শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৭। ‘অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে’ – অধ্যাপক সমর গুহ এমপি’র নিবন্ধ | যুগান্তর | ২৩ মে, ১৯৭১ |
১। বাংলাদেশের জাতীয় অভ্যুত্থান ভারতের জনমতকে যে কী প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে তার জাতীয় প্রতিফল ঘটেছে ভারতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত সর্বসম্মত ঐতিহাসিক প্রস্তাবে। সমগ্র ভারতীয় জনতা এই আশা করেছিল যে এই প্রস্তাবকে যথার্থভাবে কার্যকরী করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী সরকারকে আশু স্বীকৃতি দিয়ে। কিন্তু ৭ই মে বিরোধী দলের বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এরূপ স্বীকৃতি দানে অক্ষমতা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সমগ্র বিরোধী পক্ষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই মত প্রকাশ করেছেন যা সংসদ গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কার্যকর সাহায্য দেওয়ার জন্য অবিলম্বে এই দেশের স্বীকৃতিদান ভারত সরকারের পক্ষে এক অপরিহার্য জাতীয় কর্তব্য।
২। সরকার পক্ষ মনে করেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে এখনও যথাযোগ্য সময় আসেনি এবং এরূপ স্বীকৃতিদান বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সহায়কও হবে না। পক্ষান্তরে বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে প্রায় ঐক্যবদ্ধভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেছে যে, বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতিদান একান্ত আবশ্যক এবং এরূপ স্বীকৃতি-দানের পন্থায়ই বাংলাদেশের সংগ্রামীদের কার্যকর সহায়তা দিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই সংগ্রামকে সম্পূর্ণ করা সম্ভব।
৩। শুধু বিরোধী পক্ষই নয়-বহু রাজ্যের বিধানসভা, ভারতের অগণিত গণ-প্রতিষ্ঠান এবং শাসক কংগ্রেসের বুহু প্রতিষ্ঠিত নেতা বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতিদানের দাবী জানিয়েছেন। এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার সরকারী নীতি শুধু অস্পষ্ট, অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অযৌক্তিকতাই নয়-গণতান্ত্রিক দিক দিয়েও সরকার আজ ভারতের জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন। কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এখন সে দেশের পক্ষে সহায়ক নয়, কারণ যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ প্রকাশ্যে বা নেতৃবর্গের বৈঠকে ভারত সরকার উপস্থিত করতে সক্ষম হন নি। অথচ, বাংলাদেশের প্রতিটি দেশ-প্রেমিক বাঙ্গালী প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের সদ্যগঠিত জাতীয় সরকার সর্বসম্মতভাবে শুধু ভারত সরকারের কাছেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন তাঁদের সরকারের আশু স্বীকৃতিদানের জন্যে।
………… নীরব কেন?
৪। তবু বিশ্বের ছোট-বড় রাষ্ট্র আজ বাংলাদেশের প্রশ্নে এরূপ নীরব ও নিস্ক্রিয় কেন? বহুবার নগ্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বের কোন রাষ্ট্রেরই আজ আন্তর্জাতিক স্বাধীনতা বা গনতন্ত্র রক্ষার দিকে দৃষ্টি নেই – বড় রাষ্ট্রগুলি তো বটেই, ছোট রাষ্ট্রগুলিও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারন করে সম্পূর্ণরূপে জাতীয় স্বার্থের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গীতে। তাছাড়া বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই চায় না যে পাক-ভারত সমস্যায় সমাধান হোক এবং তাঁর ফলে ভারত একটি শক্তিশালী ও প্রধান রাষ্ট্ররূপে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হোক এবং পাক-ভারতের পারস্পারিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে সব কয়টি বৃহৎ রাষ্ট্রকেই ভারতীয় উপ-মহাদেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য সদা-সচেষ্ট হতে দেখা গিয়েছে।
সবারই এক রা
৫। একথা আজ সুস্পষ্ট যে রুশ, মার্কিন, বৃটেন বা ফ্রান্স পাকিস্তানের বিখন্ডন চায় না, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় এই রাষ্ট্রগুলি উদগ্রীব তাই এই রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশের জাতীয় অভ্যুত্থানকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যার অতিরিক্ত গুরূত্ব দিতে রাজী নয়। সে জন্যে পাক বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবিক অধিকারের প্রশ্নটি রাষ্ট্রসংঘ পরিষদে উত্থাপন করে পাকিস্তানকে বিব্রত করতে পর্যন্ত এই রাষ্ট্রগুলি রাজী নয়। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার উদ্দেশ্যেই রাশিয়া ও বৃটেন বাংলাদেশের স্বাধিকারের একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সিথিল কনফেডারেশন গঠন করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা। শোনা যাচ্ছে যে পিন্ডিশাহীও এই প্রস্তাবে রাজী এবং এরূপ প্রচেষ্টায় রুশ উদ্যম গ্রহণেও অসম্মত নয়।
