শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০৪। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাব ও তার ওপর আলোচনা | রাজ্যসভার কার্যবিবরণী | ৩১ জুলাই, ১৯৭১ |
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাব ও তার ওপর আলোচনা
প্রণব কুমার মুখার্জি (পশ্চিম বঙ্গ):
এই হাউজ ইচ্ছা প্রকাশ করছে যে ভারত সরকার সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে; তার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে এবং সংসদের বর্তমান সেশন শেষ হবার আগেই এটি ঘোষণা করবে।
স্যার, এই রেজোলিউশন এর বিষয়বস্তু নতুন নয়। এটা নিয়ে বিভিন্ন ফর্মে সংক্ষিপ্ত আলোচনা, দৃষ্টি আকর্ষণ এই হাউসে অনেকভাবেই হয়েছে। এই বছর ৩১ শে মার্চ একটি রেজোলিউশন সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা হয়েছিল যার শেষ অংশে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেন-
“এই হাউজ গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে পূর্ববাংলার ৭৫ মিলিয়ন জনগণের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এর বিজয় হবে। হাউস তাদের আশ্বাস দিতে চায় যে তাদের সংগ্রাম ও উত্সর্গের সাথে ভারত ও তার জনগণ সহানুভূতিশীল ও ভারতের জনগণের সমর্থন তারা পাবেন এবং তাদের জন্য শুভেচ্ছা রইল।
একই রেজল্যুশন লোকসভা দ্বারা ৩১ মার্চ পাস করা হয়। তার পর চার মাস পেরিয়ে গেছে। এখন এটা আমাদের চিন্তা করার বিষয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য ও আমাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করার জন্য এখনই সঠিক সময়। বিভিন্ন দেশে আমাদের বৈদেশিক মিশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন যা ২৫ জুন প্রস্তাবিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন –
৬ থেকে ২২ জুন, ১৯৭১ আমি মস্কো, বন, প্যারিস, অটোয়া, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডি সি এবং লন্ডন সফর করি।
প্রকৃত ফল কী হয়েছিল? বিভিন্ন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও শরণ সিং এর মতবিনিময় তুলে ধরা হয়। শত সহস্র নয়, লাখ লাখ জনগণ বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। মন্ত্রী বলেন –
“আমি স্পষ্ট বলেছি যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যেকোন সাহায্য এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়াটা তাদেরকে পূর্ব বাংলায় নির্যাতনে উৎসাহ দেয়ার নামান্তর। ’
মন্ত্রী ২৫ জুন ১৯৭১ তারিখে এগুলো বলেন। এই যৌথ ইশতেহার ১৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব বরাবর জারি করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য করা হলে তা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের শাসক চক্রকে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে তাদের বর্বর কার্যক্রম বা কুকর্ম করতে সাহায্য করবে। ট্রাজেডি হল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এই যৌথ বৈঠকের পরেই তারা পদ্মা নামক জাহাজে অস্ত্র বোঝাই একটি চালান পাঠান পাকিস্তানের জন্য। বিদেশী কূটনৈতিক মিশনের সবগুলোর মাঝে শুধুমাত্র সোভিয়েত সরকার তাদের সাথে করা যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী ভারত সরকারকে আশ্বস্ত করে যে তারা ভারত সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে এবং এ ঘটনার উপর কড়া নজর রাখবে।
অন্য সরকারগুলো কি বলেছে? অন্যান্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কি নিশ্চয়তা দিয়েছে? তারা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য তাদের সহায়তা নিশ্চিত করেছে। তারা পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে এব্যাপারে মত দেন। কিন্তু বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের উপর নির্যাতন বন্ধের জন্য তারা কি ব্যাবস্থা নিয়েছেন? তারা শুধু কথাই বলেছেন। আমি ভারত সরকারের কাছে জানতে চাই কি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং এই শরনার্থিদদের অন্তঃপ্রবাহ বন্ধ হবে? আপনি ভালো ভাবে খেয়াল করলে দেখবেন ভারত সরকার এ পর্যন্ত কিছুই করেনি। জনাব চেয়ারম্যান, এটা বলা হয়েছিল যে ভারত সরকার যথাযথ সময়ে পদক্ষেপ নেবে। তারা যথাযথ সময়ে বাংলাদেশ সরকার কে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু ‘উপযুক্ত সময়’ কখন আসবে? উপযুক্ত সময় কি তখন হবে যখন বাংলাদেশের ৭৫ কোটি মানুষ শেষ হয়ে যাবে আর সেখানকার এক কোটি হিন্দু ভারতে এসে জড়ো হবে? যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ, সচেতন যুবকরা শেষ হয়ে যাবে তখন? যখন সেখানকার সকল বুদ্ধিজীবীরা ধ্বংস হবে তখন? জনাব চেয়ারম্যান স্যার, জাতিসংঘের নীতি অনুসারে নয়, ভারত সরকারের উচিৎ সঠিক সময় ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া। এবং তা হবে প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী। স্যার, আপনি নিজে একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এবং আপনি জানেন যে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে স্বীকৃতির জন্য সব শর্ত পূরণ হয়েছে। এটা ওপেনহেম-এর মত বিশিষ্ট আইনবিদের স্বীকৃতি লাভ করেছে। জনাব চেয়ারম্যান স্যার, বাংলাদেশে এই বছরের ১০ এপ্রিল একটি পূর্ণ অস্থায়ী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে স্থাপন করা হয়েছে। জনাব নজরুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এবং এই সরকার এখন সামরিক অপারেশন পরিচালনা করছে। এটা সামরিক কমান্ড্যান্ট নামে অভিহিত এবং এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা শুধু ভারতীয় প্রেস না, এটা প্রায় সব বিদেশী কূটনীতিকদের এবং অনেক বিদেশী সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নজরে আছে। এবং যেসব বিদেশী সাংবাদিক বাংলাদেশ পরিদর্শন করেছেন তারা জানিয়েছেন কার্যত বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ এলাকা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর দখলে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্য শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু সেনানিবাস ও নির্দিষ্ট কিছু শহরে দখল করে আছে এবং সেখানে তারা বেসামরিক নাগরিকদের উপর নৃশংসতা চালাচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন কার্যত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার জনাব নজরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।
অতএব, আমি জানিনা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দান থেকে ভারত সরকারের বাঁধা কোথায়। আমরা কি পাকিস্তানের অপপ্রচারে ভীত হয়ে গেছি? আমরা কি আশঙ্কা করি যে, যদি আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হুসেবে স্বীকৃতি দেই তাহলে কি সমস্ত বিশ্বের বিরুদ্ধে যাওয়া হবে? আমি কোন কারণেই ভারত সরকারের নড়বড়ে হওয়ার কোন কারণ দেখতে পাচ্ছিনা। ভারত সরকারের উচিৎ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার অপপ্রচারের দিকে না তাকিয়ে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়া।
পাকিস্তান দেখানোর চেষ্টা করছে যে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা ভারতের সৃষ্টি। পাকিস্তান অতীতেও এমন করেছে, বর্তমানে করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। আপনি এটা বন্ধ করতে পারবেন না। পাকিস্তানের অপপ্রচার বন্ধ করতে পারবেন না। মুজিবুর রহমান নিজে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ১৯৬৫ সালে ভারতীয় আগ্রাসনের জন্য প্রথম নিন্দা প্রকাশ করেন ও একজন স্বাক্ষরকারী ছিলেন – যে ইশতেহার তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভর্নর জারি করেছিল। অতএব, এটা বলার প্রশ্নই ওঠেনা যে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা ভারতের সৃষ্টি। পাকিস্তানের অনেকে ও পাকিস্তানের অনুসারীদের অনেকে এমনকি বিশ্ব সম্প্রদায়ের বেশীরভাগ এটা বিশ্বাস করবে না। তারা জানে যে, মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য নির্ধারিত এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিশাল ম্যান্ডেট পেয়েছে। কিন্তু ভারতের লক্ষ্য নির্দিষ্ট নয়। ভারত সরকার বা তার জনগণ কোন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেনি। এটি মূলত একটি আন্দোলনের ফল যা বাংলাদেশেই সৃষ্টি হয়েছে। এটি মূলত একটি আন্দোলন যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ছয়-দফা কর্মসূচি, যার দাবীতে তারা নির্বাচনে গেছে তা মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে ছয় দফা কর্মসূচির কিছুই ভারতপন্থী না। ছয় দফা কর্মসূচি, যার উপর তারা বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক ম্যান্ডেট পেয়েছেন সেখানে একটি দফা নেই যা ভারতপন্থী হিসেবে মনে হতে পারে। এসব লোক ভারতের পক্ষে কিছু করছেন না। তারা ভারত দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কিছু করছেন না। ছয় দফা কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সমস্যার উপর ভিত্তি করে তৈরি। তারা স্বায়ত্তশাসন চান। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকার চান। তারা নিজেরাই তাদের অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পেতে চান। তারা বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে চান। তারা তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের সুযোগ চান। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীদের শোষণ থেকে মুক্তি চান। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চান। তারা সাংস্কৃতিক মুক্তি চান। এটা কি দোষের? জাতিসঙ্ঘের সনদে ক্যাটাগরি চার্টারে আর্টিকেল ১ এ উল্লেখ আছে প্রত্যেক জাতির যাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, জাতীয়তা আছে তাদের নিজস্ব ধারণা সঞ্চারিত করার অধিকার থাকবে। তারা গণতন্ত্রের চর্চা করবে এবং তাদের ইচ্ছা পূরণ করার অধিকার থাকবে। এটা কি জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত হয়নি? ধারা ১ (২) এ আছে –
“ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যে বন্ধুত্তপূর্ন সম্পর্ক যা সমঅধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং সার্বজনীন শান্তি শক্তিশালী করার জন্য তা অন্যতম সহায়ক। ”
এটা কি সত্য নয় যে, জাতিসংঘের সনদে সমান অধিকার এবং আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার গৃহীত হয়েছে? জাতিসংঘের কনভেনশনে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার চান। তাই তাদের স্বায়ত্তশাসন থাকতে হবে। তারা নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চান। নিজেদের কপালের উপর নির্ভর করে দাড়াতে চান। তাহলে এই পথে বাধা কোথায়? কিভাবে এটা ভারতীয় প্রচারণা হতে পারে?
কিভাবে এটা ভারতের একটি আগ্রাসন হয়ে ওঠে? কিভাবে এটা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস হয়ে ওঠে? জনাব চেয়ারম্যান? আমি বুঝতে পারছি না বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকার বাধা কোথায়। আন্তর্জাতিক আইনে যথেষ্ট দৃষ্টান্ত আছে। এটা কি সত্য নয় যে, ১৯০৩ সালে যখন পানামা কলাম্বিয়া থেকে আলাদা হয় তার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বীকৃত দিয়েছিল? এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পানামা কে স্বীকৃত দেয় এবং পানামা থেকে তার নিয়ন্ত্রণকারী কলাম্বিয়াকে প্রতিরোধ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বেই এর মূল অংশ যুক্তরাজ্য থেকে যে পৃথক হয়ে গিয়েছিল, সেটা কি সত্য ঘটনা নয়? তারপর ১৭৬৬ সালে আলাদা হবার ১ মাসের মধ্যে ফ্রান্স আমেরিকাকে স্বীকৃতি দেয়। এটা কি সত্য নয় যে, যখন গ্রীস ১৮২৭ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তার এক সপ্তাহের মধ্যে চার ইউরোপীয় রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিল? এটা সত্য যে যেভাবে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং সার্বিয়া অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তার ছয় সপ্তাহ পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের স্বীকৃতি দেয়। আন্তর্জাতিক এমন যথেষ্ট উদাহরণ আছে। তাই আমি বুঝতে পারছি না কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। মানবিক কারণে আমাদের তাদের স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এটা কি সত্য নয় যে নৃশংসতা, বর্বরতা বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণের উপর ঘনীভূত হচ্ছে? সেখানে ভারত সরকারের মানবিক ভিত্তিতে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। ১৮৭৬ সালে যখন রুমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং সার্বিয়া অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয় তখন কী ঘটেছিল? বেসামরিক মানুষকে জবাই করা হয়েছে, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। আর এর ফলে প্রায় সব ইউরোপীয় দেশ অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করে এবং তারা সেই সব দেশগুলোকে স্বীকৃতি দেয়। আমি জানিনা ভারত সরকার কেন দ্বিধাগ্রস্ত। আমি জানিনা এই সিদ্ধান্ত নিতে কত সময় লাগবে। আমরা শরণার্থী অন্তঃপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করেছি। সরদার শরণ সিং ভারত সরকার এর অবস্থান সম্পর্কে খুব স্পষ্ট বলা উচিৎ। প্রধানমন্ত্রীরও সরকারের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট করা উচিৎ। জনাব চেয়ারম্যান, আমি অকপটে আমার ভুলত্রুটি স্বীকার করছি। আমি ভারত সরকারের অবস্থান বুঝতে ব্যার্থ হচ্ছি।
আর কত সময় লাগবে? কত সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? কি শর্ত ভারত সরকারের মতে পৌঁছাতে সাহায্য করবে? পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে হবে। হাউসের আস্থায় সিধান্ত গ্রহণ করা উচিত, মানুষের আস্থার জন্য সেই সিদ্ধান্ত তাদের জানানো উচিত, গোপনে কোন কিছু সম্পন্ন করা উচিত না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাউসে বলবেন যে কি শর্ত পূর্ণ হলে ভারতীয় সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে।
জনাব চেয়ারম্যান, আমি হস্তক্ষেপের কথা বলছি না। আমি বলছি না যে ভারত সরকারকে অস্ত্র তুলে নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত। আমি বলছি না, যদিও কারণ আছে তবুও ভারত সরকার অস্ত্র তুলে নিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি যা বলছি তা হল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা যুদ্ধ করুক; তারা তাদের সামরিক শাসকদের সম্মুখীন হোক। আমাদের তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিতে হবে। একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে তাদের স্বীকার করতে হবে এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনে যে ব্যাপক ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সেখানে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের যোগ্য প্রাপ্য দিতে হবে। জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, এই হাউজে কতবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ভারত সীমান্তে অনুপ্রবেশের মত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বিষয় আলোচিত হয়েছে আপনি জানেন।
দুপুর ১২ টা-
অন্য এক দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই হাউজে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন পশ্চিমবঙ্গে পাক অনুপ্রবেশ ছিল ১৩ টি, আসামে ৩, ত্রিপুরায় ১৩, মোট – ২৯ টি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা গুলির সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় যথাক্রমে ১০৯, ২৮ এবং ১০৪ টি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গলে ১১ জন, আসাম ও মেঘালয়ে ৩১ জন, ত্রিপুরায় ৩০ জন; মোট – ৭৭ জন। আহতদের সংখ্যা ছিল ১৩৫। এই সকল অনুপ্রবেশ হয়েছে মে ১৯৭১ থেকে। এটা কি আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেবার জন্য যথেষ্ট অবস্থা তৈরি করেনি? তা সত্ত্বেও জনাব চেয়ারম্যান আমি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছিনা। আমার চাহিদা খুব সামান্য। আমাদের উচিৎ বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে স্বীকার করে তাদের সহায়তা দান এবং তাদের সাথে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। তাদের স্বাধীনতার জন্য তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করতে দেয়া হোক। আমরা তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিই। আমি কি খুব বেশী চাইছি? তাহলে কেন আমরা রেজোলিউশন পাস করব না? এটা কি প্রয়োজন নেই? আমাদের এই সরকার জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন করুক আমরা কি তা চাই না? আমরা কি লজ্জা পাবোনা যদি বাংলাদেশ লোক আমাদের নিন্দা করে? তারা কি বলবে না, “যখন আমরা পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, যখন আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছি তখন আমরা কি আমাদের প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করতে পারিনা? — যাদের সাথে রয়েছে সাংস্কৃতিক বন্ধন, জাতীয়তার বন্ধন। জনাব চেয়ারম্যান, এখন যদি বাংলাদেশের কোন মুক্তিযোদ্ধা মনে করে যে ভারত তাদের ব্যাপারে দোটানায় আছে তাহলে কি অবাক হবেন? জনাব চেয়ারম্যান, আমি আবারো বলছি যে ভারতীয় সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। যারা ইতস্তত ভাব করে তারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা বলছে যে এই শরনার্থিরা ফিরে যাবে যদি স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায় – কিন্তু আমি জানিনা কিভাবে এই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। কিভাবে এই মানুষ ফিরে যাবে। ভারত সরকারের কি উচিৎ না সত্তর লাখ শরণার্থীর প্রশ্ন জনতার কাছে উত্থাপন করা? আমরা বাজেট ও সম্পূরক বাজেট দাবী করি। আমরা শরণার্থীদের জন্য কি কাজ করছি? মৌলিক প্রশ্ন রয়ে যায়। এইসব মানুষ এদেশে এসে থাক, সেটা আমাদের দোষ না। তারা আমাদের দোষে এই সীমান্তের কাছে আসেনি। আমরা কি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনা? আমরা কি তাদের বলতে পারিনা যে শরনার্থিদের যদি আরও বেশী করে আমাদের এখানে পাঠায় তাহলে তা আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতি করবে এবং এই অবস্থায় আমরা দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারিনা। আমাদের এটি নিষ্পত্তি করা আবশ্যক। সরকারি কি কথা বলতে পারে না?
জনাব চেয়ারম্যান, স্যার আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার ভাষা ভাঙ্গা হতে পারে এবং আমার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হতে পারে। কিন্তু কেন ভারত সরকার দুর্বল স্বরে কথা বলবে? এবং ভারত সরকারকে ভাঙা ভাষায় কেন কথা বলতে হবে? তারা কি সন্দেহাতীতভাবে কোন কথা বলতে পারে না? নেহরু-লিয়াকত আলী চুক্তি সকল আন্তর্জাতিক আইন মেনে হয়েছিল।
তারা গণহত্যার চালাচ্ছে। তারা বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে নৃশংসতায় লিপ্ত। প্রথমে তারা সেখানে বসবাসকারী হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর করে। এখন তারা হিন্দু ও মুসলমানদের নির্বিচারে নৃশংসতা চালাচ্ছে। প্রতিটি মানুষ পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বর্বর নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। অতএব, স্যার, আমরা হতাশ। আমরা অত্যন্ত হতাশ বোধ করছি। আমরা সন্দিহান যে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে কিনা। বরং তারা তা পরিবর্তন করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা অস্বীকার করতে পারেন। তিনি বলতে পারেন যে, সম্ভবত ভারত সরকার করবে তা না। যখন মানসিক অশান্তি শেষ হয় তখন মানুষ তা ভুলে যায়। জনাব চেয়ারম্যান যদি এটা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে চলে তাহলে তা মানসিক সমস্যা তৈরি করতে বাধ্য। জনাব চেয়ারম্যান স্যার, খুব সাধারণ মানুষ হিসেবে বলছি, দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলছি – আপনারা ভুলের মধ্যে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে যা ঘটছে তা পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের অন্যান্য পূর্ব অংশের অর্থনীতি এবং রাজনীতির ওপর একটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া ফেলবে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। আমাদের একটি অবস্থান নিতে হবে। এবং এটা সঠিকভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত। দ্ব্যর্থহীন হওয়া উচিৎ। জনাব চেয়ারম্যান স্যার, আমি বুঝতে পারছি না ভারত সরকার উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে কি করবেন। ভারত সরকার প্রথমে বলছিলেন যে, তাদের তিন মাসের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। এখন তারা ছয় মাস সময় বাড়িয়েছে। সম্ভবত তারা এক বছরের বেশি সময় আবার এক্সটেনশন করবে। এটা ছয় মাসের প্রশ্ন নয়, এটা আপনি কিভাবে মোকাবেলা করবেন তার প্রশ্ন। যতক্ষণ না সেখানে রাজনৈতিক সমাধান হয়, যতক্ষণ না সেখানে একটি অসাম্প্রদায়িক সরকার এবং জনগণের ইচ্ছার সরকার তৈরি হয় ততক্ষণ এসব শরণার্থীদের ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ হবেনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হলে শরনার্থিরা ফিরে যাবে। কিন্তু আপনার সাহায্যের জন্য কে আসছে? আন্তর্জাতিক সংগঠন কী করছে? (ঘণ্টা বাজার শব্দ)। আমি শেষ করছি। জাতিসংঘ বলছে এটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার একটি বিষয়। তারা ভারত ও পাকিস্তানে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক এখানে কি করবে? উ থান্ট, জাতিসংঘের মহাসচিব, যখন গণহত্যা চলছে তখন কি করেছেন? যখন বিদেশী প্রতিনিধিদল এটা রিপোর্ট করে, যখন হাউস অব কমন্সে লেবার পার্টির নেতা এটা শতাব্দীর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হিসাবে বর্ণিত করেন, যখন কানাডিয়ান প্রতিনিধি দল বলেছে সেখানে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন বেসামরিকদের উপর নৃশংসতার চালাচ্ছে তক্ষণ তিনি কী করেছেন? কেন তিনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাধারণ পরিষদ আহ্বান করেননি? যদি সুয়েজ খাল জাতীয়করণের পর, ১৯৫৮ সালে লেবাননে উন্নয়নের পর, U.N সাধারণ পরিষদের বৈঠক ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডাকতে পারেন তাহলে এই ক্ষেত্রে সমস্যা কী?
কেন সাধারণ সমাবেশ একটি রেজল্যুশন দেবেনা? পাকিস্তানের বর্বর নৃশংসতার পরেও? (ঘণ্টার শব্দ)। স্যার, আমি জানি আমার সময় সীমিত। আমি শেষ করতে যাচ্ছি। আমি আবার মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে অনুরোধ করতে চাই, যেন ভারত সরকারের নীতি সীমাবদ্ধ না হয়। যেন ভারত সরকার দেরি না করে। ভারত সরকার সন্দেহাতীতভাবে দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে, নিজেদের জনগণের স্বার্থে এগিয়ে আসার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।
এই কথাগুলো বলে স্যার, আমি শেষ করছি। ধন্যবাদ।
প্রশ্ন প্রস্তাব করা হয়।
শ্রী সীতারাম কেশরী (বিহার): স্যার –
১। রেজোল্যুশনে –
কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এবং বর্তমান অধিবেশন শেষ হবার আগে পার্লামেন্টে ‘উপযুক্ত সময়’ শব্দের ব্যাখ্যা ও প্রতিস্থাপন করা হোক।
শ্রী জে পি যাদব (বিহার); স্যার,
৩। রেজোলিউশনের –
‘কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য’ শব্দ মালার পরে ‘সামরিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে’ শব্দমালা সন্নিবেশিত করা হোক”
প্রশ্ন প্রস্তাব করা হয়েছে।
শ্রী এম.সি. চাগলা (মহারাষ্ট্র): জনাব. চেয়ারম্যান, সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা শুধুমাত্র একটি অপরাধ নয় বরং একটি বিয়োগান্তক ঘটনা। ইতিহাস অনেক অন্ধকার ঘটনার সাক্ষী। ইতিহাস আমাদের রক্তে পূর্ণ। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা কার্যত নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বলছি যে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সেখানে মানবাধিকারের প্রতিটি কনভেনশন লঙ্ঘন করা হয়েছে। আমি মনে করি দীর্ঘ সময়ের যে ইতিহাস আমাদের আছে সেখানে বাংলাদেশের ঘটনাগুলো এত ভয়ঙ্কর ও অমানবিক, যা এর আগে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। আমি আমার কথা যতোটুকু সম্ভব সংক্ষিপ্ত করব কারণ এটা নিয়ে অনেকেই বিতর্ক করবেন। অন্যদের তীব্র প্রতিক্রিয়া আমাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু আমাদের স্বার্থ এবং লক্ষ্য ভারত কিভাবে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সেটা দেখা। রিপোর্ট আসার পরে প্রধানমন্ত্রী প্রবৃত্তিগতভাবে ভয়াবহ বিতৃষ্ণার সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। আমি প্রায়ই দেখেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সহজাত আনুমান সঠিক হয়। কিন্তু তারপর কিছু ঘটে। পরে সেটা কঠিন চিন্তায় রূপান্তরিত হয়। তখন আমাদের ভাবতে হয় আমাদের দেশের স্বার্থ, কুসংস্কার, এবং ভারসাম্য বজায় রাখা – এইসব। আমি আমার বন্ধু, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরামর্শ দেয় তখন এমনই ঘটে। মন্ত্রী মোটামুটি ভাল জানেন এবং আমি বলতে পারি যে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অনুগত, সক্ষম এবং যোগ্য। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মন্ত্রণালয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভুগছে। তারা ধারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইন খুঁজছেন – আরও অনেক কিছু। কিন্তু তারা দেখলেন না যা ঘটছে তার কোণ নজির ইতিহাসে নাই। তাহলে কিভাবে তারা ধারা খুঁজে পাবেন বাংলাদেশ ইস্যুতে? সেখানে যা ঘটেছে তা হল সরকারি ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থিদের সবচেয়ে সহিংস উপায়ে অবদমন করা হচ্ছে।
আপনি নোট করতে পারেন যে এটি কোণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কেউ যদি আলাদা করার চক্রান্ত করে তবে তা মুজিবুর রহমান নয় – ইয়াহিয়া খান। কারণ নির্বাচন অনুযায়ী মুজিবুর রহমান হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এটা সহ্য করতে পারেন নি। ফলে গণহত্যা শুরু করা হয়েছিল। শুধু এই শব্দটি দিয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বর্ননা করা যাবেনা।
রেজোলিউশনে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অন্য হাউসে ৩১ মার্চ সরকারের মত নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছিল। আমরাও তার সাথে সহানুভূতি প্রকাশ করি। সারাদেশে এমন একটি অসাধারণ অনুভূতি কাজ করে যার প্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগের সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশ করি। আমি সরকারকে ও আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে চাই বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য আপনারা কি করেছেন?
শ্রী আও আধেশর প্রসাদ সিনহা (বিহার): আপনি জানেন না, শ্রী ছাগলা?
