You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.10 | 'ইয়োথ ফর বাংলাদেশ'- এর একটি আবেদন | প্রচারপত্র - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৪৪। ‘ইয়োথ ফর বাংলাদেশ’- এর একটি আবেদন প্রচারপত্র ১০ জুন, ১৯৭১

‘ইয়োথ ফর বাংলাদেশ’- এর একটি আবেদন

বর্ণনাতীত একটি মানবিক দুর্যোগ ধীরে ধীরে পশ্চিম বাংলার উপর ডাল-পালা বিস্তার করছে। পশ্চিম বাংলা বাদে অবশিষ্ট ভারত হয়তো এই ব্যাপারে ইতিমধ্যে পড়েছে বা শুনেছে। কিন্তু অভূতপূর্ব এই সংকট রাজ্য এবং সমগ্র দেশে দিনে দিনে আরও ঘনীভূত হচ্ছে এবং উপমহাদেশবাসী এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে আন্তরিকতা প্রদর্শন এবং সংকট নিরসনে ব্যাক্তিগত ও স্বতন্ত্র উদ্যোগ গ্রহনে ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছে।

পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া এই নৃশংস ঘটনাবলীকে আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে না দেখে বরং সহমর্মীতার সাথে আমাদের নিজেদের ব্যাপার হিসাবে বিবেচনা করতে চাই। পাকিস্তানীদের অব্যাহত সন্ত্রাসের ফলে গত ছয় সপ্তাহে ৫০ লক্ষ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিয়েছে। এই সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ১০% এরও বেশী। এখনো প্রতিদিন ৬০, ০০০ করে মানুষ আসছে এবং এই সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কোন লক্ষণদেখা যাচ্ছেনা। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সংখ্যা ১ কোটিতে যেয়ে ঠেকতে পারে।

এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে এই বিপুল পরিমাণ মানুষের আগমনের প্রভাব এই শতাব্দী জুড়ে বিরাজমান থাকবে।

এই বিশাল সংখ্যাক মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে এখানে এসেছে এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ অনাহারে থেকেছে। তাদের মর্মভেদী যন্ত্রণা উপলব্ধি করা এবং তাদের আগমনের ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার দায়িত্ব সমগ্র জাতী, বিশেষ করে তরুণ সমাজের উপর পড়েছে।

এবার আগাম বর্ষাকাল এসেছে এবং এই ৫০ লক্ষের মধ্যে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ উন্মুক্ত মাঠে, গাছের নীচে থাকছে। প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভেজা এবং হীমশীতল রাতের ঠান্ডা মোকাবেলা করা এইসমস্ত মানুষের দূর্ভোগ সহজেই কল্পনা করা যায়। বিশেষ করে শিশুদের, যারা পাকবাহিনীর গুলি অথবা মহামারীতে মা-বাবার একজন বা উভয়কেই হারিয়েছে তাদের অবস্হা বর্ণনা করার অপেক্ষা রাখেনা।

খাদ্য, ওষুধ, স্হানাভাব এবং সেবা করার মানুষের অভাবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভয়াবহ অবস্হা বিরাজ করছে।

এর উপরে আবার কলেরা মহামারী আকার ধারন করেছে এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষ্ণনগর থেকে শিকারপুর এই ৫০ মাইলের সীমানায় শুধু মৃত এবং মৃতপ্রায় মানুষ। বাতাসে পঁচা মাংসের গন্ধ। আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর রাস্তায় দেখা যাচ্ছে বীভৎস সব দৃশ্য। শিশু মৃত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে, সদ্যবিধবা মহিলা মৃত স্বামীকে এখনো বাতাস করে যাচ্ছে, কুকুরের দল প্রতিরোধশক্তিহীন মানুষকে জীবন্ত ছিঁড়ে খাচ্ছে। সদ্য এতিম শিশু পিতা-মাতার মৃতদেহের পাশে বসে আছে- এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য রাস্তার আশেপাশে অহরহই দেখা যাচ্ছে।

কলেরার কারণে এখন পর্যন্ত কম করে হলেও ৩০০০ মানুষ মৃত্যুবরন করেছে। এটাতো মাত্র শুরু! মহামারী চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সদ্যই কলকাতায় জরুরী অবস্হা ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ বহুবছর কলকাতায় কলেরার প্রাদূর্ভাব দেখা যায়নি! বর্ষাকাল যত পার হবে, টাইফয়েড এবং গুটিবসন্ত মহামারীর নতুন কারন হিসাবে যুক্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত ইউনিয়নগুলোর প্রত্যক্ষ সহায়তায় রাজ্যসরকার উদ্বাস্তু সমস্যা সামাল দিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন পরিস্হিতি ভারত সরকারের পক্ষেও সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। বিদেশী সাহায্য চাওয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে কিছু সাহায্য আসতেও শুরু করেছে।

