শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩০। বাংলাদেশ দি ট্রুথ | কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি প্রকাশিত পুস্তক | ৯ মে ১৯৭১ |
এই ছোট প্রচারপত্রে বাংলাদেশের আন্দোলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যখন জনাব জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের দাবির উপর পাকিস্তান গঠন করা হয় এই দুই দেশের মাঝে ধর্ম ছাড়া আর কোন বিষয়ে সাদৃশ্য ছিলোনা। ধর্ম কদাচিত জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎস হতে পারে। অন্যথায়, সমস্ত খ্রিস্টান ও মুসলমানরা একই রাষ্ট্রের অধীনে বাস করতে চাইত। তাদের ভাষা সংস্কৃতি ভিন্ন ছিল। যদিও পূর্ব অংশের জনসংখ্যা বেশী ছিল কিন্তু অপর অংশটি সব সময় অগ্রাধিকার ভোগ করেছে। পুর্ব অংশের ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগণকে শুধুমাত্র ব্রিটিশ থেকে পাঞ্জাবের প্রভুদের নেতৃত্ব বরন করে নিতে হয়েছে। একমাত্র বিষয় ছিল যে উভয় অংশের মানুষের একই ধর্ম ছিল। কিন্তু এটা খুব ক্ষুদ্র সান্তনা-যুক্তি হিসেবেই প্রতীয়মান হল। বাংলা ভাষাভাষী লোকদেরকে মাঝে মাঝে সামান্য কিছু দেয়া হত। কিন্তু অধিকাংশই বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য। এই অন্যায়ের জন্যই সম্পদের সমান অধিকার নিশ্চিতকল্পে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবী অনিবার্য হয়ে ওঠে।
এই চাহিদা শুধুমাত্র একটু বিচক্ষণতা ও সহানুভূতি দিয়েই সমাধা করা যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব অংশের দরিদ্র মানুষদের কাঙ্ক্ষিত সাম্যতা ও স্বায়ত্তশাসনের বদলে পেতে হয়েছে বুলেট। এই চেঙ্গিস খান-নাদির শাহ-হিটলার চিকিত্সায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ডাক দেয়।
বাংলাদেশের এ কাহিনী ইতিহাসে নতুন নয়। অনেক দেশ যারা এখন স্বাধীন হয়েছে তারা অন্য দেশের অংশ ছিল। পরবর্তিতে তারা আন্দোলন করেছে এবং অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন একবার শুরু হলেও কখনো কখনো তা স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিরদিনই তা অর্জিত হয়েছে। কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা আজ বা কাল অর্জন করেই নেবে। তবে অন্যান্য দেশের অর্জিত স্বাধীনতার সাথে এটার স্বাতন্ত্র্য হচ্ছে এখানে দখলদার বাহিনীর দ্বারা ঘটানো অসভ্যতা, খুন ও ধ্বংসলীলা। আর দ্বিতীয় সবচেয়ে দু: খজনক সত্যটা হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সরকারের এই যুদ্ধে সাড়া না দেওয়ার মনোভাব। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে এবং আমরা ভারত সরকার তাদের সাথে থাকতে পেরে গর্বিত। আমাদের মানুষ সবসময় বিশ্বের প্রতিটি অংশে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, বা রাজনীতি নির্বিশেষে স্বাধীনতাকামী মানুষকে সমর্থন দিয়েছি। ফ্রান্স যেভাবে অ্যামেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে পাশে ছিল আমরাও একইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। যখন একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে তখন সেটা শুধু সেখানকার অগণতান্ত্রিক সরকার নয় বরং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক, স্বাধীনতা প্রেমী মানুষের জন্য ভাবনার বিষয়।
বাংলাদেশের এ গল্প লিখেছেন ডঃ বাগেন্দু গাঙ্গুলী এবং ডঃ মীরা গঙ্গোপাধ্যায়। তারা অনেক কষ্ট করে স্বল্প সময়ের মধ্যে এটা লিখেছেন এবং আমরা সত্যিই তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কোলকাতা বৈশাখ ২৫, ১৩৭৮
রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিন,
৯ মে ১৯৭১
এস সেন
উপাচার্য
বিশ্বের বিবেক পাকিস্তানের বর্তমান শাসকদের অহংকারী অধার্মিক আচরণে শোকাহত। দীর্ঘদিনের ভীতি প্রদর্শন, অর্থনৈতিক শোষণ ও গণহত্যার ধারাবাহিকতায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
ভারতীয় ভূখণ্ডের এক হাজারেরও বেশি মাইল ভৌগলিকভাবে পৃথকীকৃত কিন্তু ইসলামী বিশ্বাসের দ্বারা একত্রে বাঁধা দুই দূরবর্তী অঞ্চল মাত্র তেইশ বছর আগে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই বছরগুলোতে দুই অংশ কাছাকাছি আসেনি। বরং তাদের মধ্যকার পার্থক্য বেড়েছে আরও অনেক বেশী। এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা পশ্চিম পাকিস্তান গত দুই দশক ধরে অর্থণৈতিকভাবে নাটকীয় উন্নতি লাভ করলেও তুলনামূলকভাবে জনবহুল পূর্ব অংশ বিশ্বের অন্যতম পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এবং পূর্ব অংশকে শুষে নিয়েই পশ্চিমের এই উন্নতি।
অর্থনৈতিক অসমতা
পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পুর্ব পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। কিন্তু সত্যিকারের মাথাপিছু আয় বৈষম্য ছিল ৪০ এবং ৫০ শতাংশের মাঝামাঝি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় এই অংকটা এত বেশী দেখা যায়। তাছাড়া পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদের আহরণ এবং বিদেশী ঋণের কারণে এটা আরও বেড়ে যায়।
স্থানীয়ভাবে ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স ডিপোজিট হিসেব করলে এবং এটাকে মোট জাতীয় আয়ের ব্রেকডাউন বের করে মিলিয়ে দেখলে যে কেউ সেটা সহজেই অনুমান করতে পারবে। এতে দেখায় যায় পুর্ব পাকিস্তানের অবস্থান পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে তিন গুণ উপরে। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ের বিপরীতে জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় শ্রমশক্তির প্রাদেশিক বন্টন ডাটা ব্যবহার করে দেখলে এই সম্পর্কে ধারনা করা যেতে পারে। এখানে দেখা যাবে পশ্চিম পাকিস্তানে এর পরিমাণ পুর্বের চাইতে তিন গুণ।
