শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
২১০। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি | রাজ্যসভার কার্যবিবরণী | ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি
প্রধানমন্ত্রী, আনবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী): মি: চেয়ারম্যান স্যার, অকল্পনীয় বাধার বিপরীতে বাংলাদেশের জনগনের সাহসী যুদ্ধ স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসে সাহসিকতার একটি নতুন অধ্যায়ের সুচনা করেছে।
এর আগে তারা গনতান্ত্রিক বিজয়ের এক নমুনা রেখেছে নির্বাচনের মাধ্যমে এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও শেখ মুজিবর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন। আমরা কখনই জানতে পারব না কিভাবে এই বাস্তবসম্মত ও মহান অনুভুতি, যদি আসলেই তা থেকে থাকতো, বদলে গেল প্রতারণা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশে।
আমাদের জানা ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল, আওয়ামী লীগ, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তারা সম্পুর্ন অপ্রস্তুত অবস্থায় ভয়ঙ্কর সামরিক আক্রমনের মুখে পরেছে। এই অবস্থায় স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয় মুক্তি ফৌজ, যা পরিণীত হয় মুক্তিবাহিনীতে, যাদের সাথে যোগ দেয় পুর্ব বাংলার হাজার হাজার মুক্তিপাগল তরুন যারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে চেয়েছিল। যে একতা, একাগ্রতা ও সাহসের সাথে বাংলাদেশের জনগন লড়ে যাচ্ছে তা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলো তুলে ধরেছে।
পাশের দেশের এসব ঘটনা এবং এর ফলে তৈরি সীমান্ত পার হয়ে আসা শরনার্থীদের ঢল আমাদের দেশের উপর সুদূরপ্রসারী ছাপ রাখবে নিঃসন্দেহে। এটাই স্বাভাবিক ছিল যে আমাদের সহানুভুতি থাকবে ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবীতে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগনের দিকে। কিন্তু তাদের স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেইনি, আমাদের সিদ্ধান্তগুলো স্রেফ আবেগের বশে নেয়া নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যত বাস্তবতার পর্যালোচনার মাধ্যমে নেয়া।
বাংলাদেশের জনগনের একাট্টা হয়ে ফুঁসে ওঠা এবং তাদের সংগ্রামের সাফল্যই পরিস্কার ভাবে বলে দিচ্ছে যে তথাকথিত মাতৃরাস্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সম্পুর্ন অক্ষম। আর বাংলাদেশের সরকারের আইনগত বৈধতার প্রসঙ্গে এখন সারা দুনিয়া জানে যে এতে সারা বাংলাদেশের জনমতের প্রতিফলন আছে, যা কিনা অনেক দেশের সরকারই দাবী করতে পারে না। গভর্নর মরিসের প্রতি জেফারসনের বিখ্যাত উক্তি মত বলতে হয়, বাংলাদেশের সরকার “জনগনের পরিপুর্নভাবে প্রকাশিত মতামত” এর মাধ্যমেই সমর্থিত। একথা ধরে নিলে, পাকিস্তানের সামরিক শাসক, যাদেরকে রক্ষা করার জন্য কিছু দেশ উদগ্রীব, কোনভাবেই তাদের জনগণকে, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকেও প্রতিনিধিত্ব করে না।
এখন যেহেতু পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাই শান্তিপুর্ন সমাধানের আশায় আমাদের ধৈর্য ধরা, যা না করলে কেউ বলতে পারে যে আমরা হস্তক্ষেপ করছি, এই ধৈর্যর কোন মানে আর নেই। বাংলাদেশের জনগন, যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে যুদ্ধ করছে এবং ভারতের জনগন যারা শত্রুর আক্রমন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার যুদ্ধ করছে, এখন একসাথে, একই লক্ষ্যে কাজ করছে।
আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশের সরকারের পুনঃ পুনঃ অনুরোধের ভিত্তিতে ভারতের সরকার, সকল বিষয় ভেবে চিনতে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমাদের আশা আছে যে সময়ের সাথে সাথে আরো অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং অতি শীঘ্রই বাংলাদেশ পরিপুর্ন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে।
এই সময়ে আমরা স্মরণ করছি এই নতুন দেশের জন্মদাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমি নিশ্চিত যে এই রাজ্যসভা চাইবে যাতে আমি অবিলম্বে বাংলাদেশের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে এবং তাদের সহযোগীদেরকে আমাদের উষ্ণ অভিনন্দন জানাই।
আমি এই সভাতে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে পাওয়া তথ্য পেশ করছি। সন্মানিত সদস্যরা জেনে খুশি হবেন যে বাংলাদেশ সরকার তাদের দেশ পরিচালনার মূলমন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে গনতন্ত্র, সমাজতন্রে, ধর্মনিরেপক্ষতা, এবং এমন একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ন বা লিঙ্গ ভেদে কোন বৈষম্য থাকবে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে যে নীতিগত ভাবে তাঁরা জোটনিরপেক্ষ, শান্তিপুর্ন সহাবস্থানের পক্ষে, এবং সব ধরনের ঔপনিবেশিকতা, স্বাজাতিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ এর বিপক্ষে। ভারতএসব ব্যাপারে নীতিগতভাবে একই অবস্থানে আছে।
