শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮০। দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্ন | হিন্দুস্তান স্ট্রান্ডার্ড | ২০ সেপটেম্বর ১৯৭১ |
বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী মতামত প্রকাশ
(নিজস্ব প্রতিবেদক), নয়া দিল্লী, ১৯, সেপ্টেম্বর
আজ এখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে বিবাদমান মতামত উপস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশের প্রতি “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়”-এর বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে একটি সেশন নির্দিষ্ট ছিল যা পরিবর্তন করা হয় এবং চেয়ারপার্সন সেনারাতা গুনাবর্ধনে বারবার অংশগ্রহণকারীদের ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য বলছিলেন।
বাংলাদেশের স্বীকৃতি বিবেচনাধীন আছে- এ ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য দিল্লীতে অবস্থিত কিছু বিদেশী মিশনে পরিদর্শনের প্রস্তাব করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। কিছু অংশগ্রহণকারীরা তালিকায় ভারত সরকারের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিল।
আরেকপক্ষ এই সম্মেলন “ভারত সরকারকে যাতে অস্বস্তিতে না ফেলে” এই যুক্তিতে বিরোধিতা করেছিল। একজন অংশগ্রহণকারী প্রস্তাব করেন যে, এর বিপরীতে তাদের অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা উচিত এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য এপর্যন্ত যত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার জন্য প্রশংসা করা উচিত।
মুজিবের মুক্তি
বিতর্ক আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে অ্যাবে পিয়েরে উঠে দাঁড়ান এবং তার বক্তব্য পেশ করার জন্য সভাপতির অনুমতি চান। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার নৈতিক সাহস কোনো সরকারের নেই। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, এই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেয়ার জন্য এবং তার ও তার দলের পক্ষে ডিসেম্বরের শেষে যে ব্যাপক নির্বাচনী অঙ্গীকার দিয়েছিল সেটাকে সম্মান জানানোর জন্য ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি করা কি ভালো হবে না?
একটি সেশনে বিদেশী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ অভিমুখে স্বাধীনতা মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার প্রস্তাবনা বিবেচনা করার সময় জনাব পিয়েরে দ্বিতীয়বারের মতন ভারত সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, এই মার্চ ভারত সরকারকে অসমর্থনীয় অবস্থান ফেলতে পারে যেটার শুরু এর নিজস্ব অঞ্চল থেকে হতে পারে।
কিছু অন্যান্য অংশগ্রহণকারী এর প্রস্তাবনা সম্পর্কে তাদের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আরেকজন মনে করেন যে, এই পদক্ষেপে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের আশীর্বাদ থাকা উচিত না হলে এটা তার উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।
আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের পরামর্শে বলা হয়, আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করলে এটি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের মতন শুভের চেয়ে অশুভ ও জটিলতাই বেশি ডেকে আনবে।
অধিবেশনটি একমত হয় যে, শেখ মুজিবরের মুক্তির জিজ্ঞাসার জন্য নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাই কমিশনের কাছে তাদের সমাধানের একটি কপি প্রেরণ করবে। তারা মঙ্গলবার এটি করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ইসলামাবাদ অভিমুখে যাত্রা
অধিবেশনটি নয়া দিল্লী বা কাবুল থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে পশ্চিম পাকিস্তানকে তাদের দেশের পূর্ব ভাগে প্রকৃত পক্ষে কি ঘটছে সে ব্যাপারে অবহিত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক শোভাযাত্রার আয়োজন করার ব্যাপারে বিবেচনা করছে। একজন অংশগ্রহণকারীর মতে, যাত্রা শুরু করার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে তেহরানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
একটি প্রস্তাবনায় বলা হয় যে, ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে যখন একটি শক্ত বিরোধী দল দাঁড়িয়ে যায়, তার পরিণতি কী হয় সেটার প্রতীকী রূপ হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে দেখেছেন।