জনতার রায়
৬। রুশ মার্কিন-বৃটেন- এই রাষ্ট্রত্রয় এই ঘটনাকে স্বীকার করতে রাজী নয়। যে বাংলাদেশের স্বাধিকারের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধান বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তায় অধিকারী জন সাধারণই করে দিয়েছে। ৯৯.৬ শতাংশ গণভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিজেদের সার্বভৌম স্বাধীনতা ঘোষনা করে একটি নিজস্ব প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করেছে। বাংলাদেশের সমগ্র জনতা এই সরকারের প্রতি কিরূপ সক্রিয় আনুগত্য জ্ঞাপন করেছে বাঙালীর বর্তমান সামগ্রিক গনঅভ্যুত্থান তার সুস্পষ্ট ও তাথ্যিক স্বাক্ষর। কিন্তু জাতীয় স্বার্থান্ধ আন্তর্জাতীয় রাষ্ট্রগোষ্ঠীয় কাছে এই প্রমাণ ও বাস্তব ঘটনার কোন মূল্য নেই।
৭। বাংলাদেশ সার্বভৌমিকতার যে শর্ত গুলি পূরণ করেছে তার চেয়ে অনেক কম শর্ত পূর্ণ করেও বিশ্বের বহু বিদ্রোহী জাতি বহু বিশ্বরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব নাম, নিজস্ব পতাকা, নিজস্ব জাতীয় সংগীত এবং স্বদেশের জাতীয় ভাষার প্রবর্তন ছাড়াও গণভোটে নির্বাচিত প্রায় সমগ্র প্রতিনিধির সমর্থন, বে-সরকারী ও বাঙালী সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর আনুগত্যলাভ এবং এই দেশের মুক্ত অঞ্চল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের নৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা – এই শর্তগুলি বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তার স্বীকৃতির পক্ষে শুধু যথার্থই নয়-পর্যাপ্তও বটে। তাই সার্বভৌমিকতার শর্ত পূর্তির প্রশ্ন ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষে বিশেষ কোন যুক্তিযুক্ত বাধা নেই। রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামান্য শর্ত পূরণের ক্ষেত্রেও অনেক স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রকে যে স্বীকৃতি দিয়েছে তার অনেক নজীর রয়েছে আন্তর্জাতিক ইতিহাসে।
জাতীয় স্বার্থ
৮। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটবে কিনা এবং পরবর্তী অধ্যায়ে এই সংঘর্ষ ভারত অ পিন্ডি-পিকিং চক্রের প্রত্যক্ষ সামরিক দ্বন্দ্বে পরিণত হবে কিনা – সেই প্রশ্নের বাস্তব বিশ্লেষণের আগে এ কথাটি বিচার করে দেখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ভারতের জাতীয় স্বার্থ কতখানি জড়িত।
৯। এ কথা আজ পরিস্কার যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দায়িত্ব শুধু এ দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি আদলনৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের ভাগ্যের সঙ্গে পূর্বাঞ্চল ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আর্থিক রাজনৈতিক এবং দেশ রক্ষার ভবিষ্যৎ সমস্যাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু পূর্বাঞ্চল ভারতের স্বার্থেই নয়- সমগ্র ভারতের ভবিষ্যৎ প্রগতির জন্যও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে।
১০। এ কথা বিশ্লেষণের আজ আর প্রয়োজন নেই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক ও সামরিক সংগঠন এবং পিন্ডি জংগী শাসনের স্থায়িত্ব বাংলাদেশের শাসন ও শোষনের উপরে একান্তভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বিচ্ছিন্ন হলে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক সামরিক অ রাজনৈতিক ভিত্তির উপরে যে প্রচণ্ড আঘাত পড়বে এবং তার পরিণামে পাকিস্তানে যে অনিবার্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তার গতিও হবে সুদূর প্রসারী।
১১। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষ ভারত ভাগের পরেও বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ডের জনজীবনকে মর্মান্তিকভাবে বিষাক্ত করে রেখেছে। লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশুর অশ্রুজলেও এই নিত্য স্বাক্ষর নিশ্চিহ্ন হয়নি। বিধাতার এক মহান আশীর্বাদরূপে বাংলাদেশে যে নতুন জাতীয়তাবাদের আহবান দিয়েছে – সেই ঐতিহাসিক ডাক সফল হলে ভারতীয় উপ-মহাদেশ এই প্রাণক্ষয়ী বিষের প্রকোপ থেকে মুক্ত হবে।
