বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তর এলাকা মুক্তিফৌজের দখলে
ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলা শহরগুলির ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ও বঙ্গপসাগরের উপকুলবর্তী সামরিক ঘাঁটিগুলি ছাড়া বাংলাদেশেল সব এলাকা পাক সামরিক শাসনের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, শহর ও জনদে উড়ছে স্বাধীন বাংলার জয় পতাকা। দলে দলে পাঠান সৈন্য আত্নসমর্পন করেছে, অনেকে মুক্তিসেনাদের তাড়া খেয়ে শূণ্য হাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আত্মসমর্পন করেছে।
কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর একে একে মুক্তিফৌজের দখলে চলে আসছে। তবে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে পাকফৌজের আক্রমণ বন্ধ হয়নি এবং ঐ আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য স্বাধীন বাঙলা সরকার সারা বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় দেশ ও জাতিগুলির কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে।
সীমান্ত শহর হাসনাবাদ থেকে ইউ-এন-আই জানাচ্ছেন, গত রাত্রে যশোর জেলার মাগুরায় প্রায় ৩৫০ জন পাক-সৈন্য বিনা যুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে।
সৈন্য দলটি ১৩টি গাড়ী যোগে যশোর অভিমুখে যাওয়া সময় মুক্তিফৌজের বহু লোক ও আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক তাদের ঘিরে ধরে।
চারদিন তীব্র যুদ্ধ চলার পর গতকাল পাক-সৈন্যদল ক্যান্টনমেন্টে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলে যশোর শহর মুক্তিযোদ্ধাদের করতলগত হয়।
কৃষ্ণনগর (নদীয়া) থেকে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, রাজশাহীতে এখনও যুদ্ধ চলছে। এখানে দুইজন মেজর সহ অন্তত একশ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। প্রকাশ, এই এলাকায় মুক্তিফৌজের পরিচালনা করছেন বেঙ্গল রেজিমেন্টর একজন কর্ণেল। জানা গেছে, তারা শতাধিক রাইফেল শত্রুদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
রাজশাহী ও লালমনিরহাটে এখন তীব্র লড়াই চলছে। গত কয়েকদিন ধরে এই দুইটি অঞ্চল পাক সৈন্যদের দখলে আছে।
এক সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম পাকিস্তান রেজিমেন্টর অধিকাংশ সৈন্যই প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজের কাছে আত্নসমর্পণ করেছে।
আবার বোমাবর্ষণঃ মুক্তিফৌজের করতলগত ছোট ছোট শহরগুলি পূনর্দখলের জন্য পাক-সৈন্যরা তৎপর হয়ে উঠেছে। আজ বিকেলে পাক বিমান বাহিনী আবার বাংলাদেশের কয়েক স্থানে বোমা বর্ষণ করেছে। এইসব স্থানের নাম পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুর।
সীমান্ত অঞ্চল থেকৈ এখানে প্রাপ্ত প্রকাশ, পাকিস্তানী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরারবর মোতায়েনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিমানযোগে আধা-সামরিক বাহিনী (সীমান্ত স্কাউট ও সেঞ্জার্স) আমদানী করেছে। মুক্তিফৌজ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলস্মন করায় পাকিস্তানী তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রচুর গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্য আমদানীর কথা বিবেচনা করছে।
পাক-সৈন্যদের আত্মসমর্পণঃ রায়গঞ্জ (পঃ দিনাজপুর), ২রা এপ্রিল-সীমান্তের অপর পার থেকৈ গতকাল নির্ভরযোগ্য সূত্রে এখানে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের মু্ক্তিযোদ্ধারা এখন দিনাজপুর, রংপুর, বগুলা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট সম্পূর্ণভাবে নিজ দখলে রেখে। ঐসব স্থানে পাক-সৈন্যরা বিনাশর্তে অত্নসমর্পণ করেছে এবং ঢাকা ও রাজশাহীতে এখনও তীব্র যুদ্ধ চলছে বলে ঐ সূত্র থেকে বলা হয়েছে।
পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে গতকাল প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, পাক-সৈন্যরা ৩১শে মার্চ সন্ধায় দিনাজপুর শহরে নিউ টাউন ও রাজবাড়ীতে পরাজিত হয়েছে। দিনাজপুর ও ফুলবারায় সৈয়দপুর থেকে যে সমস্ত পাক-সৈন্য এসেছি, তারা হয় নিহত নয়তো বন্দী হয়েছে। রাজশাহী জেলায় চাপাইনবাবগঞ্জে যেসন সৈন্য পাঠানো হয়েছিল, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত নয়তো বন্দী হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট শহরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে এবং পাক সৈন্যরা সেখানে আত্নসমর্পণ করছে।
মৌলভীবাজারে ১৪০ জন পাক সৈন্য নিহতঃ আগরতলা থেকৈ প্রাপ্ত খবরে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট জেলার মহকুমা সদর মৌলভীবাজারে যুদ্ধ চলছে এবং এখানে ১৪০ জন পাক-সৈন্য নিহত হয়েছে। শহরটি এখও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যদের সাহায্য আরও সৈন্য প্রেরণের চেষ্টা চলছে। সৈন্যরা চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে।
রংপুরে তুমুল লড়াইঃ শিলিগুড়ি, ৩রা এপ্রিল-সৈয়দপুর, পার্বতীপুর ও রংপুর পাক-সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই চলছে। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর এই ২৪ মাইল এলাকায় অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে। রংপুরের পাঁচ মাইলের মধ্যে কোন জনবসতি আছে বলে মনে হয়না। মুক্তিযোদ্ধারা এদিন একশো পাকসেনাকে খতম করে দিয়েছে। ক্যাপ্টন নওয়াজেশের নেতৃত্বে ওরা লড়াই করছেন। এখানে ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের এক হাজার নতুন লোক এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
কয়েদী মুক্তিঃ মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুর জেলাটি মুক্ত করে দিয়েছে। এখানকার কয়েদীরা বেরিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। এদের মধ্যে দুজন ভারতীয় ছিল। এরা ভারতে পালিয়ে এসেছে বলে জনরব।
-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪এপ্রিল, ১৯৭১