বাংলাদেশ সরকার বারবার তাদের দেশের যেসকল জনগন আমাদের দেশে সামায়িকভাবে আশ্রয় গ্রহন করেছে তাদের ফেরত যাবার ব্যাপারে এবং তাদের সহায়সম্পত্তি তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বাত্বক সহায়তা দেব।
আমি বিশ্বাস করি যে আগামীতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার, যারা একই নীতি ও ত্যাগে বিশ্বাসী, একে অপরের সার্বভৌমতা, আঞ্চলিক সুরক্ষা, পারস্পরিক সহায়তা ও একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এভাবেই মুক্তি ও গনতন্ত্রের জন্য এক সাথে কাজ করে আমরা সুপ্রতিবেশী হবার ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে উঠব, এবং এভাবেই শুধু এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতি ও প্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতি আমাদের শুভ কামনা।
সকাল ১১ টা
বিরোধীদলীয় নেতা (শ্রী এম এস গুরুপাড়াস্বামি): জনাব, আমি প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিকে মুক্ত বাংলাদেশের জন্য ম্যাগনা কার্টা হিসেবে দেখছি। এটি এই বছরের এবং এই দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন এবং ঐতিহাসিক বক্তব্য, এবং এই বিবৃতির মাঝেই আছে এই উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নতুন করে গঠনের অপার সম্ভাবনা। জনাব, আমার হৃদয় আজ আপ্লুত হয়েছে এবং আমি নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে চাই যে আমার দৃষ্টিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এই উপমহাদেশের জীবন্ত জোয়ান অফ আর্ক হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন; জোয়ান অফ আর্ক মৃত্যুবরণ করেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বেঁচে থেকেই বিজয় অর্জন করেছেন। এই ক্ষণ শুধু আমাদের মনেই নয়, আমাদের ইতিহাসের খাতায়ও লেখা থাকবে …
শ্রী এম পি শুকলা (উত্তর প্রদেশ): সোনার অক্ষরে।
শ্রী এম এস গুরুপাড়াস্বামি: এবং এই সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র এই দেশের লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হবে তাই নয়, বরং এশিয়া ও আফ্রিকার লাখ লাখ মুক্তিকামী জনগনের জন্যে আশার বানী হয়ে আসবে। এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যাকে সমগ্র দুনিয়া স্মরণ রাখবে।
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দেখিয়ে দিয়েছেন, একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কি করা উচিত, কি অবশ্যকর্তব্য এই ধরনের সমস্যায়। তিনি অত্র এলাকা থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের চাপও একটি গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সহ্য করেছেন।
আমার বক্তব্য দীর্ঘায়িত না করেই আমি আমি বলতে চাই, যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুধু আমার বা আমার দলের সকল সদস্যেরই নয়, এখানে উপস্থিত সবারই ভালো লেগেছে। আমি শুধু তার বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়েই তাঁকে উপদেশ দেবো যাতে তিনি পৃথিবীর সকল দেশের সরকারকে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য লিখিত আহ্বান জানান। আমি তাঁকে এবং ভারতের সরকার এবং জনগনকে অভিনন্দন জানাতে চাই এমন একটা মহান মুহুর্ত আমাদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য, যখন আমরা একটি নতুন দেশ ও দেশের মানুষদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি, যারা মুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের পক্ষে।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমি প্রধানমন্ত্রীর নেয়া এই অসাধারন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমার ও এখানে জড়ো হওয়া আমার সহকর্মীদের আনন্দ ব্যক্ত করছি।
শ্রী দয়াভাই ভি প্যাটেল (গুজরাট): মি: চেয়ারম্যান, আমিও আমার পুর্ববর্তী দুজন বক্তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই। আমাদের সবার উচিত প্রধানমন্ত্রীকে তার বিজ্ঞ নেতৃত্বের জন্য অভিনন্দন জানান। আমার মনে আছে তাঁকে অনেকবার সবার কাছ থেকে বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি জানানোর জন্য চাপ সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিবারই তিনি জানিয়েছিলেন যে এটা সঠিক সময় নয়, এবং তিনি সঠিক সময়েই কাজটি করবেন। তিনি তার কাজের মাধ্যমে প্রমান করে দিয়েছেন যে তিনি দরকারের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একই সাথে আমি এই সুযোগে আমাদের সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রিকে তাঁরা যেভাবে প্রতিকুল অবস্থার মোকাবেলা করেছেন সেজন্যে অভিনন্দন জানাতে চাই। আমাদের উপর একটি ন্যাক্কারজনক হামলা করা হয়েছে, তারা ভেবেছিল আমরা অসতর্ক থাকব। আমারদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং তার সহকর্মীরা এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন এবং এরচেয়েও খারাপ হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ঈশ্বর এই দেশের উপর দয়াবান আছেন। চলুন আমরা এক হই তাঁর আশির্বাদের জন্য, যাতে আমরা এরকম বাঁধা বারবার পেরিয়ে যেতে পারি এবং দেশের প্রয়োজনে এক থাকতে পারি।
