শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬৪। সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কাউল কর্তৃক বাংলাদেশ প্রশ্নে সরকারী নীতির সমালোচনা | হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড | ৩১ জুলাই ১৯৭১ |
বাংলাদেশ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে আমরা ভুল করেছি, বললেন জেনারেল কাউল
৩০ জুলাই- ওয়াই এন ই বলছে, সাধারন পরিষদের প্রাক্তন প্রধান এবং বিতর্কিত “দ্যা ইউনাইটেড স্টোরি” এর রচয়িতা জেনারেল কাউল বাংলাদেশ বিষয়ে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ না নেয়ায় তার সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
তার নতুন বই, “কনফ্রন্টেশন উইথ পাকিস্তান” এ জেনারেল কাউল বলেন, আমরা একটি বিশাল সুযোগ হারিয়েছি, এমন সুযোগ ভবিষ্যতে আর নাও আসতে পারে। আমরা বাংলাদেশ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর একটা বিরাট অংশকে ধ্বংস করে তাদের দুর্বল করে ফেলতে পারতাম, যা আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই হুমকিস্বরূপ। কিন্তু আমরা সে সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি।
জেনারেল কাউল মনে করেন, পাকিস্তান এবং চায়নার যৌথ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ অবশ্যই হুমকিস্বরূপ এবং ভারতের উচিত এখনি এ বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাপানের সাথে আলোচনায় বসা।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমালোচনা করে, জেনারেল কাউল বলেন- ২৫শে মার্চ এর পর প্রথম দিকে যখন নানারকম মতামত দেওয়া হচ্ছিল যে ভারতের উচিত স্বাধীনতাবিরোধী এসব শক্তির জন্য প্রেরিত সাহায্যে আঘাত হানা, তখন কিছু ব্যক্তি ঝংকার তুলে সে উদ্যোগটি থামিয়ে দেয় এবং বলে যে এতে করে আমরা চায়নাকে আমাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলবো।
কিন্তু নেফা ক্যাম্পেইনের ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করে জেনারেল কাউল ব্যাঙ্গ করে বলেন- ‘কিন্ত সে ভয়ে কেন আমরা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হব, যখন আমরা জানিই যে ভারতের আর্মি একি সাথে পাকিস্তান এবং চায়নাকে হারিয়ে দিতে সক্ষম’?
১৯৬২ সালে নেফা ছত্রভঙ্গ হবার শুরুর দিকেই জেনারেল কাউল তার নান্দনিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে। তিনি ইতিমধ্যেই তার পূর্বের বইতে উক্ত ঘটনার জন্য রাজনৈতিক ভুমিকা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নেহরু, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিঃ ভি কে কৃষ্ণা মেনন কে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত আর্মি কমান্ডারদের উপর চাপিয়ে দেয়ার বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।
তার বর্তমান বইয়ে ১৬ জুলাইয়ে দেওয়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নাটকীয় ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এর পিকিং ভ্রমনের আহবানে সাড়া দেওয়ার সর্বশেষ খবর সংযুক্ত হয়েছে।
জেনারেল কাউল বলে- “পাকিস্তান চায়নার সাথে মিলিত হয়ে আমাদের উপর হামলা চালাতে পারে এটি ধরে নিয়েই এখন আমাদের কুটনৈতিক আলোচনা জোরদার করতে হবে এবং বন্ধুত্বভাবাপন্ন রাষ্ট্রদের সাথে বসে এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে।
আমরা যাই করিনা কেন, চায়না বা পাকিস্তান যেন ভবিষ্যতে আমাদের বিরুদ্ধে কখনই কোন পদক্ষেপ না নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি পাকিস্তান আমাদের বাধ্য করে এবং আমাদের পদক্ষেপ ই হয়, তবে উপযুক্ত মিত্রের সাথে মিলে প্রথম পদক্ষেপটি আমাদেরকেই নিতে হবে।
জেনারেল কাউল আরো বলেন, যদি ২৫শে মারচের পরপরি আমাদের আর্মি মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে যেত তাহলে আমরা প্রচুর সুবিধা পেতাম। আমরা পাকিস্তানী ট্রুপের দুইটি ডিভিশনকে হাতের নাগালে পেয়ে যেতাম, যারা ঐ সময়ে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেটাই হত সবচেয়ে সঠিক ক্যাম্পেনিং সিজন।
সমুদ্রে আমরা পাকিস্তানীদের জাহাজের খালাস না করেই জাহাজ থেকে নামতে বাধ্য করতে পারতাম। সাধারন মানুষ, পাকিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে ছিল এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য তাড়া চেতনার দিক থেকেও আমাদের পাশেই দাড়াতো। কিন্তু এই পদক্ষেপটি নাওয়া সম্ভব হত, যদি এর পরের পদক্ষেপগুলো নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা থাকতো। আসলে আমরা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা আর ফিকে সহমর্মিতা জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি।
জেনারেল কাউল আরো বলেন- মে, ১৯৭১ থেকে পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় নতুন ট্রুপ পাঠাবে, যার ফলে ৪টি ডিভিশন সেখানে কাজ করবে। এই মুহূর্তে আমরা তাদের থেকে অসুবিধাজনক অবস্থায় আছি। যদি আমরা মার্চ অথবা এপ্রিলেই পাকিস্তানের উপর হামলা চালাতাম, তাহলে আমরা একটা সুবিধাজনক অবস্থান থেকে যুদ্ধ শুরু করতে পারতাম।
“এখন সে সুবিধা শত্রুর হাতে চলে গিয়েছে, এখন উল্টো তাড়া সময় এবং স্থান নির্বাচন করে আমাদের উপর হামলা করতে পারবে। যারা ভাবেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, তাদের প্রশ্ন করা উচিত যে স্বীকৃতি না দিলে কি যুদ্ধ এড়ানো যাবে?
পাকিস্তানে উদ্ভুত বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিশেষ করে তরুন আর্মি অফিসারদের সাহায্যে ক্ষমতা দখন করার জন্য মিঃ ভুট্টোর চেষ্টার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন- “ যদি ক্ষমতার লড়াইয়ে ইয়াহিয়া জিতে যায়, তবে তার ফল পাকিস্তানের দুই অংশকেই ভোগ করতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতে, জেনারেল কাউল বলেন- ইয়াহিয়া খানের হাতে এখন শুধুমাত্র একটি উপায় আছে আর তা হল ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। যদিও, ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ হোক বা না হোক, একটি বিষয় নির্দিষ্ট করে বলা যায় যে -যদি নতুন কারো কাছে পূর্ববাংলার ক্ষমতা আসে, এবং তাই হচ্ছে এখন, পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা মিলে চায়নার ইন্ধনে বৃহত্তর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে।
এই দুই অঞ্চলকে এক ব্যানারে নিয়ে আসতে চায়না পূর্বেও ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে, এবং এবার তাতে সফল হলে ভারত ও পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হবে। কোন সামরিক পরিকল্পনার রূপরেখা গঠন না করে, নেফা ক্যাম্পেইনে প্রাপ্ত যুদ্ধের ক্ষতগুলো আমাদের যে শিক্ষা দেয় তা হলঃ
“সময়ের মূল্য না বিচার করে পরিস্থিতি বিচার করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কখনই আমাদের সরকারের ঢিলেমি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই, কেননা তার ফলাফল ভয়াবহ হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সাথে শীঘ্রই আমাদের একটা চুক্তিতে আসতে হবে, যেন এই নতুন হুমকির মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।