You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০২। পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের অবিরাম সরবরাহ এবং তার ফলশ্রুতির উপর আলোচনা রাজ্য সভার কার্যবিবরণী ১৯ জুলাই, ১৯৭১

জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব
পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের অবিরাম সরবরাহ এবং তার ফলশ্রুতি

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত (পশ্চিম বঙ্গ): মাননীয় চেয়ারম্যান, আলোচনা শুরূ করার আগে আমি একটি ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। যখন রাজ্য সভা মুলতুবি ছিল, সেই সময় আজকের আলোচ্য বিষয়ে লোক সভায় আনুষ্ঠানিক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজ্য সভায় শুধু একটি মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাব যথেষ্ঠ নয়। তাই আমি প্রস্তাব করতে চাই যে এই মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা প্রস্তাবে রুপান্তর করা হোক। আপনি জানেন যে মাননীয় বিদেশ মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং এই সভায় একটি বিবৃতি পাঠ করেছিলেন, কিন্তু কোন আলোচনা হবার আগেই সভা মুলতুবি হয়ে যায়। যেহেতু এই ব্যাপারে লোক সভায় যথেষ্ঠ সময় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেহেতু আমাদের ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ করার লক্ষে আমি চাইছি অতীতের অনেক প্রস্তাবের মত এই মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবটিকেও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা প্রস্তাবে রুপান্তর করা হোক।

শ্রী গড়াই মুহুরী ( উত্তর প্রদেশ): মাননীয় চেয়ারম্যান, আমিও শ্রী ভূপেষ গুপ্তের প্রস্তাব সমর্থন করছি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিগত কয়েকদিনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, এবং এসবের উপর রাজ্যসভায় একটি সার্বিক আলোচনা হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং চীনের সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে এবং এই পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে আমাদের উচিত মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবের পরিবর্তে এই ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা।

চেয়ারম্যান মহোদয়: আমি আপনাদের কথা শুনছি।

শ্রী কৃষ্ণকান্ত ( হরিয়ানা): আমাদের মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপন এবং পূর্ণাঙ্গ আলোচনা দুই ই করা উচিত।

শ্রী ওম মেহতা ( মাননীয় সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী): প্রথমে মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হোক, তার পর আমরা একটা সময় বের করে এই ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করব।

শ্রী নিরেণ ঘোষ (পশ্চিম বঙ্গ): একটা সময় বলতে আপনি কি বুঝাতে চাইছেন? এই বিতর্ক আজই হতে হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: এটি সময় খুঁজে বের করার প্রশ্ন নয়, এ ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা হওয়া উচিত। আজ অথবা আগামী কাল।

কিছু মাননীয় সাংসদ: না, না।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: এটি খুব সহজে আজকেই হতে পারে। যেহেতু মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাব এবং আলোচনার বিষয়বস্তু একই, সেহেতু সহজেই মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটিকে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় রুপান্তর করে ফেলা যায়। আতীতে এরকম অনেক নজীর আছে। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির অনর্থক।

চেয়ারম্যান মহোদয়: আমি একটি প্রস্তাব নিতে চাই। আলোচ্য বিলটা নিষ্পত্তি হয়ে যাবার পর এ ব্যাপারে আজকেই একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে পারে।

শ্রী শরণ সিং ( মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী) : আমি এই ব্যাপারে আলোচনার জন্য সংসদের উৎসাহ অনুধাবন করতে পারছি, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ব্যাাপারে লোক সভায় আজ এবং আগামীকাল পূর্ব নির্ধারিত বিতর্ক আছে। সুতরাং এই দুই দিন আমি লোক সভায় ব্যাস্ত থাকব। আমি আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চাইনা, কিন্তু আজ এবং আগামীকাল আমি উপস্হিত থাকতে পারব না।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মাননীয় মন্ত্রী উপস্হিত না থাকলে এ ব্যাপারে আলোচনার কোন অর্থ নেই। আমি যতটুকু জানি, লোকসভায় মাননীয় মন্ত্রী শুধু বিতর্ক শুনবেন, কোন আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন না। বিতর্ক শোনা যদি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে ….

শ্রী নিরেণ ঘোষ: লোকসভায় আজ গুজরাট এবং পান্জাবের বিল নিয়ে আলোচনা হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি প্রস্তাব করছি রাজ্যসভায় আজ এ ব্যাপারে আলোচনা হবে এবং মাননীয় মন্ত্রী লোকসভায় না যেয়ে আমাদের আলোচনায় উপস্হিত থাকবেন।

শ্রী ওম মেহতা: এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র সংসদের।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটি উত্থাপন করা হচ্ছে। আমি পাকিস্তানে আমেরিকা এবং চীনের অস্ত্র সরবারাহ এবং এর ফলশ্রুতির ব্যাপারে মাননীয় বিদেশ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

চেয়ারম্যান মহোদয়: শ্রী গুরুপদস্বামী এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছেন।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী (মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা) : আমি শুধু বলতে চাই যে আজকে আলোচনা না করে আমরা আরেকটি দিন ঠিক করে এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে পারি। মাননীয় সাংসদের মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটি উত্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু সাধারণ আলোচনা আজকে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত হবেনা।

চেয়ারম্যান মহোদয়: সেটা বিবেচনা করা যাবে। ততক্ষণে মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটি উত্থাপন করার প্রক্রিয়া চলতে থাকুক।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি ইতিমধ্যে মাননীয় বিদেশ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।

[ ডেপুটি চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে আলোচনা শুরু হচ্ছে ]

সর্দার শরণ সিং: আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে এই সংসদে সর্বশেষ যে আলোচনা হয়েছিল, তারপর এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। আমাদের কাছে সংবাদ আছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জনসমক্ষে যা বলছে, তার চেয়ে অনেক বেশী অস্ত্র পাকিস্তানে চালান হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ৮ জুলাই ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সূত্রে জানা যায় যে গত ৫ বছর ধরে পাকিস্তানের কাছে গড়ে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। সিনেটর চার্চ বলেন যে আনুমানিক ৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চালানের অপেক্ষায় আছে। আমাদের মতে তার হিসাবটাই বাস্তবের কাছাকাছি। শুধুমাত্র ডলার মূল্যটাই ঘটনার তাৎপর্য বোঝার জন্য যথেষ্ঠ নয়, অতীতে পাকিস্তানের কাছে অনেকবারই নাম মাত্র মূল্যে অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছে। খুচরা যন্ত্রাংশ, যেগুলোর মূল্য অত্যন্ত কম; সেসবও পুরোনো মারণাস্ত্রকে আবার সচল করে তুলতে পারে। আমি সংসদকে আশ্বস্ত করতে চাই যে অস্ত্র সরবারের ব্যাপারে আমাদের প্রতিক্রিয়া মার্কিন সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। আমরা তাদের বিস্তারিতভাবে জানিয়েছি যে এই অস্ত্র সরবরাহ উপমহাদেশের শান্তি এবং সমৃদ্ধির প্রতি হুমকি এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে তা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে।

কোন দেশ যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটা বাংলাদেশে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া হিসাবে গণ্য হবে এবং পাক সামরিক জান্তা কতৃক বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণের নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের বক্তব্য এবং সংবাদ পত্রের খবর ছাড়া আমাদের কাছে আর কোন তথ্য ছিলনা, তাই মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। মাননীয় মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখে আমার বলতেই হচ্ছে যে আমি অত্যন্ত হতাশ।

প্রথমত, তিনি বলেছেন যে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া মানে তাদের সহায়তা করা, কিন্তু তিনি পৃষ্ঠপোষকতা শব্দটা ব্যাবহার করছেন না। বাস্তব অর্থে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া মানে গণহত্যার সরাসরী অংশিদার হওয়া, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঠিক সেটাই করছে। অথচ মাননীয় মন্ত্রী শুধু সহায়তা শব্দটি ব্যাবহার করছেন। আমি অবাক হচ্ছি যে সরকার এটা বলতে পারছেনা যে পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়া মানে গণহত্যায় প্রতক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা। এটা গণহত্যার আন্তর্জাতিক নীতি, জাতিসংঘের সনদ এবং মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন এবং যুক্তরাষ্ট্র এসব লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী। পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ নেয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারের রাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশল কি? এ ব্যাপারে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এ কথা কি সত্য নয় যে ১৯৫৪ সালে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সাক্ষর হবার পর ফজলুল হকের সরকারকে
উচ্ছেদের লক্ষে (যে সরকারের শেখ মুজিবও মন্ত্রী ছিলেন) পাকিস্তানে প্রায় ২৫০০ মিলিয়ন ডলার, প্রায় ২০০ কোটি রুপি সমমূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে?