শ্রী ভুপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বাংলা): জনাব আজ এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে, এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। গত বিশ বছর ধরে আমার সুযোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও সরকার থেকে আসা এই হাউসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শোনার কিন্তু আমি মনে করতে পারছিনা শেষ কবে আমাদের দেশ এবং গোটা মানবজাতির জন্য এত গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত এর আগে নেয়া হয়েছে।এই সিদ্ধান্ত একাধারে মানুষের প্রতি গভীর সহানুভুতি, অসাধারন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অসামান্য রাষ্ট্রনায়কোচিকতার প্রতীক। এই সিদ্ধান্ত, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতা ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রার ছাপ রাখতে চলেছে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকার শুধুমাত্র এই সভায় উপস্থিত সবার থেকেই নয়, বরং পৃথিবীর যাদের কাছে মানবতার লঙ্ঘন অগ্রহণযোগ্য সেইসব মুক্তিকামী মানুষের কাছ থেকেই ধন্যবাদার্হ হলেন। আমি জানি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা ত্যাগ, দুঃখ ও বীরত্বের মাধ্যমে অর্জিত এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক স্বর্নালি অধ্যায়ের সুচনা করলাম, যা লেখা থাকবে স্বর্নাক্ষরে।এই সিদ্ধান্ত, নিশ্চিত করলো বাংলাদেশের জন্ম, আমি যেখান থেকে এসেছি, যেখানে আমার জন্ম …
শ্রী এ ডি মানি (মধ্য প্রদেশ): ময়মনসিংহ।
শ্রী ভুপেশ গুপ্ত: একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশই চায় বাংলাদেশের এবং এই উপমহাদেশের জনগণ। আমি এই সিদ্ধান্তের মাঝে দেখতে পাই সেই মাটির ইতিহাস যেখানে নারী পুরুষ সবাই সব বাধা ভেঙ্গে আজ তাদের আকাঙ্ক্ষিত বিজয় লক্ষ্যের দিকে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ভারতের জনগনের পক্ষ থেকে তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি। আজকের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ভারত সরকারের নয়, সমগ্র ভারতের জনগন, সকল দেশপ্রেমিক, এমনকি এই পৃথিবীর সকল স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন। আমি আশা করছি আজকে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, খুব শীগগিরই পৃথিবীর শান্তিকামি, মুক্তিকামি ও উন্নতিকামী দেশগুলোও সেরকম সিদ্ধান্ত নেবে। আমি আবারো বাংলাদেশের জনগনের কল্যান কামনা করছি এবং আজকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে যারা কাজ করেছেন তাদের সবাইকে অভিনন্দন জানাই। আমি ইতিহাসের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। ইয়াহিয়া খান এখন অতীত ইতিহাস। সে ধ্বংস হবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, আর আমরা বাংলাদেশের ও মানবতার খাতিরে বাংলাদেশের উত্থানের আশা করছি।
শ্রী রাজ নারায়ণ (উত্তর প্রদেশ): মহোদয়, আমি সবার আগে বাংলাদেশের জনসাধারন, আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান, নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন, এবং মুক্তিবাহিনীকে আমার মোবারকবাদ জানাব, তাঁরা তাঁদের, নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা ও বিরামহীন, সংগ্রামের দ্বারা আমাদের নিকট হতে স্বীকৃতি আদায় করেছেন।
মহোদয়, আমি ভারতের জনগনকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ভারতের জনগণ আপ্ন নিষ্ঠা এবং তাদের জীবনের সংগ্রামী ভুমিকার পরিচয় দিয়েছে। তারাও পৃথিবীর বড় বড় শক্তির মোকাবেলা করেছে, ১২ আগস্টে এই পরিষদে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জোর দাবী জানানোর জন্য আমাকে ধাক্কিয়ে বের করে দেয়া হয়, অন্ততপক্ষে আমার সেই স্বপ্ন পুরন হয়েছে। ভারত সরকার আমার অনুসৃত পথে আসতে বাধ্য হলেন এজন্য আজ আমি সুখি ও প্রসন্ন। … সামনে আমাদের আরো কাজ রয়ে গেছে। আগে যেমন ইঙ্গিত দিয়েছিলাম আজও দিচ্ছি। আমি চাই ভারত এমন শক্তি অর্জন করুক যাতে আমেরিকা ও বৃটেনের মত সুবিধাবাদী দেশগুলো বুঝতে পারে যে, ভারত আজ ঐক্যবদ্ধ, ভারত অ পাকিস্তানের একত্রীকরণের জন্য যতদিন ভারত ও পাকিস্তান এক না হবে, যতদিন ভারত ও পাকিস্তান একীভূত না হবে, ততদিন ভারত ও পাকিস্তানের দরিদ্র ও মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্য সফল হবে না। এ জন্য সম্পুর্ন শক্তি দিয়ে আমাদের জানিয়ে দিতে হবে, আমেরিকা হোক কিংবা বৃটেন – তোমরা যতই শক্তিধর হওনা কেন, যতই সম্পদশালী হওনা কেন, আমরাও ৫৫ কোটি মানুষের দেশ, সুতরাং ৫৫ কোটি মানুষের দেশের সাথে আর খেলা নয়, তোমরা অনেক ষড়যন্ত্র করেছ। আমার অনেক বন্ধু যথার্থই বলেছেন যে, আমেরিকা, বৃটেন ও রাশিয়ার চক্রান্তে হিন্দুস্থান ভাগ হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে, আমরা এক হিন্দুস্থান গড়তে চাই।
