সশস্ত্র প্রতিরোধে বরিশাল
সাক্ষাৎকার- মেজর মেহেদী আলী ইমাম
(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত)
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আমি আমার বাড়ী মঠবাড়িয়ার দাউদখালীতে ছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের সমস্ত পরিস্থিতি আমি রেডিও থেকে শুনতাম। সব সময় আশংকার মধ্যে ছিলাম যে, পাকসেনারা কখন আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই চলে এলো ২৫শে মার্চের কালরাত্রি। রেডিও ও অন্যান্য খবর মারফত বুঝতে পারলাম ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় পাক মিলিটারীরা নিরীহ জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি এসব খবর শোনার পর ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়া থেকে লঞ্চযোগে বরিশালের পথে রওয়ানা হলাম।
২৭শে মার্চ সকাল ১০-১১টায় বরিশাল শহরে পৌঁছলাম। বরিশাল শহর তখন গরম। শহরের ছেলেরা রাইফেল, লাঠি, বল্লম এবং অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে বরিশাল শহর পাহারা দিচ্ছিলো। লোকমুখে জানতে পারলাম মেজর জলিল নামে একজন এখানে এসেছেন এবং স্থানীয় এমসিএ নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায় কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। এবং এখানেই আছেন মেজর জলিল। আমি এ খবর পেয়ে বেলা ১২টার সময় নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায় গেলাম। সেখানে অত্যন্ত ভীড়। ভীড় ঠেলে ভিতরে গেলাম। সেখানে মঞ্জুর ভাই, মেজর জলিল, স্থানীয় এমসিএ আমু ভাই, শামসু মিয়া, মহিউদ্দিন ভাই, বারেক (এরা সকলে এমসিএ ছিলেন) এবং আরো অনেক স্থানীয় ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন। সবাই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন এবং এ পরিস্থিতিতে কি করা যায় তা ভাবছিলেন। আমি মেজর জলিল, মঞ্জুর ভাই এবং অন্যান্যদের সাথে দেখা করলাম। মেজর জলিলের সঙ্গে আমার আগে আলাপ ছিলো না। তিনি আমার সম্পর্কে প্রথমে খোজ খবর নিলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন থানা দখল করে নেবার জন্য।
২৭শে মার্চ রাতে আমরা প্রতিটি থানাতে অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠালাম যেসব বাঙালি সৈনিকরা ছুটিতে আছেন তাদের পাঠিয়ে দেবার জন্য এবং মুজাহিদ, আনসার, উৎসাহী যুবক, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের বরিশালে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলাম এবং আসতে না পারলে সেখানেই ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে বলা হলো। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ট্রেনিং-এর জন্য দিতে বলা হলো। প্রতিটি থানা আমাদের নির্দেশ জেনে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো। আমরা মেজর জলিলের নির্দেশে জায়গায় জায়গায় যুবকদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করলাম।
২৭শে মার্চের রাতে নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাড়ীতে সব আওয়ামী লীগ নেতা ও অন্যান্য দলের নেতাদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। মেজর জলিলকে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক করে কাজ শুরু করে দিলাম। দক্ষিণাঞ্চলের এলাকা বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা নিয়ে গঠিত ছিলো। এসপি’দের নির্দেশ দেয়া হলো সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাতে দিয়ে দেবার জন্য। এসপি’রা নির্দেশ মেনে নিয়ে সমস্ত অস্ত্র আমাদের হাতে তুলে দেন।
সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করা হয়। খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি গ্রুপ গঠন করা হয়, যাদের কাজ ছিলো সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য খাবার জোগাড় করে দেয়া। ট্রান্সপোর্টগুলি আমাদের কাজের জন্য নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বেসামরিক শাসনকার্য পরিচালনার জন্যও একটি পরিষদ গঠন করা হয়। ডেপুটি কমিশনার নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও অন্যান্যদের নিয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। এছাড়া বরিশাল শহরের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এগুলি ছিলো, বেলস পার্ক, সদর গার্লস হাই স্কুল, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী (কমান্ডো ট্রেনিং-এর জন্য), মাধবপুর ও প্তাপপুর। অন্যান্য থানাগুলোতেও এরূপ অনেক ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এসব কেন্দ্রে হাজার হাজার যুবক দেশকে মুক্ত করার জন্য ট্রেনিং নিতে শুরু করে। বেলস পার্কে সর্ববৃহৎ ট্রেনিং কেন্দ্র ছিলো। এখানে হাজার হাজার যুবক ট্রেনিং নিতর থাকে এবং এদের অনেককে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়। আমি সমস্ত ট্রেনিং কেন্দ্রের উপর নজর রাখতাম। ক্যাপ্টেন হুদা মেজর জলিলের সাথে থাকতেন এবং অন্যান্য দিকগুলির উপর নজর রাখতেন।
অয়ারলেসের মাধ্যমে আমরা পূর্বেই চাঁদপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট ইত্যাদি স্থানে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। চাঁদপুর থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠালেন, পাকসেনা যেকোনো মুহুর্তে চাঁদপুর আক্রমণ করতে পারে। তিনি আমাদের কিছু লোক পাঠাতে বললেন। মেজর জলিলের নির্দেশে আমি প্রায় ১০০ যুবককে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ চাঁদপুরে পাঠিয়ে দিলাম। ফরিদপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও আমি প্রায় এক হাজার জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে শত্রুর আক্রমণ রুখতে পাঠিয়ে দিলাম। এছাড়াও বিভিন্ন থানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরো ৫০০ জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সহ শত্রুদের রুখবার জন্য পাঠিয়ে দেই। বজ্রমোহন কলেজের কেমিস্ট্রির একজন অধ্যাপক এবং বিঞ্জান বিভাগ ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় আমরা হ্যাণ্ড গ্রেনেড, মলেটিভ ককটেল ইত্যাদি হাতবোমা তৈরী করতে শুরু করে দিলাম এবং এগুলি বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিলাম। বরিশাল-পটুয়াখালী যেহেতু নদী প্রধান ছিলো সেহেতু শত্রুরা গানবোট নিয়ে আমাদের আক্রমণ করবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। তাই গানবোট ধ্বংস করার জন্য ‘রকেট’ ধরনের বোমা তৈরী করার চেষ্টা করি। এতে কিছুটা সফল হলেও আমরা তা কার্যকর করতে পারিনি।