You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৯০। বাংলাদেশ ও ভারতের ভবিষ্যৎ জয়া প্রকাশ নারায়ণ লিখিত নিবন্ধ কম্পাস ২৭ নভেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

বর্ষার অবসান হতেই ক্ষমতাসীন নেতৃবর্গ সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এবং রীতিমত কলরব শুরু করেছেন। সবচেয়ে সামরিক ঢং- এর কলরব করেছেন আমাদের সুযোগ্য প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর দ্বারা তিনি এদেশের জনসাধারণের বুদ্ধির অবমাননা করেছেন আর নিজেকেও পৃথিবীর লোকের কাছে হাস্যসম্পদ করে তুলেছেন। জলন্ধরে তিনি নাকি বলেছেন- ‘পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক তো খতম হয়ে গেছে। ভারতের আর লড়াই করবার দরকার নাও হতে পারে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান উপলব্দি করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী তাদের প্রাধন্য স্থাপন করে চলেছে আর বিশ্বের মতামতও ক্রমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সবচেয়ে বিচিত্র উক্তি হল- ‘মুক্তি বাহিনী আর একটী মুষ্ঠাঘাত করলেই বাংলাদেশের মুক্তি হয়ে যাবে’।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে শ্রী জগজীবন রাম নিশ্চয়ই অন্যের চাইতেও ভাল জানেন। তিনি জানেন বাংলাদেশে গেরিলার কত সামান্য হাতিয়ার নিয়ে লড়ছে- তাদের নিয়মিত সংগ্রাম করার বাহিনীকত ছোট, অগ্নেয়াস্ত্রে তদের কি শোচনীয় স্বল্পতা রয়েছে, আধুনিক আস্ত্রশস্ত্র এবং ভাড়ী সামরিক সরঞ্জাম তাদের প্রায় কিছুই নেই এত সামান্য আস্ত্রশক্তি এবং অর্ধশিক্ষা নিয়ে তারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের পাঁচ ডিভিসন সৈন্যকে ঘায়েল করতে পারবে এ রকম আশা করা মানে অতিবড় মূর্খের স্বর্গে বাস করা। আরও খারাপ কথা হল- এ দেশের জনসাধারণ যাদের ভাগ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাগ্য অবিচ্ছদ্যরূপে বাঁধা হয়ে গেছে, এ ধরণের উক্তি তাদের শোচনীয়রূপে বিভ্রান্ত করবে। আজ যখন জনগণের মধ্যে এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি করা জরুরি প্রয়োজন যাতে সংগ্রামী চেতনায় তারা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারে, নিজেদের মধ্যকার সবরকম ভেদাভেদ ভুলে যেতে পারে, কর্মের প্রতিক্ষেত্রে সর্বদিক উদ্যম নিয়ে আত্ননিয়োগ করতে হবে, তখন কেউ নয় স্বয়ং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই মারাত্নক আত্ন-সন্তুষ্টির মধ্যে জগৎকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছেন, যে বিনা সাহায্যে বাংলাদেশের সৈন্যরাই কাজ খতম করে দিতে পারেবে।