সারা বিশ্বের সেরা ভারত আমাদের, আমরা বুলবুল, এটি আমাদের কানন। আমরা সেই ভারত গড়তে চাই। বাংলাদেশের স্বাধিনতা সেই ভারত গড়ার প্রথম সোপান। এজন্য আমাদের লক্ষ্য আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে, ভারত ও পাকিস্তানের একত্রীকরণের লক্ষ্যকে অব্যর্থ রাখতে হবে। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ জুন এ,আই,সি,সি (অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কনফারেন্স) দিল্লীর বৈঠকে কংগ্রেস যে প্রস্তাব গ্রহন করেছিল সেটি আবার স্মরন করুন। দ্বিজাতিতত্ব চিরতরে নির্মূল হয়ে যাবে। দ্বিজাতিতত্ব নির্মূল হতে চলেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সাথেই এই তত্বের বিলুপ্তি ঘটেছে। এর জন্য মুজিবুর রহমানকে যতই ধন্যবাদ জানানো হোক তা নগন্য হবে।
সভাপতি: হ্যাঁ, এখন সিপিএম থেকে কে বলবেন? হ্যাঁ, জনাব স্যান্যাল।
শ্রী শশাঙ্ক শেখর স্যান্যাল (পশ্চিম বঙ্গ): আমি আমার তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে যে সংবর্ধনা ও অভিনন্দন জানানো হচ্ছে তাতে শামিল হচ্ছি এবং প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তাদেরকে, যারা এটা নিয়ে লড়াই করেছেন, আমাদের দেশে এবং বাংলাদেশে, যারা ইতিমধ্যেই তাদের প্রান উতসর্গ করেছেন এবং প্রান দিতে প্রস্তুত আছেন।
জনাব, দয়া করে আমার বাচালতা ক্ষমা করবেন, ১৯৮৭ সালে, যখন প্রিয় ইন্দিরাজীর পিতা ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী, আমি তখন কেন্দ্রীয় সংসদে কংগ্রেসের পেছনের সারির একজন সদস্য, যখন দেশবিভাগ হয়, আমি ভাঙ্গি কলোনিতে মহাত্মা গান্ধীকে দেখতে যাই, আমি আমার খদ্দর এর কাপড় সেখানে রেখে এসে, আমার খদ্দরের কোট আর চাদর ভিজিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম যে কংগ্রেস বিশ্বাসঘাতকতা করেছে উপরে দিল্লির সাথে, আর নীচে আমার বাংলার সাথে।
জনাব, সেদিনটি থেকে আমি অনেক কষ্টে ছিলাম। কিন্তু আজকে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি, নিজেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই কারনে যে আজ আমি পাকিস্তানের মরন দেখে যেতে পারছি। যা বাকি আছে, সে হচ্ছে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা, এবং তারা এই প্রেতাত্মার যন্ত্রণা ভোগ করবে যারা তারা ভারতও না, বাংলাদেশও না, এমন কি বাকি থাকা পাকিস্তানেরও কোন অংশ না, এই যন্ত্রণা ভোগ করবে জাতিসংঘের কিছু অর্বাচিন সদস্য। তারা ভোগ করুক সেই যন্ত্রণা বারবার। এখন মুক্তি ছড়িয়ে পরবে সবখানে, বাংলাদেশে, আমি এটাই আশা করেছিলাম প্রিয় ইন্দিরাজীর কাছ থেকে – তাঁর বাবা ছিলেন আমার সহকর্মী, তাঁর দাদা ছিলেন আমার সহকর্মী, আমরা একসাথে কাজ করেছি, যাতে তিনি সাফল্য থেকে সাফল্যে পদচারণ করতে পারেন, এবং যাতে তিনি দেখতে পান যে এই উপমহাদেশের সংগ্রামী জনগণ আজ এক নতুন পতাকার নিচে এসে হেসে উঠছে, যে পতাকা উড়ছে ইন্দিরা গান্ধীর মাথার উপরে।
শ্রী তিল্লাই ভিল্লালান (তামিল নাড়ু): আজকের এই আনন্দের দিনে, আমিও আনন্দে যোগ দিচ্ছি নানান দলের নেতাদের সাথে। আমি এই সুযোগে অভিনন্দন জানাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে (বাঁধা)। যেমনটি তিনি বারবার বলেছিলেন এই সভায়, ঠিক সেভাবেই সঠিক সময়ে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিয়ে তিনি প্রমান করেছেন যে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাস্ট্রনায়ক এবং শ্রেষ্ঠ প্রশাসক।
জনাব, আমরা ধর্মীয় আলোচনায় বলে থাকি যে শক্তি সিভান(Sivan) এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী। রাজনীতির মাঠেও তিনি (ইন্দিরা) প্রমান করেছে দিয়েছেন যে শক্তি সবার উপরে (বাঁধা)। এরপরে আমি বলতে চাই যে, যে হাত মাতৃস্নেহে দোলনা দোলায়, সেই হাত এখন বাংলাদেশের মুক্তির দোলনার দোল দিচ্ছে (বাঁধা)। এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার মাধ্যমে তিনি প্রমান করেছেন যে তিনি এই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাস্ট্রনায়ক, মহিলা রাস্ট্রনায়ক (বাঁধা) … তাই আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই।
একই সাথে সরকারের পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্তে আমার সর্বান্তকরণ সমর্থনের কথা আমি আমি জানিয়ে দিয়ে চাই।
আমার কথা আমি শেষ করতে চাই এই বলে, শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘজীবি হোন, বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দীর্ঘজীবি হোন!
