শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২১১। যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতির উপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিবৃতি | রাজ্য সভায় কার্যবিবরণী | ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
পুর্ব ও পশ্চিম সেক্টরে সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতির উপর মন্ত্রীর বিবৃতি
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (জগজিভান রাম) ঃ স্যার, মাননীয় সদস্যবৃন্দ ডিসেম্বরের ৪ তারিখের অপরাহ্নে এই হাউসে আমার দেওয়া বিবৃতি স্মরণ করবেন। তখন আমি বলেছিলাম যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধনের জন্য আমাদের উপর পাকিস্তানের স্বপ্রনোদিত ও পরিকল্পিত আক্রমণ হতাশাজনক। আমাদের প্রতিরক্ষার দুর্বল জায়গা বের করতে এবং যথাসম্ভব ক্ষতি করতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বারবার আক্রমণ করে চলেছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে রুখতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
পাকিস্তানি বিমান বাহিনী আমাদের বিমান ঘাটির উপর দিয়ে উরে যাচ্ছে, কিন্তু যে পরিমান ক্ষতি করতে পেরেছে তা খুব নগন্য। আমরা সেই ক্ষতি মেরামত করে নিতে পেরেছি এবং আমাদের বিমানঘাঁটি এখন পুনরায় কাজ করতে সক্ষম। তিনজন পাকিস্তানি পাইলট আমাদের কাছে বন্দী।
আমাদের বিমানবাহিনী গত দুইদিন ধরে সামনের দিকের আকাশ সীমা প্রতিরক্ষায় মনযোগ দিচ্ছে এবং স্থল পথের অভিযানগুলোতে খুব কাছ থেকে সহায়তা করছে। আমরা খুব সফলভাবে পাকিস্তানি যোগাযোগ, সরঞ্জাম এবং জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিতে পেরেছি। সবমিলিয়ে আমরা ২২টি বিমান হারিয়েছি।
পুঞ্চে পাকিস্তানের বারংবার আক্রমণকে রুখে দেওয়া হয়েছে যাতে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ছাম্ব সেক্টরের উপর খুব চাপ যাচ্ছে। আমাদের সৈন্যদের তুলে নিয়ে মোনাভার তাভি নদীর পাড়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। সৈন্য তুলে নিয়ে এসে আমাদের পরিকল্পিত স্থানে মোতায়নের আগের যুদ্ধে পাকিস্তানের ২৫টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা হয়েছে এবং ঐ যুদ্ধে তাদের প্রচুর সৈন্য হতাহত হয়েছে। আমরা আখনুর এবং শাকরগড়ে খুব প্রতিচাপ অনুভব করছি।
পাকিস্তানি সৈন্যদের ডেরা বাবা নানক ছিট্মহল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাভি নদীর উপর যে সেতু তা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে যাবার পাকিস্তানি চেষ্টা প্রতিহত করা হয়েছে।
অমৃতসর সেক্টরে কিছু পাকিস্তানি পোস্ট এখন আমাদের নিয়ন্ত্রনে। ফিরোজপুর এলাকায়, পাকিস্তানি সৈন্যদের সেজরা ছিট্মহল থেকে উৎখাত করা হয়েছে।
রাজস্থান সেক্টরে, রামগড়ে একটি পাকিস্তানি সাজোয়া উপস্থিতি কিছুটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল, কিন্তু এই অবস্থান লঙ্গানাভালাতে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কার্যকরভাবে উচ্ছেদ করা গেছে। তাদের ২০টির মত ট্যাঙ্ক নিশ্চিতভাবেই ধ্বংস করা গেছে এবং আরো ৭টির মত ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে পাকিস্তানিদের ৯৬টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে।
সিন্ধে আমরা দুইদিক থেকে কার্যকর ভাবে ঢুকতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সৈন্যরা বিভিন্ন দিক থেকে এগুতে পেরেছে এবং আমাদের সবচেয়ে সামনের বাহিনী নয়াচর থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরে আছে। আমরা ইসলামগড় দখল করতেও সক্ষম হয়েছি।