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের প্রবল চাপের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে শুরু করেছে। পাকসেনাদের তুলনায় আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিলো খুবই কম। সেজন্য অন্য কোথাও থেকে অস্ত্র যোগাড় করা যায় কিনা চিন্তা করতে থাকি। বন্ধুদেশ ভারত থেকে অস্ত্র যোগাড় করার জন্য দক্ষিণাঞ্চল কমান্ডের প্রধান মেজর জলিল আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে ভারত পাঠান। অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করা ছাড়াও অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ করাও প্রয়োজন ছিলো। আমরা চিন্তা করে দেখলাম পাকিস্তানীদের সাথে এ অবস্থাতে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। তবুও সামরিক দিক দিয়ে বরিশালের গুরুত্ব ছিলো। আমরা বরিশালকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেই। সেজন্য ঢাকা থেকে বরিশাল আসার পথে ২টি সড়কসেতু ধ্বংস করে দেই। ঢাকা থেকে বরিশালের সরাসরি রাস্তাযোগে কোনো যোগাযোগ না থাকলে শত্রুরা আসতে পারবে না। এই সড়কসেতু ২টি উড়িয়ে দেয়াতে শত্রুদের বরিশাল যাবার পথে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ফেরীগুলি নষ্ট করে দেয়া হয়। পাকসেনারা যাতে বিমানে করে নামতে না পারে তার জন্য রহমতপুর এয়ার বেইসে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। শত্রুরা যাতে নদীপথে আসতে না পারে তার জন্য বরিশাল থেকে ৫/৭ মাইল দূর পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় বাঙ্কার খুঁড়ে নদীপথের উভয় দিকে শত্রুদের অগ্রগতিকে বাঁধা দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি অবস্থান গড়ে তুলি।
অন্যদিকে খুলনা হয়ে শত্রুরা যাতে বরিশাল ঢুকতে না পারে তার জন্যও ঝালকাঠিতে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য আমি সেখানে যাই। খুলনা থেকে বরিশালে নদীপথে আসতে হলে গাবখান চ্যানেল হয়ে আসতে হবে। তাই গাবখানের উভয় পাশে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করি মধ্যে একটি ফ্ল্যাট রেখে দেই যাতে শত্রুদের গানবোট না আসতে পারে। শত্রুরা নদীপথে পার না হতে পারলে নদীর এক পাড়ে নামবে। তখন আমরা আক্রমণ চালাবো। এটা ছিলো পরিকল্পনা।
এরপর যাই পিরোজপুরে। পিরোজপুরে লেঃ জিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়। মেজর জলিল তাকে পিরোজপুরের ভার দিয়ে আমাকে নিয়ে বাগেরহাটে যান। বাগেরহাটের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলি এবং পরিকল্পনা নেই খুলনা বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয়ার জন্য। পরিকল্পনা মোতাবেক ৩/৪ এপ্রিল রাতে বেতার কেন্দ্রে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাই এবং ২৪ ঘন্টার জন্য খুলনা বেতার কেন্দ্র মুক্ত রাখতে সক্ষম হই। কিন্তু পাকসেনাদের প্রবল চাপে খুলনা বেতার কেন্দ্র বেশীক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। খুলনা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধে আমাদের তিনজন শহীদ হন। পাকসেনাদের ৩৫ জনের হতাহত হতাহত হয়। আমরা বাগেরহাটে ফিরে আসলাম।
বাগেরহাটে এসে প্রথমে খুলনার এমসিএ জনাব রহমান, ছাত্রনেতা টুকু এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। যোগাযোগ করে আমরা রূপসা নদী পার হয়ে রাতের আঁধারে খুলনা শহরের পিছন দিক দিয়ে গিয়ে গোল্লামারীতে অবস্থিত খুলনা বেতার কেন্দ্রের নিকটে কলাবাগানে ২টি প্লাটুনকে অবস্থান নিতে বলি। খুলনা থেকে গোল্লামারী আসার পথে একটি ব্রিজ ছিলো। সেই ব্রিজের নিচে এ্যামবুশ নেয়ার জন্য আরেকটি ছোট গ্রুপকে নিযুক্ত করি। বয়রাতে কিছু ইপিআর ছিলো। তাদের বলা হয় আমরা যখন আমরা যখন গোল্লামারী বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো তখন তারা যেন সার্কিট হাউসে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে খুলনা শহরের নিকটস্থ গ্রামের দেশপ্রেমিক যুবকদের (নকশালদের) সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারা আমাদের আক্রমণে সাহায্য করার জন্য একসাথে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো একসাথে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুলনা শহর শত্রুমুক্ত করবো।
