শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭২। বাংলাদেশ- টাইম এন্ড লজিক রানিং আউট এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশের পুস্তিকা | পুস্তিকা | সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ
টাইম এন্ড লজিক রানিং আউট
যখনই পাকিস্তান কোন ঝামেলায় জড়ায়, প্রায় প্রতিবারই বিশ্বের তরফ থেকে প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতকেই শান্তির পথে খলনায়ক হিসেবে ধরা হয়। এই দূর্বলতা তার ব্যাপক জনসংখ্যা ও উন্মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা হতে উদ্ভূত হয়েছে, ভারতকে এ নিয়েই থাকতে হবে যখন এই বছরের ২৫শে মার্চের সন্ধ্যা হতে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থার উপর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম হতে সতর্কতা বার্তা ছড়ানো সত্ত্বেও বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ হয়েছিলো মন্থগতিতে, যা মোটেও আশ্চর্যজনক ছিল না। মধ্যপ্রাচ্য তথা সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা যা এখনো চলছে, প্রায় সার্বজনীনভাবেই পুরো বিশ্বের মোড় সেদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব সংস্থার দূর্বল অবস্থান সত্ত্বেও ইউ. এন. প্রতিনিধিদল অঘোষিতভাবেই স্বীকার করেছে যে বাংলাদেশে খুব ভয়ংকর কিছু ঘটেছে এবং এই অবস্থা আরো গুরুতর হচ্ছে। এমনতরো দৃশ্য ইউ.কে., কানাডা এবং অন্যখানের সংসদীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা আরো বেশী স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে এবং দলীয়ভাবে বিশ্ব হতে তা আরো আসার অপেক্ষায়।
বর্তমানে অবস্থা এমন যে ভারতের কাছে বাংলাদেশ হতে আসা প্রায় ৭০ লক্ষের মতো শরণার্থী রয়েছে যাদের বাংলাদেশে থাকার অধিকার আছে, যাদেরকে ভারতে বসবাসের স্থান দেওয়া যাবে না এবং যারা অদূর ভবিষ্যতেও ফিরে যেতে পারবে না। বর্ষা মৌসুম সত্ত্বেও শরনার্থীদের অনুপ্রবেশ চলতে থাকে এবং সামরিক জান্তা, যারা সেই রাষ্ট্রকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে তাদের দ্বারা স্থুল দাবী করা হচ্ছে যে বাংলাদেশে পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক আছে। মুক্তি ফৌজের গেরিলা কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং তা বৃদ্ধি করতে দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের ভিত্তির উপর গঠিত, যারা জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং রাজ্যের আইনসভার উপর একচেটিয়া অবস্থান বজায় রেখেছে, ক্রমাগতই তারা তাঁদের গূঢ়প্রতিনিধিদের দ্বারা ‘জনগণের ক্ষমতা’র দাবী এবং ইয়াহিয়াখানের আর্মি দ্বারা নৃশংসতার প্রকৃত চিত্র বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। মেইনল্যান্ড চায়না ক্রমাগতই সামরিক জান্তা জন্য সামরিক ও আর্থিক উভয়ই মূল সাহায্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ অজানা নয়, বরং মাও-সে-তুং এর নিজস্ব যুক্তির শাসন কায়েম করতে শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেনীর অবমাননার জন্য। বাংলাদেশের এই অবিরাম বিশৃঙ্খলার পরিণামস্বরূপ তারা মধ্যবিত্ত শ্রেনীর নেতৃত্বের অবসান দেখতে পায় যা তারা গণবিপ্লবের দৃষ্টিকোণ হতে হিসেবে প্রগতিবিরোধী বলে বিবেচনা করছে যা মূলত সামগ্রিকভাবেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে পাকিস্তানের উদ্বিগ্নতার মতোই বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অনেক দূর এগিয়েছে যে; নিকট ভবিষ্যতে চরমপন্থীরা ক্ষমতা দখল করবে এবং বিশ্বে মাওয়ের চিন্তাধারা ও মাও আধিপত্যবাদের সাথে তাদের সংযুক্ত হওয়ার পরিণাম নিয়ে চীনাদের মনে কোন প্রশ্নই নেই।
