You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭৭। দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অবিলম্বে মুজিবকে মুক্ত করার দাবী ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১


ই. বি. ট্র্যাজেডি
জাতিসমূহ বিস্মিত, ক্ষুদ্ধ
মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তিদানের আহ্বান

নয়াদিল্লী, সেপ্টেম্বর ১৮ – আজ অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ২৪টি দেশের প্রতিনিধি কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘তৎক্ষণাৎ ও নিঃশর্ত মুক্তি’ এর জোরালো দাবী উত্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঘটমান ঘটনাবলির ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান বেদনা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

তিন দিন ব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনের সভাপতিত্ব করা সর্বদয়া নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ কর্তৃক উত্থাপিত এই দাবীতে সম্মেলনটিতে অংশগ্রহণকারী সকল প্রতিনিধি উঠে দাঁড়িয়ে সমর্থন প্রকাশ করেন।

শেখের গোপন বিচারের বিরুদ্ধেও এখানে নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। এছাড়া বিশ্বের সরকারগুলোর কাছে আর্জি জানান হয় তারা যেন সকল সভ্য সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত আইন, অনুশাসন এবং মানব স্বাধীনতার লঙ্ঘন রুখতে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।

সম্মেলন এবং বাংলাদেশের জনগণের সফলতা কামনা করে রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী মেন্ডেস-ফ্রান্স, বুদ্ধিজীবী আদ্রে মার্লো, সঙ্গীতজ্ঞ ইয়েহুদি, মেউহিন, আমেরিকান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং একটি বড় সংখ্যার ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে পাওয়া বার্তা গৃহীত হয়।

সভাপতির পর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সম্মেলনে ভাষণ দেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এ. আর. মল্লিক। তিনি মার্চের ২৫-২৬ এর দুঃস্বপ্নের আগে ঘটে যাওয়া মর্মভেদী ঘটনাবলির বর্ণনা দেন যার ফলে পরবর্তীতে ১০ লাখ বাঙালির বিনাশ ঘটে, ৮০ লক্ষের বেশি গৃহহীন হয়ে জীবন বাঁচাবার তাগিদে ভারতে যেয়ে আশ্রয় নেয়।

তাঁর পরে বক্তৃতা দেন শ্রীলঙ্কার সিনারাত গুনওয়ার্ধানে। এক আবেগপূর্ণ ভাষণে তিনি বলেন “বাংলাদেশের জনগণ তাদের স্বশাসনের অধিকারের প্রয়োগ যেরূপে করেছে তা পূর্বে কোনো জাতির কাছ থেকেই দেখা যায় নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব ছিল তারা যেন তাদের আইনসিদ্ধ অধিকার লাভ করতে পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা। ”

নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বি. পি. কৈরালা সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন “যদি বাংলাদেশের আলো নিভে যায়, তবে বিশ্বের আরো অনেক স্থানের আলোও নিভে যাবে। ”

নাৎসিদের পথ

‘ফ্রেঞ্চ লীগ অব হিউম্যান রাইটস’ এর সভাপতি মঁসিয়ে ড্যানিয়েল মেয়ার বাংলাদেশে চলমান ভয়ানক বিয়োগান্তক ঘটনাবলিকে নাৎসিদের হাতে সংঘটিত ইহুদী গণহত্যার সাথে তুলনা করেন।

ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ রোয়েম প্রশ্ন রাখেন “আমরা কি কারণের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুধুমাত্র তার ফলাফল –শরণার্থীদের উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখব? ”

তাঁর নিজদেশের অবস্থানের সরাসরি বিরোধিতা করে ড. রোয়েম বলেন যে বাংলাদেশের ঘটনাটিকে একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই কারণ এটি বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ।

তিনি জোর দিয়ে বলেন যে সর্বপ্রথম বিষয় হল শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি। তিনি বলেন, হাজারো জীবিত মুজিবের চাইতে একজন নিহত শেখ মুজিবুর রহমানে বেশি বিপদজনক। ”

