শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৩২। বাংলাদেশ স্বীকৃতির প্রশ্নে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় | দৈনিক “আনন্দবাজার” | ১০ মে, ১৯৭১ |
স্বীকৃতিতে অস্বীকৃতি কেন?
সেই পুরাতন স্বীকৃতির প্রশ্নটা মাঝে মাঝে চকিতে আশার রেখা দেখাইয়াই যেন মরীচিকার মতো মিলাইয়া যাইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ প্রবল প্রায় সমস্ত বিরোধী দল বারে বারে একবাক্যে বলিতেছেন, “বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দিন”। এই দাবী নানা রাজনৈতিক দলের কন্ঠে, এমন কি একাধিক রাজ্যের বিধানসভাতেও ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। শুক্রবার পশ্চিমবংগ বিধানসভার সর্বসম্মত প্রস্তাবটি ঐতিহাসিক নিদর্শন তো বটেই। ইহার বয়ান বাংলাদেশের সার্বভৌম গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি সৌভ্রাত্বের নিদর্শন তো বটেই, সেই সংগে বলিয়া দিয়াছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশের এই সংকটে তাহার কি প্রত্যাশা এবং কি প্রয়োজন।
দিল্লী তবুও মনে হয় এখনও মন স্থির করিয়া উঠিতে পারেনাই। কারন ভয় নয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই কথা ঘোষনা করিয়াছেন। ভয় যদি না হয়, দ্বিধার মূলে তবে কী? মুক্তি আন্দোলনের প্রতি এই দেশ পূর্ণ সমর্থন জানাইবে অথচ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিবে না- এই দুইটা মেলানো একটূ কঠিন। যেন দ্বিধার সংগে কোথাও দ্বন্ধ ঢুকিয়াছে। স্বীকৃতি আদৌ দেওয়া হইবে না, শ্রীমতি গান্ধী একথা অবশ্য বলেন নাই, শুধু অপেক্ষা করিতে বলিয়াছেন। অপেক্ষা আরও কতকাল অপেক্ষা? আরও কত নরবলির পরে?
ভারতের দ্বিধার উৎস-সন্ধানে বাহির হইয়াছে প্রথমেই আমরা সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন তুলিয়া ধরিতে চাই। স্বীকৃতির শর্ত কী, কোন কোন উপচার, উপাদান পূর্ণ হইলে একটি রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র বলে। রাষ্ট্র মানে কি শুধুই একটি ভৌগোলিক সত্তা, আর জনতা? রাষ্ট্র তাহার চেয়েও কিছু বেশী-সুসংগঠিত এবং আইনসংগত একটা সরকারও চাই। তাজউদ্দিন সরকারকে ভারত এখনই মানিয়া লইতে পারিতেছে না- উত্তম। কেননা ভারতের মতে ওই সরকারের হাতে কোনও স্থিতিশীল ভৌগলিক বিভাগ নাই। কিন্তু ইয়াহিয়া শাহীর হাতে আছে তো? জংগীবাহিনী গায়ের জোরে শহরের পর শহর দখলে রাখিয়াছে বা আনিয়াছে ইহা ঠিক। কিন্তু ইহাও একই রকম ঠিক যে, ওই মুলুকে অসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সরকারের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যে যদি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়, তবে পূর্ববঙ্গে আজ পাক সরকারের কোনও প্রকার অস্তিত্ব নাই- দাপট আছে মাত্র। দাপটকেই কি দিল্লী অস্তিত্বের একমাত্র লক্ষন বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে? সবার উপরে সত্য তবে বাহুবল?