জনাব. চেয়ারম্যান: দয়া করে বাধা দেবেন না
শির এম সি ছাগলা: আমি নিশ্চিত আমার সন্মানিত বন্ধু আমার চেয়ে বুদ্ধিমান।
শ্রী আধেসশর প্রসাদ সিনহা: আপনি জানেন না কি সমর্থন আমরা দিচ্ছি? আপনি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনার আমার চেয়ে ভালো জানার কথা। পক্ষীয় কোথা বলবেন না। জনাব ছাগলা, যতদূর যম্ভব আপনার তথ্য নিরপেক্ষ হতে হবে।
শ্রী এম সি ছাগলা; আমি জানি আমাকে কেন বলতে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। আমি কি কিছু ভুল বলছি?
শ্রী পিতম্বর দাস (কহা প্রদেশ): হাতি ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে কত জল।
শ্রী এম সি ঘাঘলা: আমি যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে চাই – আশা করি মন্ত্রী বা অন্য সদস্যরা উত্তর দিবেন। আমরা কি কার্যকরভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন করছি? বাংলাদেশকে সমর্থন করতে হলে অবিলম্বে তাদের সরকারকে স্বীকৃত দেয়া উচিৎ। আমি পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই এই সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃত না দিলে তা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ ভুল এবং প্রতারণা। ইতিহাস আমাদের এই জন্য কখনো ক্ষমা করবে না।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এই মহুর্তে সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হবে। প্রতিবেশী হিসাবে যেটাকে ভারতের বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে বোঝানো যেত। দ্বিতীয়ত পার্টিশনের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা অনেকটা পূর্বাবস্থায় ফেরানো যেত। তৃতীয়ত দ্বি-জাতিতত্ত্ব চিরতরে শেষ করা যেত যা সবচেয়ে খারাপ তত্ত্বগুলোর একটি যেটা পার্টিশনের আগে শুরু হয়েছিল। আমরা জানি সেটা ছিল আমাদের মাতৃভূমি ভেঙ্গে দেয়ার চক্রান্ত। কেন এই স্বীকৃতি দেওয়া হলো না? আমি কারণ ক্ষতিয়ে দেখতে চাই। প্রথমত এটা বলা হয়ে থাকে যে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্যভাবে আমরা স্বীকৃতি দিতে পারছিনা। আমি এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করি জোরালোভাবে। যতদুর আমি আন্তর্জাতিক আইন জানি – যদিও আমি বিশেষজ্ঞ না – একটি দেশ কে স্বীকৃতি দেয়া না না দেয়া প্রদানকারী দেশের নিজস্ব ব্যাপার।
এটা আমাদের ব্যাপার আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেব কি দেবনা। আমাদের জাতীয় স্বার্থ এর উপর নির্ভর করবে। দ্বিতীয়ত, এটা বলা হয়েছিল যে সেখানে কোন সঠিক সরকার গঠন হয়নি। এতেও আমি দ্বিমত পোষণ করি। যে দেশ স্বীকৃতি দেবে সে নিজেকে জিজ্ঞেস করবে ঐ দেশের বৈধতা কতটুকু। তখন সে বলতে পারে আমি ঐ দেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি। এটি প্রদানকারী দেশটির নিজস্ব ব্যাপার।
এখন, স্যার, আমি একটি প্রশ্ন করছি – কার কাছে কে বৈধ? মুজিবের না ইয়াহিয়ার? স্যার, বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা সেনা অভ্যুত্থান নয়। একটি বৈধ সরকারকে উৎখাত করার পায়তারা মাত্র। সরকার সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত বৈধতা নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু এখন নিঃসন্দেহে বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার সেখানে আছে। মুজিবুর রহমানের দল গণতান্ত্রিক ভাবে ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। সেখানে কিছু সাজানোর ছিল না। ইয়াহিয়া খান ছিলেন বিদ্রোহী। ইয়াহিয়া খানের কোনো যুক্তি বা আইনি বক্তব্য নেই যাতে তিনি এই গণতান্ত্রিক সরকারকে প্রত্যাখ্যাত করতে পারেন।
শ্রী কল্যাণ রায় (পশ্চিম বংগ ) – জেনারেল ফ্রাঙ্কো সম্পর্কে কি বলবেন?
শ্রী এম সি ছাগলা: হ্যাঁ, আমি যা বলতে চাই তা-ই। কিন্তু, এমনকি ফ্রাঙ্কোর ক্ষেত্রে, তিনি একজন বহিরাগত হিসেবে এসেছিলেন। কিন্তু এটা সত্য যে তিনি গৃহযুদ্ধের সময় স্পেনের সাংবিধানিক সরকারকে পরাভূত করার চেষ্টা করেন। স্যার, কিন্তু সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের চেপে রাখছিল – এখানে তেমনটা না। ইয়াহিয়া খান মূলত সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং এই সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কে রাজনৈতিক উপায়ে পরাভূত না করতে পেরে লক্ষ লক্ষ হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল যাতে এরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।
স্যার, বাংলাদেশের স্বীকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারত আইনগত, বৈধভাবে এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, আমরা বাংলাদেশে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারতাম। এবং যদি আমরা বাংলাদেশকে অস্ত্র সরবরাহ করি বাংলাদেশ একটি অবস্থানে যেতে পারত। যদিও হয়ত পুরোপুরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বহিষ্কার করতে পারত না কিন্তু বাংলাদেশের একটি বড় অংশ দখল করতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশকে অস্ত্র দান না করে অথবা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে উল্টো আমাদের দেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনার প্রক্রিয়া করার সুযোগ তাদের করে দেয়া হয়েছে। এখন কি লাভ হল? অসহায় বাংলাদেশকে সেনাবাহিনী শেষ করে দিচ্ছে। তারা সেই এলাকা দখলে রেখেছে। এত কিছুর ভেতরেও সেখানে গেরিলা কার্যক্রম চলছে। কিন্তু তাদের দিকে কোন যত্ন নেই। আমি বলছিনা যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে আর অস্ত্র সরবরাহ করে শরনার্থি ঠেকানো যাবে।
তারা ভারতে আসছে এবং এই সরকার তা ঠেকাতে পারত। আমি বলছি ঠেকানো যেত। এই ৬ মিলিয়ন উদ্বাস্তু এখানে থাকতো না।
এখন, স্যার শরণার্থীদের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই। স্যার, আমি শরণার্থীদের জন্য কাজ করার জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানাই। আমি মনে করি আমরা একমাত্র দেশ যারা তাদের গ্রহণ করেছি, তাদের গৃহায়ন ও তাদের খাওয়ানোর ভার গ্রহণ করেছি- এবং এজন্য আমরা গর্বিত। এটা আমাদের অর্থনীতির উপর একটি অসাধারণ বোঝা। কর ব্যবস্থা যথেষ্ট উঁচু কিন্তু আমি দেখতে পাই আমার বন্ধু, অর্থমন্ত্রী, খুব শীঘ্রই লোকসভায় সম্পূরক মঞ্জুরী জন্য অনুরোধ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু, স্যার আমরা আর কতকাল এই বোঝা বহন করতে যাচ্ছি? আমি এই হাউজে বলতে চাই যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সব সময় সাহায্য করবেনা। যদিও কিছু দেশ থেকে আমরা অনেক অর্থসাহায্য পেয়েছি।
শ্রী কল্যাণ রায়: খুব সামান্য পেয়েছি।
শ্রী এম সি ছাগলা: কিন্তু এটা শুধুমাত্র এই বছরের জন্য। এই শরণার্থীরা যদি বছর বছর আসা অব্যাহত রাখে তাহলে আমরা সবাইকে ম্যানেজ করতে পারবোনা। এবং এটা আমাদের অর্থনিতিকে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন করবে। ৬ মিলিয়ন লোক কে মেনে নেয়া অনেক কঠিন।
শ্রী কল্যাণ রায়: নয় মিলিয়ন মানুষ।
শ্রী এম সি ছাগলা: ইতিমধ্যে আমাদের দেশে অনেক বেকার সম্প্রদায় আছে। আমরা তাদের ভর্তুকি দিতে পারিনা। এটা অপমানজনক।
কিন্তু এই ছয় মিলিয়ন মানুষের ব্যাপারে …
এএন সন্মানিত সদস্য: ছয় মিলিয়ন এর বেশী, । প্রায় আট মিলিয়ন উদ্বাস্তু আছে।
শ্রী এম সি ছাগলা: এই ৮ মিলিয়ন মানুষকে প্রতি মাসে খাদ্য খাওয়াতে হবে। এই বোঝা বহন করতে হবে। সবাইকে কাপড় দিতে হবে। ভারত এভাবে কতদিন পারবে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এখনো দেখতে যে এইসব শরণার্থীদের কিভাবে ফেরত পাঠানো যায়। মাননীয় মন্ত্রী, স্বর্গের নামে কসম করে জিজ্ঞেস করি দয়া করে আপনি কি বলবেন এদের ফেরত পাঠানোর পথ কি? কিভাবে প্রধানমন্ত্রী দেখতে পাবেন যে শরণার্থীরা ফিরে যাচ্ছে? তিনি তো তাদের ঠেলে বের করে দিতে পারবেন না। আপনিও পারবেন না।
শ্রী কল্যা রায়: তাদের মৃত্যুর পর তারা আধ্যাত্মিকভাবে ফিরে যাবে।
শ্রী এম সি ছাগলা – কিন্তু ছয় মিলিয়ন মানুষ মরতেও অনেক সময় নেবে। এবং তাদের আবার কিছু সন্তানও হবে। কোন উপায় নেই। আমি জানি যে, আমি নিজেই শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোন পরামর্শ দিতে যাচ্ছি না।
এখন, স্যার আমাদের শক্ত হতে হবে। আমরা ভুলে যাই যে আমরা মহান জাতি। আমাদের ক্ষমতা বড় হওয়া উচিত। কিন্তু এমন আচরণ করছি যেন আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ।
শ্রী কল্যাণ রায়: হ্যা।
শ্রী এম সি ছাগলা – আমি এর সাথে একমত না। আমি এমন মনে করি না। আমাদের দেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। তাহলে আমরা কেন দ্বিতীয় শ্রেণীর জাতি হয়ে থাকব? কিন্তু, স্যার, আমরা নিজেদেরকে তাই করে রেখেছি। আমি বলি কেন। আমরা কখনো উদ্যোগ নিতে পারিনা। কোন সমস্যা দেখা দিলে, আমরা প্রথম মনে করি চীন কী করবে। আমরা মনে করি পাকিস্তান কী করবে, রাশিয়া কিভাবে কাজ করবে …
এএন সন্মানিত সদস্য: …… কিভাবে মিশরের প্রতিক্রিয়া হবে।
শ্রী এম সি ছাগলা: হ্যাঁ, আমরা মনে করি কিভাবে মিশরের প্রতিক্রিয়া হবে। কিন্তু আমি জানতে চাই পাকিস্তান কি কোনোদিন মনে করে ভারতের প্রতিক্রিয়া কি হবে? এই হাউজ; সরকার পক্ষ বা আমার বন্ধু এটা বলেন আর না নাই বলেন; তারা আসলে অন্য কারো স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা রাশিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। রাশিয়া এটা আমাদের জন্য কেন করবে? আমরা রাশিয়ার কাছে কি চাই? কেন আমরা কারো জন্য অপেক্ষা করব? স্যার, অতীতে, অনেক অনুষ্ঠানে, যখন শ্রী জওয়াহারলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি কোথাও অন্যায় হলে উঠে দাঁড়িয়েছেন। যা সমগ্র বিশ্ব জানে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন কোথাও স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে যখন যেখানে অত্যাচার ছিল, অবিচার ছিল, তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন – কোনোদিন অন্যের জন্য অপেক্ষা করেন নি। তার কথা সমস্ত এশিয়া শুনত।
স্যার, এটাই আমাদের করতে হবে। আমি বিশ্ববাসীর মতামত সম্পর্কে বলব। রেজল্যুশন বলছে যে সেশন শেষের আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমি বলব এখনি স্বীকৃতি দিন। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। অন্যথায় এটা একটি বিলম্বিত জাতি হয়ে যাবে – তাই এখনই আমাদের কিছু করতে হবে। অন্তত আমরা বিশ্বকে জানাতে পারি যে আমরা এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা শুরু করছি। বিশ্বের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি। আমি আরো হতাশ, বিশ্ব বিবেক বাংলাদেশে কি ঘটছে তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না। বিশ্ব বিবেকের কি ঘটেছে? তারা নিঃশব্দ, নীরব বা মৃত হয়ে আছে। জোট নিরপেক্ষ অবস্থার কি পরিবর্তন ঘটেছে? আফ্রিকায় এবং আরব বিশ্বে যা ঘটছে – আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছি। ইউ এ আর এর ব্যাপারে আমাকে কথা শুনতে হয়েছে।
আমি নাসিরের পাশে দাঁড়িয়েছি। কারণ সে সেক্যুলারিজমের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এবং আমি জানি আমি তখন ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হচ্ছে যে তারা ধর্মান্ধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। স্যার, আমি আপনার ধৈর্য বিচ্যুতি ঘটাতে চাই না। আমি কি এক বাক্যে উপসংহারে আসতে পারি? সরকার যা করছেন তার পরিণতি তাকে ভোগ করতে হবে। যদি জাতীয় সার্থে কিছু করা হয় সেটা যাই হোক না কেন করা উচিৎ। পাকিস্তান যদি যুদ্ধ করতে চায় তাহলে আমরা পারব। আমরা আগেও পেরেছি আবারো পারব। পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই – পাকিস্তান সবসময় আমাদের শত্রু থাকবে। চীন নিয়ে আমি ভিত না – তারা শুধু কিছু হাউ-কাউ করে। এর বেশী – অর্থাৎ কোন আক্রমণ আমি তাদের কাছ থেকে হবে বলে মনে করি না। সরকারের আজ যা দরকার তা হল সাহস। এবং তা জাতীয় স্বার্থে করতে হবে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বাস দেই যদি তিনি ভারতে আজ গণভোট নেন তাহলে ৯০% জনগণ বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে রায় দেবে।
শ্রী বিপিনপাল দাস (আসাম):বাংলাদেশ সম্পর্কে এই হাউজে যা আলোচনা করা হয়েছে বার বার সেটাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ইস্যু ধরা যাবেনা। এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটা আমরা শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের ভিত্তিতে নয় বরং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ও ধরে নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
[জনাব.ডেপুটি চেয়ারম্যান]
এটা একেবারে ভুল হবে যদি কেউ বিশ্বাস স্থাপন করে যে পাকিস্তান ইসলামের জন্য বা মুসলমানদের স্বার্থ দেখছে। চার মাসের মধ্যে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই যে জীবন, সম্মান এবং এমনকি -লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের সম্পত্তি একটি মুসলিম সরকারের হাত একেবারে অনিরাপদ হয়ে আছে। তারা দাবি করে তারা ইসলামী আইন অনুযায়ী পরিচালিত। বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যার উপর মুসলিম সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপ্তি ২০ বছর ধরে পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদীরা আরবদের যে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছিল সেটাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সবার দেখা উচিৎ পাকিস্তান বা ভারতের মধ্যে কোন দেশ জীবন, সম্পত্তি ও মুসলমানদের সম্মান দেয়ার দিক থেকে বেশী নির্ভরযোগ্য। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারনা বহিবিশ্বে দেয়া হয়েছে।
সত্য এটাই যে পাকিস্তান কোনোদিন মুসলমানদের জন্য ভাল কিছু করেনি। এটা অ্যাংলো-আমেরিকান ষড়যন্ত্র ও পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক সমর্থিত চক্রান্ত যার ফলে পাকিস্তানের দরিদ্র জনসাধারণ শোষিত হচ্ছে এবং অন্যদিকে ভারতের বিপক্ষে একটি সামরিক উষ্ণতা সৃষ্টি করছে। ব্রিটেন, কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তরিকভাবে কেউ ভারতের সমৃদ্ধি চায় না বা ভারত শক্তিশালী হোক তা চায় না। এবং তারা সবসময় পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে তাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য। ব্রিটেন এখন গ্রেট পাওয়ার নাই তাই তারা তাদের দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে আমেরিকার কাছে। আমেরিকা ছাড়া আর কোন দেশ বাংলাদেশ ইস্যুতে এতোটা জড়িত নয়। তারা গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের মানবিক মূল্যবোধের কথা বলে কিন্তু নির্লজ্জভাবে ওঁরা পাকিস্তানকে অস্ত্র ও ত্রাণসাহায্য করছে। আর পাকিস্তান তা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের উপর গণহত্যা অব্যাহত রাখছে। আসলে এই উপমহাদেশে পাকিস্তান আসলে আমেরিকান বেইস স্টেশন হিসাবে কাজ করছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিদর্শন স্বরূপ। আর পাকিস্তান পেন্টাগন এবং সিআইএ’র এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
স্যার, আমি বিস্মিত হবোনা যদি দেখি যে চীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে তথা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকার সাথে তাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় তা স্পষ্ট হয়। এই কমিউনিস্ট দেশটি স্বাধীনতা কামী একটি দেশের বিরুদ্ধে যাচ্ছে যারা সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করছে। শোষণ, গণহত্যা, ধর্ষণের সাথে জড়িত একটি শাসকদের সমর্থন করছে। চীন এর আসল উদ্দেশ্য আজ উন্মুক্ত হয়েছে। তাদের সাথে আমেরিকান সম্পর্কের সম্পূর্ণরূপে অন্য মাত্রায় উন্নয়ন হচ্ছে এবং আমি মনে করি না এটার সাথে বাংলাদেশ ইস্যু সম্পর্কহীন। বিশেষত যখন পাকিস্তান দালালের ভূমিকায় অবতীর্ন এই পাওয়ার পলিটিক্সের সময়। তাই এই অবস্থায় বাংলাদেশ প্রশ্নে আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। প্রথম যে কাজটা আমি সুপারিশ করব – আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি তাৎক্ষণিক রিভাইজ দরকার – এবং সেটা চিন, আমেরিকা আর পাকিস্তানের জালে আটকা পড়ার আগেই করতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য একদিকে সোভিয়েত রাশিয়া ও অন্যদিকে জাপানের সাথে আমাদের বেশী ঘনিষ্ঠ হতে হবে। একটি দেশের বৈদেশিক আদর্শ তাদের আভ্যন্তরীণ সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভর করে না। এটা উপর ভিত্তি করে এবং জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার বিবেচনা উপর ভিত্তি করে করা উচিত। এই কারণে যে আমি দৃঢ়ভাবে বলছি রাশিয়া ও জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। এটি শুধুমাত্র এই দেশ নয় বাংলাদেশ বিষয়েও সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের সংগ্রাম মূলত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য। পাকিস্তান এক দেশ হিসেবে একতাবদ্ধ থাকবে নাকি ভেঙে যাবে সেটা আমাদের বিষয় না। সেটা পাকিস্তানের জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রের মান, মানবাধিকার মান, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধ এবং সমাজতন্ত্রের মূল্যবোধ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই কোণ থেকে বিবেচনা করে আমরা পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম সমর্থন করেছি এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সমবেদনা ঘোষণা করছি। প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে: আপনি কর্ম পরিকল্পনার মধ্যে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন? আমি মনে করি না এই ব্যাপারটা এখানে জনস্বার্থে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত অধিকাংশ সন্মানিত সদস্যরা এটা জানেন। আমি বিশ্বাস করি সরকার তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। এখন, স্যার, এক জিনিস করা উচিত …..
শ্রী লোকনাথ মিশ্র (উড়িষ্যা): তারপর আমরা আলোচনা বন্ধ করব?