কিন্তু আমাদের এখনো ব্যাক্তিগত এবং সামষ্টিকভাবে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। এই পত্র মারফত সমগ্র দেশের তরুণ সমাজকে সামনে এগিয়ে এসে দায়িত্ব গ্রহণ করার অনুরোধ করা হচ্ছে।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন:
১. শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক।
২. প্রত্যেকের নিজের এলাকাতে সাংগঠনিক সেবা।
৩. আর্থিক অনুদান।

সেবা:

১. এই মুহূর্তে দরকার কয়েকশ ডাক্তার ( অন্তত শেষ বর্ষের ছাত্র হতে হবে, কিন্তু ইন্টার্ন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে), নার্স, কম্পাউন্ডার অথবা ফার্মাসিস্ট।

২. আরও দরকার নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক, বিশেষ করে যাদের উদ্বাস্তুশিবির ও অন্যত্র শরণার্থী এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।

স্বেচ্ছাসেবকদের অন্তত ৩ মাস কাজ করতে হবে। কর্মস্থলে থাকা ও খাওয়ার ব্যাবস্হা করা হবে।

সাংগঠনিক: :

তরুণদের সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষে আমরা সবাইকে রাজ্য, জেলা, থানা এমনকি পাড়া পর্যায়ে সংগঠন করতে উৎসাহ দিচ্ছি। এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আমরা জনমত গড়ে তোলার জন্য;

১. পাকিস্তানের হত্যা-নৃশংসতা এবং শরণার্থীদের কষ্ট তুলে ধরার জন্য আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং জনসভার আয়োজন করা হবে।

২. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য একটি পিটিশনে স্বাক্ষর সংগ্রহ ( কলকাতায় আমরা ইতিমধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি) করে সেটি প্রধানমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

৩.নিম্নলিখিত জরুরী জিনিষগুলো সংগ্রহ করা হবে;
খাদ্য: শিশুখাদ্য, টিনজাত খাবার, চাল, ডাল, লবণ, চিনি, চা ইত্যাদি
তাবু বানানোর জন্য তারপুলিন অথবা পানি নিরোধক কাপড়।
কাপড় (নতুন বা ব্যাবহৃত), ধূতি, লুঙ্গি, শাড়ি, ভেষ্ট, শিশুদের জন্য কাপড়।
বিছানার চাদর, কম্বল।
ছাতা, বর্ষাতি অথবা বৃষ্টিনিরোধক যেকোন কিছু।
ক্যানভাসের জুতা, চপ্পল (সব ধরনের মাপের)।
ওষুধ: সবধরনের ভিটামিন, ঠান্ডা-জ্বর-কাশির ওষুধ, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, শিশুদের টিকা, এন্টি-সেপটিক, ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডার, ডিটারজেন্ট, সাবান এবং ব্যান্ডেজ।
নগদ অর্থ।

অনুদান: :

যারা সরাসরি অর্থ সাহায্য করতে চান, তাদেরও আমরা স্বাগত জানাই।

ইতিমধ্যে ‘অক্সফার্ম’ এবং ‘ ওয়ার এগেইন্সট ওয়ান্ট’ এর মত আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এখানে এসে পৌছেছে এবং কাজ শুরু করেছে। ‘ইয়াং ব্রিটিশ’ ডাক্তাররা অক্লান্তভাবে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে ভারতীয় তরুণদের কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা এখনো কোন সাড়া পাইনি। ভারতীয় তরুণ সমাজ সময়ের প্রয়োজনের সর্বদাই এগিয়ে আসে। এখনই এই মহৎ উদ্দোগে সামিল হবার, চ্যালেঞ্জ নেবার সুযোগ। আমি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে ভারতীয় যুবসমাজের কাছে আবেদন করছি যেন তারা সময়ের প্রয়োজনে জেগে ওঠে। আমাদের তরুণ সমাজ শুধু এই ৫০ লক্ষ মানুষের নির্বিঘ্ন অবস্হানই নিশ্চিত করবেনা, তারা যেন তাদের দেশে ফেরত যেতে পারে এবং নিরাপদে থাকতে পারে সেই লক্ষেও কাজ করবে।

চেয়ারম্যান মিহির
ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ চেয়ারম্যান
১৪ ইজরা ম্যানশন
কলকাতা-১

তারিখ জুন ১০, ১৯৭১