You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০১। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির উপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিবৃতি ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১২জুলাই, ১৯৭১

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জাগজীভান রামের বিবৃতি, জুলাই ১২, ১৯৭১

জুলাই ১২, ১৯৭১ এ প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের বাজেট আলোচনায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জাগজীভান রামের প্রত্যুত্তর নিন্মে বর্ণিত করা হল।

আমি বাংলাদেশের দুর্দশাময় অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে যে পুনরুত্থান হয়েছে তা বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নগ্নশাসন তুলে ধরেছে। এটা আবারো প্রমান করে গণতন্ত্রের ভীত এতো গভীর আর শক্ত যে তা গত এক শতকের চতুর্থাংশ ধরে চলমান কোন সামরিক শাসক দখল করতে পারেনি। বাংলাদেশের জনতা সাহসিকতার সাথে তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার্থে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে আসছে। বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে চলা সন্ত্রাসবাদ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই সংগ্রামে সাহসিকতা ও বিরত্বের সাথে জড়িতরা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে। দুঃসময়ে হাউস আমাদের বন্ধুদের সমর্থন ও সমবেদনা জানিয়েছে।
বাংলাদেশি জনসংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এতে পরিষ্কার হয় যে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের জনগনের উপর নিষ্ঠুর গনহত্যা চালিয়েছে যা আমাদের অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংবিধানিক মৌলিক কাঠামোর প্রতি হুমকি স্বরূপ। আমরা যে মূল্যবোধ লালন করি এবং আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যে অঙ্গীকার করেছি তা বিপদের মুখোমুখি। তবু সরকার হুমকির সম্মুখীন হয়েও বেঁচে আছে শুধু তার দায়িত্বের জন্য।

পূর্ব সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা সম্পর্কে হাউস অবগত। পশ্চিমা সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে তাদের যুদ্ধ বিরতি সম্পর্কে ও হাউস অবগত আছে।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের রেজিমেন্ট গঠনের ক্ষুদ্র প্রয়াস, যুবকদের বাধ্যতামুলক ভাবে সৈন্য দলে নিযুক্ত করা, এবং তাদের পাকিস্তানি সেনাদের জন্য অন্যান্য বন্ধু দেশ থেকে বা এজেন্সির মাধ্যমে হাতিয়ার ও গোলা বারুদ আনানো সম্পর্কে হাউস অবগত। এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের শিখা নিভানোর জন্যেই এসব প্রস্তুতি নেয়া হয়ে ছিল। আমরা আশা রাখি, যারা এসব ব্যাপারে তাদের সাহায্য করেছিল তারা তাদের দায়ভার সম্পর্কে সচেতন, এবং এসব মরনাস্ত্র আনার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে অবগত।

এইসব হুমকি নিয়ে হাউসে আমরা আলোচনা করেছি। শুধু বলতে পারি আমরা দিনের পরদিন এইসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি এবং আশ্বস্ত করবো পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত সতর্ক পাহারায় আছে এবং সবধরনের হামলা মোকাবেলার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নেয়া আছে। আমাদের দেশে অনুপ্রবেশকারী ও অন্যান্য প্রতিকুল অবস্থা দৃঢ়ভাবে মোকাবেলার জন্য আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

সীমান্তে অবস্থানকারী আমাদের লোকেরা, হোক তা কাশ্মীর, জুম্মু, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় বা অন্য কোথাও, সবাই খুঁটিনাটি সম্পর্কে সচেতন। বাংলাদেশীদের উপর পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক নির্যাতন পদ্ধতি তাদের পাকিস্তান পরাস্ত্র করার সংকল্পকে আরো শক্তিশালী করেছে।

মুক্তি বাহিনী

সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতির দাবী হাউসে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাক্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে দেশব্যাপী যে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ চলছে তা আমরা জানি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ঘরে বা বাইরে যে কোন ব্যাপারেই সরকার আমাদের পাসে আছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথার সাথে আর কিছু সংযুক্ত করার দরকার নাই। এক কথায় পরিষ্কার। স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিফৌজেদের অদম্য সাহসই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য আনবে। বিভিন্ন সীমান্ত থেকে আসা খণ্ড খণ্ড প্রতিবেদন নির্দেশ করে কিভাবে সাহসিকতার সাথে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের নাজেহাল করছে। মুক্তি বাহিনীর এক জন গেরিলা বা একজন কমান্ডো পাকিস্তানি লুণ্ঠনবাজ সেনাসম্রাজ্ঞের চাইতে দামি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত কার্যক্রমে এটা পরিষ্কার যে সামরিক জান্তা বাংলাদেশের জনগনের উপর বেশি দিন তাদের ধ্বংস লীলা চালাতে আর উপনিবেশিক শাসনতন্ত্র চালাতে সক্ষম হবে না। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমাদের সর্বাত্মক সহানুভূতি ও সমর্থন আছে।