শরণার্থী
১২। বাংলাদেশের স্বদেশ বিতাড়িত গৃহচ্যুতরা অধিকাংশই হিন্দু- সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে এদের সংখ্যা এক কোটির মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এখনও এদের পরিচয় বাঙালীরূপে এবং এরা স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক। কিন্তু দীর্ঘদিন শরণার্থী শিবিরে থাকলে- গৃহচ্যুতের দল পূর্বাগত উদ্বাস্তুর দলে পরিণত হবে। এই শরণার্থীর অবিরাম আগমন পূর্বাঞ্চল ভারতের সামাজিক, আর্থিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলবে এবং পূর্বাঞ্চল ভারতের দেশরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তুলবে। ভারতের আর্থিক কাঠামোর উপরেই যে এই শরণার্থীরা প্রচন্ড আঘাত হানবে তাই নয়- ভবিষ্যতে শরণার্থীর সমস্যা মুখ্য সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনের কর্তব্যকে গৌণ করে তুলবে।
১৩। বাংলাদেশের স্বদেশ-প্রেমিক মানুষ আজ ভারতের উপরে গভীরভাবে নির্ভরশীল। দীর্ঘায়িত সংগ্রামের পরিস্থিতি এবং পিন্ডিশাহীর বর্বর অভিযানে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের উপরে বিশ্বাস হারিয়ে হয়তো চীনমুখী হয়ে যাবে। ভারতের বন্ধুত্বে বিশ্বাসী মৌলানা ভাসানীকে ভারতের প্রত্যঘাতেই যে পিকিংপন্থী করে তুলেছে- সেই ঘটনাও অজানা নয়। এরূপ পরিবর্তন ঘটলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে চীনা – নীতির আমূল পরিবর্তনেও যে বিব্লব ঘটবে না, তা বলা যায় না।
গেরিলা যুদ্ধ
১৪। বাংলাদেশের দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে? গেরিলা যুদ্ধের সাফল্যের প্রধান উৎস রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বদানের মানসিক প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের নেই। আওয়ামী লীগের মানসিক গঠন ও সংগ্রামের প্রস্তুতি ছিল পাক-স্বাধীনতা যেগের কংগ্রেসের ন্যায়। তাই আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করেছিল গান্ধীপন্থি অসহযোগ আইন অমান্যের। এই সংগঠাত্মন বৈপ্লবিক মানসিকতার রূপান্তরিত করার জন্য নেতাজী সুভাসচন্দ্রের ন্যায় নেতৃত্ব এদের মধ্যে নেই। উপরন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতাদের গেরিলা সংগ্রাম পরিচালনার সম্ভাবনা পিন্ডিশাহী চরমভাবে দূরূহ করে তুলেছে। তাই অধিকাংশ আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী আজ দেশ ত্যাগী হতে বাধ্য হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে গেরিলা র সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব বদল এবং ভারত-বিরোধী নেতৃত্বের আবির্ভাবের বিশেষ আশংকা রয়েছে। এরূপ নেতৃত্বের নির্ভরতা অনিবার্যভাবে হবে ভারত-বৈরী চীনের উপরে নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশের দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রাম গোটা পূর্বাঞ্চল ভারতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গৃহযুদ্ধের সংকট যে সৃষ্টি করতে পারে, তা নিছক অতি দূরদর্শী কল্পনা নয়।
পাক-ভারত সংঘর্ষ
১৫। বাংলাদেশকে এককভাবে স্বীকৃতি দিলে ভারতকে অনিবার্যভাবে পাকিস্তান বা পাক চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হবে, এরূপ আশংকা ও সবল যুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়।
১৬। রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামরিক- কোনদিক থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের সঙ্গে বর্তমানে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। পূর্বাঞ্চলে একটি গোটা জাতি বিদ্রোহ করেছে পাক-ফৌজের বিরূদ্ধে। পাক-ফৌজ রণনৈতিক স্ট্রাটিজির দিক থেকে শুধু যে একটি সামগ্রিক বৈরী জনতার ঘেরাওয়ে আবদ্ধ রয়েছে তাই নয়- এই ফৌজ গণ সংগ্রামে- দমনের উদ্দেশ্যে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বাঞ্চল সরবরাহ ও যোগাযোগের ব্যবস্থাও পাক-ফৌজের অনূকূল নয়। পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিবিশন সৈন্য পূর্ববাংলায় পাঠাবার সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তেও এ ফৌজের আক্রমণ ক্ষমতা ব্যাহত হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও যদি পাক ফৌজ কোন আক্রমনাত্বক দুঃসাহস দেখায় তাহলে দুই সীমান্তেই এই ফৌজের আশু বিপর্যয় সুনিশ্চিত। পূর্বাঞ্চলে পাক-ফৌজের পক্ষে এ সপ্তাহ টিকে থাকাও সম্ভব নয়। পূর্বাঞ্চল পতনের পরে ভারতীয় ফৌজকে পশ্চিমাঞ্চলে পাঠিয়ে পশ্চিম প্রান্তকে শক্তিশালী করা ভারতের পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে না। পাক ফৌজের পক্ষে এরূপ সম্ভাব্য পরিণতির কথা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় বলেই এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে আত্ম হত্যার পথ বেছে নেওয়ার অ্যাডভেঞ্চার করতে উদ্যত না হলে, পাকিস্তানের পক্ষে বর্তমান অবস্থায় প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়।
