You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬৭। মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন প্রচারপত্র ২২শে আগষ্ট, ১৯৭১

মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন

প্রথমত, মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষ হতে আমি বাংলাদেশের সেইসব মুক্তিযোদ্ধা এবং সেইসব জ্ঞাত ও অজ্ঞাত সকল দেশপ্রেমীদের অভিবাদন ও সম্মান জানাচ্ছি যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজেদের মূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও আমি আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিবাদন ও সম্মান জানাই এবং সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর সর্বাঙ্গীন সুস্বাস্থ্য ও সাফল্য প্রার্থনা করছি।

ভাই ও বোনেরাঃ আমাদের সমিতির পক্ষ হতে আমি আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই, আমি আপনাদের সামনের সেইসব কাজ পেশ করছি যা আমরা করেছি এবং আমার বিবেচনায় আপনারাই এর জন্যে সেরা বিচারক।

আপনারা জানেন যে বিশ্ব ইতিহাসের ঘটনাবলীতে মানুষ কখনোই এই ধরনের গণহত্যা, নৃশংসতা ও পাশবিকতা দেখেনি যা ইয়াহিয়া কর্তৃক পূর্ব বঙ্গে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হতে সংগঠিত হয়েছে। আপনারা অবগত আছেন যে ইসলাম ধর্ম-রক্ষকেরা বাংলা-দেশের মুসলমানদের হত্যা করছে, আমরা কি এতে নিশ্চুপ থাকতে পারি? এর একমাত্র উত্তর হচ্ছে ‘না’।

আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হওয়ায় অন্যদের তাদের দেশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামকে সমর্থন দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং মানবতার দিক হতে কর্তব্য বলে অনুধাবন করছি। অতএব, গণতন্ত্রের ঝাণ্ডা উপরে তুলে ধরে রাখতে ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল মালাদ নাগরিক বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠিত হয়। এটি এমন একটি সংগঠন যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা একই সাথে ট্রেড ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সহ মিলিত হয়েছে।

আমাদের সমিতি গঠনের পরে আমরা সেইসব শহীদ যারা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য প্রাণ ত্যাগ করেছিল তাদের স্মরণে ১৯৭১ সালের ১৮ই এপ্রিল একটি মৌন মিছিলের আয়োজন করেছিলাম। পাঁচশোর বেশী নির্ধারিত পুরুষ ও নারীদের হাতে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহনের মধ্য দিয়ে মিছিল অগ্রসর হয় এবং যেখানে সমিতির কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় সেখানে তা গণ-মিছিলে পরিণত হয়। আমরা জনতার কাছে আবেদন করেছি যে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শক্তিশালী করতে যে কোন প্রকারেই তারা যেন সহযোগীতা করে।

আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, ১৯৭১ সালের ৬ই জুন আমরা বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং মুসলিম সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান শ্রী হামিদ দালওয়াই সাহাবের ‘বাংলাদেশ পরিদর্শন করা হতে পারে’ শীর্ষক একটি আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে প্রচুর সংখ্যক জনসমাগম হয়েছিলো এবং সমিতি তদ্বানুসারে বক্তৃতা, শিক্ষা পাঠের ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেভাবেই এই উদ্দেশ্যে সমিতির প্রায় বিশজন কর্মীর একটি দল কয়েকদিনের জন্য মালাদের সর্বত্রই ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও মেগাফোন নিয়ে ক্রমাগত চলাফেরা করেছে। এই সময়ে, আমরা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত্রের প্রায় একশোর অধিক রাস্তার একপাশে সভার আয়োজন করেছিলাম যেখানে প্রায় দশ হাজারের মতো মানুষ জড়ো হয়েছিলো এবং অত্যন্ত মনোযোগ সহকারেই তা শুনেছিল।

কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে, সমাজের সকল স্তরের জনতা হতে তহবিল সংগ্রহের জন্য আমরা এক রুপি মূল্যমানের কূপন এবং খালি রসিদ বই ছাপিয়েছিলাম। এটা আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে জানাচ্ছি যে এই অর্থ প্রধানত অবহেলিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্য এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার, স্থানীয় গুণ্ডা হতে শুরু করে রেলওয়ের বিভাগীয় সুপারিন্টেডেন্ড, ছাত্র হতে, ক্ষুদে দোকানদার এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, পুলিশ এবং আরপিএফ ব্যক্তি হতে, বুদ্ধিজীবী হতে, সরকারী ও বেসরকারি খাতের কেরানি হতে, সবজি বিক্রেতা হতে এবং এমন আরো অনেক হতে সংগৃহীত হয়েছে। আমরা এই অর্থ এই মহান বহুজাতিক শহরের বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী মানুষ হতে সংগ্রহ করেছি। এটা ঘোষণা করতে আমার খুব আনন্দ লাগছে যে যেখানেই আমরা তহবিল সংগ্রহের জন্য গিয়েছি সেখানেই জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়েছি। জনতা যথেষ্টই উদার ছিল এবং এই উদ্দেশ্যের জন্য উদারভাবেই দান করেছে, আমরা মনের অন্তঃস্থল হতেই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