শ্রী বিপিনপাল দাস: আমি আসছি সে প্রসঙ্গে। আমি জানি আপনি সব সময়ই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য কথা বলেন। যে যুদ্ধে বাইরের শক্তির কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে করা হয় তার শেষ ফল ভালো হয়না। অতএব, বাংলাদেশ এবং তার মুক্তিবাহিনীর উচিৎ নিজের যুদ্ধ নিজেরাই করা। এই হাউজে গত অধিবেশনে আমি এটা বলেছিলাম। শরণার্থীদের থেকে ১ লাখ যুবকদের বেছে নিয়ে তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তাদের স্বাধীনতার নিজস্ব যুদ্ধে নিজেরাই যেতে পারে। আমি বলছি এটা আমার পরামর্শ মাত্র এবং আমি এটা বিশ্বাস করি বলেই বলেছি। আগে এটা বলার পরে কেউ আমার কোথায় কর্নপাত করেনি। আমি এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারব না। আমি আগেই বলেছি, এটা জনস্বার্থে হবে না। এখন বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে আমি মনে করি মুক্তিফৌজ তাদের অপারেশন সফল ভাবে করতে পারছে এবং পাকিস্তান আর্মির জন্য গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তারা সঠিক পথে যাচ্ছে। এই কারণে এখন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের পোস্ট করার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে। এর কারণ তারা মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম থামাতে চায়। এটা হল পাকিস্তান-বাংলাদেশ ইস্যুটিকে ইন্দো-পাকিস্তান ইস্যুতে পাল্টে দেবার পশ্চিমা চাল। এই পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে তার কারণ মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি শাসকদের জন্য যে অপারেশন চালাচ্ছে তা গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এমদের এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পাকিস্তান আগামীকাল আমাদের আক্রমণ করলে অবশ্যই আমরা রুখে দাঁড়াবো এবং আমাদের দেশকে রক্ষা করব। কিন্তু আমি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সরাসরি সশস্ত্র সংঘাতের মুখোমুখি হবার পক্ষে নই।
অতএব আমাদের সমগ্র নীতি হবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা এবং সফল হবার জন্য তাদের নিজস্ব যুদ্ধ করতে সাহায্য করার জন্য ঐ সমস্ত লোকদের সাহায্য করা উচিত। আমি আমার মনের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই যে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণের জয় হবে। আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে, শেষ পর্যন্ত মুক্তি ফৌজ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে তাদের দেশ স্বাধীন করতে পারবে।
এখন স্যার, এই হাউসে যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তা হল স্বীকৃতি। আমি মনে করি না এই হাউজে এমন কেউ আছে যা স্বীকৃতি দেবার বিপক্ষে। যদ্দুর মনে পড়ে, এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছিলেন সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিপক্ষে না। প্রশ্ন হল যখন আমরা বলেছি, দেশের মানুষ বলেছে, তখন অনেক সদস্য বলেছেন, জনাব ছাগলাও বলেছেন, ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপার টি সিদ্ধান্ত আর কেউ নিতে পারবেনা। শুধু সরকার এই সিদ্ধান্ত নেবে। তারা পরিস্থিতির শ্রেষ্ঠ বিচারক। কোন পরিস্থিতিতে তারা এটা করবেন তা তাদের ব্যাপার। অতএব, আমি মনে করি সরকারকে চাপ দেয়া আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত। আমি আবারো বলছি যে মুক্তি ফৌজ তাদের মুক্তির যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য তাদের বসে থাকা উচিৎ নয়।
জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমরা একটি প্রাইভেট মেম্বার রেজোলিউশন নিয়ে আলোচনা করছি। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ রেজোলিউশন। এবং স্বাভাবিকভাবেই অনেক সদস্য এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চাইবে। প্রত্যেক সদস্য পনের মিনিট কথা বলার সুযোগ পাবেন। এই আলোচনায় বৃহৎ সংখ্যায় সদস্যবৃন্দ অংশগ্রহণ করতে চান – তাই কাউকে অতিরিক্ত সময় দেয়া যাবেনা। তাই আশা করি আপনারা ১৫ মিনিটে শেষ করবেন।
জনাব বিজু পাটনায়েক,
শ্রী বিজু পাটনায়েক (উড়িষ্যা): আমরা এর আগে এই হাউজে সদস্যদের মধ্যে এটা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকতে পারেন না। এটি তার একটি সুনামের বিষয়, সম্মানহানিকর কিছু নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জিনিস নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা উচিৎ। এই হাউজ থেকে করা সকল বিবৃতি সময়ে সময়ে বাংলাদেশে পৌঁছাবে। ট্রেজারি বেঞ্চ এবং বিরোধীদল এর সাথে আলোচিত মতামত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উভয়ের মতের সাথে সাদৃশ্য আছে। কিন্তু দেখা যায় সরকার মাঝে মাঝে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে যা এই হাউজের অনেকের কাছে সন্দেহজনক।
আমরা সংক্ষেপে গণহত্যা, নিপীড়ন, নজিরবিহীন ধ্বংস যজ্ঞ আর নির্যাতন শব্দগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। এর আগে এই হাউজের কোন এক সদস্য বলেছিলেন পার্টিশনের সময় প্রায় ৬ মিলিয়ন হিন্দু এই দেশে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের সময় সরকারী রেকর্ড বলে এই বছরের ১ জুন পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ থেকে ৬.৫ মিলিয়ন মানুষ এসেছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশ প্রশ্নে দ্বি-জাতিতত্ত্বের অসাড়তা উদ্ভাসিত হয়েছে – আমি বিনীতভাবে এর সাথে অসম্মতিজ্ঞ্যাপন করছি।
পূর্ববাংলায় দেশ ভাগের সময় প্রায় ১০ মিলিয়ন হিন্দু ছিল। ধরি তা এখন আরও ২ মিলিয়ন বেড়েছে। মানে মোট ১২ মিলিয়ন হিন্দু। তখন তাদের ছয় মিলিয়ন বেরিয়ে এসেছিল এবং এখন বাকি সাড়ে ৬ মিলিয়ন। জনাব ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানের শাসকরা দ্বি-জাতিতত্ত্ব বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাই আমরা চাই এমনই একটি ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার সরকার প্রতিবেশী দেশে থাকুক। জনাব মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ মতের উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের আন্দোলন ব্যর্থ হলে পাকিস্তান শেষ হবেনা। ভারত শেষ হবে। আমি আবার বলছি, পাকিস্তান একটি শতভাগ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সম্পৃক্ততা উভয় দিকে হতে হবে। রেকর্ড অনুযায়ী ৬৫ লাখ হিন্দু এই গণহত্যার সময় পূর্ববঙ্গ থেকে চলে গেছে এবং এর মধ্যে ১৫-২৫ বছর বয়সী নারী গোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক কম। কারণ এই সময়ে এদেরকে হয় পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা মধ্য প্রাচ্যে বিক্রি করা হয়েছে। এগুলো সত্য জীবন কাহিনী।
স্যার আমাদের কবুতরের মত চোখ বন্ধ্ করে রাখার অভ্যাস আছে এবং বসে বসে ভাবতে থাকব যে সমস্ত বিশ্ব ভাল আছে। আসলে আমরা নিজেদের সাথেই ভিন্ডামি করছি। পুরো বিশ্ব ভারতের ইতিহাস পড়ে। ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে একটি গভীর গবেষণা আছে বিশ্ব বাসীর কাছে। আমরা নিজেদেরকে একটি মহান জাতি মনে করি। আমরা সবচেয়ে জনবহুল একটি দেশ হতে পারি।
শ্রী এ ডি মনি (মধ্য প্রদেশ): আমরা কখনোই বলিনি।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমরা নিজেদেরকে একটি মহাণ জাতি হিসাবে দেখি। আপনি কি সেটা খেয়াল করেছেন? এটা একটা জাতি, যা অত্যন্ত জনবহুল সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। তার মোট স্ট্রাইকিং পাওয়ার ৪ মিলিয়ন টন ইস্পাত যার মাত্র ৯ মিলিয়ন টন ধারণ ক্ষমতা।
আমাদের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ হয়েও জাপান ৯২ মিলিয়ন টন ইস্পাত উৎপাদন করে- কোনো লোহা বা কয়লা ছাড়াই। এই হল আমাদের মহিমা, এই হল আমাদের মহান সরকারের অবস্থা। এই হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাপেক্ষে আমাদের সার্বভৌমত্বের অবস্থা। আমাদের স্বীকার করতে হবে আমরা কি। আজ আমি নিশ্চিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করবেন যে আজ আমরা এশিয়ার মধ্যেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারিনাই। চীন আমেরিকা সরাসরি লিঙ্ক ও অর্থনৈতিক লিঙ্ক এর পাশাপাশি ভারত অবহেলিত। এমনকি নেপাল থেকেও। তুলনামূলকভাবে, আমরা একটু ইসরাইলের অবস্থা দেখি। যে দেশ একজন নারী দ্বারা শাসিত হচ্ছে। যে দেশ ডায়ান এর মত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আছে যারা তথাকথিত আরব বাহিনী বিতাড়িত করেছে। যারা মিসরের সমগ্র বিমানবাহিনীকে পরাস্ত করেছে এবং মিশর তার মাথা উঁচু করতে পারেনি। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে আমাদের যুদ্ধের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্বীকার করবেন, আমাদের বিমানবাহিনীর ঘাঁটি কালিকুন্ড পূর্ব সেক্টর ও পাঠান কোট পশ্চিম সেক্টরে শেষ করে দেয়া হয়েছিল। তারা এসে আমাদের জঙ্গী বিমান ধ্বংস করে চলে গেছে – আমাদের কিছু করার ছিলোনা। আমরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতির জন্য প্রস্তুত আছি। যদি প্রস্তুত থাকি তাহলে আমরা ভিত কেন? শুনছি একটি রেজোলিউশন হাউসে পাশ হতে পারে যে আমরা বাংলাদেশকে স্বীকার করব শুধু তাদের জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য। তারা যাতে তাদের নিজেদের যুদ্ধ করে যেতে পারে সেই ব্যাপারে। জনাব মুখার্জী বলেন, এটা এই অধিবেশনের শেষ দিকে করা হবে। জনাব ছাগলা বলেন এটা গতকাল সম্পন্ন করার কথা এবং যদি তা না করা হয় তাহলে আজ করা উচিৎ। জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যানকে আমি রেকর্ড করতে বলছি যে এই সরকার আসলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি কোনোদিন দেবেনা।
শ্রী শীল ভদ্র ইয়াজি(বিহার): প্রশ্ন
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি আপনাকে কারণ বলব
শ্রী মাহাভির টায়গি (উত্তরপ্রদেশ): আমরা ইতিমধ্যে স্বীকার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমরা বাংলাদেশকে কোনোদিন স্বীকৃতি দেবনা। এই সাহসী মুক্তি বাহিনীকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন শুধুমাত্র শেষ করে দেবেনা বরং পরবর্তী ২০ বছর ধরে তাদের শাসন চলতে থাকবে। আমি এই কথা ঐতিহাসিক কারণে রেকর্ড করে রাখতে বলছি।
শ্রী শীল ভদ্র ইয়াজী: আপনি ভুল বলছেন।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি আপনাকে বলছি কেন। আমি আপনাকে আমার মূল্যায়ন বলব। এই সরকার পা ঠাণ্ডা করে ফেলেছে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এই সরকার ১২০০ কোটি রুপি বরাদ্দ রেখেছে যেখানে পাকিস্তান রাখে ৩৫০ কোটি। তাদের কি জন্য প্রস্তুত করা হয়? আমরা কেন ভীত? আমাদের মানুষ মাটির উপর গুলি খেয়ে পড়ছে। গতকাল আমি শুনে অবাক হলাম যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন আমাদের সীমান্ত বিএসএফ এর দায়িত্বে।
বিএসএফ, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের মর্টার নেই, আর্টিলারি নেই। তাহলে কিভাবে আমরা দূরপাল্লার ফায়ারিং করব? কে কাকে বোকা বানাচ্ছে জানি না? ৩৫০ কোটির বিপরীতে সরাসরি বাজেটে ১২০০ কোটি রুপির বাজেট। এছাড়া এর বাইরে আমরা বিএসএফ, এসএসবি, আসাম রাইফেলস, এয়ার ফোর্সের সব সীমান্ত পোস্ট এর বাহিনীকে খাওয়ানোর পিছনে, সীমান্ত সড়ক নির্মাণে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি রুপি খরচ করি। আমাদের প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টার সমর্থনে ৫০০ কোটি রুপি ব্যয় করি। পাকিস্তানের মত আমাদের ৯ টি ডিভিশন আছে। ৩১ মার্চ যদি আপনি স্বীকৃতি দিতেন এবং বাংলাদেশে অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা পাঠাতেন – তখন সেখানে পাকসেনা ছিল মাত্র ২ ডিভিশন – সেক্ষেত্রে ২ দিনে এই সমস্যা শেষ করে ফেলা যেত।
শ্রী রাজনারায়ণ(উত্তরপ্রদেশ): ঠিক
শ্রী বিজু পাটনায়েক: অথচ আমরা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে চারটি ডিভিশন হতে দিয়েছি। আমরা তাদের গত ছয় মাসে আরো দুটি ডিভিশন বাড়ানোর সময় দিয়ে দিয়েছি। এবং আমরা এখনো বিবেচনা করিনি যে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কতটুকু সতর্ক থাকবে। অনুপ্রবেশ, বিমান অনধিকারপ্রবেশকারী, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, এগুলো কতটুকু তারা করতে পারে। অতএব, আমি বললাম, আমাদের সরকার ভীত নয়। আমি একটি কথা রেকর্ড করে রাখতে বলি। যদি পাকিস্তানীদের ভয় করে তাহলে ৯ পায়ের চিনাদেরও ভয় করবে। আমি বলতে চাই যে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী চীনাদের ভয়ে ভিত। আমি এটা বলে দিলাম। একদিন আমি এই হাউসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উত্তর দেবেন। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ধীশক্তি কি? আমাদের কমান্ড বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ এবং জেনারেলদের যুদ্ধ ভীতি কতটুকু? এই হাউস সে প্রশ্নের উত্তর জেনে বিস্মিত হবে।
শ্রী বিনিনপাল দাস এর: স্যার, সেনাবাহিনীর সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা দায়িত্বশীল সদস্যের জন্য শোভনীয় নয়।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি এই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। আমি আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট চালিয়েছি। আমি চার বছর ধরে ব্রিটিশ কারাগারে ছিলাম। আর আমার এটা বলার অধিকার আছে।
শীর বিপিন পাল দাস : আমরা এও জানি কি জনাব বিজু পাটনায়েক চীনা হামলার সময় কি করেছেন।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমার রেকর্ডে জন্য নেহেরুকে জিজ্ঞাসা করুন।
শ্রী কৃষাণ কান্ত (হরিয়ানা): পয়েন্ট অব অর্ডারে এই হাউসে আমরা একটি গুরুতর ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি।
শ্রী রাজ নারায়ণ : হ্যাঁ।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: আমরা কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু কারো হতাশাজনক কোন মন্তব্য করা এই মুহূর্তে ঠিক নয়।
শ্রী রাজ নারায়ণ : পয়েন্ট অব অর্ডারে উপর …
ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি (রাজস্থান): স্যার, আপনি আগে সব কিছু শুনুন।
শ্রী রাজ নারায়ণ : আমরা সবকিছু জানতে চাই।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: জনাব কৃষাণ কান্ত, আপনি যা বলছেন তা সঠিক নয।
ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।
শ্রী রাজ নারায়ণ – মহোদয়, একটি বৈধতার প্রশ্ন। আমি বলতে চাই, যাদের কারণে ভারতের দাবী অংশ নস্যাৎ করা হয়েছে, নেফা হারিয়েছে, কাশ্মীর হারিয়েছে তাদের বলার অধিকার আছে। ইনি রাবিশ বলেছেন।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: কোন সদস্য শৃঙ্খলাভঙ্গের অধিকার পাননি।
(বাধা)
শ্রী রাজ নারায়ণ – যারা দেশের স্বাধীনতা বিক্রি করেছে তারা আজ এখানে চিৎকার করছে- দালাল কোথাকার।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, আপনি শুধুমাত্র এই হাউজের অভিভাবক নন, আমাদের জাতীয় স্বার্থের ও অভিভাবক।
শ্রী রাজ নারায়ণ : আপনি জাতীয় স্বার্থের কী জানেন? আপনি জাতিকে বিক্রি করেছেন।
বিরোধী নেতা (শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী) – আমি কি কিছু বলতে পারি?
শ্রী কৃষাণ কান্ত: আমাকে আগে শেষ করতে দিন।
শ্রী রাজ নারায়ণ: না, না. আমরা পয়েন্ট অব অর্ডারে….
শ্রী বিজু পাটনায়েক: জনাব কৃষাণ কান্ত, জাতি এই হাইজের চেয়ে বড়।
শ্রী কৃষাণ কান্ত: স্যার, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বা আমাদের জনগণের ক্ষমতার নিন্দা করে কোন বক্তব্য দেয়া উচিৎ নয়।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: এটা কি?
শ্রী রাজ নারায়ণ – এই সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে দূষিত করেছে।
কিছু সন্মাঞ্জনক ব্যাক্তি: না না
কিছু মাননীয় সদস্য: হ্যা, হ্যা।
(বাধা)
শ্রী আর টি পার্থ সারথি (তামিলনাড়ু): পয়েন্ট অব অর্ডারে উপর ….
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন। আমি গুরুপদ স্বামীকে ডেকেছি।
শ্রী এ জি কুলকার্নি: স্যার, আমি চাই।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে বসুন।
শ্রী উ জি কুলকার্নি: আমি বলতে বলা হয়েছে।
পয়েন্ট অব অর্ডার আছে।
(বাধা)
(বাধা)
এ ধরনের আজেবাজে কথা অবিসন্বাদিত যেতে পারে না।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: আপনার আজেবাজে কথা চলছেই ….
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি বসুন।
শ্রী উ জি কুলকার্নি এই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়।
শ্রী এল এন মিশ্র. (বিহার): দয়া করে একটু উদার হন।
শ্রী গুরু পদ স্বামী: আমি জানি শ্রী বিজু পাটনায়েক আমাদের সামরিক বাহিনীকে কলঙ্কিত বা ছোট করতে চাননি।
একজন সম্মানিত সদস্য: সে আর কী কী করেছেন?
শ্রী বিজু পাটনায়েক তিনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারদের সম্পর্কে বলেন …..
(বাধা)
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার অর্ডার। বসুন।
শ্রী উ জি কুলকার্নি: আমি বুঝতে পারি আপনি কি বলছেন।
শ্রী পাঁজ নারায়ণ : আমরা কাউলের ইতিহাস দেখেছি।
শ্রী এল এন মিশ্রের: তিনি আর নেই। চলে গেছেন
শ্রী আকবর আলি খান (অন্ধ্র প্রদেশ): তিনি একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ। আমি তাকে জেনারেল বা আমাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে দিচ্ছিনা।
শ্রী গৌরি পদ স্বামী : শ্রী আকবর আলী খান আমাদের ভাইস- চেয়ারম্যান। তার অন্তত জানা উচিত যে, তার কথা বলা উচিত নয় যখন আমি দাঁড়িয়ে আছি।
এই হাউসের কেউ সেনাবাহিনীকে কলঙ্কিত করার জন্য কিছু বলেনি। একই সাথে এই হাউসের সদস্য হিসেবে, আমাদের সত্য জানা উচিত এবং নির্দিষ্ট কিছু কথা অকপটে প্রকাশ করার আছে। শ্রী বিজু পাটনায়েক সেনাবাহিনীর কমান্ড সম্পর্কে কিছু প্রকাশ করেছেন ….
একজন সম্মানিত সদস্য: আমাদের আর্মি সম্পর্কে।
শ্রী এম এস গুরুপদ স্বামী: তিনি সেনাবাহিনী সম্পর্কে উল্লেখ করেন। আমি আপনার সাথে আছি।
শ্রী এ জি কুলকার্নি: কমান্ডার তাঁর অধীনে আর্মি দের অনুপ্রাণিত করবেন। কীভাবে আপনি কমান্ডারকে অসন্মান করেন?
শ্রী কৃষাণ কান্ত; কার্যধারায় এটা করা না ….
(বাধা)
শ্রী এম এস গুরুপদ স্বামী; আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই, এটা ভারতের দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য কিনা যে একজন সদস্য হাউজের দৃষ্টি আকর্ষন করবে? যদি সেই সদস্যের সেনাবাহিনীর সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকে সে কি তা বলার অধিকার রাখে না? সে তো তার দায়িত্ব পালন করছে। সেবা দিচ্ছে। তার উৎসাহটা আপনারা নিচ্ছেন না কেন?
শ্রী আকবর আলি খান: এটা প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় করা যেতে পারে ….এখানে করলে তা সমস্ত বিশ্বের কাছে চলে যাবে —
(বাধা)
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: একটি বিষয় উল্লেখ করার মানে এই নয় যে তিনি পুরো সশস্ত্র বাহিনীকে অপমান করেছেন।
শ্রী আর টি পার্থ সারথি: এই ধরণের আলাপ আলাপ এই ধরনের পরিণামে আমাদের দেশের নিরাপত্তা ক্ষতি করতে পারবে না ….
(বাধা)
সরদার শরণ সিং: শ্রী বিজু পাটনায়েক একটি ভালো পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে ভালো হয় এটাকে আর আর দির্ঘায়িত না করলে। তাকে পরের পয়েন্টে আসতে বলুন।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি অবশ্যই বলছি যে সন্মানিত সদস্যরা কার্যধারার মধ্য দিয়ে যাবেন এবং দেখবেন আমি আর্মড ফোর্সেস কে কলঙ্কিত করেছি কিনা। আমি যা বলেছি তা এই হাউজের জানা উচিৎ কারণ আমি বলেছি বর্তমার আর্মি কমান্ডারদের অবস্থা সম্পর্কে।
একজন সন্মানিত সদস্য: তারা বিশ্বের মধ্যে সেরা।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
আমি আবার বলছি কমান্ডারদের দায়িত্ব এখনো প্রমাণিত হয়নি। তারা ভিয়েতনামে বা ইস্রায়েলের দায়ানের মত প্রমাণ করতে পারেনি। আমি যা বলতে চাই তা হল সরকারের উচিৎ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পরীক্ষা করা। তারা কি জন্য যুদ্ধ করছে? কেন তারা যুদ্ধ করছে? স্যার, আমি বলছি, রেকর্ড করতে …. (বাধা) .. আমাদের সমস্ত কর্ম, আসলে, আমাদের সব প্রতিক্রিয়া, চীনা সম্পৃক্ততার লুকোনো ভয়। আমি বলছি রেকর্ড করতে। স্যার, আমরা গত পাঁচ বছরে…. (বাধা) .. দয়া করে এখন আমার কথা শুনুন। আমরা গত পাঁচ বছরে, ৯ টি মাউন্টেইন ডিভিশন করেছি হিমালয় এর সুরক্ষার জন্য। এটা কি সত্য নয়? যদি তাই হয়, তাহলে কমপক্ষে ১৩ থেকে ১৪ টি ডিভিশন তিব্বতের কাছাকাছি এলাকা আচ্ছাদন করে আছে। আমরা চীনা এর ভয়ে ভীত না। আপনি তাদের ক্ষেপণাস্ত্র না পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যদি ভিত হন তাহলে বলব ভারতের দিকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে তা চিন জানে – তাড়া এমন ভুল করবেনা। অতএব, সেখানে নয়টি বিভাগে আছে। এবং চৌদ্দ বিভাগের নয়টি আছে – মানে ৫০%। পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের নীতি কোন ভীতি থেকে নেয়া উচিৎ নয়। এবং সেখানে যতক্ষণ না একটি নেতৃত্ব আসছে ততোক্ষণ কোন ইনভল্ভ হওয়া উচিৎ নয়। তাছাড়া এই মুহুর্তে সেখানে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড থামানোর জন্য কোন নেতৃত্বও নেই। এবং সেখানে জাতীয় মর্যাদাও পিষ্ট হচ্ছে। এটাই আমার পয়েন্ট।
আমি, তাই জানতে চাই কেন আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছিনা। এর মানে হল শুধুমাত্র অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ। আপনি যদি বলেন যে আপনি এসব দিচ্ছেন তাহলে আমি বলতে চাই, এভাবে নয়। কেন ভারত, যার এক সময়ে পুরো বিশ্বের কাছে একটি নৈতিক প্রভাব ছিল তা কমে যাচ্ছে? গোপন পদ্ধতির জন্য? এটা গান্ধীজি বা নেহেরুর শিক্ষা নয়। কেন আপনি গোপন পদ্ধতি অবলম্বন করবেন? মান্ধাতার আমলের বন্দুক দান করে আর তাদের গেরিলা শিক্ষা দিয়ে.. (বাধা) .. জনাব শরণ সিং? এটা বিশ্বের সকলের কাছে জানা। এটা একদম শিশু সুলভ। (বাধা) আমি বলছি এটা সম্পূর্ণভাবে শিশুসুলভ।
জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে এখন শেষ করুন।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমাকে শেষ করতে দিন স্যার।
বিশ্বের সব বাহিনী জানে, সব সংস্থা জানে এবং আমি যা বলতে চাই …. (বাধা) হয় …. যে হাউসের জানা উচিত, কারণ বিশ্বের সবাই জানে এবং শুধু দুর্ভাগ্যবশত এই হাউসে তা গোপন করে রাখা হয়েছে। একমাত্র গোপন বিষয় হল আমাদের কোন সাহস নেই। তারপর স্যার আমি বলতে চাই যে গেরিলারা কোণ অঞ্চল দখল করে নাই, এবং গেরিলাদের কাছে শত্রুরা পরাজিত হয়নি। সে ক্ষেত্রে, উত্তর ভিয়েতনামীরা, যারা এখন দক্ষিণ ভিয়েতনামের সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ করছে, তাদের দখল করার কথা। এটা বিশ্বের সবচেয়ে তীব্র সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধরীতি যা বিশ্ব ইতোপূর্বে দেখেনি। কিন্তু তারা দখল করতে পারেনি।
কিছু সন্মানিত সদস্য: এটা অন্য বিষয়।
শ্রী ভূপেশ গুপ্ত: স্যার, আমি তাকে সংশোধন করতে চাই।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।
জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে এখন শেষ করুন।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: আমি মাত্র দুই মিনিট সময় নেব।
অতএব, স্যার, আমি বলতে চাই, এই সরকার চিনের ভয়ে নিজের অজান্তে নেতৃত্বের অভাবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেনা যার ফলে দেশ নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের আন্দোলন কেও ধ্বংস করছে।
এবং আমি জানি এভাবেই চলতে থাকবে। এখন উদ্বাস্তু সাত মিলিয়ন। কাল সেখানে দুর্ভিক্ষ হবে – আমি চাই ভবিষ্যতের জন্য রেকর্ড করা হোক। আরও পাঁচ বা ছয় মিলিয়ন আসবে।
(বাধা)
শ্রী এ জি কুলকার্নি: ট্যাক্স ফাঁকিবাজ
(বাধা)
শ্রী বিজু পাটনায়েক; আপনার মন্ত্রীদের কাছ থেকে এমনটাই আশা করা যায় – আপনার অর্থমন্ত্রী বলে কথা।
শ্রী এ জি কুলকার্নি: হাউস অবগত।
শ্রী বিজু পাটনায়েক: এই হাউসে অনেক কিছুই প্রচারিত আছে। যখন আমি নিজেকে ডিফেন্স করছিলাম তখন কেন আপনি ট্যাক্সের কথা তোলেন নি?
অতএব, আমি বলতে চাই, এই হাউস রেজোল্যুশন পাশের বদলে, পরিস্থিতির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও, দেরি করায় প্রতিদিন আমাদের সন্মান নিচের দিকে চলে যাচ্ছে জেনেও কিচ্ছু করছেন না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিশ্ব ভ্রমণে যেয়ে শুধুই সহানুভূতি পেয়েছেন। অন্যদিকে পাকিস্তান পেয়েছে যুদ্ধোপকরণ এবং সমর্থন। আমি এই কথা বলছি এবং আমি চাই একথা রেকর্ড করা হোক। আমি গর্বিত বোধ করব যদি আমার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করা হয় – কিন্তু আমি বলব এই সরকার এই সেশনে এমনকি পরের সেশনেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেনা। কারণ সাহসের সাথে এই কথা বলছি কারণ আমি জানি তাদের মাথায় প্যাঁচ ভর্তি। যুদ্ধ আসলে সেটা চালানোর মত নেতৃত্ব তাদের নেই। ধন্যবাদ।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমি মনে করি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে আপনি অনেকটা জোর করছেন।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: আসলেই কি তাই?
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: হাউস ২ টা পর্যন্ত মুলতবি করছি।
(হাউস তখন ১ টা ১৭ মিনিটে লাঞ্চের জন্য বিরতিতে যায়)
হাউস ২ টার সময় আবার বসে। ভাইস চেয়ারম্যান (শ্রী আকবর আলি খান) আসন গ্রহণ করেন।
লোকসভা থেকে বার্তা
The FINANE (No.2) বিল 1971
সেক্রেটারিঃ হাউজকে আমি জানাচ্ছি যে লোকসভার সেক্রেটারি স্বাক্ষরিত নিম্নলখিত মেসেজটি আমি পেয়েছি।
“কার্যপদ্ধতি ও লোকসভায় কার্যচালন এর বিধি ৯৬ এর বিধান অনুযায়ী। আমি এতদ্বারা ফাইন্যান্স (নং ২) বিল, ১৯৭১ লোকসভায় পাস হয়েছে ঘোষণা দিচ্ছি। ৩১ শে জুলাই, ১৯৭১ তারিখে তা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২. স্পিকার নিশ্চিত করেছেন যে এই অর্থ বিল যা ভারতের সংবিধানের ১১০ আর্টিকেল অনুসারে হয়েছে।
স্যার, আমি এটি টেবিলের উপর রাখছি।
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা (উড়িষ্যা)- জনাব ভাইস-চেয়ারম্যান, আমি বরং বলব যে এটা দু: খজনক যে আমরা সংসদে আলোচনা করার সময় এই রেজোলিউশন আসল। এই হাউস বা অন্য হাউসে এবং ভারতে বসবাসকারী প্রায় সকল মানুষ একমত যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। এখন প্রশ্ন হল যেমন জনাব ছাগলা বলেছেন সিদ্ধান্ত সেভাবে হবে নাকি এই অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে করা হবে নাকি সরকারের বলা উপযুক্ত সময়ে হবে সেটা জানা দরকার।
সুতরাং এটা দুই পক্ষের ঝগড়া করার মত বিষয় না। জনাব ছাগলা এবং অন্যান্যরা শুধু না ক্লাস ফাইভ বা সিক্স গ্রেডের ছাত্ররাও জানে বাংলাদেশে কি হচ্ছে, পূর্ববাংলার দুর্বিপাক, ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার বিবরণ। তাই আমি এসব বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে যাচ্ছি না।
স্যার, প্রশ্ন হল সরকার স্বীকৃতি দেবে কিনা। এখন স্যার, একটা কথা প্রচলিত আছে যে আপনারা গণতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারেন না এবং কূটনীতিক ভাবেও না। এটা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। আপনি যদি একটি যুদ্ধ পরিচালনা করতে চান তাহলে তা সংসদে পারবেন না কারণ এখানে কোন সেনাপতিকে স্থানান্তরিত করা বা কোন ব্যাটেলিয়নকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা এসব কিছু সম্ভব না।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: এই একটি সামরিক সিদ্ধান্ত?
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: আমি একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। কূটনীতিতে একটি জনপ্রিয় জিনিস হতে পারে না। আপনি সবকিছু বলতে পারেন না। আপনি আপনার সব মনের কথা প্রর্দশিত করতে পারেন না। দেশের কিছু মানুষ বলছে যে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। স্যার, আমি স্বীকৃতির জন্য বলি, কারণ আমি যখন দেখি যে মুক্তিযোদ্ধারা ভুগছে সেটা আমাকেও ভোগায়। জনাব ছাগলা বলেছেন যে তার চোখ থেকে অশ্রু আসে, আমি তার অবস্থানে থাকলে আমার অশ্রু মুছে শান্ত মন নিয়ে পুরো পরিস্থিতি দেখে একটি সিদ্ধান্তে আসতাম। সরকারকে সব সময় পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। বাস্তবতার মোকাবেলা করতে সরকার কল্পনা প্রসূত কোন ধারনার উপর নির্ভর করতে পারেনা। এসব বিবেচনায় আমি এটি সরকারের উপর ছেড়ে দিতে চাই যাতে উপযুক্ত সময়ে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
শ্রী রাজনুয়াইন: একই জিনিস?