শ্রী এ কে এ আব্দুল সামাদ (তামিল নাড়ু): আমার দল ও আমার তরফ থেকে আমি সরকারের বাংলাদেসকে স্বীকৃতি দেবার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমাদের পুরো দেশের জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইছে বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু আমাদের সরকার সঠিক সময়েই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে … (বাঁধা)। আমি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এবং আবার জানাতে চাই যে মুসলিম লীগ পুরো দেশের সাথে এক সাথেই আছে … (বাঁধা) এই কঠিন সময়ে আমরা সরকারের এই মহৎ সিদ্ধান্তের সমর্থন করছি।
ধন্যবাদ।
শ্রী কুম্ভরাম আর্য (রাজস্থান): সভাপতি মহাশয়, আজকের ঘোষণার পর থেকে আমাদের উপর বিপদ শুরু হল এবং সর্বাধিক বিপদজনক সময় আমাদের সামনে রয়েছে। এ যাবত আমরা বাংলাদেশের সহায়তাকারী ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম কিন্তু আজ হতে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে হাত মিলালাম, আজ হতে তাদের সাথে আমাদের মিত্রতা, তাদের এবং আমাদের কল্যান এক হয়ে গেছে। তাদের কোন অনিষ্ট হলে আমাদের দুর্ভোগ হবে, এজন্য বাংলাদেশে যত পাকিস্তানি সৈন্য রয়েছে প্রত্যেককে অতিসত্বর বাংলাদেশ হতে পাঠিয়ে দিতে হবে, এদিকে প্রথমেই দৃষ্টি ফেরানো উচিত। সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যের একদিনের অবস্থান আমাদের দেশ এবং বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। পশ্চিমের ফ্রন্টে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন করে পুর্ব ফ্রন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের বের করে দেয়াই আমাদের সর্বপ্রথম জরুরি কাজ যাতে একটি সৈন্যও আর অবশিষ্ট না থাকে। এটি হলে বাংলাদেশ ভেতর দিক থেকে তো সুরক্ষিত আছেই ফলে পাকিস্তান বুঝতে পারবে ভুল পন্থা অবলম্বনের পরিনাম কি হয়। ইঙ্গিতস্বরূপ আমি এ কথা আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি। আমাদের দেশ এবং এই পরিষদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আছে, সবসময় থাকবে। আমি আরেকবার প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শ্রী গঙ্গা শরন সিংহ (নাম নির্দেশিত) মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। আমি তো মনে করি ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আজকের দিনটির মত কোনদিন আর আসেনি।
বাংলাদেশের সরকার একটি সাধারন সরকার নয়। এটি সাম্প্রদায়িকতার চিতা হতে উদীয়মান একটি সুর্য, একে আমরা মেনে নিয়েছি। আমি এও মনে করি যে, বাংলাদেশের সরকার গঠন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি শুধু এশিয়ার নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্য এক স্মরণীয় ঘটনা। কিন্তু আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে এটি প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পর যে দায়িত্ব আমাদের অপর আসে তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ আজ আমাদের সহকর্মী সাথী ও সহযোগী। তারাও সেই আদর্শ, দর্শন ও নীতিমালার ধারক হয়েছে যা আমরা বহন করছি। এই আদর্শ, দর্শন ও নীতিমালার সংগ্রামে আজ আমরা প্রতিবেশীরূপে লাভ করছি এক নতুন সঙ্গী। আমি সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের জনগনকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আর বাংলাদেশের সরকারকেও আমি অভিনন্দন জানাব যাঁরা এ দুর্ভোগ সত্বেও অক্ষুন্ন রেখেছেন আপন জাতির মান এবং উড্ডীন রেখেছেন তাঁদের পতাকা। সেই পতাকায় আমি প্রণতি জানাই।
শ্রী এ ডি মানি: মাননীয় চেয়ারম্যান, আমি কি আমার পক্ষের এবং বিপক্ষের সহকর্মীদের সাথে প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য তিনি ও তার সরকার যে মহৎ ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেজন্যে ধন্যবাদ জানানোতে সামিল হতে পারি? আমি এই স্বীকৃতিদানের বিশেষত্ব তুলে ধরতে চাই। এই প্রথম, আমাদের রাষ্ট্র স্থাপিত হবার পর, আমরা একটি আধুনিক পদক্ষেপ নিয়েছি এবং দেখিয়ে দিয়েছি যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কেবল মাত্র খাতাকলমে থাকার মত নয়, বরং এটি অত্যন্ত সক্রিয়, এবং বাংলাদেশের জনগণ ধর্মনিরেপক্ষতাকে বেছে নিয়েছে তাদের নীতি হিসেবে। অন্য ভাবে বলতে গেলে, শ্রী জওয়াহারলাল নেহেরুর মেয়ে দুই দেশ নীতিকে আজ কবর দিয়ে দিলেন আর বাংলাদেশের জনগণ এক মানবজাতির অংশ হবার পথ বেছে নিয়েছে।
জনাব, আজ আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে আমাদের ৫৭৪ মিলিয়ন লোকের এই দেশ, যাকে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের সম্পাদকীয়তে খুব খারাপ ভাবে দুর্দশাগ্রস্থ বলে উল্লেখ করেছে, চাইলে শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য অনেক কিছু করতে পারি, এমনকি জাতিসংঘ কিংবা মুক্ত দুনিয়ার মোড়ল আমেরিকার চেয়েও বেশি।
জনাব, আমরা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছি এবং আমি মিসেস গান্ধীকে ধন্যবাদ দিতে চাই এটা নিশ্চিত করার জন্য যে আমাদের সন্তানেরা এবং তাদের সন্তানেরস অন্তত আগামী ২৫ বছর পাকিস্তান নামের দেশটির কাছ থেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না। সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত লোক হিসাবে আমাদের উচিৎ না বড় বড় কথা বলা। আমরা সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করি, তবে আমি এটুকু নির্বিবাদে স্বীকার করি কে যখন এসব কথা ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে, মিসেস গান্ধীকে এই দেশের অন্যতম মহান নেতৃবৃন্দের কাতারেই রাখা হবে।