একথা অবশ্যই সত্য বাংলাদেশের লোকদেরই লড়াই করতে হবে। কিন্তু যেহেতু বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা সাহসী, সংকল্পব্ধ এবং অনন্যনিষ্ঠ, সেইহেতু তারা নিজেরাই পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে এ ধরণের কথা বলে আমাদের নিজেদেরকে এবং বিশ্ববাসীকে প্রতারণা করা নিরর্থক। তাদের সাহায্য কাউকে আসতে হবে। ভারত ছাড়া সে ক্ষমতা এবং উদ্বেগ আর কার আছে? এটা যদি কেবল আর্ত প্রতিবেশীকে সাহায্য করার প্রশ্ন হত তাহলে এ যুগের জাতি-রাষ্ট্রের অনৈতিক নৈরাশ্যক ও হৃদয়হীন রীতি অনুসরন করে নিজের দোরগোড়ার বাইরেই লুটতরাজ, নারীধর্ষণ ও বিধ্বংসী কার্যকলাপ সম্পর্কে চোখ বুজে থকলেও হয়ত ভারতের পক্ষে তা যুক্তিযুক্ত হত। আমাদের বিবেককে বাঁচাবার জন্য আমরা কানে তুলো দিয়েও থাকতে পারতাম যাতে বাংলাদেশে পাকিস্থনী সৈন্যদের পাপালয়ে বন্ধী হতভাগিনী বাঙলি তরুণীদের হৃদয়ভেদী নৈশ আর্তনাদ আমাদের শুনতে না হয়। বাংলাদেশের লোকেদের ‘হিন্দুপ্রবণ’ সংস্কৃতি ধ্বংস করে, কি করে খাঁটি মুসলমান হতে হয় তা তাদের শিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশে একটি জারজ জাতি সৃষ্টি করার স্পর্ধিত পাকিস্থনী উক্তি সম্পর্কেও আমরা বাধিত থাকতে পারতাম। তাদের পূর্বাংশের উপনিবেশটিকে অমুসলমান বিশেষ করে হিন্দু শূন্য করা, যথেষ্ট সংখ্যায় বাঙালি মুসলমানকে খুন করে বা বিতাড়িত করে তাদের জায়গায় যথেষ্ঠ ‘অনুগত’ পাকিস্তানী আমদানী করে বাঙলি সংখ্যালঘুতে পর্যাবসিত করা এবং তার দ্বারা বাঙলি জাতীয়তাবাদকে নিস্ক্রিয় করে তোলা, মুসলিম জগতের সর্বোত্তম সাংস্কৃতি উজ্জীবনকে ব্যর্থ করে দেখা, বাঙলি দেশপ্রেমিকদের কবরে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে চাপা দেওয়া সর্বশেষ দ্বিজাতিতত্ত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা আমাদের মনের দরজায় খিল রাখতেও পারতাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যের কথা হল বাংলাদেশ ভারতের পক্ষেই এক জীবন-মরণের প্রশ্ন। শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় কোটিতে পৌঁছেছে এবং সেই যে অন্যায়জনক পৌনঃপুনিক উক্তি- ‘বাংলাদেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে শরনার্থীরা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে’ তা সত্য করে তুলবার জন্য বিশ্বের দুই রাশিয়া ও আমেরিকা যদি পাকিস্তানকে সম্মত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কালক্রমে শরণার্থী সংখ্যা কোটি কিম্বা বেশি হতে পারে। কিন্তু এ শুধু শরণার্থী বহনের প্রশ্ন নয়। লোকস্ফিত ও দারিদ্র্যপীড়িতে আমাদের দেশের উপর ক্রমাগত এত বেশী শরণার্থীর চাপ সামাজিক, রাজনৈতিক, ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কি পরিণাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে তা অতিবড় নির্বোধও উপলব্দি করতে পারে।

সোজাসুজি সমস্যাটির মুখোমুখি হয়ে বুঝতে হবে পৃথিবীর অন্তত মুখ রক্ষার মত সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে ভারত টিকে থাকবে কিনা, বাংলাদেশ প্রশ্নটি তার চাইতে কিছু কম নয়। নিক্সন এবং পদগার্নি যদি না-ও জানেন নয়াদিল্লীর এখন জানা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম জাতিতে পরিণত না হলে একজন শরণার্থীও, অন্তত একজন অমুসলমান কিম্বা রাজনীতি সচেতন মুসলমানও ফিরে যাবে না। তথাকথিত বিশ্ব সমাজ যতই বুঝান বা চাপ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিতে কোন ‘রাজনৈতিক সমাধান’ ইয়াহিয়া খান মেনে নিবেন কখনও তার সম্ভাবনা নাই। এ ধরনের বুঝানো পড়ানো ও পীড়াপীড়ির ফল কি হয়েছে তা ইয়াহিয়া খান নিজেই তার বহু প্রতীক্ষিত ১২ই অক্টোবরের বিবৃতিতে বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে দিয়েছেন। অনুমান রাশিয়া এবং আমেরিকা উভইয়েই ‘রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম ধাপ হিসেবে শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেবার জন্য পাক প্রেসিডেন্ট এর ওপর চাপ দিচ্ছেন। তার উত্তরও ইয়াহিয়া খান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন সামরিক ট্রাইব্যুনালের যে প্রশ্নটি তিনি খাঁড়া করেছেন তা যদি শেখ মজিবকে নির্দোষ না করে তাহলে তিনি একজন দেশদ্রোহীর সাথে কথা বলতেও প্রস্তুত নন। এ মানুষটি অতি সস্প্রতি পাকিস্তানের নির্বাচন এক বিস্ময়কর জয়ের গৌরব অর্জন করেছেন এবং সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তার দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছেন, জনমত যাচাই করে তার ভাগ্য নির্ণয় করা হবে- এ কথা বলতেও ইয়াহিয়া খানের মুখে আটকায়নি। ‘রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও চেষ্টা চরিত্রের নীট ফল। এই ‘রাজনৈতিক সমাধান’ বস্তুটিকেও ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে- অবশ্য তার একটি বক্তব্য খুবই স্পষ্ট, সেটি হল অখন্ড পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে সমাধান।

