You dont have javascript enabled! Please enable it!

সোমবার জয়-বাংলার জয়ের পালা

রংপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ মুক্ত, তিস্তা সেতু ধ্বংসঃ সোমবার জয় বাংলার শুধু জয়ের মালা, একটার পর একটা জয়ের পালা জয় রংপুর শহর-অধিকৃত। জয় কুমিল্লা শহরেও-মুক্ত। শ্রীহট্টের বিমানক্ষেত্রেও মুক্তিফৌজের করারত্ত। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরে মুজিব সেনারই জয়জয়কার। সংগ্রামী সেনারই দিন এই প্রথম সব রণাঙ্গন মিলিয়ে একটি যুক্ত কমাণ্ড গড়ে তোলার পথে পা বাড়ান। এই উদ্যোগ হানাদার হটানোর লড়াইয়ে শেষ রাউন্ডের প্রস্ততি।

মুক্তিফৌজ হানাদারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া সাঁজোয়া গাড়ি, মেশিনগান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নরসিংদী (ঢাকা থেকে ১৪ কি.মি) অভিযানে এগিয়ে চরেছেন। শ্রীহট্ট শহরের একাংশ এবং ছাউনি এলাকা বাদে পাবনা ও বগুড়ার প্রায় সব অঞ্চলই হানাদারমুক্ত।

পাকফৌজ ও হানাদার বিমান বাহিনী তৎপরতা রোধের জন্য মুক্তিসেনারা পোড়ামাটি নীতি অনুসারে তিস্তা সেতু ধ্বংস করেছেন। অকেজো করে দিয়েছেন লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্র, উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথের (৪৮০ কিলোমিটার) বহু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানী ফৌজ গর্তে তাড়া খাওয়া সাপের মত ছড়িয়ে পড়েছে রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও শ্রীহট্ট আর মার-খাওয়া সাপের মতই ছোবল মারছে যত্রতত্র, যা পাচ্ছে তাই ধ্বংস করছে কামান দিয়ে, মেশিনগান দিয়ে, পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে। অত্যাচার চালাচ্ছে বিশেষ করে নারীদের ওপর।

রংপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের দরুন লড়াই হয়েছে। দুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিফৌজই জয়ী। দখলদারদের হাত থেকে তাঁরা রংপুর শহর পুনর্দখল করেছেন। রংপুর শহরের কাছেই তিস্তা-সেতু মুক্তিফৌজ সেটি ধ্বংস করে দিয়েছেন। লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্রটিও তারা অকেজো করে দিয়েছেন। সেতুটি ধ্বংসের ফলে পাকিস্তানীর পালাবার পথ নেই। অন্য সমস্ত পথ মুক্তিফৌজ আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শ্রীহট্টেও পাকফৌজের সরবরাহের পথগুলি একে একে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও তারা প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন। সর্বত্রই মুক্তিফৌজ দখলদারদের চেয়ে সংখ্যার অনেক বেশী। ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথ এখন ব্যবহারের অযোগ্য। শ্রীহট্টের শালুটিকর বিমানক্ষেত্রটি মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর দখল করে নিয়েছেন। শ্রীহট্টের শহর ছাড়া ওই জেলার কোথাও পাকফৌজের কোন নিয়ত্রণ নেই। হরিপুর (ভারত সীমান্ত থেকে ২৯ কি.মি.) পাকিস্তান পেট্রোল লিঃ এর তৈলকেন্দ্রটি মুক্তিফৌজ শনিবার উড়িয়ে দিয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।

লালমনিরহাট পাকফৌজের দখলে আছে। পাক বিমান বাহিনীর মদতে তারা সেখানে আছে। আনন্দবাজারের সংবাদদাতা কোচবিহার থেকে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানীরা লালমনিরহাট প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করেছে। কোচবিহারে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার উদ্বাস্তু এসেছেন। তারা সবাই মুসলমান।

বাংলাদেশের তিন সেনাপতিঃ বাংলাদেশের পুর্বাঞ্চলের কিচু কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা ও শহর ছাড়া প্রায় সবটাই এখন মুক্তিফৌজের দখলে ও প্রশাসনে। এই প্রশাসনে তিনটি সেকটরের নেতৃত্ব করছেন তিনজন সেনাপতি। এরাই মিলিতভাবে মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আওয়ামী লীগের অনুগত অসামরিক অফিসার ও কর্মচারীরা এদের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন।

এই তিন সেনাপতি হলেন-মেজর মুশাররফ (শ্রীহট্ট সেক্টর), মেজর সফিউল্লা (ময়মনসিংহ) ও মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম)। জিয়াউরই মেজর জিয়া নামে অস্থায়ী সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিলেন।

