You dont have javascript enabled! Please enable it!

তীব্র সংঘর্ষ চলছে
পাবনা দখল করলো পাকবাহিনী
(অনুবাদ)

পিটিআই এবং ইউএনআই এর রিপোর্ট অনুসারে রবিবার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন ছিল উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট-মুঘলহাট সহ ক্যান্টনমেন্ট এবং বিমানঘাটি সমুহ পুনরায় দখল করে নেয়া। আকারে ছোট হলেও আরো একটি বিজয় অর্জিত হয় টাঙ্গাইলের কাছে, যেখানে পাকিস্তানী সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে বিজিত হয়। দিনাজপুর, গোয়ালন্দ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চলে পাকিস্তানীরা ব্যাপক বিমান সহায়তা পাচ্ছে এবং পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য কতিপয় বিমান হামলা চালিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরতলীতেও বোমাহামলা চালানো হয়।

একিসময়ে ঢাকাতেও দুইদলের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলছে বলে জানানো হয়। মুক্তিবাহিনী নরসিংদিতে নতুন ঘাটি খুলেছে, যেন তারা ঢাকায় আরো বড় আকারে অপারেশন চালাতে পারে।কুমিল্লার ধুলুপারা বিমানঘাটিতেও দখল অথবা অচল করার জন্যও একি ধরনের হামলা চালানো হয়, এবং হারডিং ব্রিজের নিকতেও একি রকমের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

যুদ্ধরত অবস্থাতেই মুক্তিবাহিনী তাদের অধিকৃত স্বাধীন অঞ্চলসমূহ যেমন সিলেট,ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লার কিছু অংশে পুনরায় লোকবল একত্রিত করছে।

লালমনিরহাটের সংঘর্ষে দুই কোম্পানি পাকিস্তানী সেনা বিজিত হয় এবং এদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া সৈনিকরা পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের হাতে মারা পরে।

টাঙ্গাইল এবং ঢাকার কাছাকাছি, ময়মন্সিংহের একটি সাব-ডিভিশনাল শহরে মুক্তিবাহিনী একিরকম হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী বাহিনিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। বিজিত পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। কেন্দ্রীয় পাকিস্তানী দল উক্ত বাহিনিটিকে টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীকে শায়েস্তা করতে এবং মুক্তিবাহিনীর অধিকৃত ময়মন্সিংহ শহর পুনর্দখল করতে পাঠিয়েছিল।

নরসিংদিতে নতুন ঘাটি খুলার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে নতুন এবং আরো বড় আকারে অপারেশন চালাচ্ছে গত রবিবার থেকে, তারাপুরে তাদের সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয় বলে জানা যায়। পাকিস্তানী বাহিনী ডেমরা নদী পার হয়ে নরসিংদী দখল করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ যুদ্ধের জন্য অবস্থান নিয়েছে।

পাকিস্তানী বাহিনী এ যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করছে বলে জানা যাচ্ছে, তারা নরসিংদিতে মুক্তিবাহিনীর মুলঘাটির ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। ঢাকার ২৫ মাইল দক্ষিনে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জও তারা দখল করে নিয়েছে বলে জানা যায়।

রাজশাহিঃ রাজশাহী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনী উৎখাতের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে মুক্তিবাহিনী। খবরসুত্রে জানা যায় যে প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা যমুনা নদী পার হয়ে পাবনা শহরের কাছাকাছি অবস্থান করছে এবং তারা রাজশাহির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

দক্ষিণপশ্চিম দিকের মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ড এর ডঃ আশাবুল হক জানান যে, রবিবার হার্ডিংস ব্রিজের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। ট্রাঙ্ক টেলিফোনের কুষ্টিয়া থেকে তিনি একটি আর্মি এজেন্সির সাথে কথা বলেন এবং জানান যে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনী হার্ডিংস ব্রিজের উপর মর্টার শেল চার্জ করে এবং বোমা হামলা চালায়। কুষ্টিয়া থেকে ৮ মাইল দূরে অবস্থিত কুমারখালি এলাকাতেও সংঘর্ষ চলছে বলে তিনি জানান।