ওপনিবেশিক শাসন মুক্তিলাভের জন্য আমেরিকা সংগ্রাম করেছে, কিন্তু সে অনেক দিনের কথা, নিউইয়র্ক বন্দরে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ (স্বাধীনতার মর্মরমূর্তি) ছাড়া সেই উপনিবেশবাদ বিরোধী আদর্শের আজ আর অবশিষ্ট নেই। প্রকৃতপক্ষে আজ আমেরিকা নিজেই একটি বৃহৎ উপনিবেশিক শক্তি। অন্যদিকে রাশিয়া বারাবর ওপনিবেশিকতা বিরোধী সমস্ত মুক্তি সংগ্রাম উচ্চকন্ঠে তার পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছে বটে কিন্তু তার তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোর ওপর তার দখল শিথিল করবার কোন ইচ্ছাই দেখাচ্ছে না। নিতান্ত ভদ্র ভাষাতেই এগুলো তাঁবেদার, আসলে এই রাষ্ট্রগুলোর সেই পুরাতন ওপনিবেশিকরই মতন। এই দুই মহাশক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বিশ্বের ভবিষ্যৎ এর মুঠি ধরে রয়েছে। এবং তা কোন নৈতিক ক্ষমতায় নয়, সংহারের ভীষণতম হাতিয়ার হাতে থাকার জোরে। বাংলাদেশের পক্ষে নিদারুণ বেদনায় যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ সম্পর্ক এই দুই শক্তির দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে-রুশ ভারত চুক্তি সত্ত্বেও কোন মৌলিক তফাৎ নেই। নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ অনুসারে এই দুই দেশেই পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন-

পাকিস্থনের দুই অংশের মধ্যে বন্ধন যতই ডিলে হোক না কেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিপর্যয়ের মধ্যে কী কী প্রশ্ন নিহিত রয়েছে অন্তত ভারতের সে বিষয়ে কোন ভ্রান্ত ধারনা থাকা উচিত ছিল না। ভারত তো কোন ওপনিবেশিক উচ্চাশা নেই, আর ভারত সরকারের আজও কিছু সদস্য আছেন যারা নিজেরা এক সময় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। গোড়া থেকে এটাই পরিষ্কার যে, ‘পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রে’ যা ঘটেছে তা কোন জাতির বিচ্ছিন্নতা নয়। তা হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য ঔপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম। অত্যন্ত বেদনার কথা, অনেক বেশী অস্ত্রশক্তি সম্পন্ন একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাত মাসের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের পরও, সার্বভৌম স্বাধীনতার কম কোন কিছু তাদের এবং তাদের জনগণের কাছে কদাচ গ্রহণীয় হবেনা। বাংলাদেশের ন্যায্য সরকার স্বয়ং বারংবার এই ঘোষনার পরও, ভারতের নেতৃবৃন্দ আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে চলেছেন। এর চেয়ে অন্তঃসারশূন্য আর কিছু কল্পনা করা কঠিন। গত সাত মাসের অভিজ্ঞতার পরও তারা কি করে আশা করতে পারেন যে, পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠিকে তাদের পূর্বাংশের কলোনী হাতছাড়া হওয়ার ক্ষতি স্বীকার চাপ দিয়ে রাজী করানো যেতে পারে- বিষেশ করে যখন তার কিছু শক্তিশালী বন্ধু জুটেছে? নাকি আমাদের শাসকরা নিজেরাই পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা পোষণ করেন, তা-ই যদি হয়, ঈশ্বর এই দেশকে রক্ষা করুন।