কিন্তু শুধু মাথাপিছু আয় দেখেই এই ধারনা করা যাবেনা। দুই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও এক ছিল না। দ্বিতীয় ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা দেখলে জানা যায় একই পণ্যের দাম পুর্ব পাকিস্তানে বেশী ছিল। তাছাড়া পরিবহন ও বণ্টনের ক্ষেত্রেও এই পার্থক্য দেখা যায়। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় মূল্য পার্থক্য আরও বেশী বাড়ানো হয়েছে। ১৯৫৯-৬০ থেকে ১৯৬২-৬৩ সালের আঞ্চলিক মূল্য সূচক দেখলে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানে ১০০ থেকে ১১২ ভাগ বেড়েছে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে মাত্র ১০০ থেকে ১০২ ভাগ বেড়েছে। তৃতীয় ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার (১৯৬৫-৭০) মিডপ্ল্যান রিভিউ (মাঝামাঝি পুনরালোচনা) করে দেখা যায় সেখানেও একই ধারাবাহিকতা রয়েছে।
দুই অঞ্চলের অর্থনীতির মধ্যে কাঠামোগত পার্থক্য দেখলেও মাথাপিছু আয় বৈষম্য সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রথম দিকে দেখায় যায় দুই পাকিস্তানের শিল্প অবকাঠামো প্রায় একই ছিল। বরং ব্যাংকিং কার্যক্রম পূর্বে বেশী ছিল। বিভিন্ন সেক্টরে পুর্ব পাকিস্তানের তুলনামূলক অবদান দেখলেও সেই সময়ের অর্থনীতি সম্পর্কে ধারনা পাওয়া সম্ভব। কৃষিতে পুর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল ৭০ ভাগ আর পশ্চিমের ছিল ৫০-৫৫ ভাগ। উৎপাদন খাত সে তুলনায় কিছুটা নিচে ছিল। আর আঞ্চলিক খাত ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম।
সময়ের সাথে সাথে কাঠামোগত পার্থক্য আরও বেড়েছে। “কাঠামোগত উন্নয়ন” এর উচ্চ হারে বৃদ্ধির কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের মোট (এবং মাথাপিছু) আয় যায় বেড়ে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি পুর্ব পাকিস্তানের শেয়ার কৃষিতে নেমে যায় ৬০ ভাগে যা পশ্চিমে হয় ৪৬ ভাগ। উৎপাদন খাতে পুর্ব পাকিস্তানের অবদান হয় মাত্র ৭-৮ ভাগ যা পশ্চিমে দাঁড়ায় ১৪-১৫ ভাগ। স্থানীয় উন্নয়ন ও বিপুল বেগে পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়ে যেতে থাকে পূবের তুলনায়। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালে পুর্ব পাকিস্তানে সাধারণ কৃষি শ্রমিকের পরিমাণ ৮৩.২ থেকে বেড়ে ৮৫.৩ ভাগে পৌঁছায়। পশ্চিম পাকিস্তানে তা কমে গিয়ে ৬৫.১ থেকে ৫৯.৩ ভাগে পৌঁছায়।
এই কাঠামোগত পার্থক্যের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্বে বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে বেকারত্বের হার ২০ ভাগ বাড়ে আর পশ্চিমে তা ছিল ৮ ভাগেরও কম। তার পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল আরও জটিল উন্নত শিল্প ও যন্ত্রপাতি।
পশ্চিম পাকিস্তানের আরও উন্নত আন্তঃকাঠামো ছিল। পরিবহন ব্যবস্থা আরো উন্নত ছিল। ১৯৬০ সালে উচ্চ মাইলেজসম্পন্ন মহাসড়ক ছিল ছয় গুণ বেশি। রেলওয়ে মাইলেজ ছিল ৩ গুণ বেশী। ট্রাক ও বাসের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে ৫ গুণ বেশী ছিল। ১৯৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্ট ও টেলিগ্রাফ অফিস ও যোগাযোগে অনেক বেশী ছিল – টেলিফোনের সংখ্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে ৫ গুণ বেশী। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় ৫/৬ গুণ বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রকৌশল, শিল্প এবং প্রযুক্তি কর্মীদের সংখ্যা বেশী ছিল। সর্বপরি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনে তাদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশী।
ফেডারেল সরকারের আসন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসারদের বেশিরভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। যে মন্ত্রণালয় থেকে সব গুরুত্তপূর্ন বরাদ্দ হয় – অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুটি গুরুত্তপূর্ণ পদ (সচিব এবং যুগ্ম-সচিব) প্রায় একচেটিয়াভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সিভিল সার্ভেন্টরা (১৯৬০ সালে ছিল ৫৩ জনের মধ্যে ৫২ জন) দখল করে রেখেছিল। ১৯৬০ সালে ১৭৭৯ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মচারিদের মধ্যে ৮০ ভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। অর্থাৎ একটি দেশের অর্ধেকের বেশী জনগণ যে অঞ্চলে বাস করে তাদের মধ্যে মাত্র ১৩ ভাগ ছিলেন গুরুত্তপূর্ন পদে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান – যারা উভয়েই সম্পদের বরাদ্দে ক্ষমতা রাখেন – তাদের কেউই কখনোই পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়োগ পান নাই।
ফেডারেল সরকারের আসনের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং ও শিল্প ক্ষেত্রে আকৃষ্ট করানো। পশ্চিম পাকিস্তান শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ নয় – বরং ফেডারেল গভমেন্টের ৯০ ভাগ পদ দখল করে রেখেছিল। এভাবেই পুরো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সকল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও কৌশলগত উন্নয়ন ও বরাদ্দ সম্পর্কিত দপ্তরের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানীরা দখল করে রেখেছিল।
যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আঞ্চলিক আয় বেশী ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি অবকাঠামো পশ্চাদপদ ছিল তবুও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবনমানের বৈষম্য তার চাইতেও বেশী ছিল। এর একটি অন্যতম কারণ পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বৈদেশিক সম্পদ প্রবাহ বেশী ছিল। এর দুটি অন্যতম উৎস হল (ক)স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে (দৃশ্যমান) সম্পদের স্থানান্তর এবং (খ)বৈদেশিক সাহায্যের অনেক বড় প্রবাহ পশ্চিম অঞ্চলে সরবরাহ।
স্বাধীনতার প্রথম দশকে পুর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ স্থানান্তরের একটি প্রমাণ হচ্ছে সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ও আন্তঃআঞ্চলিক আয় উদ্বৃত্ত ছিল। বাকি বছরগুলোতে এটা নির্নয় করা যেত যদি বৈদেশিক মুদ্রা এলোমেলোভাবে স্থানান্তর না করে অফিসিয়াল দামে করা হত। সম্পদের এই দৃশ্যমান স্থানান্তর ছাড়াও বৈদেশিক সহায়তার সিংহভাগ সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানেই নিয়ে যাওয়া হত।
এভাবেই অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান সুবধা নিতে থাকায় – পূর্ব পাকিস্তান – যারা কিনা সমস্ত দেশের ৫৪% জনগণ – তারা এই অনিয়মের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে শুরু করে।
