You dont have javascript enabled! Please enable it! খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব

খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হয়ে গেলেও ছাত্ররা প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে নিবৃত্ত হয়নি। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত তারা গোপনে নানা জায়গায় পজিশন নিয়ে পাক সৈন্যদের উপর ইতস্তত চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এভাবে তারা বেশ কয়েকজন সৈন্যকে হত্যা ও জখম করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু একথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই গুপ্ত আক্রমণ চালাবার কালে কোনো ছাত্র মারা যায়নি বা শত্রুর হাতে ধরা পড়েনি।

২৮শে মার্চের যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তাই বলে তারা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেননি। শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য তারা বাগেরহাটে গিয়ে মিলিত হলো। বাগেরহাটে প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল ইপিআর ও পুলিশের লোকদের নিয়ে এক মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। খুলনা থেকে যারা বাগেরহাটে গিয়েছিলো তারা মেজর জলিলের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলো। ফেলে এদের সংখ্যা দাড়ালো সাতশত। মেজর জলিল কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করা যায় সেই পরিকল্পনা রচনা করে চলেছেন।

খুলনা শহর শত্রুপক্ষের অধিকারে থাকলেও সেখানকার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী শত্রুদের দৃষ্টির আড়ালে গোপনে কাজ করে চলছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাদের প্রাণপ্রিয় শহরটিকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবেন, এই আশা বা পরিকল্পনা তাদের ছিলো না। তবুও শত্রুপক্ষকে অতিষ্ঠ করে তোলবার জন্য এবং প্রচারকাজে সুযোগ লাভের জন্য আরো একটা ঘা মারবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এটিকে খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব বলা চলে। শত্রু অধিকৃত শহরের বুকের উপর দাড়িয়ে যে নতুন আক্রমণ চালানো হয়েছিলো তা থেকে তাদের দুঃসাহস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়।

জনৈক সুপরিচিত স্থানীয় নেতা এই পরিকল্পনাটি রচনা করেন এবং তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেন। তিনি খুলনা শহর থেকে চলে গেলেন বাগেরহাটে। তারপর সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে তার এই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে পরামর্শ করলেন। মেজর জলিল তার এই পরিকল্পনাকে অনুমোদন ও সমর্থন করার পর তার বাহিনী থেকে ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।

এই মুক্তিযোদ্ধারা রাত্রির অন্ধকারে অতি সঙ্গোপনে খুলনা শহরে এসে প্রবেশ করলেন। পাক সৈন্যবাহিনীর কর্তারা এমন যে ঘটতে পারে সে কথা কল্পনাও করতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েই এই দুঃসাহসিক কাজে পা বাড়িয়েছিলো। গভীর রাত্রিতে তারা শহরের বেতার ঘাঁটি আক্রমণ করলো। তারা স্থায়ীভাবে বেতার ঘাঁটি নিজেদের দখলে রাখতে পারবে এই দুরাশা তাদের ছিলো না। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো একটি দিনের জন্য হলেও তারা এটাকে নিজেদের দখলে রাখবে এবং এর মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বাধীন বাংলার বাণী ছড়িয়ে দিবে।

সে সময় আঠারো জন পাক সৈন্য বেতার ঘাঁটি পাহারা দিচ্ছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের আঠারো জনকেই খতম করলো। পাহারাদার পাক সৈন্যরা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নিজেরাই গুলি চালিয়ে বেতার ঘাঁটির ট্রান্সমিটারগুলিকে নষ্ট করে দিয়েছিলো। ফলে বেতার ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এলো বটে, কিন্তু এটা তাদের কাজে লাগাতে পারলো না। বেতার ঘাঁটি দখল করার ফলে তাদের হাতে একটা মেশিনগান, ছয়টা গ্রেনেড এবং আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র এসে গিয়েছিলো।

রাতটা কেটে গেলো। ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুপক্ষকে মোকাবিলা করার জন্য শহরের এক প্রান্তে প্রতিরোধ ঘাঁটি তৈরী করে অপেক্ষা করছিলো। এই শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে বা হটিয়ে দিতে পারবে না একথা তারা ভালোভাবেই জানতো। কিন্তু যাবার আগে তাদের একটু শিক্ষা দিয়ে যেতে হবে।

সকাল হতে না হতেই পাক সৈন্যবাহিনী তাদের আক্রমণ করবার জন্য দ্রুত এগিয়ে এলো। প্রথমে তিন লরী বোঝাই সৈন্য, তারপর কতগুলি খালি গাড়ী এবং অবশিষ্ট সৈন্যরা মার্চ করে আসছে। ওরা নাগালের মধ্যে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি লরীকে লক্ষ্য করে ছ’টি গ্রেনেড ছুঁড়লো। এই গ্রেনেডগুলিকে তারা বেতার ঘাঁটিতে পেয়েছিলো। অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রেনেড। গ্রেনেড ছোড়ার ফলে তিনটি লরী বোঝাই সৈন্য লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো।

এই মারাত্মক দুর্ঘটনার ফলে তাদের পিছনে যে সৈন্যরা আসছিলো তারা থমকে দাড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার পর ওরা বুঝতে পারলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আর গ্রেনেড নেই। এবার নিশ্চিন্ত মনে এগোনো যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় এদের সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশী। তাদের হাতে মাত্র একটি মেশিনগান। বাকী সবই রাইফেল। এই অবস্থায় দু’পক্ষে বেশীক্ষণ লড়াই চলতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আশাতীত সাফল্যের পরে খুবই খুশি হয়েছিলো। এবার তারা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দ্রুত সরে পড়ার চেষ্টা করলো। পাক সৈন্যরা তাদের এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তাদের খতম করে দেবার জন্য দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হলো। তাদের একটা অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ কাটিয়ে তাদের ঘেরাও করে ফেলবার চেষ্টা করছিলো। মুক্তিবাহিনীর নেতা বুঝতে পারলেন তারা এক ভীষণ সংকটজনক অবস্থায় এসে পড়েছেন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে গাড়ী আছে। আর তাদের ছুটতে হবে পায়ের উপর নির্ভর করে। এই অবস্থায় এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজ কথা নয়। যদি বাঁচতে হয় তবে নতুন কৌশল অবলম্বল করতে হবে। কিছু সংখ্যক লোকের মায়া ছেড়ে দিয়ে সবাইকে বাঁচতে হবে।

দু’পক্ষের মাঝখানে তখনো কিছুটা ব্যবধান ছিলো। নেতা নির্দেশ দিলেন, কয়েকজনকে প্রাণের মায়া ছেড়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। বাকী সবাই যতক্ষণ নিরাপদে পালিয়ে যেতে না পারে ততক্ষণ এরা যতই বিপদ ঘটুক না কেনো পিছনে হটবে না। সামনে দাড়িয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে হবে। এর নাম সুইসাইড স্কোয়াড। এভাবে আত্মবলি দিতে প্রস্তুত আছে কারা? নেতা আহবান জানালেন। একটু সময় সবাই চুপ করে রইলো। তারপর সামনে এগিয়ে এলো ছয়জন। নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আর সকলকে আত্মরক্ষার সুযোগ করে দেবে।

এই রণকৌশল সার্থক হলো। সেদিনকার সেই ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে শত্রুদের হাতে ধরা পড়লো। বাকী সবাই নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করে চলে এলো। এভাবেই খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটলো।