You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৫। বাংলাদেশের অনুকূলে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর শেষে সংবাদপত্রে প্রদত্ত জয়প্রকাশ নারায়নের অভিজ্ঞতা ও বলিষ্ঠ বিবৃতি বিবৃতি ২১ জুন ১৯৭১

প্রেস বিবৃতি

ক। ১৬ই মে দিল্লী ত্যাগ এবং ২৭শে জুন ফিরে আসা- সব ৪৭ দিনের মধ্যে
খ। স্থান পরিদর্শনঃ কায়রো, রোম, বেলগ্রেড, মস্কো, হেলসিঙ্কি, স্টকহোম, বন, প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, অটোয়া, ভ্যানকুভার, টোকিও, ব্যাংকক(বিশ্রামের জন্য- কোন ইন্টারভিউ নেই), জাকার্তা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক(দিল্লীগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরার জন্য)

১। সর্বসেবা, সাং ও গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশনের পক্ষে আমি শান্তির একজন দাস হিসেবে এই মিশন গ্রহণ করি। আমি তাদের পক্ষের সকল ধরনের সহযোগীতা, বিশেষ করে আর্থিক সহায়তার জন্য আসলেই আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

২। সমানভাবে, আমরা যেসব স্থানে পরিদর্শন করেছি, সেসব স্থানের আমাদের দেশের প্রতিনিধিদের কাছে সকল সহযোগীতা ও আতিথেয়তার জন্য আমি আমার উষ্ণ সমাদর জানাই। আমার মিশন যতদূর সম্ভব কার্যকর করার জন্য আমরা সাধারণভাবে ভারত সরকার এবং বিশেষভাবে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

৩। শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সহায়তা বা মানুষের শুধুমাত্র দুঃখ-কষ্ট নিয়ে কথা বলার জন্য কিংবা জগতের নৈতিক বিবেক জাগ্রত করার জন্য আমি এই যাত্রা করি নি। লাখ লাখ মানুষ ত্রাণের জন্য ভারতে পালিয়েছে এবং একই সাথে কয়েক লাখ মানুষ বাংলাদেশে সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে –যা অবশ্যই জরুরি এবং আমি স্বাভাবিকভাবেই এ ব্যাপারে কথা বলেছি। কায়রো বাদে সকল স্থানের পত্রিকা তথা “বিশ্বের নৈতিক বিবেক বা এর যতটুকু এখন পর্যন্ত বাকি রয়েছে” হিসেবে খুব চমৎকার কাজ করছে এবং এখনও করছে।

৪। আমার বড় উদ্বেগ ছিল যে, এর সাথে রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত ছিল যার দ্রুত সমাধান দরকার ছিল, কারণ আমি যাদের সাথে মিলিত হয়েছি তাদের কাছে আমি এটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে, শরণার্থী ও মানবিক সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যার শুধুমাত্র অন্তর্নিহিত উপজাত।

৫। বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম এবং একই সাথে তাদের নিজস্ব কূটনৈতিক চ্যানেলসহ অন্যান্য তথ্যের উৎসকে ধন্যবাদ জানাই। আমি দেখেছি যে, সরকার এই প্রশ্নের রাজনৈতিক দিক দিয়ে বেশ ভালোভাবেই অবগত ছিল। আমার মনে হয় এটি সাধারণভাবে অনুভূত হয় যে, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক রায়কে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে পাকিস্তানকে বিপদ্গ্রস্থ করে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও আমি কিছু সরকারের মুখপাত্রকে দেখি পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে কিছু সংযোগ রয়েছে – এমন আশায় বুক বাঁধতে। তারা সবাই পাকিস্তানকে সামরিক সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য এবং একটি রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার জন্য চাপ দিচ্ছিল। এটা ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের নেতাদের সাথে আলোচিত ছিল যখন তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তারা তাঁবেদারদের সাথে সহাবস্থান করছে কিনা, তখন তারা তা জোরালোভাবে নাকচ করে দেয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যা করেছে, কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালি পাকিস্তানের সাথে ‘সামান্যতম সংযোগ’ পর্যন্ত মেনে নিবে না- এমন দৃষ্টিপাতই তারা প্রকাশ করে।

৬। এই বিষয়ের বাস্তবতা হল এবং এই দেশে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্বে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার ভারসাম্যের স্থিতি অবস্থা বজায় রাখার জন্য বড় বড় ক্ষমতাধররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার এই ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী। তারাই ইচ্ছাকৃত নীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে একত্রিত হয়ে ভারতকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

৭। বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত গেরিলা যুদ্ধ এ উপমহাদেশের অগ্রগতি ও স্থায়িত্বের জন্য বিরূপ ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু আশা করা যাচ্ছে যে, এই অশুভকে কোনভাবে প্রতিহত করা যেতে পারে।

৮। বিশ্বের রাজনীতির কিছু কিছু নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলনের উত্থানের অনিবার্যতা প্রসঙ্গে এখনও দৃঢ় প্রত্যয়ী। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের দাবি করা “স্বাভাবিক” অবস্থা ভুল প্রমাণিত করতে পারছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা পরিস্থিতির বাস্তবতা মুখোমুখি হবে বলে আশা করা সমীচীন হবে না।