স্বায়ত্তশাসনের দাবি
পাকিস্তানের দাবিতে পূর্ববাংলার জনগণ সমর্থন দিয়েছিল কারণ তারা আশা করেছিল যে নতুন রাষ্ট্র হলে তা তাদের অগ্রগতির জন্য মঙ্গলজনক হবে ও নতুন সুযোগ বয়ে আনবে। কিন্তু এই আশা পূর্ণ হয়নি। এবং পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাভাবিকভাবেই এতে ক্ষুব্ধ। ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ – এ একজন সদস্য গণপরিষদে বলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে কারণ তারা অবহেলিত হচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ হিসেবে তাদের দেখা হচ্ছে। ’ এই ক্ষোভ থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠে। জনগণ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের করা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করতে থাকে। এখানে উল্লেখ করা ছিল যে পাকিস্তানের উভয় সাংবিধানিক অংশ “স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম” হবে। তারা উল্লেখ করেন যে পাকিস্তান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বদলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে।
পূর্ববাংলায় বিশ্বাসঘাতকতা চরমে ওঠে ভাষা প্রশ্নে। মার্চ, ১৯৪৮, জিন্নাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে আসলে শিক্ষার্থীদের দাবি ওঠে যে বাংলাকে উর্দু সঙ্গে সাম্যাবস্থা দিয়ে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শ্রোতাদের বলেছিলেন: “আমি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে যাচ্ছে, এবং অন্য কোন ভাষা নয়”।
বাঙালি দেখল তাদের উপর শুধুমাত্র সংস্কৃতিক হুমকি নয় বরং প্রশাসনিক চাকরী থেকে শুরু করে সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের নিকৃষ্ট অবস্থায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছিল – এবং পাঞ্জাবিদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছিল। ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন জব্বার, সালাম, রাফিউদ্দিন, বরকত ও আরও বাইশ জন অন্যান্য তরুণ তাদের প্রিয় মাতৃভাষার সমর্থনে বের হয়ে রক্ত দেয়। এই শহীদদের রক্তদানের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববাংলার লীগ সরকার রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণার জোর দাবি জানায়। তাদের দাবী সে সময় দাবীয়ে রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তিতে সংবিধানে ১৯৫৬ সালে গৃহীত হয়: “পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা। “
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুসলিম লীগ আন্দোলন করে যার ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পরিণতি পায়। যুক্তফ্রন্ট যারা নির্বাচনে ক্ষমতায় বসে তারা তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিল। নতুন মন্ত্রণালয় ৭ দফা প্রোগ্রাম দিয়েছিল যেখানে একই বিষয় ছিল। সেখানে স্পষ্ট ছিল “প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি ও মুদ্রা ব্যাতীত পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকবে। উল্লেখিত বিষয়গুলি শুধুমাত্র কেন্দ্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। কিন্তু এক পক্ষকাল সময়ের ভেতর মন্ত্রী ব্যার্থ হন কারণ কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে যেনতেনভাবে শেষ করে দেন।
সময়ের সাথে সাথে দুই পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং তাই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা বাড়ছিল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ১৯৫৮ সালে শুরু হয় এবং প্রায় সাড়ে দশ বছর ধরে চলে। সামরিক শাসন হবার কারণেই আইয়ুব খানের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বোঝার সুযোগ হয়নি। বেশ স্বাভাবিকভাবেই, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সমস্যা নতুন মাত্রা পায় এবং ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সরকারের একটি ফেডারেল ফর্ম যা সংসদে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের দ্বারা নির্বাচিত হয় তারা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য সব কিছু পূর্ব পাকিস্তানের ফেডারেটিং সরকার দেখবে। দুই দেশের মুদ্রা স্থানান্তর না করে তার পরিবর্তে আলাদা মুদ্রা ও মুদ্রানীতি করা হবে। যুক্ত সরকার খরচ মেটানোর জন্য ট্যাক্স এর অর্থ নিতে পারবে তবে তাদের কোন করারোপ করার ক্ষমতা থাকবেনা। প্রতিটি ফেডারেট সরকার বিদেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে এবং তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ফেডারেল রাষ্ট্রের তাদের নিজস্ব মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী থাকবে।
ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার মাত্র দুই মাস পর মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করা হয় এবং দেখানো হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সামরিক ও বেসামরিক উচ্চ পদমর্যাদার অফিসার ভারতের কূটনৈতিক কর্মী দের সাথে জড়িত হয়ে একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।
আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলন ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে চরম আকার ধারণ করে। এবং এর আসল নেতৃত্বে ছিল ছাত্রদের ‘জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’ যেখানে সব রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে সরকারকে বাধ্য হয় এবং ১৯৬৯ এর শুরুতে মুজিবুর মুক্তি লাভ করেন। এবং তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য আইয়ুব খান আমন্ত্রণ জানান। সম্মেলনে মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে জাতীয় প্রশ্ন টি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ক্ষমতায় যারা এসেছে তারা পাশ কাটিয়ে গেছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিক পৃথক সত্তা রয়েছে। এসব বিষয় রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠানের স্বীকার করতে হবে। তিনি ছয় দফার জন্য চাপ দিতে থাকেন।
আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ কয়েকদিনের মধ্যেই ধসে পড়ে। সেখানে একটি দ্বিতীয় সামরিক কর্তৃত্ব শুরু হয়। ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসীন হন।
নতুন শাসকদের লক্ষ্য ছিল ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়ার তিন ঘোষণা যা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে ৩০ মার্চ পাশ হয়। ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কোনো সরাসরি অঙ্গীকার করে নাই। শুধু বলেছেন তিনি প্রদেশগুলোকে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন দেবেন কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা ও কাজের অসুবিধা যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকটা লক্ষ্য রেখে।
লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে ১২০ দিনের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভা ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি তে জয়লাভ করে। এবং এইভাবে হাউসের ১৩১ এর মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে ভোটারদের একই রকম ফলাফল পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়াহিয়া খান মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তার সফর শেষে ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন যে ক্ষমতা দ্রুত তাঁকে স্থানান্তরিত করা হবে। কিন্তু তিনি সে সময় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জন্য একটি তারিখ ঠিক করতে অস্বীকৃতি জানান। অনেক বিলম্বের পরে, এসেম্বলি ৩ মার্চ ডাকা হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো, যার নেতৃত্বের পিপলস পার্টির নির্বাচনে ৮৫ টি আসন পেয়েছিল, তিনি হুমকি দেন আওয়ামীলীগ ৬ দফা প্রত্যাহার না করলে তিনি এসেম্বলিতে যাবেন না। তিনি করারোপণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমতা চেয়েছিলেন। মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, পূর্ববাংলার জনগণ ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষেই তাদের স্পষ্ট রায় দিয়েছিলেন যেখানে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এর কথা বলা হয়েছে এবং এই রায়কে সন্মান দেখাতে হবে। দেশের সংবিধান ছয়দফার উপর ভিত্তি করেই করতে হবে।
ভুট্টোর হুমকি সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছিল। এবং আওয়ামী লীগের ত্রিশ সদস্যের কমিটি ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে প্রস্তুত করা খসড়া সংবিধান পর্যালোচনা করতে বসল। ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলল এবং হুমকি দিল যে যদি তার দল ছাড়া ন্যাশনাল এসেম্বলি হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে বড় রকমের আন্দোলন হবে। হঠাৎ করে ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। তিনি “ভারাক্রান্ত হৃদয়ে” এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বলেন, দুই পাকিস্তানের নেতাদের মনোভাব ও ভারতের আচরণ নিতান্তই পরিতাপের বিষয় বলে তিনি তা বন্ধ ঘোষনা করছেন। ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, পাকিস্তান চরম সঙ্কটের মুখোমুখি এবং এই অবস্থায় অধিবেশন স্থগিত করার প্রয়োজন ছিল এবং এই সঙ্কটের কিছু সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশে অবিলম্বে নিজ নিজ এলাকার জন্য সামরিক আইন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিযুক্ত করা হল এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নতুন সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।
এক সংবাদ সম্মেলনে মুজিবুর রহমান এটিকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে নিন্দা করেন এবং পরদিন ঢাকায় হরতাল এবং তার পরের দিন থেকে সারাদেশে সাধারণ অবরোধ ঘোষণা করেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন রাষ্ট্রপতি এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে পরামর্শ না করেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন। ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয় এবং কয়েক হাজার মানুষ সংবাদ সম্মেলনের ভেন্যুর বাইরে মিছিল করতে থাকে।
বিক্ষোভকারীদের চিৎকার ও প্রতিরোধের মুহুর্তে মুজিবুর ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেন “আমরা একটি শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব”। কিন্তু পরদিন ঢাকায় সহিংসতার সূত্রপাত হয় এবং পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী জনগণের ওপর গুলি ছোড়ে। পরদিন ঢাকা এবং অন্য দুটি শহরে কারফিউ জারি করা হয় এবং সামরিক আইন প্রশাসন একটি ডিক্রি জারি করে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেস সেন্সরশীপ চালু করে। ৩ মার্চ, মুজিবুর একটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরুর ঘোষণা করেন যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত হবার আগ পর্যন্ত বলবত থাকবে বলে ঘোষনা করেন। একই দিনে ইয়াহিয়া খান সংবিধান প্রণয়নের উপর ঢাকায় ১০ মার্চ একটি সম্মেলন করার জন্য দুই অংশের নেতাদের আমন্ত্রন জানান। সৈন্যরা রাস্তায় জনবিক্ষোভের উপর গুলি করে শত শত মানুষকে হত্যা করে। মজিবুরের অনুরোধ তারা গ্রাহ্য করেনা। পরবর্তি কিছু দিনে আরও অনেককে হত্যা করা হয়। ইতোমধ্যে সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে প্লেন এবং জাহাজে করে আরো সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন সেনাবাহিনী পাকিস্তানের “সম্পূর্ণ এবং পরম” অখণ্ডতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, তার দল অধিবেশনে যোগ দেবার ব্যাপারটি বিবেচনা করবে যদি যদি ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন, সেনা প্রত্যাহার করে বেসামরিক শাসন বলবত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের তদন্তের আদেশ দেন।
অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। সমস্ত পূর্ববাংলা মুজিবুর ও তার আওয়ামী লীগের পিছনে ছিল। এমনকি প্রধান বিচারপতি এবং ঢাকা হাইকোর্টের বিচারকরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। এটা একটি বিস্ময়কর এবং সত্যিই অতুলনীয় আন্দোলন ছিল। ১৫ মার্চ, মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, তিনি জাতীয় পরিষদে ও প্রাদেশিক পরিষদে তার দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি ৩৫ দফা ঘোষণার একটি সেট প্রস্তুত করেন এবং ইয়াহিয়া খান ১৬ মার্চ ঢাকায় এসে আলোচনা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ভুট্টো ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা আলোচনায় যোগদান করেন।
কোন পর্যায়ে আলোচনা সমাপ্ত হচ্ছিল না। এমনকি ইয়াহিয়া খান বা তার দল কোনো ইঙ্গিত বা অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন নাই। পরিশেষে চার দফার একটি চুক্তিতে আসেন তারা। এগুলি হলো: সামরিক আইন ও প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার দ্বারা একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর; সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের জন্য প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর; ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন; এবং পূর্ব ও পশ্চিম অংশে জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক অধিবেশন ব্যাবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তান প্রস্তুতিমূলক একটি যৌথ অধিবেশনে সংবিধান চূড়ান্ত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। নীতিগতভাবে এই চুক্তি মুজিবুর এবং ইয়াহিয়ার মধ্যে হবার পরে প্রশ্ন ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতা কার হাতে থাকবে।
কিন্তু হঠাৎ করে, ২৫-২৬ মার্চ ইয়াহিয়া রাতের অন্ধকার ঢাকা ত্যাগ করেন। একই সাথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তাদের একশন শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুজিবকে এই ব্যারথতার জন্য দায়ী করে। এবং ২৬ মার্চ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। ২ দিন পর বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার গঠন ঘোষণা করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এটা এখন স্পষ্ট যে, ইয়াহিয়া খান ও তার দলের শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের কোন ইচ্ছাই ছিলোনা। তারা শুধুমাত্র আধুনিক অস্ত্র দিয়ে সৈন্য শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য সময় ক্ষেপণ করছিল। অসহযোগ আন্দোলনের অসাধারণ সাফল্যের জন্য পাকিস্তানী শাসকদের ঔপনিবেশিক শোষণের দিন চিরতরে চলে গেল। অত: পর পাকিস্তান সরকার ২৫ মার্চ গণহত্যার সামরিক আদেশ দেন।
বাংলাদেশের সাহসী মানুষ তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করল, শহীদের রক্তে তাদের মাতৃভূমির প্রতি একর সবুজ জমি লাল রঙে রঞ্জিত হল।
বাংলাদেশের যুদ্ধ
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক হামলা ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে শুরু হয় এবং এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তান সরকার শুধুমাত্র জনগণের ম্যান্ডেট নয় বরং সভ্যতার সব অনুশাসন ভঙ্গ করেছে। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সংঘটিত নৃশংসতার পূর্ন চিত্র এখনো পাওয়া যায় নাই। কিন্তু ভারতীয় ও বিদেশী কিছু সংবাদপত্র ও লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু যারা ভারতে পালিয়ে এসেছেন তাদের বক্তব্য থেকে জানা যায় পাকিস্তানী শাসকেরা বাংলাদেশে কি পরিমাণ গণহত্যা চালাচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে কার্যত একটি বড় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তারা ব্যাপক বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণ করে শহর ও গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিল। গণহত্যার জন্য তারা ট্যাংক, কামান, মর্টার ও মেশিনগানের মত অত্যাধুনিক ভারী-মারনাস্ত্র ব্যবহার করছে। তারা আগ্নেয় বোমা ও জনশ্রুতি আছে যে এমনকি তারা নাপাম বোমা ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তান সরকার ধারাবাহিকভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও জননেতাদের একটা বড় অংশকে হত্যা করছিল। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বৃহৎ সংখ্যক শিক্ষক ও ছাত্রদের হত্যা করেছে এবং তারা সব কর্মক্ষম বাঙালিকে বেছে বেছে হত্যা করছে। গণহত্যার একটি বেলেল্লাপনা চলমান ছিল।
পাকিস্তান সরকার ক্রমেই আন্তর্জাতিক আইনের সব নীতি লঙ্ঘন করেছে। তারা ইন্টার আলিয়া, ইউ এন সনদের প্রস্তাবনা ও প্রবন্ধ নং ১, ৫৫ ও ৫৬ ধারা, ১৯৬৬ সালের মানবাধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি, ১৯৬৬ সালের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ঘোষনা, ১৯০৭ সালের হেগ রেজোল্যুশন, ১৯৪৯ এর জেনেভা কনভেনশনের ধারা ৩ এর ধারা ২৩ (জি), ১৯৪৮ এর যুদ্ধরত আক্রমণ থেকে অযোদ্ধাদের অনাক্রম্যতা মতবাদ এবং জেনোসাইড কনভেনশন আইন ভঙ্গ করেছে।
২৫ মার্চ ১৯৭১ এ যুদ্ধের প্রথম রাত হতে শারীরিক ও মানসিক ধ্বংসের একটি নিয়মিত ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি শীঘ্রই স্পষ্ট হয় যে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপকে টার্গেট করে তাদের শেষ করার কার্যক্রম চলছিল। এদের মধ্যে ছাত্র এবং শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ অন্তত ৯ জন শিক্ষাবিদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তি কয়েক দিনে আরও অনেককে হত্যা করা হয়। ২৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষাবিদকে একটি দেয়ালের সাথে লাইনে দাড় করিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঢাকা, খুলনা, যশোর, রাজশাহী, পাবনা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ফায়ারিং স্কোয়াডে অনেক বিশিষ্ট শিক্ষক, কবি ঔপন্যাসিক, চিকিত্সক ও আইনজীবীদের হত্যা করা হয়। এমনকি স্কুলের বাচ্চারাও রেহাই পায়নি। যশোরে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপর সৈন্যরা মেশিন-গান চালায়।
ঢাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। তিন তলা ইকবাল হলের প্রত্যেকটি রুম তছনছ করা হয় এবং ভিতরের সব মানুষকে হত্যা করা হয়। একই রকম হামলা জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ হল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক হল এ চালানো হয়। এসব স্থানের প্রতিটি মানুষকে হত্যা করা হয়।
সেনা আক্রমণ শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্রী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অনেক ছাত্রীদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং জোর করে অনেককে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। শহীদ মিনার, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্থাপনা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়। ফ্যাকাল্টি স্টাফদের আবাসস্থলে ঘুমন্ত শিশুদের পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করা হয়।
জন রোড নামে একজন আমেরিকান এইড কর্মী সম্প্রতি ঢাকায় ছিলেন এবং তিনি সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা সৃষ্ট ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরবর্তিতে তিনি U.S.A. সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির প্রকাশিত চিঠিতে বর্ণনা করেন কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে সেনাবাহিনীর ট্যাংক দ্বারা শেলিং করা হয়েছে এবং সব বাসিন্দাদের হত্যা করা হয়েছে। তিনি “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অধ্যাপক সহ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অনেককে পরিকল্পিতভাবে করা হত্যাকাণ্ডের বর্ননা দেন। তাঁর মতে পূর্ব বাংলায় জঙ্গলের আইন চলমান আছে – সেখানে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সমূলে হত্যা করা হচ্ছে।
সাইমন ড্রিংক, ডেইলি টেলিগ্রাফ এর একজন সংবাদদাতা। তিনি ঢাকা হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন ২৬ মার্চ সকালে সেনাবাহিনী এগারো ঘন্টার জন্য ধারাবাহিকভাবে ঢাকার সমগ্র পুরাতন শহর ধ্বংস করে। মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ভিতরে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। যদি কেউ পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে সৈন্যরা তাদের ধাওয়া করছিল। দৃক বর্ননা করেন কিভাবে একটি বাজারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের উপর গুলি করা হয়েছে এবং সকালে যেন তারা সেখানে ঘুমাচ্ছিল।
পুরাতন শহরের সর্ববৃহৎ ডুটি বাজারে মৃতদেহ এবং জ্বলন্ত দেহের দুর্গন্ধ এতোই মাত্রাধিক ছিল যে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তারা কাপড় দিয়ে নাক চেপে ধরে চলাফেরা করছিলেন। পচা লাশের দুর্গন্ধ ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকার বাতাসে ছড়িয়ে গেছিল। পাকিস্তানি সেনারা লাশগুলো ট্রাকে করে এনে নদীর তীরে ডাম্প করছিল। জগন্নাথ হল ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রোকেয়া হলের মধ্যবর্তী খোলা মাঠ একটি সমাধিস্থলে পরিণত হয়েছে। মানুষকে কবর খুঁড়তে সৈন্যরা বাধ্য করছিল এবং যখন তারা কাজ শেষ করছিল সৈন্যরা তাদেরকেও হত্যা করছিল। সামরিক অভিযান শুরুর থেকে পক্ষকাল পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় দুর্গন্ধযুক্ত পচা লাশ পরে ছিল।
রাজশাহীতে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উপর বারবার বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। টি বি হাসপাতাল ও মুসলিম স্কুলের উপরেও করা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী আসার পথে যা কিছু পাচ্ছিল তাঁর সবকিছুই ধ্বংস করছিল। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ইউনিফর্ম ছাড়া তারা ১৩ এপ্রিল রাজশাহী ও সংলগ্ন গ্রাম ছারখার করে দেয়। তারা বেসামরিক নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করে এবং শহরে অগ্নি সংযোগ করে। ভীতগ্রস্ত সাধারণ জনগণ পদ্মা নদী পার হয়ে পালাবার চেষ্টা করার সময় সেখানে অপেক্ষারত সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের নির্মমভাবে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মর্টার শেল ও মেশিনগানের গুলিতে নারী ও শিশুরা নদীতে মারা গিয়ে ভেসে যেতে লাগল।
অন্যান্য এলাকায় পলায়নপর উদ্বাস্তুদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কয়েকদিন ধরে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স খুব নিচু দিয়ে বিমান চালিয়ে সিলেট-চুরখাই-সুতারকান্দি রাস্তায় আশ্রয়রত উদ্বাস্তুদের উপর গুলিবর্ষন করে। তাছাড়া বিমানগুলো আশেপাশের এলাকাগুলো প্রদক্ষিণ করছিল। যখন তারা পলায়নপর কাউকে দেখছিল তখন তারা তাদের দিকে এসে ঝর্না-গুলি (shower bullets) নিক্ষেপ করছিল। আর কিছুক্ষণ পরপর গ্রামবাসী ও পথিপার্শ্বস্থ গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
একজন ডেনিশ স্টুডেন্ট যে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছিল সে সেখানে বেসামরিক জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের সংঘটিত নৃশংসতার কাহিনী বর্ণনা করে। চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে একটি গ্রামে মাতি দিয়ে বানানো কিছু ঘরে সেনারা কয়েকটি মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়ে অনেক মানুষ ও শিশুদের হত্যা করে। শহরেও তারা অনেক মানুষ হত্যা করে। একটি দোকানে প্রায় পনের জন মানুষ খাদ্য কেনার ছিল দাঁড়িয়ে দিল। সৈন্যরা তাদের সবাইকে বাইরে আসতে আদেশ দেয় এবং লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তাদের একজন জীবিত ছিল – সে দুইটি বুলেটবিদ্ধ ছিল। অন্য সবাই নিহত হয়। ডেনিশ ছাত্র বলল যে ৩১ মার্চ থেকে পরবর্তি ৩ দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা এবং ঢাকা রোড বরাবর সব কিছু জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জাহাজের একজন অফিসার ছাত্রটিকে বলেছিল কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ৪০০ লাশ ভাসছিল।