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: আমি আমার বিষয় বিবেচনা করব। এমন না যে আমি ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে বলছি বলে আমি সরকারের সমর্থন করি। এমনকি যদি আমি রাজনারায়ণের সমর্থক হই আমি একই কথা বলতাম। কারণ এটা কোন দলীয় ব্যাপার না। এটা একটি জাতীয় প্রশ্ন। এখন, স্যার, তারা বলে থাকে যে, সরকারের অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে সাহায্য করা উচিত।
তাহলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি এই বিষয়ে একমত। স্যার, স্বীকৃতি মানে, আপনি যুদ্ধের ঘোষণা দেন বা না দেন, পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং আপনাকে মুজিবনগরের সমগ্র বোঝা নিতে হবে -যেখান থেকে সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে – সেক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন যে আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করছেন? নিশ্চই না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যাই হোক না কেন যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি। এমনকি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কি বোঝাপড়া হয়েছে? একটা রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছেছিল যার ফলে তাসখন্দ চুক্তি হয়। আজকাল যেখানেই যুদ্ধ শুরু হয় তা আসলে শেষ হয়না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে কোনো ছাত্র জানে বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্যাটার্ন পরিবর্তনের একটি প্রবণতা এখন চলছে। এটা এমন না যে আমেরিকার ভালোবাসা কমে গেছে। এর কারণ আমেরিকান ডলার জাপানি ইয়েন এবং পশ্চিম জার্মান মার্ক দ্বারা প্রভাবিত। এটা তাদের নিজস্ব অর্থনীতি এবং তাদের আন্তর্জাতিক বাজার রক্ষা করার কৌশল। এখন তারা এশিয়ার বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছেনা কারণ জাপান সেখানে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ইউরোপীয় বাজারের পশ্চিম জার্মানি তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। যুদ্ধবাজ ও পেন্টাগন মনে করে যে, যদি কোন বিশ্বে একটি অরাজকতা বিরাজ করে তাহলে তাদের উৎপাদন ৩০০ শতাংশ বাড়বে যার ১৫০ শতাংশ প্যাসিফিক অথবা আটলান্টিক এ এবং বাকি ১৫০ শতাংশ ডাম্প হবে নিজের দেশে। সকল মৃত্যু ও ধ্বংসের এই বণিকদের সংকোচন ঘটবে কারণ আমেরিকা নিজেও বেকারত্বে ভুগছে। গত আমেরিকান বাজেটে ঘাটতি ছিল। এটা জানা যে ডলারের শাসন সর্বত্র। তবে প্যাটার্ন পরিবর্তিত হচ্ছে। আমি জানি না এটা পরিবর্তন হবে কিনা কিন্তু প্রবণতা শুরু হয়েছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও ভাস্রব পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করে তারপর ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি সরকারকে পরামর্শ দেব তাড়াহুড়া করে কিছু না করতে।
আমেরিকার পরবর্তী খেলা কি? এটা শুধু বিশ্ব আবিষ্কার করা নয় – যেমনটি জনাব বিজু পাটনায়েক আমাদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক মন্ত্রী গিয়েছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে বিশ্ব ঘুরে এসেছেন। হতে পারে যে জনাব বিজু পাটনায়েক আরো নতুন কিছু বের করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন কি হল? আমেরিকা ভয়ঙ্কর ভিয়েতনাম যুদ্ধে হারছে। তারা চীনা বাজার দখল করছে। দ্বিতীয়ত, তারা ঠাণ্ডা মাথায় ভিয়েতনামের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। তারা এটা শান্তিপূর্ণভাবে করতে চায়। কিন্তু পেন্টাগনের যুদ্ধবাজরা নিক্সন প্রশাসনকে শান্ত থাকতে দেবেনা। তারা অন্য কোথাও যুদ্ধ করতে চান। তারা বাংলাদেশে ভিয়েতনাম বানাতে চান এবং যদি আমরা একানে নিজেদের জড়াই তাঁর মানে হবে আমরাও সেই যুদ্ধে জড়িয়ে গেলাম। এই যুদ্ধ এত তাড়াতাড়ি শেষ করা যাচ্ছে না। অতএব, আমি মনে করি যে সরকার সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন এবং জোয়ারের জলের মত আমাদের ব্যক্তিগত মতামত এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে হবেনা। ব্যক্তিগত মতামত একটি সরকার পরিচালনায় সাহায্য করেনা। যা সত্য তা মেনে নিয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থ মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। আমরা আমাদের বন্ধু, জনাব বিজু পাটনায়েক কে অনুসরণ করব না। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি একটি সামান্য নাটক করে হাউস থেকে বেরিয়ে গেছেন। তিনি এখানে এখন নেই। তিনি বলেন, ১৯৬২ সালে তিনি জনাব নেহরু কে উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি বরং বলব যে জনাব পাটনায়েক জনাব নেহরু কে বিপথগামী করেছিলেন এই বলে বলে যে সীমান্তের ওপারে চীনা বাহিনী পর্যাপ্ত ছিল না এবং তার কথার উপর একটি দু: সাহসিক কাজ হলেও হতে পারত। তিনি শুধু যুদ্ধ ও যুদ্ধের কথাই বলেন। কে যুদ্ধ চায়? গরীব মানুষেরা যুদ্ধ চায়না। সমাজতান্ত্রিক, জনাব রাজনারায়ণ যুদ্ধ চায় না। পুঁজিপতিরা যুদ্ধ চায়, শিল্পপতি, গ্যাংস্টার রা – যারা অর্থ বানাতে চায় তারা যুদ্ধ চায়। আমি জানি যে, জনাব বিজু পাটনায়েক এর শিল্প খুব খারাপ অবস্থায় আছে এবং যদি যুদ্ধ হয় তাহলে তিনি পারমিট ও লাইসেন্স এর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করবেন যাতে তিনি ক্ষতি পোষাতে পারেন। এটাই জনাব ভান্ডারী বা জনাব বিজু পাটনায়েক এর আগ্রহের মূল কারণ।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারি: এভাবেই কি আপনি জনাব বিজু পাটনায়েক এর ভাষণ ব্যাখ্যা করলেন?
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: যুদ্ধ, তা বাংলাদেশের জন্য বা অন্য যেখানেই হোক আসলে একটা খারাপ জিনিস। আমি দুঃখিত যে জনাব পাটনায়েক আমাদের সব জেনারেলদের অপমান করেছেন। যদিও স্যার, আমি আপনার মাধ্যমে, এই হাউসে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবময় কাজের জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করি। আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে আপীল করি যে কোন খারাপ সময় আসতে পারে এবং তার পরিণামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যাতে করে মানুষ যারা আমেরিকার ভাষায় কথা বলেন, যারা জনাব রাজনারায়ণের ভাষায় কথা বলেন তারা তাদের অবস্থান জানতে পারবেন। আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে গর্বিত। তারা ১৯৬৫ সালে ভাল লড়েছে, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভাল করেছে। আমি স্বীকার করি যে আমাদের জেনারেলরা প্রস্তুত নয়। আমি জানি যখন জনাব পাটনায়েক বলেন যে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং চার বছর ধরে তিনি জেলে ছিলেন। কিন্তু ছাড়া পেয়ে কিভাবে তিনি এত বড় শিল্প গড়েন এবং কোটিকোটি টাকা কিভাবে বানালেন? এছাড়াও, শোনা যায় ১৯৬৫ সালে সালে তার মালিকানাধীন একটি বিমানও ছিল। যখন পণ্য নিয়ে জওয়ানদের উপর ফেলার কথা ছিল তখন তিনি অন্যত্র ফেলেছেন। শ্রী মঙ্গেশর প্রসাদ শাহী (উত্তরপ্রদেশ)। তিনি কংগ্রেসে ছিলেন।
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: তিনি সে জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করে, তাহলে আমি তাকে রেহাই দেবনা।
শ্রী রাজ নারায়ণ – কোণ কোণ মন্ত্রী কত কামিয়েছেন, কত খেয়েছেন, কত লাইসেন্স নিয়েছেন এখানে তার বিবরণ দেয়া হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলুন।
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: আপনার মাধ্যমে আমি জনাব রাজনারায়ণ কে বলতে চাই আপার জীবন একটি খোলা বই এর মত। বিশ বছর ধরে আমি রাজনীতিতে আছি। যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে আমি একটি পয়সা অসৎভাবে করেছি, তাহলে আমি শুধুমাত্র এই হাউজ থেকে নয় রাজনীতি থেকে পুরাপুরি অবসর নেব। আমার জীবন একটি খোলা বই। এমনকি যদি জনাব ওম মেহতা, আগামীকাল কোণ ভুল করেন এবং যদি এটা আমার নজরে আসে, আমি জনাব ওম মেহতা কে অনুরোধ করব এবং আমিও সেটা যুক্ত করব। আমরা আমাদের জীবন ও দেশের একটি পর্যায়ে এসেছি। আমরা কোণ পুরানো কৌশল নিচ্ছি না। আমরা একটি পরিষ্কার এবং ভাল এবং একটি দক্ষ সরকার চাই। যাতে আমরা আমাদের লক্ষ্যের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারি। জনাব বিজু পাটনায়েক আরেকটি অভিযোগ করেছেন। আমরা গেরিলা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
শ্রী সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারী – এখানে কি বিজু পাটনায়েক – এর যোগ্যতার উপর বিতর্ক চলছে?
ভাইস চেয়ারম্যান (শ্রীআকবর আলি খান): আপনি পরে সুযোগ পাবেন।
শ্রী সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারী – আপনি যদি বিজু পাটনায়েকের উপর বিতর্ক অনুমোদন করেন তাহলে আমিও তার বিপক্ষে অনেক কথা বলতে পারি।
শ্রী ব্রমানন্দ পান্ডা: জনাব ভান্ডারী, তুমি আমার উপর আস্থা রাখুন। আমি তার পয়েন্ট এর জবাব দিচ্ছি। আমি অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলছিনা। তিনি আরেকটি অভিযোগ করেছেন যে আমাদের সীমান্তের ভিতরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আছে। এখানে আমরা গেরিলাদের ট্রেনিং দেই ও দেশে পাঠাই। স্যার, এটা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। অমূলক। সেখানে সীমান্তে আমাদের দিকে কোন শিবির নাই কিংবা আমরা সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে যুদ্ধবিগ্রহের সাথে জড়িত না। এটা তাদের যুদ্ধ, তারা যুদ্ধ করছে। যদি কেহ বলে যে আমাদের সীমান্তের ভিতরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আছে এবং আমরা সেখানে মানুষ ট্রেনিং দিয়ে পাঠাই। আমি বিনীতভাবে বলতে পারি যে, তিনি ইয়াহিয়া খানের ভাষায় কথায় কথা বলছেন। তার কথায় ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় না। আমি বলতে চাই যে তারা তাদের নিজেদের যুদ্ধ নিজেরাই করুক। এবং তারা তা করছেন। শুধুমাত্র আমরা অনুভব করছি যে তারা দুর্বল।
স্যার, কিছু সন্মানিত সদস্য বলেছেন যে স্বীকৃতি দিলে কিছু সমস্যা আছে। তখন চীন কি করবে? যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে আমাদের দেশ কি করবে? আমি বলতে চাই যে, আমরা একটি জাতি। আমরা পৃথিবী থেকে আলাদা কোণ ছোট দ্বীপ না। আপনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন তাহলে তা ভালোই হবে। আপনাকে বাস্তবতা বুঝতে হবে। আপনাকে জানতে হবে কোথায় কখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে আপনার বন্ধুরাই আপনার শত্রু। সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক জটিলতা কি হবে? সেগুলো ভুলে গেলে চল্বেনা। এজন্যই আমি আমার ভাল বন্ধু জনাব মুখার্জিকে বলছি, অধৈর্য হবেন না। আমি বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অনুভূতি জানি। তিনি আমার চেয়ে নিবেদিত ও আন্তরিক এবং কারণ তিনি একই সংস্কৃতি ও ভাষার মানুষ।
শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু (পশ্চিমবঙ্গ); এটা তার নিজের কোণ বিষয় না।
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: ব্যক্তিগতভাবে এবং স্বতন্ত্রভাবে, আমি বরং তাকে ধন্যবাদ দেব। কিন্তু এসব কিছু ফ্লোরে খোলাখুলিভাবে আলোচনার বিষয় না। যখন এমন একটি রেজোলিউশন আসে যেটা বিতর্ক সৃষ্টি করে তখন বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ এর পক্ষে বলবে, কেউ বিপক্ষে। এবং এতে যুদ্ধের আদর্শ কমবে না। মনোবলও কমবে না – যারা গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছে। সুতরাং, আমাদের এই আলোচনা করা উচিৎ যে সরকার এর কাছ থেকে কি পাওয়া যায়। আমি বলিনা যে, মন্ত্রিসভায় তারা সবসময় ভাল সিদ্ধান্ত নেন এবং জনাব রাজনারায়ণের চেয়েও জ্ঞানী মানুষ সেখানে আছে। সরকার সব সময় বাস্তবতার উপর নির্ভর করেই কাজ করবে। আমরা সংবাদপত্র থেকে নির্দিষ্ট তথ্য জানতে পারি। অন্য জায়গা থেকে কিছু জানতে পারি। আমরা এসব বিশ্লেষণ করে উপসংহার টানতে পারি। কিন্তু তারা সেই মানুষ যারা বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করছেন। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবেন তারা যুদ্ধ চান নাকি স্বীকৃতি।
শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু: সংসদ ওভাররুল্ড করা হল।
শ্রী ব্রহ্মমানন্দ পান্ডা: আমি বলছি না যে সংসদ ওভাররুল্ড হল। আমি আপনার মতই একজন সংসদ সদস্য।
শ্রী কল্যাণ রায়: আপনি বরং আরও ভাল।
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: অনেক কিছু আছে। আমি রিপোর্ট করতে চাই না।
শ্রী জগদীশ প্রসাদ যাদব – (বিহার) যখন হতে আপনি সারেন্ডার করেছেন তখন হতে আপনার ভাষা বদলে গেছে।
শ্রী ব্রহ্মমানন্দ পাণ্ডা – ভাষা তো ঠিক ই আছে, আপনার দেখা ও শোনার ভুল।
কেউ যদি বলেন যে, আমরা মুক্তি ফৌজ দের জন্য সীমান্তে প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করেছি তাহলে আমি তার কথা খণ্ডন করব।
ভাইস-চেয়ারম্যান (শ্রীআকবর আলি খান): আপনাকে ধন্যবাদ।
শ্রী ব্রহ্মানন্দ পান্ডা: কিছু বন্ধু অতীতের ইতিহাস তুলে হাউসের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু আমার জন্য অতীত হল ভবিষ্যতের ইতিহাস গড়ার মাধ্যম। আমার বন্ধুরা ইতিহাস থেকে অনেক কিছু উদ্ধৃত করেছেন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতের চেহারা বদলে দিতে পারি। আমাদের রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ এবং আমাদের জ্ঞান দিয়ে আমরা এই প্রাচীন গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারি। ভারত একটি মহান দেশ। আমি কখনই বলব না যে আমরা একটি মহান দেশ না। আমি এটা নিয়ে গর্বিত। আমরা একটি মহান দেশ, এবং আমরা সবসময় ইতিহাস তৈরি করতে উন্মুখ। এবং আমরা পিছনে পরে থাকিনা। আমাদের নিজস্ব ইতিহাস আছে। আমরা আমাদের ইতিহাস তৈরি করছি। আসুন ইতিহাসের দিকে একটু ভিন্ন ভাবে তাকাই।
ভাইস-চেয়ারম্যান (শ্রী আকবর আলি খান): আপনাকে ধন্যবাদ।
শ্রী ব্রম্মানন্দ পান্ডা: আসুন জনগণ হিসেবে আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই। ক্যাপিটালিস্ট, মহারাজা এবং সৌদাগর হিসাবে নয়।
অতএব, স্যার সরকার যেহেতু উভয় হাউস ও দেশের মানুষের অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন তাই তাদের বাস্তবতা বিবেচনায় আনা উচিৎ।
আবার, শেষ করার আগে, আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কে ধন্যবাদ জানাই তাদের গৌরবময় অর্জনের জন্য। আমি তাদের যে কোনো সময়ে তৈরি হওয়া বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলি। কারণ তারা আমাদের স্বদেশ এবং সীমানা রক্ষার জন্য প্রস্তুত। তারা আমাদের দেশের আসল মানুষ।
বিরোধী দলের নেতা (শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী): জনাব চেয়ারম্যান, স্যার, আমি বিতর্ক সাবধানে শুনেছি এবং অনেক পয়েন্ট আমার বন্ধুরা উল্লেখ করেছেন। অতীতে আমরা এ বিষয়ে অনেক দরকারী আলোচনা করেছি। আমি অবাক হচ্ছি, স্যার, গতবারের সাথে এইবারে সরকারের মনোভাবে তেমন কোণ পরিবর্তন না দেখে। যদিও এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভারত সরকারকে দেখছি চুপ করে বসে থাকতে। এবং তাদের মুখের ওপর আমি আলস্য দেখতে পাচ্ছি। আপনারা যদি এছাড়া অন্য কিছু দেখেন আমাকে জানাবেন।
স্যার, জাতি এক ক্লান্তি লগ্নে দাঁড়ানো। খুব বিরল মুহূর্ত যা ফিরে আসবেনা আর। আমার মতে, স্যার, এই ধরনের মুহূর্ত মার্চ মাসে এসেছিল। ২৫ মার্চ। যখন মুক্তিযোদ্ধা দের জনপ্রিয় নেতা, তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখন ভারত সরকারের একটি দরকারী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম যে, সরকার বাংলাদেশে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা পালন করবে। আমি ভেবেছিলাম তারা হবে স্বাধীনতার স্থপতি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমি মনে হচ্ছে তারা বাংলাদেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সমাধিফলক লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। স্যার, আমি আগেই বলেছি, বিরল সুযোগ খুব কমই আসে। এবং ভারত সেই সুযোগ হারাচ্ছে।
ভারত সরকার যদি সঠিকভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে, প্রজ্ঞা ও সাহস ও দূরদর্শিতা দেখায় তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাকে ভারত সরকারের সাড়া দিতে হবে। ভারত সরকার যদি স্বীকৃতি দিট তাহলে তা স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে যেত। স্যার, এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ, এবং এই বিরল সুযোগ এখন আমাদের হাত থেকে সরে যাচ্ছে। স্বীকৃতির ফলে অভাবনীয় পরিবর্তন আস্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে যে নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে সেটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। এটা ঠিক যে, ভ্রাতৃপ্রতিম গোষ্ঠী ও জাতির সহানুভূতিশীল সাহায্য ছাড়া কোন স্বাধীনতা সংগ্রামের সফলতা দ্রুত আসেনা। তাই এক রকম মানসিকতার দেশগুলোর উচিৎ সেই পরিস্থিতে এগিয়ে আসা। আমি এই সরকারের কাছে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করি তারা তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করেছে কিনা। আমাদের দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সরকার এখনও স্বীকৃতি দিতে দেরি করছে। জনাব শরণ সিং স্বীকৃতির বিরোধিতা করেন নাই। আবার পক্ষেও নাই। এটা খুব অশ্চর্য অবস্থা। এই হাউস এমন একটি অবস্থায় আছে যেখানে কোণ ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। সরকার যদি বলে যে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে নাই অথবা স্বীকৃতি দেব না তাহলে বলব সরকার হ্যামলেটের চরিত্রে অবতীর্ন। স্যার, আপনি কি জানেন হ্যামলেট কি করেছিলেন? করব নাকি করব না। সরকার আজ ঠিক তেমন অবস্থায় আছে। তাদের শক্তি আছে। ক্ষমতা আছে। আমি নিশ্চিত।
শ্রী শংকাঙ্ক শেখর সান্যাল (পশ্চিম বালা): সরকার খুব ভাল করতে জানে কি করতে হবে বা হবেনা।
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী – তারা সুযোগ পেয়েছে কিন্তু সরকার তাদের পক্ষ থেকে কোন সচেতনতা দেখাচ্ছেনা। বাস্তবতার কোন উপলব্ধি নেই। তারা জানে না যে সুযোগ তাদের হাত থেকে সরে যাচ্ছে। তারা সত্যি বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সুযোগ থাকবে। এটা তাদের দ্বিধা নাকি তাদের দোদুল্যমানতা তা জানিনা। তাদের এই বিলম্বের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সরকার বলছে যে বাংলাদেশ ইস্যু তার একার নয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। এটা তারা ভুল করেছেন। প্রাথমিকভাবে এটা আমাদের ও তাদের যৌথ সমস্যা। এই মিথ্যা অবস্থান থেকে তারা নিজেদের ন্যায্যতা যাচাই করে তাদের প্রতিনিধিদের অন্য দেশে পাঠাবে। সিদ্ধান্ত না নিয়েই তারা বিদেশে ভ্রমণ শুরু করেছেন। তারা এটাকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু বানিয়েছেন। কিন্তু ফল কি? আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসাবে দেখিয়ে অন্যান্য ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ঘুরিয়ে দিতে পারতাম। যখন বলা হবে এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, তখন অন্য সরকারগুলো স্বাভাবিকভাবেই খুশি হবে এবং তারা হস্তক্ষেপ করতে পারবে বলে অনুভব করত। তারা অনেক কিছু সুপারিশ করতে পারত। এখন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে পর্যবেক্ষক দল পাকিস্তান ও ভারত এর বর্ডারে পাঠানো হবে। আমরা এটার বিরোধিতা করেছি। তারা কি বুঝতে পারেনি যে উচ্চ ক্ষমতার দেশগুলো আমাদের পাত্তা দেবেনা? সোভিয়েত ইউনিয়ন উপমহাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে আগ্রহী নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে আগ্রহী নয়, আর চীন কিংবা আরব বিশ্ব, কিংবা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ, কিংবা জাপানও নয়। এটাই বাস্তবতা। তারা ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে চায় না। তাই তারা যায় না যে পাকিস্তান সমস্যায় পরুক। তারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করছে। এটা কি আমাদের আগে থেকে জানা নাই? আমাদের অনেকেই আগে বলেছেন যে আমরা অসহায় মানুষর মত দেশে দেশে সাহায্য চাইতে যাবনা। আমার ধারণা আমরা যদি আরও ৩ মাস আগে যখন বাংলাদেশ সংগ্রাম শুরু হয় তখন যদি স্বীকৃতি দিতাম তাহলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো যেত এবং এত শরনার্থি আসতো না। আমাদের নিজেদের ভুলে উদ্বাস্তুরাএসেছে। বরং তারা যোদ্ধায় পরিণত হত। এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করতে হবে। পুরো দেশ বিপদে আছে। তারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভুলের জন্য আজ এমন হয়েছে। পুরো জাতী আজ ভুগছে। সরকার বোকার মত বসে আছে। তাদের রাজনিতিক কৌশল ভুল। যদি না তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবাত ব্যাপারে মানসী প্রস্তুতি নেয় নি।
কুমারী শান্তা ভাসিত(দিল্লি): আমাদের শিল্প ধ্বসে হয় যাচ্ছে। এবং অর্থনীতিও ধ্বসে যাচ্ছে। একটি যুদ্ধ কি তা পূরণ করতে পারবে?
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী বক্তৃতায় আমি একটি কথা বলেছিলাম। আমি সেটি আবারো সন্মানিত মহিলা সদস্যের জন্য বলছি। আমি বলেছিলাম যুদ্ধ না ঘোষণা করেই পাকিস্তান আমাদের উপর বিশাল বোঝা সৃষ্টি করতে পেরেছে। এটা একটা সত্য নয়? আমার মনে হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা নিষ্ক্রিয় থাকার চেয়ে অনেক ভালো হতো। কারণ যুদ্ধ ছাড়াই আমরা যুদ্ধের বোঝা টানছি। এই দুঃখজনক পরিস্থিতিতে আজ আমরা আছি। এটা কি সত্য নয়? এর ফলে আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভয়ানক অর্থনৈতিক ধস নামতে পারে। একটি সুযোগ ছিল। কিন্তু আজ কী হচ্ছে? আগামীকাল কি ঘটবে? আমার নিজের একটি পূর্বাভাস বলি – যদিও চাই তা যেন কখনো না হয় – সেটা অল এই সম্পূর্ন এলাকা অস্থির হয়ে উঠবে এবং চরমপন্থীরা পুরো এলাকা দখল করে ফেলবে। উদ্বাস্তু দ্বারা সৃষ্ট অর্থ নৈতিক বোঝা প্রচণ্ড ভয়াবহ আকার নেবে। এটা ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ও ভারত সরকার তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্য অর্থনৈতিক পতনের প্রস্তুতি নিতে পারেন। তারা বলবে: “ওহ!” এখানে তো উদ্বাস্তু আছে তাই আমরা উন্নয়ন করতে পারিনি। প্রবৃদ্ধি হয় নি। ধরণের ছুতো দেয়া গ্রহণযোগ্য হবেনা।
আমি এই প্রশ্ন রাখি। আমাদের সামনে বিকল্প কি? আসুন এটা মোকাবিলা করি। আমাদের ৭৫ লাখ শরনার্থি আছে এবং এটা কালক্রমে আরও ১০ মিলিয়নের পৌঁছাবে। তারা কি এই উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠাতে চান? আপনি কি মনে করেন তারা আশু ভবিষ্যতে সক্ষম হবে? এটা কি সরকার ভাবছে যে মুক্তি বাহিনী তাদের কর্তৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর উপর প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং দেশকে দখলমুক্ত করতে পারবে? যদি তাই বলেন তবে আমি দুঃখিত আমি এসব কথার সাথে এক মত হতে পারলাম না। ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী মুক্তি বাহিনীর থেকে অনেক শক্তিশালী। তাদের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আছে। বড় বড় ক্ষমতাশালীরাও এখানে জড়িত। সরদার শরণ সিং অসম্পৃক্ততা নীতি অনুসরণ করছেন। সত্য এটাই যে এখানে বিশাল ক্ষমতাশালীরা জড়িত, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পৃক্ততা আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসেনি এবং বলেনি যে তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি আছে।
শ্রী কল্যাণ রায়: হ্যা আছে।
শ্রী এম এস গুরুপরদ স্বামী- তারা শুধুমাত্র গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছে। আমেরিকানরা ইতিবাচক সাহায্য প্রদান করেছে। চীন অস্ত্র সরবরাহ করছে। বেশ কিছু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সক্রিয়ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের সহযোগিতা করছে। এই অবস্থায়, আপনি কীভাবে আশা করেন যে মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করবে? আমি এমন মনে করি না। যদি কেউ তা বলে তবে তা হবে হঠকারী। আমি মন্ত্রীর সামনে এই প্রশ্ন রাখছি। আপনি কি মনে করেন যে উদ্বাস্তুরা ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছরের মধ্যে ফিরে যাবে? তাদের যদি ফেরত পাঠানো হয় তাহলে তারা কীভাবে তা মেনে নেবে? তারা বলছে বাংলাদেশ ইন্দো-পাকিস্তানী কোন ঘটনা নয়। এটা কি সত্যি ইন্দ-পাকিস্তানী ইস্যু নয়? আপনি অস্বীকার করতে পারেন। আপনি কি পাকিস্তানের প্রভাব অস্বীকার করছেন না? পাকিস্তানের সাথে কি কোন ঝামেলাই নেই? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জানিয়েছেন বর্ডারে সৈন্য দেয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে ভারতী সৈন্যরা নিশ্চই জয়ী হবে আপনি কি মনে করেন পাকিস্তানীরা তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য উসকানি দেবে? এটা তাদের আগ্রহের বিষয় না। কেন তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দেবেনা?