লালমনিরহাট বিমান ঘাটি, তিস্তা ব্রিজ এবং হারাগাছি ফেরিঘাট মুক্তিবাহিনীর দখলে যাওয়াতে পশ্চিমা বাহিনী রংপুর শহরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। লালমনিরহাটে অবস্থানকারী মুক্তিফৌজের একটি বড় অংশ এখন রংপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে রংপুর থেকে দিনাজপুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে দুই কোম্পানি পাক আর্মি অতর্কিত হামলার শিকার হয় এবং পুনরায় রংপুর ঘাটিতে ফিরে যায়।

সিলেটঃ সিলেটে মুক্তিবাহিনী দখল বজায় রাখার জন্য পুনরায় একত্রিত হচ্ছে এবং রেডিও ও রেইলস্টেশন পুনরায় দখল করে নিয়েছে। গত তিনদিন ধরে সিলেট শহর খালি অবস্থায় আছে, কেননা বেসামরিক নাগরিক্রা যুদ্ধাবস্থার কারনে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনী সিলেট শহর ভালভাবেই পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। গত শনিবার তারা কুমিল্লা থেকে সিলেটের দিকে আসা ১২ জন পাকিস্তানী আর্মির একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং সবাইকে মেরে ফেলে। জানা যায় যে, পাকবাহিনী কুমিল্লার বিমানঘাঁটি এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করে রাখলেও এ অঞ্চলের উত্তরাংশ এখন মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে এবং এই ১২ জনের দলটি সেখান থেকেই সিলেটের দিকে যাচ্ছিল।

কিন্তু, মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা ও সিলেটে পাক আর্মিদের রসদ ও প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করার রুটগুলো দখল করে নেয়াতে এইসকল স্থানে আকাশপথে রসদ পরিবহন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এবং তা এপ্রিল-মে এর মত ঝড়ের মৌসুমে আরো কঠিন হয়ে পরবে। আসছে মাসে অবস্থা আরো কঠিন হবে ধারনা করা হচ্ছে।

কুমিল্লা, সিলেট এবং ময়মনসিংহের মত এলাকার গ্রামাঞ্চলের উপর দখল রাখার মানে হচ্ছে মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চলের খাদ্যসরবরাহের উৎসগুলিকে দখলে রাখছে। পাকিস্তানে উৎপাদিত সকল চায়ের উৎসও এই অঞ্চল।

পাবনা দখলঃ দুই দিন আগে, ঢাকা থেকে পাঠানো ১০০ জনের একটি সৈন্য দল পাবনা শহর দখল করে নেয়।

পাকিস্তানী বাহিনী তিস্তা ব্রিজ এলাকায় গমন করে এবং সেখানে তারা প্রায় ১০০র মতো ঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে।

কৃষ্ণনগর ত্রানসংস্থার কাছে থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে, পাবনা থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরা নদীয়ার করিমপুর বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে।
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারি বিমান হামলা এবং পাকিস্তানী আর্মিদের লোকবল বৃদ্ধি করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, দিনাজপুর এবং ফেনিতে ভারী বোমাহামলার খবর পাওয়া যায়।

পাকিস্তানী ৫২-৫৩ বম্বার প্লেন থেকে চট্টগ্রাম শহরতলীতেও বোমা হামলা চালানো হয়, এবং এসময়ে মর্টার এবং ট্যাঙ্ক ও ব্যাবহার করা হয়। ধারনা করা হচ্ছে যে, মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-ফেনি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যে ক্ষতিসাধন করেছে তা মেরামতের জন্য এই এলাকায় ইঞ্জিনিয়ারসহ মজুরদের নিরাপদে পাঠাতেই এই হামলা চালানো হচ্ছে।

গোয়ালন্দে বোমাহামলাঃ কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে, রবিবার বেলা ২টার দিকে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী ও স্থলবাহিনী গোয়ালন্দে হামলা করে। ২০০ পাকিস্তানী প্যারাট্রুপার ২ দিন আগে গোয়ালন্দে অবতরণ করে বলে জানা যায়। একি সাথে বলা হচ্ছে যে, গোয়ালন্দের এই বোমা হামলায় হতাহতের সংখ্যা প্রচুর এবং প্রচুর পরিমানে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে।

-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ১২ই এপ্রিল, ১৯৭১।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!