এটা কি সত্য নয় যে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তথাকথিত সামরিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা সত্বেও ইরান, পশ্চিম জার্মানী, স্যান্টো এবং ন্যাটোর সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে গিয়েছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা জানতে পারছি যে ৬৬ এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে শুধু অস্ত্র সরবরাহই করেনি, বর্তমানে সেই সরবরাহের মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

আজকের সংবাদপত্রে আমরা জানতি পারছি যে পাকিস্তান শুধু খুচরা অস্ত্র নয়, কামানও আমদানি করছে। এমতাবস্হায় আমি সরকারের নীতি কি সে ব্যাপারে জানতে চাই। একজন সিনেটরের উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন যে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহের অপেক্ষায় আছে। এই পরিমাণ আসলে আরো বেশী, উনি সেটা উল্লেখ করেন নি। এই অস্ত্র সরবরাহ সরাসরি নিক্সনের নির্দেশে ঘটছে। ইডাহোর জনৈক সিনেটর মার্কিন সিনেটে এরকমই বলেছেন এবং তার বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ করা হয়নি। সত্যি কথা বলতে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক একরকম স্বীকারই করে নিয়েছে যে নিক্সনের নির্দেশেই অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। অনেকটা কোম্পানির পরিচালককে মাসে ১ রুপী বেতন দেয়ার মত অবস্হা। যুক্টরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র উপহার দিচ্ছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে তারা গণহত্যার প্রত্যক্ষ অংশীদার, বরং এই প্রশ্নও তোলা যায় যে তারা কি ভারতকে যুদ্ধের জন্য উষ্কানি দিচ্ছেনা? অস্ত্র আসার সাথে সাথে পাক বাহিনীর হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি কলকাতা থেকে এসেছি, সেখানে মানুষ বলাবলি করছে যে মার্কিন অস্ত্র পেয়ে পাক বাহিনীর হামলার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনকি তারা আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘন করে উস্কানিমূলকভাবে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে। এমতাবস্হায় মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য নিম্নরুপ:

“আমি সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে কিছু দেশে গিয়েছে এবং সেসব সরকারের সাথে যেসব ঐক্যমতে পৌছেছি তা হচ্ছে:”

(১) “পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সামরিক সমাধান নেই, অবিলম্বে সেখানে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে। “

কিন্তু সংসদে এসে আমরা মাননীয় মন্ত্রী মারফত জানতে পারছি যে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবারহ বন্ধ হয়নি, বরং এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

(২) “পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থী আসা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। “

বাস্তবে শরণার্থী আসার সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে। গতকাল আমি কলকাতা থেকে জানতে পেরেছি যে এখনো প্রতিদিন ৩০, ০০০ করে নতুন শরণার্থী ভারতে ঢুকছে।

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ৩য় অংশ ছিল, শরণার্থীদের দেশে ফেরার নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। কসাই ইয়াহিয়াকে মারণাস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র কি সেই পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করছে?

চতুর্থত মাননীয় মন্ত্রী রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন। সংসদে তার বক্তব্যের পর ২৯ জুন ইয়াহিয়া বিশ্ববাসীকে ভাষণ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কি ধরনের সমাধানে বিশ্বাস করেন। আমি এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চাইনা। মার্কিন সরকার বিশ্ববাসীকে জানিয়েই অস্ত্র সরবরাহ করছে। এমতাবস্হায় রাজনৈতিক সমাধান কিভাবে আসবে?

পঞ্চমত, বর্তমানে এখানকার পরিস্হিতি খুবই নাজুক। আমেরিকান অস্ত্র এসে পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের করণীয় কি? মাননীয় মন্ত্রী সংসদে বলেছেন যে যখন পূর্ণাঙ্গ বিতর্ক হবে, তখন তিনি তাঁর অবস্হান ব্যাক্ত করবেন। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন চুক্তির কথা শুনতে চাইনা, হয় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকান্ডের উপযুক্ত প্রতিবাদ করুণ অথবা স্বীকার করে নিন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আরো দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ২৫শে জুন সংসদে বক্তব্য দেয়ার পর পরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার সাথে মাননীয় মন্ত্রীর বয়ানের কোন মিল নেই। তাই আমি বলতে চাই যে, সরকার আসলে আমেরিকার ভয়ে ভীত, তারা এটা প্রকাশ্যে বলতে ভয় পায় যে মার্কিন নীতি এই অঞ্চলের শান্তি ও ভারসাম্য নষ্ট করছে। আমি জানতে চাই যে তিনি এখনো কেন যুক্তরাষ্ট্রকে বলছেন না যে এই অস্ত্র সরবরাহ শুধু বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ নয়, ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। মার্কিন এই কর্মকান্ড পরিষ্কারভাবেই যু্দ্ধের উষ্কানি। পাক সেনারা সীমান্তের ওপার থেকে আমাদের যু্দ্ধের জন্য উষ্কানি দিচ্ছে। তাই মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য কোন সামরিক বা রাজনৈতিক নির্দেশনা বহন করেনা। আমেরিকা অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে …..

( সময় শেষের ঘন্টা) আমি শেষ করছি …..

সরকারের উচিত নিজের অবস্হান পরিষ্কার করা। আমি সরকারের কাছে আর্জি জানাই যে তারা যেন একটু মেরুদন্ড শক্ত করে, একটু সাহস প্রদর্শন করে। শুধু মিঃ এল কে ঝা এর বক্তব্যের উপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবেনা, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূত হবার অনুপযুক্ত। আমি বিশ্বাস করি যে তিনি আমাদের মাননীয় মন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করছেন। মাননীয় মন্ত্রী মাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছেন, তাঁর কাছ থেকে আমি রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা জানতে চাই। এত খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রে দূতাবাস চালানো হচ্ছে, কিন্তু সেখান থেকে শুধু খবর আসছে যে আমেরিকা পাকিস্তানে অস্ত্র চালান করছে এবং দাবী করছে যে তারা নাকি অত্র এলাকার শান্তি রক্ষার্থেই এটা করছে। বিষয়টাকে গুরুত্বসহকারে নিতে হবে, অবিলম্বে মিঃ ঝাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তিনি সম্পূর্ণরুপে ব্যার্থ হয়েছেন। সর্বাগ্রে এই কাজটাই করতে হবে।

দ্বিতীয়ত আমেরিকার কর্মকান্ডকে ভারতবিরোধী হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। আমাদের কূটনীতি ব্যার্থ হয়েছে। আমেরিকার যাবতীয় কর্মকান্ড ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উষ্কানি হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, এবং তাদের গণহত্যার সহকারী, জাতিসংদ সনদ, মানবাধিকারের সনদের লঙ্ঘনকারী এবং পাক-ভারত যুদ্ধের অনুঘটক হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে হবে। মিন মিন না করে শক্ত হাতে পরিস্হিতি দমন করতে হবে, এটাই আমার দাবী। আমি জানিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেন শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে কলকাতায় এসেছেন। শরণার্থীদের সাথে মিঃ কিটিঙের ছবি দেখে আমি লজ্জিত হয়েছি। তাকে কে কলকাতায় আসার অনুমতি দিয়েছে? আমেরিকানরা কলকাতা বিমানবন্দর, ত্রিপুরা বিমানবন্দরের ছবি তুলছে। আমি কি জানতে পারি যারা গণহত্যার সরাসরি সহযোগী তাদের প্রতিনিধিদের কেন শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে কলকাতায় পাঠান হচ্ছে? আমি অত্যন্ত অবাক, তাকে লাথি মেরে পশ্চিম বঙ্গ থেকে বের করে দেয়া উচিত। আমি জনতার কাছে অনুরোধ জানাব যে আমেরিকার কৃতকর্মের জন্য যেন তাদের রাষ্ট্রদূতকে লাথি মেরে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।

তার উপস্হিতি আমাদের জনগণের জন্য অপমানের। যে দেশের কারণে ভারতে লাখে লাখে শরণার্থী আসছে, আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার সেই দেশেরই রাষ্ট্রদূত কিটিঙকে শরণার্থীদের সাথে দেখা করার অনুমতি দিচ্ছেন। আর রাষ্ট্রদূত লোক দেখান ভাব করছেন যেন তিনি শরণার্থীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। মার্কিন সরকারের এটি এক ধরণের দ্বিমুখী নীতি। মিঃ কিটিঙকে বলুন তিনি যেন দিল্লীর বাইরে না যান। আপনারা তাকে দেশে ফেরত যেতে বলতে পারেন, কিন্তু কোন অবস্হায়ই উদ্বাস্তুদের সাথে দেখা করতে কলকাতায় পাঠাতে পারেন না। আমি কখনো এমন মেরুদন্ডহীন নীতি দেখিনি। আমেরিকা পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করছে, আমাদের বলা হচ্ছে যে পরিস্হিতি যেকোন দিকে মোড় নিতে পারে। অথচ তাদের রাষ্ট্রদূতের সাথে চরম রকমের বন্ধুসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই, মন্ত্রীসভায় এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য জোর দাবী জানাই। আমাদের আবার ১৯৬৫ সালের পরিস্হিতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে জোর ভূমিকা পালন করছে। তাই সাথে কূটনীতির ব্যাপারে জনগণের অনুভূতির কথাও বিবেচনা করতে হবে। আমরা যুদ্ধ চাইনা, আমরা কোনরকমের সামরিক ব্যাবস্হা নিতে চাইনা। কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে চাই। এবং বাংলাদেশকে অবশ্যই স্বীকৃতিদান করতে হবে। এই দুটি জিনিষ যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: আপনি যথেষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছেন।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি শেষ করছি। আমি পরে আরো বলব। সরকারের তরফ থেকে কোন ধরণের শক্ত ব্যাবস্হা নেয়ার আশ্বাস পাচ্ছিনা। আমি জানতে চাই ঠিক কি কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করা হচ্ছেনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহায়তা করা হচ্ছেনা। এ বিষয়গুলো মাননীয় মন্ত্রীর পরিষ্কার করা উচিত।