শ্রী ব্রহ্মানান্দা পাণ্ডা – একটু স্পষ্ট —
শ্রী এম এস গুরুপদ স্বামী –
আমি হার মানি না। আমি আমার নিজের বিশ্লেষণ দিচ্ছি। পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে না। আমাকে বিশ্বাস করুন। ছোট আকারের বিচ্ছিন্ন লড়াই এখানে সেখানে হতে পারে। কেউ কেউ সীমান্তের ভারতীয় অংশে মৃত্যুর পরিসংখ্যান দিয়েছে। কিন্তু আমি বলছি কোন সাধারণ যুদ্ধ হয়নি। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেনা। কেন করবে? বাংলাদেশ তাদের জন্য সহজে অবস্থান করার মত একটা এলাকা। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সেখানে কোন সমস্যা নেই। জানা যায় কিছু কিছু অঞ্চলে মুক্তি বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে হয়রান করছে। তাদের কোন খাদ্য সরবরাহ নাই। ফলে তারা অনাহারী থাকছে। এই সব কি বিশ্বাস হয়? স্যার, আর্মি কে আগে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। এখানে ভুক্তভোগী মানুষ আছে। কতদিন এভাবে চলবে? বেশিদিন না। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল খুব বেশী।
একজন মাননীয় সদস্য: এটা অনেক বেশী।
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: আমি স্বীকার করি। কিন্তু এটা কি এত উঁচু যা তাদের শেষ বিজয় অর্জন করতে সক্ষম করে? আমি এটা বিশ্বাস করি না। অতএব, স্যার, প্রশ্ন হল: কি কৌশল, কি নীতি, কি মনোভাব আমাদের গ্রহণ করা উচিত? প্রথমত, বাংলাদেশ বাহিনীর সাহায্য লাগবে এবং দ্বিতীয়ত শরণার্থীদের ফিরে যাবার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে অসহায়ত্ব ছাড়া কোন উত্তর নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হল পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বোঝাপড়া ছাড়া আমাদের জন্য কি আর কোন বিকল্প নেই? আমি যুদ্ধবাজ নই। কিন্তু আমাদের বিকল্প কোথায়? আপনি কি বলতে পারবেন যে সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে কোন নিষ্পত্তি সম্ভব? আপনি বলতে পারেন যে শরণার্থীরা ফিরে যাবে? আমি বিশ্বাস করি না। তাই, স্যার, এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। রেজল্যুশন বলছে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের স্বীকৃতি দেয়া উচিত। আর স্যার ইতিমধ্যে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে এবং সময় আমাদের শত্রু। আমরা ইতিমধ্যে সুযোগ মিস করেছি। আমি জানি অন্য দিকে এক বন্ধুর একটা সংশোধনী আছে। সংশোধনী বলে যে সরকার উপযুক্ত মুহূর্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু সেই উপযুক্ত সময় আসলে চলে গেছে এবং আর আসবেনা।
স্যার, সম্ভবত জনাব শরণ সিং তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেবেন।
শ্রী কল্যাণ রায়: তিনি সেই কাজ করবেন যা চেকোস্লোভাকিয়া করেছিল।
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: হ্যা, সম্ভবত বাংলাদেশের মৃত্যুর পর তারা স্বীকৃতি দেবে। এই অর্থে সেই স্বীকৃতি হবে যে আমরা কোন এক সময় বাংলাদেশে আন্দোলন হয়েছিল এবং বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি আর্মির নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে করেছিল এবং শেসে মারা গিয়েছিল।
শ্রী কল্যাণ রায়: বীরত্বের সাথে ….
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: …………….. বীরত্বের সাথে, যেমনটি আমার বন্ধু বললেন। আমরা একটি স্মারক স্থাপন করব বা একটি সমাধিফলক লিখব বাংলাদেশের জন্য। সেটাই করতে হবে। ধন্যবাদ স্যার।
শ্রী সুন্দর সিংহ ভান্ডারী (রাজস্থান) উপসভাপতি মহোদয়, শ্রী প্রণব কুমার বাবু একটি বেসরকারী প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাপারে এই সংসদে আলোচনার অবকাশ দিয়েছেন। নতুন লোকসভা গঠন হয়েছে এবং অধিবেশন শুরু হয়েছে, তখন থেকে বাংলাদেশের প্রশ্নটি আলোচোনার বিষয়বস্তু রয়েছে। যে প্রস্তাবের উপর আমরা ৩১শে মার্চ বিতর্ক করেছিলাম এবং যেটি পাশ হয়েছে, ঐ প্রস্তাবও সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যদের পারসস্পরিক আলাপ-আলোচনার ফলশ্রুতি। বাংলাদেশের প্রশ্নে বিতর্ক উত্থাপনের জন্য প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তখন সরকারের পক্ষ হতে বলা হল যে পৃথক পৃথক প্রস্তাব আনা উচিত হবে না। আমরা কি একত্রে বসে এ প্রশ্নের একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আনতে পারি না? এই পারসস্পরিক আলোচনার ফলেই উভয় সভায় প্রস্তাব পেশ করার জন্য সয়ং প্রধাণমন্ত্রীর ওপর ভার অর্পন করা হয় যাতে এই প্রস্তাব কোন সংশোধন ও বিতর্ক ছাড়াই অবিস্মবাদিতভাবে উভয় সভায় গৃহীত হয়। এই প্রশ্নে আমরা একটি জাতীয় সিদ্ধান্ত নিলে মিলেমিশে চলতে পারা যেত। এখন একক সিদ্ধান্তে পৌছানোর পর এই আওয়াজ উঠেছে যে এরপর সামনে চলার চূড়ান্ত ক্ষমতা শুধুমাত্র সরকারী পক্ষের ওপর ন্যস্ত করা হোক, অন্যান্যরা এতে হাত না বাড়াক। সরকার পক্ষই শুধু নয়। সমস্ত সংসদের অনেক সদস্য এব্যাপারে চূরান্ত ক্ষমতা প্রধাণমন্ত্রীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আগ্রহী আমি এটা বুঝি না। এমন গুরুত্বপূর্ন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করা হবে না। ৩১শে মার্চে আমরা যে প্রস্তাব নিয়েছি সে মোতাবেক সামনে অগ্রসর হতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। সরকারদলীয় একজন সদস্য প্রস্তাবে এই সংশোধন এনেছিলেন যে, স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ সরকারের ওপর ছেড় দেয়া হোক। বন্ধুবর শ্রী ব্রম্মানন্দ মহাশয় ভাষণ দানকালে বলেছেন, আমরা প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়েছি, স্বীকৃতি দেয়া হবে কি না এসব ব্যাপারে মীমাংসা সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া হোক।
শ্রী ব্রম্মানন্দ পান্ডেঃ না, আমি এমন করে কিছু বলিনি।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারীঃ রেকর্ড পুনরায় শোনার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।
শ্রী ব্রম্মানন্দ পান্ডেঃ আমি বলেছি, যথাযথ সময়ে স্বীকৃতির দেয়ার দায়িত্বটুকু সরকারের হাত ছেড়ে দেয়া হোক।
শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারীঃ স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়া যে শব্দই ব্যবহার করেন না কেন, তাও ভালো যে আপনি আপনার বক্তব্য ফিরিয়ে নিয়েছেন।
শ্রী সুন্দর সিংহ ভান্ডারী: আপনি হয়ত ভুলে এই শব্দটি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু যা ভুলে বলেছেন সমগ্র দেশের মানুষের মনে আজ তাই আশঙ্কা উদ্রেক করেছে। স্বীকৃতি কখন দেয়া হব আজ এ চিন্তা মানুষের মনে তত বেশী নয় যতটা এই যে, স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা, যেমন জনৈক মাননীয় সদস্য তার বক্তৃতায় খুব জোরের সাথেই বলছেন যে, তার সন্দেহ হচ্ছে সরকার এখন হয়ত পিছুটান দিতে যাচ্ছেন। এ কারণেই এই প্রশ্ন আজ দেশে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। এখন এ কোথাও বলা হচ্ছে যে, এই ইস্যুতে দেশ ভাগ করার প্রয়াস চলছে। এতে কোন সন্দেহ নাই যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে যে রাষ্ট্রীয় ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যা সবার সম্মিলিত প্রস্তাব ছিল সরকার যদি এর আলোকে অগ্রসর হতে কুন্ঠিত হন বা পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব করেন যার ফলে ওই প্রসঙ্গ শেষ হয়ে যায়, তাহলে সারা দেশ এর ওপর প্রস্তাব পাশ করে বসে থাকবে এবং অপেক্ষা করা দেশের জন্য শোভনীয় হবে না। আমরা যদি বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই তাহলে সরকারকেও তার হঠকারিতা ত্যাগ করতে হবে, দেশের অভ্যন্তরীণ সবকিছু উপেক্ষা করে সরকার সমস্ত দেশের সমাধানের যে ঠিকা নিজের উপর নিয়েছেন এটা ছাড়তে হবে ভারতে কল্যাণে কি আসবে বাংলাদেশের কল্যাণে কি আসবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে অধিকতর ওয়াকিফহাল আপনারা হতে পারেন, কিন্তু অবশিষ্ট সকল মানুষ অন্ধকারে আছে, তারা দেশের কল্যাণ বুঝতেই সক্ষম নয়, সবকিছু উপলব্ধি আপনারাই করতে পারেন, আমরা আপনাদের অধিকার মেনে নিতে প্রস্তুত নই। এটি একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। এদেশের শাসন ভার আজ যদি আপনাদের বৈধ উপায়ে অর্জিত হয়ে থাকে তবে এর অর্থ এই নয় যে, দেশের অন্য সব লোক এর কল্যাণ সাধন কিংবা এর নীতি নির্ধারণ নিজের চিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করার দায়িত্ব হারিয়ে ফেলেছে। সকল দায়িত্ব নিজ নিজ সরকারের মনে করা হোক বা ব্যক্তিবিশেষের মনে করা হোক, কিংবা নিজের দলে মনে করা হোক না সে দলের দায়িত্ব ব্যক্তিবিশেষের ওপর – এ সকল দায়িত্ব আপনাদের ঘরের হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে আপনারা সকল দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে অন্যদের অন্ধকারে রেখে এদেশে ঐক্য বজায় রাখতে পারবন না। এ ব্যাপারে আমার আশঙ্কা রয়েছে। আমি চাই না, এই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নে কোনপ্রকার বিভেদ সৃষ্টি হোক বা মতদ্বৈধতা হোক। কিন্তু এ জন্যশুধু অন্যদের দোষারোপ করলে চলবে না।
এ প্রশ্নে কেন বিলম্ব হচ্ছে সরকার তার কোন কারণ দেখাতে পারছেন না। এই বিলম্ব্র দরুন যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা দুনিয়া দেখছে, ভারতের প্রতিটি মানুষ দেখেছেন। আমার পূর্ববর্তী বক্তাগণ একটি বিষয়ের দিকে ঈঙ্গিত করেছেন যে, অন্ততঃপক্ষে স্বীকৃতিদানের আশ্বাস না দেয়ার দরুন উদ্বাস্তুদের সংখ্যা নিরন্তর বেড় চলেছে। কোন ব্যাক্তি এজন্য আশ্বস্ত হতে পারছেন না যে স্বীকৃতি দেয়ার পরও দেশে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এইরুপ হতো। আমি বুঝতে পারছিনা, যদি সরকার স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাহায্য চাইতো, তারা সাহায্য করতে ততপর হতো, তবু এই ৮৫ লক্ষ লোক যারা উদ্বাস্তরূপে এসে পড়েছে তাদের সংখ্যা অনুরুপ হত। সরকার এখনো বলছেন, প্রতিদিন ৫০ হাজার লোক আসছে। পুনর্বাসন মন্ত্রীর বিবৃতি অনুযায়ী এই সংখ্যা কোটির কোঠা ছুঁতে পারে, এজন্য আমরা এ প্রশ্নে কোন মীমাংসায় আস্তে চাইছি না, আমরা অপেক্ষা করছি আর উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আমাদের পদক্ষেপ না নেয়ায় এই সরল পরিনতি আমাদের দেশের ওপর পড়েছে। এটি এরূপ প্রত্যক্ষ যে, যে কেউ এটি দেখতে পারে। বহির্বিশ্বের মতের প্রশ্নে যতদুর বলা যায় আমরা তা অর্জনের চেষ্টা করছি। সরকারর ভাষ্য হচ্ছে, সারা বিশ্বে আমাদের প্রতিনিধি গেছে এবং বারবার এই উত্তর দেয়া হয়েছে যে, আমরা আশা করি ভারতের বিষয়টিকে তার খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। তারা যদি বুঝতে আরম্ভ করেন তবে খুব ভালো কথা, কিন্তু তারা বহির্বিশ্বে এবং জাতিসংঘে যে কাজ করেছে তাতে এ কথার পরিপুষ্টি হয় না। জাতিসংঘে এ প্রশ্নে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ভারত ও পাকিস্তানে পর্যবেক্ষন পাঠানোর জন্য আলোচনা ও প্রস্তুতি চলছে। ভারতে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রেরণের বিষয়টি কিভাবে সৃষ্টি হলো। আমি বলছি, আমরা কখনই মেনে নেবো না। কিন্তু এ আলোচনা শুরু হলো কিভাবে? একদিকে আমরা উপলব্ধির কথা বলছি, একদিকে আমরা বলছি যে, বহির্বিশ্ব কর্তৃক এ সমস্যা উপলব্ধির প্রয়োজন আর অন্যদিকে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতে পাঠানোর কথা চলছে। ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান বের করা উচিত। বিশ্বের যে সব রাষ্ট্র রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছে, আমি সরকারের কাছে জানতে চাই, কোন আন্তর্জাতিক শক্তি এ কথা স্পষ্ট করে বলেছে যে ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে থাকতে এটি তার অন্তর্গত রয়েছে, এরূপ হলে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হোক এবং সরকার এটি পরিষ্কারভাবে বলুন। আমি মনে করি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যে আলোচনা চলছে তাতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতকে দুটি পক্ষ ভেবে আসছে। আমরা বাংলাদেশের প্রশ্নটি কিভাবে বুঝিয়েছি, আমরা কি বলতে গিয়েছি এ প্রশ্ন সাম্প্রতিক সফরের কি প্রভাব পড়েছে।
এই সফরের ফলে অবশ্যই মানুষের মধ্যে উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে কিছুটা সহানুভুতি জেগেছে। তাদের জন্য ঔষধ ও খাদ্য এসেছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে হয়ত আমরা কিছু সাহায্যও পেয়েছি। আর হয়ত এরূপ কিছু সাহায্য আমরা পাব কিংবা সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে কিছু বলা যায় না কিন্তু যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন বিদ্যমান সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের কথাবার্তা বিষয়টিকে কোনভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যার দরুন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হচ্ছে না।
বাংলাদেশেকে আমরা স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের যুদ্ধ বাধাবার একটি কারণ সৃষ্টি হবে এই বিতর্ক বারবার উত্থাপন করা হয়। আমি বুঝি না পাকিস্তান আমাদের স্বীকৃতির প্রশ্ন নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য অপেক্ষা করছে। পাকিস্তান পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে বাংলাদেশের কোনও অংশ যদি এমন হয়ে যায়, যেখানে পাকিস্তানী সৈন্যের প্রবেশ অসম্ভব হয়ে পড়ে কিংবা কোন অংশ যদি স্বাধীন হয়ে যায় তবে তার দায় দায়িত্বও ভারতের। এই ভিত্তিতে পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষনার অধিকারী হয়ে যাবে। এই ঘোষণা সে করে রেখেছে। সুতরাং আমরা যদি স্বীকৃতি না দেই তাহলে পাকিস্তান যুদ্ধ বাধাবে না আর যদি স্বীকৃতি দেই তাহলে যুদ্ধ বাধাবে এমন কোন কথা নেই। আমর জিজ্ঞাসা স্বীকৃতির ব্যাপারে এত বিলম্ব কেন? এটা কি এজন্য যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী নিজেরাই স্বাধীনতা যুদ্ধ করে নিজেদের দেশ স্বাধীন করবে, কিন্তু এই স্বাধীনতার দায়-দায়িত্ব পাকিস্তান ভারতের ওপর আরোপ করতে চাচ্ছে। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাবার কোন ছুঁতো পাচ্ছে না। তার জন্য আপনারা কতদূর নিজের দিক রক্ষা করা চলবেন। এখন একটি পথ মাত্র খোলা আছে, মুক্তিযোদ্ধা যাতে পাকিস্তানে কোন এলাকা মুক্ত করতে না পারে, এটা এজন্য যে, ভারত তাকে সে এলাকা মুক্ত করে দিয়েছে এবং যেহেতু ভারত সে এলাকা মুক্ত করে দিয়েছে সেজন্য পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করার পূর্ন অধিকারী পাকিস্তান এই অজুহাত দেখাতে সক্ষম না হয়। আমি মনে করি এরূপ বিতর্কে নেমে আমরা নিজেদেরকেই প্রতারনা করার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশের প্রশ্নে আমাদের প্রতিবেশীর প্রশ্ন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তু আজ ভারতের ভূ-খণ্ডে। তারা কেন ভারতে এসেছে? বাংলাদেশের অন্য প্রান্তে, খুব কাছাকাছি, বার্মায় কেন ঢুকে পড়লো না, ভারতে কেন এল? এটি ইতিহাসের কথা যা বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এটি পুরাতন ইতিহাস। এটি ১৯৪৭ সাল উত্তর ইতিহাস। পাকিস্তানের অত্যাচারে নিপীড়িত মানুষ ভারতে আসতো। বাংলাদেশের মানুষ অভিনব কিছু করেনি। পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে মুক্তিকামী মানুষ বাঁচার সহজ উপায় মনে করে ভারতে এসেছে।
শ্রী চাগলা এখানে বলেছেন বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সহানুভূতির অর্থই এই যে, পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের অংগ নিয়ে টিকে থাকবে না, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের বিলোপ ঘটে তবে আমাদের ভয় কিসের। যদি আমরা একথা প্রথমেই বলতাম তাহলে আমাকে সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তান বিরোধী বলে অভিহিত করা হত কিন্তু এখানে এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব উত্তাপনকারী শ্রী প্রণব কুমার মুখার্জী বলেছেন, বাংলাদেশের এই যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান পূর্ব বাংলা হতে প্রতিটি হিন্দুকে বের করে দেয়ার প্রয়াস নিচ্ছে। শ্রী চাগলা সরকারি হিসেবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ৭০ লক্ষ রিফিউজীর মধ্যে ৬৫ লক্ষ হিন্দু। আজ এই সত্য কথাটি বললেও সরকারের দিক হতে বলা হবে এই প্রশ্নকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। সত্য ভাষণে সাম্প্রদায়িক মোড় আসে না। হয় আমরা যা ঘটছে তা থেকে নিজেদের চোখ ঢাকি, পাকিস্তানের অভিলাষ কি তা থেকেও আমরা দেশবাসীকে অন্ধকারে রাখি, নয়ত পাকিস্তান বাংলাদেশে কি করতে চায় তার উদ্ধেশ্য সম্পর্কে আমাদের কোন মাথাব্যথাই থাকা উচিত নয়। আমাদের দেশে এই প্রশ্নকে আমরা একটি জাতীয় সমস্যা মনে করি।
আজ পাকিস্তান সামরিক তৎপরতার মধ্যে বেছে বেছে প্রতিটি হিন্দুকে পূর্ব বাংলা হতে ভারতে বহিষ্কার করে দেয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে যখন থেকে পাকিস্তান হয়েছে তখন হতে তার এই মনভাব সক্রিয়। ভারত পাকিস্তান বিভাগের শর্তসমুহ ১৯৪৭ এর ১৪ই আগস্ট হতেই মুছে ফেলা হয়েছে। পাকিস্তান কখনো তার তোয়াক্কা রাখেনি। পাকিস্তান এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিপরীতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হ্রাস করতে হবে, ওই নীল নক্সার অন্তর্গত এই শেষোক্ত বিষয়টির বিষয়ক্রিয়া অধিকতর তীব্র। ইহা তাদের নীলনক্সা অনুযায়ী পূর্ণ হচ্ছে। আজ আমরা যদি উদ্বাস্তুদের এই বোঝা হতে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে চাই তাহলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এটা তারা নিজেরাই চাচ্ছে, আমরা নিজেদের পক্ষ হতে করছি না, এটা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের লোকেরই বলছে যারা নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রায় ৯৮ ভাগ জনসমর্থন পেয়েছে। যে ক্ষমতাসীন দলের সরকার তাকে সে দলই নির্বাচনে নেমে জনগণের ভোট নেয় এটা আমরা দেখে আসছি কিন্তু মিলিটারী জান্তার অধীনে একটি বিরোধীদল ৯৮ ভাগ সমর্থন লাভ করে, এটি পৃথিবীতে সম্ভবতঃ নজিরবিহীন আর এই প্রবল জনসমর্থন প্রাপ্ত হয়েছে বাংলাদেশের আজকের নবগঠিত সরকার। তারা আবেদন করেছে তাদেরকে স্বীকৃতি দিতে, তাদেরকে সাহায্য করতে। আমরা তাদের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের মিত্রতা লাভ করতে পারি, এই গনহত্যার ইতিহাস ওখানেই থামাতে পারি। গেরিলা যুদ্ধের দ্বারা তারা নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের একটি অন্তর্জালা একটি আকাঙ্খা প্রকট করেছেন মাত্র। গেরিলাযুদ্ধ সৈন্যদের হয়রানি করতে পারে, সৈন্যদের দ্বারা কৃত অত্যাচার ঠেকাতে পারে না। যদি আমরা বাংলাদেশের ওপর নির্যাতন রোধ করতে চাই, সৈন্যদের দ্বারা পরিচালিত গনহত্যা বন্ধ করাতে চাই স্বীকৃতি লাভের পর বাংলাদেশ সরকার আমাদের কাছে এ কাজের জন্যই সাহায্যের আবেদন রেখেছেন। অতএব, এ প্রশ্নে আমাদের আর বিলম্ব কয়া উচিত নয়।
বাবু জয়প্রকাশ নারায়ণও এটি সমর্থন করেছেন। তিনিও বিশ্বসফর করে … তিনি এতদূর বলেছেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান যদি যুদ্ধ ঘোষণা করে, তবে পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করবে শুধু এই ভয়ে আমাদের এটি এড়ানো উচিত হবে না। বাংলাদেশের প্রতিও আমাদের একটি কর্তব্য আছে, আমরা তা পালন করব। সরকারের এতে বিলম্ব করে আপন কর্তব্য হতে পেছনে সরে আসছে এতে আমরা ক্ষুদ্ধ এবং এ আশঙ্কা সারা দেশে বিস্তারিত হচ্ছে। এ কারণে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে, এই অসন্তোষ এখন প্রকট হবে। সরকারকে তার কর্তব্যদের প্রতি সজাগ করার জন্য, সরকারকে তার অবধারিত কর্ম সত্বার বাস্তবায়ন করানোর জন্য কাল থেকেই আমার পার্টি সতুগ্রহের ঘোষণা করেছে। আমার নেতা শ্রী পীতাম্বর দাস এই সত্যগ্রহের নেতৃত্ব করেছেন। এটি সরকারের এই কর্তব্যবোধের প্রেক্ষিতে সত্বর মীমাংসা করার জন্য। কিন্তু সরকার যদি কোন পদক্ষেপ না নেন তবে তার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির কুপরিনতি সারা দেশে দেখা দিতে পারে। এমন এক বিষয় যার ওপর নীতিগত দিক থেকে আমরা সবাই একমনা, আমি চাই না, তার ওপর দেশে কোন প্রকারদ্বৈত সৃষ্টি হোক। আমরা আজ পর্যন্ত মিলেমিশে একাজ করেছি সামনেও একাজ মিলেমিশে করবার অবকাশ আছে। এজন্য এ প্রস্তাবের মাধ্যমে একটি আবেদন করা হয়েছে। ………… সংশোধনের মারফত শ্রী জগদ্মবী প্রসাদ যা এনেছেন —— যে শুধু স্বীকৃতি দিয়ে চলবে না, স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে সামরিক তথা অন্য সাহায্য দিতে হবে। এখন একথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক যাতে এ থেকে পেছনে সরে যাবার কোন অবকাশ না থাকে। প্রস্তাবক মহদয় বলেছেন যে, স্বীকৃতি দেয়া হোক, আমরা আরেকটি সংশোধন চাই এ, স্বীকৃতি দিয়ে তাদেরকে সামরিক সাহায্যও দেয়া হোক। এই সনশোধনীর সঙ্গে প্রস্তাবকেও মেনে নেয়া হোক, আমরা এটাই চাই।
শ্রী শীলভদ্র ইয়াজি (বিহার)- উপ-সভাপতি মহোদয় বাংলাদেশে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে তাকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে শ্রী প্রণব কুমার বাবুর প্রস্তাব আমি সমর্থন করছি। কিন্তু তিনি যে পার্লামেন্টের এই অধিবেশন চলাকালেই স্বীকৃতি চাচ্ছেন আমি তার বিরোধিতা করি। এই সঙ্গে আমি শ্রী পুরকায়স্থ ও শ্রী সোনারাম কেশরীর সংশোধনীর সমর্থন জানাই যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।
উপ-সভাপতি মহোদয়, ২৫ মার্চের পর উভয় পরিষদে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রস্তাব পাস করার পর হতে বাংলাদেশে হিটলারশাহী চলছে। যখন প্রস্তাব পাস হয়েছিল তখন বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সাহায্য দানের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন উঠেছে, স্বীকৃতি দিয়ে যদি সাহায্য দেয়া হয় কিংবা না দিয়েও দেয়া হয়, আমি এর গভীরতায় যেতে চাইনা, আমি সরকারের কাছে একটি কথা রাখতে চাই যে বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেশে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম গণতন্ত্রের সংগ্রাম করছে সেটা কি তাদেরই সংগ্রাম? না। তারা তো সারা বিশ্বের জন্য সংগ্রামরত। ভারতের জন্যও তারা সংগ্রাম করছে।
দোষী কে? মুসলিমলীগ ও কংগ্রেসের নেতারা দেশ ত্যাগ করেছে। দেশ ভাগের পর মুসলিমলীগ ও কংগ্রেসিরা গদিতে বসেছে। এব্যাপারে জনসাধারণের রায় মোটেও নেয়া হয়নি। দেশ ত্যাগের পর জনসাধারণ যদি মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইলেকশনে আসত এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে তার পরে পাকিস্তানকে ভাঙবার প্রশ্ন কোথা থেকে উঠত? কিন্তু কাইয়ুম খাঁ ও ভুট্টো বলেছেন দুইজন প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং ইয়াহিয়া খাঁ কে প্ররোচনা দিয়েছেন যে এমন কোন কিছু হওয়া উচিৎ নয়। মুজিবুর রহমান তো সমগ্র পাকিস্তানের কথাই বলতেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের কথা বলতেন না। মুজিবুর রহমানের পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন হওয়া সত্ত্বেও তাকে শাসনের বাগডোর দেয়া হয়নি। ইয়াহিয়া খাঁ ও টিক্কা খাঁ ডাণ্ডা নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে জনগণকে প্রহার করেছে। এজন্য আমি বলতে চাই, এযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশরই নয় ধরে নিন, আমাদের দেশেও কোন পাগল ইয়াহিয়া খাঁ হয়ে গেল, এখনকার সরকারকে জেলে আটক করল এবং জনসাধারণকে প্রহার করা শুরু করে দিল, আমি সরকারকে জিজ্ঞেস করব তখন কি অবস্থা হবে? আজ বাংলাদেশের সংগ্রাম যারা করছে তারা গণতন্ত্রের জন্য, প্রজাতন্ত্রের জন্য এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য লড়ছে।
আমার ক্ষোভ রয়েছে রাশিয়া ও অ্যামেরিকার ওপর। তারা জনগণের প্রতিনিধিবৃন্দের ওকালতি করেন, প্রজাতন্ত্রের দোহাই দেন কিন্তু বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য অগ্রসর হচ্ছেন না। চিন নিজেকে জনগণের সবচেয়ে বড় ত্রাণকর্তা মনে করে, সেও আজ বাংলাদেশের জনগণকে নির্মুল করতে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইউয়াহিয়া খাঁর সরকারকে সর্বোতভাবে সাহায্য করছে এবং বলছে আমরা ইয়াহিয়া খাঁর হিটলারশাহীকে সাহায্য করব। আজ যারা গণতন্ত্রপ্রিয় লোক আছেন তারা কোথায় চলে গেছেন, বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছে তা থামানোর চেষ্টা কেন করা হচ্ছেনা? এবং তার বিরুদ্ধে কেন আওয়াজ তোলা হচ্ছেনা? এটি মহাভারতের মত ব্যাপার হয়ে গেছে। যখন ধ্রুপদীর শাড়ি হরণ করা হয়েছিল তখন যত বড় বড় ব্যাক্তি ছিলেন ভীষ্মপিতামহ এবং কৃষ্ণ এরা নিষ্ক্রিয়ভাবে তাকিয়ে ছিলেন এবং এরই ফলে তখন মহাভারত যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। আজ বাংলাদেশ হতে আমাদের দেশে ৭০ লক্ষ লোক এসে পড়েছে এবং ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যরা বাংলাদেশে সাত লক্ষ লোক মেরে ফেলেছে। ধ্রুপদীর শাড়ি হরণ করা হয়েছিল। তখন মহাভারত যুদ্ধ হয়েছিল। আজ এত মানুষ নিহত হয়েছে তবু ভারতের জনগণ চুপচাপ বসে আছেন। রাবণ সীতাকে লংকা নিয়ে গিয়েছিল, যার ফলে যুদ্ধ হল এবং রামায়ণ রচিত হল। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ দেশকে বিভক্ত করেছিলেন, বাংলাদেশের জনগণ ভুল করেনি, ভুল করেছিলেন আপনারা যারা দেশ ভাগ করেছিলেন।
জনসাধারণের কোন ভুল ছিলোনা। আপনাদের দরুন দেশ ভাগ হয়েছে, যারা ডিক্টেটর, যারা সেনা পরিচালক, যারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। একথা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে যে বাংলাদেশের নারীদের উপর কি কি অত্যাচার হয়েছে। এসব কথা আমি সংবাদপত্র পড়ে বলছিনা, আমি সেখানে যাই, তাদের লোকজনদের সাথে সাক্ষাত করি এবং এই ভিত্তিতে বলতে পারি, কোন মুর্দা লোকও যদি ওইসব কথা শোনে তবে তার মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার হবে এবং ইচ্ছে হবে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে তাদের হেফাজত করতে। পরিস্থিতি এরূপ কিন্তু আমরা কিছু করছিনা। এক কোটি রিফিউজি এসে যাবে, সরকার বলছেন ৭০ লক্ষ এসে পড়েছে।
শ্রী নাগেশ্বর প্রসাদ শাহীঃ ৮০ লক্ষ।
শিল ভদ্র ইয়াজিঃ যখন গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে তখন শরণ সিংহ ভিষনু পিতামহের মত কি বসে থাকবেন, চ্যাবন বসে থাকবেন, ইন্দিরা গান্ধী বসে থাকবেন, রাশিয়া বসে থাকবে, চীন বসে থাকবে? অ্যামেরিকাও বলছে যে, আমরা সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রের জন্য লড়ছি, তাহলে সে কী করছে? ওখানে গণতন্ত্রের কবর হচ্ছে এবং এর সাথে সাথে যে গণতন্ত্রপ্রিয় লোকেরা ভোট দিয়েছিল তাদেরকে বেছে বেছে মারা হচ্ছে। হিন্দু মুসলিম প্রসঙ্গ আমি তুলছিনা, হিন্দুদের মধ্যে ১০০ ভাগই তো মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ছিল।
শ্রী যোগেন্দ্র মিত্র (উত্তরপ্রদেশ)- আপনার জানা আছে ১০০ ভাগই ছিল?