এই আন্দোলন আরো শক্তিশালী করার জন্য সমিতির ব্যানারে নারী বিভাগও গঠন করা হয় এবং বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও প্রচারে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অতএব, আমি এও অনুধাবন করছি যে সেই সব অকৃত্রিম সংগ্রাহক (নারী এবং পুরুষ) যারাই বিভিন্ন সময় তহবিল সংগ্রহের জন্যে এগিয়ে এসেছেন ও কাজ করেছেন এবং সমিতিকে প্রয়োজনীয় উপকরণাদি বিনামূল্যে যোগান দিয়েছেন তাদের সকলকে আন্তরিক অভিবাদন ও সম্মান জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব, এটা বলাই বাহুল্য যে, যে পরিমাণ অর্থ আমরা সংগ্রহ করেছি (যা কিছুই সংগৃহীত হয়েছে) তা বলতে গেলে প্রায়ই অসম্ভব ছিল যদি না তারা তাদের মূল্যবান সমর্থন না দিতো এবং আমাদের সাহায্য না করতো।

আমরা জানি যে সংগৃহীত অর্থ এই বিশাল মানের কার্যাবলীর কাছে কিছুই নয়, বরঞ্চ আমি এটা বলতে চাই যে। তা বিশাল সমুদ্রের সাথে তুলনা করার মতো বিন্দুমাত্র জলের সমানও নয়। এমনকি “শুধুমাত্র বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে” সংগ্রামের পক্ষে পরিবেশ সৃষ্টি ও জনসাধারণকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তা ওয়াকিবহাল করার খাঁটি ও আন্তরিক অভিপ্রায়ের ভাবনা ছিল, আমাদের সংগ্রহ ৮, ১৫২ রুপি যার মধ্যে ৮, ১০১ রুপি প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা পরবর্তীতে নয়া দিল্লীস্থ বাংলাদেশ সহায়তা কমিটিকে হস্তান্তর করা হবে।

আমি স্বীকার করছি যে আমাদের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের পক্ষ হতে আপনাদের সবার কাছে তহবিলের জন্য যাওয়া হয়নি, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সকলেই যখনই সাহায্যের জন্য আপনাদের দরজায় আসবো, তখন আমরা আপনাদের সকলের সহায়তা পাবো।

আমি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবো যদি না আমি আমাদের গৃহীত সংগৃহীত অর্থের সুষ্ঠু বিন্যাস পদ্ধতি সম্পর্কে আপনাদের নিকট আলোকপাত না করি। এই বিষয়ে, আমরা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্য মন্ত্রী শ্রী অজয় মুখার্জীর নিকট চিঠি লিখেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের তহবিল সংগ্রহকালীন সময়ে সেই মন্তিসভার বিলোপ হয়। তারপর ১৯৭১ সালের ২৪শে জুন আমরা নিবন্ধনকৃত এ/ডি হতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, কলকাতা-১৭ এর মিশন বরাবর চিঠি লিখি, কিন্তু যখন আমরা জানতে পারি যে মিশনের প্রধান ১৯৭১ সালের ১৮ই জুলাইয়ের আগে আমাদের প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো অবস্থানে নেই, তখন আবার আমরা ১৯-৭-৭১ তারিখের একটি চিঠিতে তাকে তা মনে করিয়ে দেই এবং সেই চিঠিতে আমারা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করি যে আমাদের সমিতি ১৯৭১ সালের ১৫ই আগষ্ট সংগৃহীত অর্থ হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথাপি, বুঝা যাচ্ছিল যে মিশন তাদের দায়িত্ব নিয়ে অনেক ব্যস্ত ছিল।

অতঃপর ৪-৭-৭১ তারিখ পর্যন্ত মিশনের প্রধানের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষার পর (যেহেতু এই বিষয়ের সেক্রেটারির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার ছিল) অবশেষে ৫-৭-৭১ তারিখে নিবন্ধকৃত এ/ডি হতে নয়া দিল্লীস্থ ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বরাবর চিঠি লিখি এবং আমাদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ সহায়তা কমিটিতে এই অর্থ হস্তান্তর করা হবে।

১৯ তারিখে তৎক্ষণাৎ আমরা কলকাতাস্থ মিশনের প্রধান হতে দু’টি চিঠি পাই এবং বর্তমানে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পরবর্তী সংগৃহীত তহবিল কলকাতা-১৭ এর মিশনের প্রধান বরাবরে পাঠানো হবে।

হিসাবের প্রতিবেদন একইভাবে নিরীক্ষার অধীনে যথাসময়ে জমা দেওয়া হবে।

শেষ করার পুর্বে, এটা একান্তই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখন্ডতা রক্ষায় একতা এবং সংঘবদ্ধ কর্মকান্ডের বার্তা হিসেবে বহন করার জন্য আপনাদের সকলের নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ রইলো। আমি ভীত যে, এখনো যদি আমরা বাংলাদেশ বিশয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারি, তবে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ত্রুটিগুলো জন্য আরো বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে। আমাদের ভুলের জন্য ইতিহাস কখনই আমাদের ক্ষমা করবে না। আমাদের সমিতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে- ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হতে সন্দেহাতীতভাবে যারা মন্ত্রণালয়ের শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, কিন্তু এটা বিশ্ব শান্তিকেও বিপন্ন করছে। ভারত ধারাবাহিকভাবে দুর্বল ও নিপীড়িতদের পক্ষাবলম্বন করে আসছে। সে ন্যায়বিচার এবং নিরপেক্ষতার সমর্থক এবং তা সেই অত্যাচারী যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, যখনই যেখানে অত্যাচার ও নিপীড়ন হয়েছে ভারত তার বিরুদ্ধে উচ্চকিত থেকেছে।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!