শ্রী নিরেণ ঘোষ : মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, তারা আমাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেন, কিন্তু আমাদের কথা শোনেন না।

সর্দার শরণ সিং : আমরা সেই দলের ভূমিকার কথাও জানি, মাননীয় সাংসদ যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্ক্সবাদী কমুনিষ্ট পার্টি।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, রাজ্য সভার বিরতীকালে তার মনের ভেতর যত কথা-ক্ষোভ জমা হয়েছিল শ্রী গুপ্ত আজ তার পুরোটাই বলে দিয়েছেন। একটি বক্তব্যেই তিনি সব বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে দিয়েছেন, মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবের সাথে প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক। এবং তিনি সম্ভবত সাধারণ আলোচনার জন্য যে বক্তব্য তৈরি করেছিলেন, তার পুরোটাই এই সুযোগে দিয়ে দিয়েছেন।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মাননীয় সভাপতি, আমি গতকাল মাঝরাতে কলকাতা থেকে এসেছি এবং আজ সকালে এই দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাবের কথা জানতে পেরেছি। আমার বক্তব্য কোন প্রস্তুতি ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবেই দেয়া।

সর্দার শরণ সিং: আপনার কোন লিখিত বক্তব্যের প্রয়োজন নেই, আপনার মাথার ভেতরেই সব থাকে।

শ্রী নিরেণ ঘোষ : শ্রী ভূপেষ গুপ্তের বক্তব্যের সাক্ষী আমি, আমরা একই বিমানে এসেছি।

সর্দার শরণ সিং: কিন্তু আপনারা কলকাতার এক জায়গা থেকে আসেন নি।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, মাননীয় সাংসদের বক্তব্যের জবাব দিতে হলে আমাকে একটি পাল্টা বক্তব্য দিতে হবে, সেটা করা থেকে আমি বিরত থাকছি। আমি বিশেষভাবে শুধু কিছু পরামর্শের জবাব দিতে চাই। তিনি আমার সাথে কোন বিষয়ে কথা বলেননি, অথচ অত্যন্ত জোরালভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন।

শ্রী এ জি কুলকার্নী (মহারাষ্ট্র): মিঃ এল কে ঝায়ের পরিবর্তে আপনি কেন উনাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন না?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র (উড়িষ্যা): উনি মন্ত্রীসভার বৈঠকের কথা বলেছেন।

সর্দার শরণ সিং : আমি তার কিছু কথার জবাব দিতে চাই। মিঃ ঝা কে ফিরিয়ে আনার যে পরামর্শ উনি দিয়েছেন, সেটি আমি প্রত্যাক্ষান করতে বাধ্য হচ্ছি। এ প্রসঙ্গে আমি আমার আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করতে চাই, মিঃ ঝা সুচারুভাবেই তার দায়িত্ব পালন করছেন ….

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি এই কথার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এরকম প্রশংসাবাক্য পাওয়ার মত কোন কাজটা মিঃ ঝা করেছেন?

মিঃ ঝায়ের একমাত্র গুন হচ্ছে তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন হিসাবে পরিগণিত হতে পেরেছেন।

সর্দার শরণ সিং: একটি রাষ্ট্রের কর্মকান্ডের জন্য সবসময় সেই রাষ্ট্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে দায়ী করা যায়না। এরকম দোষারোপ করা সম্ভবত এই সংকট মোকাবেলা করার উপযুক্ত পন্হা নয়। আর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে আরো কঠোর ভাষা ব্যাবহার করতে বলেছেন। আমার মতে যথেষ্ঠ কঠোর ভাষাই ব্যাবহার করা হয়েছে, যদিও তা মিঃ গুপ্তের মত এত কঠোর নয়।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: উনি কি জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন সম্পর্কে অবহিত? যে ভাষাই ব্যাবহার করা হোক না কেন গণহত্যায় সাহায্য করার অর্থ সমগ্র বিশ্বেই অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।

সর্দার শরণ সিং : আমার বক্তব্যের শেষ অংশে আমি পরিষ্কারভাবেই বলেছি যে কোন দেশ যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটা বাংলাদেশে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া হিসাবে গণ্য হবে এবং পাক সামরিক জান্তা কতৃক বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণের নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত হবে। মিঃ গুপ্ত যদি একটু ধৈর্য নিয়ে অভিধান খুঁজে দেখেন, তাহলে দেখবেন তাঁর আর আমার শব্দ চয়নে অর্থের কোন পার্থক্য হয়নি। আমার মতে ভাবার্থ ঠিক থাকলে কোন একটি বিশেষ শব্দ চয়নে তিনি আমাকে বাধ্য করতে পারেন না, নিজের পছন্দসই শব্দ ব্যাবহারের অধিকার আমার থাকা উচিত।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: তাঁর আর আমার ব্যাবহৃত শব্দসমূহের ভাবার্থ এক নয়। প্রশ্রয় দেয়া আর প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া
এক জিনিষ নয়, অনেক কিছুতেই প্রশ্রয় দেয়া যেতে পারে যেটা আইনের দৃষ্টিতে সরাসরি অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়না। যে মুহূর্তে আপনি প্রত্যক্ষ মদদ শব্দটা ব্যাবহার করবেন, তখনই সেটা জাতিসংঘ সনদের আওতায় চলে আসবে।

সর্দার শরণ সিং : তাঁর তৃতীয় প্রশ্ন ছিল মিঃ কিটিঙ কেন কলকাতা বা পশ্চিম বঙ্গে গিয়েছেন …..

শ্রী চিত্ত বসু (পশ্চিম বঙ্গ): এবং তাকে কেন লাথি মেরে বের করে দেয়া হবেনা।

সর্দার শরণ সিং : আমাদের আরেকটু ভদ্রোচিত আচরণ করা উচিত। প্রশ্নটা ছিল তাকে কেন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে করতে কলকাতায় আসার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমাদের সরকারের নীতিই হচ্ছে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূত, সংসদ সদস্য এবং সংবাদ মাধ্যম বিনা বাধায় শরণার্থী শিবিরে যেতে পারবেন এবং তাদের সাথে কথা বলতে পারবেন। আমি আপনাকে এটাও বলতে পারি যে যে ব্যাক্তিই শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন এবং উদ্বাস্তুদের দুঃখ-কষ্ট নিজ চোখে দেখেছেন, তারা সবাই সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হিসাবে ফেরত এসেছেন। আমাদের কোন কিছু লুকানোর নেই, কোন একজন রাষ্ট্রদূত শরণার্থী শিবিরে যাবেন, তাদের অবস্হা নিজের চোখে দেখবেন, তাদের দুঃখ-কষ্টের কাহিনী শুনবেন- এতে আমি আপত্তির কোন কারণ দেখিনা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের আমরা পরিষ্কারভাবে আমাদের অনুভূতির কথা জানিয়েছি, আরো জানিয়েছি যে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অস্ত্র এখানে গণহত্যার কাজে ব্যাবহৃত হচ্ছে এবং পাক বাহিনীকে আরো নির্মম হয়ে উঠতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার মানে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের আক্রমণাত্নক নীতিকে উৎসাহ যোগানো এবং ভারতের নিরাপত্তার উপর হুমকি সৃষ্টি করা- এই নীতি অটল রাখতে আমরা সবসময়ই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। সম্মানিত সাংসদ হয়তো একথাই বলতে চেয়েছিলেন, আমরা কিন্তু ইতিমধ্যেই তা করে ফেলেছি। আমরা এ ব্যাপারে মন্ত্রীসভার একটি বৈঠক আয়োজনেরও প্রস্তাব করেছি। আমি শ্রী ভূপেষ গুপ্তকে আশ্বস্ত করতে চাই যে সময় সময় মন্ত্রীসভার সদস্যরা বৈঠকে মিলিত হন এবং এ ব্যাপারে সংসদের পক্ষ থেকে আলাদা করে কোন তাগাদা দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে আমরা স্বল্পতম সময়ের নোটিসে বৈঠকে বসতে পারি। সাম্প্রতিক কালে আমরা এরকম অনেকগুলো বৈঠক করেছি। আজকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে আমরা মন্ত্রীসভা এবং বিভিন্ন কমিটিতে নিয়মিত আলোচনা করে আসছি। আমি শ্রী ভূপেশ গুপ্ত এবং এই মহান সংসদকে আশ্বস্ত করতে চাই যে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে সবসময়ই আলোচনা হচ্ছে।

আমি তাঁকে আরো আশ্বস্ত করতে চাই যে এই বিষয়টি সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।

তার সর্বশেষ প্রশ্নটি ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি বর্তমান মনোযোগ আকর্ষণী নোটিশটির সাথে কোনভাবেই সম্পর্কযুক্ত নয়।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী ভূপেশ গুপ্তের প্রস্তাবে আমি অবাক হয়েছি। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রদূতকে ফেরত নিয়ে আসতে চান। কেউ যদি নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হয়ে থাকেন, সেটা রাষ্ট্রদূত নন, তাঁর বন্ধু সর্দার শরণ সিং।

সর্দার শরণ সিং: আমি আপনারও বন্ধু।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: এখন আসল ঘটনা বোঝা যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূতকে ফেরত আনার প্রস্তাব দিয়ে শ্রী ভূপেষ গুপ্ত প্রমাণ করছেন যে তিনি এখনো কংগ্রেসের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তিনি কোন মন্ত্রীর পদত্যাগ চান না, প্রধাণমন্ত্রীর পদত্যাগ চান না। তিনি শুধুমাত্র রাষ্ট্রদূতকে ফেরত নিয়ে আসতে চান।

সর্দার শরণ সিং : আপনি আপনার দল থেকে এই সুবিধা পাচ্ছেন যে আপনি সম্পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে কারো পদত্যাগ দাবী করলেও আপনাকে কোন কৈফিয়ত দিতে হবেনা।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমার দলের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নাও হতে পারে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমার বন্ধু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। আমিও বোকা হতে চাইনা, আশা করি এটা কোন সমস্যা নয়।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমার দল ক্ষমতায় আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। যদি কখনো ক্ষমতায় আসি তাহলে আমরা দায়িত্ব নিয়েই আসব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আজ সর্দার শরণ সিংকে দায়িত্ব প্রদর্শন করতে হবে। এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। আমি ব্যার্থতার দায় এল কে ঝায়ের উপর চাপিয়ে দেবনা, আমি শ্রী শরণ সিংকেই দায়ী করব। উনি ৮/৯ টি দেশের রাজধানী ঘুরে এসে দিল্লী বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বড় গলায় বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের স্বার্থবোরোধী কিছু করবেনা। তিনি বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে যুক্টরাষ্ট্র কোন ভারতবিরোধী ভূমিকা নেবেনা। তিনি যদি এল কে ঝায়ের কথার উপর ভিত্তি করে তাঁর বক্তব্য দিতেন, তাহলে আমি ঝা কে প্রত্যাহার করার কথা বলতাম। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন, নিজে ব্যাক্তিগতভাবে যুক্টরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলে এসেছেন। আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে শ্রী শরণ সিং কি যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে এসে দেয়া তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে জাতীকে বিভ্রান্ত করেন নি? তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া উচিত। তাঁর সাথে যদি প্রতারণা করা হয়ে থাকে, তবে তাঁর সেটাও স্বীকার করা উচিত।

(তাঁর বক্তব্যে এসময় বাঁধা পড়ে)

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত নিজে অনেক সময় নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এখন আমার বক্তব্যে বাধা দিয়ে আমার সময় নষ্ট করছেন। আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করতে দিন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আমরা এখন মিত্রবিহীন, কাছে বা দূরে কোথাও আমাদের কোন বন্ধু নেই।

আমাদের কোথাও কেউ নেই। অথচ সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী পাকিস্তানের পৌরহিত্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে নতুন মৈত্রী রচিত হচ্ছে।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি ( পশ্চিম বঙ্গ) : পাকিস্তান কি হিসাবে কাজ করেছে?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: এই মহাজোটের মহামিলনে পাকিস্তান পুরোহিত হিসাবে কাজ করেছে।

জনৈক সাংসদ: এই মিলন কি অনৈতিক?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: হ্যাঁ, এই মিলন অনৈতিক। এই পৌরহিত্যের পুরষ্কার হিসাবেই কি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে?

কিন্তু আমাদের সরকারের কাছে এ ব্যাপারে কোন তথ্য ছিলনা। বিভিন্ন দেশে থাকা রাষ্ট্রদূতরাও নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি। যার ফলে পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় সম্পর্কে মাননীয় মন্ত্রী আমাদের অবহিত করতে পারেন নি।

এই ধরণের অদক্ষতার ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমরা সবসময়ই পিছিয়ে থাকছি। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই যে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের খবর তিনি আগে থেকে পয়েছিলেন কিনা।

তৃতীয়ত, আমি জানতে চাই সরবরাহকৃত অস্ত্রের মোট পরিমাণ কত এ ব্যাপারে তাঁর কোন ধারণা আছে কিনা। মোট অস্ত্রের পরিমাণ কত? অবস্হাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কেউই এই ব্যাপারে কিছু জানেনা।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমার মনে হয় টাকার পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলার বা তার কাছাকাছি হবে।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: এটি আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছেনা।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: শ্রী মিশ্র, আপনি বলুন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী শরণ সিং এর কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। “প্রাভাদা” বা “নিউ ইয়র্ক টাইমস” এ প্রকাশিত কোন সংবাদও আমার বিশ্বাস হয়না।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আপনি বলেছিলেন যে মাননীয় মন্ত্রী সমগ্র জাতীকে বিভ্রান্ত করছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত বিদেশমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি এই সংসদের কাছে জবাবদিহী করতে বাধ্য। তিনি জাতীকে বিভ্রান্ত করেছেন। এখন এই মহান সংসদকে বিভ্রান্ত করলে তাঁকে এর ফল ভোগ করতে হবে।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: বিভ্রান্তিকর তথ্য থেকে কি আসল তথ্য পাওয়া যেতে পারে?

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী চ্যাটার্জি মাননীয় মন্ত্রীর ত্রাতা হিসাবে এগিয়ে এসেছেন।

শ্রী এ পি চ্যাটার্জি: আমি মাননীয় মন্ত্রীকে সাহায্য করতে আসিনি। তিনি একজন মহান ব্যাক্তি।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: শ্রী চ্যাটার্জি, আপনার যখন সময় আসবে তখন আপনি কথা বলবেন। এখন আমাকে বলতে দিন। আমার তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ….

সর্দার শরণ সিং : আপনি ইতিমধ্যে চার-পাঁচটি প্রশ্ন করে ফেলেছেন, অথচ বলছেন তৃতীয় প্রশ্নের কথা।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি প্রকৃত অস্ত্রের পরিমাণ জানতে চাই, কম বা বেশী কোন অনুমানিক সংখ্যা নয়। যুক্তরাষ্ট্র দাবী করেছে যে তারা ২৪ এপ্রিলের আগের চুক্তিতে বিক্রিত অস্ত্র সরবরাহ করছে, পদ্মা বা অন্য কোন জাহাজে এই ধরণের কি পরিমাণ অস্ত্র আসছে সেটা আমাদের জানতে হবে। মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কিন রাষ্ট্রদূত অথবা যুক্তরাষ্টে আমাদের রাষ্ট্রদূত মারফত সরবরাহকৃত অস্ত্রের পরিমাণ জানার চেষ্টা করতে পারেন। মাননীয় মন্ত্রীর উচিত আমাদের এই তথ্য জানানো, এবং এটাও জানানো কি পরিমাণ অস্ত্র ইতিমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে এবং কি পরিমাণ অস্ত্র চালানের অপেক্ষায় আছে। মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান ……

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: আমার মনে হয় আপনি যথেষ্ঠ বলেছেন।
শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আপনি অনুমতি দিলে আমি শেষ একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি অনুমতি না দিলেও কোন অসুবিধা নেই। শ্রী ভূপেষ গুপ্ত বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যাক্তি, আমারতো আর সেই সৌভাগ্য নেই।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: তিনি রাজকীয় সুবিধা পাবার জন্য লড়াই করছেন, আর আমাকে বলছেন আমি নাকি সুবিধাপ্রাপ্ত।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি সংসদের সম্মতিতে এই কাজ করেছি, আপনি করেছেন সকলের অসম্মতিতে।

শেষ প্রশ্ন হিসাবে আমি জানতে চাই যে রাশিয়া কি দয়া করে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেনি?

(বিরতী)

শ্রী চিত্ত বসু, আমার মনে হয়না সম্প্রতি আপনি মস্কো গিয়েছেন অথবা রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের সাথে আপনার কথা হয়েছে। দয়া করে যা জানেন না, সে ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবেন না।

আলোচনার মূল বিষয়বস্তু সচ্ছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটা খবর।

জনৈক সাংসদ: ঠিক, ঠিক।

(বিরতী)

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমি চাই শ্রী শরণ সিং এটা অস্বীকার করুন। আমি প্রাভেদা বা নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবর বিশ্বাস করিনা, সর্বোপরি শ্রী ভূপেষ গুপ্তের কথা বিশ্বাস করিনা।

(বিরতী)

এ পি চ্যাটার্জি : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সন পিকিঙ যাচ্ছেন।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: নিক্সন চৌ এন লাইয়ের পেছনে দৌড়াচ্ছেন, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: মাননীয় চেয়ারম্যান, নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যাবার পর …..