সর্দার নরেন্দ্র সিং ব্রার (পাঞ্জাব): মাননীয় সভাপতি, আমি দলের পক্ষ থেকে এবং ব্যাক্তিগতভাবে বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রথম থেকেই আমাদের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। এর সঙ্গে সঙ্গে এক দেশ ও এক নেতার তত্বটি মেনে নিয়ে আমি বলতে চাই যে আমরা প্রধানমন্ত্রীর পেছনে আছি। (উর্দু)
এই সুযোগে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার এবং জনগনকে আমাদেরকে এই মহৎ কাজে একটানা সমর্থম দিয়ে যাবার জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রান দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাদেশের জনগণ ধন্য হোক, ভারতের জনগণ ধন্য হোক, পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী জনতা ধন্য হোক। সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিকতন্ত্র নিপাত যাক।
শ্রী শীলভদ্র ইয়াজী (বিহার): মাননীয় সভাপতি,আমি আমার সরকার, প্রধানমন্ত্রি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে অল ইন্ডিয়া ইন্দো বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আরো মোবারকবাদ জানাচ্ছি এবং এর সাথে সাথে এই আশা করছি যে বিশ্বের সকল গনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহ আমাদের প্রধানমন্ত্রির অনুসরণে খুব সত্বর বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করবেন। জয় হিন্দ, জয় বাংলাদেশ।
কেন্দ্রীয় গনপুর্ত ও আবাসন মন্ত্রী (শ্রী আই কে গুজরাল): আমি সাধারণত বেশি কথা বলি না, কিন্তু আজকে আমি আমার একটি স্মৃতি আপনাদের জানাতে চাই। হয়ত আমি সেই গুটিকয়েকের একজন, হয়ত এই সভাতে আমি একমাত্র লোক যে উপস্থিত ছিল ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে যেখানে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি যে আমি লাহোরের সেই প্রস্তাবনার শেষ দেখে যাচ্ছি।
ড: ত্রিগুণা সেন (পশ্চিম বাংলা): সম্ভবত আজকে আমি এই দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমার হৃদয় এতই অভিভুত যে আমি কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি আমার হৃদয় নিংড়ানো অভিবাদন জানাই আমাদের নেত্রীকে। আমি জানি যে শুরু থেকেই সব দলই প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দিচ্ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। বাইরের থেকেই অনেক চাপ ছিল, কিন্তু তিনি জানেন যে একদম শুরু থেকেই আমি তাঁকে বলেছিলাম এই মুহুর্তে স্বীকৃতি না দিতে, কারন আমি জানতাম বাংলাদেশের তরুনরা চাচ্ছে তাদের যুদ্ধ তারা নিজেরাই লড়তে, যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের সমস্যা গুলো এবং কখন সেই সমস্যা তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি তাঁকে বলেছি যে আমি সেই ছেলেদের দেখেছি এবং দেখেছি তারা কিভাবে যুদ্ধ করছে। আমি দেখেছি তাদের চাষাভুষোরা কিভাবে প্রশিক্ষন নিচ্ছে এবং তাদের তরুণরা কিভাবে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছে। তাঁদের সাহসিকতা ও একাগ্রতা নিয়ে আমি অনেক গল্পই করতে পারব। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম তাঁদের কে স্বীকৃতি দেবার বদলে তাঁদেরকে যুদ্ধ জয় করার জন্য সহায়তা দিতে।। আমি বলেছিলাম একটা সময় আসবে যখন আপনি অবাক হয়ে দেখবেন যে তারা নিজেদের স্বাধীনতা নিজেরাই রক্ষা করতে সক্ষম, আর সেটাই হবে তাঁদেরকে স্বীকৃতি দেবার সঠিক সময়। আমার পুর্ন আস্থা সবসময়েই ছিল প্রধানমন্ত্রির উপর। রাজনীতিবিদ হয়া খুব সহজ। সব দলের সব রাজনীতিবিদরা তাঁকে চাপ দিচ্ছিলেন স্বীকৃতির জন্য। রাজনীতিবিদ হওয়া সহজ, কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক হওয়া কঠিন। আমি অনেক রাষ্ট্রনায়কের ইতিহাস ও জীবনী পড়েছি, কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মত রাষ্ট্রনায়ক আমি দেখিনি। আজ আমি সত্যই অনেক খুশি। আমি তাঁকে তার এই সিদ্ধান্তের জন্য অভিবাদন জানাই, কিন্তু আমি এই সভার সদস্যদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে বাংলাদেশের ভেতরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মহিলা ধর্ষিত হয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে অনেক কিছু যা তাঁদের আবারো বানাতে অনেক সময় লাগবে। তাঁদেরকে আমাদের বন্ধুর মত দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে তাঁদের সরকার গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহন করবে। এটা শুধু নীতির ব্যাপার নয়, আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি তারা এটা প্রয়োগ করে। আমি পাহাড়ে তাঁদের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে তাঁদের একটা অনুষ্ঠান ছিল এবং তারা আমাকে সেখানে দাওয়াত দিয়েছিল কেননা আমি তাঁদের প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে সহায়তা দিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজন কোরান থেকে পাঠ করল, আর তারপর আরেকজন ভগবদ গীতা থেকে পাঠ করল।