চট্টগ্রামের একটি পাটকল ম্যানেজার জানান যে তার সব কর্মচারীকে মেরে ফেলা হয়েছে। পিটাসবার্গের একজন প্রকৌশলী যিনি চট্টগ্রামে ছিলেন তিনি জানান যে সেনারা মানুষকে বেঁধে গুলি করে হত্যা করছিল। তাদের কোন প্রশ্ন করা হচ্ছিল না। যদি কেউ দৌড়াতে শুরু করে তাহলে তাদের কুকুরের মোট পেছন দিক থেকে গুলি করে মারা হচ্ছিল। প্রকৌশলী বলেন, হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হচ্ছিল। যদি তারা কোন মানুষকে না পায় তখন তারা বাড়িগুলোর জানালার দিকে মর্টার নিক্ষেপ করছিল। মৃত শত শত শিশুদের লাশ পরে ছিল। ওই মৃতদেহগুলি রাস্তায় জমে উঁচু হয়ে ছিল এবং পচছিল।
এমনকি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী রাস্তা ব্যারিকেড দেবার জন্য লাশগুলোকে ব্যাবহার করছিল।
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর হত্যাকাণ্ড ও গ্রাম ও শহরাঞ্চলে পরে থাকা লাশ নাৎসি নৃশংসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনকি শিলাইদহে যেখানে কবি রবীন্দ্রনাথ তার অধিকাংশ সৃষ্টিশীল সময় অতিবাহিত করেছিলেন সেটাও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। তারা খাদ্য গুদাম এবং গ্রেনারি লুটপাট করছিল এবং পার্শবর্তি ফসল রাসায়নিক দিয়ে জ্বালিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছিল যাতে করে ভবিষ্যতেও এখানে কোন ফসল না হয়।
পাকিস্তানি সেনারা নারীদের শ্লীলতাহানি করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক তরুণী মেয়েদের জোর করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়েছিল। এমনকি বাঙ্গালী সেনাদের স্ত্রী ও কন্যাদের অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান কিভাবে কুমিল্লা-চাঁদপুর রোডে এক গ্রামের সব নারীকে স্ট্রিপ করে সামনে আগন্তুক একটি ট্রাকের সামনে মিছিল করে এগিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। এরা সবাই হয় গুলিতে অথবা ট্রাকের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়।
সৈন্যরা নির্দোষ, বিশ্বাসপ্রবণ লোকদের উপর নারকীয তামাশা করছিল। বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে মানুষকে আসতে বলছিল এবং তাদের মাসিক বেতন সংগ্রহ করতে বলছিল। মানুষ সরল বিশ্বাসে সেখানে গেলেই তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছিল। অন্য এক জায়গায় মানুষকে এসে দোকান থেকে তাদের রেশন সংগ্রহ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাদের নিশ্চিত করা হয় যে তাদের কোন ক্ষতি করা হবেনা। কিন্তু যখন মানুষ দোকানে আসে তখন সৈন্যরা ওপেন ফায়ার করে একশো জনকে হত্যা করে।
একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর ডায়েরী কলকাতা ডেইলিতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যায় বিদেশীরাও সৈন্যদের থেকে রক্ষা পায়নি। তিন ব্রিটিশ কে একটি সেনা ইউনিট ২৯ মার্চ গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যায় – তারা পুরোনো ঢাকায় সেন্ট থমাস চার্চ এর উপর বোমাবর্ষণ এর ছবি তুলেছিল। তাদের একজন ব্রিটিশ কাউন্সিল এর নিযুক্ত অফিসার ছিলেন এবং অন্য দুই জন ব্রিটিশ পরিচর্যা সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক সদস্য ছিলেন। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী এটা আমেরিকান কনস্যুলেটদের জানালে একজন মার্কিন কর্মকর্তাকে ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়। তিনি গিয়ে দেখেন যে ঐ তিন ব্রিটিশকে ফায়ারিং স্কোয়াডে লাইন ধরিয়ে দাড় করানো হয়েছে মেরে ফেলার জন্য। শুধুমাত্র সময়মত যাবার কারণে তারা প্রাণে রক্ষা পায়। এমনকি পাকিস্তান সরকার ঢাকায় উড়ে আসা একটি রেড ক্রস বিমানকে প্রবেশ করার অনুমতি দেয় নাই। ২ দিন ধরে করাচীতে রিলিফ নিয়ে অপেক্ষা করার পরে সেটা ফেরত চলে যায়।
পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা সংঘটিত নিষ্ঠুরতার ভয়ানক বর্ণনা দেয়া কোন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া বিক্ষিপ্ত প্রতিবেদন থেকে যথেষ্ট ভালো ভাবেই বোঝা যায় অবস্থা কি ভয়াবহ ছিল। আতঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড এখনও অব্যাহত আছে – তবুও মানুষ বীরত্বের সাথে প্রতিরোধের চালিয়ে যাচ্ছে। বর্বরদের কাছ থেকে এই সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য আর কত বাংলাদেশীকে প্রাণ দিতে হবে কে জানে।
বাংলাদেশের জনগণের এই দুর্ভোগের মধ্যে আমরা মানবতার বিবেকের কাছে আপীল করছি। বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামে সাহায্য করুন, জনগণের সরকারকে সাহায্য করুন, লাখো কণ্ঠে প্রতিবাদ জানান, গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসুন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রক্ষার পথে এগিয়ে আসুন।
(উৎস:
১। মোঃ আনিসুর রহমান, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, এ প্রবলেম ইন দ্যা পলিটিকাল ইকোনমি অব রিজিওনাল প্ল্যানিং, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর ইন্টেরন্যাশনাল এফেয়ার্স, জুলাই, ১৯৬৮;
২। গুনার ম্যরডাল, এশিয়ান ড্রামা, ভলিউম ১, এলেন লেন সয়া পেঙ্গুইনে প্রেস, লন্ডন, ১৯৬৮
৩। দ্যা স্টেটসম্যান – কলিকাতা
কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
সেক্রেটারির রিপোর্ট
কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। এখানে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র, কর্মকর্তা ও শিক্ষক, কর্মচারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহের শিক্ষক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সংস্থার সদস্যরা। কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ সেন, ভাইস-চ্যান্সেলর, সহসভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ছিলেন প্রফেসর পি কে বসু, একাডেমিক বিষয়ক প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর, এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন শ্রী হিরেন্দ্রমোহন মজুমদার, ব্যবসা এবং অর্থনিতি বিষয়ক প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর।
