You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10 31 | রণাঙ্গন থেকে - সংগ্রামের নোটবুক

রণাঙ্গন থেকে

গণ প্রতিরােধ পাকিস্তানী হানাদারদের ভাড়াটে লুটেরা রাজাকার বাহিনীতে দলত্যাগের হিড়িক পড়িয়া গিয়াছে। স্বাধীন। বাঙলা বেতার কেন্দ্র হইতে এই খবর প্রচার করিয়া বলা হয় যে, গত কয়েকদিনে বাঙলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত পূর্ব রণাঙ্গনে কয়েক শত রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র সমেত মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পগুলিতে আসিয়া  আত্মসমর্পণ করে। জনসাধারণও ক্রমেই সংঘবদ্ধভাবে লুটেরা রাজাকার বাহিনীকে রুখিয়া দাঁড়াইতেছে। অনেক স্থানে জনতা দেশী অস্ত্র-শস্ত্র লইয়া রাজাকারদের ঘিরিয়া ফেলিয়া নিধন করিতেছেন অথবা মুক্তিবাহিনীর হাতে সমৰ্পণ করিতেছেন। গত ১৭ই অক্টোবর রংপুর জিলার ডিমলা থানার অন্তর্গত বালাপাড়া গ্রামে সাত জন রাজাকার গ্রামবাসীদের কয়েকটি গরু ধরিয়া লইয়া যাইতেছিল। সাদেক মাসুদ নামে এক তরুণের নেতৃত্বে স্থানীয় জনসাধারণ উক্ত রাজাকারদের ঘিরিয়া ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখিয়া বদমাইশরা জনতার প্রতি গুলি চালায়। ইহাতে উপস্থিত জনতার এক জন নিহত ও ৯ জন আহত হন। তৎসত্বেও জনতা সাহসিকতার সহিত রুখিয়া দাঁড়ায় ও রাইফেল সহ ১ জন রাজাকারকে বন্দী করিয়া মুক্তি বাহিনীর হাতে সােপর্দ করে। কিছুদিন আগে চাপানি হাটে জনতা রাজাকারদের উপর আক্রমণ করে। রাজাকাররা হাটে হাটে জনসাধারণের টাকা পয়সা ইত্যাদি ছিনাইয়া লইত। এখানে রাজাকারদের হাতে ৮ জন গ্রামবাসী প্রাণ। দেন। বড়াইবাড়ি হাটে এইরূপ একদল লুটেরা রাজাকারকে ধরিয়া জনতা বেদম উত্তম-মধ্যম দেয়। ইহাতে এই সব হাটে রাজাকারদের অত্যাচার কিছু কমিয়াছে। 

দিনাজপুর। গত ৮ই অক্টোবর দেবীগঞ্জ থানার গোসাইগঞ্জ গ্রামে ৭০ জন শত্রুসেনা গেরিলাদের ছােট একটি দলের উপর আক্রমণ চালাইলে গেরিলারা অসীম বীরত্বের সাথে উহা প্রতিরােধ করিয়া তিন জন রাজাকারকে নিহত ও ১৫ জনকে জখম করে। ইসহাক আলী ও ইদ্রিস মাসুদ নামে দুই জন আহত রাজাকারকে গেরিলারা বন্দী করে। গেরিলাদের পক্ষে মাত্র একজন আহত হন।  হাড়িভাসা হাটে মাইন বিস্ফোরণে ৩ জন পাক সেনা ও ১ জন রাজাকার নিহত হয় ও ৫ জন জখম হয়। এখানে একটি পুলের কাছে মাইন বিস্ফোরনে ৯ই অক্টোবর ৪ জন পাক সেনা খতম হয়। ফেলিয়া যাওয়া মৃতদেহগুলি গ্রামবাসীরা মহাউল্লাসে মুক্তিবাহিনীর ঘাটিতে লইয়া আসে। গত ২১শে অক্টোবর পঁচাগড় তেঁতুলিয়া রাস্তায় চৈতনপাড়া পুলে পাহারারত সব কয়টি রাজাকারকে খতম করিয়া গেরিলারা বিস্ফোরক দিয়া পুলটি উড়াইয়া দেয়। পাক বাহিনীর বীর পুঙ্গবরা দূর মর্টারের শেল বর্ষণ করে। ইহাতে ১ জন মুক্তিসেনা আহত হইয়াছেন। গেরিলারা দেড় মণ টেলিফোনের তারও কাটিয়া আনেন।