সমস্যাটি যদি শুধু বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়েই হত তাহলে আমরাও বাস্তবতাবর্জিত অপ্রাসঙ্গিক অনেক বুলি আওড়াতে পারতাম। কিন্তু আমাদের মৌলিক জাতীয় স্বার্থ যে কতখানি বিপন্ন তা আমি আমার কথা দিয়ে হয়ত আমাদের শাসকদের বুঝাতে পারবো না, তাই প্রধানমন্ত্রীর কিছু উক্তিই উদ্বৃত করেছি (উক্তিগুলো ২৪শে মে ১৯৭১ লোক সভায় প্রদত্ত এবং সরকারীভাবে মুদ্রিত প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে)ঃ শরনার্থী স্রোতের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বলেছিলেন, “এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুল দেশত্যাগ মানুষের লিখিত ইতিহাস অভূতপূর্ব। গত আট সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ হতে প্রায় ৩৫ লক্ষ লোক ভারতে এসেছে। দেশভাগের পর থেকে উদ্ধার বলতে আমরা যা বুঝে এসেছি এরা তা নন। এরা যুদ্ধের কবলে পড়েছেন, সীমান্তের ওপারে সামরিক সন্ত্রাস হতে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এখানে এসেছে। “এরপর প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, শত নয় সহস্র নয় লক্ষ লক্ষ নাগুরিককে বেয়েনটের মুখে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার অধিকার কি পাকিস্তানের আছে। আমাদের কাছে এ এক অসহ্য অবস্থা। ”

তা ছিল মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহ, এখন হচ্ছে অক্টোবরের চতুর্থ সপ্তাহ। তখন শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫ লক্ষ, ৯৫ লক্ষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মতে তখনই যদি অবস্থা ‘অসহনীয়’ হয়ে থাকে তারপর গত পাঁচ মাসে যে ক্রমাগত শরনার্থীদের স্রোত বেড়েই চলেছে তা আমরা কি করে সহ্য করতে পারলাম? সম্ভবতঃ আমাদের প্রিয় আন্তজার্জাতিক উপকারীদের বন্ধুসুলভ আমাদের সহ্যের স্তর উন্নীত করতে সাহায্য করেছে। জানি না কোনদিনই আমাদের সহ্যের সীমায় আমরা পৌঁছিব কিনা।

একই বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, “ভারতের ঘারে বন্দুক রেখে এবং ভারতেরই মাটিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানকে তার রাজনৈতিক বা অন্যান্য সমস্যার সমাধান করতে দেয়া যায় না। পাকিস্তান কিন্তু ঠিক তাই করে চলেছে, তথাপি তা থামাবার জন্য প্রধানমন্ত্রী এই মাত্রই তিনি করেছেন তার দূতদের অন্যান্য রাষ্ট্রে পাঠিয়ে তাদের অনুরোধ উপরোধ করেছেন যে কাজ পাকিস্তানে করতে দেয়া যায় না বলে তিনি গম্ভিরভাবে ঘোষনা করেছেন তা থেকে তারা যেন পাকিস্তানকে বিরত রাখেন। পাকিস্তান অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষতি করে এবং তাদের মাটির উপর দাঁড়িয়ে তো তার সমস্যা সমাধান করতে চায়নি, তাহলে ভারত তার নিজের জাতীয় স্বার্থে করতে প্রস্তুত নয় তা তাদের কেউ করবে- খুন কম করে বললেও তা আত্নবঞ্চনা নয় কি? অন্য কোন রাষ্ট্র যে আমাদের কল্যাণে ভারতকে আর ‘অসহ্য’ বিড়ম্ভনা থেকে উদ্ধার করার জন্য বীর পুঙ্গরবে ভূমিকা নেয়নি তাতে অন্তত আমি তো তাদের দোষ দিতে পারি নাঃ বীর্যবত্তার যুগ যদি কখনও থেকেও থাকে, বহুকাল তা অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেনঃ ‘শুধু ভারত নয় প্রত্যেক দেশকেই তার নিজের স্বার্থ দেখাতে হয়। ওরা (অর্থাৎ পাকিস্তানীরা) বিশ্ব মানবতার একটি বিরাট ভূখন্ড এই যে ভারত তার শক্তি ও স্থায়িত্ব বিপন্ন করেছে। “তারপর ঝঙ্কৃত শব্দে তাঁর বক্তৃতার উপসংহার টেনে প্রধানমন্ত্রী বললেন- বিশ্ব যদি এ অবস্থায় বসে থাকে তাহলে আমরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য এবং আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন কাঠামো বাঁচানো এবং পরিপুষ্ট করার জন্য বাধ্য হয়েই প্রয়োজনমত সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করব। বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশের মৌলিক স্বার্থ কিভাবে জড়িয়ে আছে এর চেয়ে স্পষ্টতার ভাষ্য এবং যে কোন অবস্থায় দেশ রক্ষা ও দেশের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে সর্বাধিক ব্যবস্থা অবলম্বন সম্পর্কে পৃথিবীকে এর চেয়ে পরিষ্কার ও শক্ত হুঁশিয়ারী আর কিছু হতে পারে না।

