শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫৪। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাবঃ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষা সহ সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে হবে’। | কালান্তর | ২৬ জুন, ১৯৭১ |
অস্ত্র, সামরিক শিক্ষা ও সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে হবে
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির দাবী
“বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষা সহ সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে”- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পরিষদের এক বিবৃতিতে এই দাবী করেন। বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে এবং অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবী জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখার জন্য এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ও শরণার্থীদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, সমর্থক এবং জনসাধারণ কে আবেদন জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি জাতীয় সংহতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনের জন্য প্রধানমন্ত্রী কে মূখ্যমন্ত্রী সম্মেলন আহবানের জন্যেও পার্টি দাবী জানিয়েছেন।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ গত ১৬ ও ১৭ জুন তারিখে দুইদিন ব্যাপী অধিবেশনে মিলিত হন। এই অধিবেশনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রী রাজেশ্বর রাও এবং কেন্দ্রীয় সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য শ্রী ভবানী উপস্থিত ছিলেন। রাজ্য পরিষদের এই সভায় রাজ্য জুড়ে যে নৃশংস ভ্রাতৃঘাতী আন্তঃপার্টি সংঘর্ষ চলছে সে বিষয়েও আলোচনা হয় এবং এই হানাহানি বন্ধের জন্য কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা সম্পর্কেও এই সভায় আলোচনা হয়।
অধিবেশন শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সংহতি জানানো সারা ভারতবর্ষের জনগণের এখন জরুরী কর্তব্য বলে কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য পরিষদ মনে করেন। প্রায় ষাট লক্ষাধিক মানুষ ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচারের মুখে দেশ ছেড়ে এই দেশে শরণার্থী হিসেবে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে তাদের দেশকে যথাসত্ত্বর মুক্ত করতে পারে তাঁর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, সামরিক শিক্ষা ও অন্যান্য সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে। এর ফলেই গৃহহীন মানুষ তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারবে বলে পরিষদ মনে করে। এই প্রয়োজনেই বাংলাদেশ সরকারকে অবলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন বলে রাজ্য পরিষদ মনে করে। এই স্বীকৃতি দানের বিষয়ে কিছু না করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য পরিষদ ভারত সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং পার্টি তাঁর সমস্ত শাখাকে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বলেছেন।
পার্টির জন্য পরিষদ তার সমস্ত শাখাকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থাদি উন্নতি করার জন্য কাজ করতে বলেছেন। শরণার্থী শিবিরে যারা আছেন তাঁরা যাতে আশ্রয়, খাদ্য, ওষুধ রীতিমতো পান এবং যারা বিভিন্ন ব্যক্তির কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন, তাঁদের প্রয়োজনে তারাও যাতে সাহায্য পান তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। বৃদ্ধ, শিশু ও মহিলাদের যাতে যথাসম্ভব ভালোভাবে রাখা যায় যুবকদের যাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করা যায় তার জন্য পার্টির কর্মীগণ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরগুলোতে সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।
শরণার্থী শিবির পরিচালনায় কেবলমাত্র নেতিবাচিক স্বরুপ উদঘাটন নয় পরন্ত ব্যর্থতা ও দুর্বলতাগুলিকে কাটানোর জন্য পার্টির কর্মীদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে হবে যাতে শরণার্থীদের সুষ্ঠু ও কার্যকরী ভাবে যাহায্য করা যায়।
কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য পরিষদ মনে করে, বাংলাদেশের এই সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। রাজ্য পরিষদ বাংলাদেশের শরণার্থী বিষয়ে উড়িষ্যা সরকারের মনোভাব এবং মেঘালয়ে দাঙ্গার বিষয়ে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি জাতীয় সংহতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন এবং সীমান্ত রাজ্যগুলির স্কন্দভার ভাগ করে নেওয়ার প্রয়োনীয়তা সম্পর্কে সকল রাজ্যগুলিকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সমুহের সম্মেলন আহবানের জন্য পার্টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এ কারণস্বরূপ বলা হয়েছে যে যদি বাংলাদেশের সংগ্রাম ব্যর্থ হয় তাহলে ভারতের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়ার জোয়ারে ভেসে যাবে।
সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের যারা গোলযোগ করার চেষ্টা করছে তাঁদের বিষয়ে হুশিয়ার থাকার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারনের কাছে আহবান জানিয়েছেন। পার্টি স্থির করেছে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংহতি জ্ঞাপক অভিযানই বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম মূল কার্যসুচী। ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ শ্রমিকদের মধ্যে, কিষান সভা কৃষকদের মধ্যে এবং যুব, ছাত্র, মহিলাদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে হবে। এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমস্ত মানুষের সমাবেশ ঘটাতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে আন্তঃপার্টি ভ্রাতৃঘাতী হত্যাকাণ্ড জনিত গুরুতর পরিস্থিতির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজ্য পরিষদ এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে খুনীদের গ্রেফতার করতে এবং ব্যক্তি সন্ত্রাস রোধে পুলিশী অক্ষমতার পটভুমিকা শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই ধরনের সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব। রাজ্য পরিষদ এবং ব্যক্তি সন্ত্রাস বিরোধী অন্যান্য পার্টির সদস্যদের সম্মেলন আহবান করে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করা হোক।
সর্বশেষে বাংলা কংগ্রেসের ভাঙ্গন জড়িত পরিস্থিতিও রাজ্য পরিষদে আলোচিত হয়। পার্টির বক্তব্য এই যে শ্রী সুশীল ধারাকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া উচিত নয়।