You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তি সংগ্রাম গ্রামে গ্রামে প্রতিরােধের জোয়ার এনেছে

ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার কয়েকটি গ্রাম। কিছুদিন আগে পাকফৌজের হিংস্র অমানুষিক নির্যাতনে তখন কবরের ভীতি ছড়িয়ে পড়ছিল এ-সব গ্রামে। গ্রামের মানুষের দেহের পেশী যেন শিথিল হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের মধ্যে মধ্যে শূন্য ভিটাগুলি যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সামান্য শব্দে ওদের হৃদপিণ্ড  কেঁপে উঠত। বুকের মধ্যে শির শির করত কিছু সময়। শুধু কয়েকগ্রাম মিলে কয়েকজন রাজাকার বরাহ প্রতাপে হল্লা করে বেড়াত জঘন্যভাবে। গ্রামের মানুষেরা এই সময় নীরবে তাদের শত্রু মিত্র চিনেছে। তারা এ অবস্থার মধ্যেও নিজেরা মিলিত হয়েছে। প্রত্যেকেই অন্যদের কাছে আকুতি, তাঁর প্রার্থনা জানিয়ে যেন একটু হালকা হয়েছে। ওঁদের কথাবার্তার সময় কোন রাজাকার এলে ওঁরা অনায়াসে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে নেয়। ঘৃণায় আহত দৃষ্টি নুইয়ে পড়ে মাটির দিকে। এসব প্রতিকুলতার মধ্যেও তারা তাদের প্রতিজ্ঞা-স্বাধীন বাংলা-আকড়ে ধরে শক্ত হাতে। এই প্রতিজ্ঞাকে অবলম্বন করেই তারা বেঁচে আছে। যখন লাখাে জনতা একই প্রতিজ্ঞায় একই প্রার্থনায় ঐক্যবদ্ধ হয় তখন তা’ কি প্রচণ্ড শক্তি হয়ে কাজ করে-প্রতিজ্ঞার ভিত্তি কত সুদৃঢ় হয়-আকাক্ষিত বস্তু  কত নিকটস্থ হয়ে আসে এদের সংগে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ না থাকলে তা উপলব্ধি করা অসম্বভ। কিছুদিন পূর্বে মুক্তি বাহিনীর কয়েকজন গেরিলা ঐ অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং প্রথম দিন রাতে তারা গ্রামের এক কৃষকের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। বাড়ীর মালিকের সঙ্গে গেরিলারা কিছু আলােচনা করে সেই রাতেই একটা অভিযান চালিয়ে ঐ অঞ্চলের রাজাকার নেতা ঈসমাইল খাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। পরদিন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই সংবাদ সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষের মধ্যে একটার চাপ। চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়।

সেদিন গেরিলারা আরও কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ করে। এবং ঐদিন রাতে পুনরায় অভিযান চালিয়ে আরও পাঁচজন রাজাকারকে হত্যা করে এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। এমনি ভাবে দিনের পর দিন গ্রামের লােকের সক্রিয় সহযােগীতায় গেরিলারা কয়েকদিনের মধ্যে ঐ অঞ্চলের সাতাশ জন রাজাকার খতম করলে অবশিষ্ট পদতলে আশ্রয় নিয়ে বাঁচে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে গ্রামের লােকের সহযােগীতা। গেরিলারা যাদের ওপর কোন দায়িত্ব। দিচ্ছেন তারা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করছেন। গ্রামগুলাের মধ্যে যেন তার যােগাযােগ সৃষ্টি হয়েছে। কোন জায়গায় কোন কিছু ঘটলে তা মুহূর্তেই গেরিলাদের কাছে পৌছে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের প্রতিহিংসার আগুনে কৃষকেরা যেন এক একটা শান্ত সাইক্লোন। যুবকেরা ট্রেনিং নিয়ে এখন গেরিলাদের সঙ্গে পাকফৌজের মােকাবিলায় অংশ গ্রহণ করছে। এমন কি প্রৌঢ়রা এবং মহিলারাও ট্রেনিং নিচ্ছে। ওখানে বেহায়া পাকফৌজ কয়েকবার আক্রমণ চালাতে এসে গেরিলাদের কৌশলী হাতের মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে শহরে শহরে বসে আছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে এক অদম্য শক্তির জোয়ার এসেছে। একের পর এক গ্রামগুলাে দালাল শূন্য হয়ে মুক্তাঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।

দাবানল ১ ৪ ৪

৩১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!