শ্রী শিলভদ্র ইয়াজিঃ আপনি এখানে বসে আছেন, আমি সেখানে যাই, মুক্তিফৌজদের সাথে দেখা করে আসি, আপনি শুধু লক্ষৌ পর্যন্ত যান, আপনি শুধু দর্শক।
আমি বলছিলাম গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম চলছে তাতে আমাদের করনীয় কি। এখন স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা। আমাদের আজাদহীনদের সরকার গঠিত হয়েছিল নেতাজির নেতৃত্বে, কোন সরকার স্বীকৃতি দিলো কি দিলনা, আমরা যুদ্ধে গেছি। আমি সে বিষয়ের গভীরতায় যেতে চাইনা। স্বীকৃতি দিলে কাল যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে আমি এটাও মানিনা। পাকিস্তান আজ ভাঙছে ভুট্টোর নির্বুদ্ধিতায়, ইয়াহিয়া খানের ভুলে পাকিস্তান ভাঙ্গনের প্রান্তে। এবং চূড়ান্তভাবে ভাঙবে, কিন্তু আমাদের সরকার কি ভূমিকা পালন করবে। দ্বিজাতি তত্ত্ব চিরদিনের জনু নির্মুল করবে না কি করবে। সে যদি এখনি কোন পদক্ষেপ না নেয় তবে পূর্ববর্তি বক্তাগণ যেমন বলেছেন, তাদের সাহায্যার্থে অন্য কেউ আসবে, বাংলাদেশের লোক আপনাকে ধন্যবাদ জানাবে, (বলবে), যতখানি করেছেন ঠিক করেছেন, কিন্তু শুধু বাংলাদেশই নয়, সম্পূর্ণ ইস্টার্ণ জোন আপনার হাত থেকে বেরিয়ে যাবে, এরূপ ফোর্সেস আছে আপনাকে সাবধানী দিচ্ছি। সরকার কখন একশন নেবেন, কখন কি করবেন, আমি জানিনা। কিন্তু সরকার বাংলাদেশে যুদ্ধরত মুক্তিফৌজের সাহায্য করা উচিৎ এটা নিশ্চিত করুক। অনেকেই একথা তোলেন যে, সাহায্য কীভাবে দেয়া হবে? পাকিস্তান কীভাবে করছে, বিদ্রোহী নাগাদের ট্রেনিং ঢাকাতে হয়, মিজোদের হয় — তারা বলেনা, কিন্তু আপনি করেননি। আমাদের সরকার কি করেছে? বিজু পাটনায়ক আশ্চর্য কথা বলেন, তার বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, মুক্তিফৌজের যুদ্ধ কাগজের যুদ্ধ, তিনি নিজেকে স্ফুটনিক বলেন কিন্তু সৎ বুদ্ধি একটুও নেই। তারা কত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছে। ফ্রন্টে গিয়ে আপনি তাদের মনোবল দেখুন, আপনি দেখে আশ্চর্য হবেন, নেতাজির নেতৃত্বে যে আজাদহিন্দ ফৌজ যুদ্ধ করেছিল তাদের চেয়ে এদের মনোবল বেশী উঁচু। মুক্তিফৌজে যত যোদ্ধা আছেন কারও স্ত্রী নিহত হয়েছেন, কারণ কোনয়, কারও অন্য কেউ মারা গেছে। কিন্তু তাদের চেহারায় কোন ঔদাসীন্য নেই। তাদের এই হুসও নেই এ তারা খেতে পাবে কিনা। আজাদহিন্দ ফৌজ যোদ্ধাদের স্ত্রী কন্যারা তো নিরাপদ ছিল, তাদের চেয়ে এরূপ অতিরিক্ত কষ্ট সয়ে এরা লড়ছে।
এজন্য সোজা কথায় আমি সরকারকে বলতে চাই যে, সরকার বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঘোষণা করুন বা না করুন কিন্তু তাদেরকে সাহায্য দানের ঘোষনা যেন অবশ্যই করেন। রাজ নারায়ণ বাবু বলেছেন, শুধু পার্লামেন্টের যুদ্ধ ঘোষণা করলে চলবে না। কূটনীতিও সংসারে একটি বড় জিনিস। উত্তম কূটনীতি হচ্ছে মিথ্যা কত ভালো বলা যায় তা জানা থাকা চাই। উত্তম কূটনীতি অনুসারে আপনার যা করনীয় তা করুন কিন্তু এটা বলবেন না। আমাদের চাণক্য ও কৃষ্ণের নীতি অনুসরণ করা উচিৎ। ‘আস্যুথম্না হতঃ নরো ব কুঞ্জরঃ’ নীতি গ্রহণ করে আমাদের শ্রীকৃষ্ণ ও চাণক্যের প্রদর্শিত পথে চলে কার্য সিদ্ধি করতে হবে। মুক্তিফৌজকে আমাদের সাহায্য করতে হবে এবং আমরা সাহায্যও করেছি কিন্তু আমরা কিছু বলব না। এভাবে তাদেরকে আরও রসদ দিয়ে সাহায্য করা আবশ্যক। যেভাবে চলছে সেভাবে কাজ হবেনা। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সংসদে ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশের জন্য ভারতবর্ষের লোকজন যদি জাহান্নামে যাবার প্রয়োজন হয় তাহলে সেখানে যাবার জন্যও প্রস্তুত থাকা চাই। আগেও পাকিস্তান যখন গোলমাল (গড়বর) করেছিল তখন আমরা লাহোর ও শিয়ালকোট পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ভবিষ্যতেও যদি দরকার হয় আবার আমরা তাই করব।
শ্রী পীতাম্বর দাশঃ আপনি পরোক্ষভাবে লাহোরকে জাহান্নাম বানিয়ে দিলেন।
শ্রী শিলভদ্র ইয়াজিঃ এব্যাপারে সমাধানের প্রশ্ন যতটুকু তা আর্মিকে করতে হবে আমি তা মানিনা। সিভিলিয়ান সরকারই সমাধান করবে। আমাদেরকে অতি সত্বর সমাধানে পৌঁছাতে হবে — জেনারেল কায়োল এর কথা আমি সমর্থন করিনা। আমার বোঝা হয়ে গেছে অ্যামেরিকা কতখানি গণতন্ত্রপ্রিয়, রাশিয়া করোখানি গণতন্ত্রপ্রিয়, চীন কতখানি গণতন্ত্রপ্রিয়, সকলের মুখোশ উন্মোচন হচ্ছে। আজ বাংলাদেশে যে যুদ্ধ হচ্ছে তা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য। ওটি শুধু মুজিবুর রহমান ও আওয়ামীলীগের লড়াই নয়, তাদের থামানোর জন্য সারা বিশ্বের মানুষ উঠে আসতে পারে।
সরকারের কাছে আমার নিবেদন, বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে আমি রাজনারায়ণ মহাশয়ের সঙ্গে একমত। কিন্তু আমি এও চাই যে, তাদেরকে এমন সাহায্য দেওয়া উচিৎ যা দিয়ে সেখানে যত জুলুম অত্যাচার হচ্ছে সত্বর তার অবসান ঘটে। এভাবে যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রচিত হয়েছিল সে তত্ত্বের শেষ আপনাআপনি হয়ে যাবে। এর সাথে সাথে সেখানে সমাজবাদের প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঘোঘনা হয়েছে, সমাজবাদের নামের ওপর ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে এ কৃত্রিম প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে তাকে ধুলিস্ম্যাত করতে আমরা সফল হব। আজ বিশ্বে যখন কোরিয়া ও জার্মানির একত্রীকরণের কথা হচ্ছে তখন পাকিস্তানের ব্যাপারে বিশ্বশক্তিসমূহের আপন নীতির ওপরে লজ্জা হয়না। বিশ্ব শক্তিসমূহ যখন বলছে জার্মানির একত্রীকরণ হওয়া উচিৎ, ভিয়েতনামের একত্রীকরণ হওয়া উচিৎ, তাহলে তারা আজকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নীরব কেন? সমাজবাদের নামে অতি সত্ত্বর আমাদেরকে ‘টু-নেশন থিওরি’র বিলোপ ঘটাতে হবে। এরই মধ্যে আমাদের কল্যাণ, আমাদের দেশের কল্যাণ, বাংলাদেশের কল্যাণ রয়েছে এবং সারা বিশ্বের যত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ আছে তাদেরও কল্যাণ রয়েছে। এসব কথার সঙ্গে শ্রী মুখার্জি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের যে প্রস্তাব রেখেছেন আমি তাকেও সমর্থন জানাই। সঙ্গে সঙ্গে পুরোকায়স্থ মহাশয় ও সীতারাম মহাশয়ের সংশোধনীয়ও আমি সমর্থন করছি। পরিশেষে আমি এই বলে বসে যাচ্ছি যে, কচ্ছপ গতিতে কাজ চলবে না। আপানাকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। জয় হিন্দ। জয় বাংলাদেশ।
[জনাব.ডেপুটি চেয়ারম্যান]
শ্রী এস জি সারদেশাই(মহারাষ্ট্র): জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবি এই হাউজ ও পাশাপাশি অন্যান্য হাউসের সামনে উত্থাপন করা হয়েছে। সরকার কখনোই এই দাবির বিরোধিতা করে নাই। তারা নীতিগতভাবে এটা গ্রহণ করেছে, কিন্তু যথাযথ সময়ে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বিষয় হল এটা কোনো বিলম্ব করার বিষয় নয়। এই দাবী হাউজের বাইরে সারা দেশে ক্রমশ বাড়ছে। ক্ষমতাসীন পার্টি গোঁ ধরে আছে। এটা শুধু বিরোধী দলের প্রশ্ন না। প্রশ্ন হল এই গোঁ ধরা বাড়ছে কেন? যদি এই বিষয়টি আরও দেরী হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় দুর্যোগ নেমে আসবে। সরকারের উচিৎ বিষয়টি বিবেচনায় আনা। তারা বলে যে, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দিষ্ট সহায়তা দান করছে। কিন্তু তা নয়। এটি সত্য যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনী অনেক সংগঠিত। এবং তাদের কাজ আরো ভালো ও চমৎকার সমন্বয় হচ্ছে।
কিন্তু অন্য দিকে আমাদের উদ্বেগের বিষয় আছে। এই সব কার্যক্রম সত্ত্বেও, সপ্তাহে সপ্তাহে এবং মাসের পর মাস এই সরকার একটি আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যাচ্ছে। এটা নিয়ে অতি বিলম্ব করা হচ্ছে এবং এর ফলে চূড়ান্ত বিজয় কঠিন হয়ে পড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থী সংখ্যা বাড়ছে। আমরা যে সংখ্যা জানি তা হল ৩.৫ মিলিয়ন যা ছিল কয়েক সপ্তাহ আগের। এখন এটা ৮ মিলিয়ন। জানিনা এটা কোথায় শেষ হবে। মাত্র কয়েক মাস আগে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, তিনি ভারতের সাথে কোন যুদ্ধ চান না এবং হয়ত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ চান না। অথচ তিনি এখন যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন। এমনকি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করছিলেন তখন তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানে তারা আর কোন অস্ত্র সরবরাহ করবেনা। কিন্তু এখন প্রকাশ্যে তারা বলেন যে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছে। যে ধারণা প্রথমে প্রিন্স সাদ্রুদ্দিন করেছিলেন তাই এখন জাতিসংঘের মহাসচিব করছেন। এর মানে কি? তার মানে খুব সহজ, পাশ্চাত্য ক্ষমতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাংলাদেশের জনগণকে জবাই ও গণহত্যায় সাহায্য করছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা তাদের সশস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভারতের অর্থনিতী দুর্বল হয়ে গেলে ভারত হয়ত বাংলাদেশকে আর সাহায্য করতে পারবেনা। এটা দিনের পর দিন ঘটছে। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই আমাদের নীতি অনুযায়ী আসলে কি কাজ হচ্ছে? যদি তা না হয় তাহলে আমি বলব এর কোন ভালো ফল নাই। বাইবেলে আছে ভাই স্বর্গের যাওয়ার রাস্তা ভালো ইচ্ছা দ্বারা পূরন হয়। কিন্তু এই পলিসির আসল ফল কি? চার মাস পর ফল কী হল? আমাদের লক্ষ্য, ভারতকে শক্তিশালী করা মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী করা। যাতে তারা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে জিততে পারে এবং বাংলাদেশে একটি স্বাধীন সরকার ব্যাবস্থা চালু করতে পারে। যার ভিত্তিতে শরণার্থীরা ফিরে যেতে চাইবে। আর যদি উত্তর এমন হয় যে আমাদের এখন এসব করার প্রস্তুতি নেই তাহলে জানতে চাই আগে কি করেছি তাহলে আমরা? এজন্যই আমাদের এখন স্বতন্ত্র্র নতুন চিন্তার প্রয়োজন। সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এবং এই পর্যায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এটাকে আপনি বাইপাস করতে পারেন না।
স্যার, এই সরকার অতীতে সব সময় বলেছে এটা ইন্দো-পাক সমস্যা না। স্যার, আমি এই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্পষ্টভাবে এটির উত্তর দিতে বলছি। বাংলাদেশের জনগণ কারা? তারা কি ভারতীয় ব্রহ্মদের মত যে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে? যাদের কোন আকার নেই আকৃতি নেই; নিরাকার নিগুনা? বাংলাদেশের জনগণ কর্পোরেট বাস্তবতার সম্মুখীন। এবং এর একটাই অর্থ হয়। তা হল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে বাংলাদেশের সরকার গঠন। বাংলাদেশ সরকার মানে বাংলাদেশের এবং যদি আমরা এত পরিষ্কারভাবে না বলতে পারি তাহলে ধীরে ধীরে আমরা ডুবে যাব। স্যার যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সর্বশেষ ষড়যন্ত্র কি? সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে হারানো, নিশ্চিত ভাবে হারানো, রাতারাতি নয়, ধাপে ধাপে। সরকারকে এমন একটা অবস্থানে আনতে বাধ্য করা যাতে এটা ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে মোড় নেয়। এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়েছে। এটি ইন্দোপাক ইস্যু নয়। এটা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণের মধ্যকার সমস্যা। এই মুহুর্তে সমগ্র বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ। আমরা বলতে চাই মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন সেটেলমেন্ট গ্রহণযোগ্য নয়। যতক্ষণ না আপনি এটা একেবারে স্পষ্ট করছেন ততক্ষণ আমাদের অবস্থান দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
স্যার আমি আপনাকে অন্য কিছু বলতে পারি। আমি আপনাকে আরও কিছু বাস্তবতা তুলে ধরছি। এই সংসদে সর্বসম্মতভাবে একটি সংগ্রামের সমর্থন পাস করেছি। এই সংসদে পরবর্তী বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা পাকিস্তানি শাসকদের সমস্যার সমাধান করার জন্য ভারতের খরচে এবং ভারতের মাটিতে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার মীমাংসা করার জন্য অনুমতি দিতে পারি না। পরবর্তীকালে তিনি বলেন, ভারতকে অনেক কঠিন সময় পাড় করতে হবে এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে। এটা পরে বলা হয়েছিল যে যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ব্যাপারটা রাজনৈতিক নিষ্পত্তির বিষয় আমলে না নেন তাহলে ভারত একতরফা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। এই হাউস বিবৃতি দেয়া হয় ভারত একতরফা পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এই হাউজের কেউ জানে না এই একতরফা পদক্ষেপ দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে। আমি বলছি না ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তান চলে যাবে। কিন্তু একতরফা পদক্ষেপ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট করা আবশ্যক। যখনই পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বলা হয়েছে, “আপনি শক্তিশালী বার্তা কেন পাঠান না? প্রকাশ্যে বলা হয়েছিল যে, মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানে পরিচালিত হবে না কিন্তু সেটি যে মিথ্যা ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে। মার্কিন সাহায্য পাকিস্তানের জন্য চলমান এবং এটি মোটেই বন্ধুসুলভ কাজ নয়। তারপর বলা হয় যে এটি কূটনৈতিক কারণ। এর কূটনৈতিক প্রয়োগ থাকতে পারে। কেন নয়? আমরা তো সেখানে সেনা ঠেলে পাঠাচ্ছি না। কেউ না। কিন্তু এটা যদি বিশ্বকে বোঝাতে হয় তাহলে শক্তিশালী বার্তা দিতে হবে। এটা আমাদের এক ধরণের অপমান। পাকিস্তানি শাসকরা ভারতে মানুষকে ঠেলে পাঠাচ্ছে এবং উল্টা পাল্টা বলছে। তাই এর জন্য শক্তিশালী বার্তা দিতে হবে।
কিন্তু আপনি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছেন না। এর কী কারণ থাকতে পারে? এক উপসংহার তারা টেনেছে – আর তা হল ভারত হয়ত আপাতত কিছু করতে যাচ্ছেনা। তাই এই মুহুর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নটা বাস্তবসম্মত ও গুরুত্তপূর্ন। এটা শুধু নীতির প্রশ্ন না। এটা বলতে দেরি হবে না যে আমরা নীতিগতভাবে তা গ্রহণ করব। কিন্তু আমরা কখন উপযুক্ত সময় মনে করব সেটা নির্ধারন জরুরী। সময় আছে। কিন্তু এই অবস্থায় সময় খুব কম। তাই নির্দিষ্ট কিছু রেফারেন্স তৈরি করতে হবে। আমার বন্ধু, জনাব ইয়াজি বলেছেন, ‘জাতীয় স্বার্থ’ – এই শব্দ দিয়ে তিনি কি বুঝিয়েছেন আমি জানতে চাই। কিভাবে আপনি আমাদের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দেখেন? আমার বন্ধু সবসময় জাতীয় স্বার্থের কথা বলেন। সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে সুনিশ্চিতভাবে বলা হয়েছে যে ১৯৭০-৭১ সালে তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেন নাই। তারা এটা স্পষ্ট করেছেন। তারা সুনিশ্চিতভাবে শুধুমাত্র গণহত্যা থামানোর কথাই না বাংলাদেশ ও এর জনগণের স্বীকৃতির ব্যাপারেও বলেছেন। জিডিআর অবস্থান প্রকাশ করেছে। বুলগেরিয়া করেছে। অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশ করেছে। আমি সরকারকে জিজ্ঞেস করতে পারি কিনা এমন একটি পরিস্থিতিতে তারা কি সোভিয়েত ইউনিয়নের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য বসে থাকবেন? এটা আমাদের সমস্যা, আমরা এখানে জড়িত, আমাদের ভাইয়েরা যুদ্ধ করছে, আরেক ধাপ আগাই চলেন, তারা যতটুকু যেতে পেরেছে গিয়েছে। যা বলার বলেছে। আমরা এক ইঞ্চিও আগাই নাই। তাদের পরবর্তি পদক্ষেপের আশায় আর বসে থাকার দরকার নাই।
আমার বন্ধু, জনাব ইয়াজি, এটা সেটা বলবেন। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এবং আমি নিশ্চিত এই পদক্ষেপের পরে বিশ্বের অন্যান্য সহানুভূতিশীল দেশ তাদের সমর্থন প্রকাশ করবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের অধিকার। আমাদেরকেই করতে হবে। আপনি যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন তাহলে এর মানে হল আমরা শুধুমাত্র আবেগের বশে নয় বা রাজনৈতিকভাবে নয় বরং পুরো বিশ্বের কাছে সাংবিধানিকভাবে এবং বিচারিকভাবে প্রমাণ করতে পারব যে এই দ্বন্দ্ব ভারত পাকিস্তান নয় বরং বাংলাদেশ ও তার শাসকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। ভারত এমন কোন সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না যা আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই গোটা বিশ্বকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হোক। যত তাড়াতাড়ি আমরা এটা করব আমাদের তত সুবিধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে তার শরণার্থী সমস্যা পর্যন্ত – কূটনৈতিক থেকে সামরিক সমস্যা – সব কিছুর সমাধান হওয়া শুরু হবে। আমরা মুজিবের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাথে শরনার্থি সমস্যার ব্যাপারে আলোচনা করব। এতে করে স্বীকৃতি আর শরণার্থী সমস্যা আলাদা করা হচ্ছেনা। এজন্যই এই সরকারকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে কোনও প্রকার বিলম্ব আরও বিপর্যয়মূলক হবে এবং এই দেশ স্পষ্টভাবে কোনো U.N. পর্যবেক্ষক গ্রহণ করতে যাচ্ছে না। এসব করলে পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। তাই আমাদের এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে আর কোন কারণ নাই। “তাদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ” বলে কিছু নেই – এটা ‘’আমাদের স্বার্থ’। আমি জানতে পারি কি কেন দেরী হচ্ছে? এতে কি লাভ? কোনো প্রকার বিলম্ব এটিকে খারাপ অবস্থানে নেবে এবং ভারত পর্যবেক্ষক গ্রহণ করতে অবশেষে বাধ্য হবে। হয়ত তারা রাতারাতি আসবেনা, দিন মাস লেগে যাবে। আমরা হয়ত আর ঠেকাতে পারবোনা। তারা যথেষ্ট কৌশলী এই ব্যাপারে। তারা জানে কীভাবে কাজ আদায় করিয়ে নিতে হয়। ধীরে ধীরে তারা তাদের পরিকল্পনা মাফিক আগাবে আর একসময় ধাক্কা দেবে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান এটা করছে। তারা বলে কেন আপনি পর্যবেক্ষক গ্রহণ করবেন না? আপনার কি কিছু লুকানোর আছে? “অবশ্যই, আমাদের লুকানোর কিছু নাই। অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা সেটা বলে আমরা চলতে পারিনা। আমি এই প্রশ্ন শুধু আবেগের দিক থেকে উত্থাপন করিনি নৈতিকতার দিক থেকে করেছি। এখন সময় সবার একমত হবার।
আমি এই প্রশ্ন অত্যন্ত বাস্তবমুখী ব্যবহারিক এবং জরুরী হিসেবে উত্থাপন করছি। সবাই জানে যে ভারত সরকার তাদের সাহায্য করছে কিন্তু আপনি যদি তাদের আরো কার্যকরভাবে সাহায্য করতে চান তাহলে স্বীকৃতি দিতে হবে। চোরাগোপ্তা ফ্যাশনে চালালে হবেনা। পুরো বিশ্ব তা জানে। এটা আরো কার্যকরভাবে করতে হবে। একবার আপনি স্বীকৃতি দিলে আপনি সবাইকে বলতে পারবেন গেরিলারা যুদ্ধ করছে এবং আমরা তাদের সাহায্য করছি। তারপর ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবকরা যেতে পারবে। উত্তর ভিয়েতনাম কি করেছিল? সবাই জানে যে উত্তর ভিয়েতনাম পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে এবং উত্তর ভিয়েতনাম তার সেনাদের ধাক্কা দেয়নি বরং তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা আমাদের ভাই, আমরা তাদের সাহায্য করছি। আমরা তাদের জন্য যুদ্ধ করব। তাই আমাদের এটা আগামীকাল ভারতীয় যুবকরা স্বীকার করুক এবং সরকার বলতে পারেন, আমরা তাদের সাহায্য করছি। আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়া যাবার সময় সত্যাগ্রহিরা সেখানে গিয়েছে সরকারের পূর্ন সহায়তায়। নেহেরু বলেছিলেন আমরা গোয়াতে আক্রমণ করছিনা। কাজেই এভাবে আপনি যদি তাদের সাহায্য করতে চান তাহলে স্বীকৃতি ছাড়া তা সম্পন্ন করা যাবে না। জনাব বিজু পট্টনায়েক বলেন যে গেরিলারা গোটা এলাকা মুক্ত করতে পারবে না – আমি তার সাথে একমত না। আসলে পুরো এলাকায় গেরিলারাই দক্ষিণ ভিয়েতনাম স্বাধীন করেছিল। উত্তর ভিয়েতনামের এ্যারোপ্লেন সেখানে যাননি। তাদের ট্যাংক সেখানে যায়নি। কেউ বলেন না যে উত্তর ভিয়েতনামের ট্যাংক ছিল। তাই সবই করা যাবে। একটা জিনিস বলতে চাই, আমরা যুদ্ধ চাই না। এটা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমরা বস্তুগত সাহায্য করতে চাই যা অবিলম্বে প্রয়োজন। আমাদের পরবর্তী ২ বা ৩ মাসের মধ্যে এই কাজ করতে হবে। এরপর আমরা আবার পরিস্থিতি বিচার করব। তাদের স্বীকৃতি দিন। গেরিলারা শক্তিশালী হোক। কূটনৈতিক বিশ্ব জানুক। মুজিবের সঙ্গে নিষ্পত্তি হোক। ভারত ইউ এস এ বা অন্য কারো সাথে দরাদরি করতে নারাজ। আমরা শুধু উদ্বাস্তু ইস্যুতে আলোচনা করতে রাজি। আপনি তাদের সহজ অবস্থান প্রকাশ করুন এবং মুজিবের সঙ্গে নিষ্পত্তির হোক। আমরা অন্য কোন বিষয়ে কথা বলব না। এতে সব ভারতীয়দের পূর্ণ সমর্থন থাকবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এটা নিয়ে চিন্তিত হতে হবে না কিন্তু এই মুহূর্তে কোন দ্বিধা বা দোদুল্যমানতা কাম্য নয়। আমরা আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করছিনা। ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আসে যখন সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই নেওয়া হয়। আপনি ব্যর্থ হলে, ইতিহাস এই সরকারকে ক্ষমা করবে না। তাই এই কংক্রিট পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু করতে হবে। জনাব ছাগলার সাথে আমি একমত যে তিনি বলেছেন কেন অধিবেশন শেষে হবে – আমরা আজই স্বীকৃতি দেব। এটা এখনই করা উচিৎ। দয়া করে আমাদের এই অবস্থা থেকে রক্ষা করুন।