নইলে আজ এই প্রশ্ন তোলা যাইত যে, ইয়াহিয়া সরকারকেই বা দিল্লী তথা সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়াছিল কবে? আয়ুবের বদলে ইয়াহিয়া ব্যাপারটা যদি নিছক সরকার বদল হইত তবে নতুন করিয়া স্বীকৃতির কথা উঠিত না অবশ্য। কিন্তু ১৯৬৯ সনে ইয়াহিয়া যেভাবে ক্ষমতা গ্রাস করেন, ভাঙিয়া দেন বিধানসভা, বরখাস্ত করেন মন্ত্রীদের, বাতিল করেন সংবিধান-তাহাতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির মৌল চরিত্র একেবারে বদলায়া যায়। মিশনে নাগিব যখন এইভাবেই গদি দখল করেন, হইয়া উঠেন সর্বেসর্বা ডিক্টেটর, তখন কিন্তু ব্রিটেন তাঁহাকে নূতন করিয়া স্বীকৃতি দিয়াছিল। সেই স্বীকৃতি ছিল “ডিফাক্টো”। অর্থাৎ মিশর রাষ্ট্রের চরিত্র একেবারে বদলাইয়া আইনের চোখে আমূল বদলাইয়া গিয়াছিল বলিয়াই নতুন স্বীকৃতির প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল। সেই দিক হইতে ইয়াহিয়াশাহী আজও অস্বীকৃত রহিয়াই গিয়াছে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র যেভাবে পয়দা হইয়াছিল, এ পাকিস্তান ঠিক সেই পাকিস্তান নহে। দুনিয়া চুপ করিয়া রহিয়াছে শুধু কি পেশীশক্তির প্রতি সম্ভ্রমবোধে? একটি অবৈধ সন্তান সকলের কাছে দিব্য জলজল হইয়া গেল, কিন্তু বৈধতার বিচার উঠিল সে সরকার সম্পর্কে, বাংলাদেশ শাসন করার যাহার গণতান্ত্রিক অধিকার। এই সরকারের পিছনে জনতা আছে, আছে বিপুল জনসমর্থন, শুধু ভৌগোলিক ভাগটা বিরূপ বলিয়াই সে অসিদ্ধ হইয়া যায়। এইভাবে বোধ হয় স্বয়ং ঈশ্বরও অসিদ্ধ হইয়া যান প্রমাণাভাৎ।
ইহার পর কেহ যেন গণতন্ত্রের নামে কথায় কথায় শপথবাক্য উচ্চারণ না করেন। শক্তই একমাত্র শর্ত- গণতন্ত্রের এই তো অর্থ দাঁড়াইতেছে। পিণ্ডি সরকারও যে পাকিস্তানকে আজ এক জাতি বলিয়া মনে করে না তাহার স্বীকৃতি পিণ্ডি-ফোমের আচরনেই আছে। বিশেষ করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার বাঙালী জাতির নিধন-উৎসাদনে যখন মাতিয়াছে তখন ধরিয়া লইতে হইবে ওই দেশে জাতি আসলে দুইটা, দুইটা জাতিকে এক রাষ্ট্রের অন্তরালে বাঁধিয়া রাখিতে হইবে ইহা কোন দেশী জবরদস্তি?
কুটনৈতিক বিধিবিধান ছাড়াও এই প্রসংগে অন্তত ভারতের আরও কয়েকটি দিক ভাবিবার আছে। নানা রাজ্য আর নানা দল সমস্বরে যে দাবী তুলিয়াছে, যে আহবান জানাইয়াছে তাহাকে উড়াইয়া দেওয়া সরকারের পক্ষে প্রাজ্ঞজনোচিত হইবে না, ন্যায়সংগতও না। কেননা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণতন্ত্র মানে সকল দল। ইহা ছাড়া আজ বাংলাদেশের বিপুল প্রত্যাশা ভারতের প্রতি যে শুভেচ্ছা জাগাইয়া অতিমাত্রার বিলম্ব ঘটিলে তারা ধীরে ধীরে লয় পাওয়ারও বিলক্ষন ভয়। সেই হতাশা আর তিক্ততার পটুভূমিতে চীনের ছায়াটি দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইয়া যাইতে কতক্ষণ? আর আগানো কঠিন ভারত হয়তো শুধু এইটুকুই তাকাইয়া দেখিয়াছে? কিন্তু এখনও খেয়াল করিতে পারে নাই যে পিছানো অসম্ভব। সময় আর স্রোত কাহারও জন্য অপেক্ষা করে না কথায় বলে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত বাংলাদেশের আক্রান্ত জনগণের আহত মুখচ্ছবি হয়তো একদিন নীরস তিরস্কারে ভারতকে বলিয়া দিবে-চিরতরে অপেক্ষা করিয়া রহে যার প্রত্যাশী একটি জাতির ভালবাসা একটি শুভেচ্ছাও।