সে যে কি সুন্দর সংস্কৃতে পাঠ করল! পরে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার নাম আর কোথা থেকে সে এত সুন্দর সংস্কৃত শিখল। সে বলল তার নাম নুরুল ইসলাম। আমি বললাম, তুমি মুসলিম? আর সে বলল আমি বাঙালি। সে নিজেকে হিন্দু বা মুসলিম হিসেবে ডাকার প্রতিবাদ করল! আপনারা অবাক হয়ে যাবেন তাঁদের আচার ব্যবহারে। একজন গ্রামবাসী তার ১৪ বছরের ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে এলো। সে বলল, সেন সাহেব, আপনার নাম শুনেছি, আপনি এই ছেলেটাকে নিয়ে যান, আর প্রশিক্ষন দিন, যাতে সে ফিরে গিয়ে একজন খান সেনাকে মারতে পারে। সে নিজেও আবার ফিরে যেতে চাইছিল (বাংলাদেশে), আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন সে ফিরে যেতে চাইছে। সে উত্তর দিল, আমি ফিরে যাচ্ছি যাতে আমার উপর তাদের একটা বুলেট খরচ হয়, যাতে এই বুলেটটা অন্য কারো প্রান নিতে না পারে। তারা অত্যন্ত আশাবাদী। তারা খালি গায়ে, খালি পায়ে, শুধু ভাত খেয়ে, কাঁধে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে। আমি তাঁদের অনেককে দেখেছি বুলেটের ক্ষত নিয়ে ফিরে আসতে এবং ডাক্তার খুঁজে ব্যান্ডেজ করে আবার যুদ্ধে যাবার জন্য উদগ্রীব থাকতে, অনুপ্রেরণার জন্য। আজ আমার এটা বলতে লজ্জা নেই যে, এমনকি আমাদের সৈনিকেরা যারা তাঁদের সাথে মিশেছে, তারাও এঁদেরকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমাদের সৈনিকেরা যা শিখেছে চার বছরে, এই ছেলেগুলো তা শিখছে দুই দিনে। তারা অস্ত্র বা অন্যান্য সরঞ্জাম এমন সহজভাবে চালায় যেন তা খেলনামাত্র।তাঁদের এই স্পৃহা, এই স্পৃহাকে কেউ দমাতে পারবে না। আজকে আমরা গনতন্ত্র, ধর্মনিরেপক্ষতা ইত্যাদি অনেক কিছুই বলছি, তবে আজ আমার কাছে সবচে জরুরি হচ্ছে আমাদের নেত্রীকে, প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানানো।
আকালি বিক্ষোভকারিদের মুক্তির ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ের বক্তব্য
স্বরাস্ট্রবিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী (শ্রী কে সি পান্ত): আমি আকালি দলের নেতা শ্রী ব্রার এর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলতে চাই। দিল্লির গুরুদুয়ারা চালনা নিয়ে সৃষ্ট গোলযোগের কারনে গ্রেফতারকৃত আকালিদের মামলাগুলো সরকার খতিয়ে দেখেছে। এই বিক্ষোভ আমরা আশা করিনি। সরকার খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে দিল্লির গুরুদুয়ারাগুলো চালাবে দিল্লির শিখরাই, এবং বর্তমানের সাময়িক ব্যবস্থা যত তারাতারি সম্ভব বাতিল করা হবে। এ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় আইন মুসাবিদা করা হচ্ছে এবং পার্লামেন্টের বর্তমান সেশনেই এটা উত্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমন করেছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের এই অবস্থায় আশা করছি দেশের সব দল এখন এক হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় যোগ দেবে। অন্যান্য সকল দলের মত আকালিরা সময়ের প্রয়োজনে দেশকে সহায়তা করার দাবী রাখে, এবং সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁদের এই ইচ্ছাকে সন্মান জানানোর। এরই ভিত্তিতে সরকার এই মুহুর্তে বিক্ষোভের ফলে গ্রেফতার হওয়া সকল আকালিকে মুক্তি দিচ্ছে।
শ্রী বি ডি খোবরাগাড়ে (মহারাষ্ট্র): আজ এই খুশির মুহুর্তে আমিও আমার এই সভার সদস্যদের সাথে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি জানানোর নেয়া তাঁর সময়োচিত এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দন জানাতে চাই। এই সেদিনই আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম যে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের নগ্ন আগ্রাসনের বিপরীতে আমাদের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাতে আর দেরি করা উচিৎ হবে না। আমি অত্যন্ত খুশি যে এর মাত্র দুই দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানালেন। এই সাহসী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যারা মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য সবসময় প্রেরনা হয়ে থাকবে।আমাদের দেশ সব সময়েই সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে, এবং একারনেই এই সাহসী সিদ্ধান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্য, যারা এখনও পরাধীনতার শেকলে বাধা, একটি প্রেরনা হয়ে থাকবে এবং তাদেরকে বিদেশি শাসকদের হাত থেকে মুক্তি পাবার উৎসাহ দেবে।
এই সাথে আমি বাংলাদেশের জনগণকে, যারা সাহসের সাথে তাদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গেছে, আমার অভিনন্দন জানাতে চাই। আমি বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে যারা প্রান দিয়েছেন, সেইসব শহীদদের স্মরণ করছি সশ্রদ্ধচিত্তে। কয়েকজন সদস্য ইতিমধ্যেই বলেছেন যে এটা কেবল মাত্র শুরু। আমি তাঁদের সাথে একমত এবং আশা করছি শেষটা খুব বেশি দূরে না। আমি আশা করছি আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ সম্পুর্নভাবে শত্রুমুক্ত হবে এবং অচিরেই সসন্মানে জাতিসংঘে নিজ আসন গ্রহন করবে। আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছি। আমি আবারো প্রধানমন্ত্রিকে অনুরোধ করবো যাতে তিনি অন্যান্য দেশগুলোকেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে অনুরোধ করেন। আমি কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রির কাছে এই যুদ্ধের ব্যাপারে তাঁর নেয়া সব সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করার কথা বলেছি। আজ আমি আবারো সেই সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করে জানাতে চাই যে দেশের স্বার্থে আমরা সব ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি এবং আমরা সর্বান্তকরণে তাঁর সাথে আছি। ধন্যবাদ।
শ্রী আকবর আলি খান (অন্ধ্র প্রদেশ): জনাব, আমাকে যদি এক মিনিট সময় দিতেন কিছু কথা বলার জন্য। আমি শুধু একটা ব্যাপারে বলতে চাই। আমি খুব বেশি সময় নেব না। আমি জানি এই অবস্থায় আপনার কাছ থেকে সময় চাওয়া উচিত না, তবুই আমি শুধু একটা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই।
সভাপতি: ঠিক আছে, এক মিনিট।
শ্রী আকবর আলি খান: জনাব, দেশ বিভাগের ঠিক পরপরই আমি মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সাথে কথা বলি। আমি তাঁর কাছে যাই আর বলেছিলাম … আমি এটা হিন্দুস্তানি ভাষায় বলতে চাই*