(বিরতী)

চেয়ারম্যান মহোদয়: আপনি প্রশ্ন করুন, কেউ বাধা দেবেন না।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: আমার শেষ প্রশ্ন, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যার অংশীদার হয়েছে।

আমি শ্রী শরণ সিংকে জিজ্ঞাসা করতে চাই যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে তিনি কি করবেন? তিনি কোন নির্দিষ্ট উত্তর দিচ্ছেন না। মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবে হয়তো এই প্রসঙ্গটি নেই, কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণী প্রস্তাবে অনেক কিছুই নেই। সেখানে শ্রী শরণ সিং এর নামও নেই। কিন্তু তিনি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। সুতরাং আমি তাঁর কাছে জানতে চাই যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে সরকারের বর্তমান অবস্হান কি?

সর্দার শরণ সিং : মাননীয় চেয়ারম্যান, প্রথম প্রশ্নের ব্যাপারে আমি মাননীয় সাংসদকে বলব আমার বক্তব্য আরেকবার পড়তে।

তিনি তাঁর প্রথম প্রশ্নে পালাম বিমানবন্দরে দেয়া আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ আমার বক্তব্য ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দিলে আমি তার জবাব দিতে বাধ্য নই। আমি কখনোই কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্য কিছু বলিনি। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যমূলক।

দ্বিতীয় প্রশ্নে তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক যে নতুন মোড় নিয়েছে, তার সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন। এই ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এবিষয়ে আমি ইতিমধ্যে একটি বিবৃতি দিয়েছি। কিন্তু আমি জানিনা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের সাথে এ ব্যাপারের কি সম্পর্ক আছে। এ প্রক্রিয়া শুরু হবার অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে এবং তাদের মধ্যকার নতুন এ সম্পর্ক অস্ত্র সরবরাহ প্রক্রিয়ায় গুনগত কোন পরিবর্তন আনবে বলে আমি মনে করিনা। এই সম্পর্ক উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পাকিস্তানের মাধ্যমে এই নতুন সম্পর্ক রচিত হওয়ায় পাকিস্তান কি বাড়তি অস্ত্র পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না তে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু বলতে পারি যে এই ঘটনা ছাড়াও পাকিস্তান অস্ত্র পেয়ে আসছিল এবং খুব সম্ভবত পেতে থাকবে। তৃতীয় প্রশ্নে আমার কাছে সরবরাহকৃত অস্ত্রের পরিমাণ জানতে চাওয়া হয়েছে। আমি আমার বক্তব্যে বলেছি যে সিনেটর চার্চের দেয়া ৩৫ মিলিয়ন ডলারের অঙ্কটি আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হচ্ছে। আমি যেহেতু ভবিষ্যৎদৃষ্টা নই, সামনে কি পরিমাণ অস্ত্র আসবে সেটা অনুমান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: চুক্তিতে মোট অস্ত্রের পরিমাণ উল্লেখ থাকার কথা। আমি জানতে চাই যে আপনি সেই পরিমাণ সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা।

সর্দার শরণ সিং: শ্রী মিশ্র, এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়নি। আপনার বুঝতে হবে যে তারা অনেকগুলো চাহিদাপত্র জমা দিয়েছে। এখানে দুটো ব্যাপার আছে। অস্ত্র চালানের কিছু অংশ মারণাস্ত্র, আবার কিছু অংশ খুচরা যন্ত্রাংশ। আমি বলেছি যে সরবরাহের অপেক্ষায় থাকা মোট অস্ত্রের মূল্য ৩৫ মিলিয়ন ডলার। সামনে কি সরবরাহ আসবে সেটা আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে বলতে পারছিনা, হয়তো শ্রী মিশ্র পারবেন। তারপর তিনি জানতে চেয়েছেন রাশিয়া সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করছে কিনা। রাশিয়া পরিষ্কার জানিয়েছে এপ্রিল ১৯৭০ এর পর থেকে তারা পাকিস্তানে কোন অস্ত্র বা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছেনা এবং আমিও এমন কোন তথ্য পাইনি যার ভিত্তিতে তাদের অবিশ্বাস করা যায়। আমাদের রাশিয়া সরকারের কথা বিশ্বাস করা উচিত, যেখানে তারা পরিষ্কারভাবে বলছে যে এপ্রিল ১৯৭০ এর পর থেকে তারা পাকিস্তানে কোন অস্ত্র বা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেনি।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারী ( রাজস্হান): তারা কি খুচরা যন্ত্রাংশের কথা বলেছে?

সর্দার শরণ সিং: হ্যাঁ।

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: যুক্তরাষ্ট্রও পরিষ্কারভাবেই বলেছে।

সর্দার শরণ সিং: আমার মনে হয়না তারা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছে। তারা যদি বলত যে তারা অস্ত্র সরবরাহ করেনি, আমি তাদের কথা মেনে নিতাম। শ্রী লোকনাথ মিশ্র: তারা বলেছে যে যেহেতু তাদের একটি চুক্তি আছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী তারা অস্ত্র সরবরাহ করছে।

সর্দার শরণ সিং : শ্রী মিশ্র, আপনি কেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে কথা বলছেন।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলেছে যে তারা অস্ত্র সরবরাহ করছে …..

শ্রী লোকনাথ মিশ্র: তারা কখন এটা বলেছে?

( বিরতী)

শেষ প্রশ্নে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে আবারো জানতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে এখনো উপযুক্ত সময় আসেনি এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ, উপমহাদেশের শান্তি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দিক বিবেচনা করে সঠিক সময়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমি কি এটা মনে করতে পারি যে সরকার নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

সর্দার শরণ সিং: সংবিধানের নীতিতে এই স্বীকৃতির ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া আছে। আপনি কেন নীতি নিয়ে কথা বলছেন?

ডঃ ভাই মহাবীর ( দিল্লী): আমাদের মন্ত্রী আমেরিকা সরকারের শীর্ষ নেতাদের সাথে দেখা করে এসেছেন। আমি জানতে চাই এই অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বক্তব্য কি? কেন অস্ত্র দেয়া হচ্ছে? পাকিস্তানের উপর কোন হুমকি আছে নাকি? পাকিস্তান কি কোনভাবে সংকটাপন্ন? নাকি তার বহিরাক্রমণের ভয় আছে? আমি আমেরিকার সাম্প্রতিক বক্তব্য সংবাদপত্রে দেখেছি, যার মধ্যে ভিয়েতনাম নীতির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ” একটি ছোট দেশও নিজেদের অধিকার চর্চা করতে পারে, নিজেদের পথ বেছে নিতে পারে”

সেখানে আরো বলা হয়ছে, ” যুক্তরাষ্ট্র সবার বাঁচার এবং বাঁচতে দেয়ার অধিকারে বিশ্বাস করে। “যে সরকার এই দাবী করে, তাকে কি জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে অস্ত্র সরবরাহ করা বাঁচার এবং বাঁচতে দেয়ার নীতির মধ্যে পড়ে কিনা? আমি এ ব্যাপারে মার্কিন নেতাদের বক্তব্য জানতে চাই।

আপনার বক্তৃতায় আপনি বলেছেন যে ” এটি গণহত্যায় মদদ দেয়ার শামিল”

এর মাধ্যমে আপনি বুঝিয়েছেন যে, ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের লোকদের উপর যে আক্রমণ চালিয়েছে, আমেরিকা অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তাতে সমর্থন জানিয়েছে। ঠিক আছে, কিন্তু আপনি একথা বলতে সম্মত কিনা যে আজকে যা ঘটেছে তা আরো গুরুতর।

ইতিমধ্যে একটি দেশের উপর আগ্রাসন চালানো হয়েছে, এবং এখনো চালানো হচ্ছে। বেসামরিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, আমি বলব অনেকটা জীবাণুযুদ্ধ চালানোর মত আগ্রাসন।

সব শেষে আমি বলব, যে জাহাজটি আমাদের সর্বপ্রকার বিরোধিতা সত্বেও পাকিস্তানের অস্ত্র বহন করে আনছে, তাকে বাধা দেয়ার জন্য আমাদের সরকার কি নৌ অবরোধ করার চেষ্টা করবে? এসব অস্ত্র কি গন্তব্যে পৌছাতে বাধা দেয়া হবে, নাকি বলা হবে আন্তর্জাতিক জলসীমার জন্য কিছু করা যাবেনা।

সর্দার শরণ সিং : মাননীয় সাংসদ, পাকিস্তানে সরবরাহকৃত অস্ত্রের মোট পরিমাণ সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্যে যে সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছি, এর বাইরেও আরো সূত্র থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। একারণেই আমি বলেছি যে সিনেটর চার্চের উল্লেখিত ৩৫ মিলিয়ন ডলার অঙ্কটা সম্ভবত সবচেয়ে কাছাকাছি অনুমান। আমাদের কাছে যেসব গোয়েন্দা তথ্য আছে, তার ভিত্তিতেই এই আমি এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি। তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্র কেন পাকিস্তানে অস্ত্রসরবরাহ করছে। ১৯৪৫ সালে পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি করা শুরু করার পর থেকে অনেকবারই যুক্তরাষ্ট্রকে এই প্রশ্ন করা হয়েছে। তাদের কথা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক শক্তিকে দমন করার কৌশল হিসাবে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে, যদিও এই দাবীর কোন যৌক্তিকতা নেই। আমরা শুরু থেকেই জেনে এসেছি যে ভারতকে চাপে রাখার উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে।

