হারাগাছ ও তিস্তা সেতু এলাকা মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে
উত্তরাঞ্চলের কোন স্থান, ১০ই এপ্রিল-গত রাত্রে নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী তীব্র লড়াইয়ের পর হারাগাছ এবং তিস্তা সেতু এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখলে এনেছে। পাক-হানাদাররা এই যুদ্ধে দু’কোম্পানী সেনা নিয়োগ করেছিল, তারা এখন মৃত ও আহত সেনাদের ফেলে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের দিকে চম্পট দিয়েছে। মুক্তিফৌজ এই যুদ্ধে কিছু অস্ত্রশস্ত্র, একটি জীপ এবং রসদও দখল করেছে।
হারাগাছ ও তিস্তা সেতু অঞ্চল মুক্তিফৌজের দখলে আসায় রংপুর লালমনিরহাট ক্যান্টনমেন্ট দুটির মধ্যে সরবরাহ পাঠাবার পথ বিছিন্ন হয়ে গেছে। পাক হানাদারদের একন বিমানে সরবরাহের উপর নির্ভর করতে হবে।
রংপুর ক্যান্টনমেন্টকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করার উদ্দেশ্য মুক্তিফৌজের সেনারা ছোট দলে ভাগ হয়ে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি রেল সেতু ও একটি চলাচলের সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। এই সেতুগুলি রংপুরের সঙ্গে কুড়িগ্রামের যোগাযোগ রক্ষা করতো।
মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণঃ ইয়াহিয়া বাহিনীর একটি দল কয়েকটি ট্রলিযোগে লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটের দিকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছিল, পথে মুক্তিফৌজ আচমকা দলটির ওপর হানা দিয়ে কয়েকজন হানাদরকে খতম করে, বাকী হানাদররা লালমনিরহাটের দিকে পালায়।
আত্মবলি দল গঠিতঃ আরও আশার কথা মুক্তিফৌজ এই অঞ্চলে ছোট ছোট আত্নবলি দল সংগঠন করেছে। এই দলগুলি ইতিমধ্যেই শত্রু-অধিকৃত এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই আত্নবলি দলগুলির নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রখতেও সক্ষম হয়েছে। মুক্তিফৌজ এসব এলাকা সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্য কুড়িগ্রামের দিকে পথে পথে পরিখা খনন করেছে। মুক্তিফৌজের কাছে খবর এসেছে যে, রংপুরের দিকে আগুয়ান পাক হানাদার বাহিনী রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ওপর মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণ আটকে দিতে পারে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, শেখ মুজিবের মুক্তিবাহিনী গত বৃহস্পতিবার রাত্রে ভারী মর্টার চালিয়ে হারাগাছ ও তিস্তা সেতু এলাকায় আক্রমণ শুরু করে, কিন্তু শক্রু বিমানাক্রমণের আশঙ্কায় শুক্রবার ভোরের দিকে জঙ্গলে আত্নগোপন করে।
হারাগাছ হচ্ছে তিস্তা নদীর একটি ফেরীঘাট, এটি সামরিক দিক থেকে এখনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে লালমনিরহাটের ক্যান্টনমেন্টের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এই ফেরীঘাট দিয়ে পাকসোনা রংপুর থেকে যায়।
রংপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর দলগুলির মধ্যে এখন যোগসূত্র স্থপিত হয়েছে। মুক্তিফৌজ এ অঞ্চলে প্রথম দিকে যে রকম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, এখন সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মুক্তিবাহিনী সাধারণ যুদ্ধবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে সেনাদের সুশিক্ষিত করে তোলায় শেখ মুজিবর বাহিনীর সমরসাধ্য এখন পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাক বাহিনী পর্যুদস্তঃ দিনহাটা থেকে নিজস্ব প্রতিনি জানাচ্ছেন, তিনি রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী সফর করেন। মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টন আবুল হোসেন তাঁকে জানান, গতকাল তুগ্রাইহাটের মুক্তিফৌজের সঙ্গে এক সংঘর্ষ পাকহানাদার ফৌজের এগারজন সেনা নিহত হয়। এ জায়গাটি কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৪ মাইল দূরে। একজন মুক্তিসেনা আহত হয়ে কুড়িগ্রাম হাসপাতালে ভর্তি হন। পাক সেনা দলটি জীপে করে কুড়িগ্রাম যাওয়ার পথে তুগ্রাইহাটের কাছে মুক্তিফৌজ তাদের বাধা দেয়। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর পাকদল চম্পট দেয়।
রংপুরের দিকে মুক্তিফৌজঃ ইপিআরের জনৈক নায়েক ভুরুঙ্গামারীতে বলেন, মুক্তিফৌজ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার পর রংপুরের দিকে এগিয়ে চলেছে খবর পেয়ে লালমনিরহাট থেকে একদল পাকহানাদার সোনা রংপুর রওয়ানা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সংবাদ অনুযায়ী, গতকাল তিস্তা সেতুর কাছে এক সংঘর্ষে ছ’জন পাকসেনা নিহত হয় একং দুটি মর্টার ও চৌদ্দ বাক্স গোলাগুলি মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। অস্ত্রশস্ত্রগুলি কুড়িগ্রামে মুক্তিফৌজের কর্মকেন্দ্রে আনা হয়েছে। আওয়ামী নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, দু’একদিনেই সমগ্র জেলা থেকে পাকসৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
রাজশাহী থেকে কুমারেশ ক্রমবর্তী লিখছেনঃ সমগ্র রাজশাহী জেলা এখন প্রায় বিল্পবী মুক্তিফৌজের দখলে। এই জেলার প্রধান চারটি মহকুমার মধ্যে নবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ সম্পূর্ণরূপে মুক্তিবাহিনীর দখলে। আর সদর মহকুমার মধ্যে একমাত্র ক্যান্টমেন্টের কিছু অংশ ছাড়া সম্পূর্ণ সদলে স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভা পাচ্ছে। ক্যান্টনমেন্টেই রাজশাহীর একমাত্র মিলিটারী ঘাঁটি।
-যুগান্তর, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১