গত শনিবার শ্রীহট্টের কোন এক জায়গায় মেজর মুশাররফের সদর দফতরে ওরা তিনজন মিলিত হয়েছিলেন এবং ঠিক করেছেন যে, যতদিন না জাতীয় পরিষদের বৈঠক বসে এবং জাতীয় সরকার গঠিত হয় ততদিন তারা মুক্তিফৌজ ও প্রশাসন পরিচালনা করবেন।

মেজর মুশাররফ সাংবাদিকদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা নিজে সঙ্গে থেকে দেখান এবং জানান যে, পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধে তারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছেন। মুক্তিফৌজ বাংলাদেশে কত জনপ্রিয়, সাংবাদিকেরা তা নিজেদের চোখেই দেখতে পান। বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিফৌজের নতুন স্বেচ্ছাসেবকের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে-তাও তাঁরা দেখান।

যশোরে সংর্ঘষঃ যশোর শহরের সর্বত্র নিজেদের কর্তৃত্ব দাবির জন্য হানাদার বাহিনী সোমবার রাত্রে মুক্তিফৌজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। যশোর-ঢাকা সড়ক ও যশোর-বেনাপোল সড়কে দোতলা তেতলা বাড়িগুলি দখল করে হানাদাররা মেশিনগান ও মর্টার থেকে গোলাবর্ষন করে চলেছে।

যশোরের এই খবর ছাড়াও ইউ এন-আই-পি টি আই জানান যে, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম শহরে পাকবাহিনীর উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন। কুমিল্লা থেকে বহু হানাদার হটে গিয়ে এখন ময়নামতির ছাউনি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। মুক্তিফৌজ আঘাত করেই সরে পড়ার নীতিকে আক্রমণ চালিয়েছিল।

কলকাতার খবর পাওয়া যায়, চট্টগ্রাম,রংপুর ও খুলনার বেতার কেন্দ্রগুলি এখন মুক্তিফৌজের হাতে। তবে হানাদাররা যন্ত্রপাতি নষ্ট করে যাওয়ায় বোধহয় প্রচার বন্ধ আছে। বন্দরগুলি সম্পূর্ণ নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য মুক্তিফৌজ প্রস্তুত হচ্ছেন।

মজুদ খাদ্য ফুরিয়ে আসছে বলে হানাদাররা এখন ভেঙ্গে পড়ছে। রংপুর এমনকি ঢাকাতেও পাকসেনারা সরবরাহের সংস্থানে খুবই বিপন্ন বোধ করছে। মৌলবীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল-এর সেনারা একটি কমান্ডের অধীনে নিজেদের নতুন করে সংগঠিত করে নিচ্ছে।

হানাদাররা ঢাকা-কুমিল্লা এবং ঢাকা-শ্রীহট্টের মধ্যে সড়ক ও রেলসংযোগ খোলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কারণ, এর ফলে সেনা চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। হানাদাররা দুএক জায়গায় সংযোগ পুনরায় চালু করলেও মুক্তিবাহিনী আবার অন্যত্র এই সংযোগ বিছিন্ন করে দিয়েছে। আতর্কিত আক্রমণে সমশেরণগরের কাছে মুক্তিফৌজ হানাদারদের বহু গাড়ি ও অস্ত্র দখল করে নিয়েছে। রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী একটি হেলিকপ্টার মুক্তিসেনারা গুলি করে ফেলে দিয়েছেন।

পাকফৌজ ট্রেনের উপর গেরিলা আক্রমণঃ মোগলহটা, রংপুর (বাংলাদেশ)-লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটের দিকে একটি ফৌজী রেল-ইঞ্জিন এগোবার পথে মুক্তিফৌজের গেরিলাদের বোমার ঘায়ে জখম হয়ে ফিরে যায়। লালমনিরহাটকে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। লালমনিরহাট-রংপুর ক্যান্টনমেন্ট সড়ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন। পাকমিলিটারী বোঝাই একটি ট্যাঙ্ক এই পথে এগোতে গিয়ে অবরোধের মুখে উল্টে যায়। ২০/২৫ জন ফৌজ আহত হয়েছে। রংপুরে কোনও বিমানবন্দর নেই, আছে শুধু হ্যালিপ্যাড ফলে আকাশপথে জঙ্গী-বাহিনী কোন সুবিধা করতে পারছে না। সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। পশ্চিমী ফৌজ ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ।

আজও রংপুর ও লালমনিরহাটে মিলিটারী লুণ্ঠন ও হত্যা চালায় ব্যাপক। গত তিনদিনে ৪৭ বাঙালী বুদ্ধিজীবিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রংপুরের ডি সি সৈয়দ আমিজ আহাসান ও এস পি আর বারিককে আজ তাদের বাড়ি থেকে ফৌজ ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গিয়েছে। তাদেরও হত্যা করা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!