চীন আসেনি
১৭। রাশিয়ার সম্মতি ও সাহচর্যে চীনা ফৌজ কোরিয়ায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম, লাওস বা ক্যাম্বোডিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চীনের জাতীয় স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষভাবে চীন এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। অস্ত্র সরবরাহ চীন এদেশগুলিকেও করেছে- পাকিস্তানকেও করেছে। চীন বার বার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের কোন অঞ্চলের সামরিক সংঘাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার হয়নি। তা ছাড়া চীন জানে যে, আসন্ন বর্ষার সময়ে পূর্ব বাংলায় বা পূর্বাঞ্চল ভারতের কোন প্রান্তে বড় রকমের সৈন্য চলাচল করা এক দুঃসাধ্য প্রচেষ্টায় পরিণত হতে বাধ্য। চীন একথাও জানে যে ভারত বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে রুশ-মার্কিন সমর্থন ও সহযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও চীন যদি –পাকিস্তানের খাতিরে ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয় তা হলে রুশ বা মার্কিন রাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে দূরে সরে থাকতে পারবে না। চীন- মার্কিন সমঝোতার সম্ভাবনাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চীন পাকিস্তান রক্ষায় নিজের স্বার্থকে বিপন্ন করবে, এরূপ আন্তর্জাতিক ঔদার্য আদর্শবাদী প্রতিচ্ছবি যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিভাবে কলঙ্কিত হবে, সে কথাও চীনকে বিবেচনা করতে হবে।
১৮। তাই সমগ্রভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অযৌক্তিক নয় যে, পাকিস্তান বা পাক-চীনের পক্ষে ভারত-বিরোধী আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্র বর্তমানে অনুকূল নয়।
১৯। বিরোধী পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে একজন মন্ত্রী বলেন যে, স্বীকৃতি না দিয়েও বাংলাদেশকে সাহায্য দেওয়া যায়। হ্যাঁ সাহায্য দেওয়া যায় অপ্রকাশ্যে গোপনে। কিন্তু ভারতের ন্যায় গণতান্ত্রিক দেশে এরূপ সাহায্য গোপন রাখা সম্ভব নয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যায় বিরাট কাজে এরূপ প্রচেষ্টা সাহায্যদাতা ও গ্রহীতা কারও পক্ষেই যথার্থ কার্যকর করা যায় না।
২০। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েই এই দেশের পক্ষে সরকার আন্তর্জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হবে না। এ কথা সত্য হলে সেই সঙ্গে অন্য কথাও সত্য হবে যে একটা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করার ফলে বাংলাদেশের সরকার যে মর্যাদা লাভ করতে তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতীয় প্রচার চালিয়ে ভারতে মতামত স্থাপন করে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জনের পথও সুগম করতে সক্ষম হবে।
২১। ভারত সরকারের স্বীকৃতি লাভ করলে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে প্রকাশ্যে এই দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণ গ্রহণ করে, ভারতের সামরিক সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দ্রুত সম্পূর্ণ করা সহজতর হবে।
২২। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করার এবং ভাবী বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রস্তুত করার জন্যও ভারতেরই বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেওয়া কর্তব্য। ভারত যদি, এককভাবে হলেও, এই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও নির্ভীকতা দেখাতে পারে তাহলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠা ও কর্তৃত্ব হবে অদ্বিতীয় এবং অদূর ভবিষ্যতেই ভারত বিশ্ব সমাজে প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশসের স্বীকৃতি দানে ভারত অন্য যে কোন রাষ্ট্রের অনুবর্তী হওয়ার অপেক্ষায় থাকলে ভারত আন্তর্জাতীয় ক্ষেত্রে পরনির্ভরতা ও পরমুখাপেক্ষিতার বর্তমান অবস্থা থেকে ভবিষ্যতেও উত্তীর্ণ হতে পারবে না।