আশ্চর্জনকভাবে মেইনল্যান্ড চায়না, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং লাতিন আমেরিকান উপমহাদেশ হতে আমেরিকা যে শিক্ষা পেয়েছে তার পুরোটাই তাদের উপর বিস্মৃত হয়ে গিয়েছে। আমেরিকান সরকারের পক্ষে প্রাথমিক দূরদর্শিতায় একই রকম অভিজ্ঞতাকে চিহ্নিত করতে পারতো। তাদের বোঝা উচিত ছিল যে, চীনের নেতা হিসেবে মাও-সে-তুংয়ের আবির্ভাবের জন্য এবং চরমপন্থি দল দ্বারা সেই উপমহাদেশের ক্ষমতা দখলের জন্য তারাই দায়ী। তাদের শেখা উচিত ছিল যে চিয়াং-কি-শেকের দ্বারা লুঠতরাজ ও যৌনদাসীত্বকরণ আমেরিকান অস্ত্র দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল ও এর মূল নীতি ফলানোর জন্য অনুসৃত হতে অর্থ দেওয়া হয়েছিল এবং আমেরিকা যেখানেই তাদের উদ্বৃত্ত অস্ত্র ও তহবিলের যোগান দিয়েছিল সেই সবের প্রতিটি দেশেই একই রকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল এবং গালফের কম বেশী অনেকের সাথে অবনতি করতে সহজ বহির্গমন পথের ব্যবস্থা করেছিল। প্রাথমিক অস্বীকার সত্ত্বেও এটা এখন প্রকাশ্য এবং আমেরিকান সরকার যথেষ্ট নির্লজ্জের মতো প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে যে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত আছে এবং ভারতের আতংক ও এই প্রশাসনের চলার পথকে কৌতুক করতে বিশ্বজুড়ে উপহাসের সত্ত্বেও তা অব্যাহত রাখবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পাহারার উপর রয়েছে। কিন্তু সে কিভাবে কাজ করবে তার ভবিষ্যৎবাণী কেউ করতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলো তা ইরান, তুর্কি বা অন্যান্য দেশ যাই হোক না কেন তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে ব্যাপক অস্ত্র সরবরাহ করেই চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তান এর সবটুকুই যে মুসলিম জনসংখ্যার প্রাধান্যপূর্ণ বাংলাদেশ যা আগে পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত অধিকতর জনগোষ্ঠীকে ধারণ করছে তাদের স্বাভাবিক আকুতিকে দমন করতে ব্যবহার করছে এই সত্যটুকু সম্পর্কে তারা একেবারেই উদাসীন। উপসংহার হিসেবে এটাই অখন্ডনীয় মনে হয় যে, এই সমস্ত কর্মকান্ডই পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী উপর ভিত্তি করে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের লালন পালন করতেই অবাধ ক্ষমতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
এটা এখানে বিশ্লেষণ করা উপযুক্ত হবে এই জন্য যে তৎকালীন ভারতের একটি অংশে কিভাবে এবং কেন এইসব ঘটেছে যখন পাকিস্তানের চাইতেও চারগুণ জনসংখ্যার হয়েও অবিচ্ছিন্ন ভারতের অন্য অংশটি নিজের ভবিষ্যত সময়কালের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য সংগ্রাম গঠনে এগিয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি অধঃপতিত, খন্ডিত মুঘল সাম্রাজ্য থেকে ভারতের দখল নিয়ে নেয়। বৃটিশেরা মুসলমানদের উপরে হিন্দুদের উৎকর্ষতাকে আরো মজবুত করে। পক্ষপাতমূলক পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা হিন্দুদের মধ্যে নবজাগরণের ও নতুন এক জীবনধারার উন্মেষ অনুসৃত হওয়া শুরু হয়। উনিশ শতকের শেষের দিক হতে হিন্দু বিদ্রোহ শুরু হয়। আকবরের শাসনামলে যারা একই জায়গার সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করা শুরু করেছিল পরিবর্তিত সাম্রাজ্য নীতিতে হিন্দু ও মুসলমানদেরকে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রূপান্তরিত করে। ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ধর্মযুদ্ধে গান্ধীজ্বী ভারতের সকল সম্প্রদায়কে একই পতাকাতলে জড়ো করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্ররোচিত সাম্প্রদায়িক ক্রোধ জ্বলে ওঠার পরে হিন্দু ও মুসলমান দুই আলাদা জাতির মতো কুখ্যাত তত্ত্বে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে জিন্নাহকে আদর্শ হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ফেলে রাখা নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক মতপার্থক্যগুলো হয়তো যথাসময়ে সমাধান করা যেতো। কিন্তু, আন্দোলনের কর্ণধারেরা ইতোমধ্যেই শ্রান্ত হয়ে গিয়েছে। তারাও ক্ষমতার কিছুটা স্বাদ পেয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ঔপনিবেশিক বৃটিশদের ক্ষমতা এতোটাই দূর্বল হয়ে গিয়েছিলো যে তা পুনরুদ্ধারের আশার বাইরে ছিল। বৃটিশদের ক্ষমতা হতে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নেতারা সেই সুযোগ বাজেয়াপ্ত করে ফেলে যা শুধুমাত্র তাদের ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন কিছু হতে বের হয়ে আসার জন্য উৎসুক ছিল, কারণ তা যদি তারা না করে তবে সেটাই ঘটবে। জিন্নাহ্র হতবুদ্ধি অবস্থায় অবিচ্ছিন্ন ভারত পাকিস্তান এবং ভারত নামে বিভক্ত হয়ে যায়। ঐক্যের অসহায়ের মতো কান্না সত্ত্বেও মহাত্মা এর বিরুদ্ধাচারী ছিলেন। এই অস্বাভাবিকতায় মহাত্মাকে তাঁর মৌনসম্মতির জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। দেশটি মুসলিমদেরকে পাকিস্তানে এবং অমুসলিমদের ভারতে দেশান্তরের মতো মানবিকতাকে উপড়ে ফেলার বিশাল এই দ্বিপথকে দেখে ফেলেছে।
পাকিস্তানের অস্তিত্বের ২৪ বছরে অনেক রকম শিক্ষাই পেয়েছে যা জাতি হিসেবে আমাদের বিপন্ন করতে আমরা অন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করতে পারে। বিদায়ী বৃটিশ শক্তি যারা বৃটিশ শাসনের শেষ দিকে মধ্যস্তকারীর গোপন উদ্দেশ্যে ভাইদের মাঝে যুদ্ধে রত করে ভারতকে বিভক্ত করেছিল তারা ইতোমধ্যেই নিদারুণ ফল ভোগ করেছে।
বৃটিশরা ভারতে যে শূন্যতার তৈরী করেছিল তা আমেরিকা, পাকিস্তান এবং ইউএসএসআর নির্দ্বিধায় পূরণ করে ফেলে। এটা স্বীকার করতে হবে যে নিজেরা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের জন্মের কারণ হচ্ছে অভিজাত ও নব্য অভিজাত মুসলমানেরা পাকিস্তান দাবীর পেছনে মুসলিম জনসাধারনকে তাদের দারিদ্র ও অনুন্নয়নের উপর ভিত্তি করে তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে সফল হয়েছিল যা এই উপমহাদেশে বৃটিশদের যুগোপযোগী প্রভাবের দ্বারা হয়েছিল। এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই যে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় সংগ্রামে অভিজাত ও নব্য অভিজাতদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য ছিল, বরং তাদের বেশীরভাগ আগ্রহ নিজেদের ও তাদের পরিবার-পরিজনের জন্য স্বাধীনতার ফল ভোগ করার মধ্যে। জিন্নাহ্ ও লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর সংকটাপূর্ণ মুহূর্তে তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের আড়াল করে পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের সমর্থনে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের নতুন অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান হতে বঞ্চিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা সেনাবাহিনী কিংবা প্রশাসনের কার্যালয়ের মাছ-ভাতের উপর এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে কৃষিতে সমৃদ্ধ অঞ্চলে উৎপাদিত ফসলের ফল ভোগের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার মধ্যে নিজেদের প্রকাশের নতুন পথ খুঁজে পায়। যেখানে একজন অন্ধ ব্যক্তিও দেখতে পায় যে বর্তমানে ধর্ম কোন জাতির জন্য মাইলফলক হতে পারে না সেখানে অন্য আর কোন উপায়ে আমরা ইউরোপের খ্রিস্টান জাতি ও মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম জাতির মধ্যকার অব্যাহত যুদ্ধকে ব্যাখ্যা করতে পারি?