নিউইয়র্কের অধ্যক্ষ স্ট্যানলি প্ল্যাস্ট্রিক আমেরিকানদের মনোভাব উল্লেখ করতে যেয়ে বলেন “ এক শতাব্দীর জন্যে একটি ভিয়েতনামই যথেষ্টের বেশি ছিল। তারা আরেকটি ভিয়েতনাম দেখতে চায় না। ”

তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন যে সর্বস্তরের আমেরিকান মতবাদ কর্তৃক বিক্ষোভ প্রদর্শন ও চাপ প্রয়োগ সত্ত্বেও প্রশাসন আমেরিকাকে এমন একটি অবস্থানে এনে দাঁড়া করিয়েছে যেখানে “পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বাদ দিলে আমেরিকাই বাংলাদেশে চলমান ঘটনাবলির জন্যে দায়ী। ”

জনগণ উত্তর দেবে

অধ্যক্ষ প্লাস্ট্রিক বলেন যে আগামী বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আমেরিকার ব্যথিত জনগণের পক্ষ থেকে বর্তমান প্রশাসনের জন্য নিশ্চিতভাবেই একটি বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে।

ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স এর সমাজতান্ত্রিক সদস্য ফ্রেড ইভান্স তাঁর তীব্র ও শক্তিশালী ভাষণের সমাপ্তি টানেন এভাবে “জয় বাংলাঃজয় মুক্তিযোদ্ধা”।

নাইজেরিয়ান আইনজীবী সমিতির মিস্টার গ্যানি ফৌয়েহিনমি বলেন “আমরা বাংলার লাখো জনগণকে ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে পারি না। ”

তিনি বোমা, বন্দুক এবং মৃত্যু যেন বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে দিতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে এই জনগণ ক্রমাগত শোষণের স্বীকার এবং এখন তাদের তুলে ধরা দাবী সম্পূর্ণরূপে ন্যায্য।

‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ এর সহসভাপতি যুক্তরাজ্যের স্যার জর্জ ক্যাটলিন বলেন যে সম্মেলনের উচিৎ হবে জাতিসংঘের উপর চাপ প্রয়োগ করা যেন বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা পূরণ এবং তাদের তুলনাহীন দুর্দশার শেষ আনয়নে জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হয়।

জাপানের অধ্যক্ষ সুয়োওশি নারা, যিনি জাপানে অবস্থানরত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই সম্মেলনে যোগদান করেন, এমন উপায় ও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান যাতে করে এই বাংলাদেশ সমস্যাটি বিশ্বশক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রিত একটি বৃহত্তর এশিয়ান যুদ্ধে পরিণত না হয়।

মিশরের জনাব ক্লোভিস মাকসুদ, যিনি লিবিয়া ও সুদানেরও প্রতিনিধিত্ব করেন, বলেন যে বাংলাদেশের সমস্যাটিকে কোনোভাবেই ইন্দো-পাক দ্বন্দ্বের অংশ হতে দেয়া যাবে না।

নিজের আবেগতারিত ভাষণে তিনি বলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়টি সকল মানবতার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাব মাকসুদ বলেন যে পূর্ব বাংলার জনগণকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার মানে হল একটি বর্ণবাদী প্রথাকে এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়া।

জনাব মাকসুদ বলেন যে আরবেরা ভেবেছিল নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালির সমঅধিকার ও সম্মানের যে অপলাপ তার অবসান ঘটবে।

তিনি বলেন যে আরব বিশ্বের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে তিনি এখানে এসেছিলেন প্রকৃত অবস্থা পরিদর্শন করতে। আরবেরা এ বিষয়ে “যতটা ভালভাবে উচিৎ ততটা ভালভাবে অবগত ছিল না” আর তার পেছনের কারণ হল তারা নিজ নিজ দেশে চলমান সংকটে গভীরভাবে নিমজ্জিত ছিল।

তাদের দুজন প্রতিনিধি ডেনমার্কের মিস্টার নেলিসন এবং নরওয়ের মিসেস সিগ্রিড হ্যানিসঢাল এর মাধ্যমে ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট’ পূর্ব বাংলার জনগণের স্বশাসনের অধিকার খর্ব হবার ব্যাপারে উদ্বেগ জানায়।

