You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ প্রায় পুরোই মুক্তিফৌজের কব্জায়

আগরতলা, ৩০ শে মার্চ (পিটিআই/ইএন আই) – পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে শ্রীহট্ট পর্যন্ত সমগ্র এলাকাটি বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কর্তৃক অধিকৃত হয়েচে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই সংবাদটি আজ সকালে জানা যায়। এখানে শ্রুত এই বেতার ঘোষণায় বলা হয় যে, সমগ্র এলাকায় এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।

বাঙলার রাজধানী ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চল শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে আসায় পাকবাহিনী সর্বত্র পশ্চাদপসরণ করছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার দাবী জানিয়েছে। ঢাকার আশেপাশে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে। অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ বেতারে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে তাঁদের সাফল্য প্রত্যক্ষ করার জন্য আহবার জানিয়েছে।

মুক্তিফৌজ ঢাকা দখলের পর অবশিষ্ট হানাদারদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়ছেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানঘাঁটি দখলের জন্য তীব্র লড়াই চলছে। পাক-বাহিনী ঢাকার উপকন্ঠে বোমাবর্ষণ করছে।

চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বন্দর আর এখন ব্যবহার করা যাবে না বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, শ্রীহট্ট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ প্রভৃতি মুক্তিফৌজের পূর্ণ দখলে রয়েছে। বরিশাল, পাবনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বজেলা ফরিপুরের কোন খবর পাওয়া যায়ন। মুক্তিফৌজ এখন বাংলা জলপথও সম্পূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে এনেছেন। মুক্তিফৌজ প্রথম হানাদারদের উপর মর্টার ব্যবহার করেছেন বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ঘোষণা করেছে মুক্তিফৌজ ঢাকা শহর দখল করে নিয়েছে।

বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ ঘোষণা করেন যে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ স্থান এখন তাঁর মুক্তিফৌজের দখলে রয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ তথা বিশ্ববাসীকে তা দেখে যাবার জন্য তিনি আমন্ত্রন জানিয়েছেন। ছয়টি বেতার কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি এখন মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন মৃত্যুভয়ে পালাচ্ছে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলা ভাষায় এক বিশেষ ঘোষণায় তিনি বলেন যে, মুক্তিফৌজ বিপুল সংখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থান এখন তাদের নিয়স্ত্রণে রয়েছে।

পাকিস্তান রেডিওর প্রচারণাকে মেজর জিয়া ডাহা মিথ্যা কথা বলে বর্ণনা করেন। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত দশজন পাঠান গতকাল সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিম দিনাজপুরের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী পাহিনী কাছে আত্নসমর্পণ করেছে।

চট্টগ্রাম জ্বলছেঃ চট্টগ্রাম শহর জ্বলছে। মুক্তিফৌজ সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে হাতে লড়াই করছেন। বন্দরণগরী চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ট্যাংক ব্যবহার করছে।

শহরের প্রধান অংশ এখন মুজিবের বাহিনীর হাতে রয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামে বিমান থেকে সৈন্য নামান হয়েছে। জাহাজ থেকে আজও গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। এই বন্দর শহরে এখন প্রবল লড়াই চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে, বন্দরটিকে ব্যবহারযোগ্য করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

দিনাজপুরে প্রবল লড়াইঃ রাধিকারপুর থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, রবিবার সারারাত ধরে দিনাজপুর শহর এবং সংলগ্ন গ্রামগুলোতে প্রবল লড়াই চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। বোমা ও মেশিনগানের শব্দে রাধিকাপুর ও সংলগ্ন গ্রামের জনসাধারণকে বিনিন্দ্র রাজনী যাপন করতে হয়েছে।

রাজশাহী ও খুলনাঃ রাজশাহী ও খুলনাতে কয়েক কোম্পানী পাকিস্তানী সৈন্য বিমানে নামানো হয়েছে। রাজশাহীতে মুক্তিফৌজের প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।

উভয় স্থানে মুক্তিফৌজ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। একটি মাত্র স্থানে স্থানে বিদেশী সৈন্যরা সীমাবদ্ধ ছিল। রাজশাহীর গোদাগাড়ি ঘাট পর্যন্ত এখন মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রনে আছে। তাঁরা রাইফেল বাহিনীর সদর দপ্তর পুনরায় দখল করেছেন।

আজ সকালে উপরোক্ত স্থানে পুনরায় সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলের ও পুলিশের সাহায্যে শেখ মুজিব বাহিনীর লড়াই অব্যাহত রয়েছে। খুলনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে পাক-সৈন্যরা ধ্বংস করেছে।

ক্যান্টেনমেন্ট দখলের চেষ্টাঃ কুমিল্লা ও যশোহর ক্যান্টনমেন্ট দখলের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য মার্কিন স্যাবর জেট থেকে বোমাবর্ষণ করছে বলে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও মুক্তফৌজ এই ক্যান্টনমেন্ট দুটিকে দখলে রেখেছেন।

ঢাকাতে তীব্র সংঘর্ষঃ ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে এবং ক্যান্টনমেন্ট বিমানবন্দর এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও মুক্তিফৌজের মধ্যে প্রবল লড়াই চলছে। পরে ঢাকা শঞর মুক্তিফৌজ দখল করেছেন বলে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র ঘোষণা করেছেন।

কৃষ্ণনগর থেকে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, ঢাকা কর্পোরেশন অফিস এখন মুক্তিফৌজের দখলে। প্রশাসক মেজর এস এ খান নিহত।

মুর্শিদাবাদ জেলার ভারতীয় সীমান্ত গ্রাম ভাগবানগোলার বিপরীত দিকে পাক-সীমান্ত প্রহরারত ২০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী প্রহরী মুক্তিফৌজের হাতে নিহত হয়েছে।

রাতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধঃ নদীমাতৃক পূর্ববাংলার জলপথে রাত্রে নৌকা চলাচলে নিষিদ্ধ করে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম সরকার’ এক নির্দেশ জারী করেছেন।

মুক্তিফৌজের আক্রমণে বিছিন্ন ও পর্যুদস্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা যাতে পালাতে না পারে তার জন্যই এ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে।

রংপুরঃ সমগ্র রংপুর শহর মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রংপুর-কোচবিহার এলাকার পাকিস্তানী রাইফেলের টহন মুক্তিফৌজের নির্দেশ বন্ধ করা হয়েছে।

আখাউড়াঃ আখাউড়াতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ছয়জন অফিসার নিহত হয়েছেন। সেখানকার আশেপাশে এখনও যুদ্ধ চলেছে।

করাচীর ভাষ্যঃ করাচীর সরকারী সূত্রে বলা হয়েছে যে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে মাঝে মাঝে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় আছেন সে সম্পর্কে আজ কিছুই বলা হয়নি। পাকিস্তান রেডিও থেকে পূর্ববঙ্গের অবস্থাকে ‘সম্পূর্ণ শান্ত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

-যুগান্তর, ৩১ মার্চ, ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!