বাংলাদেশের ঘটনা আলাদা, কারণ এর জনগণ জাতিতত্ত্ব, ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা বাস্তব্যবিদ্যা যাই কিছু আছে সবকিছুই পূর্ব পাকিস্তান হতে হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের হতে সম্পূর্ণ আলাদা। সঙ্গীত ও সাহিত্যপ্রেমী বাংলাদেশের জনগণ তাদের ইচ্ছানুসারে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষমতায়নের জন্য বিদ্রোহের পতাকা উত্থাপন করেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের ভিতরে নিজেদের মধ্যেও সেনা শাসনের বদলে স্বশাসনের দাবীর জন্য দলগত অভিব্যক্তি প্রকাশের পথ খোঁজা শুরু হয়ে গিয়েছে। ইয়াহিয়া খান ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’ -এর পক্ষে সংবিধান গঠনে সম্মত হয়েছেন। তাঁর উপদেষ্টাদের কাছে স্পষ্টভাবে পশ্চিম পাকিস্তান বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনের মধ্যে কি চলছিল তা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিলো না। শাসক দলের সকল হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে এবং প্রাদেশিক আইনসভায় একচেটিয়াভাবে প্রধান দল হিসেবে হিসেবে অক্ষুণ্ণ থাকে। শেখ তার ছয় দফা কর্মসূচীর প্রেক্ষাপটে সতিকারের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে সহাবস্থান তৈরী করেছিলেন যার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী বা শিল্প ও বাণিজ্যে যেখানে পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাব হতে জনগণ শাসন করছিল সেখানে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। ইয়াহিয়া পাকিস্তানের অস্বাভাবিক অবস্থায় অবধারিত বিভক্তির গন্তব্যে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলেন।
বিশ্ব বর্তমানে যেখানে দাঁড়িয়েছে তাতে এর প্রধান তিন পরাশক্তি হচ্ছে- ইউএস, ইউএসএসআর এবং মেইনল্যান্ড চায়না। এই তিন পরাশক্তি বিশ্বে চতুর্থ কোন পরাশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক তা চায় না। অল্প ক্ষমতাধরেরা তা ইউরোপ বা অন্য যেখানেই হোক না কেন তা চতুর্থ পরাশক্তির মত সমান ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারে। ভারত তার ব্যাপক জনগোষ্ঠী, পৃথিবীতে বিদ্যমান ধন্যসম্পদের উপর অধিকারবেল তার দখল যার উপর ভিত্তি করে সে যে অবস্থানে আছে তা হতে তাকে প্রতিরোধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে এই সম্ভাব্য মহাশক্তি হতে শক্তিশালী পাকিস্তানকে আলাদা করে পাওয়া। বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর হচ্ছে ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের দ্বারা পাকিস্তানের আসন্ন বিচ্ছেদের ঘোষণায় তা সে বড় বা মধ্যম বা ছোট যে ভাইয়েরই হোক না কেনও তাদের এই দৃষ্টিকোণ হতে দেখা উচিৎ, যেহেতু বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে তাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বড় বা মাঝারি ক্ষমতাধর বা নীরব থাকাদের ক্রমাগত অর্থনৈতিক এবং সামরিক সমর্থনের মাধ্যমে সাহায্য করা হচ্ছে।