প্রাথমিকভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া ৫০০০ রুপি হল এই কমিটির কেন্দ্রীয় তহবিল। এবং এই কমিটি অতিসত্বর কার্যক্রম শুরু করে।
জন্মলগ্ন থেকেই এই কমিটি উদ্বাস্তুদের সহায়তা শুরু করে। এছাড়া খাবার প্যাকেট থেকে ঔষধ এবং ফার্স্ট এইড সরঞ্জাম দেয়া হয়। প্রচুর উদ্বাস্তু প্রবেশ করার জন্য – যার সংখ্যা ইতোমধ্যে ১৫ লাখে পৌঁছেছে – আমাদের এই ক্ষেত্রে আরও কয়েক হাজার রুপি ও শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। শ্রী বিনা ভৌমিক (বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী) আরও কয়েকজনের সহায়তায় একটি ছোট্ট দলে এই বিষয়ে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাদের হাত লাগিয়েছে।
আমাদের প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলকে ৫ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে টেলিগ্রাম দিয়েছেন। টেলিগ্রামে আমাদের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলকে বাংলাদেশের উপর মারাত্মক আক্রমণ এবং ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস ও সেখানকার শিক্ষক ও ছাত্রদের উপর পরিচালিত গণহত্যার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষন করেন। এছাড়া তিনি পাকবাহিনী যে গণহত্যা চালাচ্ছে সে ব্যপারে জানান। মহাপরিচালক টেলিগ্রাফের প্রাপ্তি স্বীকার করে গণহত্যার শিকারদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীও টেলিগ্রামের প্রাপ্তিস্বীকার করেন।
আমাদের একটি লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব শিক্ষক ও ছাত্র ভারতে এসেছেন তাদের সাহায্য করা। আমরা তাদের অস্থায়ী আর্থিক সহায়তা দেব এবং একটি রেজিস্টার খুলব। স্নাতকোত্তর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ডঃ অনিরুদ্ধ রায়, পোস্ট-গ্রাজুয়েট কমার্স এর শ্রী অনিল সরকার ও শ্রী পীযুষ দাশ, শ্রী অংশুমান মল্লিক, ও শ্রী অনিল বসু এই বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ভিজিটিং অধ্যাপকের/লেকচারশিপের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এই প্রকল্প সমগ্র ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা যেতে পারে। প্রকল্প ইতিমধ্যে লিখিত আকারে বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করি এতে করে কিছু ফল হবে।
এর পাশাপাশি আমরা বাংলায় শেখ মুজিবের ছয় দফা কর্মসূচি নিয়ে একটি প্রকাশনা করতে চাচ্ছি। শ্রী অজিত মোহন গুপ্ত (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র) এই বিষয়টি দেখছেন। ভারত প্রোটোটাইপ স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী শ্রী স্বরাজ ভট্টাচার্য, চিত্রাঙ্গদার স্টাফ ফটোগ্রাফার আমাদের অনেক মূল্যবান ফোটোগ্রাফ দিয়ে সাহায্য করেছেন।
আমাদের সভাপতি সমিতির তহবিলে উদার অনুদানের জন্য সবাইকে – বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদের কাছে (বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায়) লিখিত আবেদন করেছেন। খুব উতসাহজনক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম যিনি দান করেছেন তিনি আমাদের জাতীয় অধ্যাপক শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। অন্যরা যারা দ্রুত দান করেছেন তাদের মধ্যে আছে কৃষ্ণনগরের উইমেন্স কলেজ, সরোজিনী নাইডূ কলেজ, উইমেন্স কলেজ, কলকাতা লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ, বেথুন স্কুল, ড, বি সি রয় মেডিসিন ইনস্টিটিউট এর শিক্ষক ও কর্মকর্তা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর বিভাগের ৬১ জন শিক্ষক, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, মডার্ন হিস্টোরি, ও ইংরেজি বিভাগ, ভারত চ্যারিটি ট্রাস্টের এন এল তোদি, মেসার্স প্রেস এজেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, মেসার্স এলাইড এজেন্সি, পাস্তুর গবেষণাগারের স্টাফ, সিদ্ধেসর হেসারি কারখানা, গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস কলেজ, উমেশচন্দ্র কলেজ, বাংলাদেশ এইড কমিটি, বোম্বে শ্রী এইচ পি. লোহিয়া, অ্যাংলো-ভারত জুট মিল (কর্মকর্তা ও শ্রমিক), শ্রী অজিত কুমার দত্ত, সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, অধ্যক্ষ মমতা আশিকারি ও সর্বস্তরের আরও অনেকে। ফ্রি ঔষধ সংগ্রহ করেছেন শ্রী উৎপল চৌধুরী ও এস এম সোমা চ্যাটার্জি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ছাত্র সমিতির পক্ষ থেকে তহবিল সংগ্রহ করছে। আমরা আশা করি দাতাদের সংখ্যা দৈনন্দিন বাড়তে থাকবে যাতে করে আমরা আমাদের কাজ মোকাবেলা করতে পারি।
অধ্যাপক জেইনদের পত্রনবিস, যতীন চ্যাটার্জি, দীপক হাজরা এবং পি সেন শর্মা কার্যালয়ের সার্বিক দায়িত্বে আছেন। সমিতির অফিস, দ্বারভাঙ্গা ভবনের দ্বিতীয় তলায় সকাল ১১ টা থেকে ৫-৩০ টা পর্যন্ত এবং বিধান সরণির দ্বিতীয় তলায় সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
আমাদের কাজগুলো শেষ করতে তহবিল প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও শিক্ষক ভাইস-চ্যান্সেলর এর তহবিল থেকে কিছু সময়ের জন্য মাসিক অবদান রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা অন্যদের কাছেও উদাত্ত আহ্বান জানাই। চেক পাঠাতে পারবেন – কোষাধ্যক্ষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি – এই ঠিকানায়।
৯ মে, ১৯৭১
ডি কে চক্রবর্তি
সেক্রেটারি
কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের আজকের এই সংগ্রাম। অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বন্দুক, বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধ করা যাবেনা। কেনোনা জনতা আর ঐক্যবদ্ধ।
লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায় সঙ্গত। তাই আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত।
জয় বাংলা।
শেখ মুজিবুর রহমান
১৯/০৩/১৯৭১
(শেখ মুজিবুরের ভাষণের ইংরেজি ভার্শন ৩৫ পাতায়)
প্রকাশক – প্রফেসর দিলিপ চক্রবর্তি, সেক্ররটারি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি, সিনেট হাউজ, ধারভাঙ্গা বিল্ডিং, কলিকাতা- ১২
প্রিন্টেড বাই – জনাব অজিত মোহন গুপ্ত, ভারত প্রোটোটাইপ স্টুডিও, ৭১/১ কলেজ স্ট্রিট, কলিকাতা – ১২
দাম – — রুপি মাত্র