আজ পাঁচ মাস পরে এই কথাগুলো কত আসার মনে হয়। এই পাঁচ মাসে আমাদের অবস্থা তো কেবলই ঘোরালো হয়েছে। কাজ করার যখন কোন ইচ্ছাই ছিল না তখন এ ধরনের বীরত্বব্যঞ্জক উক্তি করার কি প্রয়োজন ছিল। কথা এবং কাজের এই ব্যবধানই পৃথিবীতে এই দেশের মর্যাদা মারাত্নকরূপে ক্ষুন্ন করেছে, দেশের নেতাদের সম্পর্কে লোকে আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। কথা-কথা-কথা কিন্তু কোন কাজ নয়, এর একটি মারাত্নক পরিণাম হল দেশের মধ্যে দিব্বি নিশ্চিন্তার ভাব ছড়িয়ে পড়েছে, সম্ভাব্য পাকিস্তানী দুষ্কর্মের মোকাবেলা করার মত কোন মানসিক প্রস্তাব নেই। স্বাধীন ভারতের এই সংঘাতিক সংকটে জাতীয় নেতৃত্বের এর চেয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থতা কল্পনা করা কঠিন।

তাঁর সংযম ও ‘রাষ্ট্রিক বিচক্ষণতার’ জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য রাশি রাশি সুপারিশপত্র পাচ্ছেন, কিন্তু তাতে এই দেশ যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বোঝার চাপে আর্তনাদ করেছে তা বিন্দুমাত্র হাল্কা হয়নি এবং জাতির অস্তিত্ব যেভাবে বিপন্ন হয়েছে তাকেও ঠকানো যায়নি। মাসের পর মাস আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক সমাধানের খোঁজ চলছে, কিন্তু তাঁর এই মাত্র ফল হয়েছে ইয়াহিয়া খান বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং তাঁর পথ হতে সরে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছেন। তা তিনি করতেই পারেন, তাঁর একাধিক শক্তিশালী বন্ধু আছে।

আসলে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের চাবিকাঠি কেবল ভারতের হতেই আছে। আমি এর আগেও বলেছি স্বাধীনতা ছাড়া কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। সতরাং যার জীবন-মরণের প্রশ্ন বাংলাদেশের প্রশ্নের সাঙ্গে জড়িত সেই ভারতকেই রাজনৈতিক সমাধানের এই নিষ্ফল সন্ধান বন্ধ করতে হবে এবং সাহস করে বাংলাদেশ ও তাঁর ন্যায়সঙ্গত সরকারকে স্বীকার করে শক্ত হাতে প্রশ্নটিকে চিরদিনের মত মোকাবেলা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীন তাঁর সঙ্গেই উপযুক্ত কথাটি বারবার বলে চলেছেন। ইতিহাস প্রমান করবে তিনি ইতিমধ্যেই এ রকম কয়েকটি উপযুক্ত মুহূর্ত হারিয়েছেন।

সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ছিল এপ্রিলের প্রথম পক্ষে, যখন বাংলাদেশ নেতৃবর্গ ও মুক্তিযোদ্ধাগণ সাহায্যের জন্য চীৎকার করেছিলেন, যখন তাঁরা তাঁদের সরকারও প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন এবং তাঁদের বক্তব্য পেশ করার জন্য সাহায্যের আশায় দিল্লী ছুটে যাচ্ছিলেন। তখন আমরা যেতাম বন্ধুদের পৃথিবীতে যা কিছু শোভন, নীতিসম্মত ও মানসিক তা আমাদের দিকে আসত। তখন আমরা যেতাম বন্ধুদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী ভূমিকা নিয়ে, আক্রমনকারীর ভূমিকা নিয়ে নয়- আর এই সাহায্যের বারবার অনুরোধ আসছিল বাংলাদেশ সঙ্গত ও সংবিধানিক সরকারের কাছ থেকে, যে সরকারকে জন কয়েক মীরজাফর বাদে সকলেই পূর্ণ সমর্থন করেন। অথচ সেই সুযোগ আমরা বৃথায় যেতে দিয়েছি যে সুযোগ কোন জাতির জীবনে একশ বছরে একবার আসে। তখনকার এই নিষ্ক্রিয়তার জন্য ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বদনাম দেওয়া হচ্ছে। আমাদের বীর জোয়ান ও তাঁদের সুযোগ্য অফিসারদের সম্পর্কে এর চেয়ে অধিক অশোভন আর কিছু হতে পারে না। সৈন্যবাহিনীর অপ্রস্ততি নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাই এই জন্য দায়ী-আপাতকালের জন্য বিকল্প পরিকল্পনা তাঁরা দিতে পারেননি।

গোপন হলেও এখন একথা প্রায় সকলেই জানে ঢাকাস্থিত আমাদের ডেপুটি হাইকমিশন বারবার সরকারকে সমাধান করেছিলেন যে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় আলেয়া ছাড়া কিছু নেয়, পাকিস্তান পূর্ব সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং আজ হউক কাল হউক সে ঝাপিয়ে পড়বে। অন্যদিকে একথাও জানা ইসলামাদস্থিত আমাদের হাইকমিশন বরাবর অনেক আশার কথা বলেছেন। দু’জনেই সমান যোগ্য প্রতিনিধি, তাঁদের ওপর দোষারোপ করে লাভ নেই। যখন দুটি সম্ভাবনাই ছিল, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তব্য ছিল, যে কোন একটি সম্ভাবনার জন্যই প্রস্তুত থাকা। আমাদের সুদক্ষ প্রধান সেনাপতিকে যদি অত্যন্ত খারাপ সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত থাকতেই পরামর্শ দেওয়া হত, তাহলে আমি নিশ্চিত জানতাম আমাদের সৈন্যবাহিনীকে দোষ দেবার কোন কারণই থাকত না।

কোন কোন মহলে অনেক করে বলা হয়েছে যে, তেমন কিছু করতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাপারটা পাক- ভারত যুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াত। আজ হউক কাল হউক সে ঝুঁকি নিতেই হবে, কেননা আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এপ্রিলের সেই গোড়ার দিকে অবস্থা খুবই অনুকূল ছিল এবং বিশ্বের লোক জেগে উঠবার ও চলতি ধরনে শোরগোল তুলবার আগেই প্রশ্নটির মীমাংস হতে পারত। এই অনৈতিক দোষদর্শী ও হৃদয়হীন পৃথিবীতে কাজ করে ফেললে তবে লোক তা হিসাবের মধ্যে আনে। আমি এইকথা বলছি না ভারতের উচিত ছিল বাংলাদেশ দখল করে নেওয়া- কিন্তু তাঁদের সাহায্যে আমাদের ছুটে যাওয়া উচিত ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলে দশ- পনের দিনের মধ্যে কাজ শেষ করা উচিত ছিল। তারপর আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরও করতে এবং বাংলাদেশ থেকে সরে আসতে পারতাম যদি না বাংলাদেশ সরকার চাইতেন কোন না কোন ধরনের আমাদের সামরিক সাহায্য বাংলাদেশ আরও কিছুদিন থাকুক, আমাদের আধুনিক সমরাস্ত্র এবং অফিসারগন বাংলাদেশের নিজেস্ব বাহিনী গঠনে কিছুদিন সাহায্য করুক।