পুর্ব দিকের সেক্টরে, আমাদের সৈন্যবাহিনী মুক্তি বাহিনীর সাথে মিলে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের চাপে পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছু হটছে। আজ সকালে আমাদের বাহিনী যশোর বিমানঘাঁটি দখল করেছে। কালীগঞ্জের পশ্চিমে সকল এলাকা পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছে। মেহেরপুর থেকে ঘেনেলা হয়ে গোয়ালন্দ ফেরী ঘাট পর্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ মহাসড়ক অবরুদ্ধ করা হয়েছে। হিলি/দিনাজপুর এলাকায় আমাদের সৈন্যরা রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম, রংপুর এবং দিনাজপুরের উত্তরাঞ্চল এখন দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত।
মাননীয় সদস্যরা দুইদিন আগের আখাওড়া দখল সম্পর্কে অবগত আছেন। মৌলভী বাজার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৌশলগত জায়গাগুলো এখন আমরা ঘিরে রেখেছি। গতকাল পাকবাহিনী ফেনী দখল করে নিয়েছে; আমাদের অগ্রগামী দল এখন চাঁদপুর ফেরী ঘাটের দিকে এগুচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, পাকিস্তানী বিমানবাহিনীকে বলতে গেলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে; ঐ অঞ্চলের আকাশসীমা এখন সম্পুর্ন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। সমুদ্র থেকে চিটাগং, চালনা, মংলা এবং খুলনার চারদিকে সামরিক স্থাপনার জন্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। দখলদার বাহিনী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে সামুদ্রিক যোগাযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। মাননীয় সদস্যবৃন্দ ৪ ও ৫ ডিসেম্বরের রাতে আমাদের নৌবাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযান সম্পর্কে অবগত আছেন। দুটি পাকিস্তানী যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং একটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। আমাদের নৌবাহিনী করাচী বন্দরের ১৫ মাইলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। তাদের গোলায় ৪ং বন্দরের স্থাপনা এবং তেলের ট্যাঙ্কের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে পাকিস্তানের একটি সাবমেরিন ডুবিয়ে দিয়েছে। পুর্ব রণতরী এখন পাক নিয়ন্ত্রিত উপকুলে অভিযান চালাচ্ছে।
তিন বাহিনী সম্মিলিতভাবে সুপরিকল্পিত অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযান সমুহের কার্যকর দক্ষতা এবং যে পরিকল্পনায় এই অভিযানগুলো চালানো হয়েছে তা যথেষ্ট সন্তোষজনক।
জাতিসংঘের কিছু সদস্যের জাতিসংঘের একটি বিমানে করে স্থানান্তরের বিষয়ে একটি ব্যাপার কক্ষের সামনে উপস্থিত করার প্রয়োজন মনে করছি। জাতিসংঘের একটি বিমান C-130 তে ডিসেম্বরের ৬ তারিখ সকাল ৮টা থেকে ১০টার ভেতর স্থানান্তর সম্ভব করা হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষে এটা করা সম্ভব ছিল না। নয়া দিল্লীতে জাতিসংঘের একজন প্রতিনিধির অনুরোধের প্রেক্ষিতে ডিসেম্বরের ৭ তারিখ সকাল ৭টা থেক ১০টা (IST) এর ভেতর জাতিসঙ্ঘের একটা বিমানের সফল স্থানান্তর করা হয়েছে। গত রাত ১০টার পর থেকে ঢাকা এরিয়ায় আর কোন অভিযান চালানো হয়নি।
ঢাকা থেকে জানানো হয়েছে যে, জাতিসংঘের একটি বিমান ঢাকা বিমান ঘাটির উপর ধ্বংস হয়েছে। বিমান সদর দপ্তর নিশ্চিত করেছে যে ঢাকাতে কোন ভারতীয় বিমান আর অভিযান চালাচ্ছে না। জাতিসংঘকে তাদের বিমান ধ্বংসের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য বলা হয়েছে।
এই সভার সদস্যদের পক্ষ থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা এবং সাহসের সাথে শত্রুদের পরাজিত করার জন্য আমি বিমান বাহিনীর বীরোচিত কর্মের প্রশংসা করছি।