You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংগ্রামের তৃতীয় সপ্তাহের সূচনায় পাকফৌজের পাল্টা অভিযান
তবু মুক্তিফৌজেরই প্রাধান্য

সমগ্র উত্তরখণ্ড এবং পশ্চিমখন্ডেরও বৃহদংশ করায়ত্ত, মুক্তিবাহিনী এই দাবিপত্রটি হাতে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তৃতীয় সপ্তাহে পাদর্পণ করল। কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ণ বিমাণঘাঁটিটি দখলের জন্য বৃহস্পতিবার রক্তক্ষয়ী লড়াই চলে। সর্বশেষ সংবাদ, এই এলাকায় মুক্তিফৌজের চতুর্থ বেংগল রেজিমেন্টরই প্রাধান্য। এই ক্যান্টনমেন্টটি এখন সম্ববত ফৌজে হাতে। ময়নামতী চাউনি এলাকায় ঢুলুপাড়া বিমান ক্ষেত্রটি কার্যত মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে।

কলকাতায় জলপাইগুড়ি থেকে প্রাপ্ত একটি প্রকাশ, উত্তরখন্ডে সৈয়দপুর মুজিব সেনার অধিকারে এসে গেছে। এই ছাউনিতে দুটি ট্যাংক অধিকুত, ২০০ দখলদার সেনা নিহত। কিন্তু ফৌজী গোলায় আর বোমায় চারপাশের গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার লোকের প্রাণ গেছে।

আর একটি খবর-রাজশাহী শহরের পতন। শুধু শহর নয়, রাজশাহী সেনা ছাউনিও শক্রুমুক্ত যশোরে ফৌজী বাহিনী অবস্থা সঙ্গীন। মুক্তিবাহিনী লড়াই জোরদার করার তোড়জোড় করছে। এখানে পাকসেনার দল অবরুদ্ধ ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিফৌজের কাছে আত্নসমর্পণ করে বলে জানা যায়। সৈন্যরা বন্দী হয়, তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

এদিনের খবরের বিপরীতে চিত্রও আছে। দখলদার বাহিনী বসে নেই। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে তাদের রনংদেহি মূতি দেখা গেছে। নতুন রণসম্ভার এবং মরাণাস্ত্রে বলীয়নে পিন্ডি ফৌজ শ্রীহট্ট, যশোর, কুষ্টিয়া এবং দিনাজপুর এলাকায় বহুমুখী অভিযান চালায়। একটি বাহিনী যশোর অঞ্চল থেকে এগিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্ট করে চুয়াডাঙ্গা দিকে। আর একটি উত্তর থেকে নেমে আসে দিনাজপুর অভিমুখে, গোয়ালন্দঘাট থেকে তৃতীয় একটি সেনাদলকে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। পদ্মা দিয়ে পিন্ডি ফৌজ গোয়ালন্দঘাটে নতুন সৈন্য আর সাজসরঞ্জাম নামাতে পেরেছে। লড়াই চলছে প্রচণ্ড, তবে হানাদার সেনাদল কোথাও বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি। পাক বিমান বাহিনী এদিনও রাজশাহী, শ্রীহট্ট, নারায়নগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোমাবর্ষণ করে। তারা চারদিন কামানের গোলা ছড়িয়ে গোয়ালন্দ রসদ নামায়। কিন্তু বাধা পায় প্রবল। মুক্তিফৌজ যেন অগণিত যোদ্ধা দিয়ে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর রচনা করে রেখেছিল।

দিনাজপুর শহরের দশ মাইল এ ভীষণ সংঘর্ষ চলছে-অন্তত সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত সংবাদ ছিল এই। পরে আরও খবরে জানা যায়। চিরিরবন্দর পোরের কাছে বাধা পেয়ে তারা পিছু হটে যায়। চুয়াডাঙ্গা এলাকাতেও সংগ্রাম তীব্র। শোনা গেছে শুধু কামানের আওয়াজ, দেখা গেছে খালি ধোঁয়ার কুণ্ডলি। ভারত সীমান্ত নিকটবর্তী এই অঞ্চলে মেজর এম এ ওসমানের নেতৃত্ব মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের সম্মান বাঁচাতে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। চালনার খাল দিয়ে হানাদারদের রণতরী চালানোর চেষ্টা মুক্তিফৌজ এদিন বার বার ব্যার্থ করে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা খুলনা আর যশোর শহরে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। দুটি শহরই হাজার হাজার মুক্তিফৌজ বস্তুত ঘিরে রেখেছে। খুলনা এলাকার শিল্পাঞ্চল দখলের জন্য প্রবল সংগ্রাম চলেছে। এই অঞ্চলে মুক্তিফৌজের অধিনায়ক শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসিরুদ্দীন।

দূর্গ দখলের অভিযানে সেনাপতির সঙ্গী বেগম ওসমান

যশোর, ৮ এপ্রিল-যশোর দুর্গ দখলের জন্য দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা দূর্গ দখলের জন্য দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা দূরবর্তী চারটি কোণ থেকে রণাঙ্গনের দিকে কদমে এগিয়ে চলেছে। বুঝবার শেষ রাতে তাঁদের এই অভিযান শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিশাল বাহিনীর অভিনায়ক মেজর ওসমান। পাশে থেকে শক্তি যোগাচ্ছেন সহঅধিনায়কা বেগম ওসমান। দুর্বার বেগে এগিয়ে চলা এই বাহিনীর মুখে ধ্বনিঃ চলো, চলো দূর্গে চলো।

দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দুর্গ দখলের জন্য মুক্তি সংগ্রামীদের প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। নিজেরা কারফু জারি করেছেন প্রয়োজনীয় এলাকায়। সন্দেহজনক ও অচেনা মুখ দেখলেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। বাইরের কয়েকজন বেঈমান ধরা পড়ায় তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছে। পরিখা খোঁড়া হয়েছে বিশেষ বিশেষ জায়গায়। বিবর ঘাঁটিও হচ্ছে অগ্রবর্তী অঞ্চলে। দুর্গের চারদিকে বেষ্টনী রচনা করে ওয়ারলেস সংযোগ ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন রণকৌশলে শস্ত্রুবাহিনীকে শেষ আঘাত হানা জন্য সব ব্যবস্থাই পাকা। র্বাধিনায়কের নির্দেশ পাওয়া মাত্র ঝাটিকা গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মুক্তি সোনারা এখন তৈয়ার।

অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী ফৌজের নাভিশ্বাস উঠেছে। মরণ কামড় দেওয়ার জন্য তারা দুর্গের আশপাশে চালাচ্ছে পোড়ামাটি নীতি। গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ দিন সকাল থেকেই দাউ দাউ করে ঘরবাড়ি পুড়তে দেখা যায়। চাঙ্গুটিয়া, আরিফপুর, পতেঙ্গালি প্রভৃতি এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত। এছাড়া গুদাম, দোকানপাট লুঠ করেছে মিলিটারী সমর্থক আর একদল পশ্চিমী ঠ্যাঙাড়ে দল। হত্যা, হামলায় বিতাড়িত হয়ে হাজার হাজার শরণার্থ ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। আরও বহু শরণার্থ ভারত প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ এপ্রিল, ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!