মাত্র এই একটি সুযোগই হাতছাড়া হয়নি। কিন্তু সেসব কথা বলতে গেলে তা ক্লান্তিকর হবে। কাজের কথা হলঃ যথেষ্ঠ বিলম্ব ঘটে গেলেও এখন পুরোপুরি সাহস করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত এবং তাঁদের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে সর্বতোভাবে সাহায্য করা উচিত। তাতে হয়ত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, কিন্তু তেমন পরিস্থিতির জন্য যে কোন অস্থাতেই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। শ্রীমতি গান্ধী বারবার জোর দিয়ে বলেছেন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিয়েও স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্ভবত সমস্ত সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। এ কথা শুধু এ দেশের লোকের চোখে ধুলো দেওয়া হচ্ছে। কোন সন্দেহ নেই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রচ্ছন্নভাবে কিছু সাহায্য দিচ্ছি। তা আমরা যতই অস্বীকার করি, গত কয়েক মাসে ধরেই পৃথিবীর সংবাদপত্র তা নিয়ে লিখেছে এবং পৃথিবীর কোন বৈদেশিক দূতাবাসের কাছেই তা গোপন নয়।

আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও ক্ষুন্ন করা ছাড়া এ ধরনের নিরর্থক দোমুখো কাজে কী ফল হচ্ছে? কোন কোন দেশ যদি অভিযোগ করে যে আমরা গোপন সাহায্যের দ্বারা বাংলাদেশে সংঘাত জিইয়ে রাখছি তাহলে সত্যি কি আমরা তাঁদের দোষ দিতে পারি? অতএব এখন আর বীরত্বব্যঞ্জক উক্তি নয় বীরত্বপূর্ন কাজের প্রয়োজন। আমি আগেই বলেছি বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধান শুধু ভারতের হাতেই আছে। ভারত যদি এগিয়ে যায়, নিশ্চিতরূপে অন্যারাও তা অনুসরণ করবে। ভারত এত বন্ধুহীন নয়। অন্যদের সাহায্যে যদি ভারতের প্রয়োজন, ভারতের সাহায্যও অন্যদের কম প্রয়োজন নয়।

শুরুতে ভারতীয় সংসদ পরিষ্কার ভাষায় ও একমত হয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যে প্রস্তাব নিয়েছিলেন তাতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সমগ্র জাতি এই প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে তাঁর দ্বিধাগ্রস্থতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা একই সময়ে গরম ও নরম উক্তি জাতির মানসিকতা বিভক্ত ও হীনবল করে দিয়েছে। দূর্ভাগ্যের কথা, এত বড় সংকটে- যখন জাতীয় ঐক্য অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন- তখনও তিনি তাঁর ভাগ করার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন, কয়েকটি পার্টির বিরুদ্ধে এই অশোভন অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর শুধু দলের স্বার্থ নয় সাম্প্রদায়িক স্বার্থেও বর্তমান অবস্থানকে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু কোন পার্টি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ জাগাবার উদ্দেশ্যে বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে একথা অসত্য।

প্রধানমন্ত্রীর একজন শুভাকাঙ্ক্ষীরূপে আমাদের ইতিহাসের এই সংকট মূহুর্তে তাঁকে আমার বিনম্র পরামর্শঃ তিনি দলীয় রাজনৈতির ঊর্ধ্বে উঠুন, তার নেতৃত্বে সারাদেশ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করুন, জনগনকে পরিষ্কারভাবে পথ দেখান এবং তাদের খোলাখুলি বলুন জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ত্যাগ ও দুঃখবরণ করতে হবে। তা যদি তিনি করেন এবং এই জরুরি মুহূর্তে উপযুক্ত কর্মে প্রবৃত্ত হন তাহলে তাঁর যে ব্যক্তিগত আকর্ষণ আছে, যোগ্যতা আছে, তা দিয়ে জনগণের মহত্তম শক্তিকে তাঁর পশ্চাতে দূর্ভেদ্য ব্যূহের মত সত্য করতে সমর্থ হবেন।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর প্রীতিবশতই আমি বলছি তিনি আমার এই কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনুন। আমি যে সমালোচনা করেছি তা তাকে সাহায্য করার জন্য, হেয় করার জন্য নয়। যে রাজনৈতিক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে কারুর সততাই প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু আমার কোন রাজনীতি নেই, যা কিছু আমি বলেছি অন্তরের অন্তরস্থল থেকে সরাসরি বলেছি, আমার সাধ্যমত সততা ও দেশপ্রেম অন্তরে রেখেই আমি কথাগুলো বলেছি।

(মূল ইংরেজি। অনুবাদ- মনকুমার সেন। )
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!