পরিকল্পনামতো ৩/৪ এপ্রিল রাত ৯টার সময় গোল্লামারীতে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। গোল্লামারীতে অবস্থিত পাকসেনাদের সাহায্য করার জন্য সার্কিট হাউস থেকে আরো সৈন্য ১টা জীপ ও ২টা ডজে করে গোল্লামারীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আগে থেকেই গোল্লামারী-খুলনার মধ্যে অবস্থানরত এ্যামবুশ পার্টি পাকসেনাদের গাড়ীর উপর গ্রেনেড, হাতবোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। জীপ এবং ডজ দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকসেনারা টিকতে না পেরে ব্রিজ এবং বেতার কেন্দ্র ছেড়ে শহরে পালিয়ে যায়।
বয়রাতে অবস্থানরত ইপিআর’রা শত্রুদের উপর কোনো কারণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি, সেজন্য আমরা খুলনা শহর দখল করতে পারিনি। বেতার কেন্দ্র চালু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এই আক্রমণে শত্রুদের ৭৯ জন হতাহত হয়। এদের মাঝে একজন মেজর ছিলেন। আমাদের পক্ষে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হাবিব নামে জনৈক তরুন ছাত্র ছিলো। সে তার পিতার রিভলবার চুরি করে এনে এই আক্রমণে অংশগ্রহন করে। তার বয়স কম দেখে আমি তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধের পর তাকে মৃত অবস্থায় দেখি। শহীদদের মধ্যে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ইএমই’র সৈনিকও ছিলেন।
পরদিন শত্রুরা খুলনা শহর থেকে মর্টারের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং ৩০” এমএমজি থেকে আমাদের উপর মুষলধারে গুলি চালাতে থাকে। আমরা চিন্তা করে দেখলাম শত্রুদের বিরাট শক্তির সাথে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। সেজন্য কৌশলগত কারণে ৫ই এপ্রিল রাতে শত্রুসৈন্যর প্রচণ্ড চাপের মুখে টিকতে না পেরে ফিরে বাগেরহাট চলে আসি। আমাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিলো জনগণকে আমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে জ্ঞাত করা এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত করা। সেটা আমরা করতে পেরেছিলাম।
বাগেরহাটের তৎকালীন এসডিও পরিস্থিতির জন্য ভীত ছিলেন। তিনি আমাদের ঠিকমতো সাহায্য করতে পারছিলেন না। বাগেরহাট শহরে অবস্থান নিয়ে থাকা ঠিক হবে না, কেননা শত্রুরা আমাদের অবস্থানের কথা জেনে ফেলেছিলো। তাই বাগেরহাটের ছেলেরা বলে খান জাহান আলী সাহেবের দরগার পাশে অবস্থান নিলে ভাল হবে। তাদের একটা বিশ্বাস ছিলো দরগার কাছাকাছি অবস্থান নিলে শত্রুরা আক্রমণ করতে পারবে না। সেজন্য আমি বাগেরহাটের দরগার পাশে অবস্থান নেই। বাগেরহাটের এমসিএ আবদুর রহমান অনেক সময় আমাদের কোনো নির্দেশ না নিয়ে অনেক কাজ করে ফেলতেন। আমি খবর পাই খুলনার এমসিএ শেখ আবদুল আজিজ সাহেব বাগেরহাটে এসেছেন। তার সাথে অনেক কষ্টে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন।