মাননীয় সাংসদ আরো জানতে চেয়েছেন যে তারা কি চীন থেকে পাকিস্তানকে দূরে রাখাকে অস্ত্র পাঠানোর অজুহাত হিসাবে ব্যাবহার করতে চাইছে কিনা। আমার উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, তারা এই জাতীয় অজুহাত ক্ষেত্র বিশেষে দিয়েছে, যদিও তারা ঠিক সরাসরি এই শব্দগুলো উচ্চারণ করেনি। তারা বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই তারা বিভিন্ন দেশে অস্ত্র বিক্রি করে। যদিও আমি এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা পাইনা, তারপরেও তাদের ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকার আছে। বিশ্বাস করা না করা যার যার ব্যাপার।

তৃতীয় প্রশ্ন ছিল যে তাদের এটা বলা হয়েছে কিনা যে তাদের অস্ত্র বাংলাদেশে গণহত্যার কাজে ব্যাবহৃত হচ্ছে। একথা অবশ্যই তাদের জানানো হয়েছে। শুধু এখনই না, আগেও কয়েকবার বলা হয়েছে।

ডঃ ভাই মহাবীর: আপনার বক্তব্যে আপনি একথা উল্লেখ করেন নি।

সর্দার শরণ সিং : আমি এখন আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। এছাড়াও আমি আগেও বিভিন্ন জায়গায় একথা বলেছি।

চতুর্থ প্রশ্নে তিনি পিকিঙে নিক্সনের আসন্ন সফরের ব্যাপারে আমার মন্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন এবং বলেছেন যে এই সফর থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেয়া উচিত যে জাতীয় স্বার্থ সবসময় সমুন্নত রাখতে হবে। আমি তাঁকে জানাতে চাই যে জাতীয় স্বার্থ সবসময়ই সরকারের অগ্রাধিকার এবং এটা বিবেচনা করেই আমরা সব ধরণের পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।

ডঃ ভাই মহাবীর: পরিস্হিতি দেখে কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না।

সর্দার শরণ সিং : উনি আরো বলেছেন যে ভারতের কঠোর হওয়া উচিত। হ্যাঁ, এই ব্যাপারে আমিও একমত যে ভারতের শক্ত হওয়া উচিত, যদিও মাননীয় সাংসদের দল ভারতকে শক্তিশালী করার লক্ষে কাজ করছে কিনা এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তারা সবসময় বিভক্তিমূলক নীতি নিয়ে আসছেন, যার ফলে ভারত শক্তিশালী হবার বদলে দূর্বল হচ্ছে। আমি তাকে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো দেখার চেষ্টা করার আহ্বান জানাই। আমাদের সামরিক শক্তি, তিন বাহিনীর জন্য অস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতা – এসব আমরা অর্জন করেছি আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতি, শিল্পোন্নয় এবং সর্বোপরি আমাদের জাতীয় একতার কারণে। মাননীয় সাংসদ তাঁর বক্তব্যে এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন নি। আমাদের শক্তিশালী হতে হবে, তার মানে সবগুলো সেক্টরেই শক্তিশালী হতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একটা ইস্যু খুঁজে বের করার চেষ্টা করাটা লাভজনক কিছু হবেনা।

উনি তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন এবং জিজ্ঞাসা করেছেন যে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তার প্রস্তাবগুলো মেনে নিতে প্রস্তু আছি কিনা। আমি এক কথায় উত্তর দিচ্ছি যে না, আমি প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করতে পারছিনা।

শ্রী কৃষ্ণকান্ত: আমেরিকার গত ২০ বছরের পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করলে এটা বোঝা দায় যে এশিয়াতে শক্তির একটা ভারসাম্য চাইলে তারা সবসময়ই কেন ভারতবিরোধী নীতি নিয়ে আসছে। এমনকি এবারের এই অস্ত্র সরবরাহের সাথেও এই ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পর্কযুক্ত। তারা কি এটাও জানেনা যে অস্ত্রের পাশাপাশি আমেরিকান জাহাজ বাংলাদেশে গণহত্যার উদ্দেশ্যে সৈন্য পরিবহণ করার কাজে ব্যাবহৃত হচ্ছে? আমেরিকা যদিও বারবার অস্বীকার করে আসছে যে তারা এটা করছেনা, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমেরিকান জাহাজ এবং কিছু ক্ষেত্রে উড়োজাহাজ সৈন্য পরিবহনের কাজে নিয়মিত ব্যাবহার করা হচ্ছে। এটাও কি সত্য নয় যে ইন্দো-চীন যুদ্ধের পর ১৯৬২ থেকে ৬৫ এর মধ্যবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে এটা জানা সত্বেও যে এই অস্ত্র চীন বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাবহার হবে না, শুধুমাত্র ভারতের বিরুদ্ধেই ব্যাবহার হবে। ১৯৬৩ সালে তাদের একটি সাবমেরিন দেয়া হয়। আরব সাগর অথবা বঙ্গোপসাগরে চীন বা রাশিয়ার কোন কার্যক্রম নেই, এই সাবমেরিন শুধু ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্যই দেয়া হয়েছে। ইন্দো-চীন যুদ্ধের সময় আমরা অস্ত্র কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের কাছে আমেরিকান রাইফেলও বিক্রি করা হয়নি। এটা কি ভারত বিরোধীতা নয়?

শুধুমাত্র ভারতের দিকে তাক করে পাকিস্তানে একাধিক রাডার মোতায়েন করা হয়েছে। মুলতানে একটি রাডার স্টেশন কেন তৈরি করা হয়েছে? ভারতীয় বিমানের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার জন্য। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বালওয়ান্ত্রাই মেহতার বিমান ভূপাতিত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যখন ওয়াশিংটন গিয়েছেন, তখন তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর সাথে সাক্ষাত করেছেন। কিন্তু অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে তাঁকে কিছু না জানিয়ে সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়েছে। তারা আমাদের সাথে সম্পূর্ণরুপে অবন্ধুসুলভ, ভারতবিরোধী আচরণ করছে। তারা যে ভারতবিরোধী, এই কথাটা এখন তাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেয়ার সময় এসেছে।

চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে নিক্সন চীন যাচ্ছেন না। তিনি চীনে যাচ্ছেন কারন অনেকগুলো পরীক্ষার পর চীন পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করেছে। এটাই বাস্তবতা।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, আমেরিকার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। ৫ জুলাইতে মার্কিন মুখপাত্র বলেছেন যে তারা এখনো ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যের লিখিত কপি হাতে পাননি। অথচ ইয়াহিয়া ২৮ জুন বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের সবধরণের যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি থাকা সত্বেও ৫ জুলাই পর্যন্ত তারা ইয়াহিয়ার বক্তব্য হাতে পান নি, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, এখনো কি নিজেদের জাতীয় স্বার্থে আমাদের আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতিতে অংশ নেয়ার সময় হয়নি? এখনো কি এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্হাপনে গুরুত্ব দেয়ার সময় হয়নি? বর্তমানে রাশিয়ার সাথে জাপান ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হচ্ছে। আমাদেরও কি উচিত না যে পারষ্পরিক সংলাপের মাধ্যমে একই রাস্তায় হাঁটা? রাশিয়া জাপানের সাথে আলোচনায় বসেছে। আমাদেরও কি উচিত না রাশিয়া, জাপান, উত্তর ভিয়েতনাম এবং চীন- এই চার শক্তির সাথে আলোচনার টেবিলে বসার চেষ্টা করা?