সেনাবাহিনী
আমাদের প্রতি রক্ষা বাহিনীকে উন্নত করার অদম্য ইচ্ছা আছে। সুস্পষ্ট কারনে, আমাদের সামর্থ্য ও প্রস্তুতির চর্চা ও তা প্রকাশে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলছি, যে কোন হাতিয়ার ও ভূমিকায় আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এগিয়ে। সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতার উন্নয়নের জন্য যেসব উপকরণ দেয়া হয়েছে তা হাউস এমনি এমনি জ্ঞাত হয়নি। স্থলবাহিনীর গতিশীলতার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে, পদাতিক কামান ও সাঁজোয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ট্যাংক বিরোধী মিসাইল বাহিনী দিয়ে ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। নতুন নতুন হাতিয়ার ও রণকৌশল শেখানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভারতীয় সেনাদের আত্মরক্ষা ও আক্রমণাত্মক দক্ষতা প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারন হতে পারে।

এটা সত্য যে পাকিস্তান মিরাজ-IIIE (Mirage-IIIE) যুক্ত করেছে। আমাদের বিমান বাহিনীকে পাকিস্তানের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী ও দক্ষ করা হয়েছে। আমাদের যুদ্ধ বোমা স্কোয়াড্রনকে আরো আধুনিক করা হয়েছে। কমান্ড প্রস্তুতি পরিচালনায় আমরা ইতোমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছি। ডিপো রক্ষণাবেক্ষণে ভারি মেরামত আরো বেশি আধুনিক ও উদ্দিপ্ত করা হয়েছে। সর্বদিক মিলিয়েই আমরা আশা রাখি আমাদের বিমান বাহিনীর সেবা উন্নত হবে। বিমান বাহিনীর ক্ষমতা আকর্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধির পরিমান নিশ্চিত করে স্থল ও সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে কার্যক্রম পরিচালনায় তারা যথেষ্ট কার্যকর।

নৌবাহিনী

আমাদের নৌ বাহিনীর ক্ষমতা নিয়ে কিছু উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। এটা সত্য যে সাবমেরিন যুদ্ধবিগ্রহে পাকিস্তান নতুন ক্ষমতা যুক্ত করেছে। আমাদের নৌবাহিনীতে এখন সাবমেরিন আছে। আধুনিক সাবমেরিন ধ্বংস করার ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমেরিন আমাদের আছে। নৌবাহিনী মিসাইল বহনের নৈপুণ্যও পরিচালনা করছে। বোম্বেতে ডকইয়ার্ড আধুনিক করা হচ্ছে। ভিসাখাপাতানামে নতুন একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণাধীন। নৌ বাহিনীও তাদের প্রক্রিয়ার সুযোগ সুবিধা রক্ষনাবেক্ষনে বদ্ধপরিকর। আমি নিশ্চিত, আমাদের নৌবাহিনী ভালো প্রস্তুতিতে রয়েছে।

বেসামরিক বাহিনী

আমাদের বেসামরিক এন্টি-এয়ারক্র্যাফট বাহিনী আধুনিক এবং শক্তিশালী। প্রয়োজনীয় এলাকায় আমরা সারফেস-টু-এয়ার নির্ভর হাতিয়ার স্থাপন করেছি। বেসমরিক বাহিনী গণনা চালু করার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। এই গণনায় কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয়ের বড় অংশ ধরবে। বেসামরিক কার্যক্রমে অধিক সংখ্যক মানুষ স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে।