পরবর্তীতে রাজনৈতিক ফয়সালার জন্য ইয়াহিয়া যাদের সাথে কথা বলেছিল তা সম্প্রচারিত হওয়ার জন্য পুরো বিশ্ব অপেক্ষা করছিল। ভারত রুদ্ধশ্বাসে তার উপর চেপে বসা প্রায় সত্তর লক্ষ উদ্বাস্তুর বোঝা হতে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং এর বাইরেও এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে পাকিস্তান নিয়ে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিল যার হলকা সম্পূর্ণভাবেই বিধ্বংসী রূপ নিয়ে পুরো উপমহাদেশের সাথে জড়িয়ে পড়ছিল। এই বিশ্ব রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের উত্থানের উদাহরণে পরিপূর্ণ হচ্ছে যা বাদ দেওয়ার মতো নয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা এখন প্রকাসিত হয়েছে। সামরিক জান্তাকে পরাশক্তি দ্বারা আরো মজবুত করা হয়েছে যা দেখে মনে হচ্ছে পুরাণ মহাভারতের দূর্যোধনের মতোই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর ফলে ডামাডোল ছড়িয়ে পড়া অত্যাবশ্যক, প্রকৃতি তার অমোঘ যুক্তিতে কাজ করে চলেছে। এরই মধ্যে আমাদের সরকারী ও বেসরকারী উভয় প্রতিনিধিরা বিশ্ব সম্পর্কে একটি জরিপ সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে আমরা নিশ্চিত যে বিশ্ব ঘুমাচ্ছে এবং এমনকি যারা জেগেও আছে তারাও অযথা বিরক্ত হতে অনিচ্ছুক এবং নিস্প্রাণ হয়ে বা ন্যায্য কার্য হিসেবে বিনা আপত্তিতে মেনে নিবে, তা যেমনই হোক না কেন, ভারত আমাদের জন্য সুখবর দেওয়ার মতো অন্য কারো জন্য অপেক্ষা করতে পারছে না। এমনকি বর্তমানের প্রত্যক্ষ প্রতিবেশী ও গতকালের নাগরিক হিসেবে আমাদের সাথে শান্তিতে সহাবস্থানে পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিলাষ রয়েছে।
উপমহাদেশের জনগণ শান্তিতে সহাবস্থানের জন্য ক্ষমতাধর ব্রিটিশরা অকপটেই ভারতকে বিভক্ত করেছে। এমনকি হুমকির মুখেও তা বিনা আপত্তিতে আমরা মেনে নিয়েছিলাম এই অনুমানের ভিত্তিতে যে, পাকিস্তানের জনগণ জনগণের ইচ্ছানুসারে তাদের জীবন গঠন করবে। এই বছরের ২৫শে মার্চে পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাস আকস্মিক রূপান্তরের চরম সীমায় পৌঁছেছে যা নিশ্চিতভাবেই সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে যে এটা সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ নয় যা সাড়ে ছয় কোটি জনসংখ্যার পাকিস্তান হতে অপসৃত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠরা কিছুতেই এবং কোনভাবেই অপসৃত হতে পারে না। এটা সেটাই যার বেশীরভাগই অপসৃত হচ্ছে। সবচাইতে খারাপ যা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিজয়কে দমন করতে সামরিক জান্তা বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে যা সংখ্যালঘুদের কারসাজির দ্বারা একচেটিয়া পুঁজিবাদ সমর্থিত। কম্যুনিস্ট শক্তি পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে তাদের ভাইদেরকে বিপদ হতে উদ্ধার করতে প্রস্তুত, যেমন- কিউবা। টিকে থাকার জন্য গণতন্ত্রের সেখানেই সুযোগ আছে যদিনা গণতন্ত্রের মধ্যে থাকা জনগণ সম্মিলিতভাবে নিজের অধিকার সম্পর্কে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে পারে এবং যেখানে স্বাধীনতা হুমকির মুখোমুখি সেখানে তার ভ্রাতৃত্বকে উদ্ধারে মুক্ত নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে। এই