মুক্তি বাহিনীর সমস্যা
(পর্যবেক্ষক) আমাদের দেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষিজীবি ও সাধারণ মানুষকে আজ স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অস্ত্র নিয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী পাক সেনাবাহিনীর সংগে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছে। যেহেতু অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের আজ সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেজন্য অজিকে অস্ত্রই আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়ােজনীয়। আমাদের মুক্তি বাহিনীর ভাইয়েরা কয়েকদিনের ট্রেনিং নিয়ে আজ সুদক্ষ গেরিলা ও কমাণ্ডে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশমাতৃকার প্রতি ভাল বাসাই আজকে তাদের এত সুদক্ষ করে গড়ে তুলেছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রথম দিকে মুক্তি বাহিনী পুলিশ ও ই, পি, আর বাহিনীর সামন্য ৩০৩ বন্দুক নিয়েই তারা যুদ্ধ করেছে। শুধু বুদ্ধির জোরেই তারা এই সামান্য অস্ত্র নিয়ে অনেক জায়গায় মুক্ত এলাকা করে নিয়েছিল। কিন্তু এই সামান্য অস্ত্র নিয়ে দিনের পর দিন সুসজ্জিত ট্র্যাঙ্ক কামান, বিমান গানবােট ও অন্যান্য মারণাস্ত্রের সংগে যুদ্ধ করা একেবারে অবাস্তব ও অসম্ভব। মুক্তি বাহিনী অনেক জায়গায় শত্রু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তাদের অনেক অস্ত্র অবশ্য কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে এবং সে সমস্ত অস্ত্র দিয়েই তারা যুদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য আমাদের আরও অস্ত্র দিচ্ছে ও দেবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তবুও অস্ত্রের অভাব মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা প্রকট ভাবে অনুভব করছে। অনেক মিতব্যয়িতা করে তারা তাদের অস্ত্র ব্যবহার করা সত্ত্বেও তাদের বুলেট ও অমান্য ধরনের ভারী অন্ত্রের প্রয়ােজন প্রচুর পরিমানে রয়েছে।
আমাদের গেরিলা বাহিনী যখন অপারেশনে বিভিন্ন এলাকায় যায় তখন তাদের সামান্য অস্ত্র দেয়া হয়। এবং ফলে সামান্য কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত কিছু শেষ হয়ে যায়। তারা তখন বিভিন্ন অপারেশন অসমাপ্ত রেখেই মূল শিবিরে ফিরে আসতে বাধ্য হয় এবং নুতন অস্ত্র-গােলা-গুলির জন্য দিনের পর দিন। অপেক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল সূত্র থেকে যে সমস্ত অস্ত্র আমরা পাই তার জন্য তাদেরকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। বাংলাদেশ সরকারকে অনুরােধ করব তারা যেন অপারেশনে যাওয়ার সময়ই প্রয়ােজনীয় অস্ত্র গােলা-বারুদ ও মারণাস্ত্র দিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে সেজন্য এদিকেই সবচেয়ে বেশী নজর দিতে হবে।
বিভিন্ন ভাবে আমরা জানতে পেরেছি কতকগুলি জেলায় গেরিলা ও কমাণ্ডে কার্যকলাপ সুসংহত ভাবে হচ্ছে না। সে সমস্ত জেলা বাংলা দেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এটাকে সুসংহত করার জন্য আমরা সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাই। একটা গেরিলা ইউনিট যখন অপারেশনে যার তখন। তাদের তিনটি জিনিষের প্রয়ােজন সবচেয়ে বেশী। আশ্রয়, সংগঠন ও খাদ্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মিদের নাগরিকদের এই তিনটি জিনিষের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। কারণ একটি গেরিলা ইউনিটের। যুদ্ধ ছাড়াও যদি আশ্রয়, খাদ্য ও সংগঠনের কার্যগ্রহণ করতে হয় তবে তা সময়ের অপচয় ও গেরিলা। যুদ্ধের সবচেয়ে বেশী প্রয়ােজনীয় গােপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব হয় না, এর ফলে গেরিলাদের জীবনের ঝুঁকিও এসে পড়ে। সেজন্য কর্মী ভাইদের মুক্তি বাহিনীর জন্য আশ্রয়, খাদ্য জোগান ও সংগঠনকে। সুসংহত করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তাদের নিজস্ব গ্রাম ও শহরে চলে যেতে হবে এবং এ সমস্ত কাজে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। এর ফলে জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে যাবে। মুক্তিবাহিনীর উপরে চাপ কমে আসবে, মুক্তি বাহিনীর কার্যকলাপের গােপনীয়তা বজায় থাকবে ও তাদের নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন আর হতে হবে না। বাংলাদেশের মানুষ অভাবও নির্যাতনের ফলে সংগামীদের যেন কোনরূপ ভুল না বােঝে সেজন্যও কর্মী বাহিনীকে গােপনে জনসাধারনের মধ্যে। সংগঠনিক কাজ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়ােজনীয়তা ও বিভিন্ন সময়ে জনসাধারনের কি কি করতে হবে সে ব্যাপারে তা বুঝিয়ে বলতে হবে। হাজার হাজার কর্মী ভাইয়েরা তাদের পরিবার নিয়ে আজ নিঃস্ব অবস্থায় দিনাতিপাত করছে সেজন্য তাদের পরিবারবর্গের এ বিপদের সমর নিয়মিত মাসিক সাহায্যের ব্যবস্থা করার জন্যও আমরা | সরকারের প্রতি আবেদন জানাই।
দাবানল ১: ৪ ॥
৩১ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