৯। তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তার দেশকে স্থিতিশীল রাখার জন্য “বন্ধুত্বপূর্ণ’ পরামর্শ অব্যাহত রাখবে এবং তাদের কাছ থেকে তিনি যা সাহায্য চান, সেটা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।

১০। যেকেনো বিষয়ে ভারতকে অবিলম্বে উদ্বিগ্ন হতে হয় ও পাকিস্তানের আচরণের জন্য ভারতকে ভুক্তভুগী হতে হয় এবং ভারতকে উদ্ধার করার জন্য কেউ প্রস্তুত হয়ে আছে এমন কোনো প্রমাণ আমি কোথাও পেলাম না।

১১। শরণার্থীদের দেখাশোনার জন্য কিছু অর্থনৈতিক বোঝা শেয়ার করার জন্য তারা হয়ত প্রস্তুত আছে- তবে আমাদের অনুমিত সংখ্যা তাদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে- কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক বোঝা ভারতকে একাই বহন করতে হবে। এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন এই বোঝাগুলো অর্থনৈতিক বোঝার কত বেশি ভারী।

১২। পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কিন্তু, প্রথমত এটি দ্বিপক্ষীয় সাহায্য ব্যাখ্যা করে না এবং দ্বিতীয়ত, এটা এখনও দেখার বাকি আছে যে, যদি এটি বাংলাদেশে একটি স্বদেশদ্রোহী সংগঠন না হয় এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এটিকে কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করেন – তাহলে কনসোর্টিয়ামের শর্ত পূরণ হিসেবে কনসোর্টিয়াম দ্বারা গৃহীত হবে।

১৩। আমার ভ্রমণের প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে চাই যে, আমরা যারা ভারতে আছি, আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, আমাদের সমস্যার সমাধান অন্য কেউ এসে দিয়ে যাবে না। এটি আমাদেরকেই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি বাংলাদেশের জনগণের উপর দমন ও নিপীড়ন অব্যাহত থাকে এবং এর সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ফলাফল আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যায় কি না- এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিভক্ত পাকিস্তান ভারতের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কি না- এমন প্রশ্নের সাথে এটি সমার্থক নয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টামণ্ডলী ইতিমধ্যে তাদের জাতিকে বিভক্ত করে ফলেছে। যেই প্রশ্নের উত্তর দরকার সেটি হচ্ছে- পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা জোরপূর্বক বাংলাদেশ দখল, এর সাথে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিণতি, এসব কিছু সাহসী শব্দের প্রত্যাশা করে। আমার জন্য, আমার মনের মধ্যে বেশ পরিষ্কার যে, পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আরও বেশি বিলম্ব করলে তা ভারতের জাতীয় স্বার্থের জন্য অনেক বড় বিশ্বাসঘাতকতা হবে।

১৪। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক প্রণীত গতকালের অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিবৃতি থেকে এটা বেশ সুস্পষ্ট যে, ইসলামাবাদ বাংলাদেশে যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই ইসলামাবাদের নেই। তারা বাংলাদেশের কোন নির্বাচিত প্রতিনিধির সাথে চুক্তি নিয়ে বসছে না এবং প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শক্তিকে বৈধ করার জন্য একটি বিশাল সংখ্যক আসনের প্রহসনের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পরিকল্পনা করছে। সারা বিশ্ব ও আমাদের কাছে এই ব্যাপারটা এখনই স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর মৌলিক মনোভাব সংশোধন আশা করা কল্পনামাত্র। আসলে এটি পাকিস্তানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির আশা আগের চেয়ে অনেক বেশি অসম্ভব করে তুলেছে।

১৫। আমি বিদেশে যাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি, তাদের সবাই প্রধানমন্ত্রীর সংযম এবং কঠিন সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। আমিও এজন্য তাঁর প্রশংসা করি। কিন্তু তাঁকে এখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে কি না। পাকিস্তানের সন্ত্রাস থেকে পূর্ব বাঙ্গালীদের উদ্ধার ও তাদের হারিয়ে যাওয়া গনতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের কোন কল্যাণকর উদ্দেশ্যে নয়, বরং এই দেশে ইয়াহিয়ার খানের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা নিয়া আসা এবং আমাদের জনগণের উপর প্রভাব এবং সব কিছুর ঊর্ধ্বে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রক্ষার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমি স্বীকার করি যে, প্রধানমন্ত্রীকে একাই সঠিক সময়টা নির্বাচন করতে হবে কারণ একমাত্র তিনিই এ বিষয়ের অনুকূল ও প্রতিকূলতার ব্যাপারে জানার ও বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। এমনকি ব্যক্তি নাগরিক হিসেবে আমার কাছে মৌলিক বিবেচনাগুলো স্পষ্ট এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমার আবেদন অগ্রসর করা হোক।

নয়া দিল্লী জয়প্রকাশ নারায়ণ
২৯জুন, ১৯৭১
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!