একদিন খবর পাই একটা জাহাজে কিছু হাতিয়ার আছে যার কথা পাকসেনারাও জানেনা এবং জাহাজটা পরিত্যক্ত হয়ে হয়ে পড়ে আছে। এ খবর আমাকে দেন মংলা পোর্টের একজন কাষ্টম অফিসার। সেই হাতিয়ার যোগাড় করার জন্য আমি দুটি স্পীডবোট নিয়ে সুন্দরবন হয়ে ঘুরে মংলা পোর্টে যাই। পোর্টে গিয়ে একটা স্পীডবোট পরিত্যক্ত জাহাজটির কাছে যায়। আমি অন্য স্পীডবোটটি থেকে শত্রুদের উপর নজর রাখি। আগের স্পীডবোটটি যখন কয়েক বাক্স অস্ত্র নামিয়েছে তখন হঠাৎ করে গানবোট থেকে পাকসেনারা গোলা ছুঁড়তে থাকে। আমরা কোনোরকমে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে আসি। পরে বাক্স খুলে দেখি সেগুলো বন্দুকের গুলি। বাগেরহাট থেকে আসার পথে দেখতে পাই চার নৌকা বোঝাই চাল চুরি হয়ে গেছে। আমরা তার অধিকাংশই উদ্ধার করে বাগেরহাটে নিয়ে আসি। গুলি নিয়ে স্পীডবোটে করে পালিয়ে আসার সময় বৈঠাঘাটা থানাতে আশ্রয় নেই। এখানে শুনতে পাই, পাকসেনারা গানবোটের সাহায্যে নদীপথ পাহারা দিচ্ছে। আমি এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে বাগেরহাটে ফিরে আসি। একদিন রাতে দালাল রজব আলী ও তার সঙ্গীরা আমাদের বাগেরহাট দরগা অবস্থানে রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়। আমরা হামলা প্রতিহত করি। রজব আলী ও তার দলবল রাতের অন্ধকারে প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন উপায়ে বাঁধার সৃষ্টি করতো।
নানারকম অসুবিধা, অচলাবস্থা ও সাময়িক হতাশার জন্য বাগেরহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক হতাশার সৃষ্টি হয়। আমি তাদের মধ্যে থেকে হতাশার ভাব দূর করে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করে তুলি। তারপর মেজর জলিল আমাকে পিরোজপুর ও বাগেরহাটের ভার দেয় এবং আমাকে বরিশালের প্তিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সেখানে যেতে নির্দেশ দেয়। তারপর আমি বরিশালে এসে আগেকার তৈরী বাঙ্কার এবং অন্যান্য স্থানে অবস্থান নেই। এছাড়া বরিশাল শহর ও অন্যান্য এলাকায় যাতে শত্রুরা প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করতে থাকি। বরিশাল থেকে বেশ কিছু দূরে জুনাহারে কীর্তনখোলা নদীর দুই পারে বাঙ্কার খুঁড়ে শত্রুর অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে থাকি। ঢাকা এবং ভোলা থেকে রাত্রে যাতে পাকসেনারা আসতে না পারে তার জন্য জুনাহারে অবস্থান নেই। পূর্বেই বলেছি বরিশাল হলো নদীপ্রধান। স্থলপথে পাকসেনাদের বরিশাল আসা অসম্ভব ছিলো। যেদিক দিয়েই পাকসেনারা বরিশাল আসুক না কেনো তাদের নদীপথ হয়েই আসতে হবে। পটুয়াখালী তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিলো। সেদিক দিয়ে পাকসেনাদের আসার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। আর খুলনা হয়ে এতদূর ঘুরে পাকসেনারা আসবে সেটাও সম্ভব নয়। তবুও বরিশাল থেকে কিছু দূরে আমরা বাঙ্কার খুঁড়েছিলাম পাছে খুলনার দিক থেকে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করা হয় ভেবে। তবে অস্ত্রের অভাবে সেখানে কোনো অবস্থান নেওয়া হয়নি। জুনাহারে কীর্তনখোলা নদীর দুই পারে অবস্থান নেওয়ার পর শত্রুরা যাতে অতি সহজে নদীপথে বড় স্টীমারে না আসতে পারে তার জন্য ৯০ জনকে ৯০টি রাইফেল দেই। এর মধ্যে ৫০টি ৩০৩রাইফেল ছিলো। বাকি ৪০টি ছিলো মান্ধাতা আমলের। মেজর জলিল ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে অস্ত্রের জন্য ভারত থেকে ৫০টি এসএমজি, ২০০টি ৩০৩(থ্রি নট থ্রি) রাইফেল, ১৫টি এসএলআর, ৩০০টি ৩৬-হ্যাণ্ড গ্রেনেড ও কিছু এনারগা গ্রেনেড ও লাঞ্চার নিয়ে আসেন। তবে এসব অস্ত্রের কোনো শক্তি ছিলো না পাকসেনাদের গানবোট ধ্বংস করার। এসব অস্ত্র নূরুল ইসলাম মঞ্জুর মেজর জলিলের হাতে তুলে দেন। মেজর জলিল এসব অস্ত্রের মধ্যে আমাকে ২টা এসএলআর, ৪টা এনারগা গ্রেনেড ও ৩০টি মান্ধাতা আমলের রাইফেলের পরিবর্তে ৩০টি ৩০৩ রাইফেল দেন। ইতিপূর্বেই পাক বিমান বাহিনী বরিশাল শহরে এসে ২টা স্যাবর জেটের সাহায্যে স্ট্র্যাফিং করে। বিমান বাহিনীর বুলেট বৃষ্টির ফলে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৩০/৪০ জন নিরীহ লোক মারা যায়।