* আমাকে বলতে শুরু করলেন, ভাই, যেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও সম্প্রীতির জন্য আমি আমার সারাটি জীবন নিবেদিত করেছিলাম আজ তার বিলুপ্তি হল। আপনি আবুল কালাম আজাদকে দেখেছেন, তিনি দৈহিকভাবে বেঁচে আছেন কিন্তু অন্তরে মরে গেছেন। এই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতা লাভের পর হতে যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন এ কথা তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে বারবার বলেছেন।সকলের বিশ্বাস, আজ মুজিবুর রহমানের সঙ্গী ও বন্ধুদের চেষ্টায় যে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিল অবশ্যই সেটি আমাদের নেতৃবৃন্দ ও মাননীয় বিজ্ঞজনদেরকে আন্তরিকভাবে খুশি করবে। আমি চাই আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইগণও এই নীতিসমূহ গ্রহন করবেন। আমরা তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমরা তাদের উপর আক্রমন চালাতে চাই না। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা ও আন্তরিক আবেদন, তাঁরাও এ কথা চিন্তা করুন যে মানবতা সমুন্নত হোক, গনতন্ত্র সমুন্নত হোক, সেকুলারিজম সমুন্নত হোক এবং এই আদর্শিক ভিত্তিসমূহ অনুসরন করে তারা সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন করু। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং প্রধানমন্ত্রীকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। (মূল উর্দু থেকে অনূদিত)
জনাব সৈয়দ হোসাইন (কাশ্মীর): আজ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ফলে কাশ্মীরবাসীরা অত্যন্ত খুশি হবেন এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে আমার অভিনন্দন জানাচ্ছি। কেননা সেটি একটি ব্রাউন এর মত, ‘Secular Character of India’ বানানো হয়েছে। এজন্যেই জম্মু ও কাশ্মীরের লোকেরা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত। জম্মু-কাশ্মীরের লোকেরা ১৯৪৭ সালেই দ্বিজাতিত্বকে অস্বীকার করেছে। এখনও সাম্রাজ্যবাদী চক্রে আঘাত লেগেছিল। আজ সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে সবচেয়ে বেশি নাড়িয়ে দিয়েছে এই বাংলাদেশের স্বীকৃতি। আজ আমি এজন্যেই মোবারকবাদ জানাচ্ছি যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেকুলারিজম, গণতন্ত্র, ও সমাজবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। জম্মু ও কাশ্মীরের লোকেরা আজ অনেক শক্তিশালী হয়েছে এবং তাদের এই প্রত্যয় জন্মেছে যে আমরা সঠিক পথই বেছে নিয়েছিলাম। আজ স্বীকৃতির পরে জম্মু ও কাশ্মীরের লোকেরা যদি অনুমতি পায় তবে ভলান্টিয়ার বাহিনী এসে বাংলাদেশে যুদ্ধ করার জন্য তাদের পুর্ন শক্তি নিয়োগ করবে। তাদের অনুভুতি এরূপ। (মূল ভাষণ উর্দুতে)
সভাপতি: সংসদীয় দলের নেতা, আপনি কিছু বলবেন?
সংসদীয় দলের নেতা (শ্রী উমাশঙ্কর দীক্ষিত): জনাব, আমিও এই সভার সকলের মত প্রধানমন্ত্রীকে এই মহান ও ঐতিহাসিক ঘোষণার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এটি আমার মতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী ভারতের নেয়া অন্যতম মহৎ সিদ্ধান্ত। সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে আমি গর্বিত, এবং আমি নিশ্চিত সংসদে উপস্থিত সকল সদস্যই স্বীকার করবেন যে তারা এই মহতী সিদ্ধান্তের স্বাক্ষী হয়ে থাকার জন্য আমার মতই গর্বিত বোধ করছেন। এই সিদ্ধান্তের একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে ইতিহাসে এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের সুনাম সমুন্নত রাখবে, যে ভারত তাঁদের জন্য যুদ্ধ করেছে, এবং বিপদে তাদেরকে সহায়তা দিয়েছে। এটা ভেবে ভালো লাগছে যে এই মুহুর্তে সভার সবাই, এমনকি বিরোধী দলও, শুধু জনাব রাজনারায়ন ছাড়া, জিনি নিজেকে ছাড়া আসলে অন্য কারো প্রতিনিধিত্ব করেন না, এক হতে পেরেছে এই মহতী মুহুর্তে। এই সময়ে আমি স্মরণ করছি বাংলাদেশের সাহসী জনগণকে যারা নিজেদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছে, এবং আমাদের সেনা ও অফিসারদের যারা আগ্রাসন রুখে দিচ্ছে।
এটা এটা অভুতপুর্ব ব্যাপার যে বিরোধীদলের নেতাগন শুধু এই সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানায়নি, বরং তারা যে বুদ্ধিমত্তার সাথে এই সিদ্ধান্তের সময়টা ঠিক করা হয়েছে, সেটারও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমাদের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে এই দিনটির কথা। আমি নিশ্চিত আমাদের সেনা ও অফিসাররা আগামী দিনে গর্বিত ইতিহাস রচনা করবেন। তবে আমি সবাইকে অনুরোধ করব এই বিজয়ের উদযাপন যেন আমরা পরিমিত রাখি, যদিও অভিনন্দন আমাদের সবারই প্রাপ্য। আমার মনে হয় গঙ্গা বাবু, এবং আরো ককেজন মনে করিয়ে দিয়েছেন যে যুদ্ধ এখনও চলমান এবং এই যুদ্ধ শেষ হতে হবে অশুভ এর পরাজয় এবং প্রতিবেশীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে আমাদের দেশের সফল প্রতিরক্ষার মাধ্যমে।
এই মুহুর্তে আমি সরকারী দলের পক্ষ থেকে বিরোধীদলের সকলকে তাঁদের একতা ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। ধন্যবাদ।
সভাপতি: সন্মানিত প্রধানমন্ত্রী, আমিও আপনাকে এই মুহুর্তে আপনাকে অভিবাদন জানাতে চাই এবং আপনার পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা জানাচ্ছি।
সভার কার্যক্রম আগামীকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত মুলতবী ঘোষণা করা হল।
মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বারোটা বেজে তের মিনিটে পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবী হল