শ্রী শশাঙ্কশেখর সান্যাল (পশ্চিম বঙ্গ): জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, আমার রাজ্যের সরকারি ভাষা বাংলা নয়। আমি, সেই ভাষায় বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
কিছু সন্মানিত সদস্য- তিনি আপনাকে অনুসরণ করবেনা।
শ্রীমতী টিআই পূরবী মুখোপাধ্যায় – (পশ্চিম বঙ্গ): জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, আমরা অনেক কিছু এখানে অনুসরণ করব না। এটা ইন্টারপ্রেটার এর ফাংশন। সে যে উপায়ে এখানে গৃহীত হয়েছে, তাতে আমি বিস্মিত। কিন্তু বিষয় হল আমাদের নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার আছে এবং এটা সরকার ও জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত।
জনাব. ডেপুটি চেয়ারম্যান: কেউ অধিকার অস্বীকার করে নাই।
শ্রী শশাঙ্কশেখর সান্যাল: স্যার আমি আমার পুরনো বন্ধু ও বোন, শ্রীমতী পূরবী মুখোপাধ্যায়, আমাকে উদ্ধার করতে এসেছে দেখে খুশি হয়েছ। তাই আমি কাউকে ভয় পাই না।
স্যার, ৩১ মার্চ, ১৯৭১ উভয় হাউজ বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে সর্বসম্মত রেজোলিউশন পাশ করে। সে সময় ভারতের ইমেজ সমগ্র বিশ্বে উজ্জ্বল হয়েছিল। পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়েছে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবন উৎসর্গ করছে। পূর্ব বাংলায় তারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য সংগ্রাম করছে। আগে এটা ছিল অহিংস। এটা আমাদের কাছে মনে হয় যে সেই মুক্তিযোদ্ধারা গান্ধীজীর আশীর্বাদ পুষ্ট। সুতরাং এটা ছিল পূর্ববাংলায় কোন সংগ্রামে গান্ধিজীর দর্শনশাস্ত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ। পশ্চিমের লোকেরা, যারা অহিংস সংগ্রামের কার্যকারিতা বুঝতে পারে না, কিছু সময় পূর্ববঙ্গে এমন একটি অহিংস সংগ্রাম দেখে তারা হতচকিত ছিল।
কিন্তু চার মাস পরে আজ কি পরিস্থিতি? সর্বসম্মতভাবে রেজল্যুশন গৃহীত হল। ভারতের জনগণ সরকারকে ও পার্লামেন্টকে ডকে পাঠাল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে অদূর ভবিষ্যতে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কবল থেকে বের হয়ে আসবে। এবং দুই বাংলার আবার সাংস্কৃতিক লিঙ্ক স্থাপন হবে। দুই বাংলা আবার বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। দেশ বিভাগের পর ভারতে আসা উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবে বলে ধারনা করা হয়েছিল। একই আশা বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে বর্তমানে আসছে তাদের ব্যাপারে পোষণ করা হচ্ছে। কিন্তু চার মাস পর তাদের সব আশা মাটিতে বিলীন হয়। কেন এটা হয়েছে? বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখন মনে করেন যে আমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করার ব্যাপারে আন্তরিক না। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইতিমধ্যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করায় আমাদের অভিযুক্ত করেছে। পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যে আমাদের উপর অসন্তুষ্ট। এখন আমরা খুব বিশ্রী অবস্থায় নিজেদেরকে এনেছি। যখন বাংলাদেশ প্রশ্নে আমাদের ভারতের জনগণ আমাদের ডাকে তখন উত্তর কি হওয়া উচিত?
জনাব ডেপুটি চেয়ারম্যান, স্যার, আমাদের শৈশব দিনগুলোতে আমরা রো এবং ওয়েব এর ইংরেজি ব্যাকরণ পড়েছি। আমাদের জানতে হবে যে এই স্বীকৃতি যথাযথ সময়ে দেওয়া হবে। উপযুক্ত সময় ছিল তখন যখন আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম। অতএব, স্বীকৃতি দেয়া এখন সরকারের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব।
যখন সংসদ ৩১ মার্চ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিষয়ক রেজোল্যুশন সর্বসম্মতভাবে পাস হয় তখন আমরা ভেবেছি ভারত সরকার হয়ত ফর্মালিটিস পালনের জন্য পনের দিন পরে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু অনেক মাস গেলেও সেই তারিখ পেরিয়ে গেছে। আমরা দেখি বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে এখনো আমাদের সরকার উভয়সঙ্কটে। আমাদেরকে এর ভালো খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশ বিষয়ক সর্বসম্মত রেজল্যুশন সংসদে পাস করার পর আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সব বস্তুগত সাহায্য দিতে সক্ষম হব। আমরা বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু অস্বীকার করতে পারতাম। উদ্বাস্তুদের যারা দেশ বিভাগের পর আমাদের দেশে এসেছিলেন, তারাও প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সজ্জিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেবে। আমরা বাংলাদেশের জনগণকে বলতে পারতাম শরণার্থী হিসেবে না আসতে কিন্তু তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করার জন্য আসতে পারে। তারা আমাদের কথা শুনবে যদি আমরা তাদের সব ধরণের সাহায্য দেই। এই পদ্ধতিতে আমরা আমাদের দেশ থেকে শরণার্থীদের অন্তঃপ্রবাহ প্রতিরোধ করতে পারি।
স্যার, মার্চ, ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলায় সামরিক জান্তা যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিল। যদি আমরা সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সব বস্তুগত সাহায্য দিতাম তাহলে পূর্ববাংলা পনের দিনের মধ্যে তার স্বাধীনতা পেত। একবার যদি তারা স্বাধীনতা অর্জন করে ফেলত তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তি তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারতোনা। অবশ্যই কিছু দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চিৎকার করত যদি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হত। ভারত তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সাথে বসবাস করত। আমরা সেই সুযোগ আসার জন্য অপেক্ষা করছি।
স্যার, আসলে এই চার মাসের মধ্যে কি ঘটেছে? পাকিস্তান তার সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। সে বিদেশ থেকে অস্ত্র সাহায্য পেয়েছে। তারা দেখানোর চেষ্টা করেছে যে এটা আসলে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব নয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তারা কিছুটা সফল হয়েছে।
পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারে। সম্ভবত আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছিনা। কিন্তু আমি আমার বন্ধু, সরদার শরণ সিং কে জিজ্ঞেস করতে চাই যে পাকিস্তান কি আমাদের আক্রমণ করবে না যদি আমরা বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি না দেই? পাকিস্তান যখন দুর্বল ছিল তখন কি আমাদের দেশে আক্রমণ করেনি? পাকিস্তান কিন্তু এখন শক্তিশালী হয়েছে আগের চেয়ে। তাই তারা আমাদের আক্রমণ করবে। আমাদের সীমান্তে আক্রমণ করছে তারা। এই সীমানা হামলা ব্যাপক হয়ে পড়লে আমাদের তা প্রতিহত করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান আমাদের অভিযুক্ত করবে এবং পাকিস্তানের সেই অভিযোগ বিশ্বের অনেক বড় দেশ বিশ্বাস করবে। অতএব, স্যার, আমার কথা হল আমরা অচিরেই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেব। যদিও আমরা দেরী করে ফেলেছি। তবু বলব না করার চেয়ে দেরিতে করা ভালো। এটা মনোবলহীন শরণার্থীদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হবে। এটা আমাদের দেশে শরণার্থীদের আরও অন্তঃপ্রবাহ থেকে রক্ষা করতে পারবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য। পাকিস্তান স্পষ্টভাবে আমাদের ওপর যুদ্ধ আরোপ করবে। পাকিস্তান তার বর্তমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমেরিকার লাইনে যাবে। আমি আমার কংগ্রেস বন্ধুদের বলব হয়ত পাকিস্তান এখন ভারতর সাথে যুদ্ধ চায় বাংলাদেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যর্থ করার জন্য। একইভাবে গরিবি হটাও নির্বাসিত হবে। এছাড়া যুদ্ধ শুরু হলে ব্যুরক্রেটিক মেশিনারি, ক্যাপিটালিস্ট আর মনোপলিস্টরা সুবিধা পাবে। শিল বান্দ্রা ইয়াজি, আর্জুন আরোরা ও চন্দ্র শেখররা শ্রীমতী গান্ধীকে গাইড দিতে পারবেনা। তখন তাকে ব্যুরক্রেটিস্ট আর মনোপলিস্টরা গাইড দেবে।
বিশ্বশক্তিগুলো মাঝে মাঝে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতকে এক কোনায় চাপিয়ে দেবার চক্রান্ত করেছে। ভারতের বিপক্ষে তাদের ষড়যন্ত্র মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংসের জন্য ছিল। তাদের আর সুযোগ দেওয়া আমাদের উচিৎ হবেনা।
স্যার, আমাদের উচিৎ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। তাদের বিজয়ে আমাদের বিজয় হবে। তাদের পরাজয়ে আমাদের পরাজয় হবে।
ধন্যবাদ।
শ্রী সীতারাম কিশোরী (বিহার)ঃ
উপসভাপতি মহোদয় কিছুদিন পূর্বে আমার বন্ধু শ্রী রাজ নারায়ণ বাবু বাংলাদেশের অপর তার ভাষণে বলেছেন বাড়ত সরকারের কার্যাবলি দেশদ্রোহী। আমি মনে করি এধরনের কথা বলে তিনি পাকিস্তানের হাত শক্ত করেছেন। শ্রিক্রিতি সম্পক্ক্র ১৯৭১ সালের পহেলা জুনে ভাস্বানই সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে পরিষ্কারভাবে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদর্শিত সহানুভূতির স্বাগত জানানো হয়েছে। ভারত সরকার যে এযাবত স্বীকৃতি দেন নাই এটা একথাই প্রমাণ করে যে ঐ দেশের সৃষ্ট সংকতয়ে ভারত সরকারের কোন হাত নেই। আমি বলতে চাই, আমারবন্ধু এই অবসরে যে ধরণের কোথা বার্তা বলেছেন তা ঠিক নয়। দ্বিতীয় কথা, বন্ধুবর বলেছেন, ৬৫ লক্ষ হিন্দু ও ৫ লক্ষ মুসলমান এসেছে। আমি তাকে বলব, তারা ৭০ লক্ষ হিন্দু বা ৭০ লক্ষ মুসলমান হোক আমাদের কাছে তারা পাকিস্তানী এবং পাকিস্তানের নাগরিক। এইজন্য আমি মনে করি, হিন্দু ও মুসলমানের নামে এদেশে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা কখনোই প্রচার করা উচিৎ হবেনা। এর ফলে বাংলাদেশের কাজে অনেক বড় বাঁধা আসছে। আমি আরেকটা কথা বলছি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সংকটে নির্ভিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে তার যে রায় প্রদান করেছেন সেইজন্য তিনি প্রশংসার পাত্র। এই জন্য রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে আমি ধন্যবাদ জানাই। অন্যদিকে অ্যামেরিকা আমাদের শত্রু রাষ্ট্র চিনের সাথে হাত মিলিয়ে নিতচা পূর্ন কাজ করেছে। সে পাকিস্তানকে তার এজেন্ট বানিয়েছে, তেলেস্মাতিরুপে কিসিঞ্জারকে চিনে পাঠিয়ে বাংলাদেশের অসহায় জনগণের ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আশা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে বিশ্বের দেশে দেশে এক বিষাক্ত আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। এটা নিন্দনীয়। আমি আরেকটি কোথা বলছি, অ্যামেরিকা কি চায়? চিন কি চায়? এরা উভয়ে চাচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হোক। তারা চায় না বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ন হোক। তারা চায় সমাজবাদের ভিত্তিতে প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধিশিল ভারতকে পাকিস্তানের সাথে এভাবে জরুয়ে দেয়া যায় কিনা যার মধ্যে সে হাবুডুবু খায়, এইজন্য আমি উভয়কে বলব বাংলাদের একটা ক্রান্তি চলছে আর সেই ক্রান্তির পিছনে ঐ দেশের মানুষের ভাগ্য নিহিত। এই ক্রান্তির পিছনে ঐ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্দে, ইয়াহিয়া সএকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন চালাচ্ছে। এই আন্দোলনে কোন প্রকার ঘা লাগে আমাদের এমন কোন কথা বলা উচিত হবেনা। এই জন্য আমি আমার বন্ধুদের বলব …
আমি আরেকটি কথা বলছি। বাংলাদেশে যা ঘটেছে সারা বিশ্ব তা জানে। আমাদের দেশের সকল লোক বাংলাদেশের স্বীকৃতি চায়, আমিও চাই, কিন্তু স্বীকৃতির সময় হতে হবে। অনেক অবস্থা, অনেক ব্যাপার আছে যা স্বীকৃতি দেবার আগে দেখতে হয়। তাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত এমন রাষ্ট্র ক’টি আছে, এমন কত লোক আছে। আমি আরেকটি কথা বলছি, যারা মনে করেন, ভারত বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করে যুদ্ধ করবে, তারা ভুল বুঝছেন। এটি বিদেশী লোক দের মন জয় করার জন্য, বিদেশীদের ভাববার জন্য, বিদেশীদের মূল্যায়নের, বিদেশীদের ধারনার একটি রীতি ও অভ্যাস। এটা কথা বলার একটি পদ্ধতি। মীমাংসা আমরা করব, পদক্ষেপ আমরাই নেব – ইস্পাতদৃঢ় পদক্ষেপ, আমরা সিদ্ধান্ত নেব যুদ্ধ কখন বাধাতে হবে আর কখন নয়। একটা কোথা আমরা জানতে চাই। আপনারা জানতে চেয়েছেন এর পরে কি আছে। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, ভারতে আগত শরনার্থিদের ফিরে যেতে হবে। আমি বলব, আপনারা সত্য উপলব্ধির চেষ্টা করুন। এ সত্যের পেছনে কোন দুর্ভাবনা নেই। এই সুচিন্তিত কথার পেছনে কি মস্ত ইস্পাতকঠিন ধারনা আছে নীতির মানদণ্ডে তা ইন্টারপ্রেট করুন। বিচার রীতি অনুসারে এই বিবৃতির ব্যাখ্যা করুন। যদি আপনারা নিজেদের জন্য নিদের ধারনার ব্যাখ্যা করেন তাহলে সেটি সম্ভব হবেনা।
আমি জানি দেশে একটা ষড়যন্ত্র চলছে, কী সেটা? নির্বাচনে কিছু লোক হেরে গেছে, কিছু দলের বিলোপ ঘটেছে, তারা চাচ্ছে এই অবস্থার সুযোগ নিতে। কিন্তু আপনারা সুবিধা করতে পারবেন না, কেনোনা ভারতবাসী আপনাদেরকে ভালভাবে চেনে। আপনাদের এইসব প্রচার ও এই রূপ প্রোপাগান্ডার পেছনে কি অভিসন্ধি কাজ করছে। আপনি দেখেছেন তারা আন্দোলন চালাচ্ছেনা। আপনি দেখেচনে, তারা আপনার পথে চলেছে না, আপনাকে জন সাধারণ নির্বাচিত করছেনা, তাই আপনি হিন্দু মুসলমানের প্রশ্নে কথা বলতে শুরু করেছেন।
শ্রী রাজ নারায়ণ ঃ মহোদয়, বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি না দেওয়া আমাদের ভুল। এব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত। আমি আরও সুনিশ্চিত যে, বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিতে যত বিলম্ব হবে ততই নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে এবং ভারত প্রতিনিয়ত তার জটাজালে জড়িয়ে পড়বে। নিত্যদিন আমাদের জটিলতা বারতেই থাকবে। এখন যারা ততখানি স্বীকৃতি দেবার পক্ষপাতী নন আমি তাদের জয়ব দিচ্ছি স্বীকৃতি দিতে কেন বিলম্ব হচ্ছে। ৩১ মার্চ সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাশ করেছে – ‘এ মহাদ্বিপের মানুষ বহু শতাব্দী ধরে ভারতের ভৌগলিক অবস্থান ও ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণে এই সভা তার আপন সীমান্তের এত কাছাকাছি ঘটমান থাকতে পারেনা। বর্তমান সময়ে তথাকার নিরপরাধ মানুষের অপর যে নজিরবিহীন উপায়ে অত্যাচার চালানো হচ্ছে আমাদের সারা দেশের জনগণ দ্ব্যার্থহীণ ভাষায় তার নিন্দা করছে।
এই সভা গণতান্ত্রিক (লোকতন্ত্রাত্মক) জীবন ব্যাবস্থার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও একাত্মতা ব্যাক্ত করছে। এই সভা তাদের এই শ্বাস প্রদান করছে যে তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ ভারতের জনগণের আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করেছে। আমি বলতে চাই যে, এই প্রস্তাবের পরে সাথে সাথে তাৎক্ষনিক স্বীকৃতি প্রদান করা কি আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে দাড়ায়নি? মুজিবুর রহমা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এই ব্যাপারে সময় দেয়া উচিৎ। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপিত হয়েছিল। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খাঁ ৩-৩০ মিনিটে ঢাকা পৌঁছেন। ১৫ মার্চে মুজিবুর রহমান শাসনক্ষমতা নিজের হাতে নেন এবং নিজেকে শাসক ঘোষনা করেন। ১৫ মার্চ তিনি একথা বলেন। ১৫ মার্চের পর আমি ২৫ মার্চের কথায় আসছি না। আমার কথা হচ্ছে ১৫ মার্চেই ভারত সরকারের মুজিব সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া উচিৎ ছিল।
আমি বন্ধুবর শ্রী শিল ভদ্র ইয়াজদিকে বলতে চাই যারা বলেন স্বীকৃতির প্রশ্নে আমরা একমত কিন্তু এটি সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিৎ। আমি বিনয়ের সাথে বলব, তিব্বত সমস্যা কি ভারত সরকারের উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি? তিব্বতে আমাদের ১২ টি ডাকবাংলো ছিল, তিব্বতে আমাদের তিনটি সামরিক তথ্যকেন্দ্র (জানকার) ছিল, তিব্বতে আমাদের ডাকঘর চিঠিঘর এবং টেলিফোন ঘর ছিল এবং এভাবে তিব্বত চিনের খুনি কব্জায় চলে গেছে। আমার ভয় হচ্ছে, দালাইলামার নেতৃত্বে এখানে যে ৬১ হাজার তিব্বতি শরনার্থি পরে আছে এ সরকার তাদেরকেও আমার চিন সরকারের কাছে সমর্পন না করেন। আমি এই ভয়ও পাচ্ছি যে বাংলাদেশের শরনার্থি যরা এখানে এসে পড়েছে সরকার তাদেরকে অন্য কোন রাষ্ট্রের হাতে সমর্পন না করেন। অতএব, আমি বলতে চাই এ বিষয়ে আমার কোন ব্যাক্তিগত প্রশ্ন নেই, এ প্রশ্ন সারা দেশের, সারা বিশ্বের, সমগ্র মানবের এবং সকল গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার, এ প্রশ্ন কোন ব্যাক্তি বিশেষের উপর আরোপ করলে চলবে না।
… সুতরাং আমি দেশের জনগণের উদ্যেশ্যে বলব, জনগণ উঠুন এবং উঠে এসে সরকারের উপর প্রচণ্ডভাবে চাপ প্রয়োগ করুন যা আজই এখনি এই অধিবেশন শেষ হতে হতে না হতেই স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের কথা এবং নৈতিক, বৈষয়িক, সামরিক সর্বপরি সাহায্যের কথা ঘোষনা করা হোক।
মহোদয়, আমি চাগ্লা সাহেবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। চাগ্লা সাহেবের পুরো ভাষণ আমি নিজের ভাষণরূপে মেনে নিতে প্রস্তুত। চাগ্লা সাহেব বলেছেন, ইয়াহিয়া টু-নেশন মত সমর্থক। তিনি ঠিকই বলেছেন, আমিও তাই বলি, ইয়াহিয়া দুই রাষ্ট্রের তত্ত্বের পক্ষে। এইজন্য তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ হতে ঐ লোকদের বের করে দিতে চান যারা ইয়াহিয়ার মত সমর্থন করেন না। তিনি চান সকল ইয়াহিয়া সমর্থক সেখানে থাক, খাঁটি মুলসিম লিগার ও মুসলিম পূজারিরা সেখানে থাক। চাগ্লা সাহেব অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তার বিতর্কে এ কথা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমি বলব স্বীকৃতি দিলে কি লাভ হয়। স্বীকৃতি দিলে শুধু ভারতের অস্ত্রই যাবেনা, বিশ্বের এরূপ অনেক দেশ আছে যারা ভারত স্বীকৃতি দিলে, ভারতের দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে অস্ত্র দেবে। তাদের অস্ত্র পাঠাতে কোন অসুবিধা হবেনা। স্বীকৃতি দিলে সবচেয়ে বড় লাভ হবে এই যে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে মেনে নিচ্ছি এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা পেলে তার শক্তি স্বামর্থ্য বেড়ে যাবে। তাই আমি বুঝতে পারিনা আমাদের সরকার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে কেন স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। মুজিবুর রহমান মহাশয় বলেছেন আমাদেরকে স্বীকৃতি দিন। তার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বলেছেন আমাদেরকে স্বীকৃতি দিন। তাজউদ্দীন সাহেব বলেছেন আমাদের স্বীকৃতি দিন। তাদের পরিষদ সদস্য যারা এখানে এসেছেন তারা বলেছেন আমাদেরকে স্বীকৃতি দিন। তারা বলেছেন, পৃথিবীর অন্য দেশ আমাদের স্বীকৃতি দিক বা না দিক আমরা তো ভারতের ক্লের মধ্যে আছি, তিন দিক হতে আমরা ভারতের দ্বারা বেষ্টিত। এইজন্য ভারত আমাদেরকে স্বীকৃত দিক। এও তাদের বক্তব্য যে ২৩ বছর পূর্বে আমরা এক ছিলাম এবং আনাদের রক্ত এক। তাজউদ্দীন সাহেব এতদূর বলেছেন ভারত সরকার স্বীকৃতি দিতে যত দেরি করছেন তার ফলে এক এক দিনে হাজার হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটছে। তাজুদ্দিন সাহেবের একথা সত্ত্বেও ভারত সরকার বলেছেন আমরা তোমাদের স্বীকৃতি দেবনা।
শ্রী শিলা ভদ্র ইয়াজিঃ সরকার কোথায় একথা বলেছেন যে স্বীকৃতি দেবনা?