প্রতিরক্ষা সংগ্রহ

বিদেশী সংগ্রহ পাবার সম্ভবনা আমাদের জন্য সীমিত। কিন্তু আমি নিশ্চিত করতে চাই যে হাউস মানে আমরা এই সম্ভবনাকে অবহেলা করছিনা। আমাদের প্রধান নির্ভরতা অবশ্যই আমরা। আমাদের তোপ কারখানাগুলো এবং সামরিক অঙ্গীকার সেবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য কাজ করছে। বিভিন্ন নতুন হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি উন্নত হয়েছে এবং তৈরি হচ্ছে। সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। সামরিক উন্নয়ন ও গবেষণার বৈজ্ঞানিক কাজ ও তাদের সহযোগীরা আমাদের প্রয়োজন গুলোতে আত্ম-নির্ভরশীল হতে প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে।
যদিও কোন দেশই পুরোপুরি আত্ম-নির্ভরশীল নয়, বেশিরভাগ উন্নত দেশ টেকসই প্রযুক্তিগত ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছে যাতে তারা অন্যান্য দেশের সাথে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। এভাবে এসব জাতি কর্ম স্বাধীনতা অর্জন করেছে অন্যান্য দেশের সাথে দেয়া ও নেয়ার অনুশীলন উন্নত করার মাধ্যমে। এই টেকসই বা অন্যভাবে বলতে গেলে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আত্ম-নির্ভরশীলতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। আমরাও আমাদের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদদের কাছ থেকে এমন উন্নয়ন আশা করি, বিশেষ করে যারা সামরিক প্রতিষ্ঠা ও গবেষণাগারে কাজ করছে। আমি শুধু নিশ্চিত করতে পারি তহবিলের অভাবে হাউস তাদের কাজ কোন ভাবেই খতিগ্রস্থ করতে দেবেনা।

আমি হাউসকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে সীমান্তের হুমকি মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি থেকেও জাতীয় নিরাপত্তা আগে; এটা আমাদের জাতির উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত, জাতির লক্ষ্য এবং আমাদের ধারন ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। আমি নিশ্চিত আমাদের হাউস আগস্টের মধ্যেই এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং এগুলোর ব্যাপারে পরিপূর্ণ সমর্থন দেবে।

নিউক্লিয়ার শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার

এক্ষেত্রে আমি অনেক সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করেছি আমাদের সামরিক বাহিনীর অনেক সম্মানীয় সদস্যদের ইচ্ছা নিউক্লিয়ার শক্তি অর্জন করা। অনেকবার হাউসে এই ব্যপারটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমাদের বর্তমান নীতি হচ্ছে নিউক্লীয় শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার। আমাদের মতে আমাদের প্রচলিত হাতিয়ার ব্যবহারের তুলনায় নিউক্লিয় হাতিয়ারের কোন বিকল্প নেই। আমি হাউসকে মনে করিয়ে দিতে চাই আমাদের মিলিটারি দক্ষতা অবশ্যই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পের অগ্রগতি কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত। হাউস অবস্থান সম্পর্কে অবগত। ভারত নিউক্লীয় বিজ্ঞান দখল করেছে। অগ্রগতির অন্যান্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচি সম্পর্কেও হাউস অবগত। এই বিষয়ে আমি আরো কিছু বলি এবং পরিপ্রেক্ষিত আচরনে ভুল করে বসি তা হাউস অবশ্যই চাইবেনা।

আন্তর্জাতিক শান্তি-রক্ষা

আমাদের সীমান্তের প্রতিরক্ষা ছাড়াও আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর আরো কিছু দায়িত্ব আছে। বিভিন্ন উপলক্ষে জাতিসংঘের সাথে আমাদের আমাদের সামরিক বাহিনীর শান্তিরক্ষা বিষয়ক যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা সম্পর্কে হাউস অবগত।
১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিল, যখন আমরা আমাদের সমস্যা নিয়ে মগ্ন ছিলাম, আমাদের বন্ধু প্রতিবেশী সিংহল সরকারের কাছ থেকে জরুরী অনুরোধ পাই। একই অনুরোধ অন্যান্য দেশের সরকারের পক্ষ থেকেও আসে। আমাদের সংস্থানের থেকে যতটা সম্ভব সহায়তা করতে একমত হয়েছিলাম। আমাদের হেলিকপ্টার সহজলভ্য। সিংহল সমুদ্রে আমাদের নৌ জাহাজ সিংহল নৌ বাহিনীকে টহলে সহযোগিতা করেছে। আমাদের কর্মীবৃন্দ সিংহলের সাথে মুক্তি বিষয়ক কোন লেনদেন করেনি এবং তাদের শুধু নজরদারি ও টহলে সহযোগিতা করেছে। তাদের কাজের সাথে তারা সিংহল সরকার থেকে তুলে নেয়া দের নিয়ে একটি ছোট বাহিনী গঠন করেছে।

সিংহল সামরিক বাহিনীকে কিছু প্রয়োজনীয় উপকরন আমরা সরবরাহ করেছি। সিংহল সরকারের অনুরোধে, তাদের অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়েছি। হাউস জেনে খুশি হবে, এক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা পারস্পরিক ভাবে সন্তোষজনক।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!