আমরা জানি শুধুমাত্র ভাবাদর্শের ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয়না। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এশিয়াতে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন হবে, যুক্তরাষ্ট্র সেটা চায়না, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও সেটা চায়না। সুতরাং ভারতের কি স্বাধীন বাংলাদেশ চাওয়া উচিত না, কারণ বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হলে সেটা ভারতের অস্তিত্বের জন্যও উপকারী হবে। মিঃ কিসিন্জার এবং মিঃ নিক্সন বুঝে-শুনেই নিজেদের স্বার্থে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বাংলাদেশকে সাহায্য করলে আখেরে সেটা ভারতেরই উপকারে আসবে।

( সময় শেষের ঘন্টা)

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান, এটা বলা হচ্ছে যে মিঃ এল কে ঝা সেখানে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি কি কাজ করছেন বা কেন তাঁকে সেখানে রাখা হচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছিনা, কারণ কাজে আসতে পারে এমন কোন তথ্যই তিনি পাঠাতে পারছেন না। আমেরিকা নিজের নীতিতেই চলছে, মিঃ ঝা সেখানে থেকে কোন উপকারে আসবেন না। আমাদের এখন নিজেদের স্বার্থে কাজ করার সময় এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ এই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যুক্তরাষ্ট্র সেটা চায়না। কেউ যদি এগিয়ে এসে আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তবে ভারতকে একাই এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

সর্দার শরণ সিং: আমি মনোযোগ দিয়ে উনার বক্তব্য শুনেছি। উনি যেহেতু কোন প্রশ্ন করেননি, আমার নতুন করে কিছু বলার নেই।

শ্রী চিত্ত বসু: আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে মাননীয় মন্ত্রী দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলো সময়োপযোগী নয়। তার বক্তব্য গতানুগতিক, মেরুদন্ডহীন এবং আত্নসমর্পণের সামিল। তাঁর এধরণের বক্তব্য শুধু সাংসদদেরই রাগান্বিত করছেনা, সমগ্র দেশবাসীকেও হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করছে।

আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে, কারণ পাকিস্তান তাদের অনুগত থাকবে এবং তাদের সুবিধামত সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে, আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে জানতে চাই যে তিনি আমার এই মতের সাথে একাত্নতা পোষণ করেন কিনা। যুক্তরাষ্ট্র সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে, যার অর্থমূল্য দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। শুধু তাই নয়, ন্যাটো এবং সেন্টোর আরও কিছু সদস্যরাষ্ট্র তৃতীয়পক্ষ হিসাবে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে। সুতরাং এটা প্রতিষ্ঠিত যে পাকিস্তানকে ভারতের বিপক্ষে একটি শক্তি হিসাবে দাঁড় করানো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের যে সামরিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল, তা যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে নতুন যন্ত্রাংশ দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছে। মাননীয় মন্ত্রী কি আমার সাথে একমত যে, পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে যুক্তরাস্ট্র বাংলাদেশে গণহত্যার অংশীদার হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতে মদদ দিচ্ছে? আমরা দুই দেশই কি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের শিকার নই? তাই যদি হয়, তাহলে কি সরকারের উচিত না বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সব ধরনের সামরিক সাহায্য দেয়া? বাংলাদেশের মাটি থেকে আগ্রাসী শক্তিকে হটিয়ে দিতে পারলে সেটা দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই কি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত নয়? তাই যদি হয়, তাহলে এখনই কি উপযুক্ত সময় না?

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: মাননীয় মন্ত্রী এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

শ্রী চিত্ত বসু: আমরা দুই দেশই যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের শিকার এবং সেই প্রেক্ষিতে এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার উপযুক্ত সময় কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেন নি। বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদারদের হটিয়ে দেয়া আমাদের দুই দেশের জন্যই কি লাভজনক নয়? আমি আরো জানতে চাই যে চীন-আমেরিকা-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন মহাজোট গঠিত হবার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়াটা কি আরো জরুরী হয়ে উঠছেনা? আমি মাননীয় মন্ত্রীকে আরো জিজ্ঞেস করতে চাই যে এত কিছুর পরও কেন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণকে ভারতের প্রতি বৈরি হিসাবে ঘোষণা করা হচ্ছেনা? কেন এই কথাটা সহজ ভাষায় বলার সাহস আমাদের সরকার পাচ্ছেনা? সরকার কি যুক্তরাষ্ট্রকে বলবে যে এ অবস্হা চলতে থাকলে সরকার চরম ব্যাবস্হা নিতে বাধ্য হবে, ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেয়া হবে, সব ধরণের চুক্তি বাতিল করা হবে এবংভারতে অবস্হিত সব ধরণের মার্কিন সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে? যুক্তরাষ্ট্র যে ভাষা বুঝে, তাদের সাথে সেই ভাষায়ই কথা বলতে হবে। মাননীয় মন্ত্রী কি এই সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন?

সর্দার শরণ সিং: একথা সত্য যে ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাকিস্তানে এসেছে এবং এর উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তান নিজেদের সেনা-নৌ-এবং বিমানবাহিনী গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে তিনি অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে যা বলার আমি ইতিমধ্যে বলে দিয়েছি এবং এই ব্যাপারটিকে বারবার অন্যান্য প্রসঙ্গের সাথে জুড়ে দেয়ার ফলে সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া অন্য কোন লাভ হচ্ছেনা। এই প্রসঙ্গটি, চীন, বা পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র চালানের সাথে কোনভাবেই সম্পর্কযুক্ত নয়। এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং আমি ইতিমধ্যে এর জবাব দিয়েছি। আমার আর নতুন কিছু যোগ করার নেই। সর্বশেষে, ভারতকে ৫ মিলিয়ন ডলার দেয়া হচ্ছে এমর্মে তিনি একটি প্রশ্ন করেছেন। সংবাদপত্রে আমিও এটা পড়েছি, এর কোন সত্যতা নেই ……..

শ্রী চিত্ত বসু: আপনি কি এটা প্রত্যাখ্যান করছেন?

সর্দার শরণ সিং: এর কোন সত্যতা নেই। আমি কিসের উপর ক্ষুব্ধ হব? আমরা কারো থেকে কিছু নিচ্ছিনা।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারী: তিনি প্রত্যাখ্যান বলেছেন, ক্ষুব্ধ নয়।

সর্দার শরণ সিং: আমরা কারো থেকে কিছু নিচ্ছিনা।

শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারী: যদি নিতে হত?

সর্দার শরণ সিং: যদি নিতে হত মানে কি? কোন প্রকল্পিত ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।

শ্রী চিত্ত বসু: আপনাদের মনোভাব কি?

সর্দার শরণ সিং: পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে আমাদের মনোভাব ইতিমধ্যে ব্যাক্ত করা হয়েছে, এই সুযোগে আমি সেটা আবার ব্যাক্ত করতে চাই। আমরা তাদের বিস্তারিতভাবে জানিয়েছি যে কোন দেশ যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটা বাংলাদেশে গণহত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া হিসাবে গণ্য হবে এবং পাক সামরিক জান্তা কতৃক বাংলাদেশের মানুষের অধিকার হরণের নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত হবে। এই অস্ত্র ভারতের বিপক্ষে ব্যাবহৃত হবে, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহকারী প্রত্যেকটি দেশের কাছে এই বার্তা পৌছে দেয়া হয়েছে।

আমি মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যানকে বলতে চাই যে অনেকগুলো মন্তব্য শোনা হয়েছে এবং একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। আপনি মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যানকে এই দিকটা একটু বিবেচনা করার অনুরোধ করছি, একই কথা বারবার জিজ্ঞেস না করে যেন নতুন প্রশ্ন থাকলে সেটা করা হয়।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: অর্ডার, অর্ডার।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: মহোদয়, ইতোমধ্যে অনেক বিষয়ে আলোচনা করা হয়ে গিয়েছে। আমি খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখব। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আমরা এটা বুঝতে পারছি কি পারছিনা, পাকিস্তানে আসতে থাকা এই অস্ত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হয়ে দাঁড়াতে পারে? আমরা এভাবে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছি? অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে লাভ নেই, শ্রী শরণ সিং অত্যন্ত সুকৌশলে বলে দিয়েছেন যে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধী নন, তিনি শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সঠিক সময়টি ইতিমধ্যে পার হয়ে যায়নি তো? আমরা কি খুব দেরী করে ফেলছিনা?

শ্রী এ ডি মানি (মধ্যপ্রদেশ): আমরা অনেক দেরী করে ফেলেছি।

শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী: আমিও তাই মনে করি। মার্কিন অস্ত্র চালানের ব্যাপারে আমি শুধু একটি পর্যবেক্ষণের কথা বলব। আমি আশা করব শ্রী শরণ সিংও এ এ ব্যাপারে নিজের মন্তব্য জানাবেন। যুক্টরাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডঃ জেকিলের মত আচরণ করা, অন্যান্য ক্ষেত্রে মিঃ হাইডের মত আচরণ করা। যুক্টরাষ্ট্র সরকার দ্বি-মুখি কূটনীতির আশ্রয় নিচ্ছে, একদিকে বিশ্ববাসীর সামনে শরণার্থীদের জন্য চোখের জল ফেলছে, অন্য দিকে যে পাকিস্তানের কারণে এই শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তাদের অস্ত্র দিচ্ছে, তাদের মাধ্যমে চৌ এন লাইয়ের সাথে মৈত্রি রচনা করছে।

মহোদয়, আমি এখন সুনির্দিষ্ট একটি প্রশ্ন করতে চাই। আমাদের পক্ষে হয়তো একটি চরম অবস্হান গ্রহণ করা কঠিন, এবং মাননীয় মন্ত্রী হয়তো কঠোর কোন পদক্ষেপ নিতে চাইছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বি-মুখি নীতির প্রতিবাদ হিসাবে আমরা কি তাদের থেকে শরণার্থীদের জন্য সব ধরণের সাহায্য গ্রহণ বন্ধ করে দিতে পারি? আমার মতে এটি খুব ছোট একটা পদক্ষেপ হবে।

এর সাথে সাথে আমাদের কোন ধরণের কার্যকর ব্যাবস্হাও নিতে হবে, একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও। আমি জানি যে শরণার্থীদের জন্য সাহায্য প্রয়োজন এবং ব্যাপারে সরকারের নিজস্ব নীতি রয়েছে, কিন্তু সরকার কি একটু সাহসী হয়ে ঘোষণা দেবে যে যারা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে, তাদের কাছ থেকে শরণার্থীদের জন্য কোন অর্থ সাহায্য গ্রহণ করা হবেনা?