শ্রী রাজ নারায়নঃ হ্যা, এটি তো বলেছেন ভারত সরকার। নিজের দেশের স্বার্থে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কি হবে তা দেখে, যখন সময় হবে, তখন স্বীকৃতি দেয়ার কথা বিবেচনা করব। যাজী মহাশয়কে বলছি আপনার সঙ্গে আছি। কিন্তু প্রশ্ন এটিই যে, আজ আপনার ৫০ টাকার দরকার হল, তিনি বলেন, এখন তোমার দরকার নেই, তোমার কখন দরকার হবে সেটা আমি বুঝব। আশানুরূপভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ বলেছে আমাদেরকে অবিলম্বে সাহায্য দিন, এখনি স্বীকৃতি দিন, কে একদিনে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণপাত করতে হচ্ছে। কিন্তু ভারত সরকারের বক্তব্য হচ্ছে এখনো উপযুক্ত সময় আসেনি, ধৈর্যধারণ করো, যখন সময় হবে তখন স্বীকৃতি দেব। এখনো ভারত সরকার ভাবছেন যে কখন স্বীকৃতি দেবেন, কখন দেবেন না। যেখানে গ্রামের পর গ্রাম সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে গেছে, যেখানে কোন ফসল অবশিষ্ট নেই, যেখানে মানুষের খাবার নেই, সেখানের জন্য ভারত সরকারের বক্তব্য হচ্ছে স্বীকৃতি দেবার সময় হয়নি। … যখন পর্যন্ত সরকারের মাথায় এধরনের বুসশি থাকবে তখন পর্যন্ত ঐ সময় কখনো আসবেনা। একারণে বুদ্ধি ঠিক করার জন্য আমি ভারতের মানুষের কাছে আহবান জানাব হএ ভারতবাসী, ওঠো, ভারত সরকারকে চাপ দাও যাতে অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশ স্বীকৃতিলাভ করে এবং স্বীকৃত পেয়ে সে সর্বপ্রকার সহায়তা পায় এবং অন্যরাও তাকে সহায়তা দান করে। … আমি আজ আবার একটি পুরাতন বিষয় আপনাদের সামনে রাখতে চাই, হতে পারে সন্মানিত সদস্যগণ বিস্মৃত হয়েছেন। আমি ডঃ লোহিয়ার লেখা একটি কথা উদ্বৃত করছি। সে সময়ের চিন্তাধারা কি ছিল এবং আমাদের কাছে সময়ের চাহিদা কি আমরা সেটা জানতে পারব। ডঃ লোহীয়া মহোদয় লিখেছেন, একথা ভারতের জন্য প্রযোজ্য হয়না। কেননা ভারতের এমন কোন অংশ নেই যা তার স্বাভাবিক অঙ্গ নয় কিংবা তার থেকে আলাদা নয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের সৃষ্টি সম্পূর্ন কৃত্রিম, তার দুই অংশের মাঝখানে এক হাজার মাইল ভারতের ভূখণ্ড। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্ক টিকতে পারেনা। পূর্ব পাকিস্তান হয় পশ্চিম পাকিস্তানের দাশ হয়ে পড়বে নয়ত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্ক শিথিল হতে থাকবে এবং তাকে ভারতের প্রতিবেশীর ভূখণ্ডের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে এমন কোন সামরিক শক্তি নেই যে, সে পূর্ব পাকিস্তানকে দাশে পরিণত করবে, … প্রভাব নিঃসন্দেহে আছে কিন্তু কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে বলা যায়না। এরুন দাসত্ব অপেক্ষা স্বাধীনতার চিন্তা ভালো। ইতিহাসের পরিণতি হতে অব্যাহতি নেই। শ্রী শিল ভদ্র ইয়াজি মহাশয়, একটু শুনে রাখুন, ভারত যদি তাকে কোন সাহায্য নাও করে তথাপি পাকিস্তান সন্দেহ করবে এবং স্বাভাবিকভাবে বিকাশমান স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারটি ভারতের অপর চাপাবে। এখনি … ভাষা ও আমলাতন্ত্র (ণওকর শাহী) প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে কিছুটা বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে, আর সামনে হবে। এসকল বিবাদ বুদ্ধিমত্তার সাথে মীমাংসার পরিবর্তে পাকিস্তান হিন্দু-মুসলিম ও হিন্দুস্থান পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মারাত্মক পন্থা গ্রহণ করেছে।
শ্রী মহাবীর ত্যাগীঃ এটা কে লিখেছেন?
শ্রী রাজ নারায়নঃ ডঃ লোহিয়া।
জনৈক মাননীয় সদস্যঃ কবে লিখেছেন?
শ্রী রাজ নারায়নঃ ১৯৪৮ সালে। আপনি একটু মনোযোগ দিন, এটি ১৯৪৮ সালে লেখা হয়েছে। ১৯৪৮ সালেরই একটি ভবিষ্যতবানি আমি আবার করতে চাই।
মহোদয়, সন্মানিত সদস্যদের আমি একথাও বলব, ডঃ সকালেই সাবধানী উচ্চারণ করেছিলেন, পূর্ব বাংলা যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম করবে তখন ভারত সরকার তটস্থ থাকতে পারে কিন্তু ভারতের জনগণ যেন এখনি এরূপ অন্যায় না করেন। ডঃ লোহিয়া ভারত সরকার ও ভারতের জনগণকে আলাদা করেছিলেন। তিনি সাবধানী দিয়েছিলেন। ভারত সরকার সরে থাকতে পারে কিন্তু হে ভারতবাসী, ভারত সরকার যদি সরে থাকেন তবে আপনারাও অনুরূপ করবে না। সেটা মহা অন্যায়, স্বাধীন বাংলার সংগ্রামে আপনারা ত্যাগ স্বীকার করবেন।
মহোদয়, এই নিবন্ধের শেষের দিকে আছে ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগের কমাস পরে আমি বলেছিলাম তিনটির মধ্যে কোন একটি কিংবা তিন ভাবেই পাকিস্তানের অবসান হবে? আলোচনার মাধ্যমে সঙ্ঘিয় ঐক্য, ভারতের সমাজবাদী ক্রান্তি এবং পাকিস্তানের হামলার জবাবে ভারতের আক্রমণ। এই ভাষণে পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল মিস্টার জিন্নাহ চটে গিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীও সে সময় জীবিত ছিলেন। তার মৃত্যুর ফলে ঐক্যের সমস্ত ক্রম ভেঙ্গে গেছে, একারণ ছাড়া আমি এই মত পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন বোধ করিনা। যতটুকু বিলম্ব ঘটেছে তার দায় দায়িত্ব কট্টরপন্থী হিন্দুদের অপর। এটি তার মত।
মহোদয়, এখন আমি আপনার অনুমতি নিয়ে বন্ধু শ্রী শিল ভদ্র ইয়াজি, সরদার স্মরণ সিংহ এবং দীক্ষিত মহাশয়কে বলব, ইতিহাসকে ভুলে যাবেন না। যে প্রস্তাবে দেশ বিভাগ মেনে নেয়া হয়েছিল, তার মধ্যেও কি কোন অঙ্গীকার করা হয়েছিল? ১৪-১৫ জুন, ১৯৪৭ দিল্লী। গান্ধজি এ, আই, সি, সি ছিলেন। প্রস্তাবে আছেঃ কংগ্রেস – সে কংগ্রেস তো মরে গেছে, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারিতেই ঐ কংগ্রেসের মৃত্যু হয়েছে। যার নেতা ছিলেন গান্ধীজী – কংগ্রেস। তার জন্ম লগ্ন হতে একটি অখণ্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছে, তাকে পেতে লক্ষ লক্ষ নরনারী কষ্ট সয়েছে। আমাদের ভারত যাকে পৃথিবী, যাকে ইতিহাস, যাকে ভূগোল, সমুদ্র, পাহাড় এক সত্তা বানিয়েছে পৃথিবীর কোন বড় শক্তি তার ভাগ্য প্রতিহত করতে পারবেনা। যে ভারতের স্বপ্ন আমরা দেখেছি তা সর্বকাল সর্বক্ষন আমাদের হৃদয়ে ও ধ্যানে জাগরূক থাকবে। আমি স্মরণ সিংহ মহাশয়কে জিজ্ঞেস করব এর অর্থ কি? এর অর্থ হল এই যে, আমাদের ভারতের স্বরূপ তাই হবে আমরা যা অঙ্গীকার করেছিলাম ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ জুনে। …
আমি আবার আপনার মাধ্যমে একথা পুনরাবৃত্ত করতে চাই, আমাদের সংসদের কেন্দ্রীয় ভবনে রাষ্ট্রীয় সমিতির যে ৩ জন প্রতিনিধি এসেছিলেন তারা একথা বলেননি যে তাদের পক্ষে চিরদিনের জন্য পাকিস্তানের সমাধি হয়েছে? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কি একথা বলেন না, আর কোন শক্তি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এক করতে পারবেনা, আগের সম্পর্ক আর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর নয়। ইয়াহিয়া খানই পাকিস্তানের সমাধি ঘটিয়েছে। ইয়াহিয়া খাঁর সামরিক শক্তি পাকিস্তানকে খতম করেছে। অতএব আপনারা কেন ভয় পান যে পাকিস্তানের বিলোপ ঘটানোর কথা বললে আমরা কোন বড় পাপ করে ফেলব। আপন মনের দুর্বলতা ঢাকার জন্য জিনের অকর্ম্যন্যতা লুকানোর জন্য একথা বলা হয় আমরা তো পাকিস্তানকে মেনে চলি। অদিকে পাকিস্তান হতে পাখতুনিস্থান চলে যাচ্ছে বেলুচিস্থান চলে যাচ্ছে। সব কিছু আপন স্থানে এসে যাবে, এভাবেই ইতিহাসের পরিণতি হতে রেহাই পাওয়া যাবেনা।
এ প্রসঙ্গে আজ মুজিবুর রহমান কে শাস্তি দেবার কথা শোনা যাচ্ছে। আমি চাই এই পরিষদ (সদন) একই কণ্ঠে আওয়াজ তুলুন, সাবধান, তোমরা যদি মুজিবকে শাস্তি দাও, ফাঁসি দাও, তবে ভারতের নাগরিক নিজের ফাঁসি মনে করে সম্মিলিত শক্তিতে সারা বিশ্বে ফাঁসির কথা ছড়িয়ে দেবে যাতে মুজিবুর রহমান আমাদের মধ্য হয়ে হারিয়ে না যায়। মহোদয়, আমি বলতে চাই স্বাধীন বাংলাদেশকে যদি স্বীকৃতি দিয়ে দেয়া হত তাহলে কি মুজিবের ফাঁসির কথা উঠত? কখনোই উঠত না।
বাংলাদেশকে এযাবৎ স্বীকৃতি না দেয়ার পরিণতি আসছে, আজ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি দেয়ার কথা উঠেছে, মামলা চালানোর কথা হচ্ছে। এর দায় দায়িত্ব ভারত সরকারের। আমি বলতে চাই, স্বাধীন ভারতের শহীদগনের রক্তে কি ভারত সরকারের হাত রঞ্জিত হয় নি? আপনারা বলেছেন, শরনার্থি সমস্যা আছে। শরনার্থি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে ভারত সরকার স্বীকৃতি না দেয়ার ফলে। কেননা, ২৫ মার্চের পড় ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আমি এখনকার লোকদের সঙ্গে আলাপ করেছি – একজন শরনার্থিও আসেনি। ১৭ এপ্রিল মুজিবুর রহমানের সরকার মুজিবনগরে গঠিত হয়, সরকার গঠনের ঘোষণা হিয়এ গিয়েছিল। আমি ভারত সরকারকে বললাম এখনি স্বীকৃতি দিন, আপনারা বলতেন, সরকার কোথায়, কিন্তু সরকার তো এখন গঠিত হয়েছে। ভারত সরকার কোন জবাব দেননি। মহোদয়, দুঃখের সাথে আমাকে সয়ার চার্লস বেলস – এর মন্তব্য পুনরুল্লেখ করতে হচ্ছে, যা ১৯২৪ সালে তিনি বলেছিলেন। আমি আজ এ পরিষদের সন্মানিত সদস্যগণকে তার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যার কথা সরকার উপেক্ষা করেছেন তিনি বলেছিলেন, তিব্বত যদি চিনের কব্জায় চলে যায় তাহলে নেপাল, ভুটান ও সিকিম ভারত হতে মুখ ফিরিয়ে চিনের দিকে তাকাবে। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ আজ সংসদে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছেন। আজ যদি বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি না দেন এবং বাংলাদেশ ভারত হতে বিমুখ হয় তাহলে নেপাল ভুটান ও সিকিম কোথায় যাবে? নেপালের লোকেরা আমাদের সাথে লেখাপড়া করেছে, সেখানে যারা মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তারা সকলেই আমাদের সহপাঠী ছিলেন। আন্দোলনে জেলে তারা আমদের সঙ্গে ছিলেন। তারা সকলে আমাকে বলেন, যখন তোমরা শক্তিশালী হবে তখনই তো তোমাদের সঙ্গে থাকব। তোমাদের শক্তি নেই, আমরা কোথায় কাদের সঙ্গে থাকব। তোমাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের স্বার্থ রক্ষা কি করে হবে? আজ স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ ও সেখানকার নেতা বলেছেন হে ভারতবাসী, আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে না পেরে তোমরা নিজেদের স্বার্থই ক্ষুণ্ণ করেছ। অতএব আমি বিনা দ্বিধায় বলতে চাই বাংলাদেশের উপর যে আক্রমণ হয়েছিল তা সোজাসুজি ভারতের ওপরই হয়েছে, ভারতের অকপটে বলা উচিৎ এই আক্রমণ ভারতের ওপর হয়েছে। এতে সাম্প্রিদায়িকতা কীভাবে আসে?
মহোদয়, আমি আপনাকে বলতে চাই, স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের সমস্ত সমস্যার সে সমাধান বেড় করেছে তাকে আর নষ্ট হয়ে দেওয়া ঠিক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবুর রহমানের আওয়ামী পার্টি সবচেয়ে বড় পার্টি এবং আমাদের স্বার্থের বড় রক্ষক। বাংলাদেশের মানুষ চিৎকার করে বলছে ধর্ম রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারেনা। হিন্তু ও মুলসিম একে অন্যের গলা কাঁটার জন্য সৃষ্টি হয়নি। ভ্রষ্ট ও দুষ্ট মস্তিষ্কের মুসলমান মুসলমানের গলা কাটবে এবং হিন্দুর গলা কাটবে। ভ্রষ্ট ও দুষ্ট মস্তিষ্কের হিন্দু হিন্দুর গলা কাটবে এবং মুসলমানের গলা কাটবে। এক মায়ের পেট হতে যাত দুই সহোদর ভাই একে অন্যের গলা কাটে। বিভিন্ন মায়ের সন্তান পরস্পরকে বোধ করে। এজন্য আমি পরিষদের মাধ্যমে ভারতের মুসলমানগনের কাছে আবেদন জানাচ্ছ, এখানে যে সাড়ে ৬ কোটি মুসলমান আছেন তারা কি ইসলামে বিশ্বাস রাখেন না? ইয়াহিয়া খান সাহেব কি ইসলামে বিশ্বাস রাখেন না? একজন মুলসিম মাতার সন্তান ইয়াহিয়া খাঁ, আরেক মুসলিম মাতার সন্তান মুজিবের গলা কাটছে, ওখানে তারা বলছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী, আর এখানে সাড়ে ৬ কোটি মুসলমান আছে। আমার বক্তব্য হল, ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যরা আমাদের মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যাদের ওপর বলাৎকার করছে, দিনে দুপুরে করছে। পথে- ঘাঁটে করছে, আমি জানতে চাই এরা কি ইসলাম শেখাচ্ছে? … ইসলাম বিশ্বাসী।
যারা আজ মুজিবের ওপর আওয়ামীলীগের ওপর, বাংলাদেশের মুসলমানদের ওপর ইয়াহিয়া কর্তৃক ছড়ান এই গজবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেনা তারা মুসলমান নয়। তাদের মুসলমান বলে দাবী করার অধিকার নেই। যদি মুসলমান থাকে তাহলে সাড়ে ৬ কোটি মুসলমানের ইজ্জত আজ বিপদ জনক হুমকির সম্মুখীন, তাদের স্ত্রী কন্যা আমাদেরই স্ত্রী কন্যা। তাদের দেশের মুসলমান আমাদেরই মুসলমান, আমি তো মনে করি তারা আমাদেরই। সম্প্রদায়বাদের স্রোতের মধ্যে থেকে তারা স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধিতা করছে, স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছে। এইজন্য আমি বলব আল্লাহর ওয়াস্তে ঈশ্বরের জন্য, মানবের জন্য, মানবতার জন্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন।
এব্যাপারে আমি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে, উথান্ট ও সকল বিদেশী দূতাবাসের কাছে, সকল রাজনৈতিক দলের কাছে পত্র লিখেছি।
শ্রী অর্জুন অরোরাঃ একটু পড়ে শোনান –
শ্রী রাজ নারায়নঃ অন্য কোন দিন পড়ে শোনাব। আমি লিখেছি, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আপনাদের সরকার এগিয়ে আসছে না কেন? আপনারা কেন অগ্রবর্তি হচ্ছেন না?
মহোদয়, ৯ আগস্ট ১৯৪২ সালে আমরা ইংরেজদের … স্বীকার নিয়েছিলাম। ইংরেজ সামাজ্যবাদের অবসান ঘটানোর জন্য আমরা চিরদিনের জন্য ‘কিতাববন্দ’ করে দিয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট আমরা ইয়াহিয়া খাঁর … স্বীকার করে নিয়ে সক্রিয়ভাবে তার বিরোধিতায় অনশন করার ঘোষণ দিয়েছি। … ১ এপ্রিল, ২ এপ্রিল, ৩ এপ্রিল আমন কোন দেইন যায়নি যেদিন আমরা বাঙ্গালদেশের প্রশ্ন তুলিনি। ২ এপ্রিল আপনার সত্যাগ্রহ করেছি। এই সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আমরা যত উপায় ও সাধন ছিল সবই প্রয়োগ করেছি, এখন আপনিই বলুন আমরা কি করব। শ্রী শিলা ভদ্র ইয়াজির ভাষণে জনগণ এমন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন যে ভারত সরকারকে আর প্রভাবিত করতে পারেন না। এরূপ একটি বৃহৎ ও সঠিক কার্য করার জন্য আমাদের পূর্ন অধিকার আছে, ৯ আগস্ট আমরা অনশন শুরু করব। আমি বিনয়ের সাথে বলছি যে আমরা কারো সাথে চ্যালেঞ্জ করছিনা। আমরা কারো ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য কোন কাজ করিনা। আমার পত্রে আমি লিখেছি, প্রধানমন্ত্রীকেও লিখেছি যে আমরা নিজেদের মধ্যে আত্মশক্তি সৃষ্টির জন্য, দেশের নাগরিকদের মধ্যে আত্মশক্তি সৃষ্টির জন্য, এই পুণ্য কাজ করতে যাচ্ছি। এই পরিষদের সন্মানিত সদস্যগণের মধ্যে যারা সত্যিকারভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রিদানের পক্ষপাতী সর্বতোপায়ে তাকে সহায়তা দানের পক্ষপাতি, এবং বাংলাদেশের গণহত্যা ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন ও সহানুভূতি সম্পন্ন তাদের উচিৎ শুধু মৌখিক সহানুভূতি না দেখিয়ে সক্রিয়ভাবে কিছু করা। … ভারত সরকার এযাবৎ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য আমি তাকে নিন্দা করি। আমি আরও বলব এই সরকার দেশ হিতের ভাবনা মুক্ত। আনন্দফুর্তির জীবন সে যাপন করছে। এই জীবন শেষ হয়ে না যায় এই তার চিন্তা। এদেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমি ভারত সরকারের নিন্দা করছি আজ এই শেষ সময়ে আমি সরদার স্মরণ সিংহ মহাশয়ের মুখ থেকে এ বানিই আশা করছি যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, সাহায্য করছেন, এবং বিশ্বের সকল দেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য আহবান জানাচ্ছেন।
হায়াতুল্লাহ আনসারিঃ ডেপুটি চেয়ারম্যান সাহেব, এখানে একটি কথা এসে গেছে যা আমি আগে ভাবিনি। সেটি হচ্ছে রাজ নারায়ণ বাবুর মন্তব্য যে মুসলমান সহযোগিতা করবেনা।
শ্রী রাজ নারায়ণঃ আমি বলিনি।
হায়াতুল্লাহ আনসারিঃ তিনি বলেছেন মুসলমান সহযোগিতা করবেনা।
শ্রী রাজ নারায়ণঃ বৈধতার প্রশ্নে আমি বলিনি, তবুও মাননীয় সদস্য বলে যাচ্ছেন যে আমি বলেছি। আমি এই বলেছি যে যেসকল মুসলিম আজ তাদের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয় এবং আজ স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে ৬ কোটি মুসলমানের ওপর যে অত্যাচার চলছে সে কারণে যেসকল মুসলিমের মনে আগুন জ্বলে না তারা মুসলমান নয়।
হায়াতুল্লাহ আনসারিঃ আমি রাজ নারায়ণ বাবুকে জিজ্ঞেস করতে চাই, এমন কি উপায় বেড় করা যায় যার দ্বারা মুসলমানগন দেখতে পারবে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের ইম্প্রেশন আর সকলের অনুরূপ। দেখুন, এ প্রশ্নে আমরা খুব সিরিয়াসলি চিন্তা ভাবনা করেছি। আমরা চাই মুসলমানদের একটি মহা সম্মেলন ডাকা হোক। কিন্তু আমিষ এই সাথে বলছি কনভেনশন আয়োজনের মত অর্থ আমাদের কাছে নেই। বাংলাদেশের ব্যাপারে আমরা কারো চেয়ে পেছনে নেই। এখানে এটা দেখানোর জন্য মানুষ মাদ্রাজ হতে, দক্ষিণ ভারত হতে, বাংলা হতে পায়ে হেটেও আসতে পারে। এখানে যে কথা উঠেছে তা অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ন। কিন্তু আপনারাই বলুন, কোন রাজনৈতিক ইস্যুতে দিল্লী বা অন্য কোথাও সারা ভারতের মুসলমানদের সমাবেশ ঘটানো কি উচিৎ হবে? এ প্রশ্নে আমি সারা জীবন বিরোধিতা করে এসেছি, রাজনৈতিক ইস্যুতে মুসলমানদের ঐক্য হওয়া উচিৎ নয়। অতএব আমরা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলতে পারিনা। …
শ্রী সুন্দর সিংহ ভাণ্ডারীঃ আপনার যদি এখন বন্ধ করে দেই তাহলে তার বক্তব্য অসম্পূর্ন রয়ে যাবে।
শ্রী পীতাম্বর দাসঃ যদি আমাদের বন্ধ করতেই হয়ে তাহলে তার বক্তব্য অসম্পূর্নই থাকুক।
মিস্টার ডেপুটি চেয়ারম্যানঃ যদি হাউজের ইচ্ছা হয় তাহলে আমার কিছু বলার নাই। এটা একজন প্রাইভেট সদস্যের রেজোল্যুশন – অতএব আমরা এটা আজকের দিনের জন্য বন্ধ করতে পারি। হাউজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই অধিবেশন আগামী সোমবার ২ রা আগস্ট ১৯৭১ সালের সকাল ১১ টা পর্যন্ত মুলতুবি থাকবে।
পরবর্তিতে হাউজ ২ আগস্ট ১৯৭১ তারিখে সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত মুলতুবি থাকে।