আফগান সমর্থন

কাবুলের ‘ দ্যা আফগান মিলেট’ এর জনাব কিউ. হার্দাদ আফগান জনগণের সংহতির ব্যাপারে বাঙালিদের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তিনি বলেন শোষণের শৃংখল ছুঁড়ে ফেলতে বাঙালি জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা তাকে আফগানেরা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে।

‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অব রেলিজিয়ন্স ফর পিস’ এর সাধারণ সম্পাদক ড. হনার এ. জ্যাক অতুলনীয় বর্বরতার ভয়ানক সব কাহিনীর বর্ণনা করেন যেগুলোর খবর তিনি বাংলাদেশে তাঁর অবস্থানকালে জানতে পারেন।

মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি এবং পাকিস্তানকে সকল প্রকার অস্ত্র ও উপাদান সাহায্য হিসেবে পাঠানো বন্ধ করতে নিজ দেশের চারশতেরও অধিক শীর্ষ বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দ্বারা উত্থাপিত দাবীর পুনরাবৃত্তি করেন অস্ট্রেলিয়ার অধ্যক্ষ জন ডারহাম।

অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ‘উটপাখির ন্যায় মনোভাব’ এর ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন যে তাঁর দেশের বেসরকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে জনমতকে প্রভাবিত করতে একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রচারাভিযান শুরু করেছে যাতে করে জনমতের চাপ সরকারকে তাদের মনোভাব পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে।

‘যুগোস্লাভিয়ান লীগ ফর পিস’ এর মিস্টার পাভিই জেভারমোভিচ বলেন যে বাংলাদেশের জনগণকে স্বশাসনের অধিকার অবশ্যই দিতে হবে, যা তারা ইতিমধ্যেই প্রয়োগ করেছে।

উদ্বোধনী অধিবেশনের অনুষ্ঠানস্থল সাপ্রু হল বিশিষ্ট বিদেশী ও ভারতীয় প্রতিনিধিগণ, বিশেষভাবে আমন্ত্রিত কূটনৈতিকবর্গ, বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক এবং অন্যান্য গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ দ্বারা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল।

সকালের অধিবেশনে প্রায় ১৪০ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৭০ জন আসেন ৫টি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত ২৩টি বিদেশী রাষ্ট্র থেকে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় দলগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের।
সম্মেলনে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মিসেস বিজয়ালক্ষ্মী পণ্ডিত, আচার্য জে. পি. ক্রিপালানি ও মিসেস সুচেতা ক্রিপালানি, মিসেস কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায়, মেসার্স এম. সি. চাগলা, আর. আর. দিবাকর, জে. জে. সিং ভীমসেন সাচার, এন. জি. রাঙ্গা, এম. এল. সন্ধি, সাদিও আলী, এস. এন. মিশ্র, এল. এম. সিংভি, সমর গুহ, সিব্বানলাল সাক্সেনা, শাহ নাওয়াজ খান, শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং অন্যান্যেরা উপস্থিত ছিলেন।

ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্মেলনটিতে কংগ্রেস (আর) এবং সিপিআই এর কোনো আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছিল না।

এই ঐতিহাসিক সম্মেলনটি শুরু হয় এর সচিব মিস্টার রাধাকৃষ্ণ এর শুভেচ্ছা বক্তৃতার মাধ্যমে।

নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্যে জীবন বিলিয়ে দেয়া বাংলাদেশের জনগণের সম্মানে দুই মিনিটের নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনটির কর্মসূচি আরম্ভ হয়।

মূল আলোচ্য বিষয়

সম্মেলনের বিবেচনার নিমিত্তে মূল আলোচ্য বিষয়বস্তুগুলো ছিল ১) বাংলাদেশের পরিস্থিতি, ২) বাংলাদেশের সরকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং ৩) সরকারী-বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়বদ্ধতা।

এই বিষয়গুলো সম্মেলনটির তিনটি আলাদা আলাদা আদেশপত্রে আলোচিত হবে। সম্মেলনের শেষ দিনে এই তিনটি আদেশপত্রের উপর প্রতিবেদন ও তাদের বিশ্লেষণসমূহ নিয়ে আলোচনা হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!