সর্দার শরণ সিং: প্রথম প্রশ্নের ব্যাপারে আমি বলতে পারি যে এই সব অস্ত্রের চালান অবশ্যই বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্হিতিতে প্রভাব ফেলবে। এটি পাক বাহিনীর শক্তি বাড়াবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হতোদ্যম করবে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য ব্যাপারটা অবশ্যই উদ্বেগের। এবং এই অস্ত্র পাকিস্তানকে আমাদের বিরুদ্ধে আরো আগ্রাসী হতে সাহস যোগাবে। এই দুটি কারণে আমরা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের কঠোর বিরোধীতা করে আসছি। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কি দ্বি-মুখি নীতি অবলম্বন করছে কিনা। এর উত্তর হচ্ছে তাদের একটি নীতি আছে এবং সেই নীতিকে আপনি আক্ষরিক অর্থে বা ভাবার্থে যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করেই যাবে। এবং পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েই যাবে।

তিনি আরো জিজ্ঞাসা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রাণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা হবে কিনা। এ ব্যাপাারে আমি স্পষ্টভাবে বলছি, উদ্বাস্তুরা আসলে পাকিস্তানের সমস্যা। এবং পাকিস্তানী নাগরিক এই উদ্বাস্তুদের দেখ-ভাল করার জন্য আমরা যেকোন ক্ষতিপূরণ চাইবার অধিকার রাখি। দ্বিতীয়ত, এব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব আছে। শরণার্থীদের সহায়তা করা সকলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জাতী সংঘ মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যদি কেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, তাকে ফিরিয়ে দেয়া ভারতের জন্য লাভজনক হবে না। আমরা বরং পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান করতে চাই এবং এটাই আমাদের নীতি। এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সাথে জাতীয় অহংবোধ মিশিয়ে ফেললে চলবে না। শরণার্থীদের খরচ সবাইকে মিলেই বহন করতে হবে, এ ব্যাপারে রাগের মাথায় অন্য কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবেনা।

শ্রী নিরেন ঘোষ: এই মাত্র মাননীয় মন্ত্রী একটি নতুন বক্তব্য দিলেন। তিনি বলছেন যে এই আশ্রয়ার্থীরা পাকিস্তানের নাগরিক এবং আমাদের ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অধিকার আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হলে এরা আর পাকিস্তানের নাগরিক থাকবেনা। এরা তখন বাংলাদেশের নাগরিক হবে, যারা পাকিস্তানী আগ্রাসনে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সরকার কি শুধু এই পরিস্হিতি এড়াতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চাইছেনা? হয়তো ঘটনাটা এরকম না, কিন্তু তাঁর বক্তব্য শুনে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তাই আমি তার কাছে এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা চাইছি।

সর্দার শরণ সিং: আপনি এমন বক্তব্য কেন দিচ্ছেন যেটা অন্য দলকে সাহায্য করে? আপনি কি তাঁদের সাহায্য করছেন না আমাদের?

শ্রী নিরেন ঘোষ: শ্রী শরণ সিং, দূর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু কিছু বিষয়ে সরকারের সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মেলেনা। এটা আমাদের মনে রাখা উচিত, আর এটা আমাদের দোষও নয়। এই ইস্যুতে আমরা সরকারের সাথেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্ত আপনারাই আমাদের এই অবস্হান গ্রহণে ব্যাধ্য করছেন। এটি অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক, কিন্তু আমাদের আর কোন উপায় নেই।

দ্বিতীয়ত আমি জিজ্ঞেস করতে চাই যে অস্ত্র সরবরাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত না হলে মাননীয় মন্ত্রী কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেননি। এখন ২৫ শে মার্চের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে আমরা তাদের অস্ত্র দিতে পারতাম। স্বীকৃতি দেয়ার পর এটা আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াত। তখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র দিলে আগরা বলতে পারতাম যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানী আগ্রাসনকে সমর্থন করছে আর ভারত মুক্তিকামী বাংলাদেশী মানুষদের সাহায্য করছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে মার্কিন সাহায্য ছাড়া শরণার্থীদের দেখ-ভাল করা সম্ভব নয়। পরিস্হিতি যদি তাই হয় তাহলেতো আমেরিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না।

আমি আরেকটি জিনিষ জিজ্ঞেস করতে চাই। শুধুমাত্র শক্ত প্রতিউত্তর দেয়া ছাড়া আমরা বিকল্প কোন পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তা করেছি কিনা। আপনি সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর না দিতে পারলেও আমাদের অন্তত এটুকু জানান যে আপনাদের মাথায় শুধু লিখিত জবাব দেয়া ছাড়াও বিকল্প কোন চিন্তা আাছে কিনা।

পাকিস্তান সবধরণের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে : ” আমাদের অর্থনৈতিক সংকট চলছে এবং আমাদের কোন বৈদেশিক মুদ্রা নেই”। এই কারণ দেখিয়ে তারা ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে পরিস্হিতি হচ্ছে ৭০ লক্ষ লোক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসেছে, আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে আমরা উপযুক্ত সাহায্য পাইনি এবং এই ব্যায়ভার আমাদের কোষাগারকেই বহন করতে হচ্ছে। এটা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্হ নই, এটা আমাদের অবশ্যই বহন করা উচিত। আমি শরণাথী তদারকিতে অব্যাবস্হাপনার কথা এখন তুলবনা, কিন্তু যেহেতু অস্ত্র সরবরাহ এবং বিপুল সংখ্যক আশ্রয়ার্থীদের চাপে আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, আমরাও কি আমেরিকাকে সবধরণের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করতে পারিনা? আমরা মিঃ এল কে ঝা কে ডেকে পাঠিয়েও প্রতিবাদ জানাতে পারি। আপনারা ইতিমধ্যে পিকিঙ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছেন। আমি কূটনীতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে বলছিনা, শুধুমাত্র প্রতিবাদ হিসাবে রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করতে বলছি। দয়া করে কিছু একটা করুন।

ডেপুটি চেয়ারম্যান: শ্রী ঘোষ, যথেষ্ঠ হয়েছে।

শ্রী নিরেণ ঘোষ: সরকার কি জানে তাদের কর্মকান্ড দেশের জনগণের মনে গভীর সন্দেহ ও উৎকন্ঠার জন্ম দিচ্ছে? তারা কি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সাহায্য দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে? প্রকৃত বন্ধু হিসাবে আমাদের এটুকু অন্তত করা উচিত।

সর্দার শরণ সিং: আমি বলতে চাই, যে পূর্বানুমানের উপর ভিত্তি করে তিনি প্রথম দুটি প্রশ্ন করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান বা অন্য কোন ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত হবার কোন কারণ ভারতের নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত হয়ে ভারত সিদ্ধান্থীনতায় ভুগছে, এটা উনার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

পাকিস্তান সবধরণের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে, কারণ তারা কোনভাবেই এই টাকা জোগাড় করতে পারছেনা। মাননীয় সাংসদ আমাদেরও একই কাজ করতে বলছেন। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্হা এত খারাপ নয়। ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত, কোন ধরণের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ নয়।

শ্রী ভূপেষ গুপ্ত: আমরাও প্রয়োগিক কারণে এই ব্যাবস্হা নিতে পারি।

শ্রী নিরেণ ঘোষ: আপনি এত কর্কশভাবে কথা বলছেন কেন? আপনার বক্তব্য পরষ্পরবিরোধী।

মাননীয় ডেপুটি চেয়ারম্যান: দয়া করে তাঁর কথা শুনুন।

সর্দার শরণ সিং: সৌভাগ্যক্রমে আমাদের অর্থনীতির অবস্হা এত খারাপ নয় যে আমাদের ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির অবস্হা যথেষ্ঠ ভাল, আমরা কোন বিদেশী সাহায্য ছাড়াই আশ্রয়ার্থীদের দেখা-শোনা করতে পারব। তাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যাবস্হা করার জন্য আমাদের শুধু অভ্যন্তরীণ সম্পদের উপর নির্ভর করলেই চলবে। মাননীয় সাংসদ বুঝতে পারছেন না যে তিনি এরকম নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে আমি তাঁকে কোন সাহায্যই করতে পারব না। আমি জানি যে কিছু দল এবং কিছু মানুষ এমন পরিস্হিতির সৃষ্টি করতে চায়, যাতে মনে হয় ভারতের অর্থনীতিও খারাপ অবস্হায় আছে। এটা সত্য যে এই অগণিত পরিমাণ শরণার্থী আমাদের উপর বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং তাদের সমস্যা সমাধানকল্পে সরকারের প্রচুর সময় ব্যায় হচ্ছে।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!