“বাংলাদেশের জন্য সাহায্য”- কমিশন পূর্ব বাংলার মানুষকে সাহায্য করার বিভিন্ন ধাপের ব্যাপারে বিতর্ক করেছে। ইনস্যাশিয়েট(insatiate) ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড এনালাইসিস – এর পরিচালক জনাব কে সুব্রমানাম বলেন যে, ভারতের উচিত ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দৃষ্টি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ তৈরির অবস্থা সৃষ্টি করার ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা।
আরও সৈন্য
তিনি বলেন, বৃষ্টির মৌসুমের পরে পাকিস্তানী জেনারেল বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আরও কঠিন ও আক্রমণাত্মকভাবে আক্রমণ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরও সৈন্য ও মারণাস্ত্র আনবে।
এতদসত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লেখযোগ্য সফলতার মাঝেও বাংলাদেশে আরও শত্রু বাহিনীর সৈন্য বৃদ্ধি তাদের সংগ্রামের শেষ পরিণতিতে একটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আর তাই ভারতের উচিত সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারসাম্য হারনোর আগেই কিছু করা।
বাংলাদেশের জনগণকে অবাধে হত্যা সত্বেও পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য বৃদ্ধিতে আমেরিকার উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যায় জনাব সুব্রিমানাম বলেন, পাকিস্তানকে ভারতের বিপক্ষে সমশক্তির দেশ ও আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক চুক্তির সদস্য দেশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাকিস্তানকে অন্যান্য মুসলিম দেশের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হত এবং এখন যুক্তরাষ্ট্র একে চীনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে।
ব্রিটিশ এম পি জনাব উইলিয়াম মলয়ের সভাপতিত্বে অধিবেশনে অন্যান্য বক্তারা অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের প্রচারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তারা বলেন, যোগাযোগের ব্যর্থতার কারণে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশাল অজ্ঞতা তৈরি হয়েছে।
স্বীকৃতির জন্য আবেদন
বাংলাদেশের এবং আরও অন্যান্য দেশের বক্তারা তাদের দেশের সরকারের প্রতি বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। তারা বলেন, বাংলাদেশ হল একটি জীবন্ত বাস্তবতা যার সীমানা দিন দিন আগুয়ান হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রের মতন এর অঞ্চল, সার্বভৌমত্ব ও অন্যান্য সব রয়েছে, আমাদের সরকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে এর পররাষ্ট্র শক্তি আরও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
অস্ট্রেলিয়ার মিসেস স্যালি রায় বলেন, যদিও পূর্ব বাংলায় অবিশ্বাস্য রকমের জীবন ও সম্পদের অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ সংঘঠিত হয়েছে, তবুও বাংলাদেশ এরকম প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভিয়েতনাম ও বায়াফ্রা এর মতন অস্ট্রেলিয়ার কাছে আসে নি। এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ এই সমস্যার ব্যাপারে কিছুই জানে না। প্রতিনিধি দলকে অবশ্যই সেখানে পাঠানো দরকার।
অস্ট্রেলিয়ার আরেক প্রতিনিধি বলেন যে, আমাদের অনেক লজ্জাজনক গোপনীয়তা রয়েছে। যেমন- আমাদের আদিবাসীদের উন্নতির পরিকল্পনার ব্যাপারে আমরা উদাসীন বলে অভিযোগ করা হয়। নিউ গিনির স্বাধীনতার অস্বীকৃতির জন্যও আমরা অভিযুক্ত। তবে আমি আপনাদের সবাইকে আশ্বাস দিতে চাই, বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের ব্যাপারে আপনারা আমাদের কোন উদাসীনতা খুঁজে পাবেন না। যারা বাংলাদেশের ব্যাপারে জানে তারা অনেক মর্মাহত।
জনশ্রুতি আছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইরান, তুর্কি এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রসমুহ প্রচুর পরিমাণে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব সবচেয়ে বেশি অসমর্থনীয় ছিল। যেই দেশ স্বাধীনতার বাতিঘরকে শূন্যে উঠিয়ে রেখেছে এবং বিশ্বকে “আমাকে স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু দাও” এরূপ স্লোগান দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মানবাধিকার জঘন্য পর্যায়ে চলে এসেছে- এর অস্বীকৃতিকারীর দলে আমার নাম এখনই লেখা উচিত।