এ বিমান আক্রমণের ফলে জনসাধারণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং প্রাণভয়ে অধিকাংশ লোকই শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। বরিশাল একরকম জনশূন্য হয়ে পড়ে। বিমান হামলায় বেলস পার্কে অল্পের জন্য মেজর জলিল রক্ষা পান।
বিমান হামলার পর প্রয়োজনীয় মজুত রিজার্ভ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী ও অন্যান্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। বরিশাল শহরের উপর আক্রমণ অত্যাসন্ন ভেবে আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। পেট্রোল যোগাড় করার জন্য ২৪শে এপ্রিল সন্ধ্যায় স্পীডবোটে করে ভোলায় যাই। বহুকষ্টে সামান্য পেট্রোল সংগ্রহ করে পরদিন সকালে ফিরে আসি।
আমি যখন কন্ট্রোল রুমে বসে আছি তখন হঠাৎ বরিশালের ২০ মাইল দূরে নান্দিনাবাজারে অবস্থানরত আমাদের পার্টি খবর জানায় ৪টি গানবোট ও আরো দুটি বোটে করে পাকসেনারা বরিশালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা বরিশাল আক্রমণ করতে পারে। আমি তৎক্ষণাৎ জুনাহারে আমাদের অবস্থানের দিকে চলে যাই। জুনাহারে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি পাকসেনারা আমাদের উপর হামলা শুরু করে দিয়েছে। আমি জুনাহারের তালতলী নদীর পারে আমাদের অবস্থানে গিয়ে দেখি সেখানে অবস্থানরত সেনারা ভয় পেয়ে গেছে। আমি তাদের সাহস দিয়ে সংগঠিত করি। শত্রুসেনারা বাঁধা পেয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নদীর উপর ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখা ২টি স্টীমারের উপর হামলা চালায়। ১টি স্টীমার গোলা মেরে পুড়িয়ে এবং অন্যটি ডুবিয়ে দিয়ে তারা তালতলী নদীর ভিতরে ঢুকে পড়ে।
আমাদের হাতে ভারী অস্ত্র না থাকার ফলে আমরা গানবোটগুলো ধ্বংস করে দিতে পারিনি। আমি দ্রুত ১টি নৌকায় করে তালতলী নদী পার হবার চেষ্টা করি। এ সময় শত্রুসেনারা আমার নৌকার উপর হামলা চালায়। এতে নৌকার মাঝি আহত হয়। আমি দ্রুত নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং নদী পার হতে সক্ষম হই।
শত্রুসেনারা সে সময় আমার উপর মেশিনগানের গুলি চালাতে থাকে। আমি চরে ধানক্ষেতে প্রায় এক ঘন্টা পড়ে থাকি। তারপর আস্তে আস্তে ক্রলিং করে মূল অবস্থানে ফিরে আসি।
শত্রুদের গানবোট ধ্বংস করার জন্য আমার বাহিনীর ইপিআর-এর হাবিলদার আবদুল মান্নান অতি সাহসিকতার সাথে খুব নিকট থেকে একটি গানবোটের উপর হামলা চালায়। এতে গানবোটের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ১২টা পর্যন্ত মুষলধারে উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। ইতিমধ্যে হেলিকপ্টারে আরও ১০০ জনের মতো খানসেনা তালতলী পাড়ে নামানো হয়। সন্ধ্যার দিকে আমরা অবস্থান তুলে নেই। পাকসেনারা আশেপাশের গ্রামগুলির উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পরদিন ২৬শে এপ্রিল পাকসেনারা বরিশাল শহরে প্রবেশ করে এবং যুদ্ধের সময় যথেষ্ট গোলাগুলির ফলে পাকসেনারা বরিশাল শহরে ক্ষতি করতে পারেনি। ইতিমধ্যে সংঘর্ষের সময় বরিশাল শহরের লোকেরা নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যায়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ২৫ জন মারা যায়। আমাদের কেউ মারা যায়নি।
——————————————–