঘোষণা দিয়েছেন যা এর মধ্যে সভা দ্বারা অনুমোদিতও হয়েছে, যে লোকসভা আগামী ২রা এপ্রিল মুলতবি করা হবে এবং যা আর মাত্র চার-পাঁচ দিনের ব্যাপার, আমি আপনার এবং এই সভার বিবেচনার জন্য দুটো প্রস্তাবনা করতে চাই।
প্রথমত, আমি আমার সহকর্মী শ্রী বাজপেয়ীর ধারণার সাথে সহমত পোষণ করি যে এই সভার কার্যক্রম মুলতবি হওয়ার পুর্বে- আমি অন্তত মনে করি সর্বসম্মতিক্রমে যদি এটা আমরা গ্রহণ করি তাহলে এতে ক্ষতির কিছু নেই। এটা এই পক্ষ কিবা ওই পক্ষ বা অন্য কোন পক্ষের সাথে বিতর্ক বা বিরোধের বিষয় নয়- এই সভার সবার সাথে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে একটা খসড়া তৈরি করা যেতে পারে এবং শুধুমাত্র সকলের মতের সাথে মিল রেখে তৈরি করা একটা খসড়া এই সভায় উপস্থাপন করা যেতে পারে, যা দুইদিন আগের এই সভায় প্রস্তাবিত সকলের মতামতের প্রতিফলন ঘটাবে, আমি মনে করি এটা করা উচিত হবে।
আমি মনে করি এই সংসদ মে মাস শেষ হবার আগে আর বসবে না। সুতরাং, এই মধ্যকালীন সময়ে সীমান্ত এলাকায় কী ঘটতে পারে তা ভেবে ভয়ে প্রকম্পিত হচ্ছি। এই বিষয়গুলোর উপর পর্দা পরে যাবার আগেই বাংলাদেশের মানুষদের অন্তত জানতে দেওয়া হোক যে ভারতের পার্লামেন্টে সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিষয়ে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়েছে যে, আমরা আমাদের হৃদয় দিয়ে তাদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সংহতি পোষন করছি। আমি মনে করি এটা কঠিন কিছু নয়।
দ্বিতীয়ত, আমি আবেদন করছি যে আগামী ৩-৪ দিন ঘটনাবলীর উপর নজর রাখা হোক যেন প্রয়োজন পরলে সংসদ মুলতবী হবার আগে আরেকদিন আপনি দয়া করে আমাদের এই বিষয়ে বসার সুযোগ দিন, যদি আগামী ৩-৪ দিনে বিশেষ ভিন্ন কিছু ঘটে যায়। আমি কিছুই জানি না। আমি ঘটনাবলী নিয়ে আগাম কিছু অনুমান করতে চাচ্ছিনা। কোন খবরগুলো শুধুই গুজব আর কোন প্রতিবেদন গুলো সঠিক বা বেঠিক তা এই মুহুর্তে অনুমান করা খুব দুঃসাধ্য। সুতরাং, আগামী তিন চার দিনে একদম ভিন্ন চিত্র বের হয়ে আসতে পারে। তাই আমি আপনার কাছে নজর রাখতে অনুরোধ করব এবং সংসদ মুলতবীর পুর্বে আরেকদিন আলোচনা করার সুযোগ রাখার যেন আমরা আমাদের বিশ্লেষণ প্রকাশ করতে পারি। এবং, এই মধ্যবর্তী সময়ে, আমাদের সিদ্ধান্ত বিবেচনা করা হোক। আমার মনে হয়, সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা যায় এমন একটা খসড়া তৈরি করা খুব কঠিন হবে যা এই সংসদের মাধ্যমে আমাদের কথা বা অনুভূতি প্রকাশের জন্য যথাযথ হবে।
প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এবং তথ্য ও প্রচার মন্ত্রী মহোদয় ( শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) ঃ আমার একটি আবেদন আছে। আমি শুধু বলছিলাম যে, সভার নিকট আমার যা প্রতিশ্রুতি ছিল যে আমি আরেকটি বিবৃতি দিবনা কিন্তু বিপক্ষ দলগুলোর নেতাদের সাথে কথা বলব এবং আমি মনে করি আমরা উনাদের ঐ প্রস্তাবনা নিয়ে একসাথে বসতে পারব। রেজুলেশন নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু একসাথে বসে কী করা যেতে পারে তা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
শ্রী শ্যামানন্দন মিস্রঃ মাননীয় স্পিকার, আমি কি একটি আবেদন করতে পারি? আমি এই তর্কের ভিতর বলতে চাই যে, যেহেতু আপনি ২রা মে সংসদ মুলতবীর বিষইয়ে আলোচনা শেষ করতে চাইছেন আমি মত দিতে চাই এটা একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি। এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির জন্য যদি আমাদের মে মাসের শেষের দিকে আবার সংসদে বসার প্রয়োজন পরে আপনি কি সংসদ অধিবেশন ডাকার বিষয়টি দয়া করে ভেবে দেখবেন? আরেকটি আলোচনা সভা ডাকার ক্ষেত্রে কি সমস্যা হতে পারে?
মাননীয় স্পিকারঃ আমরা নেতাদের সভা ডাকছি। এই বিষয়গুলো সেখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
শ্রী শ্যামানন্দন মিস্রঃ আমাদের বিগত কিছুদিন ধরে ডাকা হচ্ছে না। দুই তিন পার হয়ে গিয়েছে।
একজন মাননীয় সদস্যঃ প্রতিদিন সভা ডাকার কোন প্রয়োজন নেই।