মৌলিক বিবেচনার খাতিরে আমেরিকা প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তাদের কর্মকান্ডকে উদাহরণস্বরূপ উদ্ধৃত করার জন্য যৌক্তিকতা উপস্থাপন করতে পারে। এমনও যদি হয় যে বিশ্বের অন্য আর কোন জাতি আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না তবুও আমরা জনসংখ্যায় প্রয়োজনে যথেষ্ট এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সহায়তায় পাশে দাঁড়ানোর নৈতিক বাধ্যবাধকতা আমাদের আছে যারা প্রাদেশিক সরকার গঠনের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে, তা সেই সরকার যেখানকারই হোক না কেন এবং যতটুকু এলাকাই তাদের অধীনে হোক না কেন। অতএব, প্রথম পূর্বশর্ত হচ্ছে বাংলাদেশে জনগণের ক্ষমতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং যৌক্তিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতির উপসিদ্ধান্ত এবং যৌক্তিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির উপসিদ্ধান্ত এবং এই সরকার যাতে ভারত বা অন্য যেকোন জায়গা হতেই সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের উপর ধেয়ে আসা বর্বর অত্যাচারকে পরাভূত করার পথকে সুরক্ষিত করতে পারে তা নিশ্চিত করা।
ভারত যদি এই নৈতিক পরিকল্পনানুযায়ী কাজ করতে পারে তবে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে এই বিশ্ব মূলত শিষ্টতায় এবং স্বাধীনতায় মানবজাতির বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য তিমি মাছের মতো মারা যাবে। অন্যরা এতে আমাদের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য। এমনও যদি হয় যে অন্য কেউই আমাদের সাথে যুক্ত হলো না এবং তাৎক্ষণিকভাবেও যদি পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও ফেলে তবে এই পঞ্চান্ন কোটির বিশাল জনসংখ্যার বিশাল অংশ প্রয়োজনে এর মুখোমুখি হতে বাধ্য। এর মধ্যেই বিশ্ব জেনে যাবে যে, আমাদের প্রয়োজনের খাতিরে এই যুদ্ধ হচ্ছে না। অতএব বিশ্ব জানবে যে, বিশ্বকে জাগ্রত করতে আজ পর্যন্ত আমরা যে যন্ত্রণা গ্রহণ করেছি ও ধৈর্য্ দেখিয়েছি তা বৃথা যায়নি। শুধুমাত্র ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায় যে ইতিহাসের মধ্যে এটি একটি বিরল সুযোগ যা জনগণের ইচ্ছার যথার্থতাকে প্রমাণ করতে, লোভীদের দমন করতে, আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভাজন-প্রক্রিয়াকে বাড়াতে পারে করে এমন কিছুর কর্তন যা বর্তমানে আমাদের মূল শক্তিকে ক্ষয় করছে এবং যে জাতি ন্যায্যত আমাদের ছিল তা ক্রমবর্ধমান জাতি হিসেবে বেড়ে ওঠায় আমাদেরকে প্রতিরোধ করা, ইতিহাসে টিকে থাকাতে আমাদের সামর্থ্য অর্জন। ইতিহাসের শুরু থেকেই একটি জাতি গড়ে তোলার জন্য মরণশীলেরা রক্ত, ঘাম এবং অশ্রুর যোগান দিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে খেলায় আমাদের ক্ষয় হয়েছে তা উল্টো রথের যাত্রা ছিল যাতে দেশের সামগ্রিক ধনসম্পদ প্রায় ধোঁয়ার মতো উবে গিয়েছে। কবে আমরা আমাদের সরকার এবং সম্প্রদায়ে সাহসী জনতার সাহসীকতার প্রতিফলন করাটা শিখতে পারবো। আমরা যে বর্বর পৃথিবীতে বসবাস করি এবং জাতিসত্তাকে উদ্বুদ্ধ করার বাস্তবতায় বিশ্বকে জেগে উঠতে