শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৪২। ‘স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন’ – একটি সম্পাদকীয় | দৈনিক “যুগান্তর” | ৫জুন, ১৯৭১ |
স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন
আজ শনিবার পাঁচই জুন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আসবেন কলকাতায়। কি দেখবেন তিনি? সীমান্তে নেই তিল ধারনের স্থান। কলকাতার উপকন্ঠে এসে পৌঁছেছে শরণার্থীর ঢেউ। পাক লুটেরা রাস্তায় কেড়ে নিয়েছে তাদের সর্বস্ব। প্রানে মরেছে অনেকে। নিঁখোজ হয়েছে স্ত্রী-কন্যা। এপারে এসেও স্বস্তি নেই। মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে কলেরা। রাজ্য সরকার দিশাহারা। শরণার্থীর সংখ্যা চার লক্ষ ছাপিয়ে উঠেছে। অন্যান্য রাজ্যে না পাঠালে বাঁচবেনা এই হতভাগ্যের দল। দু মাস অপেক্ষা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কি পেয়েছেন তারা? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর চরম ঔদাসীন্য এবং রাষ্ট্রসংঘের অসহনীয় নীরবতা। ইয়াহিয়া আগের চেয়ে বেশী বেপরোয়া বাংলাদেশে জ্বালাচ্ছে তিনি সাম্প্রদায়ীকতার আগুন। পুড়েছে অনেকে। যারা কোনমতে বেঁচেছে তারা আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। যতদিন যাবে শরণার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। ওদের ফেরার পথ বন্ধ। বন্দুক উঁচিয়ে আছে ইয়াহিয়ার বাহিনী। তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে স্থানীয় ধর্মান্ধের দল। গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকারকে যদি স্বীকৃতি দিতেন নয়াদিল্লী তবে ঘটত না অবস্থার এমনিতর অবনতি। মুক্তিযোদ্ধারা পেতেন দ্বিগুন মানসিক বল। বাড়ত সংগ্রামের তীব্রতা। গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠত প্রতিরোধ ব্যৃহ। সাম্প্রদায়িক নেতাদের মধ্যে দেখা দিত সন্ত্রাস। কমত লুটপাটের ব্যাপকতা। বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীরা হয়ত ভিড় করত না। ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের “দেখি কি হয় নীতি” এনেছে নৈরাশ্য। বাড়িয়েছে ইয়াহিয়ার স্পর্ধা এবং ভারতকে নিয়েছে আর্থিক সংকটের মুখে।
বন্ধ হবেনা শরণার্থীর স্রোত। পূর্ব বাংলায় থাকতে পারবেনা অসাম্প্রদায়ীক সাধারন মানুষ। কিসের আশায় দিন গুনছেন প্রধানমন্ত্রী? বৃহৎ শক্তিগুলো কি লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর হাত ধরে তাদের নিজেদের বাড়ী-ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসবে? তারা কি এদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে? আর্থিক চাপে ইয়াহিয়ার নাকে খত আদায় করবে? গত দু মাসের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি কি বুঝতে পারেননি জল কোথায় গড়াচ্ছে? জিইয়ে রাখবে তারা ইসলামাবাদকে। শক্তি সাম্য ভাঙ্গতে দেবে না। এশিয়ার এ অঞ্চলে কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। অখন্ড পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটেছে। পূর্ব এবং পশ্চিমের বোঝাপাড়া অসম্ভব। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়া শরণার্থীরা ফিরতে পারবেনা নিজেদের বাড়ী-ঘরে। এই সহজ সত্য মেনে নিতে কর্তৃপক্ষের দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবই সৃষ্টি করছে যত জটিলতা। শ্রীমতি গান্ধী আশায় আশায় অনর্থক সময় কাটাচ্ছেন। এখন যে অবস্থা চলছে তার ব্যাতিক্রম না ঘটলে ছ মাস কেন, ছ বছরেও শরণার্থীরা ছাড়বেন না ভারতের মাটি। পূর্ব বাংলায় শক্তি সংহত করবে ইসলামাবাদ। মুক্তিসংগ্রামীরা পাবেন প্রচন্ড বাধা আর ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর বোঝা নিয়ে ভারত খাবে হাবুডুবু। সমূহ বিপদ সামনে দেখেও মনস্থির করতে পারছেন না কেন্দ্রীয় সরকার। গোটা জাতিকে কোন অন্ধকার গুহায় টেনে নিচ্ছেন তাঁরা।
বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থীদের অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়া খুবই দরকার – সন্দেহ নেই। এ ব্যাবস্থা অবশ্যই সাময়িক। তাতে পাওয়া যাবেনা সমস্যার স্থায়ী সমাধান। গোঁজামিল দিয়ে সময় কাটাবার পালা শেষ হয়েছে? দেশবাসীর ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জবাব দিন নয়াদিল্লী-শরণার্থীদের নিয়ে তাঁরা কি করবেন? কি করে থামাবেন বন্যার স্রোত? কিভাবে পাঠাবেন, তাঁদের বাংলাদেশে? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর কাছে নয়াদিল্লীর আকুতি-মিনতি ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রীর ব্যাক্তিগত পত্রে এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় যাঁদের টনক নড়েনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের সম্ভাব্য সফরে তাঁদের ঘুমের নেশা কাটবেনা। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বুকে ধরে অনন্তকাল বসে থাকতে পারেনা ভারত। নিরাপত্তা এবং বাঁচার তাগিদেই কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে নিজস্ব পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার প্রাথমিক অঙ্গ-স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান। বাড়ান দরকার তাঁদের সংগ্রামী শক্তি। ওঁদের জয় ত্বরান্বিত হলেই স্বদেশে ফিরবেন শরণার্থীরা। নইলে তারা থাকবেন ভারতে। একথা সত্য কোন শান্তিবাদী রাষ্ট্র সহজে বল প্রয়োগ করতে চায় না। ইয়াহিয়া খান নয়া দিল্লীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছেন না। বাংলাদেশে সমস্যার সংগে ভারতকে তিনি জড়িয়ে ফেলেছেন। চারদিকে দেখা যাচ্ছে অশান্তির দুর্লক্ষণ। মুখ বুজে থাকলেই বিপদ এড়ান যাবেনা। বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করুন কর্তৃপক্ষ। অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন স্বাধীন বাংলাদেশকে। প্রশস্ত করুন ইয়াহিয়ার চরম পরাজয়ের পথ। এতেই আসবে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ শান্তি। শরণার্থীরা পাবেন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রেরনা।