গত ১৯শে অক্টোবর বােদা থানার ভাউলাগঞ্জ গ্রামে সকাল ১০টায় প্রায় ৯০ জন পাকিস্তানী হানাদার। হামলা চালায়। মুক্তি বাহিনী উহাদের আক্রমণ করিলে ১ ঘণ্টার লড়াইয়ে ২৫ জন শক্রসেনা নিহত হয়। শুধু ১ জন মুক্তিযােদ্ধা শত্রুর হাতে ধরা পড়িয়াছেন। মুক্তি যােদ্ধারা গ্রেনেড চার্জ করিয়া শত্রুপক্ষের দুইটি ট্রাক অকেজো করিয়া দিয়াছে। বিকল ট্রাক দুইটি পাক সেনারা ফেলিয়া গিয়াছে। রংপুর জলঢাকা থানার গােলমুণ্ডা গ্রামের একটি স্কুলে রাজাকাররা ঘাটি করিয়াছিল। গত ১৮ই অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করিয়া ঐ ঘাটির অনেক রাজাকারকে হতাহত করে। গেরিলারা ৫ জন রাজাকারের কান কাটিয়া দিয়াছে ও ২ জনকে বন্দী করিয়াছে। গেরিলারা সেখানে ৭টি রাইফেল, প্রচুর গুলি ও অনেক রেশন দ্রব্য উদ্ধার করে।  গত ১৩ই অক্টোবর ডিমলা থানায় সুটিবাড়ি হাটের কাছে পথের পাশে জঙ্গলে লুকাইয়া থাকিয়া গেরিলারা শত্রুসেনাদের জীপ ও ট্রাকের একটি বহরের উপর আক্রমণ করে। একজন সুবেদারসহ কয়েকজন পাকসেনা খতম হয়। গত ১৪ই অক্টোবর বড়খাতা রেল স্টেশনের কাছে এক হাতাহাতি লড়াইয়ে গেরিলারা ৩ জন শত্রুসেনাকে খতম করে।  ১৭ই অক্টোবর মােগলহাটের কাটানদীঘিতে শত্রুসৈন্যদের এক দলের উপর অতর্কিত আক্রমণ করিয়া গেরিলারা ১৩ জনকে খতম করে ও তাহাদের অস্ত্রপাতি দখল করে। সম্প্রতি কালিগঞ্জ থানার শালহাটি নােহালি গ্রামে পাক দস্যুরা এক নৃশংস হামলা চালায়। উহারা পাঁচজন কুলবধূকে ধর্ষণ করিয়া পরে হত্যা করে। সিলেট বীর গেরিলারা সিলেটের চা বাগানগুলিতে জোর তৎপরতা চালাইয়া পাক সেনাদের নাজেহাল অবস্থায় রাখিয়াছে। গত ১৯শে অক্টোবর আদিয়ার চা-বাগানে শত্রুদের চেকপােস্টে আক্রমণ চালাইয়া গেরিলারা একজন অফিসার সহ ৫০ জন শত্রুসেনাকে খতম করে। পাক বাহিনী পিছু হটিয়া দূর হইতে দূরপাল্লার কামান দাগিয়া কিছু সংখ্যক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। গত ১৫ই অক্টোবর মুক্তিফৌজ খেজুরিছড়া চা-বাগানে শত্রুদের এক ঘাটিতে দুই বিপরীত দিক হইতে মর্টারের আক্রমণ চালাইয়া শত্রু সেনাদের একটি সম্পূর্ণ প্লাটুনকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দেয়। দ্বিমুখী আক্রমণে হানাদাররা পালাইবার পথ পায় নাই। ৭ জন হানাদার সেনা অস্ত্র সমেত মুক্তিবাহিনী হাতে ধরা পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধ ১:১৭

৩১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