হবে। এটা এমন কোন কাজ নয় যে যা সরকার বা রাজনৈতিক দল কর্তৃক গঠন করা এবং সেই লেবাস ধারণ করার দায়িত্ব নিবে যা বর্তমানে করছে। দেশের আনাচে কানাচে প্রতিটি কোণ হতে জনতার জোরালো ভূমিকা আবশ্যক। যারা দেশ বিভক্তির রাজনীতিতে মত্ত ছিল বা যা এ নিয়ে যথেষ্ট মজা নিয়ে ফেলেছে তাঁদেরকে অবশ্যই জেগে উঠতে হবে এবং জনগণের ইচ্ছাশক্তি এবং তাদের অধৈর্য্তার সাথে আমাদের বর্তমান মধুর ধৈর্য দিয়ে আমাদের সাথে তাদের দাবীর প্রতিধ্বনিকে এতোটাই জোরালো করতে হবে যেন তা বজ্রশক্তিতে পরিণত হয় যাতে ক্ষমতাধরেরা তা উপলব্ধি করতে পারে।
সহায়তা
এ্যাকশন কমিটি ‘বাংলাদেশ’
অনুগ্রহ করে এই সঙ্কল্পটি প্রথম পাতায় সংযুক্ত করবেন এবং এর একটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে এবং অন্যটি এ্যাকশন কমিটি ‘বাংলাদেশ’, লাজপাট ভবন, নয়া দিল্লী-২৪ এ পাঠিয়ে দিবেন।
সংকল্প
এই বৈঠকে…………………………………………………………………………..এতদ্বারা
বাংলাদেশের জনগণের এই ক্লেশ ও অন্তর্বেদনার সময়ে তাদের প্রতি গভীর সহানুভুতি ও সমর্থনের স্থান দেওয়া হয়েছে।
সামরিক শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশুদের উপর সংঘটিত এই অমানবিক নৃশংসতা এবং গণহত্যা দ্ব্যর্থহীনভাবে অত্যন্ত নিন্দনীয় যার ফলশ্রুতিতে লক্ষাধিক বাঙ্গালীর ভারতের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগের ফলে সেই দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে বিশাল অনাকাঙ্খিত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে;
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক প্রেরণা এবং যথাযথভাবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দ্বারা দমন ইউ.এন. সনদ ও মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের চরম লঙ্ঘন;
জনগণের রায় অনুসারে গঠিত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দান এবং যত ভাবে সম্ভব তার সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরী করা হয় তার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে;
কোন প্ররোচনা ছাড়াই আমাদের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সংকটকালীন বর্তমানে সংহতি জ্ঞাপন এবং জাতীয় পর্যায়ের সচেতনতা প্রচারে দেশের সকল হৃদয়বান নাগরিকদের কাছে আহ্বান করা হচ্ছে;
বিশ্বের সকলের কাছে আহ্বান করা হচ্ছে যাতে তারা বাংলাদেশের জনগণের জন্য তাদের সহানুভুতি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং যারা এখনো পশ্চিম পাকিস্তানীদের অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে তাদেরকে যেন তা বন্ধ করতে বলা হয় যাতে পাকিস্তানী আগ্রাসনে তাদের সরকার আগুনে ঘি ঢালার মতো কোন কাজ আর না করে; এবং
উপরোক্ত বর্ণিত সকল বিষয়ের আলোকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সকল সাহায্য ও সহযোগীতায় ভারত সরকার যেন অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।
*মুদ্রন ও প্রকাশনাঃ শ্রী এস.ডি. শর্মা (যুগ্ম আহ্বায়ক, এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশ, লাজপাট ভবন, নয়া দিল্লী) দ্বারা এবং মুদ্রিতঃ নতুন হিন্দুস্তান প্রেস (চাঁদনী চক, দিল্লী)।